#এল এ ডেইস
পর্ব ৩৮
লেখনী মাহীরা ফারহীন
ডিম ভাজার আকর্ষণীয় সুবাসে মম করছে সারা ঘর। পাউরুটি, ম্যাস পটেটো, ডিম এবং মাংস ভাজা তৈরি করা হয়েছে। রান্নাঘরে কাজ করার খুটখাট শব্দ হচ্ছে। সকালের মিষ্টি রোদ এসে রান্নাঘরের জানালা দিয়ে প্রবেশ করে সিঙ্কের ওপর পরেছে। রোদের কিরণে চকচক করছে রুপালি সিঙ্ক। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পানির বিন্দুগুলো হিরের মতো ঝিলিক দিয়ে উঠছে। রান্নাঘরের সঙ্গে লাগোয়া টেবিলে সব কিছু নাস্তার জন্য সাজানো হয়েছে। শুধু খাবার নিয়ে যাওয়ার অপেক্ষা। ধীরে ধীরে এক পদশব্দ সিড়ি বেয়ে নেমে আসছে। এটা রাবিত না। রাবিত এতই লাফিয়ে লাফিয়ে চলাফেরা করে যে যেখান থেকে যায় সেখানে রীতিমতো ভূমিকম্প হয়ে যায়। তাও যখন সেটা কাঠের সিঁড়ি তখন তো কথাই নেই। সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসার পর দেখা গেল এটা রায়েদ। মিসেস রহমান রায়েদের দিকে সরাসরি মুখ তুলে চাইলেন। কিছুক্ষণ চেয়ে থাকার পর আবার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন। রায়েদও হঠাৎ মায়ের মুখমুখি হয়ে যেতে কিছুটা বিচলিত হলো। তবে মাকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে অবাকও হলো। মিসেস রহমান পেছনে ঘুরে কেতলি থেকে টার্কিশ চায়ের কাপে চা ঢালতে ব্যস্ত হলেন। এই চায়ের বিশেষত্ত্ব হলো একটি কেতলিতে পানি গরম করা হয়। তার ওপরে আরেকটি কেতলি বসিয়ে সেটায় চা ফোটানো হয়। মিসেস রহমানের হৃদয়ে কোনো হইচই হলো না। কোনো ক্রোধ ঝংকার তুললো না। পূর্বে রায়েদকে দেখলেই কোনো কারণ ছাড়া অদ্ভুত ভাবেই মনের কোণে রাগ এবং ঘৃনা দানা বাঁধত। মিসেস রহমান এতে নিজেই অবাক হয়ে যেতেন। এখন তেমন কিছুই হলো না। কোনো রাগ নেই কোনো ঘৃনা নেই। এতেও তিনি অবাকই হলেন। মনে মনে ভাবলেন,’কী হচ্ছে এসব ওর জন্য হঠাৎ করে আগের মতো অনুভূতি হচ্ছে না কেন? চাইলেও রাগ হচ্ছে না। রাগ হওয়ার কারণ কী তাই তো বুঝতে পারছি না। ওর জন্য আমার স্বামী মারা গেছে? এটা রাগের কারণ ছিলো? কিন্তু মা এবং সেলির এই কথাই তো ঠিক যে সেটা এক্সিডেন্ট ছিলো। আল্লাহ যখন যাকে তুলে নিতে চায় তখন তাকে নিয়ে যায়। এতে রায়েদের কোনো দোষ নেই। তাহলে আমি রায়েদের সঙ্গে এত নিষ্ঠুর ব্যবহারই বা কেন কারতাম?’ ভাবতেই ভাবতেই চা নিয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন। রায়েদ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে জুতা পরছে। মিসেস রহমান রান্নাঘরের বারের পেছন থেকে বেরিয়ে টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। এবং চাগুলো নামিয়ে রাখলেন। একবার রায়েদের দিকে তাকিয়ে ভাবলেন, ‘মনে হচ্ছে যেন যুগ যুগ পর ওকে দেখছি। ও যে কেমন আছে তাও তো কখনো খেয়াল করিনি। এই সকাল বেলায় না খেয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। ওহ হ্যা আমি তো ওর শরীর স্বাস্থ্যরও খবর নেই না। শেষ কবে ওর আদর যত্ন করেছিলাম তাও মনে পরছে না।’
হঠাৎ করেই রায়েদের জন্য মনের মধ্যে এক তীক্ষ্ণ চিনচিন ব্যথা অনুভব করলেন তিনি। না খেয়ে রায়েদ বের হয়ে যাবে তাতে মোটেও মন সায় দিচ্ছে না। কী অদ্ভুত এক অস্থিরতা। সন্তানের জন্য মায়ের মন তো এভাবেই অস্থির হয়ে ওঠে। তবে এত দিন তার এই অনুভুতি গুলো যেন কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল। সেই এক্সিডেন্টের সাথে যেন রায়েদের প্রতি তার মমত্ববোধ চাপা পরে গিয়েছিল। শুধু মাত্র আজ নয় চারটা বছর টানা তিনি কখনো রায়েদের দিকে দৃষ্টিপাত করার প্রয়োজন বোধ করেননি। ও খেয়েছে কী খায়নি সেটা তার মাথা ব্যথার কারণ ছিলো না। অথচ তার ভেতরটা হাহাকার করে উঠছে শুধু আজকের রায়েদ না খেয়ে বের হয়ে যাচ্ছে বলে। রায়েদ দরজা খুললো। তখনই তিনি মিসেস রহমান গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘রায়েদ, থাম!’ যদিও কথাটা তিনি কিছুটা স্বাভাবিক ভাবেই বলতে চেয়েছিলেন কিন্তু কড়া ভাবেই মুখ দিয়ে কথাটা বেরিয়ে গেল। রায়েদ চমকে উঠে ধীরে ধীরে পেছন ফিরে তাকাল। চোখ মুখ ওর থমথমে। অপেক্ষায় রইল কোনো একটা সুক্ষ্ণ খুঁতের জন্য ধমক খাওয়ার। কিন্তু মিসেস রহমান সেসব কিছু না বলে, বললেন,’নাস্তা করে যা।’
রায়েদ যেন বিদ্যুৎ চমকের মতো ঝটকা খেল। হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মায়ের কথাটা বুঝে উঠতেই কিছু সময় পার হয়ে গেল। হঠাৎ করেই কোথা থেকে যেন মিষ্টি সুবাসিত বাতাসের ঝাপটা ওকে ছুয়ে গেল। ওর মনে হলো অনেক অনেক বছর পর ওর খরায় পোড়া বুকের জমিনে বৃষ্টি পরতে শুরু করেছে। মিসেস রহমান আবারও রান্নাঘরের বারের পেছনে চলে গিয়েছেন। রায়েদ এবার দ্বিধান্বিত হয়ে পরল। আসলেই টেবিলে গিয়ে বসবে কিনা বুঝতে পারল না। এখন ওর মনে নানান প্রশ্ন এসে কড়া নাড়তে লাগল। মায়ের হঠাৎ কী হলো? এটাই মূল প্রশ্ন। রায়েদকে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মিসেস রহমান পুনরায় দৃঢ় কন্ঠে বললেন,
‘কী হলো শুনতে পাসনি? বসতে বলেছি তো।’ রায়েদ এবার আর দেরি না করে আবারও জুতা খুললো। এবং
ধীর গতিতে এগিয়ে আসল। টেবিলের একটা চেয়ার টেনে নিয়ে একমুহূর্ত দ্বিধা করে বসে পরল। মিসেস রহমান উচ্চস্বরে বললেন, ‘আম্মা! রাবিত! নাস্তা তৈরি।’
কিছুক্ষণের মধ্যেই মিসেস মাদিহ দেয়াল ধরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে কামরা থেকে বের হলেন। তিনি টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াতেই তার চোখে মুখে বিস্ময় খেলে গেল। তখনই কাঠের সিঁড়িতে শব্দের ঝড় তুলে লাফাতে লাফাতে রাবিত নিচে নেমে আসল। রায়েদের সামনেও মিসেস রহমান এক কাপ লালচে টার্কিশ চা রেখে গিয়েছেন। রায়েদ এখন গভীর মনোযোগে চা সীপ করতে ব্যস্ত। রাবিতেরও ভাইকে টেবিলে দেখে চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। পরমুহূর্তেই ধীরে ধীরে দুদিকে ঠোঁট প্রসারিত হয়ে গেল। সারা মুখে হাসি ছড়িয়ে গেল। দাদি এসে বসেছেন। তিনিও রায়েদকে এখানে সকলের সাথে বসে থাকতে দেখে মিটিমিটি হাসছেন। তাঁর ভাজ পরা চামরা হাসির রেশে আরোও কুঁচকে গিয়েছে। রাবিত এসে প্রায় ঝাপ দিয়ে রায়েদের পাশের চেয়ারে বসল। রায়েদ বসে তো আছে ঠিকই। কিন্তু কিছু বলার বা এক দন্ড হাসারও সাহস পাচ্ছে। বারবার মনের মধ্যে এক অদ্ভুত ভয় এসে খোঁচা দিচ্ছে। মনে মনে ভয় হয় কখন না হঠাৎ করে মায়ের মন ঘুরে যায়। কখন না ওকে ভৎস্যর্না দিতে শুরু করেন। তাই একদম থম মেরে মূর্তির মতো বসে রয়েছে। নড়ছেও পর্যন্ত না। মিসেস রহমান বাকি জিনিসগুলো নিয়ে এসে টেবিলে রাখলেন এবং নিজের চেয়ারে বসলেন। রাবিতের মুখে হাসি লেগেই রয়েছে। ও আগেভাগে পকেট থেকে নিজের সেলফোনটা বের করল। রায়েদ ওর পাশে বসেই আঁড়চোখে দেখলো ওয়াটস আ্যপ খুলেছে। কাকে যেন কি একটা টেক্সট করছে। তখনই মিসেস রহমানের ধমকে চমকে উঠল দুজনেই। রায়েদের বুক ধড়ফড় করে উঠল। তবে মিসেস রহমান ধমকটা দিচ্ছেন রাবিতকে। তিনি বলছেন,
‘কতবার বলেছি না খাওয়ার সময় মেবাইলটা যেন হাতে না থাকে! রাখ এখনই রাখ।’
রাবিত শুকনো ঢোক গিলে মোবাইলটা পকেটে রেখে দিল। এবং নাস্তায় মনোযোগ দিল।
.
.
.
বিস্তৃত নীল আকাশের বুকে বিরাটকার কৃষ্ণকায় মেঘ এসে ভিড়েছে। সকালেও রোদ উঠে ছিল পূর্ণদ্যমে। এখন রোদের আর তেমন একটা তেজ নেই। স্কুলের সামনের অরিগন এস গাছগুলোর ডালপালা বাতাসে দুলছে। চত্ত্বরের দেয়াল ঘেঁষে ফুটে আছে বেগুনি রঙের ডগলাস আইরিশ। মাহীন অস্থির ভাবে স্কুলের দ্বিতীয় তলার করিডর ধরে পায়চারি করছে। এক ঘন্টা পূর্বে রাবিতের একটা ম্যাসেজ এসেছিল যে, তুমি বিশ্বাস করবা না কী ঘটেছে!’ এতটুকুই। এরপর মাহীন উদ্বিগ্ন হয়ে আরোও ম্যাসেজ দিয়েছে। কিন্তু এই ছেলের কোনো খবর নেই। কোনো উত্তরও আসেনি। নায়েল হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে আসছিল। মাহীনকে দেখে থেমে গেল। কনক্রিটের রেলিঙের ওপর উঠে বসে বলল,
‘হেই গুড মর্নিং!’
‘মর্নিং’ ছোট করে বলল মাহীন।
‘ইউ লুক ফাসট্রেইটেড। হোয়াট হ্যাপেন্ড?’
‘জানি না। এমনিই পায়চারি করছি।’ হতাশ শোনাল ওকে।
‘ওহ আই সি।’ প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,
‘বাই দ্যা ওয়ে তোমার পরীক্ষার প্রস্তুতি কেমন?’
মাহীনও এবার কনক্রিটের রেলিঙের ওপর উঠে বসল। স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,’এই তো ভালোই। তবে একটু নার্ভাস। এর আগে কখনো এই তল্লাটে পরীক্ষা দেইনি তো।’
নায়েল স্মিত হাসল। বলল,’তাতে কী হয়েছে। পরীক্ষায় আর কী এমন পার্থক্য হয়। প্রস্তুতি ভালো হলেই সব ভালো।’
মাহীন সায় জানিয়ে মাথা নাড়ল। পেছন থেকে কার যেন মৃদু ডাক শোনা গেল। মনে হলো কেউ মাহীন বলেই ডাকছে। ওরা দুজনেই কৌতূহলী চোখে ঘাড় ঘুরাল। দেখা গেল নিচে চত্ত্বরে হলুদ রঙের সামোহি লেখা স্ট্যাচুটার সামনে রায়েদ দাঁড়িয়ে। ওরা তাকাতেই হাত নাড়ল। মাহীন লাফ দিয়ে রেলিঙ থেকে নেমে গেল। ব্যস্ত কন্ঠে বলল,’বোধহয় ও আমায় ডাকছে। যাই দেখা করে আসি।’
‘ঠিক আছে। তবে সময় মতো ক্লাসে চলে এসো।’
মাহীন উপরে নিচে মাথা নাড়ল। এখান থেকেই রায়েদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়ল। করিডোর ধরে দ্রুত বেগে হেঁটে চললো। নিচে গিয়ে গেট দিয়ে লাল ইটে বাঁধা কয়েক ধাপের সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসল চত্ত্বরে। যত এগিয়ে আসছে পরিষ্কার হয়ে উঠছে রায়েদের ভাবভঙ্গি। কোনো এক কারণে উদ্ভাসিত হয়ে আছে ও। মনের খবর নাকি চোখ দিয়েই প্রকায় পায়। রায়েদের মন যে কতটা উৎফুল্ল তা ওর চোখ দেখেই উপলব্ধি করা যায়। আনন্দে নেচে উঠছে চোখের তাঁরা। মাহীন ওকে দেখেই বুঝতে পারল কোনো আনন্দের কিছু একটা ঘটেছে। সুতরাং রাবিতের দেওয়া সেই অসমাপ্ত ম্যাসেজ কোনো সুসংবাদই বহন করছিল। ব্যাপারটা ভাবতেই মাহীনের মনটাও আনন্দে উপচে পরল। রায়েদের কাছে এগিয়ে যেতেই রায়েদ ওকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই খপ করে ওর হাতটা ধরে ফেললো। তারপর গাঢ় কন্ঠে বলল,’চলো আমার সাথে।’
বলেই ওকে নিয়ে প্রায় ঝড়েরবেগে হেঁটে চললো। হাঁটছে তো না যেন ছুটছে। মাহীন হতবাক হয়ে ওর সাথে ছুটতে ছুটতে জিজ্ঞেস করল,’কিন্তু কী হয়েছে? এভাবে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ আমাকে?’
‘কোথায় আবার লাইব্রেরিতে। চলো তারপর বলছি।’ ওরা চত্ত্বরের দেয়াল ঘেঁষে ফুটে থাকা সাদা ফ্রেসিয়া ও বেগুনি ডগলাস আইরিশ গুলোকে পাশ কাটিয়ে হেঁটে চললো। একসময় বড় পাইন গাছটাও পার হলো যেটা লাইব্রেরি বিল্ডিংয়ের সামনেই ডালপালা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লাইব্রেরিতে প্রবেশ করে নিজের সেই কোণার টেবিলের সামনে গিয়ে থামল রায়েদ। তারপর ঘুরে দাঁড়াল এক গাল হাসি নিয়ে। মাহীনের মুখেও হাসি। কী যে আসলে হয়েছে তা জানার জন্য আর ধৈর্য্য ধরে না যেন। রায়েদ তখনো ওর ডান হাতটা ধরে রেখেছে। মাহীন কিছু বলতে যাবে তখনই ওর হাত উঁচু করে ওকে গোল গোল দুই পাক ঘুরিয়ে অত্যন্ত উচ্ছ্বাসের সঙ্গে বলল,
‘আজ মা আমাকে নিজেদের সঙ্গে নাস্তা করতে বলেছেন! মানে আমি কতদিন পর মায়ের অনুমতিতেই তার তৈরি করা নাস্তা খেলাম। আমার কাছে এখনো সব কিছু অবিশ্বাস্য লাগছে!’
মাহীনের সারা মুখে হাসি ছড়িয়ে পরল। আনন্দে কিছুটা অদ্ভুত ভাবে ‘উইই’ শব্দ করে বলল,’রিয়েলি! আই কান্ট বিলিভ দিজ। তারমানে এটাই বলতে চেয়েছিল ও।’ অতি আনন্দে হঠাৎ মুখ ফসকে গেল। রায়েদ রায়েদের মুখে হাসি লেগে আছে ঠিকই তবে তার রেশ কমল। জিজ্ঞেস করল,’কে কী বলতে চেয়েছিল?’
মাহীন ইতস্তত হাসল। তারপর আমতা আমতা করে বলল,’রাবিত আমাকে অর্ধেক ম্যাসেজ পাঠিয়েছিল এটা বলে যে, কিছু একটা হয়েছে যেটা আমও বিশ্বাস করবো না। সেটাই বলছি বোধহয় এটাই বলতে চেয়েছিল।’
রায়েদ হালকা হাসল। বলল,’ওহ তাই তো বলি টেবিলের বসা মাত্র মোবাইল নিয়ে কী করতে বসেছিল ও। এবং বোধহয় সম্পূর্ণ ম্যাসেজ দিতে পারেনি কারণ খাওয়ার সময় মোবাইল ধরার জন্য মা ওকে ধমক দিয়েছেন।’
মাহীন স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। আবারও যেন সেই কথাটা মনে করে অতিরঞ্জিত আনন্দটা মনে এসে ভর করল। কোনো দমকা হাওয়ার ঝাঁপটা যেন আনন্দে ভরা ফুলের সুবাস নিয়ে প্রবেশ করে মনকে পুলকিত করে দিয়ে গেল। বলল,
‘রায়েদ এই কথাটা বিশ্বাস করছো তো যে সময় আসলেই পাল্টায়। শুনতে মিরাক্যালের মতো হলেও তোমার মাও কিন্তু ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন।’
রায়েদ একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল। বলল,
‘তা হতেই পারেন। এখন বলো।’
মাহীন ওর পাশের চেয়ারটা টেনে নিয়ে বলল,’কি বলবো?’
‘এই যে তুমি আসলে কী করছ?’
মাহীন বসলো ওর পাশে। তারপর বলল,’পড়াশোনা। সামনের সপ্তাহে পরীক্ষা তাই পড়াশোনা করছি।’
‘তা ভালোই। তবে আমি সেই কথা বলছি না।’
মাহীন জিজ্ঞেস করল,’তবে?’
‘এই যে আমার বাড়িতে কিছুদিন যাবত যেই অন্য রকম হাওয়া লেগেছে সেখানে তুমি কী করছো?’
মাহীন অপ্রস্তুত হলো। শুঁকনো কন্ঠে বলল,’তোমার বাড়ি তো সেই গত মাসে গিয়েছিলাম। সেখানে কী হচ্ছে আমি কিভাবে জানবো?’
‘মাহীন গত মাস থেকেই আমি খেয়াল করছি। আমার বাসায় কিছু একটা তো বদলেছে। এই রাবিত এবং দাদি সারাটাক্ষন মায়ের সাথে চিপকে থাকে। পারলে সপ্তাহে
তিন চার দিনই রাবিত ঠেলতে ঠেলতে মাকে হাঁটতে নিয়ে যায়। এবং এরা তিনজন একসাথে বসে দেখি মেডিটেশন করে। এসবের কারণ কী? এসবের সাথে তুমি কীভাবে জড়িয়ে আছ?’ গাঢ় কন্ঠ রায়েদের।
মাহীন শুকনো ঢোঁক গিললো। এতটা যখন রায়েদ বুঝেই ফেলেছে তখন মাছ দিয়ে শাক ঢাকার চেষ্টা করে লাভ নেই। মাহীন অপ্রতিভ ভাবে আমতা আমতা করে বলল, ‘আসলে..দেখো আমি জানি না তুমি ব্যপারটা কিভাবে নিবে। কিন্তু সত্যিই তোমাকে সবকিছু সামলে নেওয়ার পরই খুশির খবরটা দিতে চেয়েছিলাম।’
রায়েদের ভ্রুযুগল সূঁচালো হলো। জিজ্ঞেস করল,
‘কী ধরনের খবর?’
মাহীন প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে ইতস্তত করে বলল,
‘আমরা মিসেস রহমান কে সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাচ্ছি। গত প্রায় এক মাস যাবত।’
রায়েদ স্থীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মাহীনের চোখে চোখে। ও একটুও অবাক হলো না দেখে মাহীন অবাক হলো। রায়েদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, ‘এমন কিছু একটাই আমি আন্দাজ করেছিলাম। তবে তোমার মুখ থেকে শুনেই নিশ্চিত হতে চাইছিলাম।’
তারপর কিছুক্ষণের বিরতি। দুইজনের কেউই কোনো কথা বললো না। তবে নিজ নিজ মনে দুজনই ভাবছে।
বড় জানালা দুটো দিয়ে বাতাস আসছে শন শন শব্দে। কালো কাঠের সেলফগুলো রঙিন মলাটে মোরা বইয়ে সাজানো। রায়েদ এবার জিজ্ঞেস করল,’কিন্তু এইসব ঠিক করলে কীভাবে?’
মাহীন এবার ধীরে ধীরে শান্ত ভাবে পুরো ঘটনাগুলো সবিস্তারে খুলে বললো। রায়েদ অতি মনোযোগের সঙ্গে শুনল। সব শোনার পর হঠাৎ ওর মুখে একখানা প্রশান্তি ময় হাসি ছেয়ে গেল। ওর হাসি দেখে মাহীনের মনের বিচলিত ভাবটাও কেটে গেল নিমিষেই। রায়েদ প্রসন্ন কন্ঠে বলল, ‘এখন আমি বিশ্বাস করতে শুরু করেছি যে তুমি আসলেই কারো জীবনের গতি বদলে দেওয়ার ক্ষমতা রাখো। কিভাবে পারো?’
মাহীন মুখ টিপে হাসল। বলল,’তা কী করে বলি? আমার যা মন বলে হয় তাই করি। ব্যস।’ তারপর থেমে আবার বলল,’আর এখন পর্যন্ত আমার কোনো অদ্ভুত কাজকারবার বিফলে যায় নি এটা তো আল্লাহর অশেষ কৃপা।’
রায়েদ স্মিথ হেসে বললো,’আর আমারও ভাগ্য ভালো বলতে হবে যে তোমার সাথে দেখা হয়েছে।’
মাহীন হাসল। হঠাৎ আরেকটা অজানা কথা মনে পরে গেলো মাহীনের। যেটা শুধু ও নয় অনেকেই জানতে চায়। তবে সেটা নিয়ে এতদিন কোনোও প্রশ্ন করার সাহস হয়নি। তবে গত কিছুদিনে হয়তো করলেও করতে পারব। এখন হঠাৎ জানতে ইচ্ছে করল খুব। সাবধানে বলল,
‘আচ্ছা তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?’
রায়েদ আগ্রহী কন্ঠে বললো,
‘অবশ্যই বলো।’
মাহীন এক মুহূর্ত দ্বিধা করল। রায়েদ প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে সরাসরি ওর চোখের দিকে। মাহীন জানালার দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বলল,
‘আচ্ছা তোমার এবং বিলের মধ্যে কী হয়েছিল?’
রায়েদ শুধু ওর দিকে চেয়ে রইল। কিছু শুনেছে বলে মনে হলো না। তবে হঠাৎ ওর ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো। বলল,’অবশেষে তুমি আমাকে নিজে থেকে কিছু তো জিজ্ঞেস করলে।’
মাহীন মুচকি হাসল। রায়েদ এবার শান্ত কন্ঠে বলল,
‘বিল এবং আমার মধ্যে আসলে শুধুই ভুল বোঝাবুঝি লেগেছিল। যেটা এখনো ঝুলেই আছে।’
‘কী নিয়ে?’
‘আমার বাবা মারা গিয়েছেন সেটা ও শুনেছিল। তবে বাকি ঘটনাগুলো ওর অজানা ছিল। আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টাও করেছিল। তবে ওই কদিন আমি আমার ফোন বন্ধ করে বাহিরে গিয়ে বসে থাকতাম। ও আমার বাড়িতে এসেও আমাকে পেত না। এভাবে প্রায় এক সপ্তাহ পর যখন আমাদের দেখা হয়।
আমি তখনো ডিপ্রেশনে ছিলাম। এবং ও এসে প্রথমে আমাকে সান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করে। তবে ওরও একটা অভিমান ছিলো আমার ওপর যে, কেন আমি ওকে সবকিছু আগে জানালাম না। আমি কী ওকে বন্ধু মনে করি না। ও একবারও আমার মন মেজাজের অবস্থাটা বুঝতেই চেষ্টা করল না। তখন আমাদের বেশ একটা ঝগড়া লেগে যায়। ওই যে তখন থেকে দুজনই রাগ করে একে অপরের সাথে কথা বলা বন্ধ করেছি। সেটা এখনো অব্যাহত রয়েছে।’ কথাটা শেষ করে এক লম্বা নিঃশ্বাস বুক চিরে বেরিয়ে এল। মাহীন বেদনাহত এবং বিষন্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। ম্লানমুখে বলল,
‘একি কথা?ও কেমন বন্ধু হলো যদি তোমার খারাপ সময় তোমাকে বুঝতেই না পেরে তোমার পাশ থেকে সরে দাঁড়ায়।’
রায়েদ হালকা হাসল। মেঝের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘হয়তোবা এজন্যেই ওর আমার ওপর যতটা রাগ তার চেয়ে আমার ওর ওপর রাগ একটু বেশিই। সেদিন থেকে এখন পর্যন্ত মনে হয় ছোট বেলা থেকে ওই ছেলেটা কীভাবে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলো?’
মাহীন এবার নরম কন্ঠে বলল, ‘ও তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড কেন ফ্রেন্ড হওয়ারও যোগ্য ছিল না। নাহলে এভাবে দূরে সরে যেত না।’ বলে থামল। রায়েদ আর কিছু বললো না। জায়গাটায় নিরবতা ছেয়ে গেল। জানালার সামনে থাকা অরিগন এস গাছটির ডালে বসে কোনো এক পাখি টিউ টিউ করে ডাকছে। রায়েদই অবশেষে বলল,
‘সে যাই হোক। ও চলে গেছে তো চলে গেছে। তুমি আছ না আমার আর কোনো কারোরি দরকার নেই।’
মাহীন হাসল। হঠাৎ রায়েদের মাথায় এক দুষ্টুমি বুদ্ধি খেলে গেল। ভাবতে লাগল, হুম মাহীন গত একমাস যাবত ওর কান্ডকার্বার সম্পর্কে কিছু জানায়নি। সুতরাং আমারও ওকে একটু বিরক্ত করাটা তো যায়।’
নিজেকে প্রস্তুত করল। লম্বা এক শ্বাস ফেললো। মাহীন নিশ্চুপ ভাবে ওর পাশের চেয়ারে বসে আছে। রায়েদ একটু এগিয়ে গিয়ে মাহীনের কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘সো মাহীন তুমি তোমার বান্ধবীদের জানিয়েছো যে তুমি অফিশিয়ালি একটা রিলেশনশিপে আছো?’
মাহীন ভ্রু কুঁচকে তাকাল। জিজ্ঞেস করল, ‘কিসের রিলেশনশিপ? কার সাথে রিলেশন?’
‘আমার সাথে।’ মাহীন চোখ বড় বড় করে তাকাল। বলল, ‘এ্যই আমি তোমার গার্লফ্রেন্ড কবে থেকে হলাম? কি বলতেসো তুমি?’
রায়েদ এবার মাহীনের দুই কাঁধ জড়িয়ে ধরে বলল,
‘ওই যে সেদিন এনাহেইমে তুমি আমাকে প্রপোজ করলা। আমি সেটা একসেপ্ট করেছি।’
মাহীন নড়েচড়ে বসল। তীব্র কন্ঠে বলল, ‘আমি কখন তোমাকে প্রপোজ করলাম? স্বপ্ন টপ্ন দেখছিলা নাতো?’
রায়েদ নিজের মোবাইলটা বের করে একটা রেকর্ডিং চালু করে মাহীনের কানে ধরল। সেখানে শোনা যাচ্ছে মাহীনের কন্ঠ। টানা দশবার সেনি সেভিওরুম বলে যাচ্ছে। মাহীনের হঠাৎ মনে পরল যে ও এই বাক্যটা আসলেই ট্রান্সলেট করেছিল। এবং এর অর্থ মোটেও সেটা নয় যেটা রায়েদ বলেছিল। মাহীন ঝট করে রায়েদের ফোনটা হাতে নিয়ে নিল। মুহুর্তেই রেকর্ডিং টা ডিলিট করে দিলো। রায়েদ চমকে উঠে তাকিয়ে রইল। মাহীন এবার পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে রায়েদের মুখোমুখি হলো। আমুদে গলায় বলল, ‘এটার কথা তো আমি বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম। মনে করিয়ে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ। এখন আমাকে ট্রিক করার শাস্তি হলো তুমি আমাকে যতই প্রপোজ করো না কেন আমি একসেপ্ট করবো না।’
রায়েদ হেসে বললো, ‘কিভাবে তুমি একসেপ্ট না করে থাকো সেই ফন্দিও আমার কাছে আছে।’
মাহীন চোখ সরু করে তাকাল।
চলবে ইনশাআল্লাহ।
#এল_এ_ডেইস
পর্ব ৩৯
লেখনী মাহীরা ফারহীন
একের পর এক দিন গড়ালো। ক্যালেন্ডারের পাতা পাল্টালো। গরমটাও আরো বাড়ল। ক্যালিফোর্নিয়ার মরুভূমিগুলো আরোও উত্তপ্ত হয়ে উঠল। টানা দুই সপ্তাহ ছেলে মেয়েরা ধুমসে পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকল। কারোও আর স্কুলের আগে পরে ঘুরে বেরিয়ে, আড্ডা দিয়ে সময় নষ্ট করার মতো সময় থাকল না। পরীক্ষার ফারা কাটতেই এক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সকলে। এখন জুলাই চলছে। ক্যালিফোর্নিয়ায় জুলাই হলো বছরের সবচাইতে উষ্ণতম মাস। এই সময় পর্যটনদের আনাগোনা হ্রাস পায়। সাধারণ মানুষও কাজ ছাড়া বাড়ির বাইরে বের হয় না। ছাত্র ছাত্রীরা স্কুল শেষেই ছুটতে ছুটতে সেই যে বাসায় যায় অনেকে একেবারে পরেরদিন স্কুলের জন্য বাড়ি ছাড়ে। সন্ধ্যার গরমের রেশ কমে যায়। তখন শহরতলী হয়ে ওঠে জমজমাট। যতক্ষণ অব্দি আকাশে অন্ধকার ততক্ষণ নিচের জমিনে আলোর বন্যা বয়। চাতক পাখির মতো অপেক্ষায় আছে সকলে সেপ্টেম্বরের। সেই সময়ের দিকেই প্রকৃতি ঠান্ডা হতে শুরু করে। সূর্যের উত্তাপ কমে যায়। প্রকৃতি নানান সাজে সাজতে শুরু করে। পর্যটকদের আনাগোনা আবারও বেরে যায় এই সবুজ পাহাড় ও নীল সমুদ্রের ক্যালিফোর্নিয়ায়।
মাহীন রান্নাঘরের কাউন্টারের ওপর বসে আছে পা ঝুলিয়ে। বাইরের গোধূলির আলোর ছটা জানালা দিয়ে ভেতরে এসে পরছে। মাহীনের হাতে গরম গরম ধূয়া উঠা লালচে টার্কিশ চা। মিসেস রহমান মাত্র কেতলি থেকে ঢেলে ওকে এককাপ ধরিয়ে দিলেন। ট্রেতে আরোও তিনটে টার্কিশ কাপ রাখা। সেদিকে চেয়ে থেকে মাহীন ক্ষীণ হেসে ভাবল, বোধহয় একটা কাপ রায়েদের জন্য। বাহ!’
গত দুই মাসে প্রায়শই এ বাড়িতে আসত মাহীন। এ বাড়িতে কখন কী হয় সে সব সম্পর্কে এখন ওর জানা আছে। বিকেলের এই সময়টায় বাড়ির সকলেই চা খান এবং খোশগল্প করেন। মিসেস মাদির পায়ে ইদানীং ব্যথা বলে তিনি খুব একটা নিজ কামরা থেকে বের হন না। মিসেস রহমান তার চা টা কামরায় দিয়ে আসলেন। রাবিত বাসায় নেই। তবে রায়েদ নিজের কামরায় আছে। বোধহয় এখনো জানেই না মাহীনও ওর বাসায়ই আছে। মিসেস রহমান ফিরে আসতেই মাহীন চা টা রেখে, বারের ওপর থেকে লাফ দিয়ে নামল। তারপর বলল,
‘আন্টি রায়েদের চা টা আমি দিয়ে আসি?’ সামান্য তম দ্বিধা করলো না প্রশ্নটা করতে। কারণ ওর জানা আছে মিসেস রহমানের প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে। উনি হালকা হেসে বললেন,
‘কেন নয়। অবশ্যই যাও।’ মাহীন একটা চায়ের কাপ উঠিয়ে নিতেই উনি আবার বললেন,
‘না, না ওটা নয়। ও একটু কড়া চা খায়।’
মাহীন ওটা রেখে আরেকটা কাপ তুলে নিল। এই কাপের চায়ের রঙ তুলনা মূলক ভাবে গাঢ়। তারপর সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে ভাবল, বাহ মিসেস রহমান কতটা সুক্ষ্ণ ভাবে খেয়াল রাখেন কার কোনটা পছন্দ। শুধু তার মনে পরিবর্তনটা তিনি ঠিক ভাবে প্রকাশ করতে পারছেন না। তাতে কী রায়েদ তো সবই দেখছে, বুঝতেও পারছে।’
মিসেস রহমানের চিকিৎসার ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে।
নিয়মিত সেলির প্রেসক্রাইব করা ঔষধ খাচ্ছেন। সেলি ঘন ঘন কাউন্সিলিং করেন। রায়েদের সঙ্গে খুব একটা কথা তার এখনো হয় না। তবে মাহীনকে অনেক কথা বলেন। শুধু তাই নয় মিসেস মাদিহ এবং রাবিতকেও রায়েদের প্রতি তার মনোভাবের কথা খুলে বলেন। এখন রায়েদের জন্য তার চিন্তা হয়। ও কী করছে, কেমন আছে সেসবও যথাযথ ভাবেই পর্যবেক্ষণ করেন। তবে নিজে থেকে কিছু জিজ্ঞেস করবেন, এক দন্ড সময় দিয়ে কথা বলবেন তা ঠিক হয়ে উঠছে না। তবে তিন বেলার খাবারের পাটে রায়েদ উপস্থিত থাকে। মাঝেমধ্যে টুকটাক কথা বলেন যেমন, আজ তারিখ কত, রাবিত কোথায় বা প্রায়শই চা, কফি কিছু খাবে কিনা জিজ্ঞেস করেন। রায়েদ নিজে থেকে মায়ের সাথে কথা বলবে তা ওর সাহসে কুলোয় না। সবসময়ই মনে হয় মায়ের এই সুমিষ্ট আচরণ এই বুঝি কর্পূরের মতো উড়ে গেল। এত বছরে তাদের মাঝে দূরত্বের এক অদৃশ্য দেয়াল গড়ে উঠেছে। সে দেয়াল এত উঁচু যা সহজে টপকানো যায় না। রায়েদের ভালো থাকার খবর সাধারণত মাহীনের কাছ থেকেই নেন। রায়েদের পছন্দ অপছন্দগুলো মাহীন বোধহয় ওনার থেকে বেশিই জানে এখন।
মাহীন সন্তর্পণে ওপরে উঠে এলো। সামনের করিডোর আঁধারে ছাওয়া। এগিয়ে গিয়ে দরজায় টোকা দিল। ততক্ষণাৎ ভেতর থেকে ভেসে এলো ভারি কন্ঠস্বর,
‘কাম ইন।’
মাহীন দরজাটা খুললো। এই তল্লাটে এক জিনিস দেখে মাহীন কখনোই অবাক না হয়ে পারেনি। তা হলো কোনো বাড়িতেই বেডরুমের দরজায় লক লাগানোর বাড়তি ঝামেলাটা কেউ করে না। এই দরজায়ও কোনো লক ছিলো না। মাহীন দরজাটা ঠেলতেই খুলে গেল। অন্ধকার করিডরে ভেতর থেকে ম্লান আলো এসে পরল। রায়েদ নিজের বিছানায় বসে ছিলো। হাতে একটা বই। খোলা জানালা দিয়ে আকাশের কমলাটে মুখ দেখা যায়।মাহীন ভেতরে আসতেই ও বইয়ের দিক থেকে চোখ সরাল। মাহীনকে দেখেই এক গাল হেসে বলল,
‘তোমাকে যে আমার বাসায় কখন দেখতে পাবো তার কোনো ঠিক নেই। চাও দেখি আজকাল তুমিই আনছো।’
মাহীন মুখ টিপে হাসল। চা নিয়ে এগিয়ে এসে বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
‘আমি আজই প্রথম তোমার জন্য চা এনেছি। আজকাল কোথায় পেলা? আর হ্যা চা টা কিন্তু মিসেস রহমান বানিয়েছেন। ‘
রায়েদ চায়ের কাপ ওর হাত থেকে নিয়ে বলল,
‘তাই নাকি। কখন এলে?’
‘এই তো আধঘন্টা হলো।’
‘বসো না, দাঁড়িয়ে আছো কেন?’
মাহীন বলল,
‘না, না আমার চা নিচে রয়েছে। ঠান্ডা হয়ে যাবে। এবং মিসেস রহমানকেও তো কাম্পানি দিতে হবে।’
রায়েদ প্রমত্ত কন্ঠে বলল,
‘এবং আমাকে কে কাম্পানি দিবে?’
মাহীন হেসে ফেললো। বলল,
‘বাচ্চার মতো বলছো। স্যাডো এন্ড বোনস এবং এক কাপ চা মানেই অন ফ্লিক। আর কী চাই।’
রায়েদ চোখ ছোট করে বলল,
‘মায়ের সাথেই দেখা করতে আসো নাকি আমার সাথে?’
মাহীন দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,
‘আন্টির সাথে।’ থেমে আবার ‘আসছি’ বলেই বেরিয়ে গেল। দরজাটা আবার চাপিয়ে দিয়ে বিড়বিড় করে বলল,
‘এবং তোমাকে এক নজর দেখতে।’
নিচে নেমে এসে নিজের চা টা নিয়ে মিসেস রহমানের সঙ্গে বাগানে সাদা টেবিলে বসল। বিকেলের সুমিষ্ট সোনালি রোদে গোটা বাগান মেখে রয়েছে। বড় বড় হলুদ ও সাদা ড্যাফোডিল, ডালিয়া ও রঙবেরঙের পেতুনিয়ায় বর্ণিল আবহ। ক্লান্ত সূর্যর মরা আলোয় উত্তাপ নেই। বাতাস বইছে। বাতাসের সঙ্গে মিশে গিয়েছে নানান ফুলের মিষ্টি সুবাস। মাহীন চেয়ার টেনে নিয়ে বসতেই মিসেস রহমান জিজ্ঞেস করলেন,
‘কী করছে ও?’
‘বই পরছিল।’
‘ওহ আচ্ছা শুধু পড়তেই তো দেখি সারাদিন। আর কিছু করে না?’
বিভিন্ন জায়গায় পার্ট টাইম জব করার ব্যাপারটা চেপে গিয়ে বলল,
‘কি আবার। পড়ে, ঘুরে বেড়ায়, প্রকৃতি দেখে আবার পড়ে।’
মিসেস রহমান হালকা হাসলেন। এটা সেটা নিয়ে কথা বলতে বলতে হঠাৎ ওপরে রায়েদের কামরার জানালার দিকে চোখ গেল মাহীনের। ও যেখানে বসেছে সেখান থেকে সরাসরি জানালাটা দেখা যায়। জানালার উইন্ডোশীলে বসে রায়েদ এদিকেই তাকিয়ে আছে। না শুধু এদিকে নয় বরং বিরতিহীনভাবে আবিষ্ট নয়নে মাহীনের দিকে তাকিয়ে আছে। মাহীন কিছুটা বিব্রতবোধ করল। চোখ নামিয়ে নিল আবার। তবে রায়েদ সেখানেই এক যোগে বসে রয়েছে। নড়েই না। বারবার উপরের দিকে চোখ চলে যায় মাহীনের। চা-টা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। আবার ওপরে জানালার দিকে চাইতেই রায়েদ বাম চোখ ব্লিঙ্ক করল। মাহীন হঠাৎ হেসে ফেললো। মিসেস রহমান অবাক হলেন। তিনি বোধহয় অন্য কথায় ব্যস্ত ছিলেন। মাহীন জানালার দিকে তাকিয়ে ছিল। উনি ঘাড় ঘুরিয়ে জানালার দিকে তাকালেন। তবে রায়েদ আর সেখানে নেই। উনি এবার মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
‘কী হয়েছে মাহীন হঠাৎ করে এমন হাসছ যে?’
মাহীন হাসি থামিয়ে অপ্রতিভ ভাবে বলল,
‘আসলে ওই যে গাছের ডালে দুটো কাঠবিড়ালি ছিলো। তো ওরা হঠাৎ করেই একটা বাদাম না কী যেন নিয়ে কী সুন্দর মারামারি শুরু করল। ওটা দেখে হেসে ফেলেছি।’
মিসেস রহমান ভ্রু উঁচিয়ে বললেন,
‘এটা দেখে তুমি হেসে ফেলেছ?’ বলে তিনি হেসে উঠলেন। মাহীন দেখলো রায়েদ আবার জানালায় এসে দাড়িয়েছে। এবং হাসছে। মাহীন মনে মনে ভাবল, কী খারাপ। আমাকে কী অপ্রিতিকর, বিব্রতকর পরিস্থিতিতেই না ফেললো। হুহ!’
অতি যত্নে ভাজ করা সাদা কাগজের একটি চিঠি নিয়ে এগিয়ে এসে আরেকজনকে হাত বদল করে দিল। সঙ্গে কিছু কথা বলল। এবার সে চিঠিটা নিয়ে একের পর এক কক্ষ অতিক্রম করে একটি বড়সড় ছাদ খোলা স্থানে এসে পৌঁছল। গোল গোল টেবিলগুলো জুড়ে বসে আছে ছেলেমেয়েরা। সে চিঠি হাতে একটি টেবিলের দিকে এগিয়ে এসে শ্যাম বর্ণের একটি মেয়ের দিকে চিঠিটা এগিয়ে দিল। হঠাৎ এমন একটা চিঠি পেয়ে অবাক হলো মাহীন। র্যবিট চিঠিটা দিয়েই অন্য দিকে চলে গেল। মাহীনের সঙ্গে সাইলোহ, নায়েল, জেনেট ও লিও বসে আছে। সকলেই হ্যামবার্গার খাচ্ছিল। মাহীন চিঠিটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরল। খাম খুলে চিঠিটা বের করে পড়তে লাগল। পাশ থেকে জেনেট উঁকি ঝুঁকি দেওয়ার চেষ্টা করছিল। বাকি তিনজনও উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মাহীন সেসব কোনো দিকে দৃষ্টিপাত না করে গভীর মনোযোগের সঙ্গে চিঠিটা পড়ছে। পড়তে পড়তে দুই ঠোঁট প্রসারিত হয়ে মিষ্টি একখানা হাসি ছড়িয়ে গেল সারা মুখে। চিঠিটা পড়া শেষ করেই তাড়াহুড়ো করে সেটা ভাজ করে পকেটে ঢুকিয়ে রাখল। এখনো আনন্দে আটখানা হয়ে নিজের চিন্তায় ডুবে রয়েছে। সামনে যে চারজন মানুষ বসে অপেক্ষায় রয়েছে কিছু জানার জন্য সেদিকে হুঁশ নেই। অবশেষে জেনেটই অধৈর্য্য হয়ে বলল,’মাহীন কিসের চিঠি ছিলো ওটা?’
মাহীন চমকে উঠল। এতক্ষণে খেয়াল হলো সামনে কতগুলো মানুষ বসে আছে। নিজেকে সংযত করে বলল,’কী?’
‘না বলছি আমাদের কী বলা যাবে কিসের চিঠি ছিলো ওটা?’ জিজ্ঞেস করল সাইলোহ। হঠাৎ মাহীনের গাল দুটোয় হালকা লালচে আভা ফুটে উঠলো। লিও বলল,
‘এই এমন লজ্জা পাওয়ার মতো কী হলো?’
মাহীন অপ্রস্তুত হলো। লজ্জা নামক অনুভূতিটার প্রতি বড্ড রাগ হলো। সেই অনুভূতি আছে তো থাক তার ফলে আবার গাল আরক্ত হয়ে উঠে কী করতে? সকল অনুভূতিগুলোই যেন মনের আঙ্গিনা থেকে বের করে এনে উগলে দেয় সকলের সামনে। নায়েল ফিচেল হাসি দিয়ে বলল,
‘আহা ম্যাডাম কী লজ্জাটাই না পাচ্ছে। কেউ প্রপোজ টপোজ করল নাকি?’
বাকি তিনজন হেসে উঠল। মাহীনও হেসে উঠে বলল,
‘ধ্যাৎ! এমন কিছু না। আর তোমাদের অত জানা লাগবে কেন?’
জেনেট নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল,
‘ওহ ঠিক আছে। র্যবিট দিয়ে গেছে চিঠিটা। তাহলে ধরেই নেয়া যায় ব্যাপারটা রায়েদের সঙ্গে জড়িত।’
লিও বলল,
‘হ্যা র্যবিটকে জিজ্ঞেস করলেই তে জানা যাবে।’
মাহীনের সত্যি এবার রাবিতের প্রতি রাগ হলো। কোন কুক্ষণে যে সবার সামনে চিঠিটা দিতে হলো ওকে কে জানে!’
সাইলোহ হালকা দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল,
‘হেই বলো না। এখন রায়েদকে আমারও খুব একটা খারাপ লাগে না। এবং তোমাদের কিন্তু সত্যি একসাথে বেশ মানায়। ওই চিঠিটা দিয়েছে তাই না।’
মাহীনের লজ্জায় মাটি ফুরে ভেতরে লুটিয়ে পরতে ভিষণ ইচ্ছে হলো। অবশেষে অতিষ্ঠ হয়ে বলল,
‘ঠিক আছে। রায়েদই চিঠিটা আমাকে দিয়েছে। কিন্তু আর কিছু বলবো না।’ বলেই উঠে দাঁড়াল। তারপর বলল,
‘আমি এখানে থাকলে তোমরা নাছোড়বান্দার মতো পেছনে পরে থাকবা। তার থেকে বিদেয় হই।’ বলেই গেটের দিকে প্রায় ছুটে গেল।
.
.
.
.
‘আয়ায়ায়ায়ায়ায়া! ওহ আল্লাহ আমার বিশ্বাস হচ্ছে না!’ প্রায় চিৎকার দিয়ে বলল মাহীন। বলেই আনন্দে নিজের বিছানায় ঝাপ দিয়ে উঠে বসল। ওর মনের মধ্যে একখানা চিঠি যেন তমসাচ্ছন্ন শীতের বুড়িকে উচ্ছেদ করে বর্ণিল ফুলের সুঘ্রাণ মিশ্রিত বসন্তের হাওয়া ঝাপটা দিয়ে গেল। জানালার বাইরে স্যকামোর গাছের ঝাকড়া ডালের আড়ালে নাইটিংগেল পাখি সুর তুলে ডাকছে। এক ডাল থেকে আরেক ডালে ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছে দুষ্টু অদুরে কাঠবিড়ালি। মাহীন বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে জানালার উইন্ডোশীলে গিয়ে পা উঠিয়ে বসল। বুক ভরে বাগান থেকে হাওয়ার তোরে ছুটে আসা জুই ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণ শুষে নিল। আবার আনমনেই হেসে উঠল। ভাবতে লাগল, আহা অতি কাঙ্ক্ষিত কোনো জিনিস যেটা মুখে না করে আসলেও মনে চেয়ে এসেছি তা হঠাৎ করেই পেয়ে গেলে যে কতটা আনন্দ হয় তা এর চাইতে ভালো ভাবে এর আগে বুঝতে পারিনি। মুখে যেমন বলতাম মনে মনেও কিছুটা বিশ্বাস ছিলো যে রায়েদের আমার প্রতি কখনো অমন অনুভূতি হবে না যেমনটা আমার ওর জন্য হয়। আহা ওকে ভালো লাগার কথাটা কখনো কাউকে মুখ ফুটে বলতে পারলাম না। ওফ আমার মরার ট্রাস্ট ইশ্যু! সামান্য কথাটা কাউকে বিশ্বাস করে বলতেও পারি না। সে যাই হোক, অবশেষে আমার আশাটায় আলোড়ন ঘটতে শুরু করেছে দেখি!’ ভাবতে ভাবতেই জিনসের পকেট থেকে চিঠিটা বের করে আবারও পড়তে লাগল।
“মাহীন! যাবে আমার সাথে লস এঞ্জেলস ঘুরতে? ডেট হিসেবে? নিজে থেকে ডেটের প্রস্তাব আগে কখনো কাউকে দিয়েছি বলে মনে পরে না। কেনো জানি তোমাকে দিতে খুব ইচ্ছে করল। কাল নয় তারিখ উইকএন্ডে দুপুর বারোটায় মেট্রোর সামনে দেখা হবে। লাঞ্চ আমরা একসাথেই করব এল এ তে পৌঁছে।”
রায়েদ।
চিঠিটা পড়ে আবারও গালে গোলাপি আভা ছড়িয়ে পরল। তবে এখন সেটা দেখার মতো কেউ নেই কাছেপিঠে। আবার মনে মনে ভাবল, আহা ডেট! আমি কখনো ডেটে যাইনি। হ্যাংআউট এবং ডেটের মধ্যে কীই বা এমন পার্থক্য হয়? ডেটের মধ্যে বিশেষ কী রয়েছে? এটা কী শুধুই পশ্চিমাদের দেওয়া কাপলদের জন্য আলাদা একটা টার্ম না? চাইলেই আমাদের সূর্যদয় দেখা, নৌকা চড়া, ডিজনিল্যান্ড যাওয়া সবগুলোকেই ডেট বলে আখ্যায়িত করা যায়। তবে ডেট বললেও সেটা শুধু আর ঘুরতে যাওয়া থাকে না। ব্যাপারটা আসলেই কালের পরিক্রমায় অন্য রকম হয়ে গিয়েছে। আহ তাহলে অবশেষে আমি এল এ তে যাচ্ছি? তাও ওর সাথে? কালকে নয় আগস্ট। কিন্তু ওতো আমাকে মুখেও বলতে পারতো। এনিওয়েজ চিঠিটাই বেশি এসথেটিক রোমান্টিক লাগছে। আর হ্যা বোধহয় সেই পিকনিকের ইনভিটেশনেরই প্রতিশোধ নিলো চিঠি দিয়ে। কিন্তু যাই হোক ও যে আমাকে ডেটের প্রস্তাব দিয়েছে এটাই তো বড় কথা।’ ভাবতে ভাবতেই বাইরে নীল আকাশের দিকে চোখ তুলে চাইল। ধূয়া ধূয়া মেঘগুলোকে বাতাস ঠেলতে ঠেলতে পশ্চিমে নিয়ে চলেছে। ঈগল ডানা মেলে উড়ছে সবচেয়ে উঁচুতে। চোখের সম্মুখে স্যকামোর গাছের ডালে ছোট কমলা রঙের আদুরে এক ক্যানারি পাখির জুটি দেখা গেল। থেকে থেকে টুই টুই করে ডেকে উঠছে পালা করে। হঠাৎ অদ্ভুত এক চিন্তার আবির্ভাব ঘটলো মনের ভেতর। প্রশান্তির সঙ্গে গাছে বসে থাকা ক্যানারি পাখির দিক থেকে মনোযোগ সরে গেলো। ভ্রু সুচালো হলো। ভাবতে লাগল, আচ্ছা আসলেই কী রায়েদ কয়েকমাসেই একদম অপরিচিতা থেকে একজনকে পছন্দ করে ফেলতে পারে? ও কী সত্যিই আমাকে পছন্দ করে? নাকি আমি ওর জন্য এবং ওর মায়ের জন্য যা সব করেছি তার কৃতজ্ঞতা স্বরুপ এসব করছে? কিন্তু তাই বলে ডেটের প্রস্তাব দেয়া তো কৃতজ্ঞতা স্বরুপ করার মতো কাজ নয়। ওহ নাহ নাহ, আমি বেশিই ভাবছি। বেশি ভেবে জল ঘোলা করার চেয়ে কালকে আমি কী কী করব এল এ তে গিয়ে সেটা নিয়ে ভাবা উচিৎ।’
.
.
.
সাওয়ার নিয়ে মাত্র ওয়াশরুম থেকে বের হলো মাহীন। এক স্নিগ্ধ সতেজতায় ভরে গিয়েছে মন। ও বেরিয়ে আসতেই সারা কামরায় ভুরভুর করে সাওয়ার জেলের সুবাস ছড়িয়ে গিয়েছে। হলদে কাজ করা কলাপাতা রঙের এক কুর্তি এবং হলুদ প্লাজো পরেছে। হঠাৎ নাইমকে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দেখে থমকে দাঁড়ালো। নাইম অতি মনোযোগ সহকারে কিছু একটা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। মাহীন প্রায় ছুটে গিয়ে কাগজটা ওর হাত থেকে ছিনিয়ে নিল। ঝাঁঝ ভরা কন্ঠে বলল,
‘কী আশ্চর্য! তুই আমার কামরায় এসে আমার বিনা অনুমতিতে আমার জিনিস কিভাবে ধরিস!’
নাইম কোমরে দুই হাত রেখে টিটকারির কন্ঠে বলল,
‘ওহ তাই না? সেটা নিয়ে আমরা পরেও কথা বলতে পারব। এখন আগে আপনি বলেন। আপনি নাকি ডেটে যাচ্ছেন?’
মাহীন অপ্রস্তুত হলো। অপ্রতিভ ভাবে চিঠিটা ভাজ করল। লজ্জায় মাটি ফুরে ভেতরে ঢুকে যেতে ইচ্ছে করছিল। আর কখনো বেরিয়ে আসবে না ও। তবে লম্বা শ্বাস নিয়ে বিব্রত কন্ঠে কোনোক্রমে আমতা আমতা করে বলল,
‘শুধু…একটা চিঠি দেখে তুই আজাইরা কথা বলতে পারিস না।’
বলে চিঠিটা ড্রয়ারে ঢুকিয়ে রেখে লোশনটা তুলে নিল। নাইম সিঙ্গেল সোফায় ধপ করে গিয়ে বসল। বলল,
‘তাই? তো তুই রায়েদের সঙ্গে ডেটে যাবি না?’
রায়েদের নামটা অতি উচ্চকন্ঠে উচ্চারণ করল। মাহীন এবার বিরক্ত হয়ে বলল,
‘তোর এত নাক গলাতে হবে কেন?’
নাইম চোখ ছোট করে বলল,
‘এই কবে থেকে চলছে তোদের এই সম্পর্ক? আমাদের বাড়ি ঘুরে গিয়েছে রায়েদ তার আগে থেকে?’
‘ধ্যাৎ! আমার কারো সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। শুধু একটা ডেটের প্রস্তাব এসেছে মাত্র।’
নাইম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,’তোর বন্ধুদের ধোকা দিতে পারিস তবে আমাকে নয়। রায়েদকে যে তুই পছন্দ করিস এই ব্যপারে আমার আগে থেকে ঘোর সন্দেহ ছিলো। নাহলে ওর প্রতি শুধু না ওর পরিবারের প্রতিও তোর এতো টান কেন? আর কী যেনো?’ বলে একটু কিছু একটা ভাবার ভান করল। তারপর বলল,
‘ওহ হ্যা তোরা আগেও ডেটে গিয়েছিস। সানসেট, সানরাইজ, ডিজনিল্যান্ড ব্লাহ ব্লাহ.. মাহীন মাঝখান দিয়ে বলল,’ওইসব ডেট ছিলো না। হ্যাঙ্গআউট ছিলো।’
‘ওহ তাই তো কী হয়েছে রায়েদ তো তোকে পছন্দ করে সেটা বোঝাই যাচ্ছে। বাই দ্যা ওয়ে রায়েদের ভাগ্য কিন্তু ভালোই বলতে হবে কিছু শুরু হওয়ার আগে থেকেই জামাই আদর পাওয়া শুরুও করে দিয়েছে মায়ের কাছ থেকে।’
মাহীনের গালে লালাভা ছড়িয়ে গেল। লজ্জায় অস্বস্তিতে কাঁদা হয়ে রইল। একই দিনে এতটা ইমব্যারেসমেন্টে আগে কখনো পরতে হয়নি। তবে একথায় ঝাঁঝাল কন্ঠে বলল,
‘একটা ডেটের প্রস্তাব আসছে মাত্র। আর আমি এখনো এটাও বলিনি যে যাবো কি যাবো না। আর তুই ওকে জামাই বানায় দিলি। আজ তোর একদিন কী আমার একদিন।’ বলে বিছানা থেকে একটা ছোট কুশন তুলে ছুঁড়ে মারল নাইমের দিকে। নাইম হাসিখুশি মুখে কুশনটা ধরে ফেললো। বলল,’তাহলে তুই ডেটের প্রস্তাব বাতিল করে দিবি? আহারে রায়েদের মতো ভালো পাত্রকে রিজেক্ট করে দিবি?’
মাহীন জ্বলন্ত দৃষ্টি নাইমের দিকো তাকাল। এবার উঠে এসে এলোপাথাড়ি নাইমের ঘাড়ে কিল ঘুসি মারতে লাগল। নাইম কোনো ক্রমে ওকে থামিয়ে নিয়ে বলল,
‘বল না তুই যাবি না?’
মাহীন অবশেষে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধপ করে বিছানায় শুয়ে পরল। মনে মনে ভাবল, আচ্ছা মুশকিলে পরা গেলো তো। নাইম তো বাসায়ই থাকবে। না বলেও উপায় নেই। যদি বলি যাবো না তাহলে সারাদিন আমার সাথে চিপকে থাকবে দেখার জন্য যে আমি আসলেই যাই কিনা।’ ভেবেই ফট করে বলল,
‘ধুর ছাই! ঠিক আছে আমি যাবো! একশোবার যাবো! আর তুই কোনো কথা বলবি না।’ নাইম এবার হেসে উঠে বলল,’এইতো লাইনে এসেছিস! আমি জানতাম তুই আবার এমন প্রস্তাব বুঝি নাকোচ করে দিবি।’
ইনশাআল্লাহ চলবে।