এক মুঠো অনুভূতি পর্ব-১১+১২

0
347

#এক_মুঠো_অনুভূতি💖
লেখিকা- তাহসীন নাওয়ার রীতি
পর্ব:১১

ওসমান সকাল থেকেই ওহিকে কল দিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু বরাবরই ফোন অফ দেখাচ্ছে ওহির। আর না জাইমা ফোন রিসিভ করছে। সকাল পেরিয়ে এখন প্রায় শেষ বিকেল।
এদিকে ওহি ফিরে না আসায়, ওহির মা চিন্তিত হয়ে বসে আছেন।
–ওসমান, জাইমাকে আর একবার ফোন দিয়ে দেখো না কি বলে। ওহি তো কখনও এতো দেরি করে না, কোন বিপদ হলো না তো?
ওসমান মায়ের দিকে তাকিয়ে জাইমাকে ফোন করে। দুবার রিং হওয়ার পর জাইমা ফোন রিসিভ করে,
–জাইমা কোথায় ছিলি তুই? কতোবার কল দিয়েছি তোকে।
–সরি ওসমান ভাই, ফোন সাইলেন্স ছিলো তাই খেয়াল করিনি।
–ওহি কোথায়? তোর সাথে আছে ওহি?
–ওহি? না তো। ওহির তো বলেছিলো আজ নাকি তুমি ওহিকে ভার্সিটি থেকে নিয়ে আসতে যাবে। তাই তো আমি একাই চলে এসেছিলাম।
–মানে তোর সাথে ওহি নেই!
–না। ওহি এখনো ফিরে আসেনি ভাইয়া?
–না। তাই তো তোর কাছে জিজ্ঞেস করছি।
ওসমান জাইমার সাথে কথা বলতে বলতে মায়ের দিকে তাকিয়ে,
–মা, তুমি বাসায় থাকো। আমি ওহিকে খুঁজতে যাচ্ছি। ওহি যদি ফিরে আসে তাহলে আমাকে জানিও।
ওসমান কথাটা বলেই বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ে। এদিকে ওহি এখনো বাসায় ফিরে যায়নি শুনে জাইমাও চিন্তিত হয়ে পড়ে।
–এই শহরে তো ওহির কোন আত্মীয়স্বজনও নেই। তাহলে কোথায় যেতে পারে ওহি?
জাইমা কিছুক্ষণ ভেবে আফরাকে কল দেয়।

রোদ্দুর আর আশ্বিন তখন আফরাদের বাসায় বসে আড্ডা দিচ্ছিল। আফরার ফোন বেজে উঠায় ফোনের দিকে তাকিয়ে,
–আরে রোদ, আমাদের ভাবি ফোন করেছে। দেখি কি বলে। সকালে ক্লাস মিস দিয়ে একসাথে কোথায় কোথায় ঘুরেছিস, এখন জানবো আমরা।
–জাইমার ফোন? দে তো আমাকে..। আমি কথা বলছি।
রোদ্দুর কথাটা বলেই আফরার হাত থেকে ফোন কেড়ে নিতে চাইলে আফরা হাত সরিয়ে ফেলে ফোন রিসিভ করে,
–হ্যালো জাইমা?
–আফরা আপু, ওহি কি তোমার সাথে আছে?
–না তো। ওহি কেনো আমার সাথে থাকবে?
–আপু ওহিকে পাওয়া যাচ্ছে না। ভার্সিটি শেষে এখনও বাসায় ফিরে যায়নি সে। সবাই খুব চিন্তা করছে।
–কি বলো এসব? তুমি কোথায় আছো এখন?
–ওহিকে খোঁজার জন্য বের হচ্ছি।
–ঠিক আছে। আমরাও আসছি। তুমি চিন্তা করো না, ওহিকে পেয়ে যাবো।
আশ্বিন এতোক্ষণ চুপচাপ আফরার কথাগুলো শুনছিলো। আফরা ফোন রেখে আশ্বিনের দিকে তাকিয়ে,
–ওহিকে নাকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
–খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না মানে? ফাইজা!
আশ্বিন কথাটা বলেই উঠে দাঁড়িয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ে। রোদ্দুর আর আফরাও তার পিছু নেয়।

এদিকে,
–এমন বোকার মতো একটা কাজ তুমি কিভাবে করতে পারলে মিতু? তুমি কি ভেবে ওহিকে সেখানে বন্দি করে চলে এসেছো? আর কি মনে করেছো তুমি, মাথায় ঐ সামান্য আ/ঘা/তে ওহি মা/রা যাবে?
আমি তোমাকে বলেছিলাম ওহিকে ভয় দেখানোর কথা, তাকে মে/রে ফেলতে বলিনি আমি।
–আমার কাছে এটাই ঠিক মনে হয়েছে রোহান।
–বোকার মতো কথা বলো না মিতু। ওহিকে বাসায় না ফিরতে দেখে তার ফ্যামিলি তাকে খুঁজতে শুরু করবে। আমরা পুলিশ কেইসে ফেঁ/সে যাবো। তারপর যদি ওহি হাসান স্যারকে আমাদের কথা বলে দেয়। তখন কি হবে?
–ওহি আমাকে দেখেনি রোহান।
–তুমি ওহির ফোন সাথে করে নিয়ে এসেছো। ওহির প্রথম সন্দেহ আমাদের উপরেই যাবে। ফোন লক করা, আমরা ভিডিও ডিলিট করেও পারছি না।
রোহানের কথায় মিতু চুপ হয়ে যায়। ওহির উপর রাগ বেশি থাকায় হিতাহিত জ্ঞান ভুলে এমন একটা ভুল করে ফেলেছে সে। এখন তার ভুল বুঝতে পারছে মিতু।
–এখন কি করবো আমরা রোহান?
রোহান কিছুক্ষণ চুপ করে ভেবে,
–আগে ভার্সিটি চলো। দেখি ওহিকে কি করা যায়।

ওসমান,জাইমা,আফরা,রোদ্দুর আর আশ্বিন মিলে পুরো শহর তন্ন-তন্ন করে খুঁজেও ওহিকে পায়নি। এদিকে, সন্ধ্যা পেরিয়ে চারদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে। ওহির মা এতোক্ষণে ওহির বাবাকে খবর পৌঁছে দিয়েছেন। তিনি ব্যবসার কাজে দূরে থাকায় মুহূর্তেই বাড়ির পথে রওনা হন।
ওসমান জড়োসড়ো হয়ে রাস্তার ধারে শান্ত হয়ে বসে পড়ে। প্রতিদিনের মতোই ক্লাস শেষে ওহিকে ভার্সিটি থেকে নিয়ে যেতে এসেছিলো সে। কিন্ত ঘন্টা দুয়েক পেরিয়ে যাওয়ার পরও ওহি বেরিয়ে না আসায় বাড়ি ফিরে যায় সে।
সারাদিন ধরে বোনকে খুঁজে না পেয়ে ক্লান্ত শরীর আর উস্কসুস্ক চুলে ওসমানকে এভাবে বসে থাকতে দেখে আফরার অনেক মায়া হয়।
এদিকে, আশ্বিন ওহি হারিয়ে গিয়েছে কথাটা শোনার পর থেকেই অস্থির হয়ে আছে। পাগলের মত হন্ন হয়ে এদিক সেদিক ওহিকে খুঁজে যাচ্ছে সে। অদ্ভুত এক শূণ্যতা এসে গ্রাস করছে আশ্বিনের মনে।
কিছুক্ষণ ভেবে রোদ্দুরের দিকে তাকিয়ে,
–রাফিন কিছু করেনি তো আবার? আমার উপর প্রতিশোধ নিতে এটা রাফিনের কাজও হতে পারে, রোদ।
–ঠিক বলেছিস। আমারও তাই মনে হচ্ছে।
আশ্বিনের কথায় আফরা তাদের দুজনের দিকে তাকায়। আশ্বিন আর রোদ্দুর এক মুহূর্ত দেরি না করে রাফিনের বাসার দিকে রওনা দেয়।

একের পর এক কলিং বেল-এর শব্দ শুনে রাফিন এসে দরজা খুলতেই আশ্বিন রেগে রাফিনের শার্টের কলার টেনে ধরে,
–ফাইজা কোথায় রাফিন? আমি জানি তুই তাকে আটকে রেখেছিস।
–কি বললে? ফাইজাকে আটকে রেখেছি মানে? আগে, কলার ছাড়ো আমার।
রাফিন আশ্বিনের হাত ছাড়িয়ে তার দিকে রেগে কিছু বলতে যাবে তখন রোদ্দুর বলে উঠে,
–রাফিন, তোমার শত্রুতা আমাদের সাথে। এর মাঝে ওহির কি দোষ ছিল? ভালোয় ভাল বলছি, ওহিকে কোথায় রেখেছো বলে দাও।
–ওহিকে আমি কোথায় রাখবো? হ্যাঁ, এটা ঠিক বলেছো তোমাদের সাথে আমার শত্রুতা আছে। কিন্ত ওহি আমার কাছে বন্ধুর মতোই। ওহির কোন ক্ষতি করার কথা আমি কখনো ভেবেও দেখিনি।
–আচ্ছা? স্বার্থ ছাড়া তুমি আজ পর্যন্ত কার সাথে বন্ধুত্ব করেছো রাফিন?
আশ্বিন রেগে কথাটা বলতেই রাফিন তার দিকে তাকিয়ে শান্ত ভাবে,
–আমার যাকে ভালো লাগে, তার সাথে বন্ধুত্ব করতে কোন স্বার্থ আমি দেখি না।
রাফিনের কথায় আশ্বিন চুপ হয়ে যায়। রাফিন যে ওহিকে পছন্দ করে তা অন্য ভাবে আশ্বিনকে বুঝিয়ে দিলো সে। আশ্বিন রাগি রাগি চোখে রাফিনের দিকেই তাকিয়ে আছে।

লুকিয়ে ভার্সিটি এসে, ঐ রুমে প্রবেশ করেছে রোহান আর মিতু। ফোনের লাইট অন করে ওহির সামনে এনে দেখে, ওহি এখনো জ্ঞান হীন অবস্থায় পড়ে আছে। মিতু তার দিকে তাকিয়ে,
–এর কি ব্যবস্থা করবে রোহান?
–আমার এক বড় ভাইয়ের সাথে কথা বলেছি। আপাতত চশমিশকে উনার কাছেই নিয়ে যাবো। তারপর দেখা যাক কি হয়।
রোহানের কথায় মিতু মাথা নাড়ল।

এদিকে, সবাই মিলে ভাগে ভাগে ওহিকে খুঁজে যাচ্ছে। আশ্বিন, রোদ্দুর আর রাফিন মিলে ভার্সিটিতে এসেছে ওহির খোঁজে।
–রোদ তুই এদিকটা দেখ, রাফিন তুমি ওদিকে দেখো। আমি মুল ভবনের দুই আর তিন তালায় দেখছি।
দুইজন রাজি হয়ে যার যার মত করে খোঁজ শুরু করে। রাত হয়ে যাওয়ায় চারদিক অন্ধকার। ফোনের লাইট অন করে আশ্বিন প্রতিটি রুম ভালোভাবে দেখে যাচ্ছে। তিন তালা ভালো ভাবে খেয়াল করে সিঁড়ির কাছে চলে আসছে হঠাত একটা শব্দ শুনতে পায় সে। শব্দ শুনে আশ্বিন থেমে গিয়ে শব্দের উৎস বুঝে ধীরে ধীরে তিন তালার স্টোর রুমের কাছে চলে আসে।

রোহান আর মিতু মিলে ওহিকে উঠানোর চেষ্টা করছিলো। হঠাত কারো পায়ের শব্দ শুনে ওহিকে রেখে দ্রুত লুকিয়ে পড়ে তারা।
আশ্বিন রুমের দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করতেই অন্ধকারে পা কিছুর সাথে লেগে পড়ে যেতে নিয়েও নিজেকে সামলে নেয়। কি আছে নিচে দেখার জন্য লাইট সেদিকে ধরে দেখে ওহি মুখ বাঁধা অবস্থায় মেঝেতে পড়ে আছে। ওহিকে এভাবে দেখে আশ্বিনের মাথায় মুহূর্তেই আকাশ ভেঙে পড়ে।
–ফাইজা!
আশ্বিন মেঝেতে বসে ওহিকে আধশোয়া অবস্থায় কোলে তুলে তার মুখ ও হাতের বাঁধন খুলে দেয়,
–ফাইজা! এসব কে করেছে? ফাইজা চোখ খুলো। তাকাও আমার দিকে। ফাইজা!
আশ্বিন পাগলের মত ওহিকে কিছুক্ষণ ডেকে ফোন বের করে রোদ্দুরকে কল দেয়।

রোহান আর মিতু এতোক্ষণ আড়াল থেকে আশ্বিনকে দেখছিলো। মিতু রোহানের দিকে ইশারায় কি করবে এখন বলে। এদিকে, রোহান আশ্বিনকে দেখে ঘাবড়ে যায়। এখন আর ওহিকে সরিয়ে ফেলা সম্ভব না। এই মুহূর্তে এখান থেকে পালিয়ে যেতে পারলে পরবর্তিতে কি হবে দেখা যাবে।
রোহান আশেপাশে তাকিয়ে একটা লাঠি হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে আশ্বিনের কাছে এসে তার মাথায় স্বজোড়ে আঘাত করে। আচমকা কেউ আঘাত করায় মুহূর্তেই আশ্বিন মাথায় হাত রেখে মেঝেতে পড়ে যায়। মিতু রোহানের এমন কান্ড দেখে অবাক হয়ে বেরিয়ে এসে রোহানের হাত টেনে সেখান থেকে চলে যায়।

–চলবে(ইনশাআল্লাহ)

#এক_মুঠো_অনুভূতি💖
লেখিকা- তাহসীন নাওয়ার রীতি
পর্ব:১২

আশ্বিনের কল পেয়ে রোদ্দুর ফোন রিসিভ করলেও, ওপর পাশ থেকে কোন কথা শুনতে পায় না রোদ্দুর। রাফিন তখন রোদ্দুরের কাছে এসে।
–কি হয়েছে রোদ্দুর?
–আশ্বিন ফোন করেছে, কিন্তু কথা বলছে না। আমি আবার কল দিয়েছি তাও রিসিভ করেনি।
–চলো যাই আশ্বিনের কাছে।
রোদ্দুর ফোন রেখে রাফিনের সাথে মুল ভবনের দিকে রওনা দেয়।

এদিকে,
আশ্বিন মাথা চেপে ধরে কোনমতে উঠে বসে। ঝাঁপসা চোখে চারদিকে তাকিয়ে ওহিকে মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখে। আশ্বিন ধীরে ধীরে ওহির কাছে এসে তাকে কোলে তুলে উঠে দাঁড়ায়।
–আমার বোঝা উচিত ছিল, এখানে কেউ তো অবশ্যই আছে। বোকার মতো এভাবে একা আসাটা আমার ঠিক হয়নি। যাই হোক, এমন কাজ যে করেছে, তার শাস্তি আমি নিজ হাতে দিবো দেখো ফাইজা!
আশ্বিন কথাটা বলে ওহিকে কোলে নিয়ে অন্ধকার রুম থেকে কোনমতে বেরিয়ে আসতেই রোদ্দুর আর রাফিন সেখানে আসে। রাফিন ওহিকে দেখে অবাক হয়ে,
–ওহি! এসব..! কিভাবে হলো?
–আশ্বিন তুই ঠিক আছিস..?
রোদ্দুর আশ্বিনের মাথার দিকে তাকিয়ে কথাটা বলতেই আশ্বিন তাদের পাশে কাটিয়ে যেতে যেতে,
–গাড়ি বের কর রোদ, ফাইজাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে।

আফরা আর ওসমান ওহির দূর সম্পর্কের সকল আত্মীয়স্বজনের কাছে ওহির কথা জিজ্ঞেস করেও ওহির কোন খবর পাচ্ছে না। হঠাত আফরার ফোন বেজে উঠতেই সে দেখে রোদ্দুর,
–হ্যা রোদ, ওহিকে পেয়েছিস তোরা?
–হুম, ভার্সিটিতেই পেয়েছি ওহিকে। জ্ঞান নেই ওহির। তাই তাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি আমরা। তোরাও চলে আয়।
রোদ্দুরের কথায় আফরা ওসমান আর জাইমাকে নিয়ে রওনা দেয়।

ঘন্টা খানেকের মাঝে ওসমান, ওহির মা, আফরা আর জাইমা মিলে ওহির কাছে চলে আসে। তারা এসেই রোদ্দুরের পাশে দাঁড়িয়ে,
–ওহি কোথায়, বাবা?
–আন্টি, ডাক্তার ওহির চেক আপ করছে। একটু অপেক্ষা করুন।
কিছুক্ষণ পর ডাক্তার বেরিয়ে আসতেই ওসমান উনার কাছে গিয়ে,
–আশরাফ স্যার, ওহি কেমন আছে?
–ওসমান? ওহি তোমার বোন?
–জি স্যার। কেমন আছে সে এখন?
–চিন্তা করো না, ওহি এখন ভালো আছে। মাথায় হঠাত আঘাত পেয়ে জ্ঞান হারিয়ে ছিলো। কপাল ভালো যে আঘাতটা বেশি গভীর না। আমি ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে দিয়েছি। এখন একটু রেস্ট করুক।
–ধন্যবাদ স্যার।
ডাক্তার ওসমানের কাধে হাত রেখে চলে যায়। ওহির মা, জাইমা আর ওসমান মিলে ওহিকে দেখতে চলে যায়। আফরা রোদ্দুরের কাছে এসে,
–আশ্বিন কোথায়?
–আশ্বিনের মাথা ফেঁ/টে গিয়েছে। ওহিকে খুঁজে পেয়ে তাকে নিয়ে আসার সময় কেউ একজন আশ্বিনের উপর হামলা করেছে।
আফরা অবাক হয়ে রোদ্দুরের দিকে তাকাতেই তারা ভার্সিটির সকল ঘটনা তাকে খুলে বলে।
–কিন্তু কে ওহির সাথে এমন করতে পারে?
আফরার কথায় রোদ্দুর চুপ হয়ে ভাবতে থাকে।

ওহির কেবিনের দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে আশ্বিন। দূর থেকে ওহির ঘুমন্ত মুখের দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে। চঞ্চল প্রকৃতির মেয়েটা কিভাবে শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে আছে সেই দৃশ্য দেখছে আশ্বিন। রোদ্দুর আশ্বিনের পাশে এসে,
–অনেক রাত হয়েছে আশ্বিন। চল বাসায় চলে যাই। কাল সকালে নাহয় আবার আসবো।
–আর কিছুক্ষণ থাকি। বাসায় গিয়ে কি করবো?
আশ্বিন ওহির দিকে তাকিয়েই শান্ত ভাবে কথাটা বলে। রোদ্দুর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে,
–ওহির কাছে তার মা-বাবা, ভাই আর জাইমাও তো আছে। আফরা আর রাফিন সেই কখন চলে গিয়েছে। আমাদেরও এখন যাওয়া উচিত। তাছাড়া তোর এখন রেস্ট দরকার।
আশ্বিন রোদ্দুরের দিকে তাকিয়ে কেবিনে ঢুকে ওসমানের কাছে বিদায় নিয়ে একবার ওহির দিকে ফিরে সেখান থেকে চলে আসে।
————–

বারান্দার দেয়ালে হেলান দিয়ে শান্তভাবে বসে আছে আশ্বিন। সকালেই যে ওহিকে স্বাভাবিক ভাবে দেখেছে, কে জানতো মুহূর্তেই তার উপর দিয়ে এতো বড় ঝড় বয়ে যাবে? আশ্বিনের বাবা তার কাছে এসে,
–এখনো ঘুমাওনি বাবা?
–না, আব্বু। ঘুম আসছে না। ভার্সিটির ভেতর এতো বড় এক কাহিনী হয়ে গেলো আর আমি কিছুই করতে পারলাম না।
–এখানে তোমার কোনো দোষ ছিল না, আশ্বিন।
আশ্বিন তার বাবার দিকে তাকিয়ে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে,
–আব্বু জানো? হাসান স্যারকে আমি ফাইজার কথা জানিয়েছি। স্যার আমাকে সম্পূর্ণ ভাবে বিষয়টা এড়িয়ে যেতে বলেছেন। মানে, তিনি এই ঘটনার জন্য ভার্সিটির সুনাম নষ্ট করতে চাইছেন না।
–হয়তো তিনি জানেন আসল দোষী কে। তুমি চিন্তা করো না বাবা। এই ঘটনার জন্য যারা দোষী হিসেবে বের হবে, আমি নিজে তাদের ব্যবস্থা করবো।
–ফাইজাকে যারা কষ্ট দিয়েছে, তাদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না আব্বু। আমি তাদের দেখে নিবো।
আশ্বিনের বাবা ছেলের কথা শুনে তার মাথায় হাত রাখে।
————-

সকাল সকাল একাই ওহিকে দেখতে চলে এসেছে আশ্বিন। ওহির কেবিনের সামনে আসতেই দেখে ওহির বাবা মা আর হাসান স্যার বেরিয়ে আসছেন। আশ্বিন কপাল কুঁচকে স্যারের কাছে আসতেই স্যার তার দিকে তাকিয়ে,
–আশ্বিন এসেছো! ওহির সাথে দেখা করতে এলাম। ভালো লাগলো এখন তাকে ভালো দেখে। সাতদিনের জন্য ভার্সিটি থেকে তাকে ছুটি দেওয়া হয়েছে। যাই হোক, তুমি এখন কেমন আছো আশ্বিন বাবা?
–জি স্যার, আমি ভালো আছি।
–আচ্ছা, থাকো তাহলে। তোমার সাথে পরে কথা আছে আমার।
স্যার কথাটা বলে ওহির বাবার সাথে কথা বলতে বলতে চলে যান। ওহির মা আশ্বিনের কাছে এসে,
–কেমন আছো, বাবা? মাথায় কি এখনো ব্যথা করছে?
–না আন্টি, আমি ঠিক আছি। আপনারা কোথাও যাচ্ছেন?
–একটু বাসায় যাচ্ছি। কিছুক্ষণ পরেই আমি চলে আসবো।
–ঠিক আছে।
ওহির মা কথাগুলো বলে চলে যেতেই আশ্বিন ওহির কেবিনের সামনে এসে দেখে রাফিন ওহির পাশে বসে তার সাথে গল্প করছে। ওহি আধশোয়া অবস্থায় বসে হেসে হেসে তার সাথে কথা বলছে। দুজনকে একসাথে দেখে মুহূর্তেই কাল রাফিনের বলা কথাটা মনে পড়ে।

”আমার যাকে ভালো লাগে, তার সাথে বন্ধুত্ব করতে কোন স্বার্থ আমি দেখি না।”

আশ্বিন কথাটা মনে করে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে তাদের কর্মকান্ড দেখে ভেতরে প্রবেশ করে। এদিকে, ওহি আশ্বিনের দিকে তাকিয়ে কিছুটা অবাক হয়ে আনমনে বলে উঠে,
–আশ্বিন ভাইয়া!

আশ্বিন ওহির দিকে একবার তাকিয়ে রাফিনের সামনে এসে,
–কখন এসেছো রাফিন?
–এইতো ঘন্টা খানেক হলো এসেছি। এখন চলে যাবো, একটু কাজ আছে আমার। আচ্ছা ওহি, আমি যা যা বললাম ঠিক ঠাক ভাবে মনে রাখবে, বুঝেছো? আমি পরে আবার আসবো।
–ঠিক আছে রাফিন ভাইয়া।
রাফিন ওহির গাল টেনে আশ্বিনের পাশ কাটিয়ে চলে যায়।
আশ্বিন কিছু না বলে আড়চোখে রাফিনের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে একটা চেয়ারে বসে পড়ে। ওহি এতোক্ষণ ধরে আশ্বিনের কর্মকান্ড দেখছিলো,
–সূর্য আজ কোন দিক দিয়ে উঠলো? মানে, আশ্বিন ভাইয়া একাই সকাল সকাল আমাকে দেখতে চলে এসেছে!
ওহি কিছুটা মজা করে কথাটা বললো। আশ্বিন সেদিকে পাত্তা না দিয়ে টেবিলের দিকে তাকিয়ে,
–এই ফুলগুলো কি রাফিন নিয়ে এসেছে?
–হুম। ফুলগুলো খুব সুন্দর, তাই না?

ওহি ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে হেসে কথাটা বলে আশ্বিনের দিকে ফিরে দেখে সে রাগী চোখে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। আশ্বিনকে এভাবে তাকাতে দেখে মুহূর্তেই ওহির হাসি উড়ে যায়। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে পরে প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য বললো,
–ভাইয়া বলেছে, কাল রাতে আমাকে আপনি খুঁজে পেয়েছেন। ধন্যবাদ আশ্বিন ভাইয়া। আমি…।
ওহিকে বাকি কথা বলতে না দিয়ে আশ্বিন তার দিকে ফিরে,
–হাসান স্যার কেনো এসেছিলো? কি বলেছে তোমাকে?
–তেমন কিছু না। এমনি দেখতে এসেছিলো।
–ফাইজা! কথা লুকিয়ে লাভ নেই। বলো আমাকে স্যার কি বলেছে তোমায়।
ওহি কিছুক্ষণ চুপ থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে,
–স্যার বলেছেন, এর জন্য যারা দায়ী তাদের স্যার নিজে শাস্তির ব্যবস্থা নিবেন। কিন্তু এই বিষয়ে ভার্সিটির অন্য কাউকে যেন কিছু না জানানো হয়। মানে বিষয়টা তিনি গোপন রাখতে বলেছেন।
–আর তুমি কথাটা মেনে নিয়েছো? ফাইজা, তুমি কি খুঁজে বের করতে চাও না কে এসব করেছে? শাস্তির প্রয়োজন নেই তাদের?
আশ্বিনের রেগে বলা কথায় ওহি কেঁপে উঠে চুপ হয়ে যায়। ওহিকে ভয় পেতে দেখে আশ্বিন একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে,

–আচ্ছা, এই নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না। তোমার হয়ে আমি তাদের দেখে নিবো ফাইজা।
আশ্বিন কথাটা বলে নিজের ফোনে কিছু একটা দেখতে থাকে। ওহি চুপচাপ ঘোর লাগা নয়নে আশ্বিনের দিকে তাকিয়ে তার মাথার ব্যান্ডেজে হাত রাখতেই,
–আহ!
আশ্বিন ফোন থেকে মাথা তুলে ওহির দিকে তাকাতেই ওহি তাকে দেখে হেসে উঠে,
–এতো অস্থির হয়ে যাচ্ছেন কেনো? নাকি তারা আপনার আপনার মাথায় বাড়ি দিয়ে মাথা বিগড়ে দিয়েছে আপনার?
–কি বললে তুমি?
ওহি হেসে উঠে আশ্বিনের হাত ধরে একটা চকলেট দিয়ে,
–আমাকে নিয়ে এতো অস্থির হয়ে যাচ্ছেন কেনো, আশ্বিন ভাইয়া? কাল রাতে নিজে বিপদে পড়ে আমাকে উদ্ধার করে নিয়ে এসেছেন। আবার এখন স্যারের বিরুদ্ধে গিয়ে তাদের খুঁজে শাস্তির ব্যবস্থা করছেন। এসব কেনো করছেন আপনি?

ওহি কৌতুহল হয়ে আশ্বিনকে কথাটা বলতেই আশ্বিন চুপ হয়ে যায়। এই প্রশ্নের উত্তর তার জানা নেই। শুধু জানে, ওহির নিখোঁজ হওয়ার খবরে তার অস্থিরতা ছিলো কতটা তীব্র। হয়তো মনের কোণে বাসা বাঁধা ওহির প্রতি এই অনুভূতিই তাকে এমন পাগলামি করতে বাধ্য করছে।

–চলবে(ইনশাআল্লাহ)