এল এ ডেইস পর্ব-৪২+৪৩

0
171

#এল এ ডেইস
পর্ব ৪২
লেখনী মাহীরা ফারহীন

বাতাসে ভেজা ভেজা মোহময় প্রাকৃতিক ঘ্রাণ। কিসের ঘ্রাণ তা ঠিক ধরা যাচ্ছে না। সবুজ রঙা ম্যাপল পাতার গাছ। অসময় বলে ম্যাপলের চিরচেনা লাল বর্ণ নেই। বেশ কয়েকটা সিডার ও একটি জ্যাকারেন্ডা গাছ গোটা বাগানটাকে বেড়ার মতো ঘিরে রয়েছে। সোনা বরণ রোদ তেড়ছা ভাবে হালকা বেগুনি ফুলে ভরা জ্যাকারেন্ডার উপর স্বর্গীয় পরশ বুলিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। বাগানের গাছপালাগুলোকে চিরুনির মতো গলে বয়ে যাচ্ছে বাতাস। বড় সাজানো গোছানো প্রাকৃতিক ব্যাক ইয়ার্ড। নায়েলের বাড়ির প্যাটিওতে আট আশন বিশিষ্ট সাদা ডাইনিং টেবিল। বাড়ির বাকি সদস্যরা আপাতত বাড়িতে নেই। টেবিল জুড়ে সাতজন ছেলে মেয়ে গম্ভীরমুখে বসে আছে আসন্ন দুঃসংবাদের অপেক্ষায়। কেউ বলে দেইনি ওরা কোনো দুঃসংবাদ পেতে চলেছে। তবে ক্যারোলের মুখভঙ্গি দেখে তা আন্দাজ করে নেওয়া যায়। কোনো সংবাদ দেওয়ার ক্ষেত্রে একটা অদ্ভুত ব্যাপার আছে। আনন্দের সংবাদ দেওয়ার বেলায় মুখটা দুঃখি দুঃখি করে রেখে হঠাৎ ভালো খবরটা দিয়ে চমকে দেওয়া যায়। তবে দুঃসংবাদ দেওয়ার পূর্বে মুখটা হাসি হাসি করে রেখে চমকে দেয়া যায় না। মন মেজাজই তেমনটা থাকে না। ক্যারোল সেই প্রথম থেকে বিষন্ন, হতাশ ও কাঁদো কাঁদো মুখভঙ্গিতে বসে আছে। অবশেষে প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে মূর্তির মতো বললো, ‘আই এম মুভিং আউট নেক্সট উইক।’
সবাই বিস্ময়ের ঝটকা খেল। চোখ বড় বড় করে চেয়ে রইল। বিস্ময়ের ঢাক্কাটা কাটিয়ে উঠে লিম জু সবার আগে কথাটা পুনরাবৃত্তি করল, ‘ইউ আর মুভিং আউট!’
ক্যারোল আলতো ভাবে মাথা নাড়ল।
‘বাট হোয়াই?’ জিজ্ঞেস করল সাইলোহ।

ক্যারোলকে উত্তর দেওয়ার সময় না দিয়েই লিও বলল,
‘কয়েকমাস আগেই তো এই স্টেটে এলা। এত তাড়াতাড়ি আবার কিসের মুভ আউট?’

ক্যারোল স্তিমিত কন্ঠে বলল, ‘আমি কী এখান থেকে যেতে চেয়েছি নাকি। ওটা তো আমার দাদি আর থাকতে চান না এখানে।’

জেনেট জিজ্ঞেস করল, ‘কিন্তু কেন? এখানে কী ওনার ভালো লাগেনি? বা অন্য কোনো সমস্যা?’

‘এক্সপেন্স বেশি তাই?’ জিজ্ঞেস করল নায়েল।
ক্যারোল ধীরে ধীরে ডানে বামে মাথা নাড়ল। বলল,
‘না এগুলো কোনোটাই সমস্যা নয়। সমস্যা হচ্ছে এখন পর্যন্ত এ জীবনে আমি নয়টা স্টেট বদলেছি। প্রথমে ফ্লোরিডা থেকে ম্যানহাটেন, ইন্ডিয়ানা, বস্টন, নর্থ ক্যারোলাইনা,লুইজিয়ানা,ডালাস, সিয়াটল, ম্যারিল্যান্ড। এবং ক্যালিফোর্নিয়া নিয়ে দশটা হলো।’
লিম জু সবিস্ময়ে বলল, ‘তুমি এত স্টেটে থেকেছো? বুঝলাম না। এক জায়গায় স্টে করতে কী সমস্যা?’

‘সমস্যা হচ্ছে আমার দাদির কোথাও শান্তি হয় না। মন থিতু হয় না। শেষমেশ পেরু যেতে পারলেই বোধহয় তার হৃদয়ে শান্তি মিলবে। কিন্তু সেই পর্যন্ত আমি এই চরম অশান্তিতেই থাকবো। লাস্ট ম্যারিল্যান্ডে চার মাস ছিলাম। তাও তো এখানে ছয় মাস থাকলাম। আর আগেই হয়তো দাদি মুভ করতে চাইতেন। কিন্তু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে এতদিন কিছু বললেননি।’ নিরাশ ভাবে বলল ক্যারোল।

লিও জিজ্ঞেস করল, ‘এবার কোথায় যাবা?’
ক্যারোল ম্লান মুখে উত্তর দিল, ‘এলাবামা।’

‘আচ্ছা এটা র‌্যবিট জানে?’ এতক্ষণে একটা প্রশ্ন করল মাহীন। এতক্ষণ নিশ্চুপ বসে সব শুনছিল। ক্যারোলের বুক চিরে আরেকটা প্রলম্বিত শ্বাস বেরিয়ে আসল। বলল, ‘ওকে সবার আগেই বলেছি। গতকাল।’

‘তো শোনার পর কী বললো?’ জিজ্ঞেস করল নায়েল।
ক্যারোলকে আরোও বেশি দুঃখিত দেখাল। এবার বুঝি বুকের ভেতর জমে থাকা কষ্টটা বাঁধ ভেঙ্গে অক্ষিকোটর হয়ে বেরিয়ে আসবে। তবে এমন কিছুই অবশেষে হলো না। বেশ শক্ত আছে মেয়েটা। ছোটবেলা থেকে কত জায়গা পাল্টেছে, কত বন্ধু হারিয়েছে। বুকটা শক্ত করে কত শহর পেছনে ফেলে এসেছে বলেই এখন আর খুব সহজে ভেঙ্গে পরে না। এভাবেই গড়ে উঠেছে ও। ক্যারোল নিষ্প্রভ গলায় বলল, ‘অনেক ভাবে জিজ্ঞেস করেছে যে, কোনো ভাবেও আমি দাদিকে রাজি করাতে পারি কিনা। কিন্তু আমি কী বলবো? শেষে আর কিছু বলেনি। এমনিই উঠে চলে গিয়েছিল। এসেছিল যতটা হাসিখুশি প্রফুল্ল মনে, ফিরে গিয়েছিল ততটাই বিষন্ন, বিধ্বস্ত ভাবে।”
মনে হলো এই কথা শুনে সকলে আরোও বেশি দুঃখিত হয়ে পরল। কারোও মুখে বেশ কিছুক্ষণ পর্যন্ত কোনো কথা ফুটলো না। আগস্টের সুন্দর বিকেল, সোনার মতো রোদ, ছবির মতো বাগানে বসেও কারোরই এসব উপভোগ করার মতো মন মেজাজ নেই। বরং পরিবেশটা ভারি হয়ে আছে। ক্যারোল যেন অল্প কিছুদিনের গ্রীষ্মকালিন অতিথি পাখি হয়ে এসেছিল ওদের জীবনে। গ্রীষ্ম যেই বিদায় নিতে ধরেছে সেই মেয়েটাও চলে যাচ্ছে ওদের ছেড়ে। হয়তো বা তা মাত্র ছয় মাসেরই বন্ধুত্ব। হয়তো বা মাহীনের সঙ্গে ক্যারোলের প্রথম সাক্ষতটা দূর্বিষহ ছিলো। তবে শুরু বা সময় দিয়ে কিছুই মাপা যায় না। বন্ধুত্বের বন্ধনটা যে ছিলো দৃঢ়। ওদের সকলেরই ইচ্ছে করল ক্যারোলকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে। তবে তাতে ক্যারোলের আরোও বেশি কষ্ট হবে। এখানে বাকিরা একসাথে থাকলেও সকলকে ফেলে একা একা তো চলে যেতে হবে ওকে। মাহীনের চোখের কার্ণিশে বারবার অশ্রু বিন্দু চকচক করে উঠছিল। তবে তা গড়িয়ে পরছিল না। কিভাবে যেন চোখের মধ্যে মিলিয়ে যাচ্ছিল। অবশেষে ওরা পরিবেশ হালকা করতে ঠিক করে নিল এরপরের যেই কয়েকদিন ক্যারোল আছে সেই কয়দিন শুধু ওরা ওকেই সময় দেবে। ঘুরতে যাবে, খেতে যাবে, সিনেমা দেখতে যাবে। কেউ মনে দুঃখ নিয়ে যাওয়ার কথা মনে করিয়ে দেবে না। সকলে শুধু আনন্দ করবে।
.
.
.
নিরবচ্ছিন্ন ঝিঝি পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। অন্ধকার আকাশের বুকে ঝুলে রয়েছে জৎস্না মাখা রুপোলি শুক্লপক্ষের অষ্টমী চাঁদ। জানালা দিয়ে পর্দগুলোকে ঢাক্কা দিয়ে তিরতির করে ঢুকে যাচ্ছে বাতাস। বিছানার দুপাশের টিমটিমে হলদে আলোর ল্যাম্প জ্বলছে। রায়েদ বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে সিডনি সেলডনের ব্লাডলাইন বইটা পড়ছে। শান্ত নিরব পরিবেশটা চিরে তীক্ষ্ণ শব্দে ফোন বেজে উঠল। সেলফোনটা বিছানার ওপরই রাখা ছিলো। রায়েদ বই নামিয়ে রেখে স্ক্রিনে দেখলো ভারবেনা লিখা। সঙ্গে সঙ্গে মনটা নেচে উঠল। প্রসন্ন মনে বই রেখে কল রিসিভ করল। ওপাশ থেকে কোনো কথা শোনা গেল না। রায়েদই প্রথমে বলল,
‘তো মিস ফারুকী। এতদিনে আপনার আমার কথা মনে পরল?’
এবার ওপাশ থেকে মাহীন অপ্রতিভ গলায় বলল,
‘আহা আমি তোমাকে ভুলে কখন গিয়েছিলাম শুনি?’

‘ওহ তাই। তো গত তিন দিন কোথাও তোমার দেখা পাইনি কেন বলোতো?’

‘উম কারণ তুমি খোঁজইনি। আচ্ছা যাই হোক সেটা বাদ। আমি অন্য কিছু বলতে ফোন করেছি।’

‘কী এমন জরুরি কথা? তুমি তো কখনো এভাবে ফোন দাও না।’
ওপাশ থেকে ইতস্তত কন্ঠ শোনা গেল, আচ্ছা রাবিত কেমন আছে?’ রায়েদের ভ্রু সূঁচালো হলো। জিজ্ঞেস করল, রাবিত? হুম ও তো ভালোই আছে। কিন্তু ওর কথা কেন জিজ্ঞেস করছ? কিছু হয়েছে?’
আবারও কিছুক্ষণ নিরবতা ওপাশে। তারপর স্মিত কন্ঠে বললো, ‘ওহ আচ্ছা দেখো একটু ও কেমন আছে না আছে। কারণ ক্যারোল চলে যাচ্ছে।’

‘চলে যাচ্ছে মানে? কী বুঝলাম না? আর এর সাথে রাবিতের কী সম্পর্ক?’

‘ক্যারোল মুভ আউট করছে তাই রাবিতের মন খারাপ। আই মিন একটু বেশিই খারাপ।’ মিনমিন করে বলল মাহীন।

‘মাহীন ঘটনাটা কী বলোতো? ক্যারোল এখানে মুভ করেছে মাত্র ছয় মাস হয়েছে। এরই মধ্যে আবার মুভ করছে? আর তাতে রাবিতের একটু বেশিই মন খারাপ হওয়ার কারণ? সত্যি করে বলোতো কী হয়েছে।’

‘ওয়েল দেখো ক্যারোল রাবিতের ক্রাস ছিলো অর হাফ গার্লফ্রেন্ড ও বলা যায়।’ এক টানে কথাগুলো বলেই চুপ হয়ে গেল মাহীন। রায়েদ হা হয়ে রয়েছে যদিও কিছুটা আচ করেছিল এমন কিছুই শুনবে। কিছুক্ষণ সময় নিল ধাতস্থ হতে। জানালা দিয়ে একটা কালো প্রজাপতি ভেতরে ঢুকে তিড়িংতিড়িং করে উড়ে বেড়াচ্ছে। রায়েদ গাঢ় ভাবে বলল, ‘ মানে কি? তাই বলে এতটা? ও আমাকে কিছুই জানাল না! কবে থেকে এসব চলছে?’

মাহীনের কন্ঠ কিছুটা উদ্বিগ্ন শোনাল, দেখো চলছিল তো কিছুদিন ধরেই। তবে ওরা কোনো রিলেশনে ছিলো না। ইভেন ওদের মধ্যে কিছু শুরু হওয়ার আগেই শেষ হয়ে যাচ্ছে।’
রায়েদের বুক চিরে লম্বা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসল। একই সঙ্গে স্বস্তি মিললো আবার বেদনাহতও হলো। এখন উঠে দাঁড়িয়ে ম্লান হলদে আলোয় কামরার এদিক থেকে ওদিক পায়চারী করছে। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে ভাবল, রাবিতের সঙ্গে কথা বলতে হবে। আর এটা আমাকে না জানানোর জন্য মাহীনের ওপর রাগ হওয়ার কোনো কারণ নেই। রাবিত নিশ্চয়ই ওকে দিয়ে ওয়াদা করিয়েছিল বা কিছু একটা।’ ওপাশে মাহীনও কিছু শোনার অপেক্ষায় আছে। রায়েদ বলল, ‘আচ্ছা ঠিক আছে। আমি দেখি রাবিতের কী অবস্থা।’ থেমে আবার বলল, কিন্তু ক্যারোল হঠাৎ মুভ করছেই বা কেন? আর কোন স্টেটে যাচ্ছে ও?’
‘ওর দাদির জন্য। ওর দাদি কোথাও স্থায়ী থাকতে পারেন না। এবং ওরা এলাবামা যাচ্ছে এবার।’

‘ওহ তাহলে আর কী বলার থাকতে পারে।’

‘ঠিক আছে তুমি রাবিতের সঙ্গে কথা বলো। আমি রাখছি।’
‘কাল স্কুলে যেন তোমাকে খুঁজে পাই।’
‘আচ্ছা।’ বলে লাইন কেটে দিল। রায়েদ জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। রুপালী চাঁদের পানে চেয়ে বুক ফেড়ে আরেকটা প্রলম্বিত শ্বাস বেরিয়ে আসল।
.
.
.
.
একটা চোখ নেই। সেখান থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। বারবার অর্ধ লাগোয়া দরজায় থাবা মারছে উন্মাদের মতো। অতি বিভৎস রকমের ভেষ ওয়ালা একটা জম্বি অর্ধেক লাগানো ট্রেনের দরজার চিপা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করার চেষ্টা করছে। ভেতরের মানুষগুলো ভয়ে আতঙ্ক চুপসে কাঁদা হয়ে আছে। সেই বিভৎস জম্বির পেছনে বিশাল প্রাণহীন জ্যান্ত লাশগুলো টলতে টলতে ধেয়ে আসছে।

কামরার আলো নেভানো। জানালার কপাট বন্ধ। বদ্ধ কামরায় একমাত্র স্মার্ট টিভির বড় স্ক্রিনের আলো এবং ট্রেন টু বুসানের ভয়ঙ্কর দৃশ্যগুলো একটা গা ছমছমে পরিবেশ তৈরি করেছে। রাবিত পারলে হাতে ধরা বালিশটাই চোখের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়। ভয়ে কুঁকড়ে বসে আছে সোফার ওপর। দরজা ধীরে ধীরে হঠাৎ খুলে গেল। রাবিত প্রায় বিদ্যুৎ চমকের মতো চমকে উঠল। ওর হৃদয় বোধহয় একটা বিট স্কিপ করল। চমকের চোটে দেহ থেকে আত্নাই যেন বেরিয়ে যাচ্ছিল। ভয়ার্ত চোখে চেয়ে রইল দরজার দিকে। দরজা খুলে রায়েদ সন্তর্পণে ভেতরে প্রবেশ করল। অবশেষে রাবিত যেন ওর হারিয়ে যাওয়া আত্না ফিরে পেল। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। রায়েদ ভ্রু কুঞ্চিত করল। ভেতরে এসে দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে বলল, ‘কী ব্যাপার আমি কী ভূত?’
রাবিত শুঁকানো গলায় ছোট করে বলল, ‘না।’

‘তো এই এরকম ভয়ে চুপসে গিয়েছিস কেন?’
বলে সোফায় ওর পাশে বসে পরল। টিভির দিকে তাকিয়ে দেখে বলল, ‘ওহ আচ্ছা ট্রেন টু বুসান দেখে এই অবস্থা। তুই তো জানিস রা জম্বিরা ব্রেইন খায়। সুতরাং তুই সেফ আছিস।’
রাবিত চুপচাপ টিভির দিকে তাকিয়ে ছিল। কথাটা মাথায় ঢুকতেই বিরক্ত চোখে রায়েদের দিকে চাইল কিন্তু কিছু বললো না। কিছুক্ষণ চুপচাপ দুইজনই টিভির দিকে তাকিয়ে রইল। অবশেষে রায়েদ বলল,’এ্যই তোর মুড অফ কেন বলতো?’

‘উম কোথায়? আমি তো সিরিজ টা দেখে ভয়ে আছি। মুড অফ কোথায় দেখলা?’

‘সারাদিন ধরে তো আর তুই সিরিজ দেখছিলিস না। তোর তো সকাল থেকেই মুড অফ। বল না কী হয়েছে।’

‘বললাম তো কী হবে? কিছুই তো হয়নি।’

রায়েদ বিরক্ত হয়ে ভাবল, এই একটা গুনই আমার কাছ থেকে পেয়েছে বোধহয়। যেটা বলবে না সেটা নিয়ে এফবিআই এর এজেন্টের মতো আচরণ করে।’ মুখে

বলল, ‘আচ্ছা তো শুনলাম ক্যারোল নাকি মুভ করছে।’
কথাটা শুনে হঠাৎ করেই রাবিতের মুখে ঘন কৃষ্ণ মেঘ নেমে এলো। স্তিমিত কন্ঠে বলল, ‘হ্যা।’

‘তাহলে ক্যারোল ভালো হোক আর যাই হোক ও কিন্তু বিধর্মী। তুই কীভাবে ওকে পছন্দ করলি আমার তো মাথাই ঢুকছিল না।’

রাবিত কিছুটা বিস্ময় নিয়ে ওর দিকে চাইল। বলল,
‘তুমি এসব জানলে কী করে?’

‘আমি এসব জানলাম কী করে সেটা বড় কথা না।’ বলে
থামল। এবার নরম কন্ঠে বলল, ‘শোন একটা কথা মাথায় ঢুকিয়ে নে, যেটা আমাদের জন্য ভালো না সেটাই আল্লাহ আমাদের থেকে দূর করে দেন। তোর জন্য ক্যারোল কখনো ঠিক মানুষ ছিলোই না। হ্যা হয়তো ও অনেক ভালো হতেই পারে। কিন্তু ওতো অন্য ধর্মের মেয়ে। সুতরাং ওকে যত তাড়াতাড়ি মাথা থেকে বের করতে পারবি তত তোর জন্যেই ভালো। বুঝলি?’
রাবিত ব্যাথাতুর দৃষ্টি মেলে কোমল কার্পেট মোড়া কাঠের মেঝের দিকে চেয়ে আছে। রায়েদ বলল,
‘জানি ভুলে যেতে সময় লাগবে এবং কষ্টও হবে। তবে তা অসম্ভব নয়।’
টিভিতে বিকট শব্দ হলো একটা। একটা মহিলা একটা জম্বির দিকে বড় একটা চেয়ার ছুঁড়ে মেরেছে। রাবিত আলতো করে উপরে নিচে মাথা নাড়ল। ম্লান স্বরে বলল, হ্যা এখন আর ওকে ভুলে যাওয়া ছাড়া আমার আর করারই বা কী আছে।’
কিছুক্ষণ পার হলো। রাবিত এখন ধাতস্থ হয়েছে। রায়েদ বলল, ‘চল ট্রেন টু বুসান দেখি।’

‘তুমি না এটা আগেই দেখেছ?’

‘হ্যা দেখেছি কিন্তু আবার দেখতে কী সমস্যা?’
রাবিত কিছু বললো না। সামনের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ কী মনে হতেই বলল, ‘এ্যই এটা তুমি এখনো আমাকে বলোনি যে তোমাকে এইসব খবর দিলো কে?’

‘হ্যা? ওহ বললাম তো তোর এত জানা লাগবে না।’

রাবিত চোখ ছোট করে বলল, ‘বালদিজ বলেছে?’

রায়েদ কটমট দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মাহীন বলতে পারিস না?’

‘তো বালদিজ বলতে কী সমস্যা? ভাবছি মাহীনকে এখন থেকে এই নামেই ডাকবো। মাহীন বললে অসম্মান জনক লাগে।’

রায়েদ ঝাঁঝ ভরা স্বরে বলল, ‘চর খাবি কিন্তু।’
রাবিত হেসে উঠল। তারপর আবার হঠাৎ করে ওর উৎফুল্ল মুখখানা নিভে গেল। রায়েদ বলল, আবার কী হলো?’
রাবিত অভিমানী কন্ঠে বলল, ‘উহ! এখন তুমি আমার থেকে বেশি বালদিজ কে ভালোবাসো।’
রায়েদ হাসল। বলল, ‘এত হিংসা তোর। ভুলে যাইস কেন তুই আমার একমাত্র ছোট ভাই। বোকা ছেলে।’
রাবিত আদুরে হাসল।

ইনশাআল্লাহ চলবে।

#এল_এ_ডেইস
পর্ব ৪৩
লেখনী মাহীরা ফারহীন

টুই টুই শব্দে গাছগাছালির আড়াল থেকে ভিরি পাখি ডাকছে। সোনালি রোদে ঝলমল করছে গাছপালা। কেন জানি সবকিছুই অতি সতেজ ও ঝকঝকে। আগস্টের অর্ধেক পেরিয়ে গিয়েছে। ধীর পায়ে শীত এগিয়ে আসছে সময়ের সাথে সাথে। আজকাল গরম তেমন একটা অনুভূত হয় না। মাহীন হেলেদুলে ধীরে ধীরে চত্ত্বর ধরে হাঁটছে। মনেও বড় শান্তি। চারিপাশের প্রতিটা জিনিস প্রতিটা ঘটনাকেই নিখুঁত সুন্দর মনে হচ্ছে। মন রঙিন থাকলে বোধহয় চারিপাশটাও রঙিন দেখায়। মাথার ওপর সুবিস্তীর্ণ নীল আকাশ। নিচে দেয়াল ঘেঁষে বেগুনি ডগলাস আইরিশ এবং সাদা ফ্রেসিয়া। কিছুদিন আগে আবার অল্প কিছু লাল ও হলুদ রঙের পেতুনিয়া লাগানো হয়েছিল। সেগুলোর কলি এসেছে।
‘মিহিন! মিহিন!” নিজের নামের এহেন বিকৃত উচ্চারণ শুনে ভ্রু সূঁচালো হলো মাহীনের। কে ডাকছে দেখতে আশেপাশে দৃষ্টি বুলাল। স্কুল বিল্ডিংয়ের দিক থেকে কিছুটা দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসছে একটা ছেলে। হালকা সোনালি চুল। ধূসর চোখের রঙ। এটা ম্যাট। ওকে চিনতে খুব একটা অসুবিধা হলো না। ছেলেটা সামনে এসে দাঁড়াতেই মাহীন বলল, ‘ইয়াহ?’
ম্যাট হাঁপিয়ে গিয়েছে। কয়েকটা লম্বা শ্বাস ফেললো। এবার বলল, ‘তুমি সেদিন আসলে না কেন?’
মাহীনের কপালে এখনো ভাজ। ম্যাটের কথা বোধগম্য হলো না। কী বলছে ও।
‘মানে? কোথায় আসিনি আমি?’ জিজ্ঞেস করল মাহীন।
‘ডোন্ট ইউ নো? ডেটে।’
মাহীনের ভাজ পরা ভ্রু জোড়া বিস্ময়ে উঁচু হলো?’
বলল, ‘কোন ডেট? আমি তো জানি না আমার আবার কারো সাথে ডেট ছিলো।’
ম্যাটও এখন ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। ওর মুখশ্রী দেখেই ধারণা করা যায় মাহীনকে নিয়ে ও খুবই বিরক্ত। ওর সোজাসাপটা কথাগুলোও মাহীন বুঝতে পারছে না। তীব্র কন্ঠে বলল, ‘আর ইউ কিডিং উইথ মি! তোমার বিলের সাথে ডেট ছিলনা নয় আগস্ট?’
মাহীন দ্বিতীয় দফা বিস্মিত হলো। এসব কী বলছে এই ছেলে। মাহীন ভাবল, ব্যাপারটা ঠিক কোথা থেকে গোলমাল বেঁধেছে? নয় আগস্ট তো আমি ডেটে গিয়েছিলাম ঠিকই। কিন্তু রায়েদের সাথে। বিল মাঝখান দিয়ে কোথা থেকে আসল?’ মুখে বলল, ‘আজব তো! বিলের সাথে আমার কোনো কালেই ডেটে যাওয়ার কথা ছিলো না! ইভেন বিল তো আমাকে কখনো প্রস্তাবই দেয়নি। তুমি আমাকে এসে শুধাচ্ছ কিসের ভিত্তিতে?’
ম্যাট থতমত খেল। ভোঁতা মুখে চাইল। চোখ সরু করে বলল, হোয়াট! আর ইউ ইনসেন! বিলের চিঠিটা কী হাওয়ায় মিলিয়ে গেল?’
মাহীনের ভ্রু উঁচু হলো। অবাক কন্ঠে বলল, ‘বিলের চিঠি? আমি তো বিলের কেনো চিঠি পাইনি।’
ওরা দুজন গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে সমঝোতা করছে। অনেক ছেলেমেয়েরা হেঁটে যাচ্ছে নিজের মতো হইচই করতে করতে। ‘তাহলে বিলের চিঠিটা গেল কোথায়। আসলেই সিয়া ইচ্ছা করে ঝামেলা করেছে?’ কিছুটা মৃদুস্বরে কথাটা যেন নিজেকেই বললদ ম্যাট। তবে মাহীনও শুনতে পেল। বলল, ‘এসিসিয়া ঝামেলা করেছে মানে? এসিসিয়ার চিঠি দেয়ার কথা ছিলো?’
ম্যাট বলল, ‘হ্যা ওরই চিঠি দেওয়ার কথা ছিলো। এই মেয়েটা যে কী করে না! তুমি চিঠি না পেয়ে থাকলে নিশ্চিয়ই ওই গায়েব করেছে ওটা।’
মাহীন জিজ্ঞেস করল, কিন্তু এসিসিয়া কেন চিঠি গায়েব করবে? এর পেছনে কী স্বার্থ আছে ওর?’
ম্যাট বাঁকা হাসল। বলল, ‘কী স্বার্থ আছে? ওতো সেই কবে থেকে বিলকে পছন্দ করে। কিন্তু মাঝখান দিয়ে বিল তোমাকে পছন্দ করে বলে সেটা ওর সহ্য হচ্ছে না। তাই চিঠি ও তোমাকে দেইনি। সোজা হিসাব।’
মাহীন খুব একটা অবাক হলো না। বিল ওকে পছন্দ করে এটা ও আগেই আঁচ করতে পেরেছিল। এবং এসিসিয়ার ব্যাপারটাও অজানা নয়। বলল, ‘তোমরা যখন জানতে ব্যাপারটা ওকে দিয়ে চিঠি না পাঠালেই পারতে।’
ম্যাট বলল,’সিয়া নিজে ই যেচে পরে দায়িত্বটা নিয়েছিল।’
গেট দিয়ে ডজন ডজন শিক্ষার্থীরা হেঁটে আসছে দ্রুত গতিতে। ক্লাস আরম্ভ হওয়ার সময় এগিয়ে আসছে। হঠাৎ খেয়াল হতেই মাহীন বলল,
‘হেই ক্লাস শুরু হলো বলে। আমি যাই।’
‘ওহ ইয়াহ। বাই দ্যা ওয়ে থ্যাঙ্কস ফর দ্যা ক্লিয়ারিফিকেশন।’ মাহীন জবাবে হালকা হাসল।
.
.
.
১৮৪৮ সালের ২৪ জানুয়ারি শুরু হয় ক্যালিফোর্নিয়ার গোল্ড রাশ। সর্বপ্রথম ক্যালিফোর্নিয়ার কলোমায় সাটার মিলে জেমস ডব্লিউ মার্শাল সোনা খুঁজে পায়। এরপরই পুরো ইউনাইটেড স্টেটস এবং বিদেশ থেকে প্রায় তিন লক্ষ মানুষ ছুটে আসে ক্যালিফোর্নিয়ায়। ওদের ইতিহাস টিচার মি.ডিউইট পড়িয়ে যাচ্ছেন। অনেকে শুনছে অনেকে শুনছে না। মাহীন শুনছে আবার শুনছে না। বেশ কিছু ভাবনা মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। কোনোটার সাথে কোনোটা মিলে যাচ্ছে। কোনোটা মিলছে না। মাঝখান দিয়ে এত গোলমাল পেকে রয়েছে তা কে জানতো। যদিও এসব গোলমালে ওর কিছুই যায় আসে না। তবে অপ্রয়োজনে সবকিছু নিয়ে ভাবাটাই মাহীনের চিরাচরিত স্বভাব। অবশ্য একেবারেই এটা অপ্রয়োজনীয় তাও বলা যায় না। কোনো এক ভাবে ও এটার সাথে জড়িয়ে আছে। সেটা অস্বীকার করা যায় না। মাহীন কক্ষের মাঝের সারির একটি টেবিলে বসে আছে। ওর থেকে কয়েক টেবিল দূরে লিম জু রয়েছে। বাকি বন্ধু বান্ধবরা অন্যান্য কক্ষে অন্যান্য ক্লাসে রয়েছে। মাহীন বামে জানালার দিকে দৃষ্টি ফেরাল। বাইরে শুধু সবুজ দেখা যায়। সবুজ পাতা ছাওয়া গাছ। ঘন্টা পরতেই মি.ডিউইট ক্লাস ত্যাগ করতে উদ্যাত হলেন। এদিকে ছেলেরা মেয়েরা হইচই আরম্ভ করে দিয়েছে। মাঝে মাঝে মাহীন বুঝতে পারে না, ক্লাস চলা কালিন কী এরা শুধু এটাই ভাবতে থাকে যে ক্লাস শেষ হওয়ার পর কিভাবে হইহট্টগোল বাঁধানো যায়। অনেকে এথলেটের মতো ছুট দেয় লকার করিডরের উদ্দেশ্য। এদের লকারে অতি মূল্যবান কিছু থাকে বোধহয়।
লিম জু মাহীন ব্যাগ কাঁধে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। লিম জু ওর সাথে সাথে ক্লাস থেকে বের হলো। জানাল যে পনেরো আগস্ট ওরা লং বিচের ওদিকে যাবে ক্যারোলকে নিয়ে ঘুরতে। মাহীন সম্মতি জানাল। লং বিচ এখান থেকে কিছুটা দূরে। তবে খুব বেশিও না। পথে রাবিতকে দেখে মাহীন থামল। কিছু একটা জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন বোধ করল। ওকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করল,’আচ্ছা তুমি যে কয়েকদিন আগে আমাকে একটা চিঠি ধরিয়ে দিয়ে গিয়েছিলা। ওটা কোথায় পেয়েছিলা তুমি?’
রাবিত থতমত খেলো। হঠাৎ এই প্রশ্ন? দ্বিধানিত্ব হয়ে বলল, ‘ওহ দেখো আমি জানি না ওটা কিসের চিঠি ছিলো। বাট ওটা এসিসিয়া দিয়েছিল আমাকে।’
মাহীন সায় জানিয়ে মাথা নাড়ল। লিম জু প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। মাহীন বললো, ‘পরে বুঝিয়ে বলবো। এখন ক্লান্ত লাগছে এসব নিয়ে ঘাটতে।’ লিম জু আর কথা বারাল না। ওরা সেই করিডরে এসে দাঁড়াল যেখানে সারি সারি চকচকে রুপালী লকার রয়েছে। মাহীন ব্যাগ থেকে বইগুলো বের করে লকারে রাখল। এবং পরের ক্লাসের জন্য নির্দিষ্ট বই ব্যাগে ভরে নিচ্ছে। তখনই দেখলো ওর থেকে প্রায় বিশটি লকার পরে বিল দাঁড়িয়ে আছে। মাহীন তড়িঘড়ি করে নিজের লকার বন্ধ করল এবং সেদিকে এগিয়ে গেল। বিল নিজের লকারটা বন্ধই করছিল। তারপর পেছনে ঘুরে চলে যেতে উদ্যাত হলো। তখনই মাহীন ওর সামনে এসে দাঁড়াল। কয়েকটা লম্বা শ্বাস নিল। হঠাৎ মাহীনকে নিজের সামনে দেখে অবাক হলো বিল। তারপর প্রায় ওকে না দেখার ভান করে চলেই যাচ্ছিল। মাহীন ওর সাথে আসতে আসতে বলল, ‘ওয়েল দেখো আই নো তুমি আমার ওপর রাগ করে আছো কিন্তু..বিল মাঝখান দিয়ে বলল, কী কিন্তু? এখন আর তোমার কী বলার আছে?’ ভির এড়িয়ে মাহীন দ্রুত গতিতে তাল রাখার চেষ্টা করছে। উৎকন্ঠিত গলায় বলল, হ্যা অনেক কিছু বলার আছে। আমি তো চিঠি…বিল আবার মাঝখান দিয়ে ওকে থামিয়ে দিল।

তীব্র কন্ঠে বলল, ‘তুমি ডেটে না আসতে চাইলে আমাকে জানিয়ে দিতে পারতে। জানো আমি প্যাসিফিক পার্কে দেড় ঘন্টা অপেক্ষা করেছি তোমার জন্য। ইভেন আমার কাছে তোমার নম্বরও নেই। আর…এবার মাহীন কিছুটা উচ্চস্বরেই বলে উঠল, জাস্ট সাট আপ! আমার কথা শোনো আগে!’ বলেই থেমে গেল। আশেপাশে উপস্থিত সকলেই প্রায় ওদের দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মাহীন বলল, ‘দয়া করে এখান থেকে চলো। আমার যা বলার আমি বলে চলে যাবো। আর বিরক্ত করবো না তোমাকে।’ বিল দীর্ঘশ্বাস ফেললো। কিন্তু কিছুই বললো না। ওরা করিডোরটা পার করে গেল। তারপর আরো কিছু করিডোর পার করে বিল্ডিংয়ের বাম দিকের গেট দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসল। এবার বিল ভারি কন্ঠে বলল, বলো তোমার কী বলার আছে।’
মাহীন লম্বা একটা শ্বাস নিলো। তারপর শান্ত কন্ঠে বলল, ‘দেখো আমি আসতাম কী আসতাম না সেটা পরের কথা। প্রথম কথা হলো আমি জানতামই না তুমি কখনো আমাকে ডেটের প্রস্তাব দিয়েছো। কারণ আমি কখনোই তোমার কাছ থেকে কোনো চিঠি পাইনি।’
বিল বিস্ফারিত নয়নে চাইল। কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকার পর বলল, ‘ইউ মিন তুমি আমার চিঠি পাওইনি? হাউ ইজ ইট পসিবল!’
মাহীন বলল, আমি জানি না এটা কিভাবে পসিবল। বাট আজকে ম্যাটের সঙ্গে কথা হলো। সে আমাকে বলল যে তুমি নাকি আমাকে চিঠি দিয়েছিলা। বাট আমি তো জানি যে আমি কোনো চিঠি পাইনি। তাহলে এখানে আমার দোষ কোথায়?’
বিল নিজের মনে বোধহয় কোনো একটা হিসেব মেলাতে ব্যস্ত। ওর চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল ক্রমেই। এরপর কিছুটা ঝাঁঝ ভরা কন্ঠে বলল, হোয়াই এসিসিয়া জুহোড!’ মাহীন চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। কিছুক্ষণ পর বলল, দেখো শান্ত হও। এসিসিয়া তোমার খুব ক্লোজ ফ্রেন্ড। সো তোমরা ব্যাপারটাকে কিভাবে সামলাবা সেটা আমার দেখার বিষয় নয়। তবে…বলে থামল। বিল প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মাহীন ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করল। বিলও ওর পাশে পাশে হাঁটতে লাগল। মাহীন খালি রাস্তার দিকে তাকিয়ে বলল, প্রতিটা মানুষের জীবনেই আপস এন্ড ডাউনস আসে। অনেক সময় তার ফলে তারা আপনজনদের সাথে রুড বিহেইভও করে ফেলে। এমন সময় সেটাকে গায়ে না মেখে তাদের মনের অবস্থা বুঝতে হয়। যতই কাছের হওনা কেন তুমি হয়তোবা তবুও তারা তোমার সাথে সেই ব্যাপারগুলো শেয়ার করতে আনইজি ফিল করতেই পারে। তাই আমার এমন মানুষ একদম পছন্দ নয় যারা অপর মানুষটার মনের অবস্থা না বুঝেই ইগোকে সামনে রেখে দেয়। এতে অনেক সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়।’ বলে থামল। বিল কী বুঝলো কে জানে কিছুই বললো না। মাহীন নিজের হাত ঘড়ির দিকে চাইল। পরের ক্লাস শুরু হয়ে গিয়েছে। তারপর বিলের দিকে তাকাল। বলল, ‘ওহ ইয়েস ওয়ান মোর থিং। আই এম সিইং রায়েদ। এন্ড উই বোথ লাইক ইচ আদার।’ বিল কিছুটা অবাক হয়ে তাকাল। ব্যাথাতুর দৃষ্টি। পানসে কন্ঠে বলল,’ওয়েল কনগ্র্যাচুলেশন!’
.
.
.
লাঞ্চের ঘন্টা পরেছে কিছুক্ষণ হলো। ক্রমেই ক্যাফেটেরিয়া ভরে উঠল ছাত্রছাত্রীতে। গল্প গুজব করতে ব্যস্ত সকলে। অনেকে চেয়ার ছেড়ে টেবিলের ওপর বসে আছে। রায়েদ একটা স্যান্ডউইচ কিনে সেখান থেকে বেরিয়ে আসল। আশেপাশে কোথাও মাহীনের দেখা মিললো না। আজকাল মেয়েটাকে খুঁজেই পাওয়া যায় না। ওর ফ্রেন্ডদের জিজ্ঞেস করলে ওরাও কিছু বলতে পারলো না। আবারও স্কুল বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে লাইব্রেরিতে চলে আসল রায়েদ। পূর্বের মতো এখনো লাইব্রেরিতে একা একা না বসে থাকলেও পারে। তবে এত বছরে অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। না গেলেই বরং খালি খালি লাগে। তিনতলার লাইব্রেরিতে ঢুকে নিজের সেই কোণার টেবিলের কাছে পৌছুতেই দেখলো টেবিলে মাথা রেখে বসে আছে মাহীন। রায়েদ সন্তপর্ণে এগিয়ে যেতে যেতে ভাবল, ‘বাহ ম্যাডাম দেখি নিজে থেকেই আজ এখানে এসে হাজির। নিশ্চয়ই বলার মতো কোনো কথা জমা হয়েছে।’ মাহীনের মাথার কাছে একটা মাফিন রাখা আছে। বোঝা গেল না ও ঘুমিয়ে পরেছে নাকি এমনিই হেড ডাউন করে আছে। খোলা জানালা পার করে ফুরফুরে মিষ্টি বাতাস ভেতরে আসছে। ঘুমিয়ে আছে কিনা বোঝা না গেলেও মাহীনকে এভাবে খুব নিষ্পাপ দেখাচ্ছে। হালকা বাতাসে রেশমি চুলগুলো মাঝে মাঝে উড়ে এসে মুখের ওপর পরছে। তখন ওকে আরোও স্নিগ্ধ লাগে। রায়েদ মুগ্ধ হয়ে কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থাকার পর নিঃশব্দে ওর পাশের চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসল। খুব সাবধানে মাহীনের মুখের ওপর থেকে চুলগুলে সরিয়ে দিতেই মাহীন কিছুটা চমকে উঠে চোখ মেলে তাকাল। ঘুমের কোনো রেশ নেই চোখে। সতেজ মুখভাব। শুধু একটু চমকে উঠেছে এই যা। রায়েদ বলল, ‘তুমি ঘুমিয়ে ছিলা না?’
মাহীন উঠে দাঁড়িয়ে আবার সোজা হয়ে ভালো ভাবে বসল। কোমড় বাঁকিয়ে হেড ডাইন করে থাকার কারণে মেরুদণ্ড সোজা করতে কষ্ট হচ্ছে। বলল, নাতো। ঘুমাবো কেন?’

‘নাহ এমনি তোমাকে দেখে মনে হয়নি তুমি জেগে আছ।’ মাহীন নিজের মাফিনের প্যাকেটটা খুলতে খুলতে বলল,’ওহ আচ্ছা। তোমার অপেক্ষা করছিলাম। বাই দ্যা আমার এত সহজে ঘুম আসে না।’
‘তোমার যত এনার্জি। ঘুম আসবে কী করে।’

মাহীন মুচকি হাসল। মাফিনে এক কামড় বসিয়ে কিছুক্ষণ পর জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা তুমি এখন কী পড়ছো?’

‘ফিজিক্স।’

‘আরেহ না। উপন্যাসের কথা বলছি।’

‘ওহ আচ্ছা। লাভ হাইপোথেসিস। পড়েছো তুমি?’

‘না। তবে টিবিআর লিস্টে আছে।’

‘আর তুমি কী পড়ছো?’

‘পথের পাচালি।’

রায়েদ ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘কী?’

মাহীন হাসল। বলল, ‘একটা বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী ক্লাসিক্যাল বই। তবে তুমি নামটা উচ্চারণ করতে পারবা না।’

‘তাই? আবার বলো দেখি। উচ্চারণ করি।’

‘নাহ থাক বইটার অপমান হয়ে যাবে।’
‘নাহ বলো না।’

‘প..থের পাচা..লি।’
‘পথের পাচা.লি।’
মাহীন অবাক হলো। এবং সহাস্যে বলল, ‘ওহ ওয়াও! তুমি পারলে!’

‘কেন পারবো না। বাই দ্যা ওয়ে এটার অনুবাদ আছে।’
মাহীন দ্বিধান্বিত হলো। বলল, ‘উম থাকতে পারে। আমি খুঁজে দেখবো। পেলে তোমাকে দিব।’ রায়েদ সায় জানিয়ে মাথা নাড়ল। মাহীন ওর মাফিন খাওয়া শেষ করে বলল, ‘আচ্ছা শোনো।’
রায়েদ বলল, ‘হুম বল।’
‘ওই যে সেদিন আমি এবং তুমি যে চিঠি পেয়েছিলাম।’ বলে একটু থামল। রায়েদ আগ্রহ ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মাহীন বলল, ‘সেটা সিয়া লিখেছিলো।’
রায়েদ কপাল কুঁচকে বলল, ‘ইউ মিন এসিসিয়া?’

‘হ্যা।’

‘কিন্তু কেন এতে ওর কী লাভ?’ আরেকটু বেশিই অবাক হয়ে বলল।

‘ওয়েল দেখো প্রথমত এসব শুরু হয়েছে বিল থেকে।’

‘মানে বিল মুরেই? ঠিকঠাক খুলে বলো। বিল এবং সিয়া এসবের সাথে কিভাবে জড়িয়ে আছে?’

‘একচুয়েলি আসল চিঠিটা লিখেছিল বিল।’

‘কাকে দেওয়ার জন্য? তোমাকে?’

‘হ্যা। তো সেটা সিয়ার দেয়ার কথা ছিলো। এখন সিয়া সেটাতো জীবনে আমাকে দেইনি। তারওপর আমার তরফ থেকে তোমাকে চিঠি দিয়েছে এবং তোমার তরফ থেকে আমাকে চিঠি দিয়েছে।’

‘ওফ বুঝেছি। এসব জট ঝামেলা পাকানোর কোনো মানে হয়? আর তোমার কী বিলের সাথে কথা হয়েছে?’

‘উম হ্যা। অবশ্য মূল ঘটনাটা ওর বন্ধু ম্যাটের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি।’
দুনিয়ার প্যাচানো ঘটনাগুলো দীর্ঘশ্বাস হয়ে বেরিয়ে এলো রায়েদের বুক চিরে। তারপর হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা বিলের চিঠিটা তোমার হাতে সত্যিই পৌঁছলে তুমি কী করতে?’

‘কী করতাম মানে?’

‘ওর সাথে যেতা ডেটে?’
মাহীন হালকা হাসল। আমোদিত কন্ঠে বলল, ‘আমার ফ্রেন্ডদের সাথে আলোচনা করলে ওরা আমাকে ঠিকই পাঠাতো। তবে আমি মনে হয় না যেতে আগ্রহী হতাম।’

‘ওহ তাই নাকি। তো আমার ক্ষেত্রে কী হয়েছিল?’
মাহীন হেসে বলল, ‘ওরা তো এখনোও জানেই না।’

‘মাহীন!’

‘আহা তুমি তোমার ফ্রেন্ডদের বলসো?’

‘কোন ফ্রেন্ডকে বলবো? আমার ফ্রেন্ড কোথায়?’

‘আরেহ বানিয়েছো না ফ্রেন্ড।’

‘নায়েল। ওতো তোমারও ফ্রেন্ড।’

‘হুম তা ঠিক।’ হেসে বলল। রায়েদও হাসল।

ইনশাআল্লাহ চলবে।