এল এ ডেইস পর্ব-৪৪+৪৫

0
173

#এল এ ডেইস
পর্ব ৪৪
লেখনী মাহীরা ফারহীন

এক চিলতে সোনালি রোদ তীর্যক ভাবে জানালা ভেদ করে ধূসর কার্পেট বিছানো কাঠের মেঝেতে এসে পরছে। ফুরফুরে মন ভালো করা বাতাস তিরতির করে ঘরে ঢুকছে। রান্নাঘরের কল থেকে এক এক বিন্দু পানি টপ টপ শব্দ করে সিঙ্কের মধ্যে পরছে। মাহীন মিসেস রহমানের সেল ফোনে একটা নম্বর সেভ করল। তারপর ওনার হাতে ফিরিয়ে দিলো। ওর চোখে মুখে প্রশ্ন। বেশ কিছুদিন হলো মাহীন আর খুব একটা এ বাড়িতে আসে না। এবার মিসেস রহমানই ফোন করে আসতে বলেছে ওকে। প্রথমেই তিনি মাহীনের কাছে ওর মায়ের নাম্বারটা চাইলেন। মাহীন নাম্বারটা সেলফোনেই তুলে দিল। এবার জিজ্ঞেস করল, ‘কিন্তু আপনি আমার আম্মুর নাম্বার দিয়ে করবেনটা কী?’
মিসেস রহমান প্রথম থেকেই কেমন জানি গম্ভীর হয়ে আছেন। কোনো কিছু নিয়ে গভীর চিন্তায় আছেন বলে মনে হলো। তিনি মনে মনে কথা গুছিয়ে নিলেন। মাহীন আর কিছু না বলে অপেক্ষা করছে কোনো উত্তরের আশায়। মিসেস রহমান অবশেষে স্তিমিত কন্ঠে বললেন, ‘আসলে জানিস তো আজকাল মনে হচ্ছে আমি আসলে মানুষ হিসেবে কেমন? আমি তো এত খারাপ ছিলাম না। রায়েদের সাথে এত অন্যায় কিভাবে করলাম।’ বলে থামলেন। প্রশ্নটা যেন নিজেকেই করলেন। ওনার চোখের কোণে নোনাপানি চিকচিক করে উঠল। গম্ভীরতার পরিবর্তে এখন ক্লেশপূর্ণ মুখভাব। মাহীন ঠিক কী বলবে বুঝে উঠতে পারলো না। প্রায় তিন মাসের অধিক সময় পার হয়েছে তার কাউন্সিলিং এবং চিকিৎসার। এর মধ্যে অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে এসেছেন তিনি। রায়েদের সাথে স্বাভাবিক আচরণই করেন। তবে একটা দূরত্ব হয়ে গিয়েছে মা ছেলের মাঝে যেটা কিছুতেই ঘুচচ্ছে না। তবে এতটুকুতেই সন্তুষ্ট আছে রায়েদ। এতটুকুও যে ও পাবে সেটাই তো ছিলো অপ্রত্যাশিত। কিছুক্ষণ চুপ থেকে মিসেস রহমান বলে চললেন, ‘আমার আজকাল সারাদিন শুধু গিল্টি ফিল হয়। রায়েদকে দেখলে তো আরো বেশি। ওর সাথে কথা বললেও মনে হয় অপরাধ করছি। এত বছর এত কষ্ট যে দিয়েছি ওকে। নিশ্চয়ই অনেক বদদোয়া লেগেছে আমার। আমি তো..মাহীন ওনাকে থামিয়ে দিল। তীব্র কন্ঠে বলল,
‘আপনি কী বলছেন এসব? আপনি তো জানেন এসব আপনি ইচ্ছাকৃতভাবে করেননি। এটা আপনার একটা মানসিক সমস্যা ছিলো যেটা এখন বলা যায় ঠিক হয়ে এসেছে।’
মিসেস রহমান অস্থির হয়ে বললেন, ‘হ্যা জানি। কিন্তু এতে রায়েদের কী দোষ ছিলো। মানসিক সমস্যা আমার ছিলো। তার জন্য এতদিন ভুগতে হয়েছে ওকে। এটা ভেবেই বারবার খারাপ লাগছে। এজন্যেই তো ওর সাথে কথা বলতেও অপরাধবোধ হয়।’
ওনার ফর্সা মুখমন্ডল লাল হয়ে উঠেছে। মাহীন লম্বা একটা শ্বাস ফেললো। শান্ত কন্ঠে বলল, ‘একটু শান্ত হন। রায়েদ তো আর আপনার ওপর রেগে নেই তাই না? বরং ও আরোও খুশি হয় আপনি ওর সাথে কথা বললে। ওর সাথে বেশি বেশি করে কথা বলুন। ওকে আগের কথা মনে করার সুযোগই দিয়েন না।’
মিসেস রহমান অন্য দিকে তাকিয়ে ছিলেন। এবার মাহীনের দিকে নরম দৃষ্টিতে তাকালেন। তারপর মাহীনের হাত ধরে বললেন, ‘দেখ তুই আমার পরিবারের জন্য অনেক করেছিস। মানে আমি এখনো ভাবতে পারি না তুই এতকিছু করে আমাকে সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানোর ব্যবস্থা করলি। তোকে ধন্যবাদ দিলেও তো কম হয়ে যাবে।”
‘আরেহ আপনি আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করতে চান? আমি কিছু চাই না। শোনেন আপনি এক কাজ করেন সামনে রায়েদের জন্মদিন আসছে তখন কিছু একটা করেন। আইমিন পুরনো তিক্ত দিনগুলো ভুলিয়ে নতুন করে সবকিছু শুরু করার জন্য একটা ছোট খাটো অনুষ্ঠান বা কিছু করলে ভালো হয় না?’
মিসেস রহমান চমকে তাকালেন। বললেন, ‘বুদ্ধিটা খারাপ না। তবে রায়েদের জন্মদিনে এসব না করাই ভালো। কারণ ওর জন্মদিনের দিনই ওর বাবার মৃত্যুবার্ষিকী।’
‘ওহ আইএম সরি আন্টি। আপনি ঠিকই বলেছেন।’ একটু থেমে কিছু একটা ভেবে আবার বলে উঠে মাহীন, ‘আচ্ছা সেই এক্সিডেন্টের পর কত তারিখে রায়েদ হসপিটাল থেকে বাসায় ফিরেছিল?’
মিসেস রহমান একটু ভেবে বললেন, ‘উম একদিন পর। মানে আঠাশই আগস্ট।’
মাহীন প্রসন্ন কন্ঠে বলল, ‘এইতো। সেদিন ও বাসায় ফিরেছিল। ইট মিনস সেদিন থেকেই এসব ঝামেলা শুরু হয়েছিল। তাহলে আঠাশ তারিখেই অনুষ্ঠানটা ফেলা যায়। কেমন হবে বলুন তো?’
মিসেস রহমান হালকা হেসে বললেন, ‘তোর পুরো পরিবারকে বাসায় দাওয়াত দিবো ভাবছিলাম। এখন তাহলে সেইদিনই দাওয়াত দিবো কি বলিস।’
‘ওহ এজন্যে আমার আম্মুর নম্বর নিয়েছেন। কিন্তু হঠাৎ এই পরিকল্পনা কেন?’
‘কেন আবার। যে আমার জন্য এতকিছু করলো সেই মেয়ের মা-বাবাকে একটু দেখা লাগবে না?তোর জন্য তোর পরিবারকেও ধন্যবাদ জানাতে চাই।’
মাহীন মিষ্টি করে হাসল। তারপর হঠাৎ বলল,’আঠাশ তারিখের কথা কিন্তু রায়েদকে বলবেন না। এটা সারপ্রাইজ। মিসেস রহমান মুচকি হাসলেন। তখনই দরজা খোলার শব্দ হলো। মাহীন ও মিসেস রহমান মাথা ঘুরিয়ে মূল প্রবেশদ্বারের দিকে চাইলেন। দরজা খুলে রাবিত ভেতরে প্রবেশ করল। প্রথনে মাহীনকে খেয়াল করল না। জুতা খুলতে খুলতে চোখে পরল বোধহয়। অবাক হলো। ওর পর রায়েদ ভেতরে প্রবেশ করেই মাহীনকে দেখল। রাবিত হাত নেড়ে বলল, ‘হেই! তুমি এখানে আছ জানতাম না তো। ভেবেছিলাম ক্যারোলের বাসায় আছো।’
‘আমি নিজেও জানতাম না আমি এখানে আসবো। তবে এখান থেকে এয়ারপোর্ট যাবো। তোমরা যাবা না?’
রায়েদ জুতা খুলতে খুলতে বলল, ‘যাবো তো। নায়েল বলল, ওরা গাড়ি নিয়ে বের হওয়ার পর এখান থেকে ঘুরে যাবে। আমাদের আলাদা আসা লাগবে না।’
রাবিত সোফার ওপর গিয়ে ধপ করে বসে পরল। মিসেস রহমান বললেন, ‘কী আজ ক্যারোল চলে যাচ্ছে?’
মাহীন মাথা নাড়ল। রাবিতকে স্বাভাবিকই দেখাল। তবুও চোখে মুখে কেমন জানি একটা বিষন্ন বেদনার ছাপ। রায়েদ নিচে বসল না। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠার সময় বলল, ‘ওরা আসলে আমাকে ডেকে দিও।’
মাহীন ও রাবিত দুইজনই সায় জানিয়ে মাথা নাড়ল। রাবিত বলল, ‘তো তুমি ক্যারোলের সাথে নাই কেন?’
‘এইতো সকাল থেকে গোছগাছে সাহায্য করতে আমরা সকলেই ওর বাড়িতেই ছিলাম। ঘন্টাখানেক আগে বেরিয়ে ছিলাম।’
মিসেস রহমান রাবিতকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘কিছু খাবি? তোকে অনেক ক্লান্ত লাগছে।’
রাবিত শুকনো কন্ঠে বলল, ‘নাহ কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না।’
.
.
.
.
প্রায় আধাঘন্টা পর গাড়িটা এলো ওদের বাড়ির সামনে। এর মধ্যে মাহীন ফোন করে বলেছিল ও রায়েদের বাড়িতেই আছে। ওদের সাথে নিয়ে গাড়ি রওনা হলো লস এঞ্জেলস এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে। গাড়িতে ক্যারোল ও তার দাদিও আছে। ওনার বোধহয় বেশ অদ্ভুতই লাগছে ছেলেমেয়েদের কান্ডকারবার। এর পূর্বে অনেক জায়গা বদল করেছেন। কিন্তু নাতনির জন্য সারাদিন তার বন্ধুরা বাড়িতে বসে গোছগাছে সাহায্য করেনি। বিদায় দিতে এত বড় বহর নিয়ে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত যায়নি। এর পূর্বে ক্যারোল সিফট করা নিয়ে কষ্ট পেত ঠিকই কিন্তু রাগ হতো না। এবার আগের দিন থেকে দাদির সঙ্গে কথা বলা বন্ধ রেখেছে। নাতনির বন্ধুদের প্রতি এত গভীর টান তাকে ভাবাচ্ছে বটে। বিকেলের রাস্তার জাম কাটিয়ে আধাঘন্টা পর গাড়ি লস এঞ্জেলস এয়ারপোর্টে পৌঁছলো। বোর্ডিং সাতটার সময়। এখন পাঁচটা বাজে। তবে বাকিরা দু’ঘন্টা পর্যন্ত বসে থাকবে না। সকলের কাছ থেকে শেষ বিদায় নিয়ে ক্যারোল এয়ারপোর্ট সিকিউরিটি গেট দিয়ে ডিপার্চার লাউঞ্জে চলে যাওয়ার পরই সকলে বেরিয়ে গেলো। এর ভেতর পর্যন্ত ওরা যেতে পারবে না। এখান থেকে বেরিয়ে স্যান্টা মনিকায় পৌঁছে ওরা মাহীনকে একই গাড়ি করে ওর বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে গেল। বিষন্ন মনে হেলেদুলে বাড়িতে প্রবেশ করল মাহীন। মিসেস নাসরিন সোফায়ই বসে ছিলেন। মি.মোর্শেদও সোফায় বসে চা খাচ্ছেন। মাহীন জুতা খুললো ক্লান্ত ভঙ্গিতে। বড় থাই গ্লাসের স্লাইডিং ডোর দিয়ে তেমন একটা আলো আসছে না। বাইরে সূর্য ডুবে গিয়েছে সেই কিছুক্ষণ আগেই। আকাশের বুক থেকে সূর্যের সিঁদুর রঙা শেষ রেখাটুকুও মুছে যাচ্ছে দ্রুত। ড্রইং রুমে বৈদ্যুতিক বাতি জালানো। রান্নাঘর ও তার সংলগ্ন ডাইনিং আঁধারে ঘেরা। মিসেস নাসরিন ও মি.মোর্শেদ দুজনের হাতেই চায়ের কাপ। এসময় প্রতিদিন মি.মোর্শেদ বাড়ি ফিরে সবে খেতে বসেন। তবে আজ উইকেন্ড। ফলে তিনি বাসায়ই আছেন। কাঁচের স্লাইডিং ডোর দিয়ে দেখা যাচ্ছে বাইরে আকাশ জুড়ে অন্ধকার নেমে আসছে। মাহীন ধীর পায়ে হেঁটে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। মি.মোর্শেদ বললেন, ‘মাহীন একটু থাম তো। বস এখানে।’
মাহীন ফিরে তাকাল। তারপর এসে ধপ করে সোফায় বসল। টঙ্কস বুক কেসের তাঁকের মধ্যে ঘুমিয়ে আছে। মি. মোর্শেদ জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোর বান্ধবী চলে গিয়েছে?’
মাহীন আলতো করে সায় জানিয়ে মাথা নাড়ল। মিসেস নাসরিন হাতে ধরা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘মিসেস রহমান ফোন দিয়েছিলেন। অনেকক্ষণ কথা বললেন।’
মাহীন ভ্রু উঁচু করল। ভাবল, বাহ এর মধ্যে কাজ সেরেও ফেলেছেন।’ মুখে বলল, ‘তো কী বলেছেন উনি?’
মিসেস নাসরিন গাঢ় কন্ঠে বললেন, ‘তো তুই জানিস না বুঝি। ওখানেই নাকি বসে ছিলি?’
মাহীন বিচলিত হাসল। মি.মোর্শেদ বলল, ‘মিসেস রহমান আমাদের সপরিবারে আঠাশ তারিখে ওনার বাসায় দাওয়াত করেছেন।’
‘হ্যা এইজন্যেই উনি মায়ের নম্বর নিলেন আজ।’ বলল মাহীন।
‘তো তুই এত ঘটনা ঘটিয়েছিস কিন্তু তোর এই দুজন বন্ধু আর ওদের পরিবার সম্বন্ধে তো কিছু শুনলামই না আমি।’

মাহীন ইতস্তত হেসে বলল, ‘এই যে এখন শুনলা। সে তো মেলা কাহিনী। এখন অবশ্য উনি ঠিক আছেন।’

মিসেস নাসরিন বললেন, ‘হ্যা সেটা তো উনি নিজের মুখেই বললেন। তবে তুই ওনার বাসায় এত ঘনঘন যেতিস সেটা আমার জানা ছিলো না।’
মাহীন ইতস্তত হেসে বলল, ‘হয়েছে কী সেলি বলেছিলেন…”
এতটুকু বলতেই ওদের মূল প্রবেশদ্বারটা খুলে গেল। নাইম ভেতরে প্রবেশ করল। সকলকে একপলক দেখে নিয়ে দরজা বন্ধ করলো। তারপর জুতা খুলে সোফার দিকে এগিয়ে আসল। মাহীনের পাশে ধপ করে বসে ওর মাথায় টোকা দিয়ে বলল, ‘হিন হিন! কী খবর?’

‘কী আবার ক্যারোলকে বিদায় দিয়ে এয়ারপোর্ট থেকে আসলাম।’ ক্লান্ত স্বরে বলল মাহীন।

মি.মোর্শেদ বললেন, ‘আচ্ছা তোদের মাথায় এই মিসেস বিংয়ের সাহায্য নেওয়ার বুদ্ধিটা আসলো কোথ থেকে?’

নাইম মুচকি হেসে বলল, ‘মায়ের বুদ্ধি এটা।’
মি.মোর্শেদ মুচকি হাসলেন। মিসেস নাসরিন জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা ওনার কথা শুনেতো মনে হলো উনি বেশ ভালোই হয়ে গিয়েছেন। এখন রায়েদের সঙ্গে কেমন ব্যবহার কেরন?’
‘এখন তো স্বাভাবিক ব্যবহারই করেন। তবে ওর সাথে কথা বলতে ওনার একটু গিল্টি ফিল হয়। আন্টি আজই এইসব খুলে বলছিলেন।’ বলল মাহীন।
নাইম ফিসফিস করে বলল, ‘আরেহ হঠাৎ এই প্রসঙ্গ উঠলো কীভাবে? বাবা তো এটার কথা জানতেন না।’
মাহীনও ফিসফিস করেই জবাব দিলো, ‘মিসেস রহমান আমাদের সপরিবারে আঠাশ তারিখে ওনার বাড়িতে দাওয়াত দিয়েছেন। তাই মা বোধহয় বাবাকে সবকিছু খুলে বলেছে।’
‘রায়েদ জানে?’ ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল নাইম।
‘না ওর জন্য সারপ্রাইজ থাকবে এটা।’
‘বাহ এটা নিশ্চয়ই তোর বুদ্ধি?’
‘আর নয়তো কী?’
‘বাহ কী ভালোবাসা।’ মাহীন কটমট দৃষ্টিতে নাইমের দিকে তাকিয়ে পিঠে চিমটি কাটলো। নাইম ‘আউ’ করে উঠল। মিসেস নাসরিন জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোর আবার কী হলো?’
‘কিছু না।’ পিঠ মালিশ করতে করতে বলল নাইম।
.
.
এরপর মাহীন উঠে নিজের কামরায় চলে আসল। বিছানায় সটান শুয়ে পরল। হঠাৎ মনে পরল এই সপ্তাহের ফিজিক্স এসাইনমেন্ট সাবমিট করা হয়নি। সেটা ডেক্সটারকে জানানোর কথা ছিলো। ও সাবমিট করে দিতো। মাহীনকে আর ঝামেলা করা লাগতো না। ভাবতে ভাবতেই সেল ফোনটা হাতে তুলে নিলো। কল লিস্টে ড অক্ষর দিয়ে সেভ করা কনট্যাক্টগুলো বের করল। তারপর কল দিয়ে কানে ধরল। কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পরই ওপাশ থেকে ভেসে এলো উচ্ছ্বসিত ডিস্টার্বারের কন্ঠস্বর। মাহীন চমকে উঠে ফনটা কান থেকে সরিয়ে নিয়ে স্ক্রিনের দিকো তাকাল। ভুলবশত ডেক্সটারের বদলে ডিস্টার্বার কে কল দিয়ে ফেলেছে। ওপাশ থেকে বলছে, ‘ওহ মাহীন! কী খবর? আজ কী সূর্য পশ্চিম উঠল নাকি তুমি আমাকে ফোন দিচ্ছো।’
‘না ভুলে গিয়েছে। সে যাই কেমন আছো তুমি? অনেকদিন দেখি আমাকে আর ডিস্টার্ব করোনি।’
ওপাশ থেকে সে হালকা হাসল। বলল, ‘হ্যা করিনি। জানো তে কী হয়েছে, আমি একজন নতুন ফ্রেন্ড পেয়েছি। বা বলা যায় বেস্ট ফ্রেন্ড! এখন আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি ওর কাছে একজন সৎ ফ্রেন্ড হিসেবে নিজেকে উপস্থিত করতে।’
মাহীন ম্লান কন্ঠে বলল, ‘তাই ভালো। আমার সাথে ওইসব গোলমাল করার পর আশা করি একই ভুল এবার আর হবে না। তাই না? নাহলে এই ফ্রেন্ড কেও হারিয়ে ফেলবা।’
‘জানি। এবং আমি তোমার কাছে হাজার বার ক্ষমা চেয়েছি। নিজের ভুল যখন বুঝতে পেরেছি আমি আর সেই ভুল দ্বিতীয় বার করবো না। তবে সেই আফসোস আর থাকতো না যদি তোমার আমার সম্পর্ক আবার আগের মতো হয়ে যেত।’
‘জানো তো আমার ট্রাস্ট ইস্যুর সমস্যাটা শুরু হয়েছে তোমার থেকে। আর একটা কথা আমরা যদি আবার আগের মতো ফ্রেন্ড হয়ে যেতাম তাহলে তোমার শিক্ষাটা আর হতো না। যাই হোক তাহলে ভালো থেকো। রাখি।’
‘ঠিক আছে। তুমি ভালো থেকো।’ বলে ফোনটা রেখে দিলো।
মাহীন ফোনটা কান থেকে নামিয়ে কনট্যাক্টে নম্বরটা ডিস্টার্বার থেকে পাল্টিয়ে নামিরা দিয়ে সেভ করল। তারপর ভাবতে লাগল, আহ নামিরা এখনোও আমার বেস্ট ফ্রেন্ড হতে পারতো ঠিক আগের মতো। কিন্তু তখন ও যে আমার অজান্তে আমার নামে এদিক ওদিক কথা লাগাত, আমার বদনাম করত সেটা তো আমি ভুলতে পারি না। এরকম চিট করল কেন আমার সাথে? এখন যদি সত্যি ও শুধরে যেয়ে থাকে। তাহলে ওর জন্যেই ভালো।
.
.
.
.
স্যান্টা মনিকার বু্কে অন্ধকার নেমে এসেছে। তবে এই অন্ধকার কৃত্রিম আলোর ঝলকানির সামনে কিছুই না। শহরতলীতে আলোর বন্যা বয়ে চলেছে। পথঘাট আলো করে রেখেছে অসংখ্য গাড়ির হেডলাইট ও দুপাশ ঘেরা ব্র্যান্ডের শপগুলোর জাঁকজমকপূর্ণ আলোকসজ্জা। পিকো বুলেভার্ড স্ট্রিটে লেগেছে লম্বা জাম। লাগবে নাই বা কেন? এটা রাশ আওয়ার। এই সময় সকল কর্মস্থল গুলো একে একে কাজের সমাপ্তি টানে। কর্মচারীরা হন্যে হয়ে বাড়ির পথ ধরে। রায়েদ ও রাবিত পিকো বুলেভার্ডে নেমে গেলো। আর বাড়ির সম্মুখ পর্যন্ত গাড়ি নিয়ে গেলো না। তাতে গাড়ি জামে পরে সময় নষ্ট হতো শুধু শুধু। পাশের ফুটপাথ ধরে দুভাই হেঁটে চলেছে। ফুটপাথেও পথচারীদের ঠেলাঠেলি। অনেক টিনএজাররা এর মাঝেও স্কেটবোর্ড নিয়ে বেরিয়ে পরেছে। রাস্তার অপর পাশের ফুটপাথের পাশের স্টারবাক্স থেকে হলদে নিয়ন আলো এসে পরছে গাড়িগুলোর গায়ে। হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির নিকট এসে পৌঁছেছে। রাবিত সারা পথ কেমন গুম মেরে ছিলো। রায়েদও আর বিরক্ত করেনি। সাধারণত দুভাই একত্রে থাকলে রাবিতই বেশি বকবক করে। রায়েদ নির্বাক শ্রোতা বনে থাকে। বাড়ির সম্মুখের লোহার গেটটা ঠেলে খুললো রাবিত। রায়েদ পেছনে। “রায়েদ!” গাড়ির হর্ন,পথচারীদের কোলাহলের মাঝে কার যেন ডাকে রায়েদ থেমে গিয়ে ঘার ঘুরিয়ে পেছনে তাকাল। রাবিতও ভেতরে ঢুকে থেমে গেছে। কন্ঠটা কেমন পরিচিত ঠেকল। ভির ঠেলে ফুটপাথ ধরে বিল মুরেই প্রায় ছুটতে ছুটতে এগিয়ে আসছে। যখন রায়েদ বুঝলো যে ওদের দিকেই এগিয়ে আসছে বিল যারপরনাই অবাক হলো। অবাক হয়েছে রাবিতও। রায়েদ রাবিতকে ভেতরে যেতে ইশারা করল। এখনো গেট ধরেই দাঁড়িয়ে আছে ও। রাবিত আর কথা না বাড়িয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। না জানি বিল আবার কী করতে আসছে এমন একটা ভাবনাই খেলে গেলো রায়েদের মাথায়। তবে বিল কাছিয়ে আসতেই ধারনাটা কিছুটা পরিবর্তন হলো। চোখে মুখে কোনো তেজ নেই ওর। কেমন ক্লান্তিতে ভরা মলিন চেহারা। বিল কিছুটা হাঁপিয়ে উঠেছে। বুক ভরে লম্বা লম্বা শ্বাস নিলো। রায়েদ নির্বিকার চিত্তে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বিল অবশেষে কিছুটা ইতস্ততভাবে বলল, ‘আম হাই রায়েদ। ক্যান আই হ্যাভ সাম মোমেন্ট?’
রায়েদ ভারি গলায় বললো, ‘ফর হোয়াট?’
‘আই হ্যাভ গট সামথিং টু টক উইত ইউ।’
রায়েদ ভ্রুক্ষেপহীন। বলল, ‘আমার সময় নেই।’ বলে ঘুরে দাঁড়াতে যাচ্ছিল তখনই বিল তাড়াহুড়ো করে বলল,
‘ওয়েল দেখো অনেক দিন আমাদের কোনো কথা হয়নি। তবে কিছুই যে আর বলার থাকতে পারে না তেমনটাও তো নয়।’ রায়েদ আবার ঘুরে দাঁড়াল। বলল, ‘মাহীনকে নিয়ে কিছু বলতে চাও?’
বিল এ প্রশ্নে অবাক হলো। একই সাথে অপ্রস্তুত ভাবে উত্তর দিলো, ‘অফ কর্স না। ওর কথা এর মাঝে কোথা থেকে আসলো। এন্ড যেহেতু তুমি টেনেই আনলা তাহলে ক্লিয়ারলি বলি, আই নো তোমরা রিলেশনে আছো এন্ড আই এম ওকে ইউত দ্যাট।’
‘তো তুমি কী নিয়ে কথা বলতে চাও আসলে?’
‘আমরা কী হাঁটতে হাঁটতে কথা বলতে পারি?’
অগত্যা রায়েদ কিছু একটা ভেবে নিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে।’ বিল হাঁটতে শুরু করলো। রায়েদও ধীরে ধীরে হাঁটছে।
কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকার পর বিল বলতে আরম্ভ করল,
‘আমি জানি এত বছর আমাদের সম্পর্কটা খুবই খারাপ ভাবে গিয়েছে।’
‘আমাদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক ছিলোই না। আর বন্ধুত্ত্ব তো অনেক দিন আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল।’ তিক্ত ভাবে বলল রায়েদ।
‘জানি। বাট যেটাই ছিলো সেটাও জাস্ট ওয়ার্স ছিলো। বাট দেখো আমি আজও জানি না তোমার সাথে একচুয়েলি সেসময় কী হয়েছিল। জানার সুযোগও হয়নি কখনো।’
রায়েদ মাঝখান দিয়ে বলল, ‘জানার চেষ্টা করলে তবে তো জানতে। কিন্তু তোমার কাছে তো তোমার ইগোটাই অনেক বড় হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। তাই না?’
বিল পুনরায় কিছুক্ষণ মৌন থাকল। তারপর মলিন স্বরে বলল, ‘তা আমি উপলব্ধি করতে পেরেছি। আমারও তখন বয়স কম ছিলো। বন্ধু হিসেবে যে আমার কী করণীয় ছিলো আমি বুঝে উঠতে পারিনি। কিছুটা চাপা অভিমানও হয়েছিল আমার। কারণ…রায়েদ আবারও ওকে মাঝপথে থামিয়ে দিলো, ‘এতদিন পর এসব কথা নতুন করে টেনে আনার মানে কী?’
বিল ইতস্ততভাবে বললো, ‘তুমি কী সেসব তিক্ত ঘটনা ভুলে গিয়ে লাইক নতুন করে..আই মিন ফ্রেন্ড…রায়েদ ওকে থামিয়ে দিলো। ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘তোমার ফ্রেন্ডরা কী তোমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে যে শেষ পর্যন্ত তোমার আমার কথা মনে পরেছে? লাইক সিরিয়াসলি তুমি আবার নতুন করে ফ্রেন্ডশিপের কথা ভাবছো?’ বলে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল বিলের দিকে। বিল রাস্তায় চলাচলরত গাড়ির গুলোর দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। রায়েদ আবার বলল, ‘দেখো সেসব ঘটনা আমি অনেক আগেই মাথা থেকে বের করে ফেলেছি। আবার সেগুলো মনে করার থেকেও অনেক বেশি জরুরি কাজ আছে আমার। এবং তোমার সাথে ফ্রেন্ডশিপ তো হতেই পারে নতুন করে তবে সেরকম করে আগে যতটা ক্লোজ ছিলাম আমরা, যতটা বিশ্বাস করতাম তোমাকে সেটা আর কখনো হবে না। এটা জেনে রাখো।’
বিল যেন কিছুটা মিইয়ে গেলো এ কথা শুনে। অবশ্য এমন কিছু শোনার জন্য সে প্রস্তুতও ছিলো বটে। শুকনো কন্ঠে বলল, ‘আই নো বিশ্বাস স্পর্শকাতর একটা জিনিস। একবার সেটা ভেঙ্গে গেলে নতুন করে তৈরি হতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। তবে এর জন্য আমি তোমাকে দোষারোপ করতে পারি না। দোষটা আমার ছিলো। তাই আমি বলছি আমরা কী একটা নতুন ফ্রেন্ডশিপকে সুযোগ দিতে পারি না?’ বলে আগ্রহী চিত্তে তাকাল রায়েদের দিকে। রায়েদ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘কী দরকার আর এসব করার? আমরা আবার ফ্রেন্ড না হলেও তো সবকিছু শেষ হয়ে যাচ্ছে না। যেটা যেমন আছে সেরকমই থাকুক না।’
বিলের উৎসুকভাব মুখটা ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেল। তবুও আশাহত হলো না। হাঁটতে হাঁটতে ওরা বিলের বাড়িও পেরিয়ে এসেছে কিছুক্ষণ হলো। ওদের বাড়ি সবসময় থেকেই একই রাস্তায় ছিলো। তাঁরা শুধু ছোটবেলার বন্ধু নয় প্রতিবেশীও ছিলো বটে। বিল গাঢ় কন্ঠে বলে, ‘ বাট একটা চান্স দিতেও তো ক্ষতি নেই। এন্ড আমি গ্যারান্টি দিলাম এবার আর আগের বারের মতো কোনো ভুল করবো না।আমি তোমাকে বলছি না ফার্স্টেই তোমার আমাকে বিশ্বাস করতে হবে ব্লাহ ব্লাহ ব্লাহ…বাট আমরা ট্রাই করতে পারি। প্লিজ আমাকে না করে দিও না।’ অনুনয়ের স্বরে বলল বিল। এতে বোধহয় কিছুটা মন গললো রায়েদের। তবুও এত সহজে রাজি ও হলো না। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বিলের দিকে চাইল। বলল, ‘আসলে হঠাৎ আমার সাথে ফ্রেন্ডশিপ করতে হবে এই চিন্তাটা তোমার মাথায় চেপে বসলো কেন?’
বিল অপ্রস্তুত হলো। কিভাবে বুঝিয়ে বলবে হঠাৎ কী হয়েছে? কিছুই তো হয়নি। কয়েনদিন যাবৎ এ বিষয়টা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করেছে। মূলত এর সূচনালগ্ন হয়েছে মাহীনের হাতে। সেদিন বিলকে বলা মাহীনের কথাগুলোই ওর মনে প্রতিনিয়ত খচখচ করে গিয়েছে। কিছুতেই শান্তি পাচ্ছিল না। অবশেষে বুঝতে পেরেছে রায়েদের সঙ্গে ঝামেলার মিটমাট না হলে ওর শান্তি নেই। বিল কিছুক্ষণ ভেবে বলল, ‘জানি না। কয়েকদিন ধরে জাস্ট এইসব নিয়ে খুব গভীর ভাবে চিন্তা করেছি। তারপর এই স্টেটমেন্টে এসেছি যে যেভাবেই হোক আমি আবার সবকিছু আগের মতো ফিরিয়ে আনবো।’
রায়েদ আনমনে হাসল। ভাবল, কী অদ্ভুত না? গত চার বছর যাবৎ যখন আমার জীবনটা দুঃস্বপ্নের মতো কাটলো তখন একবারও কারোর মনে হলো না যে তার কোথাও কোনো ভুল ছিলো। চাইলেই সবকিছু ঠিক করা যেতে পারে না। যখন এমনিতেই আমার জীবনের সুন্দর সময় ফিরে এসেছে তখন ওর মনে পরলো যে আমার সাথে সবকিছু আবার ঠিক করে নেওয়া উচিৎ? কেনো? আমি কী জানি না ভেবেছে? মাহীন আমাকে না বললেও তুমি আমাকে না বললেও আমি বুঝতে পারছি, মাহীন সেদিন সেরকম কিছু একটা তো তোমাকে বলেছিলো। সেটা হয়তো আমার সাথে আসলে কী হয়ছিলো তা নয় তবে এমন কিছু যেটা ওর গায়ে লেগেছে।’ ভাবতে ভাবতেই বলল, ‘ঠিক আছে। একটা সুযোগ দিতে বলছো যখন তো দিলাম। তবে আমি আগেই বলছি আমার কোনো দায় নেই এসবের মাঝে।’
বিলের মুখখানা উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। হালকা হেসে বলল,
‘থ্যান্কস রায়েদ। আই উইল ট্রায় মাই বেস্ট টু কিপ দিজ ফ্রেন্ডশিপ।’
রায়েদ প্রতুত্তরে কিছুই বললো না। নিচে আলোর বন্যা বয়ে গেলেও মাথার ওপর আঁধার ঢাকা আকাশে মিটমিট করে কয়েকটা তাঁরা জ্বলে রয়েছে। রাস্তার পাশের রেলিঙ জুড়ে পেতুনিয়া ফুলের ঝাড় ঝুলে রয়েছে। বাতাসে তিরতির করে দুলতে থাকে ফুলগুলো। স্ট্রিট লাইটের হলদে আলোয় মেখে যায় পথচারীরা।

ইনশাআল্লাহ চলবে।

#এল_এ_ডেইস
পর্ব ৪৫
লেখনী মাহীরা ফারহীন

ট্রিং ট্রিং শব্দে কলিং বেল বাজচ্ছে। তিরতির করে বাতাস বইছে। চারিদিকে ঝলমল করছে সোনালি রোদ। সেই সোনালি রোদ তীর্যক ভাবে এসে পরেছে দরজার ওপর। বাড়ির সম্মুখেই রাস্তায় যানবাহনের কোলাহল। কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে গেল। মিসেস রহমান দাঁড়িয়ে দরজার ওপাশে। দরজার এপাশে দাঁড়িয়ে নাইম ও পাশে মাহীন। ওদের পেছনে মি.মোর্শেদ ও মিসেস নাসরিন। বিকেল সাড়ে চারটা বাজে। ওরা একে একে ভেতরে প্রবেশ করল। মিসেস রহমানের মুখ আন্তরিক হাসিতে উদ্ভাসিত। প্রথমেই তারা একে অপরের সাথে সালাম বিনিময় করলেন। তারপর কুশল বিনিময় করতে ব্যস্ত হলেন। কেন জানি মাহীনের মনে হলো তাদের প্রথম বার দেখা হলেও একে অপরকে যেন যুগ যুগ ধরে চেনেন। অবশ্য ওনাদের হাবভাবটাই এরকম। মিসেস মাদিহ সোফার ওপর বসে ছিলেন। গোটা ঘরময় হলদেটে আলো বিচরণ করছে। এদিক ওদিককার জানালা হতে বিকেলের মরা সোনালি রোদ উঁকি দেয়।
মাহীনের বাবা-মা ওনাকে সালাম জানিয়ে সামনাসামনি বসলেন। বাংলাদেশ থেকে ক্যালিফোর্নিয়ায় আসার পর কারোও বাসায় এভাবে সপরিবারে দাওয়াতে যাওয়া হয়নি মাহীনের। ওর কেন জানি হঠাৎ আগে দেশে থাকতে ঠিক যেমন ঈদের সময় আত্নীয় স্বজনদের বাসায় যাওয়া হতো সেরকম একটা অনুভূতি হলো। যদিও এটা ঈদ নয়। এই বাসায় ও এর আগেও বহুবার এসেছে। তবুও অন্য রকম লাগছে সবকিছু। আসলেই অন্যরকমই লাগছে। কারণ ধূসর পর্দাগুলো বদলিয়ে মাখন রঙা পর্দা লাগানো হয়েছে। সোফার কুশন কভার গুলো পাল্টানো হয়েছে। বুক কেসটায় রাখা শো-পিস গুলোও বোধহয় একটু এদিকওদিক করা হয়েছে। বুক কেসের পাশে দেয়ালে সাধারণত একটা চতুর্ভুজ আকৃতির কাঠের ফ্রেমে রাবিতের একটা ছবি দেখা যেত। এখন সেখানে সোভা পাচ্ছে রাবিত ও রায়েদ দুই ভাইয়ের একসাথে একটা ছবি। সেটা খেয়াল করে মাহীনের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো। রায়েদ বা রাবিত বাড়িতে নেই। অবশ্য ওদের থাকারও কথা না। মাহীনের বাবা-মা মিসেস মাদির সামনাসামনি সোফায় বসে আছেন। নাইমও সেখানেই। কিন্তু মাহীন খুব সহজ ভাবেই উঠে এসে মিসেস রহমানের সাথে রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে আছে। মিসেস রহমান প্রথমেই এক ট্রেতে করে কতগুলো শরবতের গ্লাস ড্রইংরুমের সেন্টার টেবিলে রাখলেন। মাহীন এবার সেখানে গিয়ে ভাইয়ের পাশে বসলো। মি.মোর্শেদ মিসেস মাদিহকে তার বাংলাদেশ হতে ক্যালিফোর্নিয়ায় আসার কাহিনী শোনাচ্ছেন। মিসেস মাদিও বেশ আগ্রহ নিয়ে শুনছেন। মাঝে মাঝে তিনি ফোকলা দাঁত বের করে হাসছেন। ওনার বেশ বয়স হলেও জ্ঞান বুদ্ধি যেন যৌবনকালের মতোই প্রখর আছে। মিসেস নাসরিন প্রথমে বেশ কিছুক্ষণ কথা বললেন। তারপর উঠে আসলেন রান্নাঘরের দিকে।
মিসেস রহমান মহিলাটিকে নিয়ে বড়ই বেশি আগ্রহ ওনার। কত কীই না শুনেছেন মেয়ের মুখে। শুধু অপেক্ষা ছিলো সামনাসামনি দেখা হওয়ার। মিসেস রহমান অতি ব্যস্ততার সঙ্গে সবকিছু এক হাতে সামলাচ্ছেন। কালো বর্ণের চার চুল্লীর স্টোভের চারটিতেই রান্না বসানো রয়েছে। টাইলস বসানো বারের ওপর বেশ কতগুলো বাটিতে বিভিন্ন ধরনের সবজি আগে থেকে কেটে রাখা। মিসেস নাসরিন অবাক হয়ে বললেন, ‘ওহ আল্লাহ আপনি একা হাতে এত কিছু করতে গেলেন কেন?’
মিসেস রহমান হাসলেন। বললেন, ‘করবো না কেন? প্রথমবার আমার বাড়িতে এলেন আপনারা। সর্বোচ্চ দিয়ে আপনাদের আপ্যায়ন না করলে যে আমার শান্তি লাগবে না।’
মিসেস নাসরিন হালকা হাসলেন। বললেন,’আমাদেরকে নিজের মানুষই মনে করুন। আমার মেয়ে তো শুনি অর্ধেক সপ্তাহ আপনার বাসায়ই কাটিয়ে দেয়।’
মিসেস রহমান সহাস্যে বললেন, ‘আমার ভাগ্য বলতে হবে। আপনাদের অনেকদিন ধরেই দাওয়াত দেওয়ার কথা ভাবছিলাম। জানতে বড় ইচ্ছে ছিলো কে সেই ভাগ্যবান মা-বাবা যারা মাহীনের মতো মেয়ে পেয়েছে।’
মিসেস নাসরিন হেসে উঠলেন। বারের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে বললেন, ‘আহা আপনি যদি ওর কান্ডকারবার গুলো সম্পর্কে অবগত থাকতেন এ কথা বলতে পারতেন না। সবচাইতে বেশি দুশ্চিন্তায় থাকি ওকে নিয়ে। কখন কী করতে গিয়ে কোন ঝামেলায় ফাঁসে তার কোনো ঠিক নেই।’
‘তা বটে। এমনটা হলে দুশ্চিন্তা আমারও হতো। তবে এসব সম্পর্কে তো আমি জানিই না। আর আমার একটা মেয়ে নেই বলেই হয়তো বেশি ভালো লাগে ওকে। আপনাকে একটা কথা বলছি কিছু মনে করবেন না, আমার মাঝেমাঝে হিংসে হয় ইশ ও যদি আমার মেয়ে হতো।’
মিসেস নাসরিন হেসে বললেন, ‘আহা তাহলে তো বেঁচেই যেতাম।’ তারপর একটু থামলেন। মিসেস রহমান একটা চুলা থেকে কোফতা নামিয়ে আনলেন ততক্ষণে। ঘরময় কোফতার সুস্বাদু ঘ্রাণ ছড়িয়ে পরেছে। সিংকের ওপরের জানালাটা খোলা। সেখান থেকে বাগানের রঙবেরঙের পেতুনিয়া ফুলগুলো বাতাসের তোড়ে তরতর করে উড়তে দেখা যায়। মিসেস নাসরিন বললেন, ‘আপনার ছেলেরা কেমন আছে?’ প্রশ্নটা করার পরই তিনি তীক্ষ্ণ ভাবে মিসেস রহমানের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করলেন। মিসেস রহমান তেমন বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। তিনি অমায়িক হেসে বললেন, ‘আছে ওরা দুজন বেশ ভালোই আছে। মাহীনের প্ল্যান ছিলো রায়েদ যেন আজকের প্রোগ্রাম সম্পর্কে আগে থেকে কিছু না জানতে পারে। রাবিত গিয়েছে ওকে নিয়ে বাইরে। কিছুক্ষণ পর চলে আসবে।’
মিসেস নাসরিন বললেন, ‘যাক ভালোই হয়েছে। আচ্ছা আমি শুনলাম সেলিও নাকি আসছে।’
‘আসবে না আবার। সে শুধু কী আমার ডাক্তার নাকি, আমার বোনের মতো।’
‘উনাকে এত মাস দেখার পরও কখনো মনেই হয়নি উনি এতটা মিশুক হতে পারেন।’
‘কী জানি। উনি তো প্রথম থেকেই আমাকে চিকিৎসা করার উদ্দেশ্যেই কথা বলতেন তাই হয়তো আমার ওনাকে অন্য রকমই লেগেছে।’
মিসেস নাসরিন আলতো করে সায় জানি মাথা নাড়লেন। এরপরই মিসেস নাসরিনের মাথায় হঠাৎ একটা প্রশ্নের উদয় হলো। কিছুদিন ধরেই প্রশ্নটা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো। আজ মিসেস রহমানকে জিজ্ঞেস করবেন কিনা ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ ভাবে চিন্তাভাবনার পর প্রশ্নটা করা আসলেই অসংলগ্ন বলে মনে হলো। অবশেষে সেটা মাথার মধ্যে চাপা দিয়ে দিলেন।
.
.
এদিকে মিসেস মাদিহ ওনার এখানে আসার পর পড়াশোনা নিয়ে সংগ্রামের কাহিনী শোনাচ্ছেন। মি.মোর্শেদ থেকে শুরু করে মাহীন ও নাইমও মনোযোগ সহকারে শুনছে। উনি বলে চলেছেন, ‘প্রথমত আমার দেশ, আপনজন সকলকে ছেড়ে এমন একটা দেশে আসা যেটা সম্পর্কে সেকালে আমার কোনো ধারণাই ছিলো না। তার ওপর এখানে সারাদিন কাজ করে ঘর সামলিয়ে পড়াশোনা করা যুদ্ধের চাইতে এক অংশেও কম ছিলো না।…তখনই খুট করে শব্দ হয়ে মূল প্রবেশদ্বার খুলে গেল। মিসেস মাদিহ কথা থামালেন। সকলেই দৃষ্টি ঘুরাল দরজার দিকে। দরজা খুলে প্রথমে রায়েদ ভেতরে ঢুকতেই থমকে দাঁড়ালো। হঠাৎ ঘরে এতগুলো মানুষের উপস্থিতি ওকে হতবাক করে দিলো। তারওপর এতগুলো চোখ ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। প্রথমেই চোখে পরলো সোফায় নাইমের পাশে বসে আছে মাহীন। ও নিজেকে সামলে নিয়ে সবার আগে মি.মোর্শেদ কে সালাম দিলো। সেই ওর সবচাইতে কাছাকাছিতে অবস্থান করছিলো। এরপর দৃষ্টি গেলো রান্না ঘরের দিকে। সেখানে মায়ের সাথে মিসেস নাসরিনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সালাম দিলো। তারপর তাড়াতাড়ি জুতা খুলতে লাগলো। পেছন পেছন রাবিত ভেতরে ঢুকলো। ওকে একটুও অবাক হতে দেখা গেলো না। সেও সকলকে সালাম জানিয়ে জুতা খুলতে ব্যস্ত হলো। এই হঠাৎ আয়োজনে যারপরনাই অবাক হয়েছে রায়েদ। ভাবছে, মাহীন সপরিবারে আমাদের বাসায় আসলো সঙ্গে এত ঘটা করে আয়োজন হলো এবং আমাকে কেউ জানালোও না? কী আশ্চর্য তো!
জুতা খুলে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল না। এখন একটু ফ্রেস হতে নিজের কামরায় যাওয়ার চেয়ে সকলের সাথে এখানে বসাটাই অধিক সমিচিন মনে হলো। সোফায় গিয়ে দাদির পাশে বসল। মি.মোর্শেদ জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেমন আছো?’
‘এইতো আছি আলহামদুলিল্লাহ। আপনি?’
‘আমিও ভালোই আছি। এত দেরি হলো যে?’
রায়েদ এর উত্তরে কী বলা উচিত ঠিক বুঝতে পারলো না। ওকে তো রাবিত জোর করে হাঁটতে নিয়ে গিয়েছিল। ঘরে মেহমান আসবে শুনেও গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বাইরে হাঁটতে গিয়েছিল এটা বলা মোটেও ঠিক হবে না। তবে রায়েদের বিভ্রান্তির কথা বুঝতে পেরেই হয়তো মাহীন বলল, ‘বাবা এটা ওর জন্য সারপ্রাইজ ছিলো। ওতো জানতোই না আমরা আসছি।’
মি.মোর্শেদ হাসলেন। বললেন, ‘ওহ আচ্ছা তোর বুদ্ধি না এটা।’ ইতস্তত হাসল মাহীন। রায়েদ প্রথমেই বুঝতে পেরেছিল এসব বুদ্ধি মাহীনের মাথা থেকেই বের হয়। সঙ্গে সঙ্গে আবার মাও তাল দেয়। রাবিত এসে নাইমের পাশে বসলো। মিসেস রহমান অবশেষে বাকলাভা, স্টাফড গ্রেপ লিভস, কোফতা ও সেমাই এনে সেন্টার টেবিলে রাখলেন। মিসেস নাসরিন রাবিতকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আর তুমি কেমন আছো বাবা?’
রাবিত সহাস্যে বলল, ‘এইতো ভালো আছি আন্টি।’
মি.মোর্শেদ রায়েদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তো তোমার পড়াশোনার কী অবস্থা? কয়েকদিন পূর্বেই তো মিডটার্ম পরীক্ষার রেজাল্ট দিলো।’
‘এইতো সামোহির সকল জুনিয়রদের মধ্যে প্রথম হয়েছি।’
মি.মোর্শেদ ও মিসেস নাসরিন দুইজনই বিস্মিত হলেন। মি.মোর্শেদ পুলকিত গলায় বললেন, ‘বাপরে বাপ মাশাল্লাহ!’ বলে রান্নাঘরের দিকে চোখ ফিরিয়ে বললেন, ‘মিসেস রহমান আপনার ছেলে তো ব্রিলিয়ান্ট!’
মিসেস রহমান বারের পেছন থেকেই হাসি মুখে বললেন, ‘তা আর বলতে। ওর হাভার্ড থেকে টেক্সটাইল ইন্জিনিয়ারিং পড়ার ইচ্ছা, ইনশাআল্লাহ কনফার্মই বলা যায়।’
মি.মোর্শেদ বললেন, ‘তাই নাকি? টেক্সটাইল ইন্জিনিয়ারিং ক্যারিয়ার হিসেবে বেছে নেওয়া তো গ্রেট! আর তোমার যেরকম রেজাল্ট সেটা ধরে রাখতে পারলে হাভার্ডে চান্স পাওয়া কোনো ব্যাপারই না।’
রায়েদ হালকা হাসল। কিছু বললো না। নাইম জিজ্ঞেস করল, ‘তো ভাই তুমি সারাদিনই পড়ো? নাকি সব ট্যালেন্টের কারিশমা?’
রায়েদ কিছু বলার পূর্বেই রাবিত বলল, ‘ওফ যেভাবে বইয়ের সাথে চিপকে থাকে সেটা নিয়ে আর কিছু বলার নেই। ঈদের দিনও বইকে রেহাই দেয় না।’ মি.মোর্শেদ ও মিসেস নাসরিন হাসলেন।
মিসেস মাদিহ হেসে বললেন, ‘এখন দিন পাল্টেছে। এমনিতে আগের চিরাচরিত দৃশ্যই দেখা গেলেও ছুটির দিনগুলোতে আর বই ছুঁয়েও দেখে না। আজকাল বন্ধুদেরও সময় দেয়।’
মিসেস নাসরিন বললেন, ‘অবশ্যই বন্ধুদের সাথেও সময় কাটানো উচিৎ। ছেলেমেয়েদের সবকিছুই সমান ভাবে দরকার।’ রায়েদ মাহীনের দিকে এক নজর তাকাল। ওনারা তো জানেন না ছুটির দিন অন্য কোনো বন্ধু নয় মাহীনের সঙ্গেই ঘুরেবেড়ায় ও। এক মনে নিজের নখ খুটরাচ্ছে মাহীন। যেন এই মুহূর্তে নখ খুটরানোর চাইতে গুরুত্বপূর্ণ কাজ পৃথিবীর আরেকটা নেই। মনে হলো যেন এখানে বসে থেকেও এক প্রকার অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে ও। মিসেস রহমান অবশেষে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। সোফার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আপনারা খাওয়া দাওয়া করুন। বাকিদের আসতে দেড়ি আছে। আমি এখুনি আসছি।’ সকলে সায় জানিয়ে মাথা নাড়ল। মিসেস রহমান রায়েদের দিকে দৃষ্টি ফেরালেন, তুই আমার সাথে একটু আয় তো।’ হঠাৎ সকলের মাঝখান দিয়ে এভাবে ডেকে নেওয়াতে রায়েদ অবাক হলো। ও কি কোনো ভুল করে ফেলেছে? কোনো ভুল কথা বলে ফেলেছে? নাহলে ঠিক এই মুহূর্তে সকলের মাঝখান থেকে ওকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার কী মানে? রায়েদ উঠে দাঁড়াল। হঠাৎ পুরনো আশঙ্কা এসে হানা দিলো ওর মনে। না জানি কী বলতে চান মা। না জানি পরিস্থিতি কোথা থেকে কোথায় মোর নেয়। এসব আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতেই মায়ের পিছু পিছু ওনার কামরায় প্রবেশ করল। ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে ও। কপালে গভীর চিন্তার ছাপ। কয়েক মিনিটের ব্যবধানেই নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। মিসেস রহমান কামরায় প্রবেশ করেই কোনো দিকে দৃষ্টিপাত না করে চাবি নিয়ে আলমারির কাঠের পাল্লা দুটো খুললেন। তারপর একটু ঘাটাঘাটি করে কাঠের ছোট একটা বাক্স বের করে আনলেন। আলমারির দরজা বন্ধ করে এসে বিছানায় বসলেন। রায়েদ নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে ওনার কাজকর্ম লক্ষ করছে। মিসেস রহমান ওর দিকে মুখ তুলে তাকালেন। বললেন,’কী হলো বসো।’ রায়েদ অপ্রতিভ ভাবে এসে বসলো মায়ের পাশে। ভাবলো কাঠের বাক্সটা নিয়েই বুঝি কিছু একটা করতে যাচ্ছেন মা। কিন্তু মিসেস রহমান সেটা একপাশে রেখে দিয়ে রায়েদের দিকে পরিপূর্ণতে দৃষ্টিতে তাকালেন। তারপর ঝট করে ওর হাত দুটো শক্ত করে ধরে শান্ত গলায় বললেন, ‘বাবা দেখ্ এত বছর আমি তোর সাথে যেরকম নিষ্ঠুর আচরণ করেছি তারপরও..মানে ক্ষমা চাওয়ারও মুখ নেই আমার। জানি না এতটা নির্দয় কখন কিভাবে হয়ে গিয়েছিলাম। তারপরও বলছি আমাকে মাফ করে দি…বলতে বলতে গলা ধরে এলো ওনার। চোখের কার্ণিশে নোনাজল চিকচিক করে উঠল। হঠাৎ মায়ের এমন কথায় অদ্ভুত এক প্রশান্তিময় ঢেউ ওর মনের সৈকত ছুঁয়ে গেল। একই সাথে মায়ের চোখে পানি, তার ব্যাথাতুর মুখভঙ্গি ওর মনকে নাড়া দিয়ে গেলো। বুকে চিনচিনে ব্যাথার আবির্ভাব ঘটলো। রায়েদ উল্টে নরম কন্ঠে বললো, ‘মা তোমার তো কোনো দোষ ছিলো না। এবং আমি কখনোও তোমার এমন আচরণে রাগ করিনি। এখনো আমার মনে এসব নিয়ে কোনো রাগ নেই। তুমি যে সুস্থ হয়ে উঠেছো এটাই সবচেয়ে আনন্দের বিষয়।’
মিসেস রহমানের চোখ টপকে দু বিন্দু জল ফর্সা গাল বেয়ে গড়িয়ে পরল। উনি ম্লান কন্ঠে বলল, ‘তাহলে তুই আমাকে মাফ করে দিয়েছিস?’
রায়েদ গাঢ় কন্ঠে বলল, ‘আহা আমি তোমার ওপর কখনোও রাগ করিনি! আমার কোনো অভিযোগ নেই তোমার কাছে তাহলে ক্ষমার বিষয়টা আসছে কোথা থেকে?’ মিসেস রহমানের মুখমণ্ডল গোলাপি বর্ণের হয়ে উঠেছে। তার চোখ পেরিয়ে নিঃশব্দে একের পর এক বিন্দু বিন্দু অশ্রু গড়িয়ে চলেছে। তিনি রায়েদকে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর ভাঙ্গা গলায় কোনো ক্রমে বললেন, ‘আমার মনে হচ্ছে চার বছর তুই কোথাও হারিয়ে গিয়েছিলি। এতদিন পর হঠাৎ তোকে পেয়ে গেলাম। চোখের নিমিষেই কত বড় হয়ে গেলি তুই। অথচ এর মাঝে কোনো ঈদ, কোনো রোজা, কোনো অসুখ বিসুখ, পড়াশোনা সবকিছু নিয়েই নির্বিকার ছিলাম আমি।’
রায়েদ নিশ্চুপ। চুপচাপ মায়ের কথাগুলো শুনছে। প্রতিটা কথা ওর মনে এক অনুভূতি জমা করছে। এই অনুভূতিগুলোই নোনাজল রুপে চোখের কোণায় এসে জড়ো হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর মিসেস রহমান ওকে ছেড়ে দিলেন। তারপর কিছুটা সময় নিয়ে ধীরে ধীরে বললেন, ‘শোন এখন থেকে তোকে কোনো কষ্ট ছুঁতেও পারবে না। তোর যখন যা মন চায় আমাকে বলবি। চার বছরের হারিয়ে যাওয়া সময়গুলো তো আর ফেরত আনতে পারবো না। কিন্তু এই সময়গুলোকেই সুন্দর ভাবে ঠিকই করতে পারবো।’ বলে থামলেন।
রায়েদ বলল, ‘মা তোমাকে এসব নিয়ে এত ভাবতে হবে না। তুমি যে এখন আবার আগের মতো হয়ে গিয়েছো সেটা এমনিতেই আমার সবকিছুকেই আবার রঙিন করে দিয়েছে।’ মিসেস রহমান স্তিমিত হাসলেন। তারপর হঠাৎ চনমনে হয়ে বললেন, ‘আমি না মাহীন তোর জীবনকে রঙিন করে দিয়েছে।’ বলে থেমে ইতস্ততভাবে বললেন,’আচ্ছা তোর মাহীনকে কেমন লাগে?’ হঠাৎ মায়ের মুখে এমন প্রশ্ন শুনে রায়েদ অপ্রস্তুত হলো। ঠিক বুঝতেও পারলো না ও ঠিক শুনেছে কিনা। জিজ্ঞেস করল, ‘কি বললে?’
‘বললাম তোর মাহীন কেমন লাগে?’
‘ভালো।’ ছোট করে বলল রায়েদ। রায়েদের সারা মুখময় লালচে আভা ছড়িয়ে পরেছে। মিসেস রহমান সেটা লক্ষ্য করে মুচকি হাসলেন। আর রাখঢাক না করে বললেন, ‘তুই মাহীনকে পছন্দ করিস তাই না?’
রায়েদ এ পর্যায়ে অস্বস্তি ও বিব্রততার চরম পর্যায় পৌঁছে গেল। কেন মা হঠাৎ করে সোজাসুজি এমন প্রশ্ন করা শুরু করেছেন। সামান্য হ্যা বলতে কেমন লজ্জা করছে। তবুও ইতস্তত করে কোনো ক্রমে উত্তর দিলো, ‘ওকে কার পছন্দ হবে না মা।’
মিসেস রহমান এবার পাশে রাখা কাঠের বাক্সটা হাতে তুলে নিলেন। কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে বাক্সটির দিকে তাকিয়ে থেকে সেটা খুললেন। ভেতরে লাল মোলায়েম কাপড়ের মাঝে একটি সোনালী ব্রেসলেট রাখা। মিসেস রহমান ব্রেসলেটটা হাতে নিয়ে রায়েদের সামনে তুলে ধরে বললেন, ‘তাহলে শোন মাহীনকে যদি এটা এখন দিয়ে দেই বেশি বারাবাড়ি হয়ে যাবে না তো?’
রায়েদের মনেই হয়েছিল উনি এমন কিছু একটা করতে পারেন। তবুও চোখ বড় বড় করে তাকাল। বলল,
‘মা মাহীনকে তাই বলে হঠাৎ তোমার সোনার ব্রেসলেট দিবা তুমি? এতে ওর মা-বাবা কী ভাববে?’
মিসেস রহমান হালকা হাসলেন। নরম কন্ঠে বললেম,
‘ভাববেন, অনেক কিছুই ভাবতে পারেন। তবে আমি কী তাদের সাথে কথা বলবো না? আমি মনে করি এই ব্যাপারটা নিয়ে ওনাদেরও পরিষ্কার একটা ধারণা থাকা উচিৎ। এবং সেটা বোধহয় আমার কাছ থেকে সামনাসামনি জানাটাই বেশি ভালো হয়।’
রায়েদের অস্থিরতা এবং বিচলিত ভাবটা পুনরায় ফিরে এলো তবে এবার দুশ্চিন্তাকে সঙ্গে নিয়ে। বিভ্রান্তিভরা দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘কিন্তু মা মাহীন তো এসব নিয়ে একদমই প্রস্তুত না। ওতো…
মিসেস রহমান থামিয়ে দিলেন ওকে। প্রলম্বিত শ্বাস ফেললেন। গাঢ় কন্ঠে বললেন, ‘দেখ এসব জিনিস এভাবে লুকাচুরি করে হয় না। তোদের বিয়ের বয়স হলে বিয়ে দিয়ে দিতাম। তা তো আর করতে পারছি না। তাই আপাতত সবাইকে সবকিছু জানিয়ে রাখা ভালো। কাউকে অন্ধকারে রাখা উচিং না।’ বলে উঠে দাঁড়ালেন। বাক্সটা তার হাতে রয়েছে। রায়েদও উঠে দাঁড়াল। শান্ত কন্ঠে বলল, ‘ঠিক আছে মা তুমি যা ভালো বোঝো তাই করো।’

ইনশাআল্লাহ চলবে।