এল এ ডেইস পর্ব-৪০+৪১

0
283

#এল এ ডেইস
পর্ব ৪০
লেখনী মাহীরা ফারহীন

রুপোলী রঙের চকচকে ঝকঝকে মেট্রো। রেললাইন ফাঁকা। ট্রেন এসে পৌঁছোয়নি এখনো অব্দি। পরিষ্কার সুবিস্তীর্ণ আকাশ। পেলব সাদা গুচ্ছ গুচ্ছ মেঘগুলো যেন স্থির দাঁড়িয়ে পৃথিবী বাসীদের দেখছে। আদতে মেঘগুলোও ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে কোনো দুর অজানার পথে। অপেক্ষমান যাত্রীরা কেউ বসে লস এঞ্জেলস টাইমসের খবরের কাগজ পড়ছে। কেউ বা বসে সেলফোনে মুখ গুঁজে রয়েছে। রায়েদ অপেক্ষায় এদিক ওদিক চাইছে। মাহীনের দেখা মিলছে না। কিন্তু মনে হচ্ছে ও আশেপাশেই কোথাও আছে। ধীর গতিতে হাঁটতে হাঁটতে পরখ করছে সবটা। ভিড়ের মাঝে সদ্য ফুটে থাকা পেঁয়াজি রঙের স্নিগ্ধ পদ্ম ফুলের মতো মেয়েটির দিকে চোখ আঁটকে গেল। পেঁয়াজি রঙের সোনালী সুতোর হালকা কাজ করা কুর্তি ও জিনস পরেছে মাহীন। গলায় সোনালি ওড়না পেঁচানো। কাঁধের একটু নিচ পর্যন্ত লম্বা চুলগুলো ঢেউ খেলানো। বোধহয় কার্ল করেছে। রায়েদ এগিয়ে যাচ্ছে সেদিকে। মাহীন ওকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে আসল। সাধারণত ওর চোখের নিচের পাতায় কাজলের এক ক্ষীণ আঁচড় সবসময়েই দেখা যায়। আজও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে আজ গাড়ো করে কাজল দিয়েছে। ডান কানে সোনালী পাথরের একটা টপ পরেছে। সবমিলিয়ে স্নিগ্ধ লাগছে। অসংখ্য ভিড়ের মাঝে এক অনন্যা যেন। মাহীন এসে এক গাল হেসে বললো, ‘মর্নিং!’
রায়েদ পরিপূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থেকে বলল,’মর্নিং। তোমাকে অন্যরকম লাগছে।’

‘ভালো লাগছে না?’

‘অন্যরকম সুন্দর লাগছে।’

মাহীনের গাল গোলাপিবর্ণ ধারণ করল। কোনো ক্রমে বলল,’আর তোমাকেও অনেক সুন্দর লাগছে।’
রায়েদ একটা সাদা টি-শার্টের ওপর কালো শার্ট পরেছে এবং জিনস। ছোট ছোট রেশমি চুলগুলোয় এলোমেলো ভাব। সুন্দর মুখখানায় প্রফুল্লতার ছোঁয়া।
রায়েদ মুচকি হেসে বলল, ‘ধ্যাৎ ছেলেদের আবার সুন্দর বলে?’
‘তো সুন্দর লাগলে কী বলবো? বোকা তুমি।’
রায়েদ আর কিছু বললো না। কিছুক্ষণ পর লস এঞ্জেলস গামি ট্রেন স্টেশনে এসে পৌঁছল। সাড়ে এগারোটা বাজে। ওদের যাত্রাপথে টুকটাক কথা হলো। কেউ কোনো কথাই খুঁজে পাচ্ছে না যেন। কেমন জানি এক অস্বস্তি ভাব। ট্রেনে বসার পর হঠাৎ মনে পরে গিয়েছে এবার ওরা অফিশিয়ালি ডেটে এসেছে। ব্যস! রায়েদ কিছু বললেই মাহীন লজ্জায় গুটিয়ে যাচ্ছে। ট্রেন লস এঞ্জেলস পৌঁছল প্রায় দেড় ঘন্টা পর। মেট্রোতে সবসময়ই বেশি সময় লাগে। তার চেয়ে গাড়িতে ত্রিশ মিনিটের মতো লাগত। তবে ট্রেন যাত্রায় ক্যালিফোর্নিয়ার নজরকাঁড়া ছবির মতো সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্যগুলো স্মৃতি বদ্ধ করা যায়। ট্রেনের জানালাকে মনে হয় এক চলন্ত ছবির ফ্রেম। ফ্রেমের ভেতর সাই সাই করে দৃশ্য পাল্টে যাচ্ছে। কোনো দক্ষ শিল্পীর অতি যত্নে আকা নিখুঁত ছবিগুলো। পরিষ্কার আকাশের নিচে কখনো চোখে পরে সুবিস্তৃত সবুজ ঘাসের মাঠ। কখনো থোকা থোকা হাজারো লাল টসটসে আঙ্গুরের বাগান। ওয়াইন ফ্যাক্টরি। আবার কখনো ছোট ছোট পাহাড়। পাহাড়ের সারা গা জুড়ে ঠাসাঠাসি করে দাঁড়িয়ে পাইন কিংবা সিডার গাছ। মাঝেমধ্যে গোলাপি ফুলে মোড়া ঝাঁকড়া ক্র্যাবঅ্যাপলের গাছও চোখে পরল। এল এতে নামার পর ওরা প্রথমেই ঠিক করল আগে লাঞ্চটা সেরে ফেলবে। পেট খালি থাকলে ঘুরেফিরে মন ভরবে কী করে? মাহীনের খুব ইচ্ছা ছিলো মুসো এন্ড ফ্র্যাঙ্ক থেকে লাঞ্চ করবে। কিন্তু তা আর হলো কোথায়। মুসো এন্ড ফ্র্যাঙ্কের মতো বিখ্যাত শৌখিন রেস্টুরেন্টে সপ্তাহ খানেক আগে থেকেও বুকিং দিলে মাঝেমাঝে আসন পাওয়া যায় না। সেখানে ওরা হঠাৎ হাজির হয়েই আসন পেয়ে যাবে তা তো আকাশকুসুম ব্যাপার। ওরা অন্য একটা রেস্টুরেন্ট থেকে খাওয়া দাওয়ার পাট চুকিয়ে স্টারলাইনের লাল রঙচঙে সিটি স্ট্রলিং বাস ধরল। স্টারলাইন সিটি স্ট্রলিং বাস বিশেষ ভাবেই পর্যটকদের সারা শহর দর্শন করানোর জন্যে। ওরা সোজা হলিউড ‘ওয়াক অফ ফেম’ এ গিয়ে পৌছলো। মাহীনের আনন্দ যেন গায়ে ধরে না। বাস থেকে নামার পর থেকেই প্রায় উড়ে উড়ে হাঁটছে। ‘ওয়াক অফ ফেম” মূলত রাস্তার পাশের চওড়া কালো টাইলস করা প্রশস্ত বোর্ডওয়াক। কালো টাইলসের মাঝে সারি সারি গোলাপি রঙা বড় বড় তাঁরা। এসব একেকটা তাঁরায় হলিউডের মোটামুটি সমস্ত তারকাদের নামই স্বর্ণাক্ষরে খোদাই করা আছে। প্রতিদিন প্রতিনিয়ত অসংখ্য মানুষ এই তারকাদের নাম খচিত কালো টাইলসের রাস্তা ধরে হেঁটে যায়। কোনো তাঁরা আবার খালি বসে থাকে নতুন তারকাদের অপেক্ষায়। কেনো যে এত টাকা খরচ করে ঘটা করে নিজের নাম তারকারা এই রাস্তায় লিখতে যায় কে জানে! দিন শেষে তো মানুষ তাদের নাম মারিয়ে হেঁটেই যাচ্ছে। ফুটপাথের পাশেই লম্বা বেড়ার মতো তাল গাছগুলো সারি সারি দাঁড়িয়ে। মাহীন হাঁটতে হাঁটতে বলল, ‘হাহ ওয়াক অফ ফেম থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নামের তারাটা না ভেঙ্গে ফেলা হয়েছিল?’

‘হ্যা তা তো হয়েছিলোই। তবে ওটা এখন ফাঁকা তাঁরা। দেখে বিশেষ কিছু মনে হয় না।’

‘ইশ কী দশা।’ শেষের কথাটা আফসোস ভরা কন্ঠে বলল। রায়েদ জিজ্ঞেস করল,’এর আগে এল এ তে আসোনি কখনো?’

‘নাহ আমি তো ইউএসএ তেই এলাম ছয় মাস হতে চললো। বাই দ্যা ওয়ে তুমি কোন কোন স্টেট ঘুরেছো?’

রায়েদ প্রসন্ন কন্ঠে বলল, ‘ডিসি, ওয়েমিং, নিউ ম্যাক্সিকো,কেনটাকি, আটলান্টা, আরকানসাস ও টেক্সাসে গিয়েছি।’

‘ওয়াও তুমি তো অনেক জায়গা ঘুরেছো। নিউইয়র্ক যাওনি?’

‘নাহ ওখানে কখনো কেন জানি যাওয়া হয়নি।’

‘আচ্ছা তোমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর স্টেট কোনটা ছিল?’
মাহীন ভাইবা পরীক্ষার মতো একের পর এক প্রশ্ন করেই চলেছে। এ প্রশ্নের উত্তরে রায়েদকে কিছুটা ভাবতে হলো। ভেবে বলল, ‘প্রতিটা স্টেটেরই নিজস্বতা এবং সৌন্দর্য রয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে ওয়েমিং গিয়ে। স্টেটটা বড় সুন্দর।’ মাহীন সায় জানিয়ে মাথা নাড়ল। ওরা ব্লেক লিভলি ও নিনা ডভরেভের নাম খচিত তাঁরা পার করে গেলো। ফুটপাথের পাশে আবার বড় বড় ছাউনি দিয়ে দোকান তৈরি করা হয়েছে। এসব দোকানে নানা রকম খুটিনাটি বর্ণিল জিনিসপত্র পাওয়া যায়। ক্রিস্টেন স্টুয়ার্টের তাঁরার ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় মাহীন বলল, ‘একটা মজার বিষয় হলো প্রথম প্রথম আমাদের যখন দেখা হয়েছিল তখন সত্যি বলতে তোমার বাড়ি ঠিক কেমন হতে পারে তা ভাবলেই আমার মাথায় অদ্ভুত একটা জায়গার ছবি ভেসে উঠতো।’
রায়েদ ভ্রু জোড়া উঁচু করে কৌতূহলী কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,”কিরকম জায়গা মাথায় আসতো?’
মাহীন হাসল। অকপটে বলল, ‘এডওয়ার্ড কুলিনের অন্ধকার অন্ধকার ঠান্ডা নির্জন পরিবেশ ওয়ালা বাড়িটা।’ রায়েদ হেসে উঠল। হাসতে হাসতে বলল,’কেন কেন?’

মাহীন আমুদে গলায় বলল, ‘উম দেখো, তো আমার সবসময় মনে হতো তোমার সাথে এডওয়ার্ডের অনেক কিছু মিলে যায়। যেমন ও খুব ঠান্ডা ছিল এবং সকলের থেকে দূরত্ব বজিয়ে চলতো। তাছাড়া রহস্যময়ও ছিলো। আর তুমিও কী কম ছিলা নাকি? কতদিন পর্যন্ত আমিই রহস্যের মধ্যে ছিলাম তোমাকে নিয়ে। তাই আমার মনে হতো তোমার বাড়িও বুঝি নির্জন জায়গায় অমন টাইপের হবে। এমনকি তুমি দেখতেও খানিকটা রবার্টের মতো। সবই মোটামুটি মিলেছিল তুমিও ভ্যাম্পায়ার হলে তো হয়েই গিয়েছিল।’
রায়েদের সশব্দে হাসল। হাসি থামিয়ে বলল,’আমি আর ভ্যাম্পায়ার? তুমি পারোও বটে এত কিছু ভাবতে।’ মাহীন হেসে ঘাড় উচালো। হাঁটতে হাঁটতে জিমি ক্যামেল লাইভ এর স্টুডিও পার করল ওরা। অফ হোয়াইট রঙের নান্দনিক বিল্ডিং। রাস্তায় অনেকেই স্কেট বোর্ডিং করছে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাস্তায় কোথাও সামান্য ধুলাবালির লেশমাত্র নেই। অনেকে ফোন স্ক্রলিং করতে করতে কিংবা গান শুনতে শুনতে হাঁটছে। অদ্ভুত হলেও ছেলেরা বেশির ভাগ হাফ প্যান্ট ও টি-শার্ট পরে আছে। রায়েদ জিজ্ঞেস করল,’তোমার প্রিয় এক্ট্রেস কে?’
মাহীন সাথে সাথে বলল, ‘এমা ওয়াটসন এবং জেনিফার লওরেন্স।’

‘এবং প্রিয় এক্টোর?’

‘রবার্ট পেটিনসন।’

রায়েদ হঠাৎ হাসল। মাহীন জিজ্ঞেস করল,’এতে হাসির কী হলো?’
রায়েদ হাসি থামিয়ে বলল, ‘নাহ কী হবে? একটা ছোট ছেলে স্কেট বোর্ড থেকে পরে যাচ্ছিল।’

‘কোই আমি তো দেখলাম না।’

‘তুমি রবার্ট পেটিনসনের কথা মনে করছিলা তাই দেখোনি।’

মাহীন চোখ ছোট করে তাকাল ওর দিকে। রায়েদ বলল,’চলো আমরা দ্যা পাই হোলে যাই।’
রায়েদের দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখলো রাস্তার অপর পারে ‘দ্যা পাই হোল’ নামক একটি ডেসার্ট পার্লার রয়েছে। রায়েদ বলল, ‘এখানকার ডেসার্ট অসাধারণ।’

‘তাহলে চলো দেখি কেমন।’ সায় জানিয়ে বলল মাহীন।
আরেকটু সামনে এগিয়ে গিয়ে রোডক্রসিং এলো। সিগন্যাল বারে সবুজ বাতি জ্বলতেই সকলে রাস্তা পার হতে উদ্ধুদ্ধ হলো। রাস্তার অপর পারে এসে আবার পেছনে হেঁটে চললো। এখানে রাস্তার দুইপাশের ওয়াক অফ ফেমের কালো টাইলস করা বোর্ডওয়াক। ডেসার্ট পার্লারে ঢুকতেই আকর্ষণীয় মিষ্টি মিষ্টি এক ঘ্রাণ নাকে এসে ঢাক্কা দিলো। কোথাও মৃদু স্বরে গান চলছে। তবে অতিরিক্ত কোলাহলের তোরে সেই গান চাপা পরে গিয়েছে। প্রতিটা টেবিলই ভরা। ওদের টেবিল পেতে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হলো। এর মধ্যে ওরা ডেসার্টের অর্ডারটাও সেরে ফেললো। কিছুক্ষণ পর দুই আসন ওয়ালা টেবিল পেয়ে বসে পরল ওরা। বেশ জাঁকজমকপূর্ণ বাতি জ্বলছে। মাহীন চোখ ঘুরিয়ে এদিক ওদিক চাইছে। এই জায়গাটায় সব কিছুতেই অন্যরকম একটা ব্যাপার আছে। বোধহয় হলিউড বলেই এমনটা লাগছে। অন্যান্য কাস্টোমাররা বেশ উচ্চস্বরে কথা বলছে। কাজেই খুব বেশিই শব্দ হচ্ছে। তবে তা শুধু এখানেই নয়। এই মার্কিনীরা স্বভাবতই একটু উঁচুস্বরেই কথা বলে। রায়েদ এখনো মেনুই ঘাটছে। এবং মাঝেমাঝে মাহীনের দিকে চাইছে। মেনুটা রেখে দিয়ে বলল,’আচ্ছা তো এবারও বিলটা আমিই দিব।’
মাহীন সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি সামনের দিকে ঘুরালো। তীব্র কন্ঠে বলল, ‘হেল নো!’

‘হেল ইয়েস!’

‘না না দেখো লাঞ্চের বিলটা কিন্তু তুমিই দিয়েছিলা।’
বলল মাহীন।’

সো হোয়াট? এবারও আমি দিতে পারি না?’

‘হোয়াট দ্যা হেল? ডেটের প্রস্তাব তুমি দিয়েছ বলে কী সব বিল তুমিই দিবা!’

‘হ্যা আমি…ওয়েইট.. ওয়াট?’ হঠাৎ চমকে উঠল রায়েদ কথাটা শুনে। দ্বিধান্বিত হয়ে চেয়ে রইল। তারপর জিজ্ঞেস করল,’কী বললা আমি ডেটের প্রস্তাব দিয়েছি?’

‘হ্যা তো আর কী বলবো? তুমিই তো ডেটের প্রস্তাব দিয়েছো। ভুলে গিয়েছো নাকি?’
মাহীনের কপালেও বিভ্রান্তির ছাপ। রায়েদ বলল, ‘এক মিনিট এক মিনিট, ডেটের প্রস্তাব তো তুমি আমাকে দিয়েছো।’ মাহীন চোখ বড় বড় করে চাইল। চমকিত কন্ঠে বলল,’হোয়াট দ্যা হেল! আমি তোমাকে কোনো প্রস্তাব দেইনি। তুমি আমাকে দিয়েছো।’

‘তাই নাকি? কিভাবে দিলাম? কখন দিলাম?’ অবিশ্বাস্যের সঙ্গে বলল রায়েদ।

‘গতকাল দিয়েছো। চিঠি দিয়ে।’ রায়েদ চোখ সরু করে বলল,’চিঠি দিয়ে? আমি চিঠি লিখেছি? কিন্তু চিঠি তো তুমি আমাকে দিয়েছো।’

‘আমি কাউকে কোনো চিঠি দেইনি। তুমি দিয়েছো আমাকে।’ উৎকন্ঠিত স্বরে বলল মাহীন। রায়েদ কিছু বলতে যাচ্ছিল মাহীন তার আগে বলল, ‘এক মিনিট, তার মানে দাঁড়াচ্ছে আমরা কেউই একে অপরকে চিঠি লিখি নি।’

রায়েদ শান্ত কন্ঠে বলল, ‘তবে আমরা দুইজনই চিঠি পেয়েছি।’

মাহীন ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘তাহলে মাঝখান দিয়ে চিঠিগুলো দিল কে?’

ওরা দুজনই হঠাৎ কিছু একটা ভাবতে শুরু করল। মাহীন ভ্রু কুঁচকে টেবিলের দিকে তাকিয়ে আছে। কেমন জানি একটা লাগছে। হঠাৎ কিছুটা বিব্রত ও বিচলতার হাওয়া তিরতির করে মনের আঙ্গিনায় নাড়া দিয়ে গেল। চিঠিটা পেয়ে কী আনন্দটাই না হয়েছিল অথচ সেটা রায়েদ দেয়ই নি। কী হবে যদি রায়েদকে নিয়ে ও যা ভাবত তাই সত্যি। হয়তো আসলেই রায়েদ ওকে সেরকম ভাবে দেখেই না। অথচ ও এত যত্ন নিয়ে তৈরি হয়ে চলে আসল। কী লজ্জা জনক ব্যাপার!

কিছুক্ষণ পর রায়েদ বলল,’তোমার ফ্রেন্ডরা যেমন কারসাজি করে জেনেট ও লিওকে ব্লাইন্ড ডেটে পাঠিয়েছিল। তেমনটাই আমাদের সাথেও করেনি তো।’
মাহীন মুখ তুলে চাইল। থমথমে মুখভঙ্গি। প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে পানসে কন্ঠে বলল, ‘কী জানি হতে পারে। গতকাল যখন চিঠিটা পেলাম তখন তো ওরা বেশ অবাকই হয়েছিল। জানতেও চাচ্ছিল এটা কার চিঠি। মনে তো হয়নি ওরাই এটা দিয়ে থাকতে পারে।’
রায়েদ জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি চিঠিটা আসলে পেয়েছ কোথা থেকে?’

‘রাবিত এসে দিয়ে গিয়েছে। এবং তুমি কোথা থেকো পেয়েছ?’

রায়েদ অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে চাইল। বলল, ‘রাবিত দিয়েছে? আমি আমার টেবিলে রাখা অবস্থায় পেয়েছি।’

তখনই একজন সুন্দরী ব্লন্ড ওয়েট্রেস এসে ওদের ডেসার্টগুলো টেবিলে রেখে গেল। আমেরিকান চিজকেক, চকলেট ক্রিসেন্ট এবং ডেম ব্লেঞ্চ। মাহীন বিরস মুখে বললো,
‘ওহ তাহলে মূল কথা হলো আমরা কেউই কাউকে কোনো প্রস্তাব দেইনি বাট ইভেনচুয়ালি ডেটে এসে পরেছি। এটা তো কিছু হলো না। কী আশ্চর্য!’ বলে এক লম্বা নিঃশ্বাস ফেললো। ও রায়েদের দিকে একবারও তাকাচ্ছে না। তবে রায়েদ সরাসরি ওর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রেখেছে। মাহীনের চেহারা দেখে মনে হচ্ছে, কী যেন এক বিশাল ক্ষতি হয়ে গিয়েছে। প্রফুল্ল ভাবটা কেটে গিয়ে এক রাশ বিষন্নতার ছায়া ওর চোখে মুখে। রায়েদ টেবিলের ওপর রাখা মাহীনের হাতটা ধরল। মাহীন কিছুটা চমকে উঠে ওর দিকে দৃষ্টি ফেরাল। রায়েদের হাত থেকে যেন শিরশিরে অনুভূতিরা মাহীনের সারা শরীরে প্রবাহিত হয়ে গেল। মাহীন উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রায়েদ মাহীনের চোখে চোখ রেখে শান্ত কন্ঠে বলল, ‘মাহীন হয়তো আমরা কেউই একে অপরকে প্রস্তাব দেইনি। বাট ডেটে তো স্বেচ্ছায়ই এসেছি তাই না? তাহলে কে মাঝখান দিয়ে এসব করেছে তাকে পরে ধরা যাবে। এখন ডেটটা এভাবেই কন্টিনিউ করতে কী কোনো সমস্যা আছে?’
মাহীনের মুখটা ধীরে ধীরে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। অন্ধকারাচ্ছন্ন মনের আকাশের মেঘ কাটিয়ে রোদ উঠল। আবারও মনটা প্রফুল্লতায় ভরে উঠল। ফুলের ঘ্রাণে মাখা আনন্দময় অনুভূতিরা জোড় বাতাসের মতো কৃষ্ণ মেঘগুলোকে টেনে নিয়ে গেল। মাহীন হালকা হাসল। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল,’ঠিক আছে!’
রায়েদ বলল, ‘দেখলাম কিভাবে তোমার মন একদম ভালো থেকে খারাপ হয়ে যায়। আবার একদম মন খারাপ থেকে একদম মন ভালো হয়ে যায়। ‘
মাহীন বিচলিত ভাবে হাসল। তারপর খেয়াল হলো ওদের ডেসার্ট ইতোমধ্যেই দিয়ে যাওয়াও হয়েছে। মাহীন বলল,
‘তাহলে এবার ডেসার্ট এনজয় করি?’ রায়েদ সায় জানিয়ে মাথা নাড়ল।

ইনশাআল্লাহ চলবে।

#এল_এ_ডেইস
পর্ব ৪১
লেখনী মাহীরা ফারহীন

টিং টিং করে শব্দ হচ্ছে এবং দরজা ঠেলে একেকজন কাস্টোমার ভেতরে প্রবেশ করছে। মানুষে গিজগিজ করছে জায়গাটা। কাউন্টারের সামনে লম্বা লাইন অপেক্ষমান কাস্টোমারদের। আবার অনেকে ডেসার্ট টেক আওয়ে করে নিয়ে যাচ্ছে। মাহীন ও রায়েদও ডেসার্টের কাঁচের সেলফের সামনে দাঁড়িয়ে। মাহীন সাথে করে একপিস চিজকেক নিয়ে যেতে চাচ্ছে। বারের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটা টেকাওয়েগুলো প্যাকেট করছে। মাহীন ডেসার্টগুলো দেখতে দেখতে বিড়বিড় করে বলল,’আহ চমৎকার!’
বারের পেছন থেকে ছেলেটা বাংলায় বলল, কী বললা?’
মাহীন হঠাৎ ইংরেজি ভাষাভাষীদের মাঝে বাংলা শুনতে পেয়ে চমকে উঠল। সামনে তাকিয়ে বলল,’তুমি বাঙালি?’
শ্যাম বর্ণের ছিপছিপে গড়নের লম্বা ছেলেটা আন্তরিক হেসে বলল, ‘হ্যা। বেশ কিছুদিন পর একজন বাঙালির সঙ্গে দেখা হলো।’

‘নাইস টু মিট ইউ।’

‘তুমি কী ঢাকা বাসি?’ একজন কাস্টোমারের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ক্যাশিয়ারের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল ছেলেটা।
মাহীন বলল, ‘হ্যা ঢাকায় থাকতাম। তুমি?’
‘আমিও ঢাকায় থাকতাম। ধানমন্ডি।’
মাহীন অবাক হয়ে বলল, ওহ মাই! আমিও ধানমন্ডিতেই থাকতাম।’ রায়েদ ওর পাশে দাঁড়িয়ে বিরক্ত হয়ে ওদের কথা শুনছে। যদিও কিছুই বুঝতে পারছে না। আজ এই ভাষাটা না পারার জন্য খুব আফসোস হলো।
‘ছেলেটাও আবার গায়ে পরে একের এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছে। থামা থামির কোনো নামই নেই। আর মাহীনও কী হেসে হেসে কথা বলছে। কী কথা বলে এমন দেশ উদ্ধার করছে আল্লাহই জানে!’ ভেবে বিরক্তির সঙ্গে দীর্ঘশ্বাস ফেললো রায়েদ। কাউন্টারের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা ওদের চিজকেক প্যাকেট করে দেওয়া মাত্র রায়েদ প্রায় ছো মেরে প্যাকেটটা নিল। তারপর মাহীনের হাত ধরে বলল, ‘মাহীন! মাহীন আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে। চলো।’ মাহীন হকচকিয়ে উঠল। তারপর ছেলেটাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ” আসছি।”
ছেলেটাও আবার প্রতুত্তরে বলল, হোপ টু সি ইউ আগেইন।’
রায়েদ প্রায় ঝড়েরবেগে বাইরে বেরিয়ে আসল। মাহীন কিছুটা অবাক হয়েদ বলল, ‘হঠাৎ হলোটা কী? আমাদের কী কোথাও যাওয়ার তাড়া পরে গিয়েছে? এমন ছুটছো কেন?’
রায়েদ শান্ত কন্ঠে বলল, ‘কিছু হয়নি। কতক্ষণ আর একই জায়গায় বসে থাকতাম।’
মাহীন ভ্রু উঁচিয়ে মাথা নাড়ল। বলল, ‘বাই দ্যা ওয়ে আসলেই এখানকার ডেসার্ট অসাধারণ ছিল। আবার আসা লাগবে এখানে।’
ওরা হাঁটতে শুরু করেছে। মাথার ওপরের কড়া রোদের তেজ কমেছে। ফুটপাথের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নাম না জানা গাছগুলো ভেদ করে ঝুড়ি ঝুড়ি মরা আলো এসে পরছে। রায়েদ বলল, ‘নাহ এখানে আর আসবো না। ভালো লাগেনি।’
‘কেন কেন? কী ভালো লাগেনি?’

‘কী আবার ডেসার্ট।’
মাহীন চোখ সরু করে সুর করে বলল, ‘ওহ তাই নাকি? কিন্তু তুমিই না বলেছিলা এখানকার ডেসার্ট অসাধারণ।’
রায়েদ ইতস্তত করে বলল, ‘উম হ্যা। কিন্তু এখন ডেসার্ট গুলো ভালো লাগেনি।’

‘খাওয়ার সময় তো বললা ভালো লাগসে।’ বলল মাহীন।

রায়েদ ভাবল, ওফ এই মাহীন পিছুই ছাড়ে না। কোন ফ্যাসাদে পরে গেলাম। ভাবতে ভাবতে বলল, ‘কিছুটা। যাক ছাড়ো তো।’ তারপর একটু থেমে আবার বলল, ‘আচ্ছা চলো এখনই লেকে রওনা দেই। নাহলে দেরি হয়ে যাবে।’
মাহীন বলল, ‘এক মিনিট আমাদের ওয়াক অফ ফেমে একটা ছবি তোলা হয়নি এখনো।’
‘ওহ হ্যা। তো চলো তুলে ফেলি।’ রাস্তা ধরেই হাঁটছিল এক যুবক। তাকে রায়েদ ওদের কয়েকটা ছবি তুলে দিতে অনুরোধ করল। মাহীন ও রায়েদ বোর্ডওয়াকের মাঝেই একটু দূরে দূরে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটা রায়েদকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘হেই ওয়াটস দিজ? স্ট্যান্ড ক্লোজলি উইথ ইয়োর গার্লফ্রেন্ড বয়।’
মাহীনের গাল দুটো রক্তবর্ণ হয়ে উঠল। তবে তা সেভাবে প্রকাশ পেলো না। রায়েদ ওর পাশে এসে দাঁড়াল। এক মুহূর্ত দ্বিধা করে মাহীনের কাঁধ জড়িয়ে ধরল। রায়েদের গালেও লালাভা। ছেলেটা হাসি মুখে কয়েকটা ছবি তুলে মোবাইলটা ফেরত দিয়ে বলল, ‘অন ফ্লিক! ইউ টু লুক সো সুইট টুগেদার।’ তারপর সে চলে গেল। কেন জানি ছেলেটার এসব কথায় কেউ তার ভুল ভাঙিয়ে দিল না। ওদের এক রাশ আরষ্টতা ধরে বসেছে। মাহীন অস্বস্তিতে রায়েদ থেকে একটু পিছে পিছে হাঁটছে। অবশেষে ওরা লাল রঙচঙে স্টার্লাইন সিটি ট্যুর বাসটা খুঁজে পেয়ে উঠে পরল। ‘রডেও’ রোড বেভারলি হিলস ঘুরে তারপর সিলভার লেক নেইবারহুডে যাবে ওরা। বেভারলি হিলসটা আর পায়ে হেঁটে ঘুরা হলো না। বাসে বসেই জায়গাটা উপভোগ করতে হলো। কারণ হাতে সময় নেই। লাল বাসটি দুই তলা। দ্বিতীয় তলা ছাদের ওপর খোলা। ছাদের ওপরই এখন বেশি ভীর। আসনগুলো সব ভরা। বিকেল প্রায় হয়ে এসেছে। এসময় রোদের তেমন তেজ নেই। মরা সোনালি রোদটা গায়ে মাখতে বড় আরাম। বেশ ধীরে সুস্থেই চলছে বাস যেন সবটা পরিষ্কার ভাবে দেখা যায়। তবুও বেশ বাতাস হচ্ছে। বাতাসের তোড়ে মাহীনের সমস্ত চুল এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে বারবার। বেভারলি হিলসের শৌখিন নান্দনিক ইউরোপীয় ধাঁচের বাড়িগুলো চাপাচাপি করে দাঁড়িয়ে। বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত রেস্টুরেন্টগুলোর মধ্যে কিছু কিছু চোখে ধরা দিলো। নাম করা ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোর জাঁকজমকপূ্র্ণ দোকান। মুরাল অর্থাৎ বর্ণিল রঙে রাঙানো দেয়াল চিত্রগুলো কিছুক্ষণ পর পরই চোখে পরল। একবার দেখা গেল রাস্তায় এক শেতাঙ্গ যুবক দাঁড়িয়ে বেহালায় গেম অফ থ্রোনসের টাইটেল থিমের সুর তুলেছে। পথযাত্রীদের অনেকেই থেমে গিয়ে সেখানে জড়ো হয়েছে। সুরটা মন ভরে শুনে নেওয়ার আগেই বাস জায়গাটা অতিক্রম করে গেল। রায়েদ গান শোনার জন্য এয়ারপড বের করেছে। ব্লুটুথের সঙ্গে কানেক্ট করে একটা এয়ারপড মাহীনের কানেও গুজে দিল। এড সেরনের ‘পার্ফেক্ট’ গানটা চালু করেছে।

I found a love for me
Darling, just dive right in and follow my lead
Well, I found a girl, beautiful and sweet
Oh, I never knew you were the someone waiting for me

‘Cause we were just kids when we fell in love
Not knowing what it was
I will not give you up this time
But darling, just kiss me slow
Your heart is all I own
And in your eyes you’re holding mine

Baby, I’m dancing in the dark
With you between my arms
Barefoot on the grass
Listening to our favourite song
When you said you looked a mess
I whispered underneath my breath
But you heard it,
Darling, you look perfect tonight

গানটা শেষ হতেই মাহীন বলল, ‘একটা বাংলা গান শোনাই?’

‘বাংলা গান? শোনাও। তুমি গান গাইতে পারো জানতাম না তো।’ আমুদে গলায় বলল রায়েদ।
মাহীন হেসে বলল, ‘আমি গান গাবো না তো। আমি বলছি মোবাইলে চালু করছি।’

‘ওহ হ্যা শুনে দেখা যায়। কিন্তু তুমি একটা গান গেয়ে শোনাবা?’
‘উম সেটা পরে দেখা যাবে। আগে গান চালু করি।’
রায়েদ নিজের মোবাইলটা ওর হাতে তুলে দিল। বাতাসের ঝাপটায় চুল বারবার মুখের ওপর এসে পরছে। মাহীন সরিয়ে দিচ্ছে আবার। মাহীন লগ্নজিতা চৌধুরীর প্রেমে পরা বারণ গানটা চালু করল।

প্রেমে পরা বারণ
কারণে অকারণ
আঙুলে আঙুল থাকলেও
হাত ধরা বারণ

তোমায় যত গল্প বলার ছিলো,
সব পাপড়ি হয়ে গাছের পাশে
ছড়িয়ে রয়ে ছিল
দাওনি তুমি আমায় সেসব
কুড়িয়ে নেওয়ার কোনো কারণ

গানটা শেষ হতেই রায়েদ বলল, ‘মেয়েটার কন্ঠ বড়ই অদ্ভুত। আচ্ছা এটা কী কোনো স্যাড গান নাকি?’

মাহীন জিজ্ঞেস করল, ‘স্যাড গান কেন মনে হলো?’
‘এটার মেলোডিটাই এমন। বাই দ্যা সুন্দর ছিল। আচ্ছা এটার নাম কী?’
‘প্রেমে পরা বারণ।’
‘এটার মানে কী?’
‘ফলিং ইন লাভ ইজ নট এলাওড।’
রায়েদ অবাক মুখে বলল, ‘ওরে তাই তো বলি এটার মেলোডি স্যাড স্যাড কেন। আমি তোমাকে সুইট গান শেনালাম। আর তুমি আমাকে সাওয়ার গান শোনালা।’
মাহীন হাসল। বলল, ‘এটা আমার বেশ ভালো লাগে। তাই।’ দুই তলা বাসের ছাদ থেকে লম্বা তাল গাছগুলোকে দেখে এখন মনে হচ্ছে সেগুলো যেন পাশেই মাথা একটু উঁচু করে দাড়িয়ে আছে। বেভারলি হিলস এ নেমে গিয়ে মাহীন ও রায়েদ আরেকটা স্টার্লাইন বাসে উঠলো। কারণ একটা বাস সাধারণত একই এলাকার মধ্যে বারবার ঘুরে ফিরে বেড়ায়। অন্য এলাকায় যায় না। এই বাসে কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা সিলভার লেক পার্ক নেইবারহুডে এসে পৌঁছল। এটা লস এঞ্জেলসের সবচেয়ে সাশ্রয়ী ও সুখী নেইবারহুড। এলাকাটা একটি লেক জুড়ে গড়ে উঠেছে বলে নাম, সিলভার লেক। ‘ওয়েল কাম টু সিলভার লেক ‘সানসেট জাঙ্কসন’ নামক বড় একটি গাঢ় নীল ব্যানার পার করে এলাকাটায় প্রবেশ করল ওরা। ছবির মতো সুন্দর ঝকঝকে শহরটা। ওরা বাস থেকে আগেই নেমে গিয়ে লেক পর্যন্ত হেঁটে পৌছালো। লেকের পানি গাঢ় নীল। ঠিক প্রশান্তের মতো। লেকের চারিপাশ রেলিং দিয়ে বেড়া দেওয়া। লেকের পাশের হাঁটার প্রশস্ত রাস্তা পার করে টিয়ে রঙের নরম ঘাসের ভূমি উঁচু হয়ে উঠে গেছে ওপরের দিকে। গিয়ে মিশেছে রাস্তার সাথে। এর মাঝে সিডার ও পাইন গাছের দেখা মিললো। কোথাও কোথাও হালকা গোলাপি ফুলে ছাওয়া দু একটা এলমেনড্রো গাছও দেখা গেলো। গাছে গাছে ডাল পালার আড়ালে বসে সুন্দর সুর তুলে গান গেয়ে চলেছে ক্যানারি পাখি। কখনো কখনো আবার নাইটিংগেলের তীক্ষ্ণ ডাকও শোনা যাচ্ছে। লেকে একটি মাত্র বোট চলছে। তাতে বেশ কিছু যাত্রী লেক উপভোগ করছে। রোদের প্রতিফলনে চিকচিক করে উঠছে লেকের পানি। মাহীন পানির দিকে চোখ রেখে প্রসন্ন কন্ঠে বলল, মজার ব্যাপার হচ্ছে এমন একটা লেক একবার একটা কার্টুনে দেখেছিলাম। অনেকটা এমনই দৃশ্য ছিল।’
‘তুমি এখনো কার্টুন দেখো?’
‘নাহ। ছোটবেলায় দেখতাম। সেটার কথা মনে পরেছে।’
‘কোন কার্টুন দেখতা?’
‘ডোরেমন।’
‘ডোরেমন? এটা কোন কার্টুন?’
মাহীন এমন ভাবে রায়েদের দিকে তাকাল যেন এহেন আশ্চর্যজনক কথা ও এর আগে কখনো শোনেনি। অবাক কন্ঠে বলল, ‘তুমি ডোরেমন দেখো নি কখনো? সিরিয়াসলি?’

‘সিরিয়াসলি আমি কখনো দেখিনি। আমেরিকায় যেসব কার্টুন হতো সেসব দেখেছি। কিন্তু এমন কিছু তো ওর মধ্যে ছিল না।’

মাহীম মাথা নেড়ে বলল, ‘হুম বোধহয় জ্যাপনিজ কার্টুন বলে আমেরিকায় এয়ারড হতো না। তো তুমি কী ধরনের কার্টুন দেখতা?’

রায়েদ মুচকি হেসে বলল, ‘সে অনেক আগের কথা। কয়েকটার নাম ভুলে গিয়েছি বোধহয়। কিন্তু আমি স্পঞ্জবক্স স্কয়ারপ্যান্টস, বাগস বানি, টম এন্ড জেরি, দ্যা রোড রানার, হরিড হ্যানরি এসব দেখতাম।’
‘ওয়েল টম এন্ড জেরি এবং স্পঞ্জবক্স স্কয়ারপ্যান্টস আমিও দেখতাম। বাগস বানি টিভি তো হতো কিন্তু আমার ভালো লাগতো না। আর বাকিগুলো বোধহয় বাংলাদেশে হতোই না।’
রায়েদ হেসে বলল, ‘মজার ব্যাপার হলো আমরা কার্টুন নিয়ে আলোচনা করছি।’
মাহীন হাসল। বিকেলের সোনাবরণ রোদ মাহীনের গা ছুয়ে দিয়েছে। কালো চুল রোদের আলোয় হালকা বাদামী দেখাচ্ছে। কাজলে আঁকা কাঠ বাদামের মতো কালো চোখের মণি থেকে হালকা বাদামি রঙ ছিটকে বেরোচ্ছে। সব মিলিয়ে চিকচিকে সোনালি রঙা পবিত্র এক আলোতে যেন সিক্ত হয়ে আছে মাহীন। রায়েদ ঘোরলাগা দৃষ্টিতে তাকিয়েই আছে মাহীনের দিকে। এর চাইতে সুন্দর মুখ যেন এই পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই। মনে হলো ইশ এই মুহূর্তে একটা জিনিস যদি এখানে থাকতো সবকিছুই পরিপূর্ণ হয়ে যেত। এমন মুহূর্ত যদি আর না আসে। আসলেই তো এমন স্বর্গীয় মুহূর্ত মানুষের জীবনে কয়বার আসে? রায়েদের মনে হলো সেই একটা কাজ যেন এই মুহূর্তটার জন্যেই থেমে ছিলো। সেটা না করলেই নয়। এবং সেই জিনিসটাও তো এই পার্কে আছে। এতক্ষণ মনে আসেনি কেন? তাহলে দেরি কিসের? হঠাৎ কথাটা মাথায় আসতেই মাহীনের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে এদিক ওদিক চাইল। তারপর আবার মুখ ফিরিয়ে বলল, ‘মাহীন একটু অপেক্ষা করো। আমি আসছি।’
বলেই রাস্তা ধরে দ্রুত গতিতে হেঁটে যেতে লাগল। যত দূরে যাচ্ছে ক্রমেই ওকে অনেক ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর দেখাচ্ছে। মাহীন অপেক্ষায় ওর পানে চেয়ে রইল। একবার ভাবল যাবে ওর পেছন পেছন। আবার ভাবল, না থাক যখন অপেক্ষা করতে বলেছে তো অপেক্ষা করাই ভালো। পাঁচ ছয় মিনিট পর আবার ফিরে আসতে দেখা গেল রায়েদ কে। দ্রুত গতিতে হেঁটে কাছিয়ে আসছে। কিছুটা হাঁপাচ্ছে। কাছে আসতেই মাহীন জিজ্ঞেস করল, হঠাৎ কী হলো? কোথায় গিয়েছিলে?’
রায়েদ এক মুহূর্তে ব্যায় করে বুক ভরে শ্বাস নিল। এক হাত পেছনে নিয়ে রেখেছে যেন কিছু একটা আড়াল করছে। মাহীনের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে রায়েদ বলল, ‘আচ্ছা মাহীন মনে আছে, গতবার তুমি আমাকে একটা প্রশ্ন করেছিলে। যে, আমার জন্য ভালোবাসার প্রতীক কোন ফুল?’
হঠাৎ এই কথা শুনে মাহীন থমকে গেল। হৃদয় দ্রুত গতিতে স্পন্দন করতে শুরু করল। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘হ্যা করেছিলাম। এবং তুমি বলেছিলা, এখনো ঠিক নেই। যখন কোনো ফুলকে বেছে নিতে পারবা। সবার আগে আমাকেই বলবা।’
রায়েদ প্রমত্ত কন্ঠে বলল, ‘এখন হঠাৎ মনে হলো আমি ফুলটা পেয়ে গিয়েছি। দেখতে চাও কোন ফুল?’
মাহীন আগ্রহীভরা কন্ঠে বলল, ‘হ্যা। কোন ফুল?’
রায়েদ ওর ডান হাতটা পেছন থেকে সামনে আনল। ওর হাতে এক গুচ্ছ হালকা বেগুনি রঙের ঝিরিঝিরি ভারবেনা ফুল। মাহীন স্তম্ভিত একই সঙ্গে আবিষ্ট হয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ফুলগুলোর দিকে। রায়েদের বলা কথাগুলোর মর্মোদ্ধার করতে ব্যস্ত মস্তিষ্ক। রায়েদ উৎসুকভাবে তাকিয়ে ছিল মাহীনের দিকে উত্তরের আশায়। কিন্তু মাহীন ঠিক কী বলবে বুঝে উঠতে পারলো না। রায়েদ মাহীনের এক হাত তুলে ফুলগুলো ধরিয়ে দিলো ওকে। তারপর অর্ধেক গুচ্ছ ফুল নিয়ে মাহীনের কানে গুঁজে দিতে দিতে বলল, ‘মনে আছে আমি কী বলেছিলাম? ভারবেনা ফুল ঠিক তোমার। না আসলে তোমারই প্রতিক। আরোগ্যতা এবং পবিত্রতা।’
মাহীন কেঁপে উঠল। ওর হৃদয় দ্রিমদ্রিম করে স্পন্দন করছে। এত জোড়ে হৃৎস্পন্দনের শব্দ হচ্ছে যে মনে হয়, তা রায়েদও শুনতে পাবে। সারা শরীর জুড়ে ভালোলাগার শিহরন বয়ে চলেছে। আশেপাশে সবকিছু যেন থেমে গেছে। কোনো কিছুর শব্দও কানে আসছে না। শুধু রায়েদের কথাগুলোই কানে বাজছে। মাহীন বারবার চেষ্টা করছে কী বলা যায় তা গুছিয়ে নিতে। কিন্তু কী গুছিয়ে নিবে যখন মাথা শূন্য হয়ে আছে। রায়েদ পরিষ্কার ভাবে কিছু না বলেও অনেক কিছু বলে ফেলেছে। মাহীন লেকের দিকে ঘুরে দাঁড়াল। চোখ বন্ধ করে বুক ভরে লম্বা এক নিঃশ্বাস নিল। লেকের নীল পানিতে আকাশের লাল কমলা রঙের ছোঁয়া লেগেছে। স্বচ্ছ ভাবে লেকের পানিতেও যেন আরেকটা আকাশ ভেসে উঠেছে। আকাশের বুকে ধীর গতিতে চলতে থাকা বড় ভেলার মতো রুপালি মেঘগুলোও যেন থেমে গেছে। থেমে গেছে মাহীনের উত্তরের অপেক্ষায়। রায়েদও আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। মাহীন অবশেষে আবার রায়েদের দিকে ঘুরে দাঁড়াল। তারপর নিজের হাতে থাকা ভারবেনা ফুলগুলো উঁচু করে ধরল। তরল সোনার মতো কিরণ হালকা বেগুনি ভারবেনা গুলোকে সিক্ত করে স্বর্গের এক টুকরো ফুলের মতো করে দিয়েছে। মাহীন ফুলগুলোর দিকে একবার তাকালো তারপর রায়েদের চোখে চোখে তাকাল। ছাড়া ছাড়া ভাবে বলল,
‘তুমিই তো বলেছো…যে এটা…আমার ফুল। আমার..প্রতীক।’ অনেক কষ্টে গলা দিয়ে কথাগুলো বের করল। রায়েদ অতি ধৈর্যের সঙ্গে অপেক্ষা করে আছে পরের কথাগুলোর জন্য। চোখে মুখে আগ্রহ উপচে পরছে। বুকে নিদারুণ হইচই। মাহীন প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে বললো, ‘তাহলে আমি তোমাকে অনুমতি দিলাম এই ফুলগুলোকে ভালোবাসার।’
রায়েদের ঠোঁটের কোণে তিরতির করে হাসি ফুটে উঠল। মাহীনের উত্তরটা দেওয়ার সাথে সাথেই যেন রুপালি মেঘগুলো চলতে শুরু করল। ক্যানারি, নাইটিংগেল ও ভিরি পাখি ডাকতে শুরু করল। চারিপাশে সবকিছুই হঠাৎ ঝলমল করে উঠল। মনে হলো কেউ কোনো স্বপ্ন দেখছে। এখনই ঘুৃম ভেঙ্গে গিয়ে চোখের পাতা মেললেই সব গায়েব। রায়েদ অবশেষে বলল, ‘বলো আমি কোনো স্বপ্ন দেখছি না তো?’
মাহীন এবার হালকা হেসে বলল, ‘না আমরা বাস্তবেই আছি। যদিও আশেপাশের কোনো কিছুকেই বাস্তবিক মনে হচ্ছে না। কেন বলো তো?’
রায়েদ এবার লেকের দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। মাহীনের কাঁধ জড়িয়ে ধরে বলল, ‘তা তো আমার জানা নেই। শুধু মনে হচ্ছে এমন মুহুর্তে আর কখনো আসবে না।’
মাহীনও সামনে ডুবন্ত সূর্যের দিকে তাকাল। প্রমত্ত কন্ঠে বলল, ‘জানো সূর্যাস্তই হচ্ছে এটার প্রমাণ যে কোনো কিছুর শেষটাও কত সুন্দর হতে পারে।’ রায়েদ কোনো কিছু বললো না। আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে ভাবল, ‘এল এয়ের এই দিনটা আমার জীবনের আকাশে এক অবিস্মরণীয় টুকরো হয়ে তাঁরার মতো জ্বলে থাকবে। দ্যাটস হোয়াই পিপস সে এল এ ডেইস আর দ্যা বেস্ট!’

চলবে ইনশাআল্লাহ।