এক বেরঙ চিলেকোঠায় পর্ব-০৬

0
606

#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনিতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-৬

মুখার্জী বাড়ির সদর দরজার সামনে অরুনাভ মুখার্জীর সামনে মেকি হাসি নিয়ে দাড়িয়ে আরাব। হাতে থাকা ফোনটার দিকে অসহায়ভাবে তাকালো একবার। অরুনাভ মুখার্জী ওকে বলেছেন,বাসায় ফোন করে এই‌ ঠিকানায় গাড়ি পাঠিয়ে দিতে। ওকে গাড়িতে তুলে না দেওয়া অবদি নাকি শান্তি নেই তার। গাড়ি পাঠাতে বলাটা ব্যাপার না আরাবের জন্য। কিন্তু পুরো একদিন পর মা,বাবা যে কাউকে ফোন করলেই তারা অস্থির হয়ে পরবে। গাড়ি পাঠাতে বললে,তারাই না চলে আসে!তাছাড়া,বাসায় ফোন করলে প্রতিবার জারা নামক ঝামেলার কথা মনে পরতেই মেজাজ টগবগিয়ে ওঠে ওর।অরুনাভ মুখার্জী গলা ঝেড়ে বললেন,

-কোনো সমস্যা আরাব?

-জ্..জ্বী মানে,হ্ মানে,মানে না!

হ্যাঁ বলতে গিয়েও না বেরোলো আরাবের মুখ দিয়ে।দোয়া বারান্দায় দাড়িয়েছে। দেওয়ালের এপার থেকে দেখা যাচ্ছে ওকে।আরাবের চট করেই বোনজামাইয়ের কথা মনে পরে গেলো।ফোন লাগালো ড.মুফতাহিরের নাম্বারে। ফোনটা রিসিভ হলে বললো,

-হ্যালো?ভাইয়া?আমি আ্….

-আরাব!তুমি কি মানুষ?সবাই মিলে পাগল হয়ে যাচ্ছি তোমার চিন্তায়!আর তুমি?পুরো আঠারো ঘন্টা পর তোমার মনে পরলো আমাদের কথা?মা তো….

চোখ বন্ধ করে কথাগুলো হজমের চেষ্টা করলো আরাব। দোয়া ওর চেহারা দেখেই বুঝলো,কেউ ফোনের ওপার থেকে ঝারছে ওকে।নিজেকে শক্ত করে নিলো ও। আরাব চলে যাবে এখনি। ওর বিষয়ে আর একবিন্দুও মাথা ঘামাবে না ও। জোরে শ্বাস ফেলে বেরিয়ে আসলো বাসা থেকে। সদর দরজার সামনে দিয়ে আরাবকে পাস করে চলে যাচ্ছিলো,অরুনাভ মুখার্জী ডাক লাগিয়ে বললেন,

-দোয়া? যাসনি তুই এখনো? আজকে দেরি কেনো হলো?

দোয়া থামলো। বোনজামাইয়ের কথা শুনতে শুনতে দোয়ার আগমনকেই লক্ষ্য করছিলো আরাব। এবার ওর শুনানোর পালা।দোয়া কিছু বলে ওঠার আগেই উচু আওয়াজে বলতে লাগলো,

-ওওও!তারমানে রায়নগরের মুখার্জী বাড়ি থেকে বাসা খুব একটা দুরে না তাইতো?

কপালে ভাজ ফেলে আরাবের দিকে তাকিয়ে রইলো দোয়া। বাসা দুরে না মানে? ঢাকার কোথায় থাকে আরাব?এ মহল্লা তো শহরের একপ্রান্তেই বলা চলে। যেখানে খুশি বাসা হোক আরাবের। তাতে ওর কিছুই না। নিজের প্রতি করা সে মনোভাবকে অটুট রেখে অরুনাভ মুখার্জীকে লক্ষ্য করে বললো,

-আগের টিউশনিটায় ছুটি আজ কাকাবাবু।বাকিদুটো আছে।তাই দেরিতেই বেরিয়েছি।

-ও।আরাবকে….

-বেশ অনেকটাই দেরি হয়ে গেছে কাকাবাবু।আসছি।

চলে গেলো দোয়া। আরাবদৃষ্টি স্থির করে রইলো ওর চলে যাওয়ার দিকে। দোয়া চোখের আড়াল হতেই আরাব ফোনে শান্ত গলায় বললো,

-রায়নগর মুখার্জী বাড়িতে গাড়ি পাঠাও ভাইয়া।বাসায় ফিরবো।

কল কেটে দিলো আরাব।ভেতরটা কেমন যেনো ফাকা ফাকা লাগছে ওর।দোয়ার বাই,খোদাহাফেজ এমন কোনো কথা‌ আশা করেনি ও।তবুও মনে হলো,ওর মুখে ওর জন্য এরকম কোনো কথা শুনতে পারলে বড্ড শান্তি লাগতো ওর।পরপরই আনমনে হাসলো।এভাবে কোনোদিন তাহসানুল আরাব শান্তিকামনা করেনি!আজই প্রথমবার!দোয়ার জন্য! অরুনাভ মুখার্জীর হাতে ফোন ধরিয়ে দিয়ে বললো,

-কাকাবাবু,আপনাদের কষ্ট দেওয়ার জন্য আবারো দুঃখিত।

-এসব কি বলছো আরাব?তুমি আমার আতিথীয়তা গ্রহন করেছো,এই শ্যাওলাপড়া দেওয়ালের মাঝে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছো,এটা আমার জন্য অনেক বড় পাওয়া ছিলো।আশীর্বাদ করি,জীবনে অনেক ভালো কিছু করো।আর হ্যাঁ,এরপর থেকে বাইক সাবধানে চালাবে।আর তোমার কাগজপত্রগুলো কারা নিয়ে গেছে,তাদের খুজে বের করার কথাও ভুলো না।লোকগুলো খুব মেরেছিলো সেদিন তোমাকে।দোয়া না বললে তো…

থেমে গেলেন অরুনাভ মুখার্জী।কথা শেষ করার অনুমতি দোয়া তাকে দেয়নি।এটা জানে আরাব।এটাও বুঝে গেছে,ওর জীবনে দোয়া,দোয়া হয়েই এসেছে।তাইতো সেদিন জীবন বেচে গিয়েছিলো ওর।তাইতো আজ এতোগুলো মিষ্টি অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছে ও।বাকি রইলো কাগজপত্র আর ওর উপর এটাকারের কথা,সেটা ও একদমই ভোলেনি।ঠিক বের করবে এসবের হোতা কে!আপাতত ওর ভাবনাজুড়ে অন্যকিছুরই বিচরন।

মুচকি পেছন ফিরে পকেটে হাত গুজে বাড়িটার দিকে তাকালো।এই চিলেকোঠায় আসার পর থেকে হাজারটা অভুতপুর্ব,কতো সুন্দর অনুভুতি ঘিরে ধরেছে ওকে।কথায় বলে,দুরুত্ব নাকি অনুভবকে জোরালো করে।তাই বাস্তবে পরখ করে নেবে আরাব।সে অনুভুতিগুলোকে নিয়ে বেরিয়ে তো যাচ্ছে,পরিনতি খুজবে বলে।কিন্তু কি তার পরিনতি?ক্ষনিকের ভালোলাগা?যা দুরুত্বের সাথে লোপ পাবে?নাকি ভালোবাসা?যা চিরতরে রাঙাতে চলেছে ওকে!

গাড়ি ছুটে চলেছে স্বাভাবিক গতিতে।জানালা দিয়ে আরাব বাইরে তাকিয়ে রয়েছে।যেগুলোকে পিছনে ফেলে সামনে এগুচ্ছে ও,সেগুলোকে না ভুলে আরো মস্তিষ্কে বসিয়ে নিচ্ছে যেনো।ঠোটের কোনে মুচকি হাসি।যতোটা দুরে সরে যাচ্ছে,এই চিলেকোঠায় ফিরে আসার আকাঙ্ক্ষাটা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে।চোখ বন্ধ করলে সেই মায়াময় চেহারাটাই দৃশ্যমান হচ্ছে।আর চোখ খুললে চারপাশ ফিকে হয়ে যাচ্ছে।বেশ অনেকটা সময় পর নিরবতা ভেঙে মুফতাহির বললো,

-এভাবে চুপ করে আছো কেনো শালাবাবু?

-কাউকে নিয়ে ভাবতে ভালোলাগছে ভাইয়া।

মুফতাহির ভ্রুকুচকে তাকালো।শ্যালকের মুখে এমন কথা শোনা আর অমাবশ্যার চাঁদের দর্শন পাওয়া তার কাছে একই কথা।আরাব বরাবরই ভ্রমনপ্রেমী।ওর জীবনে ভালোলাগা বলতে ল্যাবের এক্সপেরিমেন্ট আর ঘোরাঘুরি।ল্যাবের কাজে ফাকফোকর পেলেই ঘুরতে বেরিয়ে যায়।আগেরদিনও সে ওকে বলেই বেরিয়েছিলো,শীতের শুরুটা সাজেক থেকেই করে আসবে।তাই অতোটা ব্যস্ত হয়নি কেউই।ওর ফোন পেয়ে,রায়নগরের মুখার্জী বাড়ির কথা শুনে সে নিজেই কিছুটা অবাক হয়েছিলো।তাই চেম্বার রেখে গাড়ি নিয়ে চলে আসে ওকে নিতে।আরাবের হাতেপায়ে কাটাছেড়া দেখে জিজ্ঞাসা করাতে এক্সিডেন্টের কথা বললো ও।অরুনাভ মুখার্জীকে ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে পরে দুজনে।সবটা স্বাভাবিকই ছিলো।কিন্তু আরাবের এই কাউকে নিয়ে ভাবার বিষয়টা ওর কৌতুহল না বাড়িয়ে পারলো না।মুফতাহির গাড়িতে ব্রেক কষে বললো,

-আরাব?আমি কি ঠিক শুনলাম?

-একদম সঠিক কম্পাঙ্কে ঠিক শুনেছো!গাড়িটা স্টার্ট দাও।স্থির দশা চিন্তাশক্তিতে আঘাত হানছে।

হেসে দিলো মুফতাহির।আরাব এমনই।যখন নিজের দুনিয়ায় ডুবে থাকে,ওর কথাবার্তাও ওর বৈজ্ঞানিক সাহিত্যের রুপ নেয়।গাড়িটা স্টার্ট দিয়ে বললো,

-তা কাকে নিয়ে ভাবছো তুমি?

-যে আমাকে তাকে নিয়ে ভাবার অধিকার দেয়নি,তাকে নিয়ে।

আবারো হেসে দিলো মুফতাহির।আরাবের হেরফের নেই।ও‌ নিজের মতোই ওর ভাবনায় ডুবে আছে। প্রতিবার দমকা হাওয়া খুজে পাচ্ছে দোয়ার সেই ঢেউখেলানো চুলের চঞ্চলতা।হাতের দিকে তাকালে প্রতিটা মুহুর্তে মনে পরছে,নিজহাতে ওই চুল খুলে দিয়েছিলো ও।নিজের দিকে তাকালে টিশার্ট পরানোর সময় দোয়ার ইতস্তত ভাবের চেহারাটা মনে পরছে ওর।ঝাকিতে কিছুটা ব্যথার আবেশে চোখ বন্ধ করলেই মনে পরছে,সে ক্ষতগুলোতে দোয়ার স্পর্শ আছে।মুফতাহির ড্রাইভিংয়ে মনোযোগ রেখে বললো,

-তো আরাব?যে তোমাকে ভাবার অধিকার,ইনফ্যাক্ট সবকিছুর অধিকারই‌ দিতে চায়,তাকে নিয়ে কি ভাবলে?

আরাবের মেজাজের ঘন্টা বেজে গেলো।চরম বিরক্তি নিয়ে তাকালো মুফতাহিরের দিকে।বললো,

-এখনই এইসব বলতে হবে?

-তো কি করবো?তোমার বোনের এই জুনিয়র,তোমার প্রেমে ঠিক কিভাবে হাবুডুবু খাচ্ছে,তার রচনা শুনতে শুনতে আমার সাংসারিক জীবনের অর্ধায়ু শেষ শালাবাবু!জারা তো কাল বিকেলে আমার চেম্বারে অবদি চলে এসেছিলো,তুমি কোথায় গেছো জানতে।কোনোমতে জানলে এতোক্ষনে জারাও‌ সাজেক পৌছে যেতো।

আরাব চুপ রইলো।জারা মেয়েটা যথেষ্ট সুন্দরী।বাবার টাকায় প্রাইভেট মেডিকেলে পড়াশোনা করছে।সবদিকেই ঠিক আছে,তবে দোষ বলতে শুধু ওই‌ একটাই।যেকোনো মুল্যে ওর আরাব চাই!আর এটাই আরাবের ওকে ভালো না লাগার কারন।বিষয়টা ওর মা আর বোন তৌফিকা বুঝলেও,বাবা আর বোনজামাই মুফতাহির মানতে নারাজ।তাদের মতে,আরাবের জন্য নাকি জারা পার্ফেক্ট।আর তাদের সাহচর্যে জারারও বেশ ভালোমতোই ওদের পরিবারে জায়গা করে নিয়েছে।একটা জোরে শ্বাস ফেলে বাচ্চাদের মতো করে বলে উঠলো,

-এই ঝামেলাকে ডিরেক্ট রিজেক্ট করেছিলাম।তারপরও এমন ছেচড়ামি করলে,আমার কি করার আছে?

-বাহ্!শিল্পপতি তৌহিদ ওয়াহিদের একমাত্র উত্তরসুরী তাহসানুল আরাবের করার কিছু নেই?এটাও শুনতে হলো আমাকে?

-প্লিজ ভাইয়া,স্টপ দ্যাট উত্তরসুরী টপিক!

-বেশ,ওই টপিক বাদ।কিন্তু আরাব,তোমার মা বাবার একমাত্র ছেলে তুমি।ওভাবে হুটহাট উধাও হয়ে গিয়ে কি পাও বলোতো?প্রতিবার অবশ্য ট্রিপে‌ যাও,পৌছে জানিয়ে দাও,মানলাম।কিন্তু এবার তোমার এক্সিডেন্ট হয়েছিলো আরাব!পুরো আঠারো ঘন্টা যোগাযোগের বাইরে ছিলে তুমি!তুমি ভাবতে পারছো,মা বাবা,তৌফিকা মনে ঠিক কি চলছে এই মুহুর্তে?

জানালায় মাথা ঠেকালো আরাব।চোখ বন্ধ করে আবারো ভাবনায় ডুব দিলো।জানে,মা,বাবা,আপু চিন্তা করছে।ওকে এই কাটাছেড়া অবস্থায় দেখলে তারা আরো কতোকমের কথা শুরু করবে,তারও ধারনা আছে ওর।তবুও সবটাই ভালোলাগছে।এক্সিডেন্ট,এটাক,সবটাই ওর ভালোলাগর অংশে জাগা করে নিয়েছে।এই মুহুর্তে ওর একটাই অনুভব,দোয়ার জন্য বাকিসব মানিয়ে নিতে পারবে ও!সবকিছু!

পড়ানো শেষে মৃত্তিকাদের বাসা থেকে বের হলো দোয়া।রাস্তার পাশের দোকানের দেয়াল ঘড়িটায় দেখলো ছয়টা আটাশ বাজে।কিন্তু মৃত্তিকাদের ড্রয়িংরুমের ঘড়িটায় বেরোনোর সময় দেখেছে ছয়টা ছয় বাজে।ওর কাছে ফোন বা হাতঘড়ি না থাকার এই একটা সুবিধা মৃত্তিকার আম্মুর।বাসার ঘড়িটার টাইম স্লো করে দিয়ে রেখেছেন উনি।যাতে আসল ঘড়ি দেখে ওর পৌছানোর তাড়া থাকে আর ভুল সময় দেখে পড়ার সময়টা বাড়ানো যায়।মানুষের চালাকির শেষ নেই।যে যখন যেভাবে বিপদে পরবে,কেউ না কেউ তার সে অসহায়ত্বের সুযোগ ঠিক নেবে।হাটতে হাটতে তাচ্ছিল্যে হাসলো দোয়া।

সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে এভাবেই বহুতল ভবনগুলোর মিটমিটে আলো দেখতে দেখতে বাড়ি পৌছে যায় দোয়া।আগের টিউশনিটায় মাহিমের আম্মুকে বলেছে,পারলে যেনো ওকে আরেকটা স্টুডেন্ট খুজে দেয়।সে হাসিমুখেই রাজি হয়েছে।কিন্তু মৃত্তিকার আম্মুকে বলতেই সে বলে উঠলো,”আমি কোথ্থেকে খুজবো দোয়া?তুমি নিজে গিয়ে কিন্ডারগার্ডেনের সামনে গিয়ে দাড়ালেই তো পারো।ওখানে অনেক গার্ডিয়ানরাই তো আসে!”

কথাটা প্রথমে তিক্ত লেগেছিলো দোয়ার কাছে।পরে মনে হলো,ভুল তো কিছু বলেন নি উনি।ওর জীবীকার খোজ তো ওর নিজেরই করা উচিত।কিন্তু স্কুলের সামনে দিয়ে যেতেই যে বুক ফেটে কান্না আসে ওর।দিয়ানের কথা ভেবে।ক্লাস ফোর থেকে পড়াশোনা আটকে গেছে ওর।বাবা মারা যাওয়ার পরও দোয়া চালিয়ে নিচ্ছিলো ওর পড়াশোনা,কিন্তু ওর ভেতরের অসুখটার জন্যই তো ডক্টর মানা করেছে ওর লাফধাপ।তাই চোখের আড়াল করেনি।মা বুঝেছিলো,অর্থসংকট।কিছু বলেনি।কিন্তু ভাইকে কিভাবে বুঝিয়েছে,তা ওই‌ জানে।লুকিয়ে অবাধ্য চোখের জল মুছলো।এই রাস্তার সবসময় মানুষের আনাগোনা।কিন্তু একাকী পথ চলাটা প্রতিদিন সব দুঃখকে মনে করিয়ে দেয় দোয়ার।সারাদিনের ব্যস্ততায় ভুলে থাকতে চাইলেও,এই রাস্তায় হাটতে হাটতে নিজের সমস্ত দুর্ভাগ্য আর তার পরিনতি‌ মনে পরে যায় ওর।ভাগ্যও চায়,বাস্তবতাকে মনে রেখে সবসময় যেনো ও নিজের লক্ষ্যে স্থির থাকে।

-কি দোয়া?কোনো সবজি নিবা আইজ?

সবজি‌বিক্রেতা!এ কলোনির সবজিবিক্রেতার সাথে পরিচয় হয়ে গেছে দোয়ার।বাড়ি ফেরার সময় এখান থেকেই সবজি নিয়ে যায় ও কোনো কোনো দিন।মাথা নেড়ে মৃদ্যু হেসে না বুঝালো ও।লোকটা তার খালিপ্রায় গাড়িটা ঠেলে চলে গেলো।সবজি প্রায় সবই বেচা হয়েছে আজ তার।দিনশেষে হাতে দুটো রোজগারের পয়সা আসার মতো আনন্দের হয়তো আর কিছুই না।সে টাকায় ছোট্ট পরিবারের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার মতো শান্তির আর কিছুই না।ভাবলেও তৃপ্তিতে মন ভরে যায়।কিন্তু দোয়ার দায়িত্ব তো শুধু সে অবদি নয়!ওর মা যে অসুস্থ্য,ভাই যে মরনরোগ সাথে নিয়ে বেচে আছে।ওদেরকে বাচাতে হবে।ওদের নিয়েই তো ও বেচে আছে!

-এইযে দোয়া মিস!

অচেনা গলা শুনে চোখেরজল মুছে পেছন ফিরলো দোয়া। মাস্ক পরিহিত এক লোক।আবছা অন্ধকারে ঠিক চিনে উঠতে পারছে না লোকটাকে।মানুষটা এগোলো দোয়ার দিকে। মাস্ক খুলতেই দৃষ্টি প্রসারিত হলো দোয়ার। হাতে খামচে ধরলো কাধে ঝুলানো ব্যাগটা। পাশ ফিরে চলে আসতে যাবে,লোকটা পথ আগলে দাড়ালো ওর।বাকা হেসে নিজের গালে হাত বুলিয়ে বললো,

-ভাগ্নি আমার বড্ড বায়না করছে জানো তো‌ ম্যাডাম,দোয়া মিসকে এনে দাও! দোয়া মিসকে এনে দাও!কি করা যায় আপনিই বলুন তো দোয়া মিস?

-পথ ছাড়ুন!

-চড়টার কথা ভুলে গেলে দোয়া?ওটার পাওনা নেবে না?

আশেপাশে তাকালো দোয়া।রাস্তায় লোকজন আছে।তারপরও এই লোক এভাবে কথা বলছে দেখে খানিকটা দমে গেলো ও।পরপরই‌ একটা শ্বাস নিয়ে বললো,

-দেখুন,আপনি আপনার বাজে কথার জন্য সাজাটা পেয়ে গেছেন।আপনার সাথে আর কোনোরকমের কথা বলার ইচ্ছে আমার নেই।আমাকে যেতে দিন।

লোকটা আবারো হাসলো।পরপরই দাতে দাত চেপে বললো,

-যদি না দেই?

-মানে?

-মানে বুঝতে মন বোঝা দরকার দোয়া!তুমি তো আমার মনটাই বুঝলে না।না বুঝে চড় মেরে‌ দিলে।কি এমন ক্ষতি হতো আমার কাছে আসার জন্য রাজি হয়ে গেলে হুম?এখন আমার মন বোঝানোর জন্য যদি তোমাকে জবরদস্তি করতে হয় তো….

-দেখুন,সেদিন আপনার কথায় রাগের বশে গায়ে হাত তুলেছিলাম।ওই টিউশনি আমি ছেড়ে দিয়েছি।আপনাকে আর আমার মুখোমুখি হতে হবে না।প্লিজ বিষয়টাকে আর বাড়াবেন না!আমি…

-বাড়াবো!আরো বাজেভাবে বাড়াবো!রনোকের গায়ে হাত তোলার মুল্য তো তোমাকে দিতে হবে দোয়া ম্যাডাম!আমার বোনকেও অপমান করতে ছাড় দাওনি তুমি।সবটা শুধু চুইচাপ দেখেছি।বাট ইউ উইল হ্যাভ টু পে!

বেশ অনেকটা চেচিয়ে বললো রনোক।পাশের পথচারী এক মহিলা একটু তাকিয়ে থেকে চলে গেলেন।দোয়া বড়বড় চোখে তাকালো।মানুষটা এখনো এভাবে রাগ পুষে রেখেছে ভাবতেই কিছুটা ভয় কাজ করতে লাগলো ওর ভেতরে।রাগটা কমিয়ে রনোক আবারো বললো,

-শোনো দোয়া,একটা ফোনকল!জাস্ট একটা ফোনকলে তোমার সর্বস্ব হরন হয়ে যাবে!এই রাস্তায় দুচারজনকে দেখে এতোটা আস্বস্ত হয়ো না।কেউ টেরটিও পাবে না,কখন কিডন্যাপার এলো,আর মেয়েটা উধাও হয়ে গেলো!

দোয়া ঘাবড়ে গেছে।তবুও গলা নরম করে বললো,

-দেখুন,আপনি আমার‌ বয়সে বড়।আমি চাইনা আর কোনো ঝামেলা…

-ভয় পেয়ছো ভাগ্নির ম্যাডাম?ভয় পাও!তুমি আমাকে চড় মেরেছো না?আমিও মারবো তোমাকে!ভয়ে ভয়ে মেরে ফেলবো!আজ থেকে এই রাস্তা দিয়ে যাওয়ার প্রতিমুহুর্তে ভয় পাবে তুমি!এই বুঝি রনোক এসে তোমায় তুলে‌ নিয়ে যায়!এই বুঝি রনোক তোমাকে এই কোলাহলপুর্ন রাস্তা থেকে জনশুন্য জায়গায় নিয়ে যায়!এই বুঝি রনোক তোমার দেওয়া থাপ্পড়টার জবাব উশুল করে…তোমার পবিত্রতার বিনিময়ে!ভয় পাও তুমি!ভয় পাও!

আঙুলতাক করে কথাগুলো বলে গালে হাত বুলাতে বুলাতে চলে গেলো রনোক।জলভরা চোখে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে দাড়িয়ে রইলো দোয়া।কর্মজীবী মেয়েদের জীবনে ঠিক কতোরকমের মানুষের সাথে লড়াই করে বাচতে হয়,তার ধারনা নিয়েই বেচে আছে ও।নিজেকে খুব শক্তভাবে প্রস্তুতও করেছে।কিন্তু আজ অবদি এমন ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়নি ওকে।অরুনাভ মুখার্জী অনেকটাই আগলে রেখেছিলেন ওকে।কিন্তু আজ?আজকে রনোক যা বলে গেলো,সে ভয়টা কি ফেলনা?সত্যিই কি এ ভয় ঘিরে ধরবে না ওকে?

#চলবে….

[ভুলত্রুটি মার্জনীয়]