এক শ্রাবণ হাওয়ায়-২ পর্ব-১৪+১৫

0
656

#এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়-২
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব – ১৪
‘ উমমম, মিসেস আহির এভাবে আমার ওপর ঝুঁকে থাকাটা তো স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারছি না। ওয়ানা কিস মি বেবিগার্ল?’

কিয়ৎক্ষণ নির্বাক হয়ে রইলাম আমি। যেন নড়াচড়া করতে পুরোপুরি ভুলে গিয়েছি। আনভীরের চোখে এখনও সন্দেহের ছাপ, ঠোঁটে বিদ্যমান রহস্যময় একটি হাসি। উনার কথাগুলো পুনরায় স্মৃতিচারন হতেই আমার চোখ-মুখ লাল রঙে আবির্ভূত হলো। কে বলবে এই মানুষটা গতকাল মাথা ব্যথায় ছটফট করে আমার কোলে মাথা রেখে নির্বিঘ্নে ঘুমিয়ে ছিলো? উনি এবার বলে ওঠলেন,

‘ আরও কিছুক্ষণ এভাবে থাকবে?’

সাথে সাথেই উনার ওপর থেকে সরে খাটে বসলাম আমি৷ এলোমেলো চুলগুলো অপ্রস্তুতভাবে কাটা দিয়ে আটকে নিলাম। আমার চারপাশে তুমুলভাবে বিরাজ করছে অস্বস্তিকর পরিবেশ। কানের কাছে জলতরঙ্গের মতো উনার একেবারে মাত্রাহীন কথাটি বেজে চলছে৷ আমি আমার দিকে কাত হয়ে তাকালেন এবার৷ বলে উঠলেন,

‘ আমি ঘুমিয়ে থাকলে সবসময়ই কি এমন করো?’

উনার চোখেমুখে সন্দেহের আভাস দেখে আমি বিষম খেলাম। মিনমিনিয়ে প্রতিউত্তর দিলাম,

‘ মোটেও না। আমি, আমি শুধু আপনার তাপমাত্রা চেক করছিলাম।’

উনি কিছু বললেন না এতে। বরাবরের মতোই একধরনের মিহি চাউনি নিক্ষেপ করলেন আমাতে। অতঃপর মুখ হাত ধোয়ার জন্য উঠতেই আমি জিজ্ঞেস করলাম,

‘ এত জলদি উঠছেন কেন আপনি?’

‘ কেন আমার সাথে আরও কিছুক্ষণ টাইম স্পেন্ড করতে চাও?’

উনার কাট কাট কন্ঠে আমি কি বলবো ভেবে পেলাম না। বললাম,

‘ গতকাল তো আপনার কন্ডিশন খুব একটা ভালো ছিলো না, আজকে নাহয় বাসায় রেস্ট নিন? ‘

উনি এবার তাকালেন আমার দিকে। মৃদু ঠোঁট কাঁপিয়ে বললেন,

‘ এমন কিছু হয়নি যে রেস্ট নিতে হবে। আই এম টোটালি ফ্রি এন্ড ফাইন!’

বলেই উনি কাবার্ড থেকে ড্রেস নিয়ে ফ্রেস হতে চলে গেলেন। আমি এবার নিচে চলে গেলাম নুড়ী আপাকে বলতে উনার জন্য ব্রেকফাস্ট বানানোর জন্য।

__________

নুড়ী আপাকে কিচেনে ব্রেকফাস্ট বানানোর কথা বলে গার্ডেনে গেলাম আমি। দেখি নাহিদ ভাইয়া সবেমাত্র জগিং সেরে কাউচে বসে পড়লো আরামসে। আমি উনার কাছে গিয়ে মিহি কন্ঠে বললাম,

‘ গুড মর্নিং!’

‘ গুড মর্নিং ভাবি!’

‘ভাবি’ ডাকটি শুনে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে থাকতে হলো আমায়৷ নাহিদ ভাইয়ার কোনো ভাবান্তর, নেই। উনি বসে পায়ের স্পোর্টস সু খুলতে মগ্ন হয়ে পড়েছেন৷ আমি চোখজোড়া বড় বড় করে জিজ্ঞেস করলাম,

‘ আপনি আমায় ভাবি বললেন কেনো?’

‘ এআরকে’র ওয়াইফ হলে সম্পর্কে তো আপনি আমার ভাবিই হোন!’

আমি দুষ্ট হাসি দিলাম এবার। ঠোঁট কামড়ে জিজ্ঞেস করলাম,

‘ আনভীরের গতকালকের ঝাড়িতে ভয় পেয়ে গেলেন মিঃ নাহিদ রেজওয়ান? দিস ইজ নট ফেয়ার!’

আমার কথা শুনে নাহিদ ভাইয়া দাঁতে দাঁত চেপে তাকালেন আমার দিকে। পারছেন না শুধু আনভীরের ভয়ে আমায় উল্টাপাল্টা কিছু কথা শুনিয়ে দিতে। আমিও সুযোগটার সৎ ব্যবহার করলাম তাই। বললাম,

‘ আর কতদিন উনার ভয়ে আমারে ভাবি ডাকবেন! এবার আনভীরের জন্যও একটা ভাবি নিয়ে আসেন?’

‘ সময় হলে ভাবি আনবো ইনশাআল্লাহ, আপনার তা ভাবতে হবে না। এখন কৃপা করিয়া আপনার বরের কাছে যাবেন বেগম? অন্যথায় আপনার বরসাহেব যদি তার বেগমকে আমার মতো অবলা বান্দাকে গল্প করতে দেখে তাইলে আজ আমার কানের নিচে ঠাসিয়ে কয়েকটা মারবে।’

‘ যাবো, তবে একটা শর্তে!’

উনি পুনরায় তাকালেন আমার দিকে। জিজ্ঞেস করলেন,

‘ কি শর্ত?’

‘ ওই ডায়নীটা, আই মিন উনার বর্তমানে যেই সেক্রেটারি আছে সেটার জায়গায় আপনি আবার ফিরে যান। এতদিন তো আপনিই ছিলেন, এখন ওই উড়ে এসে জুড়ে বসা মেয়েটাকে কিছুতেই আপনার জায়গা আমি নিতে দিবো না, বুঝেছেন?’

নাহিদ ভাইয়া খুব ভালোমতোই জানেন যে কেনো আমি উনাকে ফিরে যেতে বলেছি। বলা বাহুল্য একটু আগে আমি যা যা বললাম সেগুলো সব বাহানা মাত্র। নাহিদ ভাইয়া তপ্তশ্বাস ছাড়লেন। বলে ওঠলেন,

‘ উনি যেহেতু এখন বলেছে আমাকে আপনার দেখাশোনা করতে হবে আমি তাই এক পাও উনার কথার হেলফেল করতে পারবো না৷ ওই কথা ভুলে যান, যতদিন এআরকে আমায় না বলছে ততদিন আমি যাচ্ছি না।’

রাগে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলাম আমি। ভদ্রতার খাতিরে শুধু পারছি না এই ছেলেটাকে পানিতে ছুঁড়ে মারতে। আমি ঝুকে এলাম উনার দিকে। দৃষ্টি প্রগাঢ় করে বললাম,

‘ তাহলে শুনুন, আপনি যদি আমার কথা না শুনেন আমি খুন করে ফেলবো আপনার৷ ওই ডাইনীটা সারাক্ষণ আনভীরের পাশে ঘুরঘুর করবে এটা দু-চোখে সহ্য করতে পারবো না আমি। আমার কথা আপনাকে তাই শুনতে হবে বুঝেছেন? একটা কথা অমান্য করবেন, ডিরেক্ট আনভীর মহাশয়ের কাছে বিচার। আর উনি যে আপানর সাথে কি করতে পারেন সেটা তো আপনারই ভালো জানা আছে।’

বলেই আমি একটা শয়তানী হাসি দিলাম। বেচারা নাহিদ ভাইয়া একেবারেই চুপসে গিয়েছে। উনি হয়তে ভাবতেও পারেননি আমি উনাকে এত অসহায় বানিয়ে ফেলবো। তাই দাঁতে দাঁত চেপে বলে ওঠলেন,

‘ আপনারা দুই মিস্টার মিসেস আমারে পাগল বানিয়ে ফেলছেন আস্তে আস্তে৷ উফফ!’

___________

আনভীর ব্লু জিন্স আর গ্রে শার্ট পড়েছেন আজ। শার্টের কলারে ঝুলছে একটি কালো রঙের চশমা। উনার একজন পার্সোনাল গার্ড যে সবসময়ই উনার আশপাশে ঘুরঘুর করে সে আপাদত দাঁড়িয়ে আছে দরজার কাছে। আনভীর ব্যাক্তিগতভাবে এসব গার্ড নিয়ে ঘোরাফিরা করতে অস্বস্তিবোধ করেন। তবে এই কাজটি করেছেন উনার বাবা। লন্ডন থেকে বাংলাদেশে আসার পরপর আজ পর্যন্ত গার্ড ছাড়া বাইরে বের হতে পারেননি আনভীর। আমি জানিনা এর কারন কি। তবে উনি যেহেতু এত বড় একজন সিঙ্গার, তাই গার্ড নিয়ে ঘোরাফেরা করাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।

আজকে নাহিদ ভাইয়ার মনটাও ফুরফুরে, অনেকদিন পর এআরকে’র সাথে ‘স্টার হিট’ এ যাচ্ছেন উনি। যদিও সেটা শুধু সাময়িক সময়ের জন্য। কেননা আনভীর স্পষ্টভাষায় বলে দিয়েছেন যে নাহিদ যদি কোনোভাবে আমার ওপর দেখভালের দায়িত্ব থেকে চোখ সরিয়ে নেয় তবে উনার কপালে শনি আছে। এতেই নাহিদ ভাইয়া চুপ।

আমি ডাইনিং টেবিলে বসে ব্রেকফাস্ট করছিলাম ওমন সময়ে আনভীরকে আমার সামনে বসতে দেখে অবাক হলাম আমি। আনভীর গলা উঁচিয়ে নুড়ী আপাকে বললেন,

‘ আজকে খাবার এখানে খাবো আপা। আমায় এখানে দাও।’

আমার বিস্ময়ের অবকাশ রইলো না। কেননা এ পর্যন্ত কখনোই আমার সাথে খাবার খাননি আনভীর। হয়তো উনার রুমে খেয়েছেন বা ওই রুমটাতে যেখানে সবার যাওয়া মানা। আমায় তাকিয়ে থাকতে দেখে আনভীর বলে ওঠলেন,

‘ আপাদত ব্রেকফাস্ট খাও মিসেস আহি। আমায় খাওয়ার জন্য যথেষ্ট টাইম আছে।’

একথাটি শুনে আমি ভীমড়ি খেলাম। খাওয়া রীতিমতো গলায় আটকে গিয়েছে। ক্রুদ্ধ গলায় বললাম,

‘ নিজেকে প্রিসিয়াস কিং ভাববেন না এআরকে। আমি শুধু দেখছিলাম যে…’

‘ আমি হ্যান্ডসাম, তাইতো?’

ইচ্ছে হলো এই লোকটার মাথায় প্লেটের সব খাবার ঢেলে দেই। আমায় কথার মাঝে উনি এমন সব কথা বলেন যে স্তব্ধ না হয়ে আমি যেন পারিনা।তাই বললাম,

‘ আপনার ধারনা ভুল মিস্টার। আপনি আজ এখানে ব্রেকফাস্ট করছেন যে? এমনিতে তো ভুতের মতো রুমে খাবার খান। আজ এখানে এলেন যে!’

উনি আহাজারি কন্ঠে বললাম,

‘ আগে সিঙ্গেল লাইফ লিড করতাম তো! একা একা টেবিলে খেতে কষ্ট হতো। এখন ভাবছি বউ আছে, তাই কষ্ট করে আলাদা খাবো কেনো?’

আমার কথা শুনে মিটমিটিয়ে হাসলেন নাহিদ ভাইয়া৷ পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা এক্সপ্রেশনলেস গার্ডের ঠোঁটকোলেও যখন আমি রম্য হাসি দেখলাম আমার গা রি রি করে উঠলে অস্বস্তিতে। এই লোকটা আস্ত অসভ্য। কখন, কিভাবে, কি ধরনের কথা বলা উচিত পরোয়ার লেশমাত্র নেই। নুড়ী আপা প্লেট আনতেই আনভীর আর কথা বললেন না৷ খাওয়ার শেষে আনভীর নুড়ী আপাকে বললেন,

‘ আজকে বাসায় এসে আপনাকে একটা ডায়েট চার্ট দিবো। নেক্সট টাইম থেকে ওই অনুযায়ী খাবার রেডি করবেন। আমার নেক্সট কাজের জন্য ওয়েট একটু কমাতে বলেছে ইন্ডাস্ট্রি থেকে।’

আমি শুধু চুপচাপ শুনলাম। আনভীর এবার আমার দিকে তাকিয়ে ডাক দিলেন,

‘আহি!’

‘ জ্বি? ‘

‘ আজকে হসপিটালের যেতে হবে না তোমায়?’

অবাক হলাম আমি। বুঝে উঠলাম না হঠাৎ যেতে না বললেন কেন। আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই উনি বললেন,

‘ আপাদত প্রশ্ন করবে না কেনো? আমি যেহেতু না করেছি, না মানে না। নাহিদ হসপিটালে জানিয়ে দেবে আজকে।’

আমায় কথা বলতে না দিয়ে উনি উঠে দাঁড়ালেন। আমার চোখে একটি নির্বাক দৃষ্টি স্থাপন করে চলে গেলেন নাহিদ ভাইয়ার সাথে। আমি চুপ হয়ে রইলাম। সমীকরণ মিলাতে কষ্ট হচ্ছে উনার হঠাৎ না করার কারন কি।

_________________

তপ্ত রৌদ্দুরের আলোয় খা খা করছে চারিপাশ। যেদিকেই তাকানো যায় সেদিকে শুধু দেখা যাবে ব্যস্ত মানুষ। অপূর্ব ঘড়ি দেখছে আর অপেক্ষা করছে কাঙ্ক্ষিত মানুষটার। যদিও সময় হয়নি এখনও। তবুও কৌতুহল ওকে এতটাই বশভূত করেছে যে ও সময়ের আগে না এসে পারেনি।

অপূর্ব একাই এসেছে আজ। অন্যসময় হলে চার পাঁচ সাঙ্গপাঙ্গ সবসময়ই থাকতো অপূর্বের সাথে। কিন্ত এবার আনতে পারেনি। কারন যার সাথে দেখা করতে এসেছে তার সাফ নিষেধ। যদিও অপূর্ব কখনোই কারও কথা শুনে না। কিন্ত এবার শুনলো। অনেকটা বাধ্য হয়েই শুনলো। এই লোক যমদেবতার মতো ওর পিছে পড়ে আছে আর তাকে যতটা সাধারন অপূর্ব ভেবেছিলো অতটাও সাধারন সে না।

অপূর্ব এসব ভাবতে ভাবতে আবারও ঘড়ির কাটায় তাকিয়ে দেখলো চারটা বেজে গিয়েছে। এরই মধ্যে রেস্টুরেন্টের দরজা খুলে প্রবেশ করলো একজন। একেতো ইন্ডাস্ট্রিয়াল এলাকা তার ওপর লাঞ্চ টাইম শেষ হওয়ার কারনে মানুষ কেউ নেই৷ আর তাই এ মানুষটাকে দেখে বুঝতে বাকি রইলো না যে কে হতে পারে। কেননা আসার আগে তার সম্পর্কে পুরো ঘাটাঘাটি করে এসেছে ও।

আগন্তুকটা এসে ঠিক বসে পড়লো অপূর্বের বরাবর৷ প্রলুব্ধকর চাউনি, যা সহজেই কাউকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম। সে মাক্স খুলতে খুলতে বললো,

‘ দেরি হয়ে গেলো নাকি মি.অপূর্ব?’

‘ না।’

আগন্তুকটা সামান্য হাসলো। বলে উঠলো,

‘ আপনি আমার জন্য এতক্ষণ ওয়েট করবেন ভাবতে পারিনি। প্রথমেই সরি লেট করে রিপ্লাই করার জন্য। আসলে ইন্ডাস্ট্রিতে কিছু কাজ ছিলো আমার৷ সেগুলো ম্যানেজ করা কতটাই হার্ড, বুঝতেই পারছেন।’

অপূর্ব মিহি হাসলো। এবার সিরিয়াস হলো আগন্তুকটা। হাতের আঙুল নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

‘ তো বলুন! রকস্টার এআরকে’র কাছে আপানর কি দরকার মি.অপূর্ব হাসান?’
.
.
.
.
.
~চলবে ইনশাআল্লাহ

ভুলক্রটি মার্জনীয়।

#এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়-২
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব – ১৫
‘ তো বলুন! এআরকে’র কাছে আপানর কি দরকার মি.অপূর্ব হাসান?’

আনভীরের আগ্রাসী কন্ঠে দৃষ্টি প্রগাঢ় হলো অপূর্বের। বিক্ষিপ্ত চোখজোড়া আনমনেই বিচরণ করে চললো সামনে বসা এই রহস্যময় মানুষটির দিকে। অপূর্ব হাসলো কিঞ্চিত। ঠোঁট নাড়িয়ে বললো,

‘ কেন আপনি জানেন না?’

আনভীর যেন বাকিয়ে কথা বলার আরও সুযোগ পেয়ে গেলো এতে। অবুঝ হওয়ার ভান করে বলে উঠলো,

‘ উমমম, যতটুকু আমার মনে পড়ে আপনি এ পর্যন্ত একবারও বলেননি যে আপনি কেন আমার সাথে দেখা করতে চেয়েছেন। তো আমি জানবো কিভাবে বলুন তো!’

অপ্রতিভ হয়ে পড়লো অপূর্ব। চোখের নজর এখনও সরায়নি আনভীরের কাছ থেকে।আনভীরের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। হাতে কালো সানগ্লাসটি নিয়ে আনমনে খেলা করে চললো সে। কপালের সিল্কি চুলগুলো এই মানুষটিকে আরও যেন সুদর্শন করে তুলেছে। অপূর্ব এবার বলে ওঠলো,

‘ আমি সরাসরি কথা বলতে পছন্দ করি এআরকে। তাই সরাসরিই কথা বলছি, কেন আমার পিছে পড়েছেন?’

আনভীর হাসলো। যেন অপূর্ব কোনো মজার কথা বলেছে। বলে উঠলো,

‘ ওএমজি! আমি কি ‘গে’ নাকি যে ছেলে হয়ে আপনার পিছে ঘুরবো? মানছি আপনি কোনো সাধারন টাইপ মানুষ না। অফটার অল এত বড় বিজনেস আছে আপনাদের। তাই বলে এভাবে আমি আপনার পিছে ঘুরবো?’

অপূর্বের ক্রুব্ধতা ধীরে ধীরে বেড়ে যাচ্ছে সামনে বসা মানুষটার বেসামাল কথাতে। দাঁতে দাঁত পিষে বলে উঠলো,

‘ ঠাট্টা করা আমি অপছন্দ করি।’

‘ হা হা হা! সেম টু ইউ। এন্ড আই এম সিরিসয়াস। আমি মেয়ে হলে আপনার পিছে ঘুরতাম সত্যি। তাই বলে ছেলে হওয়া সত্বেও এভাবে বলতে পারলেন?’

অপূর্ব নিঃশ্বাস ফেললো। বলে উঠলো,

‘ আপনার সেক্রেটারি নাহিদ রেজওয়ান আমার সব খবর কালেক্ট করা চেষ্টা করছে। এন্ড সেটা কেনো, আমি জানিনা। তাই ওয়ার্নিং দিয়ে গেলাম রকস্টার! আমার রাস্তা থেকে যতটা দূরে থাকবেন ততই আপনার মঙ্গল। আপনি সিঙ্গার, গান করবেন, ফ্যানদের ভালোবাসা নিয়ে মেতে থাকবেন, লাইফ ইন্জয় করবেন। আমার সঙ্গে শত্রুতা করতে আসছেন কেনো?’

আনভীর আলতো হেসে বলে উঠলো,

‘ আমার খুব কাছের একটা জিনিস আপনার সাথে রিলেটেড তাই।’

আনভীরের এই কথাতে একটা রহস্যময়তা আছে। ক্রমেই সেটা আন্দাজ করতে পারলো অপূর্ব। ভ্রু জোড়া কুচকে এসেছে ওর। আনভীরকে যতটা সহজভাবে ও নেওয়ার চেষ্টা করছে ততটা সহজ আনভীর না। অপূর্ব দৃষ্টি আরও গভীর করলো এবার৷ ঠোঁটজোড়া চেপে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। মৌনতা কাটিয়ে বলে উঠলো,

‘ ক্লিয়ারলি বলেন তো এআরকে, কি চান আপনি?’

আনভীর প্রসন্ন হলেন। বললেন,

‘ আহিকে ছেড়ে দাও।’

অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গিয়েছে অপূর্ব। ও ভাবতেও পারেনি যে এভাবে একজন রকস্টারের মুখে আহির কথা ও শুনতে পারবে। অপূর্ব থমথমে গলায় জিজ্ঞেস করলো,

‘ কোথায় আহি?’

‘ যেখানেই থাকুক, ইউ ডোন্ট হ্যাভ রাইট টু নো অ্যাবাউট দ্যাট।’

আনভীরের স্থির কন্ঠ। অপূর্ব যেন না হেসে পারলো না। বলে উঠলো,

‘ আহি ধুরন্দর আমি জানতাম বাট এতটাই ধুরন্দর সেটা তো আমি ভাবতেও পারিনি। শেষমেষ রূপের আগুনে একজন রকস্টারকে পটিয়ে ফেললো?’

আনভীর এতক্ষণ মজার ছলে থাকলেও অপূর্বের শেষ কথাগুলো শুনে চোয়াল শক্ত করে ফেললো। বলে উঠলো,

‘ নেক্সট টাইম এ কথাগুলো বলার সময় দশবার ভাববেন অপূর্ব। আহি আর আগের মতো একা নেই যে আপনি আর ওর সো কলড বাবা কাঠপুতুলের মতো যা করতে বলবে তাই করবে। আপনার ব্যবস্থা তো করবোই, সেই সাথে রাহিরও করবো৷ আর হ্যাঁ….’

এই বলে অপূর্বের দিকে শরীরটা এগিয়ে দিলো আনভীর। ঠোঁটে একচিলতে রহস্যময় হাসি। বলে উঠলো,

‘ আহির সাথে যেই আচরণগুলো করেছেন, সেগুলোর প্রত্যকেটার হিসাব আমি খাতায় তুলে রেখেছি৷ একটা মা হারা মেয়ের প্রতি আপনি যেই জেদ প্রকাশ করেছেন, সেগুলোর প্রত্যেকটার শাস্তি আপনি পাবেন।’

অপূর্বের শরীরে এবার এক অন্যরকম শিহরণ বয়ে যেতে থাকলো এমন ঠান্ডা থ্রেড শুনে। গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো,

‘ সত্যি করে বলেনতো, আপনি কে হন আহির?’

আনভীর বাকা হেসে বললেন,

‘ সেটা নাহয় সময় পেলেই টের পাবেন!’

বলেই আনভীর হাতের ঘড়িতে টাইম দেখে চলে গেলো এখান থেকে। মুখে বরাবরের মতো পড়ে নিলো কালো রঙের মাস্ক। যাওয়ার আগে একপলক গহীন চোখে দেখে নিলো অপূর্বকে। এই প্রথম অপূর্বের চেহারায় পড়লো দুশ্চিন্তার ছায়া। এই ছেলেটার কথাবার্তা এত সহজ নয়। অন্য চারপাঁচ জন পলিটিশিয়ান বা সেলিব্রেটিদের মতো একে বড় অঙ্কের টাকা দিয়ে হাতিয়ে নেয়া অসম্ভব। অপূর্বের মাথাটি হাজারো অজানা প্রশ্নের তাড়নায় ভো ভো করছে। যতদ্রুত সম্ভব এগুলোর উত্তর খুঁজে বের করতেই হবে। খোঁজ নিতে হবে যে একজন রকস্টার ছাড়াও আনভীর মানুষটার কি সম্পর্ক আহির সাথে।

_______________

বাড়িতে আজকে বড্ড বোর হচ্ছি আমি। কথা নাই-কাজ নাই হুট করে আনভীর বললো, আজ হসপিটাল যেতে হবে না। কেনো বলেছে কে জানে?
এখন সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে প্রায়৷ জানালা দিয়ে তাকালেই দেখা যাবে ব্যস্ত নগরীর মাঝে নীরব-নিভৃত একটি দৃশ্য। ঢাকার শহরে এমন স্থানে থাকার সৌভাগ্য হয়তো সবার নেই বললেই চলে। তবে আনভীর যেহেতু একটু গম্ভীর ধরনের, তাই একা থাকতেই খুব বেশি পছন্দ করেন। বিষয়টা একটু খারাপ লাগে আমার৷ উনার মা-বাবা, ভাই-ভাবি সবাই আছে। তবুও পুরোনো ঘটনাগুলোকে কেন্দ্র করে যদি এভাবে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন রাখে তবে এটা বোকামি ছাড়া কিছুই না। আমি জানি একটি পরিবারের মূল্য কি, কারন আমি এসব ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়েছিলাম। মাঝে মাঝে আমার চারপাশের সবকিছুকে কেমন যেন বিষাক্ত লাগে। মনে হয় আমার সঙ্গে সবকিছু হচ্ছে এক প্রহেলিকাময় স্বপ্নের মতো। আচ্ছা, আমি যেই রাহি আপুকে এতদিন চিনে এসেছি সে কি সত্যিই বিশ্বাসযোগ্য না? আনভীরই কি সত্য বলছিলেন যে আপু আসলে আমায় ব্যবহার করে কিছু একটা হাসিল করতে চেয়েছে?

আমার এসব ভাবনার মাঝেই দরজা খুলে প্রবেশ করলেন কেউ। রুমটা অন্ধকার ছিলো। আমি চুপচাপ বসে ছিলাম বারান্দায়। কারও উপস্থিতি টের পেয়ে আমি একটু নড়েচড়ে বসলাম। যদিও আমি জানি মানুষটি কে।

আনভীর আমায় খুঁজতে খুঁজতে বারান্দায় এসে পড়েছেন এবার। চোখে হালকা সন্দেহের ছাপ। আমি মলিন কন্ঠে বললাম,

‘ টেনশন করবেন না। পালিয়ে যাইনি আমি।’

কথাটি আমি একটু অভিমান করেই বলেছিলাম। কেননা আমি অতীষ্ঠ হয়ে উঠেছিলাম এভাবে বন্দীজীবন কাটিয়ে। আগে অপূর্ব ভাইয়ার, আর এখন আনভীরের। বিগত এতগুলো জীবন সবার কথার উঠবস করতে করতে অতীষ্ঠ হয়ে পড়েছি আমি। সবকিছু বিষাক্ত লাগছে কেমন যেন। আনভীর আমার পাশে দাঁড়ালেন। আলতো ভাবে হাত স্পর্শ করতেই তৎক্ষনাৎ হাত সরিয়ে ফেললাম আমি। চিৎকার করে বলে উঠলাম,

‘ ডোন্ট টাচ মি। আপনার কোনো রাইট নেই আমায় টাচ করার।’

আমার কথায় নির্বিকার রইলেন আনভীর। যেন জানতেন আমি এমন ব্যবহারই করবো। তাই শান্ত নয়নে পরখ করে চলছেন আমাকে। তারপর বলে উঠলেন,

‘ শান্ত হও আহি, আমি এমন কোনো ভুল করিনি যে এভাবে ক্ষেপে যাচ্ছো।’

‘ ও তাই নাকি?’

তাচ্ছিল্যের হাসি দিলাম আমি। বললাম,

‘ তাহলে কি করেছেন আপনি? আমায় কিছু লেইম এক্সকিউজ দেখিয়ে জোরপূর্বক আমায় নিয়ে আসলেন, আমি চুপ থাকলাম। আমায় আপনার ফ্যামিলির চাপে পড়ে বিয়ে করলেন তখনও আমি চুপ থাকলাম। কেন জানেন? আমার ধারনা হয়েছিলো, রাহি আপুর কারনেই হোক! আপনি ভালোবাসেন আমাকে। আমার জন্য কিছু একটা ফিল করেন। সেদিন রাতে আমার জন্য আপনার করা পাগলামিটা আরও গভীরভাবে আমি দেখতে পেয়েছিলাম আনভীর।
কিন্ত এখন আমার মনে হচ্ছে যে আমি ভুল।।কেননা আপনি এখনও প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক যে আমি আপনার ওয়াইফ। আমায় দিনের তিনভাগের একভাগ ঘরবন্দী করে রাখা, এখানে না যাওয়া-ওখানে না যাওয়া এগুলো দ্বারা কি বুঝবো আমি? জানেন! অপূর্ব ভাইয়াও আমায় এভাবে ঘরবন্দী বানিয়ে রাখতো। পার্থক্য শুধু একটাই, আপনি কখনোই আমার গায়ে হাত তুলেননি। কিন্ত যেটা অপূর্ব…. ‘

এতগুলো বলেই থামলাম আমি নিঃশ্বাস ফেলতে থাকলাম ঘনঘন৷ আনভীর এখনও চুপ করে শুনছে আমার কথা। আমি এবার কাতর কন্ঠে বলে বললাম,

‘ আমি বাঁচতে চাই আনভীর। একটা হ্যাপি লাইফ লিড করতে চাই। আমি অপূর্ব ভাইয়ের ভয়ে লুকিয়ে থাকতে চাই না। চাইনা আপনার পাগলামিগুলো মানুষের কাছে তুলে ধরতে। যদি অপূর্ব ভাইয়ার মতো আপনিও আমায় নিজের পাগলামি মনে করেন তাহলে আমি নিজে থেকে আপনার কাছ থেকে দূর….’

আমায় আর বলতে দিলেন না আনভীর। হঠাৎ আমার কোমড় চেপে নিজের কাছে নিয়ে আসাতে আমি অবাক হয়ে গেলাম৷ আনভীর একটা তপ্তশ্বাস ছেড়ে মৃদুভাবে নিজের ঠোঁটজোড়া দ্বারা স্পর্শ করলেন আমার ঠোঁটে। কিয়ৎপ্রহরের জন্য আমি পাথর হয়ে রইলাম। কি করা উচিত আমি যেন ভুলে গিয়েছি। আনভীর এবার প্রলুব্ধকর চাহিনী নিক্ষেপ করলেন আমাতে। বলে ওঠলেন,

‘ আমার থেকে দূরে যাওয়ার কথা নেক্সট টাইম মাথায়ও আনবে না তুমি? তুমি কি বোকা? বাচ্চা মেয়ে যে বুঝোনা কেনো আমার মতো একজন মানুষ তোমার পিছে পড়েছে? তোমায় তোমার অতীত থেকে নিয়ে আসছে? শুনতে চাও তো যে আমি এমন করছি কেনো? তাহলে শুনো৷ আই এম ম্যাডলি লাভ উইথ ইউ আহি। আজ থেকে না। তবে কবে থেকে আমি জানি না। রাহি শুধুমাত্র একটি বাহানা। আমি তোমায় ভালোবাসি আর এটাই সব কিছুর মূল। যা করছি সব কিছু করছি তোমায় পাওয়ার জন্য। এবং তোমায় নিজের কাছে রাখার জন্য অপূর্ব থেকেও আমি ভয়ঙ্কর হতে পারি। ‘

বলেই উনি আমার গলায় মুখ গুঁজে ফেললেন এবার। এতক্ষণ আমার জমে থাকা চোখের অশ্রু পাগলের মতো মুছে ফেললেন। অস্থির লাগছে উনাকে। যেন আমার কথায় প্রচন্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন৷ আমার ঠোঁটকোলে তখনও একটা হাসি ফুটে উঠলো উনার বাচ্চাসুলভ কর্মকান্ড দেখে।
.
.
.
.
~চলবে ইনশাআল্লাহ