এক শ্রাবণ হাওয়ায়-২ পর্ব-১০+১১

0
609

#এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়-২
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব -১০
-‘ আমার সামনে এভাবে ঠোঁট কামড়াবে না মিসেস আহি। আমি মানুষটা খারাপ তো, হুটহাট উল্টাপাল্টা কিছু করে ফেলতে পারি৷ গট ইট?’

আতঙ্কে ঠোঁট কামড়ানো বন্ধ করলাম আমি। নিঃশ্বাস ফেলছি ঘনঘন। আনভীর যে আমার এই স্বভাবটি নিয়ে এমন এক মন্তব্য করে বসবেন আমার সেটা ছিলো একেবারেই কল্পনার বাহিরে। আমি আতঙ্কেই মাথা নাড়ালাম এবার। আনভীর সেটা দেখে দরজার পাশে থাকা হ্যাঙ্কার থেকে একটা সাদা তোয়ালে হাতিয়ে নিলেন। কিন্ত দৃষ্টি সরাননি আমার থেকে। আমি তাই আনমনে মাথা নিচু করলাম।
তাৎক্ষণিক ভাবেই আনভীর হাত টেনে কাউচের সামনে নিয়ে আসলেন আময়। নিজে আরামসে কাউচে বসে আমার হাতে তোয়ালে এগিয়ে দিয়ে বলে ওঠলেন,

-‘ কপাল মুছে দাও। ‘

অপ্রতিভ হলাম আমি। মানুষটার জড়ানো কন্ঠ আমার সারা শরীর আবিষ্ট করে ফেলেছে। তাই পুনরায় জিজ্ঞেস করলাম,

-‘ আমি?’

-‘ এখানে তুমি ছাড়া আর কোন বউ আছে আমার?’

এই ‘বউ’ শব্দটিই আমায় স্তব্ধ করতে যথেষ্ট। হৃদয়ের গহীনে জেগে ওঠছে অবিশ্রান্ত কিছু সুক্ষ্ম অনুভূতি। আমি হালকা হাতে উনার হাত থেকে তোয়ালে কেড়ে নিলাম। মুছে দিলাম উনার কপালে, চুলে, গলায় জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম। আনভীর নির্বিকার। উনি এমন এক ধরনের ভাব করছেন যে এসব উনার কাছে স্বাভাবিক। কিন্ত আমার কাছে মোটেও স্বাভাবিক না এগুলো। আমি এবার তোয়ালে টা উনার কাছে দিয়ে চলে যেতে নিলেই উনি বলে ওঠলেন,

-‘ আজকে হসপিটালে যাবে?’

আমি মাথা ওপর নিচ করলাম। বললাম,

-‘ হ্যাঁ, আজকে ফার্স্ট ডে আমার।’

-‘ তাহলে নাহিদকে পাঠিয়ে দেবো তোমার সাথে। ভুলেও একা যাওয়ার প্ল্যানিং করবে না।’

-‘ আপনার……..আপনার না আজ একটা সং রেকর্ড করার কথা?’

বিস্মিত হলেন আনভীর৷ প্রশ্ন ছুঁড়লেন,

-‘ হাউ ডু ইউ নো?’

-‘ আ…আপনিই তো বলেছিলেন গতকালে নাহিদ ভাইয়াকে। তাহলে উনি যেহেতু আপনার সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করছে তাহলে আপনার উনাকে প্রয়োজন পড়বে না? খামোখা আমার পেছনে উনার সময় ব্যয় করে আপনার কাজের ক্ষতি করবেন কেনো?’

ঠোঁট চেপে সরু দৃষ্টিতে তাকালেন আনভীর। বলে ওঠলেন,

– ‘ আমার কাছে ফার্স্ট প্রায়োরিটি তুমি। আর নাহিদকে ছাড়া এতটাই আমি অচল হয়ে পড়বো না যে আমার কাজ হবেনা। তোমায় নাহিদই নিয়ে যাবে আর ও-ই দেখভাল করবে তোমার। বুঝেছো?’

-‘ হুম।’

-‘ আর হ্যাঁ……’

বলে উঠে দাঁড়ালেন কাউচ থেকে। ট্রাউজারের পকেটে হাত গুজে বললেন,

-‘ ওয়ান্স এগেইন আই রিপিট কেউ যেন জানতে না পারে আমাদের ব্যাপারে। এটা জানা মানে মিডিয়াতে ফাঁস হওয়া। যা আমি চাই না।’

কেন জানি কথাটি শুনে প্রচন্ড খারাপ লাগলো আমার। কি এমন হবে আমার কথা সবাইকে জানালে? এখন তো আমাদের দেখে কেউ আর লিভ টুগেদারের ট্যাগ লাগাতে পারবে না। তাহলে?এর মানে কি এটাই দাড়াঁয় যে উনি আমার প্রতি দুর্বল হলেও বিয়ে নামক বন্ধনে আবদ্ধ হতে চাননি? আমার মুখ এমন মলিন দেখে হয়তো কিছু একটা আন্দাজ করতে পেরেছেন আনভীর৷ বললেন,

-‘ যদি আমাদের সত্যটা সবাই জেনে যায় জানো কি হবে? অপূর্ব ঠিকানা পেয়ে যাবে তোমার। আমি ওর মতো কোনো illegal কাজের সাথে জড়িত না যে চাইলেই ওকে প্রতিহত করতে পারবো এসব ব্ল্যাক পাওয়ার দিয়ে।’

আমি মৌনতা বজায় রাখলাম। উনি বললেন,

-‘ ওকে ইউ মে গো নাও। ভাবিকে বলে দিও আমি ব্রেকফাস্ট পরে করে৷ নিবো।’

উনার কথা অনুযায়ী তারপর চলে গেলাম আমি। একপ্রকার দৌড়েই আমি কিচেনে গেলাম। আজরান ভাইয়া আর নাহিদ ভাইয়া ডাইনিং টেবিলে বসে আলাপচারিতা করছিলেন তখন। আমায় দেখে আজরান ভাইয়া বলে ওঠলেন,

-‘ হোয়াট হ্যাপেন্ড আহি? এভাবে দৌঁড় দিলে যে! পেছনে কিছু ধাওয়া করেছে নাকি!’

আমি মিনমিনিয়ে বললাম,

– কিছু না ভাইয়া!

নাহিদ এদিকে মিটমিটিয়ে হাসলেন। বললেন,

-‘ ওহহোওওও! আজরান ভাই বুঝেন না যে কে ধাওয়া করতে পারে?’

করুন চোখে তাকালাম আমি সবার দিকে। মনে হচ্ছে যে আজ সবাই ঘুম থেকে উঠেছে শুধুমাত্র আমায় লজ্জা দেওয়ার জন্য। সবগুলাই একরকম, যেমন ছোট ভাই,অমনই বড় ভাই!

_____________

হসপিটালে প্রথম ওয়ার্ক ডে আজ। সেই হিসেবে দিনটা ভালোই গিয়েছে। বলা বাহুল্য এই হসপিটালটি দেশের অন্যতম কিছু ব্যয়বহুল হসপিটালের মধ্যে একটি। সবার বিশেষ করে আমার মতো মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষদের এখানে খুব একটা ব্যয় বহন করার অবস্থা নেই। তাই বড় বড় নেতা-মন্ত্রী বা অধিক অর্থবান মানুষ বা পাবলিক ফিগার টাইপ মানুষদের আসা যাওয়াটাই এখানে বেশি। সেই সুবাদে এখানকার ডক্টরদের হতে হয় অনেকটাই বেশি অভিজ্ঞ। প্রথমে ইন্টার্নিশিপ, তারপর ট্রেনিং এর সাথে এসিস্ট্যান্ট ডক্টর হিসেবে জয়েন করার পর যদি নিজের নিপুণতা ভালোভাবে প্রদর্শন করতে পারে তবেই আমার এখানে পার্মানেন্ট ডক্টর হিসেবে কাজ ফাইনাল। আর এই জায়গায় সুযোগ পাওয়ার জন্য রাত দিন পরিশ্রম করেছি আমি।

গাড়ি থেকে নামতেই আমার অন্যরকম এক অনুভূতি হলো। আমার এক হাতে এপ্রোন আর ব্যাগের ভেতর স্টেথোস্কোপ সহ আরও প্রয়োজনীয় কিছু যা এখন থেকে হসপিটালের লকারেই থাকাবে। নাহিদ ভাইয়া পাশ থেকে নামলেন এবার। ইশারায় বললেন,

-বেস্ট অফ লাক ফর ইউর ফাস্ট ডে!

আমি মুচকি হেসে চলে গেলাম হসপিটালের ভেতরে। তারপর ডক্টর ধ্রুবের সাথে একে একে ওয়ার্ড চেক, তারপর হসপিটাল অথরিটির সাথে মিটিং এটেন্ড সহ কাজ করতে করতে বেলা পেরিয়ে যায়। কাজ শেষে আমি বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে এলাম হসপিটাল থেকে। নাহিদ ভাইয়া জিজ্ঞেস করলেন,

-‘ দিন কেমন গেলো আপনার?’

-‘ টু মাচ গুড!’

হুট করে মনে পড়লো আনভীরের কথা। ভেবে দেখলাম একবার কল দিবো নাকি! অনেক ভেবেচিন্তেই কল দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম আমি। জিজ্ঞেস করলাম,

– ভাইয়া, আনভীরের নাম্বারটা দিবেন?

নাহিদ ভাইয়া হাসলেন। পকেটের দিকে ইশারা করে বললেন,

-ড্রাইভে আছি তো। পকেট থেকে নিয়ে নাও মোবাইলটা।

আমি মোবাইলটা নিয়ে নাম্বার আমার মোবাইল তুলে কল দিলাম আনভীরকে। বুক দ্রিমদ্রিম করছে উত্তেজনায়। কয়েকবার রিং হওয়া মাত্রই অপরপাশ থেকে ভেসে আসলো এক মেয়ের মিষ্টি কন্ঠ,

-‘ হ্যালো!’

অবাক হলাম আমি। উনার মোবাইলে এটা আবার কে রিসিভ করলো? আমি বললাম,

-‘ হ্যালো, কে আপনি?’

-‘ আগে বলুন আপনি কে?’

মেয়েটার কথা শুনে রাগে শিরশির করে ওঠলো আমার শরীর। কোনোমতে নিজেকে শান্ত করে বললাম,

-‘ এআরকে কে দিন, বলুন আহি কল দিয়েছে। তারপর উনাকেই জিজ্ঞেস করবেন যে আমি কে! ‘

মেয়েটা সাথে সাথেই বললো,

-‘ মি. নাহিদের জায়গায় আমি এআরকের সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করছি মিস অর মিসেস। উনি এখন ব্যস্ত আছেন মিউজিক ডিরেক্টরের সাথে। এখন কথা বলতে পারবেন না, সরি।’

বলেই টুট করে কল কেটে দিলো মেয়েটা। এমন ব্যাবহারে তাজ্জব হয়ে রইলাম আমি। কল কেটে রাগে ফোঁস ফোঁস করতে লাগলাম। ওপর পাশ থেকে সবই শুনছিলেন নাহিদ ভাইয়া। বলে ওঠলেন,

-‘ আজ এআরকে’র খবর আছে!’
.
.
.
.
~চলবে ইনশাআল্লাহ

#এক_শ্রাবণ_হাওয়ায় -২
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব -১১

বাংলোর সামনে নাহিদ ভাইয়া গাড়িটা স্টপ করতেই আমি হনহনিয়ে নেমে গেলাম গাড়ি থেকে। রাগে রীতিমতো কাঁপছে আমার শরীর। নাহিদ ভাইয়া অবশ্য জিজ্ঞেস করেছিলেন,

‘ আপনি কি রেগে আছেন?’

আমি চোখ রাঙিয়ে তাকালাম উনার দিকে। খিটখিটে মেজাজে বলে ওঠলাম,

‘ নাহ! আমি রাগ করবো কেনো? আমি তো ফুরফুরে মেজাজে আছি। কোথাকার না কোথাকার মেয়ে আমার সাথে এমন বিহেভ করলো যে আনভীর তো আর ওই মেয়ের স্যার না, আনভীর ওই রাস্কেলটার বয়ফ্রেন্ড। এমনে তো এআরকে কে আমিই ডাকিনি যেভাবে ওই মেয়েটা ডাকলো।’

‘ উমমমম! পোড়া পোড়া গন্ধ পাচ্ছেন আহি? আমি কিন্তু ঠিকই পাচ্ছি। ‘

নাহিদ ভাইয়ার কথা শুনে আমি বিস্মিত হলাম। আসলেই তো! ওই মেয়ে যাই করুক, আমার কি? আমি আমতা আমতা করে বললাম,

‘ দেখুন না-নাহিদ ভাইয়া, আমার জাস্ট ওই মেয়েটার বেশি ভাব দেখানো টা বেশি ভালোলাগেনি। দ্যাটস ইট। এর বেশি উল্টাপাল্টা কিছু ভাববেন না বলে দিলাম।’

‘ ওকে।’

নাহিদ ভাইয়া কথাটি বলে ওঠলো বেপোরোয়া সুরে। অতঃপর ভেতরে গেলাম আমি। রুমে গিয়ে জানালা খুলে রুমের পর্দা টেনে দিলাম। যদিও এই সোসাইটিতে প্রত্যেকটা বাড়িই নিরাপদ দুরত্ব নিয়ে আছে তবুও রাতে লাইট জ্বালিয়ে পর্দা খোলাটা বিশ্রি ব্যাপার মনে হয় আমার কাছে। আমি ক্লান্তি শ্বাসে খাটে শরীর এগিয়ে দিলাম। বিকেলেই নাকি শিউলি ভাবি, আজরান ভাইয়া চলে গিয়েছে। হসপিটালে যখন আমায় কল দিয়েছিলো তখন আমি বিনয়ের সহিত বলেছিলাম আর কিছুদিন থাকতে। কিন্ত উনারা মানেন নি। এর একটি কারন হলো আনভীর। আনভীর সেই পুরোনো ঘটনাগুলোকে কেন্দ্র করে এখনও নারাজ পুরো পরিবারের ওপর। তাই তাদের থেকে নিজেকে পুরো গুটিয়ে নিয়েছেন তিনি।

আমি এসব ভাবনা ঠেলে ফ্রেস হতে চলে গেলাম ওয়াশরুমে। মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে অজস্র চিন্তা। এর মধ্যে প্রথম হলো যে রাহি আপু কোথায়? আর আনভীরের সাথে এমন কি সম্পর্ক আছে আপুর যে আপু এভাবে উনার ডিসঅর্ডারের ব্যাপারটি উন্মোচন করতে চাচ্ছেন?

আমি গোসল সেরে কিচেনে গেলাম। নুড়ী আপা সবকিছুই রেডি করে রেখেছে। আমি এত দ্রুত ডিনার করিনা তবে করেন আনভীর। আনভীর নিজের হেলথ নিয়ে অনেকটাই বেশি কেয়ারফুল। টাইমমতো খাবার খাওয়া, অয়েলি ফুড এভোয়েড করা, এককথায় বডি ফিট রাখার জন্য যা করা দরকার সবটাই করেন উনি। মাঝে মাঝে অতিরিক্ত নিয়মমাফিক জিনিসটা অতি বিরক্তের লাগে আমার। খাওয়া ব্যাপারটা আনন্দের, এখানে সবসময় সবকিছু মেইনটেইন করে খাওয়াতে আনন্দ কোথায়? আমি ডিনার করলাম না, নুড়ী আপাকে বললাম, মহাশয় বাড়িতে এলে তাকে যথাসময়ে ডিনার দিতে। আমি তারপর রুমে চলে গেলাম।
.
.

সাড়ে দশটা বেজে গিয়েছে প্রায়। এখনও ফিরেননি উনি। না চাইতেই জিনিসটা কেনো যেনো মাথায় চাড়া দিয়ে উঠলো। একবার ভাবলাম আনভীরকে কল দিবো কি-না। যদি আবারও ওই বদ মেয়েটা কল ধরে? আমি কল দিলাম কয়েকবার। কিন্ত একটা বারও কল রিসিভ করলোনা কেউ। না চাইতেও বিষয়টা বিষন্ন করে দিলো আমায়। চুপচাপ গিয়ে গার্ডেনে বসে রইলাম। সুইমিংপুলের ওপর লাইট পড়াতে এক নীলচে প্রতিফলন পড়ছে আমার চোখে মুখে। নুড়ী আপা একবার ডেকে গেলো খাওয়ার জন্য। কিন্ত আমি যাইনি, কেন যাইনি। আমি নিজেও জানি না। এভাবে কিছুক্ষণ বসে থাকতে থাকতেই চোখ লেগে আসলো আমার। কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম গার্ডেনের এই প্রান্তে টেরই পাইনি।
.
.
.
.
‘ আহি! এই আহি! এখানে কি করছো তুমি?’

কানের কাছে কারও সম্মোহনী কন্ঠ ভেসে আসতেই চোখ আস্তে আস্তে খুলতে হলো আমায়। দৃষ্টিটা স্পষ্ট হতেই আবিষ্কার করলাম আনভীরকে। উনি ঝুঁকে আছেন আমার দিকে। নিষ্প্রভ তার দৃষ্টি। সেই সাথে কিছুটা রাগের আভাস। পরক্ষণে ধ্যান ভাঙতেই বুঝতে পারলাম যে এখানেই ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম আমি। উনি থমথমে গলায় বললেন,

‘ এত বড় বাড়ি আমার। আমার বেডে তোমার সুন্দর তুলতুলে একটি জায়গা থাকতে এখানে ঘুমানোর কারন কি?’

আমি কথা বললাম না। আস্তে আস্তে কাউচ থেকে মাথা তুলতেই আমায় চরম মাত্রার অবাক করে চট করে কোলে তুলে নিলেন উনি। আমার চোখ রীতিমতো কপালে উঠলো এবার। গলার স্বর ব্যগ্র করে বলে উঠলাম,

‘ ক….কি করছেন আপনি?’

‘ কেনো? চোখে দেখতে পারছো না তুমি?’

‘ সেটাইতো। আপনি এভাবে……’

আমি কথাটি বলে উনার দিকে তাকাতেই লজ্জায় কাবু হয়ে গেলাম। উনার গহীন চোখে সরু দৃষ্টি নিবদ্ধ আমাতে। ছোট ছোট করে নিঃশ্বাস ফেলাতে ক্রমাগত ওঠানামা করছে বুক আর আমি ভালোমতোই টের পেলাম সেটি। আনভীর কথা বললেন না। আমায় নিয়ে ডাইনিং এর দিকে পা বাড়াতেই আমি অপ্রসন্ন হয়ে বললাম,

‘ ওখানে যেয়েন না প্লিজ। ন…নাহিদ ভাইয়া আছে?’

‘ তো কি হয়েছে। বউকেই তো কোলে নিয়েছি। হোক সেটা চিকনা বাঁশ।’

উনার এ কথায় আপনা-আপনি মুখে রাগ ফুটে উঠলো আমার। মানে সত্যি! উনি….আর আমাকে চিকনা বাঁশ বলছেন? আমি সাথে সাথেই বললাম,

‘ আমার ওজন কম বললেন ভালো কথা, নিজেকে দেখেছেন? আপনার ভারী শরীর আমার ওপর পড়লে আমি তো মরেই যাবো। ‘

হঠাৎ উনার চোখে মুখে একটা বাকা হাসি ফুটে উঠলো৷ কানের কাছে ফিসফিস করে বলে ওঠলেন,

‘ এমন তো নাও হতে পারে। ওয়ানা ট্রাই ইট?’

মানুষটার লাজ লজ্জাহীন কথাগুলো শুনে আর কিছু বলার রইলো না আমার৷ অতএব আনভীর আমায় নিয়ে গেলেন ডাইনিং টেবিলে। যা ভেবেছিলাম তাই-ই হলো। পথিমধ্যে দেখা পেলাম নাহিদ ভাইয়ার। উনি অবাক প্রসন্ন হয়ে প্রশ্ন করলেন,

‘ একি! কি হয়েছে?’

‘ কিছু হয়নি। তুই যা।’

আনভীর এ কথা বলতেই নাহিদ ভাইয়া কিছু না বলে চলে গেলো। উনি ডাইনিং টেবিলে চেয়ারে বসিয়ে দিলেন আমায়। প্লেট এগিয়ে দিয়ে বললেন,

‘ খাওনি কেনো?’

‘ ইচ্ছে হয়নি তাই। আপনার কি তাতে?’

উনি ছোট শ্বাস ত্যাগ করলেন। বললেন,

‘ খাওয়া নিয়ে ঝামেলা আমি পছন্দ করিনা আহি। অলরেডি সাড়ে এগারোটা বাজে। ফটাফট খেয়ে নাও।’

‘ এতক্ষণ তাহলে বাইরে ছিলেন আপনি?’

‘ হ্যাঁ। গান রেকর্ড, তারপর মিউজিক ডিরেক্টরের সাথে কাজ ছিলো। আর এই টাইমে ইন্ডাস্ট্রিতে কাজও থাকে অনেক। কেনো কি হয়েছে?’

‘ কি হবে আবার! কিছু না।’

মিনমিনিয়ে বললাম কথাটি আমি৷ সেই সাথে খাবোনা বলে যেই না উঠে যাচ্ছিলাম ওমনেই আমার হাত টেনে পুনরায় চেয়ারে বসিয়ে দিলেন উনি। আমায় কথা বলতে না দিয়ে চট করেই খাবার তুলে দিলেন মুখে। আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। শরীর হয়ে গিয়েছে প্রতিক্রিয়াহীন। উনি বললেন,

‘ এখন একটা কথা বলবা টাস করে চড় খাবা গালে। বউ হয়েছো তো কি হয়েছে, আদর করতে না পারলেও চড় থাপ্পড় মারতে একমিনিটও ভাববো না।’

উনার গম্ভীর কন্ঠ শুনে আসলেই আমি ভয় পেয়ে গেলাম৷ এই লোক যা, আমায় আসলেই চড় থাপ্পড় মেরে দিতে পারে। আমি এবার খাওয়ার মাঝেই বললাম,

‘ মেয়েটি কে?’

‘ কোন মেয়ে?’

‘ যে আপনার মোবাইলে আমার কল রিসিভ করলো?’

‘ ওহ! আমার সেক্রেটারি। ‘

‘ দুনিয়াতে এত ছেলে থাকতে ওই মেয়েটাকেই নিতে হলো আপনার। নাহিদ ভাইয়াকে আমার লাগবে না। আমি নিজেই নিজেকে প্রোটেক্ট করতে পারবো। কিন্ত ওই মেয়েটাকে আপনার পার্সোনাল কোনো স্টাফ বানাবেন না…’

উনি ভ্রু কুচকালেন। জিজ্ঞেস করলেন,

‘ কেনো?’

‘ রাস্কেল একটা। এমন ভাব করছে যে সে তো আপনার স্টাফ না, যেন সুইট একটা ওয়াইফ!’

ঠোঁট চেপে হাসলেন আনভীর। আমি জিজ্ঞেস করলাম,

‘ কি হলো?’

‘ ভাবছি বউয়ের কাছে তো পাত্তা পাই না। ওই মেয়েটা যদি আমাতে ইন্টেরেস্ট দেখায় সুযোগটা কাজে লাগাই নাহয়…..’

তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলাম আমি। ফট করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম,

‘ ফাইন, তাহলে যান ওই মেয়ের কাছে। ভুলেও আমি আপনার কাছে যাবো না। গুড বাই!’

‘ কোথায় যাচ্ছো।’

‘ আগে যেই রুমে ঘুমাতাম।’

বলেই ওই রুমটিতে চলে গেলাম আমি। রাগে দুঃখে ভীষণ কান্না পাচ্ছে এখন। এই সেলিব্রেটি টাইপরা এমনই হয়। ক্যারেক্টারলেস, আস্ত লুচু। একজন দিয়ে এদের হয়না। এসব ভাবতে ভাবতে চোখের অশ্রু কোনোরকম মুছে বিছানায় শুয়ে পড়বো, আনভীর বিনা অনুমতিতেই ঘরে এসে পড়লেন। এখনও বাইরে থেকে এসে জামা পাল্টায়নি। আমি বললাম,

‘ এখানে এসেছেন কেনো এবার? যান ওই মেয়ের কাছে?’

উনি চাপা হাসি দিয়ে আমার পাশে শুয়ে পড়লেন৷ উনার এহেন কান্ডে শূন্য মস্তিষ্কের হয়ে গেলাম আমি। উনি পিছন থেকে জরিয়ে ধরেছেন আমায়। হাত আমায় কোমড়ে। এবার একটান দিয়ে আমার পিঠ উনার বুকের সাথে মিশিয়ে রাখলেন। আমার কন্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে আসলো এতে। মাথা কাজ করা একেবারেই যেনো বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আমি বললাম,

‘ আপনি….আপনি ক..কি করছেন?’

‘ দেখছো না শুয়ে আছি?’

উনার নির্বিকার কন্ঠ। বাচ্চাদের মতো আহলাদি গলায় বলে ওঠলেন,

‘ ডিস্টার্ব করো না তো! ঘুম পাচ্ছে। ‘

‘ তো এখান ঘুমাচ্ছেন কেনো?’

‘ জানিনা……… ‘

উনার আজব আজব কথায় তাজ্জব না হয়ে পারছি না। উনি এবার জিজ্ঞেস করলেন,

-আহি?

-হুম!

-প্রাঙ্ক করছিলাম তখন। আমার লাইফে তোমার প্রায়োরিটিই ফার্স্ট। বুঝেছো?

আরও কিছু বলছিলেন উনি। কিন্ত আমার শরীর ছিলো প্রচন্ড বেশি ক্লান্ত। একেতো হসপিটালে অনেক ধকল গিয়েছে,,তারওপর কাল সকালে উঠতে হবে। তাই উনার কথা আবছা আবছা শুনেই ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়লাম উনার বাহুডোরে।

_____________

সকালে উঠে নিজেকে আনভীরের রুমে পেলাম। বুঝতে আর বাকি রইলো না যে আমায় এখানে নিয়ে আসার মানুষটি কে। আমি উঠে দ্রুত ফ্রেস হয়ে গার্ডেনের দিকে গেলাম এবার। বাইরে আকাশ পরিষ্কার। নাহিদ ভাইয়া ছোট করে গুড মর্নিং জানালেন আমায়। আমিও জানালাম। তারপর গার্ডেনে গিয়ে দেখি উনার ছোট পেট জীমিকে খাবার দিচ্ছেন উনি৷ ধবধবে সাদা গায়ের রঙ, আমি সেটা দেখে ভয়ে চলে যেতে নিচ্ছিলাম তখনই আনভীর পেছন থেকে বলে ওঠলেন,

‘ এখানে আসো।’

আমি পা চালানো বন্ধ করে দিলাম৷ দ্বিধায় পড়লাম যে যাবো কি-না। অতএব আনভীর বললেন,

– তুমি না চাইলেও আমি তোমায় তুলে এখানে আনতে পারবো আহি।

আমি এবার অনেকটা অনিচ্ছার সাথেই গেলাম উনার কাছে। উনি গার্ডেনের মসৃন ঘাসে বসে আছেন। তীর্যক ভাবে আছড়ে পড়ছে উনার গায়ের ওপর রোদ্দুর। উনার পায়ের কাছে জীমি। উনি এবার বললেন,

‘ ভয় পেয়ো না। আমি আছি তো। ওকে এটা খেতে দাও।’

আমার হাত টেনে আমায় পাশে বসিয়ে দিলেন উনি। কুকুর ছানাটিও আমার কাছে তিরতির করে এসে পড়তেই আমি রীতিমতো মিশে গেলাম আনভীরের সাথে। উনি এবার তীর্যক চোখে তাকালেন আমার দিকে। বলে ওঠলেন,

‘ আগে অলরেডি জড়াজড়ি করে লাফিয়ে আমায় কন্ট্রোললেস করেছো, এবার যদি উল্টাপাল্টা আবার কিছু করো, ট্রাস্ট মি, বড় একটা ভুল হয়ে যেতে পারে। আগেই ওয়ার্ন করে দিলাম আহি!’
.
.
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ