এল এ ডেইস পর্ব-৩৪+৩৫

0
268

#এল এ ডেইস
পর্ব ৩৪
লেখনী মাহীরা ফারহীন

টিংটং…টিংটং শব্দে কলিংবেল বাজচ্ছে। এই নিয়ে দ্বিতীয় বার কলিংবেল বাজল। তারও কিছুক্ষণ পর দরজাটা ধীরে ধীরে খুলে গেল। দরজার ওপাশে একজন শ্বেতাঙ্গ, সোনালি কেশ ধারী রুপসি মহিলা দাঁড়িয়ে। স্বচ্ছ নীল চোখের মণি। বয়স ত্রিশের কোঠায়। কিছুটা ফ্যাকাসে ভাব চেহারায়। উনি হালকা হাসলেন। বললেন,
‘ন্যইম, ম্যহীন? তোমরা আমার বাসায়?’ বলতে বলতে একপাশে সরে দাঁড়ালেন। এবং ওদের ভেতরে ঢোকার পথ করে দিলেন। নাইম আন্তরিক হেসে বললো,
‘হ্যা আসলে আপনি যদি কিছু মনে না করেন আমরা আপনার সঙ্গে কিছু কথা বলতে চাই।’
উনি বললেন,’অবশ্যই। ভেতরে আসো।’ এবার মাহীন ও নাইম ভেতরে প্রবেশ করল। প্রথমেই মাহীনের নাকে এসে ঢাক্কা দিলো গোলাপের কড়া সুবাস। প্রথমেই লম্বা করিডর। তারপর সামনে এগিয়ে দেখলো ডানে ড্রইংরুম। এবং বামে ডাইনিং রুম এবং রান্নাঘর। ওনার ঘর সুসজ্জিত এবং গুছানো হওয়া সত্ত্বেও কেমন জানি অগোছালো লাগল। বাইজেনটাইন রঙের সোফার পাশে একটা বড় কাঁচের সো-কেস। তার মধ্যে অন্যান্য সো-পিসের সঙ্গে ‘লুই রোডেরার’ এবং ‘ডম প্যারিনন’ এর মতো ব্র্যান্ডের ওয়াইনের বোতল রাখা। মাহীন ও নাইম সোফায় বসল। এবং উনি হেঁটে এসে সামনের সোফায় বসলেন। তারপর বললেন, ‘ওহ হ্যা তোমরা আমার নাম জানো তো? সেলি বিঙ্গ।’
ওরা দুজন সায় জানিয়ে মাথা নাড়ল। নাইম জিজ্ঞেস করল,’ফ্র্যাঙ্ক কোথায়?’

সেলি বললেন,’ও ঘুমিয়ে আছে।’

মাহীন বলল,’আপনি তো সাইকিয়াট্রিস্ট?’
উনি সায় জানিয়ে মাথা নাড়লেন। এবার মাহীন একটু নড়েচড়ে বসল। এবং বলল,
‘আসলে আমাদের কথাও সেই বিষয় নিয়েই। আমার একজন বন্ধুর মায়ের সমস্যা নিয়ে আমি কথা বলতে চাই। যার কারণে সত্যিই আমার বন্ধুর জীবন দুঃস্বপ্নের মতো হয়ে গিয়েছে।’

সেলি আগ্রহী কন্ঠে বললেন,’ঠিক কী হয়েছে আমাকে খুলে বলো।’
এবার মাহীন লম্বা এক নিঃশ্বাস গ্রহণ করে আবার ছাড়ল। তারপর ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ ঘটনাটাই খুলে বললো। সব শোনার পর সেলির কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠলো। উনি বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে ভাবলেন। তারপর শান্ত কন্ঠে বললেন,’দেখো তোমার কথা শুনে তো মনে হচ্ছে তোমার ফ্রেন্ডের মা সেই সময় একটা ডিপ ট্রোওমার মধ্যে চলে গিয়েছিলেন। এখন একধরনের ট্রোওমা আছে যা সাময়িক সময়ের জন্য হয় এবং ধীরে ধীরে সময়ের সাথে সাথে আপনজনদের সহযোগীতায়ই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। তবে শক যদি অনেক বড় ধরনের হয় তখন মানুষ কিন্তু সেরকম ট্রোওমার মধ্যেও চলে যেতে পারে যা মস্তিষ্কের ক্ষতি করে। এই যেমন মিসেস রাহম্যনের ট্রোওমা খুব সম্ভবত তার মস্তিষ্কের ‘আ্যমিগডেলায়’ প্রভাব ফেলেছে। ‘আ্যমিগডালা’ হলো মস্তিষ্কের সেউ অংশ যেটা অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করে। এবং সঠিক সময় তার চিকিৎসা না হওয়ায় তার মন মস্তিষ্ক তো সময়ের সাথে সাথে এগিয়ে এসেছে ঠিকই কিন্তু তার ‘আ্যমিগডালার’ কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে।’ বলে সেলি থামলেন।
মাহীন ও নাইম আগ্রহ ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মাহীন ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছে। উনি বলে গেলেন,’এখন এভাবে চিন্তা করো যে, এটা বোঝা যাচ্ছে যে উনি ওনার স্বামীকে খুব ভালোবাসতেন। এবং যখন তার মৃত্যু সংবাদ শুনেছেন তার পক্ষে তখন কোনো কিছু লজিক্যালি ভাবা বা দেখা সম্ভব ছিলো না। হয়তো শুধু দুঃখ এবং কষ্টই নয় বরং তার মধ্যে এমন একটা অনুভূতি কাজ করছিল যে তার ছেলেকে বাইরে নিয়ে যেতে গিয়ে তার স্বামী মারা গিয়েছে। সুতরাং এটা তার ছেলের দোষ। ঠিক আছে হঠাৎ করে এমন কথাও যদি মাথায় আসে তা অস্বাভাবিক নয়। তবে অস্বাভাবিক হচ্ছে সেটাই বিশ্বাস করে আঁকড়ে ধরে থাকা। স্বাভাবিক ভাবে এক মুহূর্তের জন্য কষ্টে রাগে এটা মনে হতেই পারে তবে ঠান্ডা মাথায় লজিক্যালি চিন্তা করলে তার আর এরকম মনে হতো না। কিন্তু সমস্যাটা এখানেই হয়েছে। তিনি আর ঠান্ডা মাথায় সেইসব বিষয় চিন্তা করার অবস্থাই পৌঁছতে পারেননি। তিনি ট্রোওমার মধ্যে চলে গিয়েছিলেন। এবং এসব তার ছেলের কারণে হয়েছে এই বিশ্বাসটাও তিনি তখনো কাটাতে পারেননি।
এবং তার ফলেই তার আ্যমিগডালা যেটা তার অনুভুতি নিয়ন্ত্রণ করে তা তার ছেলের জন্য একটা অপছন্দ এবং হেট্রেডের অনুভূতি তৈরি করেছে। যেটা কখনোই চিকিৎসা না হওয়ার কারণে এখনো বহাল আছে।’ বলে শেষ করলেন এবং একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মাহীন ও নাইম দুইজনের মুখেই বিস্ময়। মাহীন গাঢ় কন্ঠে বলল,’কিন্তু এখন তাকে সুস্থ করে তোলা যায় কিভাবে?’

সেলি বললেন,’দেখো এমন ধরনের ট্রোওমায় সুস্থ হতে বেশি সময় লাগে না। হয়তো মাস খানেক লাগবে। মাসখানেক টানা কাউন্সিলিং করাতে হবে। মেডিটেশন করতে হবে। এবং তাকে কিছু ঔষধ দিতে হবে। তবে আমি এভাবেই কোনো ঔষধের কথা বলতে পারবো না। এটা বেআইনি হয়ে যাবে। তাকে সঠিক ভাবে চিকিৎসা করাতে হলে অফিসিয়ালি ট্রিটমেন্টের জন্য আমার কাছে আসতে হবে।’

মাহীন দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারপর বলল,’দেখেন ওনাকে এমনিই যদি সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাতে চাওয়া হয় সেটা তো উনি মানবেন না। কারণ উনি তো নিজেকে সুস্থই ভাবেন। এখন প্রথমে ওনার সঙ্গে পার্সোনালি ইন্টার‌্যক্ট করতে হবে।’ বলে থামল। তারপর ইতস্তত করে বলল,’আপনি কী আমাদের সাহায্য করতে পারবেন এই বিষয়?’

উনি কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকলেন। তারপর বললেন,
‘দেখো আমি একজন সাইকিয়াট্রিস্ট। এটাই আমার কাজ। এবং আমরা মানুষের মন মস্তিষ্ক নিয়েই কাজ করি। অর্থাৎ যেভাবেই হোক আমরা প্রতিটা রোগীর সঙ্গে ব্যক্তিগত ভাবেই জুড়ে যাই। এখন আমি তোমাদের অবশ্যই সাহায্য করব। যেহেতু এতদিন আমার ছেলেটাকে যদি তোমরা নিজেদের কাছে যখন তখন না রাখতে সত্যিই আমি বিপদে পরতাম। ওর খেয়াল রেখেছ, ওকে সময় দিয়েছো তার জন্য কৃতজ্ঞতা স্বরুপ এখনো আমি কিছুই করতে পারিনি। সুতরাং কৃতজ্ঞতা থেকেই ধরে নাও সাহায্য করব।’
ওদের দুজনের ঠোঁটের কোণেই হাসি ফুটে উঠল। নাইম বলল, ‘প্রথমেই যেহেতু ওনাকে আপনার কাছে অফিশিয়ালি আনা সম্ভব নয়। তাহলে আপনি কী করবেন?’

সেলি কিছু একটা ভাবলেন। তারপর বললেন,
‘প্রথমে তো ওনার সাথে আমার কথা বলতে হবে এবং বুঝতে হবে ওনার মানসিক অবস্থাটা এখন আসলে কোন পর্যায়ে আছে। এবং প্রথমে আমি শুধু কথা বলেই ওনার কাউন্সিলিং করবো। তবে তার জন্য আমার তার সাথে দেখা করতে হবে। এখন ওনার সাথে আমার দেখা করার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব তোমাদের। এবং হ্যা সকাল থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত আমি হাসপাতালে থাকি। এরপর বাসায় চলে আসি। সুতরাং যখনই দেখা করার ব্যবস্থা করো না কেন সেটা যেন দুপুরের পর হয়।’
মাহীনের মুখে ঈষৎ হাসি। ও প্রসন্ন কন্ঠে বলল,
‘সেটা নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না। আমরা সব সামলে নেব।’ বলে উঠে দাঁড়াল। নাইমও উঠে দাঁড়াল। সেলি উঠে দাঁড়িয়ে বলল,’আমার নম্বরটা নিয়ে যাও। প্রয়োজনে ফোন দিও।’
ওরা সায় জানিয়ে মাথা নাড়ল।
.
.
.
.
একবার কলিং বেল বাজতেই কিছুক্ষণ পর দরজাটা খুলে গেল। দরজার ওপাশে রাবিত দাঁড়িয়ে। দরজার এপাশে মাহীনকে দেখে সরে দাঁড়াল। মাহীন তাড়াতাড়ি ভেতরে প্রবেশ করল। তারপর বলল,
‘মিসেস রহমান বাসায় নেই তো?’
রাবিত না সূচক মাথা নাড়ল এবং দরজাটা বন্ধ করে দিলো। তারপর বলল,’এ্যই তুমি আসলে আমাকে কী বলতে চাচ্ছিলা? তাড়াতাড়ি বলো।’

মাহীন বলল,’নাহ শুধু তোমাকে নয়। মিসেস মাদিহ কে ডাকো। সাথে ওনাকেও বলবো।’

রাবিত চিন্তিত স্বরে বলল,’আল্লাহই জানে তোমার মাথায় আবার কী চলছে।’ বলে একটু থামল তারপর আবার বলল,’আচ্ছা শোনো আমরা পেছনের বাগানের যে চেয়ার টেবিল আছে ওখানে বসি।’ মাহীন সায় জানিয়ে মাথা নাড়ল। তারপর রাবিত ভেতরের একটা কামরায় চলে গেল। কিছুক্ষণ পর মিসেস মাদিহ কে নিয়ে বেরিয়ে আসল ও। উনি মাহীনকে দেখেই প্রসন্ন হাসলেন। তারপর বললেন,
‘বাহ আজ একদম সঠিক সময় এসেছো। রায়েদ রাবিত দুইজনই বাসায় আছে।’

মাহীন কিছুটা অবাক হয়ে বলল,’ওহ আচ্ছা রায়েদও বাসায় আছে।’

মিসেস মাদিহ বললেন, ‘হ্যা তবে দিলারা বাসায় নেই।’
মাহীন মিসেস মাদির এক কাঁধ জড়িয়ে ধরে বলল,
‘আমার কথা তো আপনার সঙ্গে এবং রাবিতের সঙ্গে। চলেন আমি বলি যেটা বলতে আসছি।’

রাবিত বলল,’হ্যা চলো বাগানে। বলতে বলতে সিঁড়ির পেছনের দরজাটা খুললো। এটা বাগানে যাওয়ার দরজা। ওরা সেখান দিয়ে বের হলো। মাহীন মুগ্ধ হয়ে দেখল, খুব সুন্দর করে বাগান করা হয়েছে। বেশির ভাগ সব ফুলের গাছ। ওদের বাড়ির বাগানের মতো এখানেও একপাশে একটা তাল গাছ রয়েছে। সবুজ ঘাসে ঢাকা মাটি। দেয়াল থেকে বেশ কয়েকটা পেতুনিয়া ফুলের ঝাড় ঝুলে রয়েছে। এক কোণায় সাদা একটা টেবিল। এবং টেবিলের তিনদিকে তিনটা চেয়ার। মিসেস মাদিহ প্রথমে একটা চেয়ারে বসার পর মাহীন ও রাবিতও অপর দুইটায় বসল। রাবিত অধৈর্য কন্ঠে বলল,
‘এবার বলো তো তুমি কী বলার জন্য এত আয়োজন করলা।’
মাহীন একবার রাবিতের দিকে চাইল তো একবার মিসেস মাদির দিকে চাইল। তারপর ইতস্তত করে বলল,
”আমি একজন সাইকিয়াট্রিস্টের সঙ্গে কথা বলেছি।’ এক টানে বলে গেল। রাবিত জিজ্ঞেস করল,’সাইকিয়াট্রিস্ট? কার জন্য?’

মাহীন বলল,’মিসেস রহমানের জন্য।’
মিসেস মাদিহ ভ্রু কুঁচকে বললেন,” দিলারার কী হয়েছে? ওকে সাইকিয়াট্রিস্ট কেন দেখাবা?’

মাহীন মিসেস মাদির দিকে তাকিয়ে বলল,
‘আপনি তো জানেনই চার বছর আগে কী হয়েছে। মিসেস রহমান রায়েদের সাথে যেই আচরণ করেন সেটা কী স্বাভাবিক? অবশ্যই না। এবং এভাবেই তো রায়েদ ওর সম্পূর্ণ জীবন কাটাতে পারে না।’

রাবিত বলল,’সেটা ঠিক। মায়ের সমস্যা তো আছে। কিন্তু সবচাইতে বড় সমস্যা তো এটাই যে তাকে সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানোর জন্য রাজি করাবো কিভাবে? তিনি তো আর ছোট বাচ্চা নন।’

মাহীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,’সেটা পরের কথা। এখন শোনো আগে আমি যেই সাইকিয়াট্রিস্টের সঙ্গে কথা বলেছি সে আমাদেরই প্রতিবেশী। এবং সে প্রথমে মিসেস মাদির সঙ্গে ব্যক্তিগত ভাবে ইন্টার‌্যক্ট করতে রাজি হয়েছে।’

মিসেস মাদিহ বললেন,’কিন্তু মা, সে না হয় রাজি হয়েছে। কিন্তু দিলারাকে ব্যক্তিগত ভাবে হলেও যদি একজন সাইকিয়াট্রিস্টের সঙ্গে দেখা করতে বলা হয় ওতো রাজি হবে না।’

রাবিত বলল,’সেটাই। এখন কী করবা?’

মাহীন বলল,’দেখো আমরা মিসেস রহমানকে প্রথমে বলবোই না যে উনি একজন সাইকিয়াট্রিস্টের সঙ্গে দেখা করছেন। দুজনকে এমন ভাবে দেখা করাবো যেন হঠাৎ করেই এমনিই দুইজনের দেখা হয়ে গিয়েছে। এখন বাকি কথা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা মিসেস বিঙ্গ সামলে নেবেন।’

মিসেস মাদিহ বললেন,’তারপর? তারপর কী করবেন উনি?’

মাহীন বলল,’প্রথমে উনি মিসেস রহমানের সঙ্গে কথা বলে উনার বর্তমান মানসিক অবস্থাটা বিবেচনা করবেন। এবং নিজে থেকেই ওনাকে মোটিভেট করবেন তার কাছে অফিশিয়ালি যাওয়ার জন্য। এবং এদিকে আপনাকে এবং রাবিতকে চেষ্টা করতে হবে তাকে বোঝানোর।’

রাবিত বলল,’হ্যা ঠিক আছে। বোঝানোর কাজটা তখন দেখা যাবে। কিন্তু প্রথম দেখাটা কিভাবে করাবা?’
মাহীন কিছুক্ষণ নিশ্চুপ রইল। তারপর চিন্তিত কন্ঠে বলল,’লাইক মনে করো মিসেস রহমান যদি রেগুলার কোথাও যেয়ে থাকেন তেমন কোনো জায়গায় মিসেস বিঙ্গ যেতে পারেন। এবং একজন অপরিচিতের মতো দেখা করতে পারেন। এমন কোনো জায়গা কী আছে?’
রাবিত একটু ভাবল। তারপর বলল,’কোই না তো। মা তো সকালে কাজে চলে যান। দুপুরে বাসায় থাকেন আবার বিকেলের পর কাজে যান।’
মিসেস মাদিহ বললেন,’রাবিত তোর মা কোথায় যায় না যায় সেটাও ঠিক ঠাক বলতে পারিস না। বিকেলে সাড়ে ছয়টায় বাইরে বের হয় দিলারা। এর পূর্বে প্রায় সময় পাঁচটার দিকে হাঁটতে বের হয়। এবং কাছাকাছিই যেই পার্কটা আছে ওখানে প্রায় সময় যায়।’
মাহীন উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলল, ‘গ্রেট তাহলে তো হয়েই গেল। মিসেস বিঙ্গ ও এমনি পার্কে হাঁটতে এসেছেন সেরকম ভান করে মিসেস রহমানের সঙ্গে দেখা করতে পারেন। এবং এখানে প্রায়ই আমরা ওনাদের দেখা করাতে পারি। এরপর তো যেভাবেই হোক ওনাকে রাজি করিয়ে অফিশিয়ালি মিসেস বিঙ্গের কাছে পাঠাতে হবে।’
মিসেস মাদিহ আশাবাদী কন্ঠে বললেন,’এরপর কী দিলারা রায়েদের সঙ্গে যেরকম আচরণ করে সেসব আসলেই বদলে যাবে?’
মাহীন মিসেস মাদির হাত চেপে ধরে আত্নবিশ্বাসের সঙ্গে বলল, ‘ইনশাআল্লাহ হবে। কিন্তু আপনাদেরও চেষ্টা করতে হবে। বাসায় মিসেস রহমানকে মেডিটেশন করতে হবে। এবং আপনাকে ও রাবিতকে মিসেস বিঙ্গের পরামর্শ অনুযায়ী প্রতিমুহূর্তে মিসেস রহমান কে কাউন্সিল করতে হবে।’
রাবিত বলল,’যদি এভাবে মা সত্যিই ঠিক হয়ে যায় তাহলে অবশ্যই আমি আমার সেরাটা দিয়ে চেষ্টা করব।’
.
.
.
.
নিজের কামরায় টেবিলে বসে পড়ছিলো রায়েদ। জানালার পাশেই টেবিল। বাতাসে পর্দা উড়ছে। শান্তশিষ্ট পরিবেশ ছিলো। তবে বেশ কিছুক্ষণ ধরে কোথা থেকে যেন বেশ কথা বলার শব্দ শোনা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন জানালার বাইরে থেকেই শব্দটা ভেসে আসছে। বেশ কয়েকটা চেনাপরিচিত কন্ঠস্বর। অবশেষে রায়েদ উঠে দাঁড়াল। এবং জানালার উইন্ডোশীলে বসে নিচের দিকে চোখ রাখল। এবং দেখতে পেল ওদের বাগানের সাদা টেবিলে মাহীন, রাবিত ও দাদি বসে আছে। বিস্মিত দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে রইল। হঠাৎ মাহীনকে এখানে দেখতে পেয়ে যাবে ভাবেনি। তারপর ভাবতে লাগল, এসব কী? মাহীন এখানে কখন আসলো? এবং এই তিনজন বাইরে বসে কী এমন আলোচনা করছে? দেখে তো মনে হচ্ছে অনেক সিরিয়াস আলোচনা। কিন্তু মাহীনের হঠাৎ রাবিত এবং দাদির সঙ্গে কী কথা থাকতে পারে? ওফ এখন মাহীন তো সব কিছু জানেও। আল্লাহই জানে কী গোলমাল পাকায় আবার।’ ভাবতে ভাবতে মাহীনের দিকে তাকিয়ে রইল।

ইনশাআল্লাহ চলবে।

#এল_এ_ডেইস
পর্ব ৩৫
মাহীরা ফারহীন

অস্থির মনে অনবরত পায়চারী করে যাচ্ছে মাহীন। বারংবার বিছানায় পরে থাকা সেলফোনটার দিকে চোখ চলে যাচ্ছে। টঙ্কস অলস ভঙ্গিতে বিছানায় বসে গা চাটতে ব্যস্ত। খোলা জানালা দিয়ে পর্দা ভেদ করে এক ফালি রোদ এসে পরেছে মেঝেতে। সেই রোদের পরশ বিছানা পর্যন্ত পৌঁছেছে। হঠাৎ করে টেইলর সুইফটের ‘বিগিন এগেইন’ গানটা বেজে উঠতেই টঙ্কস চমকে উঠল। মাহীনও ততক্ষণাৎ ছুটে গিয়ে সেলফোনটা হাতে তুলে নিল। কিন্তু ক্রিনে ডিস্টার্বার লেখাটা দেখে বিরক্ত হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আবারও সেলফোনটা বিছানায় অযত্নের সঙ্গে ফেলে দিলো।
‘মিউ।’ করে উঠল টঙ্কস।
মাহীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, ‘আহা নারে যার ফোনের অপেক্ষা করছি তার ফোন না এটা।’ টঙ্কস লেজ নেড়ে আবার গা চাটতে লাগল। ফোনটা বাজতে বাজতে কেটে গেল। মাহীন জানালার সামনে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। বেশ বাতাস হচ্ছে। পর্দা উড়ে আসছে ভেতরের দিকে। কিছুক্ষণ পর আবারও একই গান বেজে উঠতে মাহীন আবারও ছুটে গেল ফোনের কাছে। এবার সাইলোহ ফোন দিচ্ছে। হতাশ হলেও ফোনটা রিসিভ করল। বলল,’হ্যালো, সাইলোহ?’

ওপাশ থেকে বলল,’হ্যালো মাহীন। শোনো পরশু দিন আমরা সবাই ক্যারোটের বাসায় যাবো। তুমি আসতে পারবা তো?’
এক মুহূর্তের জন্য ভাবল, আজ জরুরি কাজ আছে, কাল রায়েদের সঙ্গে বাইরে যাবো। তাহলে তো পরশু দিন ফ্রি থাকবো।’ ভেবে বলল, ‘হ্যা ঠিক আছে। আমি যেতে পারবো। কিন্তু তোমরা করবাটা কী?’
ওপাশ থেকে সাইলোর লম্বা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শোনা গেল শুধু। তারপর বলল, ‘আপনি তো র‌্যবিট আর ক্যারোটের সেটআপের দায়িত্ব আমাদের ঘারে চাপিয়ে দিয়ে গায়েবই হয়ে গিয়েছেন। তাই আমরাই সব কিছু সামলাচ্ছি। অনেক কষ্টে ক্যারোটকে রাজি করিয়েছি।’
মাহীন জিজ্ঞেস করল,’কী বলে?’

‘আরেহ আমরা ওকে বলেছি ব্লাইন্ড ডেটে পাঠাচ্ছি ওকে। প্রথমে রাজি না হলেও অনেক কসরত করতে হয়েছে। তবে র‌্যবিটের সঙ্গে যোগাযাগ করে ফেলেছি। ও সবকিছুই জানে। পরশুদিন সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার সময় ওদের পাঠাবো ডেটে।’

মাহীন ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় কেন?’
ওপাশ থেকে খটখট শব্দ হলো। তারপর গেল,
‘বলে করেছি…যাই হোক।’

মাহীন ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘এ্যই লাইনে সমস্যা হচ্ছে। আমি শুনতে পাইনি আবার বলো।’

ওপাশ থেকে এবার বলল,’মানে ক্যারোট অন্য সময় আসতে পারবে না। দুপুরে ও ব্যস্ত থাকে। বিকেলেও আসতে পারবে না। সন্ধ্যায়ও ওর দাদি আসতে দিবেন না। এজন্যেই আমাদের যেতে হবে। আমাদের সাথে ঘুরতে যাচ্ছে বলে বাড়ি থেকে বের হবে ও।’

মাহীন বলল,’ওরে বাবা কত প্ল্যান প্রোগ্রাম।’
তারপর ফোন কেটে দিলো। মাহীন ধপ করে বিছানায় শুয়ে পরল। ভাবল, ওফ একেই এক সমস্যা নিয়ে দিন রাত ঘোরের মধ্যে আছি। তারপর আরেকটা জিনিস নিয়ে ভাবার সময় কোথায় আমার। ওরাই সামলাক ওটা। যেহেতু এই ব্যাপারটা ওদের কাউকে বলতে পারবো না সেহেতু এটা আমিই দেখি।’ তখনই ফোনটা আবার বেজে উঠল।মাহীনের ভাবনার জাল ছিঁড়ে গেল। টঙ্কস এসে মাহীনের মাথার কাছে বসেছিল। মাহীন এখন লাফ দিয়ে উঠে বসতেই বিড়ালটা চমকে উঠল। এবার ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখলো, রাবিত ফোন দিচ্ছে। সাথে সাথে কলটা রিসিভ করল।তারপর উৎসুক কন্ঠে বলল,’ওখানে কী অবস্থা? উনি রাজি হয়েছেন?’
রাবিতের ক্লান্ত কন্ঠস্বর শোনা গেল। ও বলছে,
‘হ্যা অবশেষে মা আমার সাথে পার্কে হাঁটতে যেতে রাজি হয়েছেন। তুমি তাড়াতাড়ি মিসেস বিঙ্গকে নিয়ে চলে আসো।’
মাহীন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। তারপর বলল,’ঠিক আছে চিন্তা করো না। আমি ওনার সাথে ওখানে পৌঁছচ্ছি।’ বলেই লাইন কেটে দিল। এবং প্রায় সাথে সাথেই কনক্যাক্ট লিস্টটা বের করে মিসেস বিঙ্গের নম্বরটা ডায়েল করল। কিছুক্ষণ রিং হতেই রিসিভ হলো। ওপাশ থেকে বলল,’হ্যা মাহীন। উনি কী রাজি হয়েছেন?’
মাহীন কিছুটা উৎফুল্ল কন্ঠে বলল,’হ্যা। আপনি তৈরি আছেন তো?’
‘হ্যা আমি তো তৈরি। তাহলে তুমি বাইরে বের হও। আমি তোমাদের বাড়ির সামনে আসছি।’
মাহীন সায় জানাল। তারপর লাইন কেটে দিলো।
.
.
.
প্রায় বিশ মিনিট পরের কথা, রাবিত ও মিসেস রহমান পার্কের একদিকের রাস্তা ধরে হাঁটছেন। প্রচুর হইহট্টগোলে পরিপূর্ণ পার্ক। কারণ এই এলাকার সমস্ত ছেলেমেয়েরা বিকেল বেলায় এই পার্কেই এসে জড়ো হয়। তবে চারিদিক সবুজে ভরা। বড় বড় গাছ পালার মাঝখান দিয়েই ছোটদের জন্য খেলাধুলার সরঞ্জামও রয়েছে। মিসেস রহমান হাঁটতে হাঁটতে বলছেন,’আচ্ছা একটা কথা বল। তুই হঠাৎ করে আজ আমার সাথে পার্কে হাঁটতে আসার জন্য এত পাগল হলি কেন?’
রাবিত অভিমানী কন্ঠে বলল,’কেন তোমার সাথে হাঁটতে আসতে পারি না? কতদিন কোথাও তো যাওয়াই হয় না।’
মিসেস রহমান সায় জানিয়ে মাথা নাড়লেন। রাবিতের দৃষ্টি বারংবার এদিকসেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিছুক্ষণ পর দেখতে পেল ওদের থেকে বেশ দূরে মাহীন সহ একজন ফর্সা সোনালী চুলো মহিলা এবং একটা ছোট বাচ্চা রয়েছে। রাবিত সাথে সাথে মোবাইলটা বের করল। এবং মাহীনকে টেক্সট করল। মিসেস রহমান থেকে কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে হাঁটছে রাবিত।

ওদিকে মাহীনের সেলফোনে নোটিফিকেশনের শব্দ শুনে ও সেলফোনটা হাতে নিল। রাবিতের টেক্সট করা জায়গা অনুযায়ী দূরে গাছে ঘেরা পথটা দিয়ে ওরা হাঁটছে। মাহীন মিসেস বিঙ্গকে বলল,’আপনি ওই দূরে লাল ইটে বাঁধা পথের দিকে যান। দেখবেন ফর্সা মতো লাল টি-শার্ট পরা একটি ছেলে এবং একজন মধ্য বয়সি মহিলা। অবশ্য ছেলেটা আপনাকে ইশারা দিলে আপনি যাবেন। উনি সায় জানিয়ে মাথা নাড়লেন। তারপর নিচে হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকা ফ্র্যাঙ্কের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ফ্র্যাঙ্ক প্রথমে কিন্তু তোমার কাজ। মনে আছে তো কী করতে হবে?’
ফ্র্যাঙ্ক সায় জানিয়ে মাথা নেড়ে বলল,’ইয়েস মামা।’
তারপর ওরা এগিয়ে গেল। এবং মাহীন ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকল। ও যেতে পারবে না।

রাবিত খেয়াল করল মিসেস বিঙ্গ এবং তার ছেলে এদিকেই আসছেন। ও সঙ্গে সঙ্গে হাত নেড়ে ইশারা করল। উনি সেটা খেয়াল করে নিচে ঝুকে ছোট বাচ্চাটাকে কিছু একটা বললেন। পরমুহূর্তে বাচ্চাটা ছুটে আসল রাবিতের দিকে। হঠাৎ শক্ত করে ওর হাত আঁকড়ে ধরল। উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলল,’আরেহ ভাইয়া! তুমি কতদিন পর আবার আসছ? মাঝে অনেক দিন আসোনি কেন?’
রাবিত হতবাক বনে গেল এক মুহূর্তের জন্য। এখানে বাচ্চাটার সঙ্গে আগে থেকে চেনা পরিচিত হওয়ার ভান করতে হবে মাহীন এমন কিছু তো আগে থেকে বলেনি।
তবে নিজেকে সামলে নিয়ে নরম কন্ঠে হাসি মুখে বলল,
‘অও! তুমি আমাকে মিস করসো? আমি একটু ব্যস্ত ছিলাম তো কিছুদিন তাই আসা হয়নি।’ মিসেস রহমান পেছনে ঘুরে তাকালেন এবং থেমে গেলেন।
মিসেস বিঙ্গ তখন দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসলেন। মিসেস রহমান বললেন, ‘রাবিত এটা কে?’
রাবিত বলল,’আরেহ ও ফ্র্যাঙ্ক। আমার লিটল ফ্রেন্ড। প্রায় সময় এখানে দেখা হয়।’
সেলি ওদের সামনে এসে দাঁড়ালেন। এবং রাবিতকে উদ্দেশ্য করে বললেন,’ওহ কেমন আছো তুমি?’
রাবিত হালকা হেসে বললো, ‘আমি তো ভালোই আছি।’ তারপর মিসেস রহমানের দিকে ইশারা করে বলল,’উনি আমার মা। দিলারা রহমান।’
মিসেস বিঙ্গ আন্তরিক হেসে বললেন,’হ্যালো মিসেস র‌্যহমান। আমি সেলি বিঙ্গ।’
মিসেস রহমানও হাসি মুখে বললেন,’হ্যালো মিসেস বিঙ্গ! আপনার সাথে বোধহয় রাবিতের প্রায়ই দেখা হয়।’
সেলি বললেন,’আমাকে সেলি বলবেন। এবং হ্যা আমি প্রায়ই ফ্র্যাঙ্ককে নিয়ে এখানে হাঁটতে আসি। এবং রাবিটও আসে। ফ্র্যাঙ্কের সঙ্গে ওর বেশ ভালো সম্পর্ক।’
মিসেস রহমান ফ্র্যাঙ্কের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘বাহ ভালোই তো। ওর কথা অবশ্য আগে কখনো রাবিত বলেনি আমাকে।’
ফ্র্যাঙ্ক রাবিতকে উদ্দেশ্য করে বলল,’ভাইয়া চলো না আমরা আইসক্রিম খেতে যাই।’ বলেই হাত ধরে টানতে লাগল। রাবিত তাড়াহুড়ো করে পেছনে ঘুরে বলল,
‘মা আমি আসছি।’ বলেই ফ্র্যাঙ্কের সঙ্গে ছুটে চলে গেল। এবং কিছুক্ষণের অন্তরে চোখের আড়ালে চলে গেল। মাহীন এদিকে একা একা ধীরে ধীরে হাঁটছে। রাবিত ওকে দেখা মাত্র ফ্র্যঙ্ককে নিয়ে ওর কাছে এসে পৌঁছলো। ওদের দেখা মাত্রই মাহীন উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করল,’সব ঠিকঠাক মতো হয়েছে?’
ফ্র্যঙ্ক নিচ থেকে বলল, ‘এভরিথিং অন ফ্লিক!’
ওরা দুজন হাসল।
.
.
‘আপনাকে এর আগে কখনো দেখিনি এখানে আসতে। তেমন একটা আসেন না এদিকে?’ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন সেলি।

মিসেস রহমান বললেন,’আসি কদাচিৎ। তবে বেশির ভাগ সময় রাস্তায় হাঁটতে বের হই। পার্কে আসা হয় না।’

সেলি বললেন,’ওহ আচ্ছা। আমার ছেলেটাকে একাই প্রচুর সময় দিতে হয় তো। তাই প্রায় আমরা দুই মা ছেলে ট্রাভেল করে বেড়াই।’

মিসেস রহমান জিজ্ঞেস করলেন,’ওহ আর আপনার স্বামী? দেশের বাইরে থাকেন বা এমন কিছু?’

সেলি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। শান্ত কন্ঠে বললেন,
‘আসলে আমার স্বামী বেঁচে নেই। কয়েকমাস আগে ক্যান্সার তাকে কেঁড়ে নিয়ে গেছে।’

মিসেস রহমান দুঃখিত কন্ঠে বললেন,’আই এম সরি।’

সেলি হালকা হাসার চেষ্টা করে বললেন,’নাহ ঠিক আছে। আমি এখন সামলে উঠেছি।’
তারপর একটু থেমে আবার জিজ্ঞেস করলেন,’আচ্ছা আপনার পরিবার সম্পর্কে কিছু বলেন?’
ওনারা ধীরে ধীরে হাঁটছেন। লাল ইটে বাঁধা রাস্তার পাশে লম্বা গাছের সারি। বাতাসে গাছের ডালপালা দুলছে। লাল ইটের চিপা থেকে কোথাও কোথাও ছোট ছোট বুনো গাছ বেড়ে উঠছে। মিসেস রহমান এক মুহূর্ত দ্বিধা করলেন। তারপর বললেন,’আমি আমার শাশুড়ী এবং আমার এক ছেলের সঙ্গে থাকি।’
সেলি উৎসুক দৃষ্টিতে তাকালেন। জিজ্ঞেস করলেন,
‘ওহ আপনার এক ছেলেই?’
মিসেস রহমানকে কিছুটা বিচলিত দেখাল। তিনি ঘনঘন শ্বাস নিতে শুরু করেছেন। বললেন,’হ্যা।’ তার কন্ঠে সুক্ষ্ণ দৃঢ়তা ছিলো।

সেলি বলল,’ওহ এবং আপনার স্বামী?’
এখন মিসেস রহমানের অস্থিরতাটা বৃদ্ধি পেল বোধহয়। তিনি লম্বা এক শ্বাস ফেলে বললেন,’আমার স্বামী চার বছর আগে কার এক্সিডেন্টে মারা গিয়েছেন।’
এবার সেলি তার দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন। অর্থপূর্ণ কন্ঠে বললেন, ‘যার যাওয়ার সময় হয় তাকে তো চলে যেতেই হয়। এতে কারোর কোনো হাত থাকে না। হয়তো কার এক্সিডেন্ট একটা অছিলা ছিল। যেমনটা আমার হাসবেন্ডের ক্ষেত্রে ক্যান্সার ছিলো।’
মিসেস রহমান অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে চাইলেন সেলির দিকে। কিন্তু কিছু বললেন না। তারপর কিছুক্ষণ তারা নিশ্চুপ ভাবেই হেঁটে গেলেন। অবশেষে মিসেস রহমান জিজ্ঞেস করলেন,’তো আপনি এবং আপনার ছেলে একাই থাকেন। তাহলে আপনি কী করেন?’
সেলি বললেন,’আমি একজন সাইকিয়াট্রিস্ট।’
মিসেস রহমান সায় জানিয়ে মাথা নাড়লেন। সেলি বললেন,’আপনার ছেলের সাথে দেখা হলে প্রায়ই ও নিজের সমস্যার কথা আমাকে বলে। ফ্র্যঙ্কের সঙ্গে কথা বলে, খেলেও।’
মিসেস রহমান হালকা হাসলেন। বললেন,’ওহ তাই। ও অনেক উদ্যমি। প্রতিদিন বাসায় এসে আমার কাছে ও কী করে না করে সবই উগলে দেয়। তবে আপনার কথা কখনোই বলেইনি।’

সেলি শ্রাগ করে বললেন,’কি জানি। আমার কথা মনে থাকে না বোধহয়।’ বলে চুপ করে গেলেন। সামনে রাস্তার পাশে একটা মস্ত আইসক্রিমের মতো দেখতে আইসক্রিম ভ্যান। এর সামনে ছেলেমেয়েদের বেশ ভির দেখা গেল। রাবিত ও ফ্র্যাঙ্ক আইসক্রিমের অছিলায় গেলেও আসলে তাঁরা এর ধারের কাছেও নেই।
সেলি অবশেষে আবার কথা শুরু করলেন, ‘এই পার্কে আসি এবং দেখি আজকালকার ছেলেমেয়েদের কত সমস্যা। কেউ কেউ একা বিষন্ন ভাবে বসে থাকে। অনেকের সঙ্গে মাঝেমাঝে কথাও বলি। দেখা যায় বেশির ভাগেরই পারিবারিক সমস্যা। অবশ্য অনেকের অন্যান্য সমস্যাও থাকে। খারাপও লাগে ওদের জন্য। কিন্তু এর চেয়ে বেশি আর কীই বা করতে পারি?’

মিসেস রহমান গম্ভীর ভাবে মাথা নাড়লেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,’কত পরিবারে কত রকমের সমস্যা থাকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কারোর কিছু করারও থাকে না।’
সেলি বললেন,’এইসব পারিবারিক সমস্যার কারণে দেখেছি অনেক কিশোর কিশোরীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি হচ্ছে। পারিবারিক সমস্যার কারণে ডিপ্রেশন, ট্রোওমায় ভোগে। অনেকের ক্ষেত্রে সময়ের সাথে সাথে ঠিক হয়ে যায়। অনেকের অন্য কোনো মানসিক সমস্যা দেখা দেয় হয়তো। বড়দের ক্ষেত্রেও এমন সমস্যা দেখা দেয়।’
মিসেস রহমান বললেন,’তা ঠিক। আমার স্বামী যখন মারা গেলেন তখনকার সময়গুলো যে কিভাবে কেটেছে আমার আসলে কিছুই মাথায় নেই। মাঝে মাঝে ভাবি রাবিতের ওপর দিয়ে কি গিয়েছে, মায়ের ওপর দিয়ে কি গিয়েছে।’
সেলি ভ্রু কুঁচকালেন। জিজ্ঞেস করলেন,’আপনি কী সেই সময়ের কথা মনে করতে পারেন না?’

মিসেস রহমান বললেন,’পারি। তবে সে অনেকদিন আগের কথা। কোনো কোনোদিন বোধহয় ঘোরের মধ্যে থাকতাম। তখন যে বাসায় কার সাথে কী হচ্ছিল তা বলতে পারি না।’
সেলি শান্ত কন্ঠে বলল, ‘আপনি একটা মানসিক ট্রোওমার মধ্যে ছিলেন।’ তারপর থেমে আবার বললেন,
‘তখন কোনো সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাননি?’
মিসেস রহমানের বুক চিরে লম্বা এক নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসল। উনি স্তিমিত কন্ঠে বললেন,’না। আমি তো সময়ের সাথে সাথে সামলে উঠেছিলাম।’
সেলি এবার কিছুটা সাবধানতার সঙ্গে বললেন,
‘আমার কী মনে হয় জানেন তো আপনার সেই সময় একবার অবশ্যই সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো উচিৎ ছিলো। আপনি না হলেও আপনার পরিবারের সদস্যদের এটা করা উচিৎ ছিলো। কারণ…বলে একটু থামলেন। মিসেস রহমান আগ্রহী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। তারপর সেলি বলে গেলেন,’কারণ অনেক সময় হয়তো আমরা আমাদের ডিপ্রেশন এবং ট্রোওমাকে পাত্তা দেই না। তবে সেটা আমাদের মস্তিষ্কের কোন অংশে যে প্রভাব ফেলবে তা কেউ জানে না। মস্তিস্ক বড়ই রহস্যময় ও স্পর্শকাতর এক জিনিস। আপনি হয়তো বুঝতেও পারবেন না যে, আপনার মস্তিষ্কে কোথাও কোনো অস্বাভাবিকতা রয়েছে। তবে সেটা অন্যদের চোখে ধরা দেবে।’
মিসেস রহমান এবার ভ্রু কুঞ্চিত করলেন। জিজ্ঞেস করলেন,’আমার মধ্যে কী কোনো অস্বাভাবিকতা আছে বলে মনে হয়?’
সেলি হাসলেন। বললেন,’তা তো আমি বলতে পারছি না। তবে আমি আপনাকে উদ্দেশ্য করে বলিনি। আমার সাইকিয়াট্রিস্ট জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। এমন অনেক রোগী দেখেছি, যারা একদম স্বাভাবিক জীবনযাপন করছে। স্বাভাবিক ভাবেই চিন্তা ভাবনা করছে। তবে তাদেরও কোনো মানসিক সমস্যা রয়েছে হয়তো যেটা তাদের আপনজনদের কাছে ধরা দেয়। এই যেমন পিটিএসডি, বাইপোলার বা ডিসথেমিয়ার রোগী।’

মিসেস রহমান সায় জানিয়ে মাথা নাড়লেন। বললেন,
‘তা ঠিক। যদিও সে সময় কোনো সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাইনি। এমনিতে সব ঠিকঠাকই চলে। তবে আমার মাঝে মাঝে অদ্ভুত লাগে। মাঝে মাঝে ব্ল্যাকআউট হয়ে যায় সবকিছু। কারো কারোও জন্য অকারণেই অস্বাভাবিক অনুভূতি হয়।’

সেলি এবার চিন্তিত স্বরে বললেন,’যেমন?’

মিসেস রহমান এক মুহূর্ত ইতস্তত করে বললেন,’যেমন অকারণেই হয়তো কারোও ওপর অত্যন্ত রাগ হয়। আমি এই জিনিসটা অনেক লম্বা সময় ধরে খেয়াল করছি। আমার মন ভালোই আছে। কিন্তু হঠাৎ করেই কাউকে দেখলে আমার রাগ হয়। তাকে জাস্ট সহ্য করতে পারি না। তখন মাথাও ঝিমঝিম করে।’
সেলি বললেন, ‘কাকে দেখলে? কোনো নির্দিষ্ট মানুষ?’
মিসেস রহমানকে বিভ্রান্ত দেখা গেল। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ রইলেন। ভাবছেন, ওনাকে আমি চিনিও না অথচ এত কথা বলে দিচ্ছি। তা কী ঠিক হবে? আজই মাত্র প্রথম দেখা। কিছুই জানি না ওনার সম্পর্কে। যদিও তিনি একজন সাইকিয়াট্রিস্ট। কিন্তু আমার সমস্যা কী আসলেও মানসিক সমস্যার মধ্যে পরে? কখনো সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানোর প্রয়োজন বোধ করিনি। কিন্তু আসলেও কী রায়েদকে দেখলেই আমার যে অদ্ভুত এক রাগ হয় ওর প্রতি এটা কী স্বাভাবিক নাকি কোনো মানসিক সমস্যা? যতবারই ভাবার চেষ্টা করি ওকে দেখলেও শান্ত থাকবো। তাও তো পারি না। তাহলে এটা কী ওনাকে জানানো উচিৎ না? যেহেতু উনি একজন সাইকিয়াট্রিস্ট। এবং এমনিতেও ঘটা করে সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো আমার হবে বলে মনে হয় না।’
সেলির ডাকে চমকে উঠলেন মিসেস রহমান। তার চিন্তা ভাবনায় ছেদ পরল। সেলি এখনো প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন। মিসেস রহমান অবশেষে দীর্ঘশ্বাস ফেলে উত্তর দিলেন,’রায়েদকে দেখলে।’

‘রায়েদ কে?’

মিসেস রহমান একমুহূর্ত দ্বিধা করে বললেন,
‘আমার আরেক ছেলে।’
সেলি বিস্ময়াবিষ্ট দৃষ্টিতে তাকালেন। যদিও তিনি এটা পূর্বেই জানতেন তবে মিসেস রহমানের সামনে তাকে অপরিচিতার ভানই ধরে থাকতে হবে। কিছুক্ষণ একই ভাবে চেয়ে থাকার পর অবশেষে বললেন,’আপনি তো প্রথমে বলেছিলেন আপনার এক ছেলে!’
মিসেস রহমান বিচলিত এবং বিব্রতবোধ করলেন। প্রবল বেগে বাতাস হচ্ছে। হালকা ধুলাবালিও বাতাসের সঙ্গে উড়ে আসছে। সূর্যের আলোর তেজ কমেছে। মেঘেরা সূর্যকে বারবার ঢেকে দিয়ে যাচ্ছে। মিসেস রহমান নিশ্চুপ রইলেন। কিছুক্ষণ পর অবশেষে বললেন,’ওকে আমার ছেলে বলে মানতেই কষ্ট হয়। এমন অনুভূতির কারণ আমি নিজেও বলতে পারবো না।’
সেলি এবার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ধীরে ধীরে শান্ত কন্ঠে বললেন,’বুঝতে পারছি। এটা আপনার জানারও কথা নয়।’
মিসেস রহমান ভ্রু কুঞ্চিত করে তাকালেন। প্রশ্ন করলেন,’মানে?’
এবার সেলি শুষ্ক ঠোঁটের ওপর থেকে জ্বিব বুলিয়ে নিয়ে ঠোঁট জোড়া ভেজালেন। কিছু একটা বলার জন্য লম্বা শ্বাস ফেলে প্রস্তুত হলেন। এবং শান্ত গলায় বললেন,
‘আসলে সবই ঠিক আছে কিন্তু তবুও কিছু একটা ঠিক নেই। আমি জানি না আপনার এবং আপনার ছেলের মধ্যে কী হয়েছিল। তবে নিজের ছেলের প্রতি এমন অনুভূতি হওয়াটা মোটেও স্বাভাবিক নয়। এবং আপনার অন্যান্য সমস্যা যেমন মাঝে মাঝে ব্ল্যাকআউট হয়ে যাওয়া এসবও স্বাভাবিক নয়। আপনাকে সাইকিয়াট্রিস্ট হিসেবে একটা পরামর্শ দিবো।’ বলে একটু থামলেন। তারপরও ইতস্তত না করে পরিষ্কার ভাবে বললেন,’আপনি সাইকিয়াট্রিস্ট দেখান।’
মিসেস রহমান কিছুক্ষণ ভাবলেন। তার কপালে চিন্তার স্পষ্ট রেখা। তিনি বেশ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকার পর মৃদু কন্ঠে বললেন,’দেখি।’
সেলি চোখের কোণ দিয়ে একবার মিসেস রহমানকে দেখলেন। তারপর দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে ভাবলেন, বুঝেছি ওনার সমস্যাটা আসলে তেমন কিছুই না। যদি এখন ম্যহীন এবং রাবিট ওনাকে রাজি করিয়ে আমার কাছে অফিশিয়ালি আনতে পারে তাহলেই হবে। কারণ শুধু কাউন্সিলিং এ কাজ হবে না। তাকে ঔষধ দেওয়া লাগবে। তার ‘অ্যমিগডালার’ কার্যক্রম ঔষধ ছাড়া ঠিক হওয়া মুশকিল।’

ইনশাআল্লাহ চলবে।