এমন দিনে তারে বলা যায় পর্ব-০৯

0
172

এমন দিনে তারে বলা যায়
পর্বঃ ০৯
সানজিদা মাহি
______________________________________

সময় গড়িয়ে যায় আপন গতিতে। কারো জন্য অপেক্ষা করবার কিংবা কারো মন রক্ষা করে চলবার ধাত নেই তার। এখানে এসেছি চোখের পলকে একটা মাস ফুরিয়ে গেল। ঘরে একটা রমনীর অভাব ছিল। সে অভাব অতি নিপুণ ও সুন্দরভাবে পূর্ণতা পেল। শুধু আমার আর কর্তা মশাইয়ের দূরত্বটাই ঘুচলো নাহ। আমাদের ভাবলেশহীন মনোভাব নাকি অন্য কোনো কারণে সম্পর্কটা আজও সহজ হলো নাহ তা আমার বোধগম্য হয়নি এতদিন। অথচ এতদিন পর যখন সত্যটা সামনে এলো তখন খুব সাহস দেখিয়ে সত্যটা কঠিন হলেও মেনে নেব অবলীলায় – এই মনোভাবটা ভেঙে চূড়মার হতে সময় নিল না৷ তবে একেবারেই যে এক ছাদের নিচে থেকেও দুজন দুজনকে প্রয়োজনের বাইরে ভাবিনি তা নয়। সম্পর্কটা একটু একটু করে বন্ধুত্বে রূপ নিচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো এই ঢের। এই বেশ আছি। এভাবেই তো সম্পর্কের ভীত শক্ত হয়ে গড়ে ওঠে। সহসা মান অভিমানে যা ভাঙতে পারে না। অথচ সম্পর্কটা যে সেই প্রথম থেকেই নড়বড়ে ছিল তা বিন্দুমাত্র টের পাইনি।
কাছ থেকে দেখলে যে কেউ অনায়াসে বলে দিতে পারতো, আমাদের মাঝে আর আট-দশটা দম্পতির মতো ভালো বাসাবাসিটা হয়নি। মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবতাম, আমি উনার প্রতি যে প্রবল টান অনুভব করি, উনি আসতে দেরি হলে পথ চেয়ে বসে থাকি কিংবা চাতক পাখির মতো তৃষাতুর নয়নে প্রতিক্ষার প্রহর গুনি সেটাই কি ভালোবাসা? এই ভাবতে ভাবতেই কখন মায়ার ফাঁদে পা জড়িয়ে গেল। আর আচমকা হুমড়ি খেয়ে পড়ে গিয়ে পূর্ণোদ্দমে ভেঙে গেল নড়বড়ে ভীতটাও। কিছুই রইলো না আর অবশিষ্ট।

নিঃসন্দেহে দিনটি ছিল আমার জন্য ঘাতক স্বরুপ। একটি মেয়ে আমার স্বামীর গা ঘেঁষে তার হাত ধরে বসে আছে এটা আমার জন্য সহজ বিষয় নাহ। মনের মধ্যে শুধু একটি কথাই বাজতে লাগলো। তবে কি কর্তামশাই পরকীয়ায় জড়িত? যদি তাই হবে তবে সে আমাকে চাইলেই বলে দিতে পারতো। কেন একই সাথে দুই তরীতে পা দেয়া? পরক্ষনে মনে পড়লো তাদের কথোপকথনের অংশবিশেষ। ওদের কথা শুনে মনে হচ্ছিলো এতদিন মেয়েটির সঙ্গে কর্তা মশাইয়ের যোগাযোগ ছিল না। মেয়েটিও বিয়ের ব্যাপারে জানতো না৷ কিন্তু কর্তামশাই ভুলতে পারেনি তাকে। তার সব আবেগ শুধু ওই মেয়েটিকে ঘিরে ছিল। আমার কেবল মনে হচ্ছিল এখানে আমার কিছুই নেই। এতদিন অবহেলা পেয়েও থেকে গেছি সবকিছু একদিন স্বাভাবিক হবে ভেবে। ভালোবাসা মানুষকে কোথায় কখন ভাসিয়ে নিয়ে যায় সেকথা আমি হারে হারে বুঝতে পারছি। বিয়ের সময় পাত্র পছন্দ হয়নি। বিয়ের পরও ভাবলেশহীন ছিলাম তার প্রতি। অথচ তারপর কি থেকে কি হয়ে গেল। কখন যে তার প্রেমে পড়ে গেলাম তা বুঝে ওঠার আগেই সব শেষ হয়ে গেল। মানুষটার মাঝে আমি পরিবর্তন দেখতে পেয়েছিলাম। যে মানুষটা এক ওয়াক্ত নামাজও পড়তো নাহ সে এখন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। টাকনুর উপর প্যান্টও পরে। সেদিন ক্লিন শেইভ নিয়ে ঠাট্টা করায় আর কখনো ক্লিন শেভ করেননি। এগুলোকে আমি কি বলে আখ্যা দিব? আমার প্রতি যদি উনার কোনো অনুভূতিই না থাকবে তবে আমার কথা শুনে নিজেকে পরিবর্তনেরই বা কি মানে। আমার পৃথিবী দুলছিল প্রবল বেগে। ঘূর্ণিঝড়ের পর সব যেমন শান্ত হয়ে যায় তেমন করে নিজেকে স্থির করবার চেষ্টা করলাম।

আজ সব ভাবনার অবসান ঘটলো নিমিষে। ভাবনাদের দীর্ঘ লম্বা ছুটি দিয়ে ক্লান্ত, শ্রান্ত মনটাকে জিরোবার সময় দিলাম৷ কি হবে আর ভেবে? যে কোনোদিন হবার ছিল না কিংবা হবার নয়ও তাকে নিয়ে ভেবে কি হবে। প্রচন্ড কষ্টে টালমাটাল অবস্থা আমার। কখন কি ভাবছিলাম নিজেই গুলিয়ে ফেলছি বারবার। স্টেশন থেকে এসে বোরকা, শাড়ি বদলে বসলাম ছোট্ট টেবিলটার সামনের কাঠের চেয়ারটায়৷ বৃষ্টি থেমেছিলো কিছুক্ষণের জন্য আবার শুরু হয়েছে। ভাঙা মন নিয়ে বসে থাকলেও এ পৃথিবীর কারো কিছু এসে যায় না। আকাশের বর্ষন, প্রকৃতির ধারাবাহিক রূপ কোনোকিছুই থেমে থাকবে না৷ সবই চলবে নিজের নিয়মে। আর মানুষটা? কি হবে ভবিষ্যতে, কোথায় হবে আমার অবস্থান – সবই অনিশ্চিত। সম্পূর্ণ ঘরটার দিকে চকিতে চাইলাম। তারপর ধীরে ধীরে পর্যবেক্ষন করলাম আবেগ আর যত্ন নিয়ে নিজের হাতে গোছানো, পরিষ্কার – পরিচ্ছন্ন করা প্রতিটি জিনিসকে। এখনো পরিপূর্ণ সংসার সাজানো হয়নি৷ একদিন নিশ্চয়ই এখানে অন্য কারো পায়ের ধূলি পড়বে। প্রতিটি জিনিসে তার হাতের ছোঁয়া লাগবে। খুবই যত্ন নিয়ে কি সে ঘর আর ঘরের মালিক দুটোকেই সামলে নেবে? চোখে ভাসলো ছোটখাটো গড়নের জলপাই রঙের শাড়ি পরিহিত, একপাশে রাখা লম্বা, কালো চুলের বেণুনি, ঈষৎ রক্তাভ, পেলব গাল, লাবন্যময়ী উজ্জ্বলতা, গাঢ় কৃষ্ণ রাঙা নেত্র পল্লবের নিচে ছলছল জলপূর্ণ আঁখিদ্বয়। আমার চেয়ে অধিক সুন্দরী, অধিক যোগ্য সে জন। যাকে কর্তা মশাই মনে প্রাণে চান। আমাকে যে চান না সেটা কত অকপটে স্বীকার করে নিলেন৷ এই ভালো। কপটতা বর্জিত মানুষ তিনি। আমাকে সামনে দেখলেও কি এতটা সাবলীলভাবে এ কথা বলে দিতে পারতেন?

শান্ত নদীর উপর একাধারে চলল ঝিরিঝিরি বর্ষন। কখনোবা প্রবলতর উৎসাহে মুষলধারে বৃষ্টি। জানালার সম্মুখে বসে মূক হয়ে সারাটা বিকেল ধরে চেয়ে চেয়ে তাই দেখলাম। খোলা জানালা দিয়ে বৃষ্টি এসে শাড়ি ভিজিয়ে দিল। মুখে ছিটকে আসা ফোঁটা ফোঁটা পানির বিন্দুগুলো গড়িয়ে পড়তে লাগলো গাল বেয়ে। সন্ধ্যায় হারিকেনের আলো জ্বেলে নামাজ পড়ে, আলোটা নিভিয়ে দিয়ে আবারও সেখানেই বিমূঢ় হয়ে বসে রইলাম। অযাচিত কষ্ট জরাজীর্ণ করার বদলে শোকে পাথর করে দিল। অপ্রত্যাশিত ঘটনাবলী মানুষের মনে বুঝি এভাবেই আঘাত হানে। আদোও কি এমনটা হবার কথা ছিল? যদিও তার অপেক্ষা করিনি, তবুও সে না আসায় সুক্ষ্ম অপমানের একটা ঝটকা মনের চাতালে অবিচল গতিতে হেঁটে বেড়ালো সারাটাক্ষন। এই এতদিনে দূর পাড়াগাঁয়ে আক্ষরিক অর্থেই নিজেকে বড্ড একা লাগলো। মানুষের উপস্থিতির অংক কষলেও যেমন আমি একা, তেমনি মানসিক আনুকুল্যের হিসেব কষলেও আমি একা। একটা অভিমানে মোড়ানো মন কেমন কেমন ভাব দলা পাকিয়ে গলা অবধি উঠে এলো। বাবা-মা সবাই মিলে আমাকে এতটা একা করে দিতে পারলো?

রাতে গা কাঁপিয়ে জ্বর এলো। বৃষ্টিতে অতিমাত্রায় ভেজায় সর্দি লেগে গলা ভেঙে গেল। পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম, কঠিন, পাষাণ মানুষটি এলো না আর বাড়িতে। ফুলের ন্যায় পেলব মনকে কাঁচের মতো গুড়িয়ে দিয়ে সে চোখের আড়াল হয়ে রইলো। গলা ধরে আসতে লাগলো মুহুর্মুহু আকন্ঠ অভিমানে। নোনাজল গড়িয়ে এসে গাল ধুয়ে দিতে লাগলো ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে। তারপর একসময় শুকিয়ে আঠালো হয়ে গালে লেপ্টে রইলো। আমি কখনো শক্ত ছিলাম না। কারণ শক্ত হবার প্রয়োজনও পড়েনি। মা যখন মারা গেলেন, তখন নিতান্ত ছোট ছিলাম। মায়ের ভালোবাসা কি জিনিস সেটা অতো বুঝবার সক্ষমতা ছিল না। তাই মা চলে যাওয়ায় আমার নিজস্ব জগতে আমূল কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। অনেক মানুষের ভীড়ে একা একা বড় হওয়া আমার আবেগ কতখানি ছিল কার প্রতি তা পরিমাপের প্রয়োজন পড়েনি। বিয়ের পর একটা অপরিচিত মানুষের সান্নিধ্যে থেকে নতুন অনুভূতি প্রাপ্তির অভিজ্ঞতা হলো। একটা গোটা মানুষ আমার সম্পূর্ন ভাবনার জগত নিজের আয়ত্তে নিয়ে নিল। সত্যিই তো বাবা-মা, বড় ভাই বিনয়, ছোটভাই তনয় আর ছোটবোন বিনুর কথা তেমনভাবে তো একদিনও মনে পড়েনি। অথচ আমার নিজস্বে জগতে এই মানুষগুলোরই বিচরণ ছিল সর্বক্ষণ। ওদের সাথে কাটানো মুহূর্ত কিংবা ওদেরকে এতদিন না দেখে থাকাটা যেন সহজ, স্বাভাবিক একটা ব্যাপার ছিল। অথচ একদিন এই মানুষগুলোকে ছাড়া থাকতে হবে ভাবলেই কান্না পেত। সব ভুলে এক মানুষে বিভোর হয়ে রইলাম। সবাইকে সরিয়ে দিয়ে সে একাই গোটা জগতকে নিজের করে নিল হোক ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়। আর দিনশেষে একটা বোকাসোকা, সহজ সরল মেয়ে পেয়ে কত সুন্দর করেই না ঠকানো গেল আমাকে।

জ্বরের ঘোরে কত কথা মনে হলো। এই তো সেদিন বিয়ে হলো মাত্র একটি কথায়। আলহামদুলিল্লাহ বলতেই জীবনটা জড়িয়ে গেল অপরিচিত, অজানা একজন আগন্তুকের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে৷ সেই মানুষটা নিজের চারপাশে ঝাপসা কুয়াশার মতো, ধোঁয়া ধোঁয়া রহস্যে জড়িয়ে রেখেছিলো নিজেকে। এত করেও সেই রহস্যের বেড়াজাল ভাঙা গেল না। নিপাট ভদ্র অথচ সুস্পষ্টভাবে আচরণ দ্বারা জানিয়ে দিল নিজের ব্যক্তি সীমানার ভেতরে আমার প্রবেশ নিষিদ্ধকরণের বার্তা। অবহেলা কি অবজ্ঞা কোনটাকেই চিনতে না পেরে নিজেকে স্বান্তনা দিয়ে যাচ্ছিলাম প্রতিবার এই বলে যে, সব ঠিক হয়ে যাবে। একটু সময়ের প্রয়োজন শুধু। তবে কি হবে আর এখানে পড়ে থেকে? চলে যাওয়াই উচিত আমার। কিন্তু যাব কোথায়? বাবার বাড়ি? কি জবাব দেব কেউ জানতে চাইলে? থাক এত ভেবে কি হবে…যেতে একদিন হতোই। না হয় কালই চলে গেলাম। চোখের সামনে পড়ে থেকে কষ্ট পাবার চেয়ে দূরে গিয়ে নিজেকে শক্ত করার প্রয়াসই সর্বোত্তম কাজ হবে।

বিনিদ্রায় অশ্রু বিসর্জনে রাতটা কেটে গেল। সেজদায় বারবার ফরিয়াদ করে বলললাম, তবে কি এটাই ছিল আমার পরিণতি? এটা মেনেই কি আমাকে সারাটা জীবন কাটিয়ে দিতে হবে? ইয়া রব্বি, আমাকে পথ দেখান। কষ্টগুলো ধুয়ে দিন। সত্য মেনে নেবার তৌফিক দিন। আঘাতে জর্জরিত মন শান্তি পেল সেজদায় ফরিয়াদে। সত্যি মানুষ কষ্ট না পেলে ভুলে যায় তার একজন রব আছে। মানুষের ভালোবাসা তো ঠুনকো কিন্তু যিনি কখনো ছেড়ে যান না তাকেই আমরা ভুলে যাই। তাই তো তিনি বান্দাকে কষ্ট দিয়ে পরীক্ষা করেন এবং নিজের কাছে টেনে নেন।

সকালে জ্বরটা আর রইলো না। তবে সর্দি ভালো করেই লেগেছে। একের পর এক হাঁচি দিতে দিতে গলা ব্যাথা বাড়লো। জামা-কাপড়, বই আর দরকারি জিনিসগুলো গুছিয়ে ব্যাগে পুরে নিলাম। মনে পড়লো, রাত থেকে এ অবধি না খেয়ে আছি। নিজের সাথে নিজের যুদ্ধ করে এক কাপ চা আর দুই পিস বিস্কুট কোনোরকমে গলাধঃকরণ করলাম। তিনি এলেন আরও পরে। দরজা খুলে যে মানুষটিকে দেখেছিলাম তাকে যেন কখনো আমি দেখিইনি। উদ্বাস্তু, এলোমেলো চুলে, উজ্জ্বলতাহীন চোখে, ভাজ পড়া শার্ট গায়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি আমার ভীষণ অচেনা। একদিনে বদলে যাওয়া মানুষ।
” রাতে এতো বৃষ্টি এলো যে আসতেই পারলাম না ” সংকোচ নিয়ে কৈফিয়তের সুরে বললেন কথাটা। উদ্বেগ নিয়ে জানতে চাইলেন, ” আপনি ভয় পাননি তো? ”
আমার তখন ভীষণ কষ্ট হচ্ছিলো কথা বলতে। এত বেশি ক্লান্তি এসে ভর করেছিলো সারা গায়ে যে মনে হলো, দুটো কথা বললেই অনেকখানি শক্তির অপচয় ঘটবে। সামনে থেকে সরে গিয়ে কোনোরকমে বললাম,
” চা গরম করে দিচ্ছি। বিস্কুট দেব নাকি চানাচুর দিয়ে মুড়ি বানিয়ে দেব? ”
এক পলক দেখার পর দেখতে ইচ্ছে হলো না ওই মুখ, মুখের অভিব্যক্তি। শুধু যেন দায়িত্ব পালনের জন্যই মুখস্থ বুলি আওড়ে যাওয়া।

চা গরম করে বিস্কুট সহ টেবিলে রাখলাম।
” সকালের ট্রেনটা যেন কখন যায়? ”
জানা উত্তর তবু বিষয়বস্তুর সূচনা করতেই প্রশ্ন করা।
হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন,
” এই তো আর মাত্র এক ঘন্টা বাকি। নাস্তা করেই আবার চলে যাব ”
শাড়ির আঁচল আঙ্গুলে পেঁচাতে পেঁচাতে বললাম,
” বাবা বলছিলো গিয়ে বেড়িয়ে আসতে… আপনার এখন কর্মব্যস্ততা। তাই আমি বরং একাই যাই। একা যেতে কিছুমাত্র অসুবিধা হবে না আমার…”
তিনি চুপ করে থেকে কিছুক্ষণ ভাবলেন। তারপর চায়ের কথা ভুলে গিয়েছিলো হঠাৎ মনে পড়েছে এমন ভঙ্গিতে চায়ের কাপে পরপর কয়েকবার চুমুক দিলেন। কাপ নামিয়ে রাখলেন টেবিলে। পা নাচাতে লাগলেন আপনমনে। পুনরায় চায়ের কাপে চুমুক দিলেন। ব্যস্ত ভঙিতে বললেন,
” আচ্ছা ঠিক আছে আপনি যেদিন যাবেন তার আগেরদিন আমাকে জানিয়ে রাখলেই হবে ”
” আজকেই যেতে চাচ্ছি ”
চায়ের কাপে চুমুকরত অবস্থায় বিষম খেলেন। আমি নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলাম৷ অবাক কন্ঠে বললেন,
” হ্যা? ”
” আমার তৈরি হতে সময় লাগবে না৷ সব গুছিয়ে রেখেছি ”
এতক্ষণ তিনি কথা বলছিলেন আমার দিকে না তাকিয়ে। হঠাৎ চকিতে চাইলেন। চোখে চোখ পড়লো। তারপর হয়তো গ্লানিবোধ জাগ্রত হতেই চোখ ফিরিয়ে নিলেন।
” আজকেই তাহলে…”
” হ্যা। আপনি বসুন। আমি রেডি হচ্ছি ”

***

প্রথম যেদিন এসেছিলাম রেললাইনের ওপর পাড়ের প্রবল ঘ্রান সম্মৃদ্ধ ছোট ছোট ফুলে পূর্ণ গাছটার নাম রেখেছিলাম সুবাসিনী। গাছটায় এখন কোনো ফুল নেই। তবে বৃষ্টির ছোঁয়া পেয়ে সবুজ পাতায় এখন নিবিড় সতেজতা। নির্মল, স্নিগ্ধ রূপ নিয়ে সগৌরবে কেমন দাঁড়িয়ে আছে গাছটা। স্টেশনে বসে থাকা, দাঁড়ানো বা হেঁটে বেড়ানো মানুষগুলোর মাঝে চাপা উত্তেজনা। হাসির কল্লোলে, অনুচ্চ শব্দের কথোপকথনে মুখরিত স্টেশন। প্রতিটি মানুষের মাঝে একটা আলাদা গল্প দেখতে লাগলাম। ওই যে একদম কোণায় দাঁড়ানো শাড়ি পরিহিত মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে স্বামীর পাশে। বাবার কোলে বাচ্চাটি কেঁদে চলেছে অবিরাম। পাশ থেকে কান্না থামাবার জন্য সে নানান গল্প করছে। হয়তো বলছে, এই তো চলে আসবে ট্রেন, তারপর তুমি, আমি আর বাবা মিলে অনেক দূরে যাব কেমন? কেঁদো না সোনা। আর ওই যে বোরকাবৃত বয়স্ক মহিলাটি বসে আছে সিমেন্টের বেঞ্চে। এইমাত্র একটি ছেলে দৌড়ে এসে পানির বোতল তার হাতে দিল৷ মহিলাটি পান খেয়ে ছেলেটির মাথায় হাত বুলিয়ে দিল পরম স্বস্তিতে। আহা মায়ের ভালোবাসা কত নিখুঁত… আর মায়ের জন্য ছেলের উদ্বেগ? সেও তো খাঁটি…। সবাই ভালো আছে। নিজের, আপন মানুষ নিয়ে। শুধু দুনিয়ার সব একাকীত্ব, শূন্যতা আমার মন পিঞ্জর জুড়ে।

কর্তা মশাই এসে পাশে দাঁড়ালেন। আর কিছুক্ষণ পর ট্রেন চলে আসবে।
” এভাবে আপনাকে একা পাঠিয়ে দিচ্ছি। সবাই কি ভাববে? ”
” ওদেরকে আমি বুঝিয়ে বলব ”
” কি বলবেন? ”
” বলব যে আপনার এখন কাজ ছেড়ে আসা সম্ভব ছিল না ”
” আমি কয়েকদিনের মধ্যেই ছুটি নিয়ে যাব ”

একবার তবু বললো না থেকে যান। না হয় আমি সহ যাব পরে। আমাকে পাঠিয়ে দিলে তো তার সুবিধাই হয়। কোনো ঝামেলা আর রইলো না। অনির্বচনীয় বিষাদে মনটা আরও বিষিয়ে গেল।

শব্দ করে ট্রেন এলো। একের পর এক করে সবাই ট্রেনে উঠে পড়তে লাগলো। যারা নামার তারাও একইসাথে নামছে। তিনি আমার স্যুটকেস নিয়ে উপরের তাকে রেখে এলেন। একা বলে সেকেন্ড ক্লাসে উঠেছি। তবে জানালার পাশে বসেছি। তিনি জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে। হয়তো বলতে চান কিছু। সংকোচ আর দ্বিধা ছাড়িয়ে বলতে পারছেন না। ট্রেন হুইসেল দিল। এই শেষ মুহুর্তেও আশা ছিল তিনি বলবেন, যাবেন না থেকে যান। বললে আমি কি করতাম? জানি না। এর উত্তর নেই আমার কাছে। তবুও তো বলতে পারতেন অন্তত একটাবার…
” তনু! ”

চমকে ফিরলাম তার দিকে। এই প্রথমবার আমার নাম ধরে ডাকলেন। বুকের ভেতর ঢিপঢিপ শব্দ তুলে একেকটা মুহূর্ত কেটে যাচ্ছে। ক্লান্ত, শ্রান্ত চোখগুলো দেখে মায়া হলো। মনে হলো এই শেষ সুযোগ। মনে মনে বললাম, সুযোগটা কাজে লাগান। একটা “থেকে যান” কথা হয়তো সমস্ত রাগ, অভিমান, জেদ ভুলিয়ে দেবে। ট্রেন আবারও হুইসেল দিল।

” ভালো থাকবেন ”

ধপ করে নিভে গেল যেন সব আলো। কুয়াশা ঢেকে দিল সব… সব আশা, আবছা প্রত্যাশা…বিলীন হলো কুয়াশার আড়ালে। চোখ ঝাপসা হলো।

” থাকব ইন শা আল্লাহ ”
কথাটা শোনা গেল না হয়তো৷ কর্ণকুহরে পৌছাবার পূর্বেই মিলিয়ে গেল বাতাসে। চোখ ফিরিয়ে নিলাম। অশ্রু বিসর্জন দেখিয়ে দূর্বলতা প্রকাশ করতে চাই না। ট্রেন চলতে আরম্ভ করেছে। জানালার ওপাশে স্থির দন্ডায়মান মানুষটা ধীরে ধীরে সরে গেল চোখের কোণ থেকে। অচিন মানুষ পুনরায় অচিন হলো। রেখে গেলাম তাকে অচিন্তপুর। থেকে গেল সে গৌরিপুর জংশনে । ট্রেনের গতির সঙ্গে আবছা হলো অল্প ক’দিনে আপন করে নেয়া গ্রামটা। আবছা হলো অচিন্তপুর.. সুরিয়া নদী…এসবের পেছনে থাকা মানুষটা…কর্তা মশাই…

চলবে ইন শা আল্লাহ…