এমন দিনে তারে বলা যায় পর্ব-০২

0
234

এমন দিনে তারে বলা যায়
পর্বঃ ০২
সানজিদা মাহি
_____________________________________________

ঘুম ভাঙ্গলো পাখির সুমধুর কলকাকলীতে। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি আঁধারের গভীরতা খুব বেশি না। আবছা আলোয় সে গভীরতা ক্রমেই কমে আসছে। ভোর হব হব করছে। তারমানে নামাজের সময় হয়েছে। গোসলখানা থেকে ওজু করে এসে নামাজ শেষ করলাম। এরপর দরজা খুলে ঘরের বাহিরটা দেখতে বের হলাম। কাল সেই যে এসেছি বাইরে আর বের হওয়া হয়নি। অন্ধকার ভাবটা সরে গিয়ে আলো ফুটেছে। আশেপাশে অনেক গাছপালা। ঘরের একপাশে মাঝারি সাইজের একটা আমগাছ। গাছের উপরাংশ গাঢ় সবুজ পত্রে আচ্ছাদিত। দেয়াল থেকে কিছুটা দূরে বিরাট এক শিরীষ গাছ সগর্বে দাঁড়িয়ে। রাতে ফের বৃষ্টি হওয়ায় গাছের চিকন চিকন পাতাগুলো ভিজে আছে। হঠাৎ হঠাৎ একটা- দুইটা ফোঁটা পাতা গড়িয়ে মাটিতে পড়ছে। বৃষ্টিতে ভেজা মাটির সোঁদা সোঁদা গন্ধটা এসে নাকে লাগলো। মনে হলো এই গন্ধটাই আমাকে এতদূর টেনে এনেছে৷ সেই শৈশবের স্মৃতিগুলো মানসপটে বেশ পরিচ্ছন্ন মনোভাবে পুরনো দৃশ্যের অবতারণা ঘটালো যেন। কল্পনাকে মাঝে মাঝে বাস্তব বলে ভ্রম হয় আমার৷ বেশ অনেকদিন পর কল্পিত কোনো চিত্রের কথা ভেবে উদ্বীগ্ন হই। মনে হয় এটা তো কল্পনা ছিল না নিশ্চয়ই বাস্তবে ঘটেছিলো। নইলে এতো পরিষ্কারভাবে মনে থাকবে কেন?

একবার নিস্তব্ধ দ্বীপ্রহরে চারদিকে শূন্য শূন্য একটা ভাব নিয়ে আমি ঘরে শুয়ে বই পড়ছিলাম। পড়া অবস্থায় কি মনে করে মুখ তুলে জানালার দিকে দীর্ঘক্ষণ চেয়ে রইলাম। আমার জানালা দিয়ে বেশ ভালোভাবে আকাশ দেখা যায়। অনতিদূরে একপাশে একটা বড় আমগাছ থাকায় শোয়া বা বসা অবস্থায় জানালার অর্ধেকটা দিয়ে সবুজ পাতায় ঝাকড়া গাছটা আর অর্ধেকটা দিয়ে আকাশ দেখা যায়। এমনও সময় গেছে আমি জানালা দিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে একটানা আধ ঘন্টা, এক ঘন্টাও কাটিয়ে দিয়েছি একঘেয়েমি লাগা ছাড়াই। খুব বেশি কিছু তো দেখা যায় না জানালা থেকে। তবু জানালা দিয়ে তাকিয়ে অনেকটা সময় আমি কাটিয়ে দিতে পারি। আম গাছটার একটা ডালে একটা দাঁড় কাক বসে থেকে থেমে হাঁক পাড়ছে। আমার দৃষ্টি ছিল সেখানেই। হঠাৎ পাঁচ-ছয় বছর বয়সী একটা ফুটফুটে মেয়ে জানালায় উঁকি দিল। মেয়েটির পরনে যে ফ্রকটা ছিল সেটা হুবহু আমার পরনের শাড়ির ফুলগুলোর মতো এবং ঠিকই রঙের। ভালো করে খেয়াল করে দেখলাম আমার শাড়ির কাপড় আর মেয়েটার গায়ের জামাটা হুবহু একই ধরনের৷ মেয়েটা ঠোঁট চেপে মিটিমিটি হাসছে। চোখগুলোতে খেলা করছে জীবন্ত হাসি। আমি উঠে বসে মাথা দুলিয়ে বললাম,
” ভেতরে আসবে? এসো.. ”
ক’সেকেন্ড পর মেয়েটি আমার ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। খেয়াল করলাম ওর হাতে একটা চিঠির খাম। খামের রঙ হলুদ। এমন সময় পাশের ঘর থেকে বাবা ডাক দিলেন আমাকে। অমনি মেয়েটা দৌড়ে চলে গেল। আমিও তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে নেমে বারান্দার এদিক ওদিক খুঁজতে লাগলাম মেয়েটাকে। মেয়েটা মুহূর্তের মধ্যেই একেবারে উধাও হয়ে গেছে৷ বারান্দা থেকে ছোট উঠানমতো জায়গাটায় ছুটে এলাম। না এখানেও নেই। আমাদের কলাপসিবল গেইটটিও ভেতর থেকে আটকানো। বাবার ঘরে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, একটা ছোট মেয়েকে দেখেছে কিনা। বলল, দেখেনি। মেয়েটা মুহূর্তেই কোথায় হারিয়ে গেল মাথা খাটিয়েও বোধে এলো না। উপরন্তু জেরার সম্মুখীন হতে হলো বাবার নিকট। পরে মাথা ঠান্ডা করে অনেক ভেবেছি। এটা আসলে আমার ভ্রম ছিল। অথচ এই এতদিন পরও সে ঘটনাকে আমার নিতান্ত বাস্তব লাগে। মেয়েটার সেই হাসি হাসি মুখখানা আজও ভাসে চোখে। কল্পনার এই এক সমস্যা থাকলেও লাভও আছে বেশ। এই যেমন শৈশবের সেই মধুর দিনগুলো আর কখনো ফিরে আসবে না ঠিকই তবু সেই দিনগুলো কল্পনা করে আমি এখনো ছোটবেলার অনুভূতিটা ফিরিয়ে আনতে পারি।

হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা ঘুরে ফেলেছি। উঠানের একপাশটা একদম কাঁদা কাঁদা হয়ে আছে। ওদিকটায় গেলে নির্ঘাত আছার খাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই সেখানে আর গেলাম না।

ঘরে বাজার বলতে তেমন কিছু নেই বলে সকাল বেলাতেই ভাত বসিয়ে দিয়েছিলাম চুলায়। আর আলু ভাজি করেছি। তাই খেয়েই উনি বেরিয়ে গেছেন। বাজারের কথা বলতেই, বললেন নজুকে দিয়ে পাঠিয়ে দেবেন। আসার সময় বাজার টাজার কিছু চোখে পড়েনি। অনেক দূরেই হবে হয়তো। তাছাড়া যতটুকু জানি গ্রামে সপ্তাহের প্রতিদিন বাজার বসে না। বেলা এগারটা কি বারটা হবে এমন সময় নজু এলো বাজার নিয়ে। বললো মাহমুদ স্যার পাঠিয়েছেন। আমি বাজার রেখে ওকে ভিতরে বসতে দিলাম। ছেলেটা কয়েকবার না করে শেষে ভিতরে এসে চেয়ারে বসলো। গ্রামের ছেলে তবু লজ্জা ভাবটা প্রকট। লজ্জার মধ্যে একটা সম্ভ্রান্ত ভাব থাকে। এটা খোয়ালেই ব্যক্তিত্বের ভার কমতে থাকে। যদিও ছেলেটা ছোট। অতকিছু বুঝার বয়স নয় তার। তবু ব্যাপারটা ভালো লাগলো।

বাজার ছাড়াও উনি টোস্ট বিস্কুট আর এক প্যাকেট চানাচুরও পাঠিয়েছেন। আমি দু কাপ চা বানিয়ে এক কাপ নজুকে দিলাম আরেক কাপ আমি নিজে নিলাম। নজুকে হেসে দু-একটা কথা জিজ্ঞেস করাতেই ছেলেটা ধীরে ধীরে সহজ হয়ে এলো। টোস্ট বিস্কুট চায়ে ভিজিয়ে খেতে লাগলো। ওকে এখানকার ব্যাপারে টুকটাক জিজ্ঞেস করলাম। কথার একপর্যায়ে সে তার মাহমুদ স্যারের প্রশংসা জুড়ে দিল। এবং এটা বলতেও ভুললো না, আমি অনেক ভালো মানুষ। খাওয়া শেষ করে নজু উঠে পড়লো। বেশি দেরি হলে মাহমুদ স্যার বকা দিবেন। সে হলো মাহমুদ স্যারের অ্যাসিস্ট্যান্ট অর্থাৎ তার বাঁ হাত। আমি হেসে ওকে আবার আসতে বললাম। ছেলেটা মাথা কাত করে আবার আসার নিশ্চয়তা দিয়ে চলে গেল।

দুটো মানুষের সংসার। কাজ বলতে তেমন কিছুই নেই। রান্না আর ঘর গোছানো। এ দুটো কাজ ছাড়ালে সারাটা দিন অফুরান অবসর। দুপুরে তিনি খেয়ে গেলে একটা বড় দায়িত্বও যেন শেষ হয়ে যায়। দুপুরটা কাটে বই পড়ে কিংবা নদীর পাড়ে ঘুরোঘুরি করে। যেদিন বৃষ্টি থাকে তখন চারদিকের রূপ হয় একরকম আর যেদিন রোদ ওঠে তখন হয় অন্যরকম। বাড়ির পেছন দিয়ে একটা সরু রাস্তা অনেকদূর অবধি চলে গেছে৷ হয়তো কোনো গ্রামের দিকে গিয়ে শেষ হয়েছে। বাড়ি থেকে কয়েক কদম এগিয়ে গেলে রাস্তার নিচেই নদীর একবার কিনারা ঘেষে বিরাট একটা জাম গাছ। জাম গাছের ওপাশে কিছু জংলা গাছের সারি। সেখানে দাঁড়ালে অতি সহজে নিজেকে আড়াল করা যায়। যদিও তার খুব একটা প্রয়োজন হয় না। আশেপাশে জনবসতি নেই। নদীটাও বড় নয় বলে নৌবাহনের সংখ্যা নিতান্ত৷ একটা চট বিছিয়ে সেখানে বই নিয়ে বসা যায় অনায়াসে। তবে পড়াটা ঠিক হয়ে ওঠে না। নদীর সৌন্দর্য আর প্রকৃতিকে উপভোগ করতে গিয়ে কখন সময় পার হয়ে যায় বলতে পারি না। দুপুরে গিয়ে যখন বিকেলে ফিরে আসি তখন বইয়ের পৃষ্ঠা গুণতে গিয়ে হতাশ হতে হয়। কিন্তু তাতে মনে অবসাদ থাকে না। একটা অন্যরকম সুখে মনটা আবেশিত হয়ে থাকে। যখন সূর্যরাজ বেশ দাপটের সঙ্গে আলোকিত হয়, রোদ প্রতিফলিত হয় নদীর স্বচ্ছ জলে তখন ফোঁটা ফোঁটা মুক্তদানার মতো রোদে চিকচিক করতে থাকে নদীজল। জাম গাছের বিশাল গুঁড়িতে নিশ্চিন্তমনে খেলা করে স্বচ্ছ জলের কম্পমান স্রোতধারার ছায়া। দুলে দুলে পেলব ছায়া গুলো নাচতে থাকে অনবরত। সেদিকে এক নিবিষ্ট হয়ে চেয়ে থাকতে ভালো লাগে। একটা হলুদাভ স্নিগ্ধতা ছুঁয়ে দেয় মন। আর যখন বর্ষন হয়, বর্ষা আর বাতাসের তোপে গাছের পাতাগুলো হেলেদুলে যেন বৃষ্টির সঙ্গে গাইতে থাকে গান। নদীর পানিতে একাধারে ঝরতে থাকে আকাশের অশ্রু। আমি জানালা দিয়ে শুধু আম গাছের পাতা আর একখন্ড আকাশ দেখে মুগ্ধ হওয়া মানুষ। এখানে এসে প্রতি পদে পদে আমি মুগ্ধ হই। গ্রামের এত সৌন্দর্য আমাকে শিহরিত করে। মাঝে মাঝে তো মনে হয় আমার ঠিক বিয়ে হয়নি। মফস্বল ছেড়ে এই এতদূর একটা অজপাড়াগাঁয়ে আমাকে হাওয়া বদল করতে পাঠানো হয়েছে। আমি সে সুযোগ ভালোমতোই কাজে লাগাচ্ছি। মহান রব পৃথিবীতে মানুষের মন ভালোর কারণ হিসেবে এত এত উপকরণ সৃষ্টি করেছেন। না জানি জান্নাত— সেই প্রত্যাশিত গন্তব্য কতটা সুন্দর! যদি রবের দয়া বশত জান্নাত পেয়ে যাই তবে যুগ যুগ ধরে জান্নাতের সৌন্দর্য অবলোকন করেও আমার মুগ্ধতা কি আদৌ কাটবে?

দুদিন পরের কথা। দিনটা শুক্রবার। শুক্রবারে মাত্র একবার ট্রেন যায়। বিপরীত দিক থেকে কোনো ট্রেন আসে না। তাই উনার কাজও মাত্র একবেলা। সকাল বেলাতে আমাকে বললেন, এখান থেকে মসজিদ অনেকটা দূর। সেখানে গিয়ে জুম’আর সালাত আদায় করতে হয়। মাঝে একটা গ্রাম পড়ে। আমি তার সাথে যাব কিনা? আমি প্রথমে কথাটার মানে উদ্ধার করতে পারলাম না। আমি তার সাথে মসজিদে গিয়ে কি করব? উত্তর পেলাম পরের কথাতেই। উনি মসজিদে যাবেন নামাজ পড়তে, আমাকে গ্রামে রেখে যাবেন। সারাদিন তো একাই থাকি। কিছুটা সময়ও কাটলো। আমি তো মহাখুশি। সকালে নাস্তা সেরে আমরা রওয়ানা হলাম। অনেকদূর অবধি হাঁটাপথ। হেঁটেই যেতে হবে। দুজন নদী ঘেঁষা রাস্তা ধরে হাঁটছি। উনি হঠাৎ বললেন,
” এ নদীটার নাম কি জানেন? ”
” না তো। কি নাম? ”
” সুরিয়া নদী ”
” সুরিয়া নদী! নামটা সুন্দর তো ”
” এই ইউনিয়নের নামটা আরও সুন্দর। অচিন্তপুর ”
” অচিন্তপুর! ভীষণ সুন্দর! ”

এদিকের অঞ্চল যেমন সুন্দর তেমনি নামগুলোও। গৌরীপুর, অচিন্তপুর, সুরিয়া নদী নামগুলো ঠিক জায়গারই অন্যরূপ।

” এই সুরিয়া নদীটা অনেক বড়। আমাদের বাড়ির সামনে প্রস্থ ছোট হলেও আরেকটু সামনে গেলেই দেখবেন নদী অনেক বড় হয়ে গেছে। গৌরীপুরের অচিন্তপুর ও মাওহা ইউনিয়নের ভেতর দিয়ে প্রবাহমান সুরিয়া নদী। উপজেলার সীমানা পাড়ি দিয়ে সুরিয়া নদী মিশেছে নেত্রকোনার ঝিটাই নদীতে ”
” আপনি এখানে কয় বছর আছেন? ”
” এই তো প্রায় তিন বছর ”
” এতদিন! এতদিন একা একা থাকলেন কি করে? ”
” জানি না কিভাবে কেটে গেছে। কোয়ার্টারটা পেয়েছি বেশিদিন হয়নি। আগে স্টেশন ঘরেই থাকতাম। নজুকে তো দেখেছেন। ও আমার সাথে আছে অনেকদিন যাবত ”
” একা একা থেকে কখনো কোনো অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়নি? ”

আজ আমাকে গল্পে পেয়েছে যেন। আমার স্বামী মশাইটি এই তিনদিনে আজই এভাবে কোনো জড়তা ছাড়া আমার সঙ্গে কথা বলছে। দ্বিধার দেয়ালটা এখনো কাটেনি তা বেশ বোধগম্য। ছেলে মানুষ এতটা লাজুক, জড়তা-সংকোচে নুব্জ্য হতে পারে কখনো শুনিনি। এক দেখেছি আমার বড় ভাই। তার মধ্যে সংকোচের কোনো বালাই নেই। সারাক্ষণ মুখটা গম্ভীর করে রাখবে। তারপর হুট করে এমন কিছু বলে বসবে যে কেউ ভাবতে পারবে না এই রাশভারি মানুষটির পক্ষে দ্বিধা সংকোচ ছাড়িয়ে এ ধরনের কথা বলা সম্ভব।

সারাটা রাস্তায় গল্প করতে করতে আমরা গ্রামে এসে পৌছালাম। গ্রামের নাম ধারাকান্দি। উনি একটা প্রায় ভাঙাচোরা টিনের ঘরের সামনে এসে নজুর নাম ধরে কয়েকবার ডাক দিলেন। কিছুক্ষণ নজু লুঙ্গির উপর একটা আধ ময়লা সেন্ডো গেঞ্জি পরে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। আমাদেরকে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভীষণ অবাক হলো। উনি আমাকে নজুর মায়ের কাছে হস্তান্তর করে নজুকে নিয়ে চলে গেলেন। নজুর মায়ের নাম ঝরনা বিবি। মেয়েটি বয়সে আমার চেয়ে খুব বড় হবে না। বড়জোর দুই-তিন বছর হবে বলেই ধারণা। মেয়েটি ঠিক লম্বা নয় আবার খাটোও নয়। গায়ের৷ রঙ বেশ চাপা। পরনের শাড়িটি মলিন। কয়েক জায়গায় তালি দেয়া। ঝরনা বিবি আমাকে যথেষ্ট খাতির করলো। তার স্বামীর স্থায়ী কোনো পেশা নেই। যখন যে কাজ পায় তাই করেন। কাজের কারণে তিনি কয়েক দিনের জন্য অন্যগ্রামে গেছে শুনে বোরকা খুলে ফেললাম। ঝরনা বিবি রান্নাঘরে কাজ করছিলো। খানিকটা ইতস্তত করে রান্নাঘরে একটা পিড়িতে বসতে দিল। ছোট বাঁশ, ছন আর হরমুলের তৈরি রান্নাঘর। এক কোনায় সাত-আট মাস বয়সী একটা মেয়ে মাটিতে লেপ্টে বসে সুপারির কাটা খোলে মুড়ি খাচ্ছিলো। নাক দিয়ে সর্দি ঝরছে। সেই সর্দি ঠোঁট অবধি আসতেই মেয়েটি জিভ দিয়ে টেনে সেটা মুখে পুরে নিচ্ছে। খুবই বিদঘুটে, শ্রীহীন, কদর্য দৃশ্য। কিন্তু আমার খারাপ লাগলো না। মনে হলো এই পরিবেশে এই বিদঘুটে দৃশ্যটাই মানানসই। ঝরনা বিবি রান্নার ফাঁকে ফাঁকে আমার দিকে পরিপূর্ণ দৃষ্টি দিচ্ছিলো। সেখানে মুগ্ধতা ছিল, বিস্ময় ছিল, ছিল খানিকটা অবিশ্বাসও। শহুরে মেয়ে সম্পর্কে ঝরনা বিবির যে ধারণা ছিল তা বোধহয় আমার সাথে মেলেনি। হয়তো আরও বেশি চতুর, সৌন্দর্য-সচেতন কাউকে আশা করেছিলো। কে জানে হয়তো ভাষা আর বাচনভঙ্গি না মিললে সে হয়তো বিশ্বাসই করতো না স্টেশন মাস্টার মাহমুদ একটা শহুরে মেয়েকে বিয়ে করেছে।

ঝরনা বিবির আরেকটা সংকোচের কারণ ধরতে পারলাম কিছুক্ষণ পর। মেহমানকে আপ্যায়ন করবার মতো উপকরণ সামান্যই। হেলেঞ্চা শাক আর আলু দিয়ে কইমাছের ঝোল। সাথে মোটা লাল চালের ভাত। আমি তাকে সহজ করার জন্যই এটা ওটা জিজ্ঞেস করতে লাগলাম। ঝরনা বিবি উৎসাহের সাথে সেসবের উত্তর দিতে লাগলো। গ্রামের সাধারণ মানুষের যাপিত জীবনের গল্প, নদী আর ক্ষেতের গল্প, বর্ষায় গ্রামের রূপের গল্প, খাল-বিলের মাছের গল্প, গরু থেকে শুরু করে হাস-মুরগী-ছাগল সহ অন্যান্য গৃহপালিত প্রাণীর গল্প। সবই সাধারণ কথা তবে আমার কাছে নয় ঝরনার বিবির কাছে। সে গ্রামের মেয়ে। তার কাছে এসব নিত্যদিনকার সঙ্গী মাত্র। কিন্তু আমার কাছে বৈচিত্র্যময় প্রতিটি গল্প সাধারণ থেকে অসাধারণ হয়ে ধরা দিচ্ছিলো।

আমাদের গল্প আর রান্নার মাঝপথেই তুমুল বৃষ্টি শুরু হলো। আমি উঠে দাঁড়িয়ে রইলাম দরজার সামনে। এটাকে দরজা বলা যায় কিনা আমি জানি না। কারণ এই ফাঁকা জায়গাটা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করা গেলেও আটকাবার মতো কোনো বাহ্যিক আবরণ ছিল না। বাতাসে মাটির চুলার আগুন বারবার নিভে যাচ্ছিলো। আমি সামনে দাঁড়ানোর কারণে বাতাস ভেতরে না ঢুকতে পেরে আমার গায়ে বারি খাচ্ছে। বৃষ্টির ছাঁটা এসে আমার পায়ের পাতা সম্পূর্ণ ভিজিয়ে দিয়েছে। গোলাপি রঙের শাড়ির সোনালী ফুল তোলা আঁচলটা বাতাসের তীব্রতায় উড়ছিল বৃষ্টির সঙ্গী হতে। আমি বাঁধা দিলাম না। ঝরনা বিবির ছোট মেয়েটি এক ফাঁকে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে বৃষ্টির মধ্যে কাঁদামাখা মাটিতে হামাগুড়ি দিয়ে সামনে এগিয়ে গিয়ে এক জায়গায় বসে পড়লো। বাচ্চাটি দুই হাত মাটিতে ছুঁড়ে কাঁদা ঘাটছিল। একপর্যায়ে আমার দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হেসে ওঠে হাত দুটো কাঁদায় মাখিয়ে দু’পাশে নাড়তে লাগলো। আমি অপলক নয়নে তাকিয়ে রইলাম সেদিকে। কানে বাজছিল শিশুটির অকুটিল, প্রাঞ্জল, সরল হাসি। হ্যা এটাই তো সেই বহুদিন আগে হারিয়ে ফেলা আমার শৈশবের দৃশ্য। গ্রামের প্রতিট শিশুর মতো আমিও কি এভাবে কাঁদা মেখে খেলিনি? আমি মুগ্ধচোখে দেখছিলাম শিশুটির সারল্য ছেলেমানুষী। সেখানে রচিত হচ্ছিল বড় হয়ে যাওয়া আরেকটি শিশুর শৈশবের দৃশ্যপট….

চলবে ইন শা আল্লাহ….