ওয়েডিং স্টোরি পর্ব-২+৩

0
1010

#ওয়েডিং_স্টোরি
#পর্ব_২_৩
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

–“হ্যালো,মিস বউফ্রেন্ড!”

আহনাফের কণ্ঠ শুনে আভা ধড়ফড়িয়ে বালিশ ছাড়লো। একাংশ কারুকাজ করা পালঙে পিঠ দ্বারা হেলান দিয়ে চমকিত কণ্ঠে বললো,

— ” আপনি?”
— “আমি ছাড়া কারো সাহস আছে তোমায় ডিস্ট্রাব করার?”

আহনাফের নির্লিপ্ত উত্তর শুনে আভা খানিক অবাক হলো। এই ছেলে অনেক শেয়ানা আছে! আভা বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। রুমজুরে পায়চারি করতে করতে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। বাতাস বইছে মৃদুমন্দ। ঝড় হবে কি আজ? বেশ কদিন ধরে কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই আকাশের মন খারাপ হয়। অযথাই আকাশের চোখ বেয়ে জল গড়ায়। আজও কি এমন হবে? আভা আবার প্রশ্ন করলো,

— ” আপনি আমার নাম্বার পেলেন কোথায়? আমি তো দেইনি।”

আহনাফ নিজে বারান্দার রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। আকাশের দিকে চোখ নিবদ্ধ রেখে উত্তর করলো,

— ” হবু বউয়ের নাম্বার হবু জামাইর কাছে থাকা কোনো ব্যাপার না, মিস বউফ্রেন্ড।”

আভা বুঝতে একটুও অসুবিধা হলো না, নাম্বারটা তার একমাত্র মা-ই উনাকে দিয়েছেন। আভা ছোট্ট করে এক নিঃশ্বাস ফেললো। ওপাশের মানুষটা চুপ। আভা শীতল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

— ” কিছু কি বলবেন? ”

আহনাফ মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলো,

— ” আচ্ছা, তুমি কখনো কারো দুঃখে খুশি হয়েছো? ”

আভা অবাক হলো। এটা আবার কিধরণের প্রশ্ন! আভা উত্তর করলো,

— ” না তো। ”

— ” কিন্তু আমরা মানুষরাও কখনো কখনো কারো দুঃখে খুব খুশি হয়। খুশির কারণে আমদের মন নাচতে থাকে। আন্দোলিত হয়। জানো সেটা? ”

— ” কিসব বলছেন? আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না। ”

— ” এই ধরো তুমি বৃষ্টিতে ভিজতে পছন্দ করো। কিন্তু এটা কি জানো যখন বৃষ্টি হয় তখন আকাশের মন খুব খারাপ থাকে। সে তখন মন খারাপ করে হুহু করে কান্না করে। আর তার কান্নার ফোঁটা আমাদের কাছে বৃষ্টি হয়ে নামে। আর তুমি তখন খুশি হয়ে সেই বৃষ্টিতে ভেজো। ”

আভা অবাক হলো। চোখের পাপড়ি খানিক কেপে উঠলো।এমন করে ত কখনো ভেবে দেখিনি ও। লোকটার কথা দারুন তো! আভা নিস্তব্ধ হয়ে রইলো। আহনাফও চুপ করে রইলো খানিক। একটা মেয়ের নিঃশ্বাসের শব্দও এত মধুর হয়! আহমাদ স্তব্ধ হয়ে শুনলো। মসজিদে আসরের আযান দিচ্ছে। একটু পরেই আভার ভাই আর বাবা নামাজে বের হবে। আভার খোঁজ করবে তখন। আভা তাই বললো,

— “ব.. আযান দিচ্ছে। ”
— “ওহ সরি। শুনিনি আমি। রাখছি তাহলে। নামাযে যেতে হবে। ”

আভা ছোট্ট করে বললো,

— ” আসসালামুয়ালাকুম। ”

আহনাফ ” বাই” বলতে যাচ্ছিল। আভার মুখে সালাম শুনে সে মৃদু হেসে বললো,

— ” ওয়ালাইকুম আসসালাম। রাখছি। ”

ফোন কেটে গেলো। “টুট টুট”। আজকে আর ঘুম হবে না। আভা রুমে এসে বালিশের কাছ থেকে দুমড়ে মুচড়ে রাখা ওড়না নিয়ে গায়ে জড়ালো। তারপর বেরিয়ে গেলো রুম থেকে।

ড্রইং রুম থেকে আসাদুজ্জামান এর গলা শুনা যাচ্ছে। আভাকে জোর গলায় ডাকছেন তিনি। আভা মাথায় কাপড় দিয়ে দ্রুত এগিয়ে গেলো বাবার দিকে।তার বাবা কাধে জায়নামাজ ঝুলিয়ে মার সাথে কথা বলছেন। আভার ভাই মিনহাজ টুলে বসে জুতো পড়ছে। আভা বাবার সামনে দাঁড়িয়ে গেলো। আসাদুজ্জামান মেয়েকে দেখে হাসি হাসি মুখে বললেন,

— ” কই তুমি? আমরা চলে যাচ্ছি। দরজা কে লাগাবে? ”

আভা কিছু বলার আগেই মিনহাজ এসে দাঁড়ালো বাবার পাশে। আভার মাথায় হুট করে এক চাটা মেরে বললো,

— ” সবসময় দরজা লাগানোর জন্য এই বুচিরে কেনো ডাকো তুমি। মা আছেন তো।”

আভা মাথায় হাত ঘষে গাল ফুলিয়ে বললো,

— ‘ ভাই, তোমারে সত্যিই একদিন আমি খুন করে ফেলবো। বারবার মাথায় মারো কেনো? দানবের মতন হাত, ব্যাথা লাগে। ”

মিনহাজ আরো কিছু বলবে তার আগেই আসাদুজ্জামান সদর দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে বললেন,

— ” মিনহাজ, নামাজের দেরি হয়ে যাচ্ছে। চলো। ”

মিনহাজ আর বাক্যক্ষয় না করে বেরিয়ে গেলো বাবার সাথে। আভা দরজা লাগিয়ে মায়ের পিছু পিছু এলো।
আভার মা রান্নাঘরে এসে ড্রয়ার থেকে একটা পেঁয়াজ আর বটি নিয়ে মাটিতে বসলেন। আভাও পাশে বসলো। আভার মা পেঁয়াজ কাটতে কাটতে বললেন,

— ” এখানে বসে না থেকে রেডি হও। বেরুতে হবে তোকে। ”

আভা অবাক হলো। মায়ের দিকে চেয়ে বললো,

— ” বেরুবো?কোথায়? ”
— ” আহনাফ আসবে। এনগেজমেন্টের আংটি বানাতে যাবে তোকে নিয়ে। বেশি দেরি হলে পরে ঠিক টাইম মত বানিয়ে দিবে না। কেনো বলে নি ও তোকে? ”

আভা মাথা নাড়ালো। যার অর্থ সে জানেনা। আভার মা মেয়ের মুখের দিকে একপলক তাকালেন। তারপর আবার পেয়াঁজ কাটায় মনোযোগ দিয়ে বললেন,

–” আহনাফের মা ফোন দিয়ে বলেছেন। ”
— ” কিন্তু মা, আমি একা যাবো? ”
— ” না। মিনহাজ আছে। আজকে ওর অফিস নেই। ফ্রি আছে। ও যাবে তোর সাথে। ”

আভা ঠোঁট উল্টিয়ে মায়ের দিকে তাকালো। এ আবার কোন মসিবত! বিয়ে মানেই একগাদা ঝামেলা। এখন আবার রেডি হও , বাইরে যাও, জার্নি করো। মহা মসিবত! আভা বিরক্ত মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলো। আভার মা মেয়েকে বসে থাকতে দেখে পুনরায় তাগাদা দিয়ে বললেন,

— ” যা। রেডি হ। আহনাফ এসে যাবে এখনি।”

আভা হেলদুলে উঠে দাঁড়ালো। নিজের রুমের দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে বিড়বিড় করলো,

— ” বিয়ে মানেই ঝামেলা। ওহে প্রভু, বিয়ে নামক চিরন্তন জঞ্জাল এই পৃথিবী থেকে উঠায়া নাও। উঠায়া নাও। ”

_____________________
আহনাফ গাড়ি নিয়ে নিচে দাঁড়িয়ে আছে। আভা রেডি হয়ে মিনহাজের রুমে বসে আছে। মিনহাজ ঝড়ের গতিতে শার্টের বোতাম লাগাচ্ছে। আভা একসময় বিরক্ত হয়ে বললো,

— ” মা কখন থেকে বলেছে রেডি হওয়ার জন্যে। আর তুমি বসে বসে ঝিমিয়েছো। এখন বুঝো ঠেলা। ”

মিনহাজ তাড়াহুড়োর মধ্যে কপাল কুচকে আভার দিকে তাকালো। বললো,

— ” এখন সব আমার দোষ! তোর অকাজের হবু আরো কিছুসময় পর আসতে পারলো না। বউকে দেখার তর সইছিলো না। আহা! কি প্রেম। ”

আভা উঠে দাঁড়ালো। ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে ভাইয়ের হাত ঘড়ি নিয়ে এগিয়ে দিলো মিনহাজের দিকে। মিনহাজ হাত ঘড়ি পড়ছে তখন আভা বললো,

— ” উনার আরো এক ঘন্টা আগে আসার কথা ছিলো।এক ঘন্টা লেট করে এসেছে। তাও তুমি এই কথা বলছো। ”

মিনহাজ শরীরে পারফিউম স্প্রে করতে করতে বললো,

–” কি প্রেম। একজন নাচতে নাচতে বাসার নিচে গাড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে। আরেকজন তার দোষ ঢাকার জন্যে নিজের আপন ভাইয়ের সাথে তর্ক করছে। পাপ লাগবে তোর উপর। দেখিস! ”

আভা এবার কোনো প্রত্যুত্তর করলো না। ভাইয়ের হাত টেনে জোর করে বাইরে নিয়ে আসলো। মা-কে ডেকে সদর দরজা বন্ধ করার কথা বলে ভাই বোন নিচে বেরিয়ে গেলো।

বাড়ীর গেটের বাইরে আসতেই দেখলো আহনাফ গাড়ীর সাথে হেলান দিয়ে কার সঙ্গে ফোনে কথা বলছে। তার পরনে একটা সাদা টিশার্ট, তার উপর একটা কালো লেদার জ্যাকেট আর জিন্স। আভা আহনাফকে একনজর দেখেই চোখ নামিয়ে নিলো। আহনাফ মিনহাজ আর আভাকে দেখে ফোন কেটে পকেটে ঢুকিয়ে তাদের দিকে এগিয়ে এলো। আহনাফ আর মিনহাজ পরস্পর কোলাকোলি করে হালচাল জিজ্ঞেস করলো। আহনাফ এতক্ষণে একবারও আভার দিকে তাকায় নি। মিনহাজের সামনে আভার দিকে তাকানো ব্যাপারটা বড্ড লজ্জাজনক। কিন্তু আহনাফের মনে আভাকে একনজর দেখার জন্যে আকুপাকু করছে। আজ কেমন লাগছে আভাকে? সুন্দর নাকি ভয়াবহ সুন্দর?

আহনাফ ড্রাইভিং সিটে বসলো। মিনহাজ আহনাফের পাশে আর আভা পিছন সিটে বসলো।
গাড়ি চলছে। মিনহাজ আর আহনাফ নানা কথা বলছে। কিন্তু আভা চুপ করে জানালার পাশ ঘেঁষে বসে আছে। বাতাসের কারণে তার চুল হালকা উড়ছে। মিনহাজ আহনাফের উদ্দেশ্যে বললো,

— ” তা,আজকের প্ল্যান কি? ”

আহনাফ এক হাত দিয়ে গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে বললো,

— ” প্রথমে এনগেজমেন্টের আংটি বানাতে দেওয়া। তারপর একসাথে ডিনার।”

মিনহাজ এবার বাঁধ সাধলো। বললো,

— ” না, না। আংটি মাপ দেওয়া শেষ হলেই আমরা বাসায় চলে যাবো। আজকে ডিনার টা তুমি নাহয় আমাদের ওখানেই করে নিবে।”

— ” ভাইয়া, আজকে আমার পকেটের টাকা খরচ করেন। কদিন পর আমি যখন জামাই হবো তখন নাহয় আপনাদের অন্ন ধ্বংস করবো। বাট টুডে ইজ ম্যাই টার্ন। ”

মিনহাজ আহনাফের কথা শুনে হেসে ফেললো। আভা তাদের দুজনের দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে আছে। কত জলদি মিশে গেলো এরা দুইজন। মিনহাজ সহজে কারো সাথে মিশতে পারে না। সেক্ষেত্রে এই অপরিচিত লোকটার সাথে কত হাসিখুশি কথা বলছে। আসলেই। এই লোকটার মধ্যে এক অদ্ভুত ক্ষমতা আছে। যে কাউকে আপন বানানোর ক্ষমতা!

প্রায় আধা ঘন্টা যাবৎ গাড়ি জ্যামে আটকা আছে। ঢাকা শহরের জ্যাম মানেই ভয়ংকর কিছু। সবাই ঘেমে-নেয়ে একাকার অবস্থা। আহনাফ সবার অবস্থা লক্ষ করে গাড়ির জানালা বন্ধ করে এসি অন করলো। সবাই এবার যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলো। এতক্ষণ গরমে অতিষ্ঠ হয়েছিল সকলে। আহনাফ একনজর মিনহাজের দিকে তাকালো। মিনহাজ জানালার দিকে মুখ করে আছে। আহনাফ এবার গাড়ির সামনে থাকা আয়নাটা আভার দিকে মুখ করে দিলো। এবার আয়নায় আভাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আহনাফ চক্ষু শীতল করে আভার দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হলো কত দিন পরে দেখা!আভার চুলগুলো উড়ে এসে বারবার ওর মুখে পড়ছে। আর আভা বিরক্ত হয়ে চুল সরিয়ে দিচ্ছে। আহনাফের মনে হলো, সে যদি তার বউফ্রেন্ডের অবাধ্য চুল হতো, তবে সারাজীবন আভার চোখ,মুখ ছুঁয়ে দিতে পারতো।

জ্যাম ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু আহনাফ এখনো গাড়ি চালু করছে না। পিছন থেকে অন্যান্য গাড়ি বারবার হর্ন বাজাচ্ছে। একসময় মিনহাজ আহনাফের দিকে তাকালো। আহনাফ এক ধ্যানে আয়নার দিকে তাকিয়ে আছে। মিনহাজ আহনাফের চোখ অনুসরন করে আভার দিকে তাকিয়েই মুচকি হাসলো।ছেলেটা ফেঁসে গেছে তার বুচি বোনের চক্করে, ভেবেই প্রশান্তির হাসি হাসলো মিনহাজ। মিনহাজ নিজেকে সামলে হালকা করে আহনাফকে ধাক্কা দিলো। আহনাফ এতে সম্ভিত পেয়ে চকিতে মিনহাজের দিকে তাকালে মিনহাজ মৃদু হেসে বলে,

— ” জ্যাম ছুটে গেছে। গাড়ি চালু করো। ”

আহনাফ এতে খানিক লজ্জা পেলো। মিনহাজের সামনে এমন ধরা খেয়ে যাবে বুঝেনি সে। আর দেরি না করে আহনাফ তাড়াহুড়ো করে গাড়ি চালু করলো। আভা হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো সামনে। কি হলো কিছুই মাথায় ঢুকলো না। আজব!

#চলবে
শব্দসংখ্যা- ১৩০০+

#ওয়েডিং_স্টোরি
#পর্ব_৩
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

জমকালো গহনার দোকানে ভিতরে দাড়িয়ে আছে আভা, আহনাফ আর মিনহাজ। দোকানের চতুর্দিকে কৃত্রিম আলোয় ঝলমল করছে। মিনহাজ একপাশে দাড়িয়ে মোবাইলে কি একটা টাইপ করছে। কাউকে হয়তো মেসেজ করছে। আভা সাইড ব্যাগ আকড়ে ধরে আহনাফের থেকে দূরত্ব নিয়ে দাড়িয়ে আছে। আহনাফ দোকানদারের সাথে কথা বলছে। একটু পর আহনাফ আভার দিকে এগিয়ে আসলো।

— ” কোনো আংটির ডিজাইন পছন্দ হয়েছে? ”

আহনাফ আভার দিকে তাকিয়ে বললো। এবার? আভা ত এখনও একটাও আংটি দেখেই নি। আহনাফ আবারও একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে আভা মাথা নাড়িয়ে না বোধক উত্তর করলো।
আহনাফ এতে ব্যতিব্যস্ত হলো। কোনো আংটিই পছন্দ হয়নি? আহনাফ বললো,

— ” তাহলে অন্য দোকান দেখি?চলো? ”

আভা চকিতে বললো,

— ” আরে না,না।আমি এখন পর্যন্ত কোনো আংটি দেখিনি। আপনিই দেখে পছন্দ করে কিনুন। ”

আহনাফ দুনো ভ্রুয়ে ভাজ ফেলে আভার দিকে তাকালো। এই মেয়েটা এত ইন্ট্রোভার্ট কেনো! আহনাফ বললো,

–” মিস বউফ্রেন্ড, এনগেজমেন্ট একা আমার না, তোমারও। তাহলে আমি কেনো একা দুজনের আংটি চুজ করবো? ”

আভা ব্যাগ খামচে ধরে আশপাশটায় চোখ তুলে তাকালো। মিনহাজ একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। এই ভাইয়ের দোকানে এসেও ফোন টিপতে হবে। অদ্ভুত! এখন ও একা একা কিভাবে কি করবে? আভা পড়লো মহা বিপদে। গহনা সম্পর্কে ওর খুব একটা ধারণা নেই। যদি ওর পছন্দ করা আংটি সুন্দর না হয় তবে আহনাফের পরিবার কতকিছু ভেবে নিবে? হায় আল্লাহ! কি বিপদ! আহনাফ আভার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ ছোটছোট করে আভার মতিগতি বুঝার চেষ্টা করছে। মেয়েটা কিছু বলছে না কেনো? আভাকে চুপ থাকতে দেখে আহনাফ ছোট্ট করে এক নিঃশ্বাস ফেললো। তারপর বললো,

— ” ওকে দেন, চলো আমি চুজ করছি। ”

আহনাফ আভাকে নিয়ে আংটির সেকশনে গেলো। আহনাফ ভ্রু কুঁচকে ডিসপ্লেতে সাজানো সবগুলো একে একে আংটি পরখ করলো। কিন্তু একটাও তার পছন্দ হলো না। আহনাফ এবার সেলসম্যানকে বললো,

— ” আংটির ডিজাইন বুক আছে? ”

— ” জ্বি স্যার,আছে।”

সেলসম্যান একটা লম্বা করে বই বের করে আহনাফের দিকে এগিয়ে দিলো। আহনাফ বইয়ের একটার পর একটা পৃষ্ঠা উল্টাচ্ছে। আভা হতাশ হয়ে আহনাফের দিকে তাকিয়ে আছে। এই ছেলেটা যে খুব চুজি সেটা ও এখন উপলব্ধি করতে পারছে। আহনাফ সম্পূর্ণ ডিজাইন বুক নিজে একবার দেখলো। সবগুলো পুরনো মডেল। আহনাফ ঠাস করে বই বন্ধ করলো। সেলসম্যানকে প্রশ্ন করলো,

— ” নতুন কোনো ডিজাইন এসেছে? আমরা আসলে এক্সক্লুসিভ কিছু চাচ্ছি। ”

আভা আহনাফের দিকে অবাক হয়ে তাকালো। এতগুলো ডিজাইন দেখেও একটাও পছন্দ হয়নি? কি চোখ!
আহনাফের প্রশ্নে সেলসম্যান খুব বিনয় নিয়ে বললো,

— ” স্যার,আছে। তবে এগুলো একটু দামী। দেখাবো? ”

আহনাফ ভ্রু বাঁকিয়ে বললো,

— ” আপনাকে আমি দাম নিয়ে চিন্তা করতে বলিনি। প্লিজ দেখান। ”

সেলসম্যান এবার উপর থেকে একটা বক্স বের করলো। বক্স ওপেন করে একটা আংটি বের করলো। আংটিটা অনেক মারাত্মক সুন্দর। আভা উজ্জ্বল চোখে আংটির দিকে তাকালো। আহনাফ আংটিটা নেড়েচেড়ে আভার দিকে এগিয়ে দিলো। জিজ্ঞেস করলো,

— ” এটা ঠিক আছে? ”
— ” আপনার ভালো লাগলে নিয়ে নিন। ”
— ” আমি তোমার ভালো লাগার কথা জিজ্ঞেস করেছি। আমার কথা বলতে বলিনি। ”

আহনাফের ভ্রু কুচকানো শীতল গলা শুনে আভা মাথা নেড়ে বললো,

— ” সুন্দর। ”
–” সিওর?অর্ডার দেই? ”
–“হুম। ”

আহনাফ আভার আঙ্গুলের মাপ দিয়ে আংটিটা অর্ডার দিয়ে দিলো।
গহনার দোকানের বাকি কাজ শেষ করে বেরিয়ে গেলো ওরা। আভা আহনাফ সামনে হাঁটছে। মিনহাজ পিছন পিছন ফোনে কথা বলতে বলতে হাটছে। আহনাফ হাঁটতে হাঁটতে আভার দিকে তাকালো। আভা মাথা নিচু করে নিচে তাকিয়ে হাঁটছে। অদ্ভুত! আহনাফ ভাবলো, এভাবে সামনে না দেখে হাঁটছে কেনো? যেকোনো সময় ব্যথা পেতে পারে এই মেয়ে। এতটা কেয়ারলেস! আহনাফ তাই বললো,

— ” নিচে তাকিয়ে হাঁটলে কোনো কিছুর সাথে ধাক্কা খেতে পারো। সোজা তাকিয়ে হাটো। ”

আভা মাথা তুলে তাকালো আহনাফের দিকে। আহনাফ সামনের দিকে তাঁকিয়ে পা ফেলছে। আভা বললো,

–” ফুটপাথে অনেক সময় পাথর, কাদা আরো কতকি থাকে। যদি ব্যাথা পাই? তাই নিচে তাকিয়ে হাটি। ”

— ” হাঁটার সময় সামনে পিলার, মানুষ আর কতকি থাকে। যদি ব্যথা পান? তাই সামনে তাকিয়ে হাঁটতে হয়। বুঝেছেন?”

আহনাফ অবিকল আভার কথা নকল করে বললো। আভা ফিক করে হেসে ফেললো ওমন কথা শুনে। আহনাফ একবার আভার দিকে তাকিয়েই নজর সরিয়ে ফেললো। এই মেয়ের হাসি মারাত্মক।এক হাসিতেই দিলে ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। আহনাফ চোখ বুজে বুকে হাত দিয়ে কয়েকবার বিড়বিড় করলো,

— “অল’জ ওয়েল। অল’জ ওয়েল। ”

আভা আহনাফের দিকে খানিক অবাক হয়ে চেয়ে রইলো। এমন করলো কেনো এই ছেলে? আহনাফ শান্ত হয়ে হাঁটতে শুরু করলে আভা প্রশ্ন করে,

— ” আপনার আবার কি হলো? ”

আহনাফ অসহায় কণ্ঠে শুধালো,

— ” একটু জন্যে হার্ট ব্লক হচ্ছিল। এখন ঠিক আছি। ”

আভা ফ্যালফ্যাল চোখে তাকালো আহনাফের দিকে। বোকা কণ্ঠে প্রশ্ন ছুড়লো,

— ” আপনি হার্টের রোগী? ”
–” মানে? ”
— ” একটু আগেই তো আপনি বললেন আপনার হার্টে ব্লক হচ্ছে।তাই জিজ্ঞেস করলাম। ”

আহনাফ আভার কথা শুনে বিস্ফোরিত চোখে খানিক চেয়ে রইলো ওর দিকে। চোখে তার নিদারুণ বিস্ময়। তার সমস্ত বিস্ময় সামনে থাকা এই মেয়েকে ঘিরে।অতঃপর আহনাফ আকাশের দিকে তাকিয়ে কি একটা বিড়বিড় করে আভাকে বললো,

— ” নাহ্! কিছু না। হাটো।”

যাক বাবা! এর আবার কি হলো?আহনাফের ওমন প্রতিক্রিয়া আভার ছোট্ট মাথায় ঢুকলো না। ও আনমনে এলোমেলো পা ফেলতে লাগলো ফুটপাথের রাস্তা ধরে।

____________________
রেস্টুরেন্টে এসে বসলো ওরা। আহনাফ আভাকে চেয়ার টেনে দিলে আভা খানিক অস্বস্তিতে পড়ে যায়। আহনাফ সেসব লক্ষ করে টিপ্পনী কেটে বললো,

— ” সামান্য চেয়ার টেনে বসতে বলেছি। এতেই এত! ”

আভা টিটকারী শুনে লজ্জায় নিজের নিচ ঠোঁট চেপে ধরে চুপচাপ চেয়ারে বসে গেলো। আহনাফ মৃদ হেসে আভার মুখোমুখি চেয়ারে বসলো। একটু পর মিনহাজ এসে আভার পাশের চেয়ারটায় বসে পড়লো।
অর্ডার দেওয়া শেষ। ইতিমধ্যে খাবার চলে এসেছে টেবিলে। এত খাবার দেখে আভার চোখ ছানাবড়া। এত খাবার কে খাবে? আহনাফ আর মিনহাজ পরস্পর কথাবার্তা বলে খাবার খাচ্ছে। আভা মাথা নিচু করে নিজের প্লেটের কাবাব বারবার হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে দেখেছে। একটুও খেতে মন চাচ্ছে না। খাবার দেখেই বমি বমি লাগছে ওর। আহনাফ আর মিনহাজের এত জোড়ে জোড়ে কথা বলছে। তাদের কথাবার্তাই সম্পূর্ণ কেবিনটা মাতিয়ে রেখেছে। এত কথা ওরা পায় কোথায়?
” একের অধিক পুরুষ মানুষের একত্র আলোচনা ,পৃথিবীর সব বড়বড় পত্রিকাকেও হার মানায়।”
আপাতত ওদের দেখে আভার এই কথাই মনে হচ্ছে। আহনাফ কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে আভার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে। আভা এতক্ষণে নামেমাত্র খাবার মুখে দিয়েছে। আহনাফ আভার দিকে কড়া চোখে তাকালো। এরকম খায় দেখেই এই মেয়ের আজ এই অবস্থা। একটু পর মিনহাজের ফোনে কল এলো। মিনহাজ কল অ্যাটেন্ড করতে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলো।
মিনহাজ চলে যেতেই আহনাফ আচমকা টেবিলের উপর থাকা আভার বাম হাত আকড়ে ধরে। আভা রীতিমত চমকে যায়। চোখের আকৃতি দ্বিগুণ করে তাকায় নিজের হাতের দিকে। তার হাতটা আহনাফের দখলে দেখে চোখ ঘুরিরে আহনাফের দিকে তাকায়। আহনাফ ডান হাতে চামচ নিয়ে আরামসে বসে বসে খাবার খাচ্ছে।যেনো আভার উপস্থিতি এখানে নগণ্য। আর আভার হাত!ওর হাত তো এই জায়গায় নেই বললেই চলে। আভা এক ঢোক গিলে মিহি সুরে শুধায়,

— ” এইযে, আমার হাত। ”

আহনাফ মুখে খাবার চিবুতে চিবুতে আভার দিকে তাকালো। মুখখানা অবুঝ করে বললো,

— ” কি বললে? ”

আভা বিরক্ত হলো। সে কি খুব আস্তে বললো কথাটা? নাকি এই লোকটা শুনেও না শুনার ভান করলো? আভা এক দম নিয়ে তার হাতের দিকে ইশারা করে আবারও বললো,

— ” আমার হাত!”

আহনাফ আভার মুখের শক্তি ক্ষয় করে বলা বাক্যকে একনিমিশেই হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে এক চামচ বিরিয়ানি আভার মুখের সামনে ধরলো। আভা অবাক হয়ে চামচের দিকে তাকালে আহনাফ বললো,

— ” ও হাত কেটে পড়ে যাক। ওদিকে তাকানোর দরকার নেই। এখন তোমার নজর শুধুমাত্র আমার উপর আর এই বিরিয়ানির চামচের উপর থাকবে। নাও, বড় করে একটা হা করো তো, কুইক। ”

#চলবে