#এল_এ_ডেইস
পর্ব ৩০
লেখনী মাহীরা ফারহীন
সোনালি রোদের পরশে হলদেটে দেখাচ্ছে নরম সবুজ ঘাসগুলো। সম্পূর্ণ নদীর পাড়টুকুই ঘাসের চাদরে মোড়া। বাতাস বয়ে যাচ্ছে শনশন শব্দে। কার্ডিনাল পাখির সুরেলা গান থেমে গিয়েছে। এখন শুধু শোনা যায় ভিরি ও নাইটিংগেলের কিচিরমিচিরের শব্দ। এই বনে প্রচুর নাইটিংগেল পাখির বসবাস বোধহয়। প্রায়ই শোনা যায় তাদের কলরব। একটা গাছে হেলান দিয়ে হাতদুটো আড়াআড়ি ভাবে বুকে বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে রায়েদ। গম্ভীর মুখভঙ্গি। সেখান থেকে নদীর পাশ হতে সামনে বেশ কিছুদূর শুধু ঘাসে ঢাকা পাড় এবং এবং গাছপালা দেখা যায়। মাঝে অনেকেই ঘাসের ওপর বসে আছে। একটা গাছের নিচে হলদে রঙের কুর্তি পরা একটা মেয়ে বসে আছে। কাঁধ থেকে একটু লম্বা,ছাড়া চুলগুলোয় মুখটা প্রায় ঢেকেই আছে। ওদিকে দৃষ্টি পরতেই ভ্রু কুঁচকে গেল রায়েদের। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মাহীনের পানে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। ক্ষণেই এক রাশ অস্থিরতা জেঁকে বসল বুকে। ভাবছে, কি ব্যাপার আধাঘন্টাও তো হলো না মাহীনকে নৌকায় দেখলাম। এরই মাঝে কখন ফিরে আসল? আর ও এখন মুখ গোমড়া করে গাছের নিচে বসে আছে কেন? দেখে তো মনে হচ্ছে কি দুর্ঘটনাটাই না ঘটেছে ওর সাথে।’ ভাবতে ভাবতেই সন্তর্পণে এগিয়ে গেল সেদিকে। তবে কাছাকাছি পৌঁছতেই থেমে গেল। সামনে যাবে কি না তা নিয়ে বিভ্রান্তিতে পরে গেল। ও যে এখানে এগিয়ে আসতে গেল কেন তাও ঠিক ঠাহর হলো না। সামনে বসে থাকা মেয়েটার ওপর এক চাপা অভিমানের সৃষ্টি হয়েছে। তবে রায়েদের ভাবনার বিষয় হচ্ছে আদৌও কী মাহীনের ওপর অভিমান করার অধিকার ওর আছে?
হঠাৎ মাহীন মুখ তুলে সরাসরি ওর দিকেই চাইল। ও নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল যেন একটুও অবাক হয়নি রায়েদকে সামনেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। তবে মাহীন কিছুই বললো না। ওর দৃষ্টি একদম শান্ত স্রোত হীন পানির মতো। রায়েদও কিছুই না বলে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে ওকে দেখছে। একটু একটু করে মাহীনের মুখে ব্যাথাতুর ভাব ফুটে উঠল। হঠাৎ ওকে দেখে এত কষ্ট পাওয়ার মতো কী হলো তা ঠিক বুঝতে পারলো না রায়েদ। ভ্রু কুঞ্চিত করে তাকিয়ে থাকল। অবশেষে যেখানে ছিলো সেখান থেকে মুখ খুললো,’কী ব্যাপার তুমি এমন বিষন্ন ভাবে এখানে বসে আছো কেন?’
মাহীন নির্বিকার চিত্তে বলল,’বসো।’
রায়েদ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,’কী?’
‘বসো। এমন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলবা?’ বলল মাহীন। এবার রায়েদ এগিয়ে গিয়ে ওখানেই ওর পাশে বসল। মাহীন হঠাৎ করে প্রফুল্লিত হয়ে উঠল। ওর মনের আলো এমন ভাবে জ্বলে উঠল যেন খরায় কাঠ শুকনো জমিনে হঠাৎই ঝুপ করে বৃষ্টি আরম্ভ হয়ে তার শীতল পরশে প্রাণ ফিরে পেলো জমিন। আগ্রহী কন্ঠে বলল, ‘এখনো হাতে সময় আছে। তুমি আমার সাথে বোটিং করতে যাবা?’
হঠাৎ এমন প্রস্তাবে রায়েদ অবাক হলো। একই সঙ্গে হতবাক। ভ্রু কুঞ্চিত করে তাকিয়ে থেকে ভাবল, একটু আগেই না ও বিলের সঙ্গে বোটিং করতে গেল। তাহলে হলোটা কী? ও এত তাড়াতাড়ি ফিরেই বা আসলো কিভাবে? আর এখন আমার সাথেই বা যেতে চাচ্ছে কেন?’ ভাবতেই বলল,
‘কিন্তু তুমি তো কিছুক্ষণ পূর্বেই বিলের সঙ্গে গিয়েছিলা বোটিং এ।’
এই কথায় মাহীন কিঞ্চিৎ বিরক্ত হলো। বলল,
‘হ্যা গিয়েছিলাম। কিন্তু…রায়েদ মাঝখান দিয়ে বলল,
‘তাহলে এত তাড়াতাড়ি ফিরে আসলা কেন?’
মাহীন ইতস্তত করে বলল, ‘উম কারণ আমার ঠিক ভালো লাগছিল না তখন। সে যাই হোক এই জন্যে আমার বোটিং ঠিকঠাক হয়ইনি। এবং আমি আবার যাবো।’
‘এবং আমার সাথেই কেন? তোমার ফ্রেন্ডরাও তো ছিলো?’
মাহীন শান্ত কন্ঠে বললো, ‘কারণ আমি তোমার সাথেই যেতে চাই। সকালে তুমি আমাকে সূর্যদয় দেখাতে পর্বত চূড়ায় নিয়ে গিয়েছো তাহলে আমি কী আমার সাথে নৌকায় ওঠার প্রস্তাব দিতে পারি না?’ বলে জুলজুল চোখে তাকাল। ওর চোখের দিকে সরাসরি তাকানোরও অনুমতি দিচ্ছে না হৃদয়। হৃদয় দ্রিমদ্রিম শব্দ করে দ্রুত গতিতে লাফাচ্ছে। হঠাৎ হৃয়ের অদ্ভুত হইচইয়ে বিচলিত হলো রায়েদ। বাধ্য হয়ে মাহীনের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে বলল, ‘ওহ আচ্ছা এই তাহলে কারণ। কিন্তু তুমি আমাকে আগেই বলতে পারতে। দেরি হয়ে গেলো না এখন?’
মাহীন পানসে গলায় বলল, ‘ওফ আমি আগেই বলতাম। যদি না মাঝখান দিয়ে ঝামেলা হতো। তোমাকে তো ধারে কাছেই পাইনি। এনি ওয়েজ। বলো না যাবে না?’
রায়েদের মনে জমে থাকা চাপা অভিমানটা কোথায় যেন হারিয়ে গেল। মনেই হলো না সেটা কখনোও ছিলো। প্রসন্ন কন্ঠে বলল, ‘ঠিক আছে যাবো।’
মাহীন হঠাৎ আনন্দে এমন ভাবে লাফিয়ে উঠল, রায়েদ এক মুহূর্তের জন্য ভাবল ওকে বুঝি জড়িয়ে ধরল। তবে মাহীন এমন কিছুই না করে উঠে দাঁড়াল। রায়েদও উঠে দাঁড়াল। মাহীন বলল, ‘আচ্ছা তো একটা কথা বলার ছিলো। আমরা যেখানে যাবো সেটা হচ্ছে দক্ষিণ মাউমেল নদী ও উত্তর মাউমেল নদীর মিলন স্থল।’
রায়েদ চোখ বড় বড় করে তাকাল। অবাক কন্ঠে বলল,
‘ওখানে যে স্রোতের প্রবাহ বেশি সেটা আদৌ তুমি জানো?’
মাহীন বলল,’জানি। তবে আমরা ওই জায়গাটায় ঠিক যাবো না। তার পূর্বে দুইপাশে জঙ্গল ঘেরা যে সরু নালী মতো আছে সেখানে যাবো। ওখান থেকে তো নৌকা স্রোতের টানেও বেরিয়ে আসতে পারবে না।’
ওরা নৌকা বাঁধা স্থানটির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। রায়েদ জিজ্ঞেস করল,’তুমি রাস্তা জানো তো?’
মাহীন চোখ টিপে বলল,’নো টেনশন।’
নৌকাগুলোর কাছে পৌঁছে একটা নৌকা খুঁটি থেকে খুলে নিতে নিতে রায়েদ বলল, ‘আমি জানি না বাবা। আদৌ তুমি আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো। খুন করবা না তো?’
মাহীন হেসে বললো, ‘আহ আমার ডায়লগ নকল করা। আগেই শুনে রাখো আমি কিন্তু নৌকা বাইতে পারি না। তোমাকে খুন করলে আমি কিভাবে ফিরে আসব?’
রায়েদ আমুদে কন্ঠে বলল,’হুম যুক্তিসংগত কথা। তাহলে আমি নিরাপদ।’ এবার মাহীন প্রথমে নৌকায় উঠলো। ঢেউয়ের প্রবাহে নৌকা দুলছে বলে মাহীন টলতে লাগল। রায়েদ ওর হাতটা শক্ত করে ধরে বসতে সাহায্য করল। এরপর নিজে নৌকায় উঠে বসলো এবং বৈঠা হাতে নিলো। বৈঠা পানিতে নামিয়ে ঢাক্কা দিলো। প্রবল বেগে বাতাস হচ্ছে। ওরা বাম দিকে ঢেউয়ের বিপরীতে এগিয়ে চলেছে। মাথার ওপরের গাছের সবুজ ছাউনির সঙ্গে নদীর সেদ্ধ জলপাই রঙা পানি মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। রায়েদ বৈঠা চালাতে চালাতে বলল,
‘তুমি যেখানে যেতে চাচ্ছো সেই জায়গা এবং ওখানকার গতিপথ সম্পর্কে কিভাবে জানলে?’
মাহীন প্রসন্ন মনে নদীর পানিতে এক হাত ডুবিয়ে রেখেছে। শীতল পানি তিরতির করে হাত ছুঁয়ে গিয়ে শরীরে কাঁপন ধরিয়ে দেয়। পানির দিক থেকে দৃষ্টি না ফিরিয়েই বলল,’মি.ববোফিট বলেছেন।’
‘আর যদি তুমি ভুলে যাও?’
‘আমার এখন পর্যন্ত মনে আছে। আর যদিও আমি ভুলে যাই তাহলেও আমার প্ল্যান চেরনোবিল রেডি আছে।’
‘আর প্ল্যান চেরনোবিল টা কী?’
মাহীন এবার মুখ তুলে চাইল। হেসে বলল,’আমি ওনার কথাগুলোই রেকর্ড করে এনেছি।’
রায়েদ অবাক হয়ে হেসে বলল, ‘অবিশ্বাস্য।’ তারপর মাহীন আবারও পানিতে হাত ভেজাতে মনোযোগ দিল। বাতাসে ওর চুল উড়ে বার বার মুখের ওপর এসে পরছে। রায়েদ জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা তোমার মধ্যে কী এমন কোনো ব্যাপার আছে যেটা তুমি নিজেই পছন্দ করো না?’ মাহীন মুখ তুলে চাইল। ওর কপালে চিন্তার ছাপ করল। কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল,’হুম আছে। আমার ট্রাস্ট ইস্যু আছে। এটাই আমি পছন্দ করি না।’
‘যেমন?’
মাহীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
‘যেমন সবার সাথে সহজে বন্ধুত্ব হয় তো ঠিকই কিন্তু তাদের খুব কমজনকেই আমি আসলে বিশ্বাস করতে পারি। এইজন্যেই তো সহজে কোনো বিষয়ে কারো কাছে মুখ খুলি না।’
রায়েদ সায় জানিয়ে মাথা নাড়ল। এবং বলল,’আর আমি?’
‘তুমি কী?’
‘বলছি আমাকেও বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়?’
মাহীন স্মিথ হাসল। বলল, ‘আমি যে নৌকা চালাতে পারি না সেটা তোমাকে জানিয়ে দিয়ে এই খরস্রোতা নদীতে আমার জীবনের পুরো নিরাপত্তার দায়িত্ব তোমাকে দিয়ে এসেছি। আর কিছু বলার আছে?’
রায়েদ মুচকি হেসে না সূচক মাথা নাড়ল। মাহীনের মনে রায়েদের জায়গাটা কতটা বিশেষ সে সম্পর্কে আরোও পাকাপোক্ত ধারণা হলো ওর। মনে হলো এর চাইতে ভালো কিছু বোধহয় অনেক কাল ধরে শোনা হয় না।
মাহীন পথ বাতলে দিচ্ছে এবং রায়েদ সে অনুযায়ী নৌকা বাইছে। আকাশের ক্যানভাসের রঙ পাল্টেছে। সারা আকাশ জুড়ে কমলা, গোলাপি বা বেগুনির মাখামাখি। সূর্য ডোবার প্রস্তুতি পর্ব শুরু হয়েছে। সবুজাভ জলের ভেতরও অনেক গাছের গোড়া ডুবে রয়েছে। মাথার ওপর খোলা আকাশ নয় বরং ডালপালায় ছাওয়া ছাউনি চোখে পরে। নদীর পানি থেকে আরম্ভ করে সবকিছুই সবুজ তার ওপর সোনালী রোদ পরে হিরের মতো চিকচিক করে উঠছে। মাহীন পানিতে হাত ডুবিয়েই রেখেছে। হঠাৎ পানি থেকে হাত উঠিয়ে রায়েদের দিকে পানি ছিটা দিলো। রায়েদ মুখ কুঁচকে ফেললো। হাসতে হাসতে তীব্রভাবে বলল, ‘মাহীন!’
মাহীন হাসতে হাসতে আবার পানি ছিটা দিলো। রায়েদ হাত দিয়ে মুখ ঢাকল। তারপর হাসতে হাসতে বলল,
‘মাহীন এসব কী? দেখো আমি কিন্তু তোমার ওপর পানি ছিটাচ্ছি না।’
মাহীন ফিচেল হাসি মুখে বললো, ‘তো ছিটাও।’
রায়েদ বলল,’আমার হাতে বৈঠা আছে না। একটা বৈঠা ধরো তারপর দেখো তোমাকে পুরোই ভিজিয়ে দিচ্ছি।’
মাহীন বলল,’না, না থাক। ঠিক আছে আর পানি ছিটাবো না।’
আরো দশ মিনিট পর ওদের নৌকা একটা সরু নালির সামনে এসে থামল। বা ভেসে রইল। সামনে দুপাশের বনের মাঝ দিয়ে সরু নালিটা চলে গিয়েছে। নৌকা তার মধ্যে দিয়ে প্রবেশ করে নিরদ্বিধায় চলতে পারবে। সেখানেই ওদের নৌকা প্রবেশ করল। বিনা বৈঠার সাহায্যেও স্রোতের টানে নৌকা সামনে এগিয়ে চলেছে। তবে ঠিক নালির শেষ মাথায় এসে আটকে গেল। এখান থেকে সামনে অনেক দূর পর্যন্ত শুধুই পানি এবং পানি চোখে পরে। কোথাও কোনো জঙ্গলের চিহ্ন মাত্র নেই। নদীটি দুই দিক থেকে এখানে এসে মিলিত হওয়ায় প্রবল স্রোত পানিতে। নালির বাইরে নৌকা বের হবে না বলে রক্ষা। যদি এই স্রোতের মধ্যে নৌকা সেখানে পৌঁছে যায় তাহলে তা স্রোতের টানে যে কোথায় পৌঁছে যাবে তার কোনো ঠিক নেই। দূর দিগন্তে নদীর বুকে লাল টকটকে সূর্য ডুবে যাবে বলে নিচে নেমে এসেছে। আকাশের একাংশ রক্তিম আভাময়। সূর্যদয়ের সময় সূর্য সোনার মতো সোনালি কীরণ বিচ্ছুরণ করে যেমন উদিত হয় তেমনি একদম রক্ত বর্ণ ধারণ করে লালচে মরা আলো ছড়িয়ে দিতে দিতে কোথাও হারিয়ে যায়। সূর্যের কমলাটে আলো ওদের নৌকায় এসে পরেছে। গায়ে সোনাবরণ রোদের আলো মেখে মাহীনের কালো চোখের মণিকে হালকা বাদামি এবং কালো চুলগুলোকে বাদামি মনে হচ্ছে। শ্যামবর্ণের মিষ্টি চেহারার মেয়েটাকেও কী অদ্ভুত স্বর্গীয় সুন্দর লাগছে। রায়েদ আবিষ্ট নয়নে তাকিয়ে আছে মাহীনের পানে।
বলল, ‘তো আমাকে সূর্যদয় দেখানোটাই তোমার আসল পরিকল্পনা ছিলো তাই না?’
মাহীন হাসল। বলল,’ঠিক তাই।’
দুইজনের মুখেই মিটিমিটি হাসি।
রায়েদ বলল,’সূর্যাস্ত বা সূর্যদয় দুটোরই আলাদা আলাদা অপার্থিব সৌন্দর্য রয়েছে।’
মাহীন প্রসন্ন হেসে বলল,’কি মজার ব্যাপার না আজকের সূর্যের উদয় হওয়াটাও আমরা দুজন একসাথে দেখেছি এবং সূর্যের ডুবে যাওয়টাও একসাথেই দেখছি।’
‘সত্যিই দুর্লভ ঘটনা।’ মুচকি হেসে বলল রায়েদ।
রায়েদ দৃষ্টি ফিরিয়ে দূরের দিগন্তের দিকে তাকাল।
হিরা আকৃতির গঠনের রায়েদের ফরসা মুখখানা স্নিগ্ধতায় ভরে আছে। এই সুন্দর মুখের দিকে পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে আছে মাহীন। ভাবছে,
‘আহা এই সুন্দর মূহুর্তটা আসলে আমাদের ভাগ্যেই ছিলো। মাঝে যতই ঝামেলা হোক না কেন। তবে আজ বুঝলাম তুমি দেখি আমার জন্যে জেলাস ফিলও করো। যাক আজ এই ঘটনা না ঘটলে জানা হতো না।’
.
.
.
.
বড় বড় পাহাড় সমান ধূসর মেঘ জমেছে আকাশে। সকাল থেকে সূর্যের মুখদর্শন হয়নি একবারও।কিছুক্ষণ পর পর বিকট শব্দে আকাশ চীরে বিদ্যুৎ চমকে উঠছে। সকলেই উদ্বিগ্ন বৃষ্টি আসা নিয়ে। সকলের মাঝেই ছোটাছুটির হিড়িক পরেছে। যে যার যার মতো তাবুগুলো খুলে গুটিয়ে ফেলছে এবং এক জায়গায় একত্র করছে। বড় বড় টেবিলগুলোও মোড়াতে ব্যস্ত টিচার এবং ছাত্র-ছাত্রীরা। সকলেই একটি বিষয় নিয়ে অবাক তা হলো আজই সকলে প্রস্থান করছে এবং এই সময়েই বৃষ্টি আসছে। যেকোনো সময় কালো মেঘগুলো ভার বহন না করতে পেরে একজোড়ে বর্ষণ আরম্ভ করবে। পোর্টেবল চুলাগুলো পূর্বেই বাসে নিয়ে তুলে ফেলা হয়েছে। কিছুক্ষণ পরপর আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে সাথে সাথে সকলকেই চমকে দিচ্ছে। সকলে এটা ওটা ব্যস্ত হয়ে গোছাচ্ছে এবং বারংবার আকাশের পানে চাইছে। মাহীনদের তাঁবুগুলো গোছানো হয়ে গিয়েছে। ওরা সকলে অন্যান্য কাজে সাহায্য করছে। রাবিত নিজের সাউন্ড বক্সটা আবার চালাতে চেয়েছিল। তবে সেটা আনপ্যাক করে সেটাপ করার আর সময় পায়নি ও। সবই ঠিক ভাবেই চলছে তবে ওদের মনে হচ্ছে এখনো কিছু একটা বাঁকা ভাবে চলছে। আর তা হলো এসিসিয়া এখনো ওদের সাথে সাথেই লেগে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাঁবু গুটানো থেকে আরম্ভ করে সবকিছুতেই সাহায্য করছে। সাইলোহ ভিন্ন বাকি সকলের সঙ্গে মোটামুটি ওর ভালোই সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। রায়েদকে বেশ কয়েকবার নায়েলের সঙ্গে কথা বলতে দেখা গেল। মাহীন নিশ্চিত অন্তত নায়েলের সঙ্গে রায়েদের বন্ধুত্বটা পাকাপাকি ভাবে হয়েছে। যদিও নায়েল নিজেই এই নিশ্চয়তা দিতে পারছে না। এখন প্রায় বিকেল সাড়ে চারটা বাজে। সকাল থেকে আকাশের মেঘলা মুখ হলেও বৃষ্টি হওয়ার আয়োজন হতে হতে বেলা বেড়েছে। আরো কিছুক্ষণের মধ্যেই সকলে সারি বেঁধে বড় বড় জিনিসপত্রগুলো নিয়ে সেই বড় গেট দিয়ে বেরিয়ে গেল। জায়গাটা ত্যাগ করার পূর্বে মাহীন বেশ কিছুক্ষণ মাঠের চারিদিকে চক্কর কাটলো। মাত্র তিনদিনেই জায়গা খুব আপন হয়ে উঠেছিল। এই জায়গায় হয়তো আরোও ছেলেমেয়েরা আসবে, আরোও পর্যটকরা আসবে তবে ওদের স্মৃতিগুলো ওদের কাছেই রয়ে যাবে। গত তিনদিনের চব্বিশটা ঘন্টায় এখানেই গল্প করেছে, হইচই করেছে, রান্নাবান্না করে, ঘুমিয়েছে, হেঁটে বেরিয়েছে আরো কত কী। আসার সময় যতটা উদ্যমতা ছিলো সকলের মাঝে যাওয়ার সময় ততটাই বিষন্নতা। অবশেষে সকলেই একসময় বেরিয়ে গেল বাইরে। মস্ত বড় মাঠ ফাঁকা হয়ে গেল। জমে থাকা মেঘের ছায়ায় অন্ধকার পরিবেশে জায়গাটা আরোও নিরব, নির্জন, ও নিষ্প্রাণ হয়ে গেল যেন। বেশ কিছুক্ষণ পূর্বেও যেখানটা গমগম করছিল এখন সেখানে গিয়ে কেউ দাঁড়ালে গায়ে কাটা দিয়ে উঠবে। শন শন শব্দে প্রবল বেগে বাতাস গাছপালা দুলিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। বাস পর্যন্ত পৌছুতে লম্বা রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতেই ঝমঝম করে শুরু হলো বৃষ্টি। সকলেই তাড়াহুড়ো করে দৌড়াতে শুরু করলো। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে কোনো রকমে সকলেই ছুটতে ছুটতে বাস অব্দি এসে পৌছলো। এবার বাসে উঠতে চরম ঠেলাঠেলি বাঁধল। টিচারদের ধমক খাওয়া পর অবশেষে সকলে বাসে উঠতে সক্ষম হলো। বাসে উঠার পরও টিচাররা সকল ছাত্রছাত্রীই বাসে উঠেছে কিনা সেটা নিশ্চিত করলেন। গতবারের মতোই মাহীন সহ বাকিরা পেছনের দিকেই গিয়ে বসেছে। বাসের জানালাগুলো সব বন্ধ। বন্ধ জানালায় বৃষ্টির ছটা এসে পরছে এবং কাঁচ ঝাপসা করে দিচ্ছে। বাসের মধ্যে লাইটগুলো জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। রাবিত অনেক ছলেবলে কৌশলে ক্যারোটের পাশের সিটটা দখল করেছে। রায়েদের পাশের সিটটা খালি ছিলো বলে সেখানে নায়েল গিয়ে বসেছে। মাহীন সাইলোর সঙ্গে। জেনেট ও লিও একসাথে বসেছে। এবং সকলকে আরেকদফা চমক দিয়ে এসিসিয়া নিজের বান্ধবীদের ছেড়ে এখানেও লিম জুর পাশে পেছনেই বসেছে। যেখানে বিল সহ ওর বাকি বন্ধুরা সামনের দিকে রয়েছে। সকলের সন্দেহ হতে শুরু করেছে স্কুলের পৌঁছনোর পরও আদৌও কী এসিসিয়া ওদের পিছু ছাড়বে?
ইনশাআল্লাহ চলবে।
#এল_এ_ডেইস
পর্ব ৩১
লেখনী মাহীরা ফারহীন
এরপর দেখতে দেখতে দিন গড়িয়ে চললো। এক সপ্তাহ পার হলো। উত্তপ্ত রোদে মোড়া ক্লান্ত বিকেল। সকাল থেকে স্কুলের কার্যক্রম শেষ করে বিকেল বেলায় রাস্তাঘাট, পার্ক, শপিং মল সবকিছুতে কিশোর কিশোরীদের আনাগোনা বেড়ে যায়। বিশেষ করে ডাঙ্কিন ডোনাটস, পিঙ্কবেরি বা স্টারবাক্সে বেশি দেখা যায় তাদের। তেমনি পিঙ্কবেরিতে ফুটপাথের পাশেই কাঁচের দেয়ালের ভেতর একটা ছোট টেবিলে মাহীন ও ক্যারোল বসে রয়েছে। এটা আইসক্রিম পার্লার। ওরা আইসক্রিম মুখে পুরছে এবং গল্প করছে। ক্যারোল নিজের লাল চুলগুলো পনিটেইল করেছে। মাহীনের চুলগুলো যথারীতি খোলা রয়েছে। এক কানে একটা ছোট টপ পরেছে। ক্যারোল প্রসন্ন কন্ঠে বলছে,
‘নাহ আমি ফ্লোরিডার যেই টাউনে থাকতাম ওটা এতটাও ল্যাভিশ ছিলো না।’
‘ওহ ফ্লোরিডা বলতেই চোখে সামনে যেমন পানির মাঝে লম্বা লম্বা বিল্ডিংয়ের একটা চিত্র ভেসে ওঠে ওটা আর কিছুতে মন থেকে সরাতে পারি না।’ বলল মাহীন।
বড় বড় আইসক্রিম মেশিনের শব্দ ভেসে আসছে। প্রতি মুহুর্তে কাস্টোমারদের আসা যাওয়া চলছে। এক মুহূর্তের জন্যেও কাঁচের দরজাটা স্থির থাকছে না।
‘প্রতিটা জায়গার আলাদা আলাদা সৌন্দর্য থাকে। ফ্লোরিডায় একবার গেলে তুমি বুঝতে পারবে।’
মাহীন প্রসন্ন কন্ঠে বলল,’কখনো সুযোগ হলে অবশ্যই যাবো।’ বলে আইসক্রিমের কাপটা হাতে নিয়ে এক চামচ মুখে পুরলো।
ক্যারোট শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,’আচ্ছা মাহীন আমার কী মনে হয় জানো রাবিত আমাকে পছন্দ করে।’
মাহীন আইসক্রিমটা গিলতে গিয়ে কেনো রকমে বিষম খেলো না। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকল। তারপর বলল,
‘কী? এমন কেন মনে হয় তোমার?’
ক্যারোট শ্রাগ করে বলল,’আরেহ ও সবসময় আমার আশেপাশেই থাকে। আমার সাথে বোটিং করতে গেলো। তারপর গত সপ্তাহে আসার সময় দেখলে না বাসে কত কলাকৌশল করে আমার পাশের সিটেই বসলো। মানে এসব দেখে কে বলবে না এট লিস্ট আমি ওর ক্রাস না?’
মাহীন সায় জানিয়ে মাথা নাড়ল। শান্ত কন্ঠে বলল,
‘হুম লজিক্যাল কথা। তবে এখন তুমি কী করবা? মানে তুমি ওকে নিয়ে কি ভাবো?’
ক্যারোটের মুখে দ্বিধার ছাপ ফুটে উঠল। কপালে গভীর রেখা। কিছুক্ষণ ভাবার পর বলল,’দেখো ওকে অতটা খারাপও লাগে না। তবে আমি ঠিক এটাও বলতে পারবো না যে আমি ওকে খুব পছন্দ করি।’
মাহীন বলল,’হুম তাহলে তুমি ততদিন পর্যন্ত কিছু করতে যেও না যতক্ষণ না পর্যন্ত ও নিজে থেকে কোন হিন্টস দিচ্ছে বা কনফেস করছে।’
ক্যারোট গম্ভীরমুখে সায় জানিয়ে মাথা নাড়ল। বলল,
‘হ্যা আমিও তাই ভাবছি।’ বলে থামল এবং আগ্রহী কন্ঠে বলল, ‘আচ্ছা ট্রুথ এন্ড ডেয়ার খেলার সময় না র্যবিট তোমাকে বলেছে ওর ক্রাস কে। তাহলে বলো না সেটা কে?’
মাহীনকে এবার বিভ্রান্ত হতে দেখা গেল। তবে পর মূহুর্তে দৃঢ় ভাবে বলল,’আমি কিন্তু রাবিতকে ওয়াদা করেছি। কথার খেলাফ করতে পারবো না।’
ক্যারোট হতাশ হলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘আচ্ছা তাহলে আর কী করা।’ তারপর বলল, ‘আচ্ছা তুমি র্যবিটের বাড়ি চেনো?’
মাহীন নিজের আইসক্রিমের শেষ অংশটুকু মুখে পুরে বলল, ‘অবশ্যই চিনি।’
‘তাহলে চলো আমরা একবার সেখান থেকে ঘুরে আসি।’ উচ্ছ্বাসের সঙ্গে বলল ক্যারোল।
মাহীন চোখ চোখ বড় করে তাকাল ওর দিকে। বলল,
‘কি! ভুলে গিয়েছে নাকি ওটা শুধু র্যবিটেরই নয়, রায়েদেরও বাড়ি।’
ক্যারেট ভাবলেশহীন ভাবে বলল, ‘তো? তুমি না রায়েদের সবচাইতে কাছের বান্ধবী? তাহলে তো ওর বাসায় গেলে আরো খুশি হবে ও।’
মাহীন পানসে কন্ঠে বললো, ‘না এভাবেই ওর বাসায় চলে যাওয়া যায় না। এটা ভালো দেখায় না।’
ক্যারোট ভ্রু কুঞ্চিত করল। বলল, ‘কিন্তু আমি যতদূর জানি কেউ তো এতে কিছু মনে করবে না। এবং র্যবিট, রায়েদ দুইজনের সঙ্গেই তো তোমার ভালোই ফ্রেন্ডশিপ। আগের থেকে বলেই যেতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই।’
মাহীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে দ্বিধান্বিত কন্ঠে বলল,’কিন্তু কেন হঠাৎ ওর বাসায় যেতে চাচ্ছো?’
ক্যারোল শ্রাগ করে বলল,’কেন আবার। ওই যে বললাম না আমার মনে হয় ও আমাকে পছন্দ করে। কিন্তু আমি তো ওর পরিবার সম্পর্কে কিছুই জানি না। তাই চলো না দেখে আসি।’ বলেই উঠে দাঁড়াল।
মাহীন উঠে দাঁড়াল এবং বলল, ‘এক মিনিট থামো। আমাকে একটু ভাবতে দাও।’
ক্যারোট প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তবে কিছু বললো না। মাহীন ভাবতে লাগল, ভাইয়ের রুলস অনুযায়ী চারটা কারণ লাগবে। একটা হলো ক্যারোট আমাকে নিয়ে যেতে চাচ্ছে। দ্বিতীয় হলো ওদের বাসা আমি চিনি। তৃতীয় হলো ওরা আমার ফ্রেন্ড। এবং চতুর্থ হলো…উম হ্যা সবসময়ের মতোই আমি যেতে চাই।’ ভেবেই মুখে বলল,’আচ্ছা ঠিক আছে চলো।’
ক্যারোট হাসল। ওরা দুজন সামনে কাউন্টারে গিয়ে বিল পরিশোধ করল এবং বেরিয়ে আসল। মাহীন ও ক্যারোল দুইজনই হাঁটতে বেরিয়েছিল বলে ওদের কাছে সাইকেল নেই। রাস্তার ওপর রোদ গড়াগড়ি খাচ্ছে। রাস্তার ওপাশেই প্রাডার শৌখিন শোরুম। এবং কিছুদূর পরপর ফুটপাথের সামনে তাল গাছ দাঁড়িয়ে। মাহীনই রাস্তা চিনে ক্যারোল কে নিয়ে পিকো বুলেভার্ড চললো। ওরা গ্রিফিথ অবজার্ভেটরির কাছাকাছি ছিলো যা পিকো বুলেভার্ড থেকে বেশ দূরে। সেখানে পৌছুতে ওদের প্রায় পনেরো মিনিট লাগল। কাঙ্ক্ষিত বাড়ির সামনে এসে মাহীন থেমে দাঁড়াল। একবার খেয়াল করল বাড়ির বাইরে আসলেই কোনো নেমপ্লেট নেই। বাড়ির সামনেই রাস্তা। প্রচুর সোরগোল হচ্ছে। ওরা ছোট গেট ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল। মাহীনের কিছুটা অদ্ভুত লাগছে সবকিছু। স্নায়ুর মধ্যে চিনচিনে চাপ। গতবার যখন এসেছিল তখন কিছুই ভালো ভাবে খেয়াল করেনি। এবার চারিদিক পরখ করতেই ব্যস্ত। কলিং বেলটাও ক্যারোল বাজাল। মাহীন খেয়াল করল দরজার পাশেও কোনো নেমপ্লেট নেই। বাড়ির সামনের দেয়াল এতটাই চাপা যে সামনে অল্প কয়েকটা ফুলের গাছ লাগানোর জায়গা হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই দরজা খুলে গেল। মাহীন শুধু চাইছিল রায়েদ যেন দরজা না খোলে। এবং ওর আশা পূরণ করতেই মিসেস রাহমান দরজা খুললেন। প্রথমে ক্যারোলের ওপর দৃষ্টি পরল। তার পেছনে মাহীনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই তার মুখে হাসি ফুটে উঠল। গতবার যেমন দেখেছিলো ঠিক তেমনই আছেন তিনি। ফর্সা বর্ণে গোলাকার চেহারা। টানা টানা চোখ, চোখা নাক। মাহীন সালাম দিলো। ক্যারোল প্রথমে কিছু না বললেও ওর দেখাদেখি অদ্ভুত উচ্চারণে সালাম দিলো। মিসেস রহমান সালামের উত্তর দিয়ে সরে দাঁড়িয়ে বললেন,
‘আরেহ মাহীন তুমি তো সেই দিনের পর আর আসলেই না। কতবার বলেছি রাবিতকে একবার তোমাকে বাসায় আসতে বলতে।’
মাহীন ইতস্তত হাসল। মিসেস রহমান এবার ক্যারোলের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বললেন, ‘আর তুমি মা? মাহীনের বান্ধবী?’
ক্যারোল আন্তরিক হেসে বলল, ‘আমি ক্যারোল। শুধু মাহীন নয় রাবিতেরও বন্ধুবী।’
মিসেস রহমান কিছু একটা ভাবলেন। তারপর দরজাটা বন্ধ করে বললেন,’ওহ হ্যা তুমিই বোধহয় ক্যারোট যার কথা রাবিত বলে।’
ক্যারোল বিচলিত ভাবে হেসে বলল, ‘হ্যা আমি এই নামেও পরিচিত।’
মিসেস রহমান বললেন, ‘আচ্ছা তাই। এখন আসো বসো তোমরা। কতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছো।’
মাহীন সামনেই সোফার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল,’ওরা বাসায় নেই?’
মিসেস রহমান ভ্রু কুঁচকে বললেন, ‘ওরা? ওহ আচ্ছা রাবিতকে তো ফোন করে করে বাসায় আনা লাগে। এই আধঘন্টা পূর্বেই বাইরে বেরিয়েছে।’ হাসি মুখে বললেন তিনি।
ওরা দুজন সোফায় বসেছে। মিসেস রহমান উচ্চস্বরে বললেন, ‘আম্মা! দেখে যান কে এসেছে।’
বলে উনি রান্নাঘরের দিকে গেলেন। মাহীন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চারিদিক পরখ করছে। গতবার বাড়িটা যেভাবে সাজানো ছিলো সবই সেরকমই রয়েছে। শুধু পর্দাগুলো বোধহয় হালকা নীলচে ছিলো। এখন ধূসর রঙের। একদিকে দুইতলায় উঠার সিঁড়ি। তার পাশের দেয়ালেই একটা বড় বুক সেলফ। সেখানে রাবিতের ছবি কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো আছে। কিছুক্ষণ পর মিসেস মাদিহ অর্থাৎ রায়েদের দাদি ভেতরের কামরা থেকে বাইরে বেরিয়ে আসলেন। ওদের দেখা মাত্র ওনার ঠোঁটে ঈষৎ হাসি ফুটে উঠলো। উনি ধীরে ধীরে হেঁটে এসে সামনের সোফায় বসলেন। মাহীন সালাম দিলো। ওর দেখাদেখি ক্যারোলেও সালাম দিলো। এরই মধ্যে মিসেস রহমান রান্নাঘরের কোনে কিছু বানাতেও ব্যস্ত হয়ে পরেছেন।
মিসেস মাদিহ বললেন, ‘কেমন হলো বলো তো, যখনই তোমরা আসো ওরা কেউই বাসায় থাকে না।’
মাহীন জিজ্ঞেস করল, ‘রায়েদ কোথায় গিয়েছে?’
মিসেস মাদিহ বললেন,’ওতো বিভিন্ন জায়গায় পার্ট টাইম জব করে। বেশির ভাগ সময়েই বাসায় থাকে না।’
মিসেস রহমান হাতে ট্রে নিয়ে সোফার সামনে এসে দাঁড়ালেন। এবং সেটা মাঝের সেন্টার টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখলেন। ট্রেতে দুই গ্লাস শরবত। উনি হাসি মুখে বললেন,’সাংঘাতিক গরম পরেছে কিন্তু। নাও তোমরা।’
ওরা দুজনই আন্তরিক হেসে দুটো গ্লাস হাতে তুলে নিলো। মিসেস রহমান আবারও রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন।
ক্যারোট জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা আপনারা কী সবসময় থেকেই এখানেই থাকেন?’
মিসেস মাদিহ বললেন, ‘না মা। আমার জন্ম তুরস্কে। আমি তো রায়েদের দাদার সঙ্গে বিয়েরও অনেক বছর পর আমেরিকায় আসি। তবে এরপর আর কখনো তুরস্কে ফেরা হয়নি।’
ক্যারোল বলল, ‘তাহলে তো আপনারা সকলেই টার্কিশ বলতে পারেন।’
মিসেস মাদিহ হালকা হেসে বললেন,’অবশ্যই আমরা সকলেই পারি।’
মাহীন রান্নাঘরের দিকে নজর রেখে বলল,’আচ্ছা আমি দেখি আন্টি কী করছে?’
মিসেস মাদিহ বললেন, ‘হ্যা হ্যা যাও। সমস্যা নেই।’ বলতেই মাহীন উঠে দাঁড়াল। এবং রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল। মিসেস রহমান বেশ কয়েক ধরনের সবজি বের করে কাটাকাটি করছেন। মাহীন কিচেন বারের পাশে এসে দাঁড়াতেই উনি মুখ তুলে চাইলেন। বললেন,
‘তোমার পড়াশোনা কেমন চলছে? সামনে না মিডটার্ম পরীক্ষা?’
মাহীন বলল, ‘হ্যা পড়াশোনা তো ঠিকঠাকই চলছে। পরীক্ষার প্রস্তুতিও আছে মোটামুটি ভালোই।’
উনি হালকা হেসে বললেন, ‘হ্যা তাই ভালো। আমার রাবিত তো বই নিয়ে বসে ঠিকই কিন্তু তা হলো উপন্যাস। পড়ার বই তো ওর হাতে কখনোই দেখলাম না।’
মাহীন ভ্রু উঁচু করে বলল,’ও আবার উপন্যাসও পরে?’
‘হ্যা পড়ে তো। ওকে দেখে মনে হয় না তাই না?’
মাহীন হাসল। বলল,’মোটেও না। এই বিষয় নিয়ে ক্যারোলের ওপর রাগও করেছিল ও।’
মিসেস রহমান বেশ অনেকগুলো শসা কাটা শেষে একটা বোলে রাখলেন। তারপর গাজর তুলে কাটতে শুরু করলেন। বললেন,’তোমাদের পিকনিক কেমন গেলো? এক সপ্তাহ পার হয়ে গিয়েছে পিকনিক শেষ কিন্তু এখনো রাবিতের পিকনিকের ঘটনা বলা আর শেষ হয় না।’
মাহীন হাসি মুখেই বলল, ‘আমি আমার জীবনে এমন পিকনিকে কখনোই যায়ই নি। এটাই আমার সেরা পিকনিক ছিলো।’
উনি স্মিত হাসলেন। ম্লান কন্ঠে বললেন,’আগে আমরাও সপরিবারে প্রায়ই পিকনিকে যেতাম। এখন আর বহুদিন যাওয়া হয় না।’
মাহীন অবাক হয়ে ভাবল, কি ব্যাপার? অদ্ভুত না বিষয়টা? রায়েদ বলে আগে ও নিজের বাবার সাথে মাছ ধরতে যেতো কিন্তু এখন আর অনেকদিন যাওয়া হয়নি। ওনার মুখেও একই ধরনের কথা। ওদের সাথে আসলে হয়েছেটা কী?’ ভাবতে ভাবতেই বললো,
‘তাহলে এখন যান না কেন?’
মিসেস রহমানের মুখটা হঠাৎ বিষন্ন হয়ে উঠল। কেমন জানি স্তব্ধ হয়ে গেলেন তিনি। তারপর ধীরে ধীরে বললেন,’রাবিতের বাবা তো এখন আর নেই। উনি চলে যাওয়ার পর থেকে আমাদের আর সেই সবকিছুই করা হয়না যেটা আগে করা হতো।’
এবার মাহীনের স্তব্ধ হওয়ার পালা। সঙ্গে বিস্মিতও হলো। ও ভাবতেই পারেনি হঠাৎ এমন কিছু একটা শুনবে। অদ্ভুত ভাবে হৃদয়টা বেদনাপ্লুত হয়ে গেল। কি বলবে এর উত্তরে ঠিক বুঝে উঠার পূর্বেই মিসেস রহমান মুখে হালকা হাসি ফুটিয়ে বললেন,
‘এই নাও দেখো কী থেকে কী বলে তোমার মন খারাপ করে দিলাম। যাই হোক বাদ দাও তো।’
মাহীন কিছুই বললো না। এখনো হতবাক হয়ে চেয়ে রয়েছে। উনি আবার বললেন,
‘আচ্ছা এটা বলো রাবিত এখন আর কাউকে জ্বালায় না তো? অনেক দিন ধরে মিসেস রেয়ের কোনো অভিযোগ পেলাম না।’
মাহীন নিজেকে সামলে নিয়ে শুকনো কন্ঠে বলল, ‘না কেন জানি এখন ও অনেক ভদ্র হয়ে গিয়েছে।’
বলে ভাবতে লাগল, কি অদ্ভুত উনি শুধু রাবিতের কথাই বলে যাচ্ছেন। রায়েদ সম্পর্কে কী কিছুই বলার নেই?’ ওর ভাবনায় বিঘ্ন ঘটিয়ে মিসেস রহমান বললেন,
‘তাই ভালো। আগে যে কী চিন্তায় থাকতাম ওকে নিয়ে। একটা মাত্র ছেলে আমার তাও যদি এত কেয়ারলেস আচরণ করে তাহলে কেমন লাগে বলোতো?’
ওনার কথা শুনতে শুনতে যেন মাহীন বিদ্যুৎ চমকের মতো চমকে উঠলো। বিস্ময়াবিষ্ট দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। মিসেস রহমান ওকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঞ্চিত করে জিজ্ঞেস করলেন,
‘কি হলো? এত অবাক হলা যে?’
মাহীন উৎকন্ঠিত হয়ে জিজ্ঞেস করল,’মানে? একমাত্র ছেলে?’
মিসেস রহমান কাটা সবজিগুলো একত্র করে একটি বোলে রাখলেন। এবার ওপরের কাবার্ড থেকে বিভিন্ন ধরনের সস বের করতে করতে বললেন, ‘হ্যা।’
মাহীন ততক্ষণাৎ জিজ্ঞেস করল, ‘কিন্তু আপনার দুই ছেলে। রাবিত ও রায়েদ!’
মিসেস রহমান এবার পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে মাহীনের দিকে আবার চাইলেন। এবং শান্ত কন্ঠে বললেন,
‘আমার এক ছেলে রাবিত।’
বলেই আবার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন। কিন্তু মাহীনের মুখমণ্ডল হতে বিস্ময় কাটলো না। ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না কি থেকে কী শুনলো। সব হিসেবই হঠাৎ এলোমেলো হয়ে গেল। রহস্য রায়েদকে নিয়ে সর্বদাই ঝুলে ছিলো। অনেক প্রশ্নই মনে জমা হয়ে ছিল। তবে তাকে দেখে তো বোঝার উপায় ছিলো না। মিসেস রহমানের বলা কথাটার ঠিক কী মানে দাঁড়ায় তাও মাথায় আসছে না। ও আর কিছু না বলেই সোফায় গিয়ে বসলো। অল্প কিছুক্ষণ পর মিসেস রহমান ভেজিটেবল সালাদটা এনে টেবিলে রাখলেন। এবং নিজেও বসলেন। এতক্ষণে ক্যারোল মিসেস মাদির সঙ্গে ভালোই গল্প জমিয়ে ফেলেছে। কিন্তু মিসেস রহমানের কথাটা মাহীনের গলায় কাঁটার মতো আটকে রইলো। আর কিছু যে মিসেস রহমানকে জিজ্ঞেস করবে তাতেও মন সায় দিলো না। নিশ্চুপ বসে চারিপাশে চোখ বুলাতে বুলাতে ভাবল, আসলেই এটা অবিশ্বাস্য! রাবিতের ছবি আছে কিন্তু রায়েদের ছবি কোথাও দেখলাম না। মিসেস রহমান শুধুই রাবিতের কথা বলে যাচ্ছেন। রায়েদের কথা একবারও মুখে আনলেন না। আর এখন কিনা বললেন রায়েদ ওনার ছেলেই না? এখানে তো সবই গোলমাল। কোথা থেকে কিসের গোলমাল কিছুই তো বুঝলাম না। আর আমিও কী পাগলের মতো এটা ভাবছি নাকি আসলেই ওটার সাথে এটার সংযোগ থাকতে পারে। সেই কালো চিরকুট! ওটায় যা লেখা ছিলো তার সাথে যদি মিলিয়ে দেখি তাহলে একটা সুক্ষ্ম সম্ভাবনা থাকে দুটো ঘটনা একে অপরের সঙ্গে মিলে যাওয়ার।’ ভাবতে ভাবতে মিসেস রহমানের দিকে তাকাল। উনি মিসেস মাদির কথায় হাসছেন। কী মিষ্টি লাগছে তাকে। কী মিশুক তিনি। ওদের বয়স কম, ওনার তো বয়স হচ্ছে। ওদের থেকে অধিক অভিজ্ঞ তবুও একদম সমবয়সী বন্ধুর মতো আচরণ করেন। মাহীন আবার ভাবতে লাগল,
‘মিসেস রহমানের মতো মানুষ এতটা নিষ্ঠুর আচরণ করতে পারেন না। এটাই তো একটা জিনিস যেটা মিলছে না। কিন্তু চিঠিটা যদি সত্যি রায়েদ লিখে থাকে তাহলে তো সিরিয়াসলি ও একটা সাংঘাতিক পরিস্থিতিতে রয়েছে। এতদিন ওর সাথে ঘুরে বেড়ালাম। ভাবলাম কতই না ভালো বান্ধবী আমি ওর। কিন্তু ওর জীবনে এতকিছু চলছে সে সম্বন্ধে আমার কোনো ধারণাই ছিলো না। কিন্তু এসব হলেও কেন হচ্ছে? ও এমন কী দোষ করেছে? এটা ও নিজে বলবে বলে তো মনে হয় না। কিন্তু রাবিত বলতে পারবে। এতকিছু জানার পর ও আমার সামনে মুখ খুলতে বাধ্য।’
তারপর আরো আধাঘন্টা ওরা ওখানেই বসে থাকলো। প্রায় পৌনে ছয়টা নাগাদ বের হওয়ার জন্য উদ্যত হলো ওরা। এবার মিসেস রহমান ও মিসেস মাদিহ আন্তরিকতার সঙ্গেই ওদের বিদায় জানাল। বাইরে এখনো পূর্ণ দমে সূর্য নিজের দীপ্তি ছড়িয়ে চলেছে। সূর্য ডুবতে এখনো দেরি আছে। রায়েদের বাড়ি থেকে বের হয়েই ক্যারোল ও মাহীন বিদায় নিয়ে নিজ নিজ পথ ধরলো। তবে মাহীন ধীরে ধীরে ভাবনার জগৎ এ ডুবে থেকে হাঁটতে লাগল। অবচেতন মনই ওকে সাবধান করে রাস্তা ধরে নিয়ে চললো। আশেপাশের গাড়ির হর্ন, হইচইয়ের শব্দ কোনো কিছুই ওর কর্ণকুহরে প্রবেশ করছে না। ও পিকো বুলেভার্ড ত্যাগও করেনি তখনো। তার পূর্বেই সেলফোনটা বের করল। এবং র্যবিট লেখা কনট্যাক্ট নাম্বারটা বের করে ডায়াল করল। বেশ কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পর কল রিসিভ হলো। ধরেই ওপাশ থেকে রাবিতের কন্ঠস্বর ভেসে এলো,
‘হ্যালো কে?’
মাহীন শান্ত কন্ঠে বলল, ‘আমি মাহীন।’
ওপাশ থেকে উৎফুল্ল কন্ঠে বলল, ‘ওহ তুমি। কিরে বাবা আজ তুমি আমাকে ফোন দিচ্ছো? জীবনেও তো আমাকে ফোন দিতে দেখলাম না।’
মাহীন বলল,’হ্যা দিচ্ছি। আমার নম্বর তোমার কাছে সেভ নেই?’
‘না তুমি তো কখনো আমাকে দাওই নি।’
‘ওহ হ্যা আচ্ছা তুমি কোথায় আছো?’
কিছুক্ষণ ওপাশে সব নিশ্চুপ। তারপর বলল,’আমি তো লেক্সির সঙ্গে প্যাসিফিক পার্কে আছি। কিন্তু কেন?’
মাহীন একটু দ্বিধা করলো। তবুও বলল,’তুমি আমার সাথে দেখা করতে পারবা? এখনই।’
ওপাশ থেকে অবাক স্বরে বলল, ‘কী? এখনই তুমি দেখা করবা? কিন্তু হঠাৎ হয়েছেটা কী?’
মাহীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,’কিছু না। তুমি দেখা করো তারপর কথা বলছি।’
ওপাশ থেকে ততক্ষণাৎ বললো,’আচ্ছা ঠিক আছে। কিন্তু কোথায় দেখা করবো?’
মাহীন এক মুহূর্ত চিন্তা করল। তারপর বলল,’ডাঙ্কিন ডোনাটসে।’
‘কোন ডাঙ্কিন ডোনাটস?’
‘আরেহ ওই যে স্কুলের পাশেরটা। দুই নম্বর রোডে।’
‘ওহ আচ্ছা ঠিক আছে। আমি পৌঁছচ্ছি।’ বলে লাইন কেটে দিলো। মাহীন আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
ঘড়িতে মিনিটের কাটা ছয়টা বেজে ষোলোতে, মাহীন নিজের হাত ঘড়িতে দেখলো। ডোনাটের সুস্বাদু সুবাশে ম-ম চারদিক। গোল গোল লাল টেবিলগুলো বেশির ভাগই ভরা। ট্রে ভরে ডোনাট নিয়ে ওয়েটাররা যাওয়া আসা করছে। যদিও এটা ডোনাট শপ তবুও এখানে অন্যান্য কমন আইটেমও পাওয়া যায়। মাহীন এক কাপ কফি নিয়ে বসে আছে। বারবার ঘড়ির দিকে চোখ চলে যাচ্ছে। কিন্তু রাবিতের এখনো কোনো খবর নেই। ঠিক ছয়টা বিশ বাজে তখন রাবিত কাঁচের দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করল। মাহীন সামনের দিকের একটা টেবিলেই বসে দরজার দিকে নজর রাখছিল। রাবিতকে দেখা মাত্র হাত নাড়ল। রাবিত ওকে দেখতে পেয়ে এদিকে এগিয়ে আসল এবং অপর পাশের চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসল। তারপর প্রথমেই ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘তোমাকে এত বিচলিত লাগছে কেন?’
মাহীন শান্ত হয়ে স্থির ভাবে বসে রয়েছে। তবে ওর চেহারায় অস্থিরতা ফুটে উঠেছে। ও শান্ত কন্ঠে বলল,
‘আমি তোমার বাসায় গিয়েছিলাম।’
রাবিত চমকে উঠে বলল,’হঠাৎ আমার বাসায়? কী হয়েছে ওখানে?’
রাবিতের উদ্বিগ্নতা দেখে মাহীনের চোখ সরু হলো। তীব্র কন্ঠে বলল, ‘আমি এখন যা যা বলবো তার মাঝে কোনো কথা বলবা না।’ বলে থামল। তারপর বলতে শুরু করল, ‘আমি একদম স্কুলের প্রথম দিন একটা কালো চিরকুট পেয়েছিলাম। ওটায় কী লেখা ছিলো জানো?’
প্রশ্নটা করেই থেমে গেল। রাবিত আগ্রহী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মাহীন বলল,’যে সেটা লিখেছে তার মা তাকে নিজের ছেলে বলেই মানে না।’
এই কথাটা শোনা মাত্র রাবিত বিদ্যুৎ চমকের মতো চমকে উঠল। তারপর উত্তেজিত কন্ঠে বলল, ‘মাহীন!..ও আর কিছু বলার পূর্বেই মাহীন বলল, ‘আমার কথা এখনো শেষ হয়নি। তো যেটা বলছিলাম। সে চিরকুটে তার মনের অবস্থা, তার চারপাশের পরিবেশ পরিস্থিতি সবকিছুর কথাই বর্ণনা করা হয়েছে। এবং আজ জানো তো কি হয়েছে? তোমার বাসায় যাওয়ার পর দেখলাম মিসেস রহমান তোমার কথা তো বলছেন কিন্তু রায়েদের নাম পর্যন্ত মুখে আনছেন না একবারও। এবং আমি ওর কথা জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ওনার তো একটা মাত্র ছেলে সেটা হলো তুমি। আমি নিশ্চিত ওই চিরকুটটা রায়েদের ছিলো।’ আবারও থামলো ও। এবং দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বলল, ‘এর কী ব্যাখ্যা দিবে তুমি?’
রাবিত স্তব্ধ হয়ে রয়েছে। বেশ কিছুক্ষণ চলে গেল তবে ও কিছুই বললো না। তারপর ধীরে ধীরে বলল,
‘তোমার সন্দেহই ঠিক। হয়তো ওটা ভাইয়েরই চিরকুট ছিলো। তবে ভাই আমার আপন ভাই। এবং মা এমন কথা কেন বললো জানো? কারণ মা ভাইকে দেখতেই পারে না।’
মাহীন স্তব্ধ হয়ে ভ্রু কুঁচকে চাইল। রাবিত বলে গেল,
‘হ্যা। এই জন্যেই ভাই যতটা সম্ভব মায়ের দৃষ্টি এড়িয়ে চলে। বেশির ভাগ সময় বাসায়ই থাকে না। বাসায় থাকলেও কাউকে ফোন করার অনুমতি দেয় না। কখনো মায়ের চোখের সামনে যদি পরেও যায়, মা যতই খারাপ আচরণ করুক যাই করুক ভাই কখনোই কিছুই বলে না। সব কিছুই মেনে নেয়।’
মাহীন উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘কিন্তু কেন? কেন মিসেস রহমান রায়েদ কে দেখতে পারেন না? কী দোষ ওর?’
রাবিত দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্তিমিত কন্ঠে বলল,’সেটা আমি বলতে পারবো না।’
মাহীন উত্তেজিত কন্ঠে বললো, ‘না তুমি এখন চুপ থাকতে পারো না! তোমাকে বলতে হবে!’
রাবিত শান্ত কন্ঠে বললো, ‘আমি ভাইকে ওয়াদা করেছিলাম। সেটা ভাঙতে পারবো না।’
মাহীন দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বিরশ ভাবে বলল,’তাহলে কে আমাকে বলতে পারবে?’
রাবিত বলল,’বাবান্নেম মানে দাদি বলতে পারবে তোমাকে যদি সে চায়। এছাড়া একমাত্র ভাই নিজেই বলতে পারে। কিন্তু আমার কাছ থেকে কিছু জানার আশা করো না।’
মাহীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে টেবিলের ওপর ভাজ করে রাখা হাতে মাথা ঠেকাল।
ইনশাআল্লাহ চলবে।