#এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়-২
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব – ১৬
ফুরফুরে বাতাসের ফিসফিসানো শব্দ সম্মোহিত করে ফেলেছে আমায়৷ আশপাশের পরিবেশ জানান দেয় এখন দিনের প্রথমভাগ। আজ প্রভাতটা সুন্দর। অন্যান্য দিনের মতো সাধারন হলেও আমার কাছে কেনো যেনো ছোট থেকেও ছোট জিনিস অসাধারন লাগছে। আমি বারান্দায় বসে আনভীরের ছোটোবেলার ছবির অ্যালবাম দেখছি মনোযোগ দিয়ে।
ছোটোবেলার বললে ভুল হবে, এখানে সব উনার কিশোরকালের ছবিগুলো সংরক্ষিত যখন উনি লন্ডনে পাড়ি জমান। আমি প্রত্যেকটা ছবি মনোযোগ দিয়ে দেখছি৷ এখনকার মতো ছোটবেলাতেও চুপচাপ ছিলেন খুব, তবে ঠোঁটে বিদ্যমান ছিলো এক অকৃত্রিম সুন্দর হাসি।
আমি পাতা উল্টালাম। সেখানে দেখা যাচ্ছে উনার গিটার বাজানোর একটা ছবি। নিচে কার্সিভ লেটারে লিখা ‘ব্যাকিংহাম রোড’। ফল সিজন থাকার কারনে উনার ছবিগুলো আরও প্রাণবন্ত মনে হচ্ছিলো। এভাবেই একে একে দেখলাম উনার ডর্মে থাকাকালীন ছবি, ইডেনবার্গের ট্যুরের ছবি, হাই স্কুল গ্রাজুয়েশন তারপর ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে তোলা কিছু ছবি; নিঃসন্দেহে বলা যাবে যে অভিজ্ঞতা প্রতিটা ক্ষেত্রে অর্জন করেছেন উনি।
কিন্ত আমি অ্যালবাম ঘাটছিলাম অন্য কোনো কারনে। জানতে চেয়েছিলাম উনার অতীত। কিন্ত এখানে উল্লেখযোগ্য তেমন কিছুই পাইনি আমি। পরক্ষণেই ভাবলাম, কি দরকার উনার অতীত নিয়ে ঘাটার? উনি তো আমার বর্তমান এবং ভবিষ্যত সব। বিগত কিছুদিনে ছোট থেকে ছোট বিষয় দ্বারা উনি প্রকাশ করেছেন যে আনভীরের জীবনে আমার প্রভাব ঠিক কতটুকু।
শীতল হাওয়া আবিষ্ট করে ফেলেছে আমায়। পাশেই পড়ে আছে আনভীরের একটা ভায়োলিন৷ গতকাল হুট করে উনার ভায়োলিন বাজানোর ইচ্ছে হয়েছিলো। আমিও কৌতুহলের সাথে শুনেছিলাম সেটার প্রতিটি সুর। আনভীর বলেছিলেন,
এই ভায়োলিন উনার ইউনিভার্সিটি লাইফের কথা মনে করিয়ে দেয়। প্রায়ই উনি রাতে ডর্ম থেকে ফাঁকি দিয়ে টপকে চলে যেতেন কাছাকাছি একটা পার্কে। ক্যামব্রিজ যেহেতু বিশাল এলাকা ছিলো তাই সেকিউরিটি ফাঁকি দেওয়াটা কষ্টকর হলেও অসাধ্য কিছু ছিলো না।
এভাবেই গতকাল কতক্ষণ কথাবার্তা চলছিলো জানিনা। সকালে চোখ খুলতেই আমি নিজেকে পেয়েছিলাম বিছনায়। এই কাজ যে কে করেছেন সেটা নিয়ে আর সন্দেহ ছিলো না আমার৷ বারান্দা থেকে রুমের ভেতরে গিয়ে অ্যালবামটা আমি সন্তর্পণে রেখে দিলাম কাচের শেলফটিতে৷ ঘুম থেকে ফ্রেস হয়েছি অনেকক্ষণ হলো কিন্ত এখনও কিছু না খাওয়াতে ক্ষুধায় পেট চো চো করছিলো।
আমি নিচে গিয়েই দেখলাম নাহিদ ভাইয়া ব্রেকফাস্ট করছে টেবিলে। আমি চমকে গেলাম। টাইম অনুয়ায়ী আজ আনভীরের একটা সেমিনার ছিলো বেস্ট্রো অডিটোরিয়ামে। তাহলে উনি এখানে কেনো? আমায় এভাবে উজবুকের মতো তাকিয়ে থাকতে দেখে ভড়কে গেলেন নাহিদ ভাইয়া। কোনোমতে ব্রেডটা মুখে নিয়ে বলে ওঠলেন,
‘ এভাবে তাকাচ্ছেন কেনো ভাবি? পেট খারাপ হবে তো আমার।’
নাহিদ ভাইয়ার অপ্রাসঙ্গিক কথার পরোয়া করলাম না আমি। সন্দিহান চোখে বললাম,
‘ এভাবে ষাড়ের মতো আজগুবি কথা না বলে বলুন এখানে কি করছেন?’
অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো নাহিদ ভাইয়া। হয়তে নিজেকেই প্রশ্ন করছে যে এটাই তো তার আপাতত বাসস্থান। তবে আমি কিসের কথা বলছি? নাহিদ ভাইয়া এবার বললেন,
‘ দেখছেন না খাচ্ছি?’
‘ তা তো আমিও দেখছি। কিন্ত এখানে কেনো? আপনার না আনভীরের সাথে যাওয়ার কথা?’
‘ হ্যাঁ কিন্ত!’
‘ কিন্ত কি? আপনি আবার উনাকে একা ছেড়েছেন? আপনাকে না বলেছি উনাকে একা কোথাও না যেতে দিতে? একে তো এতসব ঝামলা আবার অপূর্ব ভাইয়া যদি উনার….’
দুশ্চিন্তা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে আমার। কেননা আনভীর অনিচ্ছা সত্বেও বলে আমায় ফেলেছিলো অপূর্ব ভাইয়ার সাথে উনার সাক্ষাতের কথা। বলেছিলেন ভাইয়াকে যে আমি এখন আনভীরের কাছেই আছি। এটা যেদিনই আমি জেনেছিলাম সেদিন থেকেই ভয় জেঁকে বসলো মনে। কেননা আমি জানি কতটা ভয়ঙ্কর মানুষ উনারা। যারা স্মাগলিং এর মতো কাজে জড়িয়ে যেতে পারে ব্যবসার অগোচরে, তারা যেকোনো কিছু করতে পারে। যদি আনভীরের কোনো ক্ষতি হয়ে যায় তো?
আমায় এত অস্থির হতে দেখে নাহিদ ভাইয়া রীতিমতো চেয়ার ছেড়ে উঠে আমার কাছে এলেন। বলতে থাকলেন,
‘ আরে হাইপার হচ্ছেন কেনো? আমাকে তো বলতে দিন। এআরকে কোথাও যায়নি বুঝেছেন? সে আজ সেমিনারে যাবে একটু দেরি করে। তাই আমিও যাইনি৷ কি ডেন্জেরাস আপনি আল্লাহ! এখন আমার জন্য আপনার কিছু হয়ে গেলে এআরকে আমার কপালে শনি আনতো। এত হাইপার হতে লাগে?’
আমার মনে এতক্ষণ অজস্র দুশ্চিন্তা থাকলেও নাহিদ ভাইয়ার কথায় আড় চোখে তাকালাম আমি উনার দিকে। নাহিদ ভাইয়া মিহি হেসে বললেন,
‘ আপনার বরসাহেব একটু আগে ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ করতে দেখলাম। এখন গার্ডেনে কি করছে আল্লাহ মালুম। যান দেখে আসেন।’
উনার দুষ্টুমি ভঙ্গিমার কথাগুলো ধরতেই আমি লজ্জায় মিলিয়ে গেলাম। নাহিদ ভাইয়া অ্যাপেলে একটা বাইট দিয়ে বললেন,
‘ কে যেনো বলেছিলো জীবনেও এআরকে কে ভালোবাসবে না। এখন তো দেখছি চোখে হারায়। দেখলেন! শেষমেষ নাহিদ রেজওয়ানের কথাই ঠিক বের হলো৷’
‘ আপনি…আপনি ব্রেকফাস্ট শেষ করেন।’
বলেই কোনোমতে উনাকে এড়িয়ে গার্ডেনের দিকে পা বাড়ালাম আমি। উদ্দেশ্য আনভীরকে একঝলক দেখা। সেই সাথে নাহিদ ভাইয়াকেও সন্তর্পণে এড়িয়ে চলা। আনভীর কি, এই ছেলের কাজকর্ম তার থেকেও ভয়ঙ্কর। আমি শুধু ভেবে পাইনা মানুষ এতটা বেফাঁস কাজকর্ম কিভাবে করে বেড়াতে পারে।
গার্ডেনে গিয়ে দেখলাম জিমি দৌড়াচ্ছে প্রাণবন্তভাবে। ছোট ছোট ফুলের গাছগুলো তরতাজা লাগছে। নানা বাহারের বিদেশি জাতের ফুলগুলোর যত্ন নিতে হয় অনেক। আর এগুলো নুড়ী আপার দায়িত্বে পড়লেও সকালে কাজটা আনভীরই করেন। আজ নুড়ী আপা বাসায় নেই। কোনো এক কারনে আনভীর নুড়ী আপাকে আজরান ভাইয়া আর শিউলি ভাবির কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। কারনটি আমি জানতে চাইলেও উনি কিছু বলেননি। আমিও তাই পরন্তু আর আগ্রহ দেখালাম না।
আনভীর সুইমিংপুলের সামনে বসে আছেন ক্লান্তির সাথে। পরনে একটা কালো হাফ হাতা টিশার্ট আর কালো একটা হাফ প্যান্ট। উনাকে এভাবে দেখে আমি তাজ্জব বনে গেলাম। চোখের দৃষ্টি করে ফেললাম হালকা। পা ঘুরিয়ে উল্টোপথে ঘুরতেই পেছন থেকে আনভীর চেঁচিয়ে বললেন,
‘ কাম হেয়ার বেবিগার্ল! ‘
গালে ক্রমশ লালাভ আভা ফুটে ওঠলো আমার। উদ্ভ্রান্তের মতো দ্রুত এবার পা চালিয়ে উনার কাচে এগিয়ে গিয়ে বললাম,
‘ পাগল নাকি আপনি? এভাবে এসব চেঁচিয়ে বলার কি আছে? নাহিদ ভাইয়া শুনলে কি ভাববে?’
‘ এমন কি সব চেঁচিয়ে বললাম আমি?’
আমি দম নিলাম। উনি এই প্রশ্নটা করেছেন শুধুমাত্র আমার মুখে ‘বেবিগার্ল’ শব্দটি শোনার জন্য। উনার চোখে-মুখে এমন একটা ভাব যেন উনি আমায় এভাবে বিভ্রান্ত হয়ে থাকতে দেখে মজা পাচ্ছেন বেশ।
আমি আড়নজরে চোখ বুলিয়ে নিলাম উনার ওপর। ঘেমে জুবুথুবু হয়ে আছে উনার মুখ। কালো চুলগুলো মিশে আছে ভিজে থাকা কপালের ওপর। চোখের দৃষ্টি নিষ্প্রভ, সেটাও মুগ্ধভাবে দেখছে সুইমিংপুলের পানিকে। রৌদ্দুরের আবির্ভাবে যেন প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে উনার চোখজোড়া। আনভীর আমার দিকে না তাকিয়ে বললেন,
‘ এতক্ষণ ওয়ার্কআউট করাতে শরীরটা ক্লান্ত লাগছিলো। কিন্তু তোমার এই চাহিনী আমায় কিন্তু বেসামাল করে দিচ্ছে আহি। কন্ট্রোল ইট।’
তৎক্ষনাৎ আমি নিজেকে সংযত করলাম। উনার কথাগুলো হাসফাস করে তুলছে অন্তরে। আনভীর উঠে দাঁড়ালেন। বললেন,
‘ ব্রেকফাস্ট করেছো?’
‘ না।’
‘ তাহলে করে আসো।’
‘ আপনি করেছেন?’
‘ না। করবো একটু পর। আগে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ সেরে নেই। তারপর করবো।’
এই কথাটি উনি বললেন আমার দিকে তাকিয়ে। ঠোঁটে একটা হাসি ঝুলছে। এ হাসিটি কেন যেন আমার খুব একটি সুবিধার মনে হলোনা৷ তবুও নিজেকে শান্ত করে জিজ্ঞেস করলাম,
‘ কি কাজ?’
আমার এই প্রশ্ন শুনে আনভীর একটা বাকা হাসি দিয়ে নিজের কালো হাফ হাতা টিশার্ট খুলে ফেললেন আমার সামনে। এহেন কান্ডে অবাক হলাম আমি৷ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম উনার দিকে। ও মাই গড! ও মাই গড! পাগল নাকি উনি? হুট করে আমার সামনে টিশার্ট খুলে ফেলাতে মুখমণ্ডল আমার লজ্জায় রক্তিম বর্ণ ধারন করেছে।
আমি উত্তেজিত হয়ে বললাম,
‘ ও হ্যালো মিস্টার! এসব কি ক…করছেন আপনি?’
‘ কি করছি?’
উনি নির্বিকারভাবে টিশার্টি রাখলেন পাশের কাউচে। ভ্রু কপালে উচিয়ে তাকালেন আমার দিকে। আমি চোখে সরিয়ে নিলাম উনার কাছে থেকে৷ ভাবতেও পারিনি যে এই রূপে উনাকে হুট করে দেখবো। আনভীর চুলগুলো খানিকটা এলোমেলো করে বললেন,
‘ আজকে ওয়েদারটা অনেক ওয়ার্ম মিসেস আহি। সুইমিং করবো তাই৷’
বলেই উনি আমায় অবাক করে দিয়ে হুট করে ঝাপ দিলেন সুইমিংপুলে। পানির শব্দে অবাক হলাম আমি৷ হতবুদ্ধি হারিয়ে তাকিয়ে রইলাম সে পানে। আনভীর আপন মনে সুইমিং করতে ব্যস্ত৷ উনাকে এভাবে নামতে দেখে জিমিও ঘেউ ঘেউ করে চলছে৷ চোখের মাধ্যমে জানান দিচ্ছে, সেও নামবে। আনভীর জিমির দিকে পানির ছিটা দিয়ে মুচকি হেসে বললো,
‘ ঠান্ডা লাগবে তোমার বেবি। আজ না। অন্য একদিন!’
ছোট কুকুরছানাটি কি বুঝলো কে জানে, সে এবার চুপচাপ আমার পায়ের কাছে বসে পড়লো। আমি কি করবো বুঝে উঠতে পারলাম না। ব্যাটা আস্ত একটা বেশরম, লজ্জা করলোনা এভাবে আমার সামনে একটা হাফপ্যান্ট পড়ে সুইমিং করতে? আমি একরাশ বিরক্তি নিয়ে বললাম,
‘ এমনিতে ওয়েদার চেন্জ হচ্ছে, তার পক্ষে এই ঠান্ডা পানিতে লাফ দেওয়ার কি দরকার ছিলো?’
‘ অভ্যাস আছে আমার। ডোন্ট ওয়ারি। তুমি নাস্তা করে আসো।’
আমি কিছু না বলে চলে গেলাম ভেতরে। নাহিদ ভাইয়া নিজের রুমে যাচ্ছিলো। আমায় দেখে বলে উঠলো,
‘ কোথায় আনভীর ভাই?’
‘ সুইমিং করে অসভ্যটা!’
আমার বিড়বিড়িয়ে কথা বলার জন্য কিছু বুঝলেন না ভাইয়া। আনমনেই সে রুমে চলে গেলো। আমি ব্রেকফাস্ট সেরে আবার গেলাম উনার কাছে। দেখলাম মহাশয় ক্ষান্ত হননি৷ এখনও সুইমিংপুলে দিব্যি বিচরণ করে বেড়াচ্ছেন। আমি এবার বললাম,
‘ এবার তো উঠুন! আপনার না যাওয়ার কথা একটা ইভেন্টে?’
উনি পরোয়া করলেন না। আমি বিরক্তি নিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই আনভীর বললেন,
‘ হাত দাও তোমার। আমি উঠবো।’
আমার সন্দেহ হলো উনার কথা শুনে। তবুও কিছু না বলে নিঃশব্দে ঝুঁকলাম পুলের দিকে। হাত বাড়িয়ে অস্বস্তি কাটিয়ে বললাম,
‘ উঠুন!’
কিন্ত আমার ধারনাকে পাল্টে দিলেন আনভীর৷ হুট করে উনি আমার হাত টান দিতেই আমি তৎক্ষনাৎ পুলে পড়ে গেলাম৷ ভড়কে গেলাম আমি। সেই সাথে কাজ করা বন্ধ হয়ে গেলো স্নায়ু। কেননা সাঁতার জানতাম না আমি। পুলের গভীর পানিতে ঠাই না পাওয়াতে কই মাছের মতো ছটফট করতে থাকলাম। আমি কোনোমতে ‘আনভীর’ শব্দটা উচ্চারণ করতেই আচমকা একজোড়া বলিষ্ঠ হাত আগ্রাসী অধিকারে আঁকড়ে ধরলো আমার কোমড়। তারপর আমায় মিশিয়ে নিলো নিজের সাথে। আমি তখন চোখ বুজেই বলে ফেললাম,
‘ ছাড়বেন না আমায় আনভীর!’
.
.
.
.
~চলব ইনশাআল্লাহ
#এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়-২
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব – ১৭
আমি কোনোমতে ‘আনভীর’ শব্দটা উচ্চারণ করতেই আচমকা একজোড়া বলিষ্ঠ হাত আগ্রাসী অধিকারে আঁকড়ে ধরলো আমার কোমড়। তারপর আমায় মিশিয়ে নিলো নিজের সাথে। আমি তখন চোখ বুজেই বলে ফেললাম,
‘ ছাড়বেন না আমায় আনভীর!’
আনভীর শুনলেন না আমার কথা। আমার কোমড়ে উনার হাতের বাঁধন আলগা করতেই আমি আবার পানিতে হাবুডুবু খেতে থাকলাম। পরন্ত আনভীর টেনে পানির ভেতর নিয়ে গেলেন আমায়৷ আমি না পারছি নিঃশ্বাস নিতে না পারছি কোনো কিছু করতে। শেষমেশ আমার কোমড় চেপে পানির ওপর নিয়ে আসতেই আমি শক্ত করে উনাকে আকড়ে ধরলাম৷ আমায় যাতে ছেড়ে দিতে না পারে তাই নিজের দু পা দিয়ে পেচিয়ে ধরলাম আনভীরকে। এখন আমাদের মধ্যে ছিটেফোঁটাও দুরত্ব নেই। উনার এলোমেলো নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে আমার মুখ বরাবর। আমিও কোনোমতে হাঁপাতে থাকলাম। চোখজোড়া হয়ে উঠেছে লাল। রাগে কটমট করে উনার দিকে তাকালাম আমি৷ নিজের দু’হাত দিয়ে বাচ্চাদের মতো উনার উম্মুক্ত বুকে আঘাত করতে করতে বললাম,
‘ আপনি কি পাগল আনভীর? এত ঠান্ডার মধ্যে এভাবে আমায় পানিতে টেনে আনলেন কেনো?’
আনভীর কিছু না বলে সশব্দে হেসে উঠলেন এবার। আমার শরীরে এবার অন্যরকম একটা অনুভূতির সঞ্চার হলো। কেননা আনভীরকে এই প্রথম হাসতে দেখছি এতটা প্রাণবন্তভাবে। হাসলে উনার গেজ দাঁতগুলো অসম্ভব সুন্দর দেখায়৷ টপটপ করে উনার চুল থেকে পানিগুলো গলায় আর ফর্সা লোমহীন বুকে মিশে যাচ্ছে৷ আনভীর এবার বললেন,
‘ আমার হট বডি দেখে এখন গরম লাগছে বেবিগার্ল? ডোন্ট ওয়ারি, আমি তো আপাদমস্তকই তোমার!’
লজ্জায় হাসফাস করতে থাকলাম আমি৷ এভাবে পুলে উনার সাথে মিশে থাকাতে সেই মাত্রা যেন দ্বিগুন বেড়ে গেলো। ইভেন্টে যেতে দেরি হচ্ছিলো বিধায় ইতিমধ্যে আনভীরকে ডাকার জন্য এখানে এসে পড়লো নাহিদ ভাইয়া৷ আমাদের দুজনকে এ অবস্থায় দেখে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো সেদিকে৷ আনভীর তা দেখে নিরন্তরভাবে বললেন,
‘ কি?’
‘ দেরি হচ্ছে আমাদের।’
নাহিদ ভাইয়ার রোবটিক কথাবার্তা শুনে বিস্ফোরিত নয়নে পেছনে তাকালাম আমি। তৎক্ষনাৎ আমি ভড়কে গেলেই আনভীর দুষ্টু হেসে বললেন,
‘ কি ছেড়ে দিবো?’
‘ এই না!’
অনেকটা আতঙ্কিত হয়ে আমি পুনরায় জাপ্টে ধরলাম আনভীরকে। উনার ঠোঁটে এবার বিশ্বজয়ের হাসি। নাহিদ এবার কোনোরকম চলে গেলো ভেতরে। বিরবিড়িয়ে বললো,
‘ এই দুই মিয়া বিবি কিছু পারুক বা না পারুক, আমার মতে সিঙ্গেল মানুষের বুকে ঠিকই আগুন জ্বালিয়ে দিতে পারবে!’
_______
ক্রাইম ডিপার্টমেন্ট থেকে রাত সাড়ে দশটা নাগাদ ফ্ল্যাটে এলো রাহি। বিগত কিছুদিন যাবৎ এক পলিটিশিয়ান ছেলের অস্বাভাবিক মৃত্যুর কেস নিয়ে অতিষ্ঠ সে। এর মধ্যে না কল ধরেছে অপূর্বর আর না কল ধরেছে ওর বাবা বা চাচার। রাহি জানে যে এর কারন কি। কেননা অপূর্ব সাফ সাফই বলে দিয়েছিলো যে আহিকে দ্রুত না খুঁজলে এর পরিণাম কি হবে। তবে এসব হুমকি রাহির কাছে নতুন না। এবার ও নিজেও চাচ্ছে আহি যাতে ওই জালিমটার কাছে না যায়। রাহি জানেনা মেয়েটা এখন কোথায় , কিন্ত অপূর্বের লোক ওর পিছু সর্বদা থাকে বলে খুঁজতেও পারছে না।
কিচেন থেকে এক গ্লাস পানি খেয়ে নিলো সে। বাহিরে সুনসান নীরবতা। ঘরের লাইটগুলো বন্ধ থাকায় অন্ধকার লাগছে চারিপাশ। রাহি সুইচের দিকে এগোলো। হাত বাড়িয়ে ছাড়লো লাইট। কিন্ত ড্রইংরুমে একেবারে প্রাণহীনভাবে অপূর্বকে বসে থাকতে দেখে ভড়কে গেলো রাহি। ও ভাবতেও পারেনি এত রাতে অপূর্ব আবার হাজির হবে এখানে। অপূর্বের সাথে ওর চোখাচোখি হওয়া মাত্রই দ্রুতপদে এসে নিজের গানটা রাহির গলা বরাবরের চেপে ধরলো অপূর্ব। রাহি নিশ্চল। প্রতিক্রিয়াহীনভাবে তাকিয়ে আছে অপূর্বের দিকে। একজন এজেন্টের কাছে নিজের আত্নঅনুভূতি গোপন করার জন্য এটা এক সাধারন কৌশল। তাই সে কোনো অভিব্যাক্তি প্রকাশ করলো না। অপূর্ব ফিসফিসিয়েবলে উঠলো,
‘ ইচ্ছে করছে ট্রিগারে চাপ দিয়ে এখনি খাল্লাস করে ফেলি তোমায়।’
রাহি দম নিলো। দৃঢ় কন্ঠে বললো,
‘ তাহলে করছো না কেনো?’
মেয়েটার এত দুঃসাহস দেখে রেগে গেলো অপূর্ব। গানটা আরও চেপে ধরেবলে উঠলো,
‘ ওইযে বলেছিলাম না? তুমি আমার পার্সোনাল এজেন্ট! যতই তুমি ডিপার্টমেন্টের হয়ে কাজ করো না কেনো? দিনশেষে আমার জালে ফাঁসতে তুমি বাধ্য। তুমি না থাকলে আন্ডারকভারের খবরগুলো আমায় জানাবে কে?’
রাহি তপ্তশ্বাস ছাড়লো। অপূর্বের এই সিদ্ধান্তকে প্রশয় দেওয়া ছিলো ওর জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। এর জন্য একজন মানুষের কাছে চরমভাবে অপরাধী সে। হয়তো ক্ষমার অযোগ্যও। রাহি এবার বলে উঠলো,
‘ এখানে এসেছো কেনো?’
‘ আহির ঠিকানা পেয়েছি।’
চোখজোড়া এবার বিরাট প্রশ্নের রাজত্ব নিয়ে বসলো রাহির। অপূর্ব এবার ছেড়ে দিলো রাহিকে। রাগের বসে পাশ থেকে একটা শো-পিস দেয়াল বরাবর ছুঁড়ে মারলো। সেদিনের এআরকে’র কথাগুলো স্মরণে আনতেই ওর মাথায় রক্ত চড়ে যায়। সাহস কি করে হলো ওই রকস্টারের এমন আচরণ করার? একজন স্মাগলার হিসেবে এআরকে’র মতো হাজারো সেলিব্রেটি চলে ওর হাতের ইশারায়। বড় বড় কিছু অনৈতিক পলিটিশিয়ানদের হাত করে সেই ক্ষমতা আরও দ্বিগুন বাড়িয়ে নিয়েছে সে। আর ওই রকস্টার বলে কিনা আহির পিছু ছেড়ে দিতে?
রাহি এবার জিজ্ঞেস করলো,
‘ক..কোথায়?’
একটা শীতল দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো অপূর্ব রাহির দিকে। মৌনতা কাটিয়ে বললো,
‘ এআরকে’র কাছে।’
প্রথমে রাহি ভাবলো যে ভুল শুনেছিলো সে। অতঃপর বললো,’কার কাছে?’
‘ আনভীর রেজওয়ান খান ওরফে এআরকে’র কাছে। ভাবতো এমন করছো যে চিনোই না ওই বা*টার্ডটাকে।’
রাহির নিঃশ্বাস ঘন হয়ে গেলো এবার। কাঁপাকাঁপা সুরে বললো,
‘ ইউ ওয়ানা মিন দ্যাট রকস্টার এআরকে? যে কি-না স্টার হিট এর ভোকাল আর্টিস্ট?’
‘ হুম!’
অপূর্বের এ কথায় রাহির মাথায় যেনআকাশ ভেঙে পড়লো। ও কল্পনাই করতে পারেনি যে মানুষটার অতীত নিয়ে এতদিন ধরে ঘাটাঘাটি করছে সেই মানুষটার কাছেই ওর বোন আছে। এবার ক্লিয়ার হলো ওর কাছে সব। আহি নিজ থেকে পালায়নি। আনভীর কিডন্যাপ করেছে ওকে। আর সেটাও শুধুমাত্র রাহির কাছে থাকা আনভীরের সেই গোপন বিষয়টার কারনে। রাহি ভালো করেই জানে একবার যদি আনভীরের এই ডিসঅর্ডারটা পাব্লিকালি ফাঁস হয়ে যায় এটা কাল হয়ে দাঁড়াবে ওর মিউজিক ক্যারিয়ারের জন্য। আর তাই আহিকে নিজের কাছে নিয়েছে শুধু রাহিকে ব্ল্যাকমেইল করার জন্য। রাহিকে এতটা উদগ্রীব হতে দেখে অপূর্বর সন্দেহ আরও প্রগাঢ় হলো। বাকা হেসে রাহির উদ্দেশ্যে বললো,
‘ এবার বলতো রাহি?……….এই এআরকে আসলে কে?’
রাহি স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলো। কিন্ত ওর নার্ভ উইক হয়ে গিয়েছে। আমতা আমতা করে বললো,
‘ ও..ওইযে! একজন সিঙ্গার।’
অপূর্ব হাসলো আবার। বললো,
‘ আমি জানতে চাই আহির সাথে ওর সম্পর্কটা কি?’
বিপাকে পড়ে গেলো রাহি। আনভীরের সম্পর্কে ও যা তথ্য জানে সেটা অপূর্বকে দেয়া অসম্ভব। অপূর্ব এটাও জানেনা যে আনভীর আসলে আহির বাবার বন্ধুর ছেলে। রাহি শান্ত করলো নিজেকে। বলে ওঠলো,
‘ সেটা আমায় জিজ্ঞেস করছো কেন তুমি? মানে সিরিয়াসলি! তোমায় দেখে অন্য বড় বড় ক্ষমতাবান মানুষদের হাঁটু কাপে। আর ওই এআরকে’র সামনে তুমি ভড়কে গেলে?’
অপূর্বের ইগোতে লাগলো ব্যাপারটা। চোয়াল শক্ত হয়ে এলো আপনা আপনি। রাহি স্বস্তি পেলো এতে। অপূর্ব বলে উঠলো,
‘ ওই রকস্টারকে ছাড়বো না আমি! ভুল জিনিসে হাত বাড়িয়েছে ও। এর পরিণামটা যে কি হবে শীঘ্রই টের পাবে। ‘
অপূর্ব সময় নষ্ট করলো না এবার। রাহির দিকে এক শীতল চাহিনী নিক্ষেপ করে চলে গেলো। এদিকে বিভ্রান্ত হয়ে আছে রাহি। বুঝতে পারছে না আনভীরের উদ্দেশ্যটা আসলে কি।
___________
গতকাল থেকে কথা বলছি না আমি আনভীরের সাথে। না বলার অবশ্য কারনও আছে। তখন ওভাবে হুট করে সুইমিংপুলের টান দেওয়ার কারনে এখনও রেগে আছি উনার ওপর। তার ওপর নাহিদ ভাইয়ার সামনে আমায় এমনভাবে লজ্জায় ফেলে দিলেন ইচ্ছে করছিলো উনাকেই সেখানেই চুবিয়ে মারি। তারপর থেকেই আমি সুক্ষভাবে এড়িয়ে চললাম উনাকে। গতকাল উনি রাতে বাসায় আসার পর একবারও কথা বলিনি আমি৷ এমনকি উনার কন্ঠে গান শুনারও আবদার করিনি।
কিন্ত আমার এমন কান্ডে পরোয়া করলেন না আনভীর৷ উনি কোনো কথা না বলেই আবার ড্রেস পাল্টে রাত সাড়ে ১১ টা নাগাদ বাইরে চলে গেলেন নাহিদ ভাইয়াকে নিয়ে। নাহিদ ভাইয়া বললো যে স্টার হিট এর পক্ষ থেকে একটা পার্টি থ্রো করছে ওখানকার চিফ। অভিমান আরও গভীরভাবে আমার মনে বিরাজ করে বসলো। চুপচাপ আমি চলে গেলাম ঘুমাতে।
সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলাম আনভীর ঘুমিয়ে আছেন আমার পাশে। আমি ডাকলাম না আর। সম্ভবত রাতে অনেক দেরি করে এসেছেন। এদিকে আমার আজ হসপিটালে একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং এটেন্ড করার কথা ছিলো ধ্রুব স্যারের সাথে। তাই উনাকে না ডেকেই নাহিদ ভাইয়ার সাথে হসপিটালে চলে গেলাম৷ আমার সত্যি প্রচুর রাগ হচ্ছিলো আনভীরের ওপর। লোকটা এমন কেনো? একটুও পারলো না নিজ থেকে কথা বলতে? নাহিদ ভাইয়া ড্রাইভিং করতে করতে আমার এ অবস্থা দেখে বললো,
‘ এখনও রাগ করে আছেন?’
আমি নিরুত্তর।
‘ এত রাগ করে কি হবে ভাবি? পুলে টান দিয়ে ফেললে এভাবে রাগ করতে লাগে?’
নাহিদ ভাইয়ের বোকা বোকা কথায় বিরক্তি আমার মাথাচাপা দিয়ে বসলো৷ দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললাম,
‘ আনভীর ঠিকই বলে। আসলেই আপনি মাথামোটা!’
নাহিদ তপ্তশ্বাস ছাড়লো৷ আমাদের দুই জনের জন্যে কবে জানি সত্যি সত্যি ও পাগল হয়ে যাবে এটাই ভাবতে থাকলো আনমনে।
আমি এবার একটা দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। খুব শখ না আনভীর আমার সামনে ভাব নিয়ে থাকার? আপনার এরোগেন্ট বিহেভ ছুটাবো আমি। এবার আমি মোবাইলের সুইচ অফ করে ফেললাম। আজ একটা কল এলেও আর ধরবোনা। আমিও দেখবো কতক্ষণ আমায় ছাড়া এতটা নিরুত্তর থাকতে পারে৷
.
.
.
.
~চলবে ইনশাআল্লাহ
ভুলক্রুটি ক্ষমাসুলভ চোখে দেখবেন।