এক মুঠো রোদ পর্ব-১৩ এবং শেষ পর্ব

0
403

গল্প :- #এক_মুঠো_রোদ (১৩) শেষ পর্ব
লেখক :- #A_Al_Mamun
.
তোমার ঘরের চেরাগ আসতেছে। আগে জানালে আসার সময় তো মিষ্টি নিয়ে আসতাম।
–কাল আনিস। এখন মিষ্টির কাছে যা।
–আচ্ছা।
এক প্রকার দৌড়েই মায়ের রুম থেকে বেরিয়ে আসে মামুন।
নিজের রুমের সামনে এসে উকি দিয়ে দেখে মিষ্টি এখনো বিছানার এক কোনায় বসে আছে।
নিজের চেহারায় একটু রাগি ভাব নিয়ে মামুন আবার রুমে প্রবেশ করে।
মামুনকে ভেতরে আসতে দেখে মিষ্টি উঠে দাড়ায়।
–তোমরা বউ শাশুড়ি মিলে কি আমায় পাগল বানিয়ে ছাড়বা?
–কেনো?
–তুমি বলছো মা বলবে, আর মা বলছে তুমি বলবে। কাহিনী কি?
–সত্যিই কি মা কিছু বলেনি?
–না।
–আমাকেই বলতে হবে?
–থাক, কারো কিছু বলা লাগবে না। শুনবো না আমি।
–এত রাগ করেন কেনো?
–তো কিছু বলছো না কেনো?
–বলবো তো।
–বলো।
–আজ একটু শরীর খারাপ থাকায় মা ডাক্তার ডেকেছিলো। জানেন ডাক্তার এসে কি বলেছে?
–কি?
–বুঝে নিন না।
–বুঝতে পারবো না, তুমি বলো।
–এমন করেন কেনো?
–বলবে? নাকি চলে যাবো?
–বলছিতো। ডাক্তার বললো…..
–কি?
–আমার খুব লজ্জা লাগছে।
–তবুও বলো।
–আমি মা হবো।
মামুন মিষ্টিকে বুকে টেনে নিয়ে কপালে আলতো করে একটা চুমু একে দেয়।
–মা আমায় আগেই বলে দিয়েছে। এই পাগলি, তোমার চোখে পানি কেনো?
–মা খুব খুশি হয়েছে।
–তো তুমি কেনো কেঁদেছো?
–এতটা খুশি কখনো লাগেনি। কি করবো বুঝতে পারছিলাম না, তাই কেঁদেছি।
–তুমি আসলেই একটা পাগলি।
–আপনি খুশি হন নি?
–খুব।
–খুব লজ্জা লাগছে আমার। সারাদিন রুম থেকেই বের হইনি।
–কেন?
–কি ভাববে ওরা? ৩ মাসেই মা হতে চলেছি।
–এতে ভাবা ভাবির কিছু নেই। ৩ বছর লাগাবো নাকি?
–তা নয়, তবুও কেমন না?
–ধুর, পাগলী মেয়ে। আমার অফিসের এক কলিগ তো বিয়ের আগেই সুখবর পেয়ে গিয়েছিলো। এরপর বিয়ে করেছে। সেক্ষেত্রে আমাদের কি ওতো তাড়াতাড়ি হয়েছে নাকি? ঠিক সময়েই হয়েছে।
–আচ্ছা বাদ দিন, ফ্রেস হয়ে আসুন। আমি খাবার দিচ্ছি।
–আচ্ছা।
এতদিন যাবত মিষ্টি সংসারটাকে একা হাতেই সামলাতো। কিন্তু এখন থেকে সাথে আরো ৩জোড়া হাত যোগ হয়েছে।
মিষ্টিকে তেমন কোনো কাজই করতে দেওয়া হয় না। রান্নাবান্না সব সানু বেগম রিয়াকে সাথে নিয়েই সেরে ফেলেন। আর মামুন অফিস থেকে ফিরে এসে মিষ্টিকে টুকিটাকি কাজে সাহায্য করে।
দিন শেষে ভালোবাসার মানুষটা যখন বুকে জড়িয়ে নেয়, তখন নিজের আবেগগুলো কান্না হয়েই বেরিয়ে আসে। যাকে সুখে রাখার জন্য দিন রাত এক করে দেওয়া হয়, সেই যখন দিন শেষে কান্নায় ভেঙে পড়ে, তখন কারই বা ভালো লাগে? মামুন যখন কান্নার কারনটা জানতে চায়, তখন উত্তর আসে এত সুখ নাকি তার সহ্য হচ্ছে না।
মিষ্টি গর্ভবতী থাকা কালিন পুরো পরিবার এতটাই যত্ন করেছে যে খুশির সময়ও মিষ্টি কান্না করে দিতো। বড্ড আনন্দে মিষ্টির দিনগুলো পার হতে থাকে।
ধীরেধীরে ডেলিভারি সময় এগিয়ে আসে।
১ মাসের জন্য ছুটি নিয়ে মামুন সারাক্ষণ মিষ্টির পাশেই সময় কাটায়।
–আর কত দিন লাগবে পাপা ডাক শুনতে?
–পাপা ডাক শুনার এত শখ?
–ওমা, কার শখ নাই?
–বুঝলাম, একটু তো অপেক্ষা করাই লাগবে।
–একটু জিজ্ঞেস করে দেখবো?
–কাকে?
–আমার বাবুটাকে।
–কিভাবে?
–এই দেখো।
মিষ্টির পেটের ওপর কান লাগিয়ে মামুন কথা বলা শুরু করে।
ওদিকে মিষ্টি মামুনের কান্ড দেখে খিলখিল করে হাসতে থাকে।
–কি বলেছে জানো?
–কি?
–বললো আর বেশিদিন অপেক্ষা করা লাগবে না। উনি খুব তাড়াতাড়ি আসতেছে।
–আপনাকে বলেছে?
–হুম।
–তাহলে আর অধৈর্য হইয়েন না। একটু অপেক্ষা করুন।
–এছাড়া তো আর কোনো উপায়ও নাই।
–খালি খালি চিন্তা করেন। শুয়ে পড়েন, অনেক রাত হয়েছে।
–আচ্ছা তুমিও শুয়ে পড়ো।
–হুম
.
মামুন মিষ্টির মাথা হাত বুলিয়ে দিতে দিতে দুজনই একসাথে ঘুমিয়ে পড়ে।
মাঝরাতে মিষ্টির বোবা আর্তনাদে মামুনের ঘুম ভেঙে যায়, দ্রুত বিছানা ছেড়ে উঠে লাইট জ্বালিয়ে দেখে মিষ্টি মুখে আচল গুজে দিয়ে কাঁদছে। যার জন্য কোনো শব্দ হচ্ছে না।
মুখ থেকে আচল সরিয়ে মামুন জিজ্ঞেস করে।।
–কি হয়েছে তোমার?
–খুব ব্যথ্যা করছে, আর পারছি না।
–আমায় জাগালে না কেনো? দাড়াও মাকে ডেকে আনছি।
একটু পর সানু বেগম মামুনের সাথে দৌড়ে রুমে প্রবেশ করে। অবস্থা গুরুতর হওয়ায় দ্রুত এম্বুলেন্সে খবর দেওয়া হয়।
মাঝরাতেই মিষ্টিকে সাথে নিয়ে সবাই হাসপাতালে রওয়ানা দেয়।
সানু বেগম রিয়াকে সাথে নিয়ে অপারেশন থিয়েটারের বাহিরের চেয়ারে বসে আছে। আর মামুন দরজার এদিক ওদিক পায়চারী করছে।
–মামুন, এখানে এসে বস।
–না মা, আমি ঠিক আছি।
–একটু তো সময় লাগবেই, কতক্ষণ এভাবে হাটবি? এদিকে আয়।
মায়ের ডাকে মামুন এসে চেয়ারে বসে।
–মা, ভয়ের কোনো কারন নেইতো?
–কিসের ভয়? আল্লাহকে ডাক। দেখবি সব ভালোয় ভালোয় শেষ হবে।
–তুমিও করো।
–আমি করতেছি।
–ভাই, ওতো চিন্তা করিস না। ভাবির কিচ্ছু হবে না।(রিয়া)
–তাই যেনো হয়।
দীর্ঘ ৩ ঘন্টা পর অপারেশন থিয়েটারের বাহিরে লাল বাতি বন্ধ হয়ে যায়।
মামুন দৌড়ে দরজার সামনে এসে দাড়ায়।
একটু পর ভেতর থেকে একজন মহিলা ডাক্তার বের হয়।
–ম্যাডাম, আমার স্ত্রী কেমন আছে?
–আলহামদুলিল্লাহ উনি ভালো আছেন।
–আমার বাবু হয়েছে?
–হ্যা ভাই, আপনার মেয়ে হয়েছে। তবে সবচেয়ে খুশির বিষয় হলো আপনার জমজ মেয়ে হয়েছে।
ডাক্তারের কথায় মামুন ওখানেই হেঁসে দেয়।
সানু্ বেগম আর রিয়াও ডাক্তারের কথায় খুব খুশি।
–আমরা ভেতরে যেতে পারবো?
–না ভাই, একটু পর ওনাকে কেবিনে দেওয়া হবে। তখন দেখিয়েন।
–ম্যাডাম তাড়াতাড়ি, আর তর সইছে না।
–চুপ কর পাগল, এত লাফাচ্ছিস কেনো?(রিয়া)
–শুনেছিস? তোর জমজ ভাইঝি হয়েছে। খুশি না হয়ে উপায় আছে? মা শুনেছো?
–শুনেছি শুনেছি, একটু চুপ কর। ওরা দেখলে কি ভাববে?
–যা ভাবার ভাবুক। আমার কি?
.
একটু পর মিষ্টিকে কেবিনে দেওয়া হয়। সবাই একসাথে মিষ্টির সামনে এসে দাড়ায়।
সানু বেগম আর রিয়া দুজন দুই বাচ্চাকে কোলে নিয়ে নেয়। আর মামুন রিয়ার পাশে এসে বসে।
–আমাদের মেয়ে দেখেছেন? জমজ।
–মেয়ে পরে, তুমি কেমন আছো?
–আপনাদের দোয়ায় খুব ভালো।
–মেয়েদের দেখেছো?
–হুম। আপনি দেখেছেন?
–না।
–দেখুন না।
মামুন উঠে মায়ের সামনে এসে দাড়ায়, মায়ের কোলে একটা মেয়ে, আর রিয়ার কোলে একটা মেয়ে। মামুন দুই মেয়েকে একসাথে নিজের কোলে নিয়ে নেয়। নিজের অজানতেই চোখ দিয়ে পানি পড়ছে মামুনের। রিয়া, মা আর মিষ্টি মামুনের দিকে এক নজরে তাকিয়ে আছে। বাবা হওয়ার অনুভূতিটা বুঝি কাউকে প্রকাশ করা যায় না? কেনো এতটা খুশি লাগে? পাথরে গড়া হৃদয়ের ছেলেটাও কেনো খুশিতে চোখের পানি ফেলে?
রাতে রাতেই মিষ্টিকে বাড়ি নিয়ে আসা হয়। মিষ্টি বিছানায় শুয়ে আছে, আর পাশেই শুয়ে আছে দুটো ছোট্ট পরি। মামুন মেয়েদের মাথার পাশে বসে বাচ্চা বাচ্চা কথা বলছে। আর মিষ্টি মামুনের কান্ড দেখে হেসেই যাচ্ছে।
–আপনিতো মেয়ে চেয়েছিলেন। আপনার মনের আসাই পূরণ হলো। খুশি হয়েছেন?
–খুব। এখন পর্যন্ত তোমার কাছে যা চেয়েছি, একটু বেশিই পেয়েছি। মেয়েও।
–আপনি যা চেয়েছেন তা পেয়েছেন। এখন যেনো আমার ভালোবাসায় কোনো কমতি না থাকে।
–কমতি থাকবে কেনো?
–এই যে দুইজন নতুন মানুষ এলো, এরাই তো আমার ভালোবাসায় ভাগ বসাবে। আমি ভালো করেই জানি।
–আরে নাহ।
–কচু না, মা ও তো এখন এদের নিয়ে থাকবে। কেউ আর আমায় ভালোবাসবে না।
–কে বললো?
–আমি জানি।
–কারো ভালোবাসায় কেউ ভাগ বসাতে পারে না।
–পারে, এখনো একবারও আপনি আমায় বুকে জড়িয়ে নেন নি। অথচ মেয়েদের কতবার নিয়েছেন তার হিসেব নেই।
–হায় খোদা, কি হিংসেরে বাবা।
–উমম
মামুন এগিয়ে গিয়ে মিষ্টিকে বুকে জড়িয়ে নেয়।
–থাক, এখন এতো ভালোবাসা দেখানো লাগবে না, নিজে থেকে তো নেন নি।
–আমার ভুল হয়ে গেছে, ক্ষমা করে দেন।
–আদর করছেন একবারও? আর ওদের কতবার করছেন?
–হায়, কই যামু আমি? এ দেখি মহা হিংসা। নিজের মেয়েদের প্রতিও হিংসা।
–আমার ভালোবাসায় কেনো ভাগ বসাবে হ্যা? ওদের যত আদর করবেন, তার চেয়ে আমায় বেশি আদর করবেন। মনে থাকে যেনো।
–ঠিক আছে ম্যাডাম।
–জানেন, খুব কষ্ট হচ্ছিলো। আপনাকে কতবার ডেকে দিতে বলেছি। কিন্তু ওরা আপনাকে ডাকে নি।
–খুব মিস করছিলে বুঝি?
–হুম, আপনি আমার পাশে থাকলে হয়তো আমার এত কষ্ট হতো না।
–তোমায় আর কখনো কষ্ট পেতে দিবো না। সারাজীবন তোমায় এই বুকের মধ্যে আগলে রাখবো।
–মনে থাকে যেনো।
–থাকবে।
.
–ভাবছি দুটো মেয়েকে একসাথে কি করে সামলাবো?
–পুরো একটা পরিবার এক হাতে সামলে নিয়েছো, আর নিজের মেয়েদের পারবে না?
–হুম পারবো তো। কখনো ভেবেছেন আমাদের টুইন হবে?
–ভাবি নি, তবে সখ ছিলো। যদি আমারও টুইন হতো। আজ আমার সখও পূরণ হলো।
–আমায় বেশি বেশি ভালোবাসলে এমন আরো সখ পূরন হবে।
–আচ্ছা? টিম হবে?
–কিসের টিম?
–একটা ফুটবল টিম।
–যাহ শয়তান।
মিষ্টিকে এক টানে বুকে নিয়ে এসে
–বলো, কতটা ভালোবাসতে হবে তোমায়?
–যতটা ভালোবাসলে আপনি সারাক্ষণ আমাকে নিয়ে ভাববেন ততটা।
–এতটা?
–হুম। ৭ মাস যাবত আপনাকে ওতটা কাছে পাইনি। অনেক মিস করছি আপনার ছোয়া। সব উসুল করে নিবো।
–কি মেয়েরে বাবা।
–খুব ভালোবাসি আপনাকে।
–এই পাগলি, কাঁদছো কেনো? আজতো আমাদের খুশির দিন।
–এই বাড়িতে আসার পর আমি কখনো কষ্টে কাঁদিনি, কাঁদতে হয়নি। এতটা সুখ আমার ভাগ্যে ছিলো যে কষ্টের চেয়ে সুখের পরিমানটাই বেড়ে গেছে। কান্নাটা তো আমার অভ্যাস ছিলো, শুধু কান্নার কারনটা বদলেছি। এখন আর কষ্ট পেলে কাঁদি না, খুশিতে কাঁদি। আমি সত্যিই খুব খুশি, একটা মা পেয়েছি, ননদ নামের একটা বোন পেয়েছি। সারাজীবন পাশের থাকার জন্য আপনাকে পেয়েছি। আর কি চাই বলুন তো। আল্লাহর রহমতে আমাদের কোল আলোকিত করে দুটো মেয়ে এলো। বাকি জীবনটা হাসিখুশি কাটানোর কারনটাও পেয়ে গেছি। এবার আপনিই বলুন, কেনো কাঁদবো না?
মিষ্টিকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে নেন মামুন।
সত্যিই তো, ভালোবাসার মানুষটাকে সারাজীবন পাশে পেলে আর কি লাগে? ভালো থাকার জন্য কি এটা যথেষ্ট কারন নয়?
যে মানুষটার কল্পনায় আপনি ছাড়া দ্বিতীয় কারও অস্তিত্ব নেই,
যে মানুষটা হাজারটা বাঁধা বিপত্তি অতিক্রম করে আপনাকে জয় করেছে,
তার চোখে আপনাকে পাওয়ার আনন্দের অশ্রু থাকবেই।
আপনি সারাজীবন তাকেই মন প্রাণ দিয়ে ভালোবাসুন,
যে তার ভালোবাসার শক্তি দিয়ে আপনাকে জয় করেছে।
“বেচে থাকুক ভালোবাসা”
.
.
……..সমাপ্ত………