এক বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যা ২ পর্ব-১৪+১৫

0
1019

#এক_বৃষ্টিস্নাত_সন্ধ্যা(সিজন ২)
১৪.
#WriterঃMousumi_Akter

প্রচন্ড ঠান্ডায় থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে বিছানা ছেড়ে উঠলাম আমি।নরমালি এত সকালে ঘুম থেকে উঠি না আমি।সকাল আটটার আগে সেভাবে ঘুম থেকে ওঠাই হয় না।শিতের সকালে আলসেমির জন্য নামাজ ও মিস হয়ে যায় প্রায় দিন,এটা নিয়ে আম্মুর কম বকা ও খেতে হয় না।আমার আম্মু তার জীবনে অনেক ইবাদত করেছে এখনো করে যাচ্ছে।আম্মুর কথা যায় হোক নামাজ ছাড়া যাবে না।

মারুফা খালার হাতে বই আর খাতা।খাতা আর বই নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আমার সামনে।

“আমি সন্দিহান ভাবে খালার দিকে তাকিয়ে বললাম, এগুলো কি খালা।”

“এগুলো বিহান বাবা দিয়েছে দিয়া মা।তোমাদের বাড়ি থেকে সকালে ভোরে গিয়ে তোমার বই নিয়ে এসছে বিহান বাবা।তোমার কিছু ড্রেস ও নিয়ে এসছে।টেবিলের উপর লাল হলুদ মিক্সড একটা গাউন ও রাখা আছে।মারুফা খালা আমার দিকে তাকিয়ে মিট মিট করে হাসছেন।”

“আমি ভ্রু ইশারা করে বললাম হাসছো কেনো খালা।”

“তুমি এটা কিভাবে শাড়ি পরেছো দিয়া মা।”

“মজা নিচ্ছো খালা তুমি।আমি কি শাড়ি ভাল পরতে পারি বলো।”

“মারুফা খালা বললেন,আমার মনে হয় বিহান বাবা এটা খেয়াল করেছে তুমি শাড়ি পরতে জানোনা খুব ভাল করে।এইজন্য ই তো সকালে উঠে তোমার ড্রেস নিয়ে এসছে আর টেইলার্স এ ফোন করে বললো,আজ কিছু ড্রেস বানাতে দিবে যেনো ইমারজেন্সি ডেলিভারি দিয়ে দেয়।ইমারজেন্সি পেমেন্ট না কি তাই দিয়ে দিয়েছে।”

–মারুফা খালার কথা শুনে চোখ ইয়া বড় হয়ে গেলো আমার।উনি আমার জন্য এত কিছু ভেবেছেন বাবাহ।আবার আশে পাশের মানুষ গুলো যে আমাকে খারাপ কথা বলছিলো সেটা নিয়েও চেতে আছেন উনি।এই একটা জায়গা আদর্শ স্বামির মতো কাজ করেছেন উনি।সব কিছুই ঠিক ছিলো মাঝখানে উনার ওই প্রেমিকা থাকতে গেলো কেনো।কোন রাক্ষ সী, ডাই নি মহিলা আমার ফিউচার সতীন আল্লাহ জানে।এই প্রেমিকা ফ্রেমিকা না থাকলে একটা কথা ছিলো।দিয়ারে দিয়া তুই এত নির্লজ্জ ক্যানো রে!রাগ কেনো নিজের ভিতরে ভয়ানক ভাবে পুষে রাখতে পারিস না।বিহান কে উপর উপর স্বামি বলে মানবো না মানবো না করিস আবার বিহানের প্রেমিকা নিয়ে ভেতরে ভেতরে মারাত্মক জেলাস তুই।বিহান না তোকে কথায় কথায় শ্বশুরের মেয়ের কথা বলে।তুই কেনো আবার বিহানের সামনে গেলে সব ভুলে যাস।বিহানের প্রতি এত দূর্বল হস না ভুলেও না।বিহানের পাল্টি নিতে সময় লাগবে না একটুও।এই কেয়ার করবে, এই তোকে নিয়ে সিরিয়াস হয়ে পড়বে ভাবটা এমন করবে সব যেনো তোকেই বলছে কিন্তু আসলে সে তার প্রেমিকা কে কি বলবে তার রিহার্সাল করে যায় তোর সাথে।তাছাড়া বিহান আর পাঁচটা ছেলের মতো নয় যে হুট হাট যাকে তাকে ভালবাসবে।ওর মন কঠিন পাথরের মতো কেউ মরে গেলেও গলবে না।তুই যদি বিহান কে ভালবেসে মরেও যাস ও নিজে থেকে ভাল না বাসলে তোর মৃত্যু কেনো পৃথিবীর কোন কিছু ওর মন গলাতে পারবে না।দিয়া বি সিরিয়াস বিহান সব সময় তোকে ইউজ করে।সবার অগোচরে প্রেমিকসুলভ আচরণ করেই তোকে মনে করিয়ে দেয় এগুলো তোর জন্য না তার প্রেমিকার জন্য।বিহান কিন্তু তোকে কোনদিন তোকে বলে নি সে তোকে ভালবাসে,ডিরেক্ট ইনডিরেক্ট কোনভাবেই বলে নি।তবে তার হাবে ভাবে মাঝে মধ্য মনে হয়েছে তার সব ফিলিংস অনুভূতি তোর জন্য আর যখন ই তুই বিশ্লেষণ করে জানতে চেয়েছিস তখন ই সে তার ফিলিংস আর অনুভূতির প্রতিটি লাইন ঘুরিয়ে পেচিয়ে বলেছে এগুলো তোর জন্য নয় আমার ওয়ান লি ওয়ান শ্বশুরের মেয়ের জন্য।দিয়া ভেবে দেখ,সেই ছোট বেলা থেকে তোর বিহান ভাই নিজে হাতে তোকে তোকে A.B.C.D, অ,আ,ই,ঈ হাতে কলমে শিখিয়েছে।ছোট বেলায় তোর টিচার ছিলো বিহান।তুই যেটুকু মেধাবী সেটা বিহানের গাইড লাইনে,রাস্তায় ছেলেদের সাথে কথা বলা ছেলে বন্ধুর থেকে দূরে রাখা নিজের ভাই এর থেকে বিহান ই বেশী করেছে।এক প্রকার নিজের ফ্যামিলির মতো সেইফ রেখেছে।সেই ছোট বেলা থেকে শাষনে রেখেছে যার ভয়ে আজ ও কোনো ছেলের সাথে কথা বলতে সাহস পাস না।টিভি সিরয়াল এর হিরোদের থেকে বিহান কে বেশী কিউট আর হ্যান্ডসাম লাগে বলে ছোট বেলা থেকে বিহানের পাশে পাশে বেশী ঘুরতি আর বিহানের দিকে তাকিয়ে থাকতি।ছোট বেলায় ভাবতিস বিহান ভাই মুভি করতে পারে না কোয়েল মল্লিক এর সাথে। বিহান ছোট বেলায় কত কোলে নিয়েছে তোকে।নাক টিপেছে,গাল টেনেছে,কান ধরে উঠবস করিয়েছে।গুরুগম্ভীর ছেলেটা ছোট বেলা থেকেই মারাত্মক রাগী হওয়া সত্ত্বেও তোকে প্রশ্রয় দিয়েছে বেশী।কেউ তার খেলার জিনিস ধরলে সব ভেঙে গুড়িয়ে দিলেও তুই নিলে চোখ রাঙানি দিতো ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে দিতিস তুই আর বিহান বলতো মাফ চাই দিয়া তুই আরো নে প্লিজ তবুও চোখের পানি ফেলিস না।তোর কাঁন্না দেখলে খারাপ লাগে।সেই ছোট বেলা থেকে বিহান তোকে বিভিন্ন ভাবে বুঝিয়েছে তুই কত গুরুত্বপূর্ণ বিহানের কাছে।বিহান নিজে তোকে যা ইচ্ছা বকাবকি করে কিন্তু অন্য তোকে কিছু বললে পৃথিবী উল্টাপাল্টা রিয়্যাক্ট করে।কোনো ছেলে সংস্পর্শে আসলে বিহান মারাত্মক অগ্নিচোখে তোর দিকে তাকিয়ে কয়েক দিন করে কথা বলে নি,তুই হাতে পায়ে ধরে কথা বলেছিস।বিহান নিজের সমস্ত কাজে বুঝিয়েছে তুই অনেক দামী বিহানের কাছে, এর এই ভাবনা থেকে ছোট বেলা থেকেই বিহানের প্রতি আকৃষ্ট তুই।বিহান নিজে কায়দা করে তোকে বিহান কে ভালবাসতে বাধ্য করেছে অথচ শেষ কালে কিনা বিহান তোকে ভালোই বাসলো না।স্ট্রেইট বলে দিলো তার শ্বশুরের মেয়ে ছাড়া তার জীবনে কেউ নেই।কি প্রয়োজন কারণে অকারণে পিচ্চি ডেকে হার্ট এ আঘাত করার।এই বিহান তোকে এক প্রকার স্যাকা দিয়েছে দিয়া।সেই পিচ্চি কালে যখন বিহান কে লজ্জার মাথা খেয়ে তোর অনুভূতি কথা জানালি সে কিনা বললো তোর এখন হামাগুড়ি দেওয়া বয়স।এই বিহান কে কখনো ক্ষমা করবি না দিয়া।সেদিন যখন তোর ক্লাসমেটের ভাই মেরিণ ইঞ্জিনিয়ার কলেজে এসে তোকে দেখেই ক্রাশ খেয়ে সিদ্ধান্ত নিলো তোর বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিবে। তুই যখন বিহান কে অপমান করে বললি আপনি শুধু আমাকে অপমান করেন আপনার থেকে মেধাবী ছেলে বিয়ে করবো,বাবার কাছে রুশা আপুর বিয়ে হলেই প্রস্তাব দিবে। বাবা ও রাজি হবেন ছেলে যখন ইঞ্জিনিয়ার আরো ইতালি থাকে। তখন দেখবেন জামাই নিয়ে রেগুলার ফেসবুকে কাপল পিক পোস্ট করবো। আপনার অত্যাচার আর সহ্য করবো না।তার পর ই বিহান কায়দা করে চিঠির ধান্দা করে তোকে বেকায়দায় ফেলে কোথায় নিয়ে আসলো।কোথায় বিহানের থেকে মুক্তি চেয়েছিলি অন্যকে বিয়ে করে সেখানে ভাগ্যর পরিহাসে সেই বিহানের চার দেওয়ালে বন্দি আজ তুই।বিহান কতটা ভয়াবহ ভাব দিয়া।এই চিঠির ধান্দা নিশ্চয়ই বিহানের ই ছিল,কিছু না কিছু তো করেই ছিলো।এর কি একটায় কারণ তোকে সারাজীবন জালানোর জন্যই এত অভিনয়।বিয়ে টাও ইচ্ছা করেই করেছে।বিহান যে ছেলে সে বিয়ে না করলে কারো সাধ্য ছিলো না।সেখানে আমি বিয়েতে না করলেও বিয়ে করে নিলো।আমাকে সারাজীবন বিরক্ত করতেই কি এত আয়োজন উনার।

উনার প্রেমিকা কি জানে উনি বিবাহিত পারসন এখন।

মনে মনে কিছুক্ষণ কথা বলে,ব্রাশ করে টেবিলে রাখা গাউন পরে বেরিয়ে গেলাম।আমার কি এটা কোনো রোগ নাকি সমস্যা এটাই বুঝি না।যে কথা গুলো উনাকে বলতে পারিনা সেগুলো মনে মনে বলি সারাক্ষণ। নিজের সাথে নিজে আর কতকাল বকবক করে কাটাবো।এতগুলো কথা নিজের মনের সাথে নিজেই বকবক করলাম।কেননা এগুলো বলার সাহস উনাকে নেই আমার।

অনেক কুয়াশা পড়েছে আজ,এ বাড়িতে মামি আর মারুফা খালা ছাড়া আর কেউ ওঠে নি।এই ঠান্ডায় আরামে সবাই ঘুমোচ্ছে আর আমি কিনা এ বাড়ির নতুন বউ ঘুম থেকে উঠে প্রাইভেট পড়তে যাচ্ছি।আহা কি সুন্দর প্রতিপরমেশ্বর স্বামি আমার।এই প্রাইভেট টা উনি ই আজ ঠিক করেছেন।
বাইকের হর্ণে কান ঝালা পালা করে তুলছেন উনি।একভাবে কেউ হর্ণ দেয়।দো’তলার বেলকনি থেকে দাঁড়িয়ে দেখি রাস্তায় বাইকে বসে আছেন উনি।বাড়ির সাথেই রাস্তা তাই বাড়ি থেকে রাস্তার সব কিছুই দেখা যায়।আমি মামির থেকে বিদায় নিয়ে দ্রুত রাস্তায় গেলাম।উঠানে পড়ে থাকা শিউলি ফুল থেকে কয়েক টা ফুল তুলে নিলাম নিজের হাতে।

উনার পরণে কালো জিন্স, গায়ে এশ কালারের হুডি,পায়ে কালো সু, মাথায় হেলমেট,আবার চাঁদর ও জড়ানো আছে গায়ে।কালো বাইকের উপর শীতের সকালের সব থেকে সৌন্দর্য মনে হয় ভর করেছে।

–নিমিষেই ভাবনার জগত থেকে বেরিয়ে এলাম আমি।উনাকে নিয়ে কেনো ভাবি আমি।একদম ই আর ভাববো না আমি।

–আমার দিকে ভ্রু টান টান করে তাকিয়ে বললেন,বাইকে ওঠ।

ও বাড়ি থেকে আমার ড্রেস এনেছে শীতের কাপড় তো আনে নি।এইদিকে নিজে শীত কে প্রতিরক্ষা করতে হ্যান্ড গ্লাভস ও পরেছে।

কোনো কথা না বলে কাঁপতে কাঁপতে বাইকে উঠলাম।

উনি বললেন,”ভাল ভাবে ধরে বস দিয়া।”

বাইক স্টার্ট দিয়ে এক মিনিট পরেই বাইক থামিয়ে বললেন,মৃগে রুগির মতো কাঁপছিস কেনো?আর হাত মুষ্টিবদ্ধ রেখেছিস তাহলে ধরবি কিভাবে।হাত খোল বলছি আর আমাকে ভালভাবে ধরে বস।

এই ঠান্ডায় উনার কথা আরো বিরক্ত লাগছে আমার।কোনো উত্তর দিলাম না আমি।

“উনি নিজের গায়ের চাঁদর খুলে আমাকে দিয়ে বললেন,এটা গায়ে জড়িয়ে নে।এইভাবে শীতের কাপড় না পরে ঠান্ডা বাঁধিয়ে কে গৃহবধু নির্যাতনের মামলা দিতে চাস দিয়া।এই বুদ্ধি টা কি তোর দাদী দিয়েছে তোকে।”

“সব সময় বাবাকে,দাদাকে, কাকা দের টানেন এখন বলেন তোর মা দিয়েছে এই বুদ্ধি।নিজের ফুপ্পির কথা বলুন।”

“আমার বংশের কোনো মেয়ে এমন ধুরন্ধর না।সে বিহানের ফুপ্পি।আমাদের রক্তে কোনো সমস্যা নেই ভেজাল ও নেই।”

“কেনো আমাদের রক্তে ভেজাল আছে।”

“সিওর আছে।তোদের রক্তে অনেক ভেজাল।”

“আপনাদের রক্ত লাল আর আমাদের রক্ত কি গোলাপি”

“না রাজাকার এর রক্ত।কেরোসিন মিক্সড।”

“সারারাত বিরক্তিকর কথা বলে মন ভরে নি আপনার।দিনের বেলা বাড়িতে সুযোগ পাবেন না তাই বাড়ির বাইরে নিয়ে এসছেন তাইনা।”

“বেশী বকবক না করে হাত খোল আর ভালভাবে ধরে বস।চাইলে জড়িয়ে ধরতে পারিস।আই ডোন্ট মাইন্ড পিচ্চি।”

“আমি হাতের মুষ্টি খুলে উনার সামনে ধরলাম।হাতের মাঝে শিউলি ফুল গুলো সুবাস ছড়াচ্ছে।ফুল গুলো আস্তে করে ফেলে দিতেই উনি আমার হাতের নিচে নিজের হাত ধরে ফুল গুলো নিজের হাতে নিয়ে বললেন এবার বস।ভালভাবে জড়িয়ে ধরে বস।ছোট মানুষ কোথায় পড়ে গিয়ে দাঁত ভাঙবি।”

“পড়ে গেলেও আপনাকে ধরবো না।”

“না ধরার ফলে পড়ে গেলে কিন্তু তুলে এনে বাইকের পেছনে দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়ে যাবো মাইন্ড ইট।”

“সব ই তো বুঝলাম উনার মতো মানুষ ফুল দিয়ে কি করবেন।ভেরি আশ্চর্য ব্যাপার।”

“উনার কাধে হাত দিয়ে বসে বললাম,এত ব্যাস্ততার মাঝে প্রাইভেট ঠিক করলেন আমাকে নিয়ে যাচ্ছেন কিভাবে।”

উনি বাইকে থামিয়ে বললেন,,

No one is too much busy in this word we all have same 24 hours
Its all about priorities..

চলবে,,

#এক_বৃষ্টিস্নাত_সন্ধ্যা(সিজন ২)
১৫.
#WriterঃMousumi_Akter

–সময় টা প্রায় ডিসেম্বরের মাঝামাঝি।শহরে সম্পূর্ণ শীতের ঢল নেমেছে।গাছ পালা রাস্তা ঘাট কিছুই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না।গাছ পালা ভিজে নেয়ে উঠেছে তারা ও মনে হয় কাঁপছে শীতে। রাস্তার সাইডে কিছু মানুষ এত ভোরেই বেরিয়েছে কর্মসংস্হানের খোজে।রাস্তা মেরামত এর কাজ চলছে তারা এ রাস্তার কাজ ই করছে।রাস্তার পাশে বসে খড়কুটো জ্বালিয়ে আগুন পোহাচ্ছে তারা।কুয়াশায় মোড়ানো শহরে বিহান ভাই এর বাইকের পেছনে ছুটে চলেছি আমি।উত্তরের ঠান্ডা বাতাসে শরীর হীম করে তুলছে।উনি বাইকের হেড লাইট জ্বালিয়ে রাস্তা দেখছেন।বাইকের আয়নায় উনার মুখ দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। আমি এক নজরে তাকিয়ে আছি বাইকের আয়নার দিকে।এই মানুষটার মাঝে এত সজীবতা কেনো?কেনো এতটা নিঁখুত সুন্দরের অধিকারী হয়েছেন উনি।একটা ছেলেকে কেনো এত সুন্দর হতে হলো।উনার পোশাক, কথা বার্তা,চলাফেরা এটিটিউড সব কিছু যেনো সম্পূর্ণ অন্য রকম।ঠোঁটের চারদিক হালকা কালচে আবরণে ঢাকা আর মাঝে গোলাপি কতক্ষণ তাকিয়ে দেখে মুগ্ধ আমি।

উনি আমার দিকে ঘুরে বললেন, আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকলে পড়ে যাবি।আর এভাবে তাকিয়ে থাকলে আমার অসুবিধা হচ্ছে বাইক চালাতে।

কথাটা বেশ মিহি কন্ঠে বললেন উনি।আমি বেশ লজ্জা পেয়ে গেলাম উনার কথা শুনে,মানে উনি বুঝে গিয়েছেন উনাকেই দেখছি।সাথে সাথেই চোখ সরিয়ে নিলাম আমি।হঠাত উনি বাইক ফুল স্পিডে চালানো শুরু করলেন,আমার অবস্থা পড়ে যায় যায় অবস্থা।

“উনার শার্টের কলার টেনে ধরে বললাম,আস্তে চালান না পড়ে যাচ্ছি।”

“উনি বললেন,আমাকে ধরে না বসলে তো পড়বি আর এভাবে কলার টেনে ধরলে দুজনে পড়ে যাবো ফলে কি হবে জানিস,তুই ও বিধবা হবি আর আমিও বউ হারাবো।বলেই উনি আবার সামনে তাকালেন।”

কি অদ্ভুত আর অধ্যাতিক কথা উনার।উনি ইচ্ছা করেই বাইক এলোমেলো চালানো শুরু করলেন।উনার এই ইচ্ছাকৃত বাইক এলোমেলো চালানোর বিরুদ্ধে ও কিছু বলতে পারছি না।দ্রুত উনার কোমর জড়িয়ে ধরলাম আমি,উনাকে ধরা ছাড়া আর কোনো উপায় ও নেই।উনার পেটের কাছের হুডির কাপড় জোরে খামচে ধরলাম।বাধ্য হয়েই উনাকে আষ্টে পিষ্টে কোমর সহ জড়িয়ে ধরে বসতে হলো আমাকে।অবশেষে বাইক তার গন্তব্য পৌছালো।

“বাইক থেকে নামার পরে আমার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করএ বললেন, আমি বলে ধৈর্য ধরে বাইক চালিয়েছি।অন্য কেউ হলে পারতো না।যে ভাবে কোমর জড়িয়ে বসেছিলি, কতক্ষণ নিজেকে কন্ট্রোল রাখা যায়,ভাজ্ঞিস ভুল ভাল কিছু করি নি।”

“আমি মুখ বাকিয়ে বললাম,জোরে চালালেন কিজন্য?”

“তার নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে।এখন উদ্দেশ্য সাকসেস।”

“কি উদ্দেশ্য সাকসেস।”

“উনি মাথার মেলমেট খুলে এক হাত চুলের মধ্য চালাতে চালাতে বললেন,একটু ভাবলেই তো অনেক কিছুর উত্তর পেয়ে যাস।সব কিছুতে প্রশ্ন করিস বলেই গোলক ধাঁধায় পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছিস তুই আর কেউ তোর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে।”

মনে মনে বলছি এইভাবে হেলমেট খুলে হাত চুলের মধ্য চালিয়ে আমার দিকে ঝুঁকে এসে আমাকে একশ ভোল্টেজ এর ক্রাশ না খাওয়ালেও তো পারেন বিহান ভাই।

এরই মাঝে একজন ভদ্রলোক ঘরের দরজা খুলে বাইরে এসে বললেন,,

“বিহান এসছো, ভেতরে এসো।কাল তোমার ফোন পেয়ে অবাক হয়েছি আর অনেক খুশি ও হয়েছি।”

জায়গাটা এস এম সুলতান এর বাড়ির পাশেই। এ বাড়ি থেকে এস এম সুলতানের বাড়ি স্পষ্ট দেখা যায়।এক তলার এক ইউনিটের একটি বাসা।অতি সাধারণ এ বাড়িতে একজন বিসিএস ক্যাডার প্রফেসর থাকেন।পেশায় তিনি একজন প্রফেসর বিজ্ঞান বিভাগের যার নাম মশিউর রহমান।ম্যাথের টিচার হিসাবে মহিলা কলেজে আছেন।উনার কথা শুনেই বোঝা যাচ্ছে উনি বিহান ভাই কে খুব স্নেহ করেন।উনার সাথেই উনার ঘরের ভেতরে প্রবেশ করলাম আমি।উনার ঘরের ডায়নিং এ গিয়ে বসলাম আমরা দুজন।এ ঘরের ওয়ালে বিভিন্ন কবি সাহিত্যিক দের ছবি টাঙানো আছে।আমি রুমের প্রতিটা ওয়াল তাকিয়ে তাকিয়ে ভাল ভাবে দেখছি।
আমরা বসার পাঁচ মিনিটের মাঝেই স্যারের ওয়াইফ কফি আর বিস্কুট নিয়ে এলেন।বিহান ভাই আর স্যার দুজনে কফি খেতে খেতে কথা বলছেন।

“স্যার কাল রাতে তো বললাম ই আপনাকে সব টা।”

“হুম কাকে পড়াতে হবে বিহান।তুমি এতটা সিরিয়াস কেনো? ”

“স্যার এইযে সে,সাথে করেই নিয়ে এসছি।”

“স্যার আমার দিকে একবার তাকিয়ে বিহান ভাই কে বললেন, তোমার কি হয়।”

“শী ইজ মাই ওয়াইফ স্যার।”

“তুমি বিয়ে করেছো?”

“বিহান ভাই একটু লাজুকতার সাথে বললেন,জ্বী স্যার!বাট আমি বাসায় থাকি না তাই ওকে পড়াতে পারি না।এইজন্য আপনার কাছে নিয়ে এসছি।এখন ওর প্রচুর স্ট্যাডির প্রয়োজন।ম্যাথে বেশ খানিক টা উইক আছে।কোথায় কোথায় কোচিং করে আর কি পড়ে জানিনা।কোনো কোচিং এর পড়ানো আমার পছন্দ হচ্ছে না স্যার।”

“বিহান আমার থেকে অনেক বেশী ট্যালেন্ট তুমি।আমার জীবনে তোমার মতো স্টুডেন্ট আমি কখনো পাই নি।এখনো সব ব্যাজে তোমার কথা বলি।তারা মোটিভেট হয় তোমার কথা শুনে।আমার জীবনে তোমার মতো পড়াকু,শান্ত,আর মনোযোগী স্টুডেন্ট পাইনি।”

“স্যার সব ই আপনাদের দোয়া আর ভালবাসা।ওর নাম দিয়া স্যার।আমি চাই দিয়া আমার থেকেও ভাল কিছু করুক।দিয়ার মা বাবার অনেক স্বপ্ন তাই দিয়াকে ও লেখাপড়ায় মনোযোগী আর ভাল গাইড দেওয়ার প্রয়োজন।”

“বিহান এজন্য ই তুমি সারাজীবন আমার প্রিয় ছিলে।আজকাল কার ছেলেরা বিয়ে করে ঘরের বউ কে নিয়ে না ভেবে বাইরে নিয়ে বেশী সিরিয়াস।একমাত্র তোমাকেই দেখলাম নিজের ওয়াইফ কে নিয়ে অনেক সিরিয়াস।”

“স্যার প্লিজ আপনি আপনার সব টা দিয়ে ট্রাই করুণ।”

“ও স্টুডেন্ট কেমন?”

“আমার থেকেও ভাল।বাট গাইড লাইনের অভাব স্যার।আপনি পড়ালেই বুঝবেন স্যার।তাছাড়া ও খুব ই শান্তশিষ্ট ভদ্র মেয়ে।”

“ওয়াইফ কে অনেক ভালবাসো। ”

“বিহান ভাই এর মুখে লাজুকতা।”

“কাল থেকে বিকাল ৩ টায় পাঠিয়ে দিও।”

“না স্যার ওকে সকাল ৫ টায় পড়ান আপনি।”

“অত ভোরে এই শীতের সময়ে কিভাবে আসবে।তার থেকে বিকালেই ভাল হবে।”

“না স্যার প্লিজ রিকুয়েষ্ট আপনি ওকে ৫ টায় পড়ান।।”

“ঠিক আছে ও যদি আসতে পারে তাহলে আমার কোনো অসুবিধা নেই।”

“ঠিক আছে স্যার আজ আমরা আসি।”

দুইটা জিনিসে অবাক হলাম খুব পরিমাণে।
উনি আমাকে বেয়াদব মহিলা, অসভ্য কত কি বলেন।অথচ স্যার এর কাছে আমাকে ভাল স্টুডেন্ট এর পাশাপাশি নম্র ভদ্র বললেন।হোয়াট ইজ কাহিনী।
তারপরের কাহিনী কি?স্যার বিকালে পড়াবেন।উনি এইভাবে জোর করছেন কেনো এত ভোরে পড়ানোর জন্য।আমাকে জব্দ করতেই উনি এসব করছেন।আমাকে বিরক্ত করা অশান্তি তে রাখা টায় উনার একমাত্র উদ্দেশ্য সেটা বুঝতে আর বাকি নেই আমার মানুষ মানুষের পিছে যে কিভাবে লাগতে পারে তা উনাকে না দেখলে বোঝার উপায় নেই।

এই কাকডাকা ভোরে আবার ফিরে এলাম বাড়িতে।এ বাড়ির কেউ এখনো ঘুম থেকে ওঠে নি।মামি কিচেনে রান্নায় আয়োজন করছে পাশে মারুফা খালা ও সাহায্য করছে।বিহান ভাই উপর থেকে জোরে বললেন আম্মু একটা ব্ল্যাক কফি পাঠাও আমার জন্য।
এই একজন ব্ল্যাক কফি ছাড়া জীবনে আর কিছুই চিনলো না।মামি কফির জন্য পানি গরম করতে দিয়ে আমার হাতে নুডুলস দিয়ে বললো খেয়ে নে মা।খেয়ে আবার কম্বলের৷ নিচে যা।আজ সূর্য উঠবে কিনা তার ঠিক নেই।আবার ঘুমিয়ে পড় গিয়ে, রান্না শেষ হলে আমি ডাকবো।নুডুলস খেতে খেতে বললাম মামি পানি গরম হয়ে গিয়েছে তোমার ছেলের কফি পাঠাও না হলে কাফ ই ভেঙে দিবে।মামি স্বভাব সুলভ হাসি দিয়ে বললেন এই দায়িত্ব আমি তোকে দিলাম।আমার রাগি ছেলেটার রাগ কমিয়ে শান্ত করার দায়িত্ব তোর।আর আমি জানি এটা তুই পারবি।নুডুলস এর প্লেট রেখে বললাম মামি আগুনে ঝাপ দিয়ে পুড়ে মরতে বলছো আমাকে।তোমার ছেলে এই ভাল এই খারাপ কি নিয়ে রেগে যায় সেটাও কেউ বোঝে না।দয়া করে আমাকে ওই দায়িত্ব দিও না।

মারুফা খালা কফি নিয়ে গিয়েছে আধাঘন্টা হয়েছে।মামি বলছেন দেখ দিয়া মারুফার কান্ড।সেই গিয়েছে এখনো এলো না।ফ্রিজ থেকে মাছ,মাংস বের করতে হবে কিন্তু মারুফার খোজ নেই।তুই বস আমি তোর মামাকে চা টা দিয়ে আসি।মামি মামাকে চা দিতে গেলে তখন মারুফা খালা আসেন।

–আমি বললাম খালা কোথায় ছিলে এত সময়।মামি বকবে খুব।

–বিহান বাবা সুচ চাইছিলো,সেটা বিভাদের বাসা থেকে আনতেই তো দেরি হলো।

-সুচ সুতো দিয়ে কি করবেন উনি খালা।

-সেটা তো জানিনা তবে
দিয়া মা বিহান বাবা ডাকে।এক্ষুণি যেতে বলেছে।

-আমি রান্নাঘর থেকে বিহান ভাই এর রুনে গিয়ে বললাম আমাকে ডাকছেন আপনি?

-হ্যাঁ

-আবার কি প্রাইভেট এ যাওয়া লাগবে।

-উনি প্যান্টের পকেট থেকে হাত বের করে আমার দিকে ঝুঁকে এসে বললেন,
“যেতে ইচ্ছে করছে বুঝি।”

-“আমি চোখে তাকিয়ে বললাম,দেখুন ক্লিয়ার বলে দিচ্ছি,শীত কালে আমি একদিন ও অত সকালে উঠতে পারবো না।না মানে না।”

-কেনো?”

-কারণ আমি সদ্যবিবাহিতা বউ,কোন বউ অত ভোরে পড়তে যায়।”

-তাহলে কি করে?মিস দিয়া অরুফে মিসেস বিহান?

-তা জানিনা তবে স্বামি নিয়ে এক ঘরে ঘুমিয়ে থাকে।”

-আর।

-আর আবার কি?

-শুধু সুয়েই থাকে আর কিছুই না।

-আমি কিভাবে বলবো।

-ওকে ফাইন আমরাও কাল থেকে সুয়ে থাকবো।

-পাগল নাকি আপনার সাথে কে সুয়ে থাকবে।

-শর্ত দুইটা হয় সুয়ে থাকতে হবে না হয় প্রাইভেট চয়েজ তোর অপশন দিয়ে দিলাম।

-ইম্পসিবল!

-পসিবল না হলে আর কি করার ভোর চার টায় উঠে হাঁটতে হাঁটতে এস এম সুলতানের বাড়ির পাশে হেঁটে যাবি।স্যার এর বাসায় পৌছাতে যেনো এক মিনিট ও লেট না হয়।

-আপনি কি পাগল নাকি অত ভোরে আমি কিভাবে যাবো।তখন তো প্রায় রাত থাকে।

-তার জন্য ই তো অপশন দিয়েছি বেয়াদপ বিবাহিত মহিলা।

-স্যার যেখানে বিকালে পড়াবেন,সেখানে আপনার এত আপত্তি কিসের আমি বুঝলাম নাহ।কি সমস্যা কি আপনার বিহান ভাই।

-যতদিন ভাই ডাকবি ততদিন কিছুই বুঝবি না।

-তাহলে কি অন্য কিছু বলে ডাকবো?

-ঘন ঘন ভাই ডেকে আহত না করে আঙ্কেল ডেকে নিহত করাটাই বেটার বলে মনে হয়।লিসেন দিয়া, ভাই,আঙ্কেল টাইপ যে কোনো সম্মোধন,নানা-দাদা টাইপ বাদে অন্য যা কিছু বলে ডাকতে পারিস।

-আমি ড্যাব ড্যাব করে উনার দিকে তাকিয়ে আছি।

-উনি ভ্রু নাচিয়ে বললেন সব মাথার উপর দিয়ে গেলো তো।
চোখ অফ কর ষ্টুপিড মহিলা একটা।

-কেনো?

-তোকে চাঁদে নিয়ে যাবো তাই?অফ কর আগে।

-চোখ অফ করে উনার সামনে দাঁড়ালাম আমি।

-কিছুক্ষনের মধ্যই গলায় উনার হাতের স্পর্শ পেয়ে চমকে গেলাম আমি।মনে হচ্ছে কোনো গহনা পরাচ্ছেন আমাকে।

-উনি আমার গলায়,কানে,হাতে, শিউলি ফুলের মালা পরিয়ে দিয়েছেন।মাথায় দিয়েছেন শিউলি ফুলের টায়রা। কপালে দিয়েছেন ফুলের টিকলি।পায়ে দিয়েছেন ফুলের নূপুর পরিয়ে।

আয়নায় নিজেকে দেখে মুগ্ধ আমি।শিউলি ফুল বরাবর ই প্রিয় আমার।ভীষণ প্রিয় এই ফুল আমার কাছে।নিজেকে দেখে সত্যি মুগ্ধ আমি।ছোট বেলায় বলেছিলাম বিহান ভাই এই ফুল আমার ভীষণ প্রিয়।আমার প্রিয় বলেই বিহান ভাই এ বাড়িতে ফুল গাছ টা লাগিয়েছিলেন।বলেছিলেন ফুল কুড়াতে আসবি সেই বাহানায় হলেও রোজ সকালে তোকে দেখার সুযোগ পাবো আর একটু রাগিয়ে দিতে পারবো।

উনি আমায় পেছনে থুতনি তে হাত ঠেকিয়ে মিষ্টি হেসে দাঁড়িয়ে বলছেন,শিউলি ফুল কেউ একজনের ভীষণ প্রিয়।সেদিন থেকে আমার আঙিনায় শিউলি ফুলের বসবাস অনবরত চলছে।বেলা অবেলায় শিউলি ফুলের প্রেমে পড়েছি আর তাকে ভেবেছি।ইস তাকে শিউলি কন্যাতে এতটা নেশাক্ত না লাগলেও তো পারতো।এখন তার শ্বশুরের ছেলে তার প্রেমে পড়লে এই দোষ টা কি শ্বশুরের মেয়ে নিবে।

চলবে,,