ওহে প্রিয় পর্ব-০৫

0
1723

#ওহে_প্রিয়
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৫
__________________
সুখ,দুঃখ মিলিয়েই জীবন। কিছু মানুষ আছে যাদের কপালে সুখ জিনিসটা থাকে সীমিত। আমি বোধ হয় সেই মানুষ দের তালিকায় রয়েছি। নয়তো জীবন শুরু হওয়ার আগেই এভাবে শেষ হয়ে যায়? বিয়ে শব্দ টাকেই আমার মনে হয় মহামারি। স্বামী শব্দ টাকেই মনে হয় এক আতঙ্কের নাম।

সবটা মেনে নিয়ে মনকে বুঝিয়ে নিয়ে স্বামী হিসেবে ঐ মানুষ টাকে মন থেকে গ্রহণ করতে চেয়েছিলাম। নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু শুরুর পথেই মারাত্মক ভাবে আঘাতগ্রস্ত হই আমি। সেদিন রেষ্টুরেন্টে হ্যাভেনের বলা কথা গুলি আমার হৃদয় ক্ষতবিক্ষত করতে পারেনি। পারবে কি করে আমার হৃদয়ে তো তাঁর স্থান হয়নি। তবে মস্তিষ্কে ভয়াবহ আঘাত লেগেছিলো। বসা অবস্থায়ই জ্ঞানশূন্য হয়ে শরীর ছেড়ে দেই আমি। যখন জ্ঞান ফেরে তখন আমি হ্যাভেনের বেডরুমে আমার মাথার কাছেই প্রচন্ড চিন্তিত হয়ে বসে আছে হ্যাভেন। বিছানা থেকে একটু দূরে সোফায় বসে আছে হিয়া আর শাশুড়ী মা। আমার জ্ঞান ফেরা দেখেই ওনি গিয়ে এক গ্লাস গরম দুধ নিয়ে এসে আমাকে বসিয়ে দিয়ে দুধটা খেয়ে নিতে বলে। আমি ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠি। হিয়া আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। অদ্ভুত ব্যাপার ওরা কেউ আমার জ্ঞানহীন হওয়ার কারণ বা কান্নার কারণ জানতে চায়নি। চাইবে কি করে আমার কাছে তখন হ্যাভেন পুরোটাই অস্পষ্ট হলেও ওদের কাছে ছিলো স্পষ্ট। সবটা ওরা জানতো স্বান্তনা দেওয়ার ভাষাও হয়তো ওদের জানা ছিলো না। কি স্বান্তনা দেবে আমায়? কি বলে স্বান্তনা দেবে?
.
শাশুড়ী আর ননদ চলে যায়। হ্যাভেন শাওয়ার নিয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে আমাকে নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকতে দেখে। পাশের টেবিলে দুধের গ্লাসটা দেখে এগিয়ে এসে বলে দুধটা খেয়ে নিতে। ওর কন্ঠে না ছিলো রাগ, না ছিলো ক্ষোপ না ছিলো অপরাধ বোধ আর না ছিলো খুশি। একদম স্বাভাবিক ছিলো।

কিন্তু আমি পুরোটাই অস্বাভাবিক হয়ে যাই। যতোই বলি বিয়ে মানি না৷ ঐ মানুষ টা কে স্বামী হিসেবে মেনে নেবো না। সত্যি তো এটাই ঐ মানুষ টা আমার স্বামী৷ আমার শরীরের প্রতিটা লোম কূপ জানে ঐ মানুষ টা আমার কে? ভালো বাসি না বলে যার নামে তিন কবুল পড়েছি, বিয়ের রাত থেকে শুরু করে প্রতিটা রাত যার কাছে নিজেকে বিলিয়ে দিচ্ছি,অনিচ্ছায় হলেও প্রতিটা রাত যে মানুষ টার উন্মুক্ত বক্ষের সাথে লেপ্টে থাকছি। প্রিয় হয়ে না হলেও অপ্রিয় হয়ে হলেও ঐ মানুষ টাই আমার জীবনের প্রথম পুরুষ, তাঁর দেওয়া সকল স্পর্শই আমার অনুভূতি তে তীব্রভাবে মিশে আছে। হোক না ঘৃণ্য, হোক না মানুষ টা অপ্রিয় তবুও তো আমার স্বামী। আকস্মিক ভাবেই আমি তাঁর হয়ে গেছি। কষ্ট হলেও দীর্ঘ সময় লাগলেও মেনে নিতাম তাঁকে। করে নিতাম তাঁকে শুধুই আমার। কিন্তু পারলাম না তাঁকে আমার করতে। ঘৃণায় নিজের শরীর নিজেই টুকরো টুকরো করে ফেলতে ইচ্ছে করছিলো৷ সব মেনে নিতে পারলেও মেনে নিতে পারছিলাম না হ্যাভেনের বলা ঐ একটা বাক্য। সব দিক দিয়ে যেনো ঠকে গেলাম আমি। শুনেছি যে যেমন তাঁর জীবনসঙ্গীও তেমন হয়। কিন্তু কোথায়? আমার জীবনে প্রেম, ভালোবাসার দাবি নিয়ে আসা কোন পুরুষকে তো ঠাই দেইনি। তাহলে হ্যাভেন কেনো আমার ভাগ্যে এলো? সব দিক দিয়ে হ্যাভেন আমার বিপরীতে রয়েছে তাহলে কেনো হলো ওর আমার মিলন?
পাগলের মতো ছটফট করতে থাকি আমি। কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না সবটা। রেষ্টুরেন্টের ঘটনাটা এক সেকেন্ডের জন্যও ভুলতে পারছিলামনা৷ বিয়েটা মেনে নিতেও আমার এতো কষ্ট হয়নি যতোটা কষ্ট হ্যাভেনের ঐ কথাটা শোনার পর হচ্ছিল। কিছুতেই মানতে পারছিলাম না আমার আগে হ্যাভেনের অন্য একটা মেয়ের সাথে সম্পর্ক ছিলো। শুধু সম্পর্ক নয় খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।
.
দিন পেরিয়ে ঘনিয়ে আসে রাত। সারাদিন মুখে কিছু তুলতে পারিনি। রাতে এক গ্লাস পানি খেতে গিয়েও গলা দিয়ে পানি নামলো না। বিছানার একপাশে গুটিশুটি হয়ে শুতেই হ্যাভেন আমাকে স্পর্শ করে। গা ঘিনঘিন করে ওঠে আমার। গা গুলিয়ে বমি পায় খুব। এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে বিছানা থেকে ওঠে পড়ি। আর যাই হোক এরপর আর লোকটার কাছে দূর্বল হয়ে নরম হয়ে পড়ে থাকা যায় না৷ বাথরুম গিয়ে চোখে, মুখে পানি দিয়ে আসি। বালিশ ছাড়াই সোফায় গিয়ে শুয়ে পড়ি।

প্রত্যাখ্যান সহ্য করার মতো ছেলে হ্যাভেন নয়। একটা মেয়ে যে কিনা বিয়ের একমাসের মাথায় জানতে পেরেছে তাঁর স্বামীর জীবনে অন্য একটা মেয়ে ছিলো যার সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিলো খুবই ঘনিষ্ঠ। যেখানে স্বামী মানুষ টাকে মানতে নারাজ আমি সেখানে তাঁর জীবনে এমন জঘন্য ঘটনা রয়েছে জানলে আমার মনের অবস্থা ঠিক কি হতে পারে? না ভাবার প্রয়োজন বোধ করেছে না অনুভব করার প্রয়োজন বোধ করেছে। সে শুধু বুঝেছে তাঁকে কেনো আমি প্রত্যাখ্যান করলাম? বিছানা থেকে ওঠে গিয়ে কোলে তুলে নেয় আমায়। গায়ের জোর খাটিয়ে নিজের চাহিদা মেটায়। সে সময় আমার মাথায় একটা কথাই চলতে থাকে এই লোকটার সাথে সারাজীবন কাটানো জাষ্ট অসম্ভব। এতো ঘৃণা এতো বিতৃষ্ণা নিয়ে একটা মানুষের সাথে সারাটা জীবন কাটানো মৃত্যুর থেকেও কঠিন।
.
সকাল হতেই ঘুম ভাঙে হ্যাভেনের ফোনের শব্দে। আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জরিয়ে ঘুমিয়েছিলেন ওনি। ঘুম ভাঙতেই আরো গভীর ভাবে জরিয়ে গলায় মুখ ডুবিয়ে দিলেন। ফোন রিসিভ করে ওভাবেই কথা বলছিলো। ওপাশের লোকটা বলছিলো আর ওনি হুম,হা উত্তর দিচ্ছিলো। যার ফলে ওপাশের ব্যাক্তির পুরো কথাটাই আমি শুনতে পাই। হ্যাভেন সহ হ্যাভেনদের পার্টির সকলকেই সেদিন দুপুর থেকে রাজনৈতিক মিটিংয়ে অংশ গ্রহণ করতে হবে। অর্থাৎ সেদিন দুপুরের পর থেকে হ্যাভেন বাড়ি থাকবে না৷
.
সকালে সকলকেই একসাথেই খেতে দেওয়া হয়৷ ও বাড়ির নিয়মগুলো প্রচন্ড বিরক্ত লাগতো আমার। স্বামীর প্রতি ভক্তি,ভালোবাসা থাকলে হয়তো এতোটা বিরক্ত হতামনা এসব বিষয়ে। হ্যাভেন যখন খেতে বসতো তাঁর পাশে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকতে হতো আমাকে। আমার মতো করেই আমার শাশুড়ী মা ও আমার শশুর মশাইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতেন। বাকিদের কাজের লোকেরা খাবার পরিবেশন করলেও শশুর কে শ্বশুড়ী আর হ্যাভেনকে আমিই খাবার পরিবেশন করতাম। খাওয়া শেষে সকলের সামনেই হ্যাভেন আমার আঁচল দিয়ে হাত,মুখ মুছতো। বাড়ির বাইরে বের হওয়ার সময় তাঁর পিছনে থাকতে হতো আমাকে। সদর দরজা অবদি গিয়ে থেমে পিছন ঘুরে সেই বিশ্রি হাসিটা দিয়ে কপালে চুমু খেতো। লজ্জায় মাথা কাঁটা যেতো আমার৷ এই কাজটা নিজের বেড রুমে চার দেয়ালের ভিতরে করলে এতোটাও বিরক্ত হতাম না বোধ হয়। বেডরুম থেকে বের হওয়ার সময় হাজার অসভ্যপানা করলেও তাঁর আশ মিটতো না সদর দরজায় দাঁড়িয়ে সকলের সম্মুখে নিজেকে নির্লজ্জ প্রমাণ তাঁকে করতেই হতো। এতো বেহায়া পুরুষ মানুষ আমি এ জীবনে আর দুটো দেখিনি। প্রচন্ড রাগ হতো আমার প্রচন্ড বিরক্ত বোধ করতাম এসবে৷ কিন্তু লাভ হতো না। আমি তাঁর আচরণে তাঁর স্বভাবে বিরক্ত হই, রাগি বা ঘৃণা করি এতে তাঁর বিন্দু পরিমাণও জায় আসে না। সে তাঁর মর্জিতেই চলে।
______________________
দুপুরে শ্বশুর মশাই, শ্বাশুড়ী মা আর ননদ মিলে একসাথেই খাবার খাই। খাবার গলা দিয়ে নামছিলো না আমার। খুব বেশী চিন্তায় থাকলে মানুষের মধ্যে একটা অস্থিরতা কাজ করে। আমার অবস্থা তখন ঠিক তেমনি৷ শুধু চিন্তা নয় বরং আমি নির্দিষ্ট একটা সময়ের অপেক্ষা করছিলাম। গভীর কূপে পড়ে গেছি আমি সেখান থেকে যেভাবেই হোক উপরে ওঠতে হবে আমায়। অন্ধকারে হাতড়িয়ে হাতড়িয়ে একটু আলোর ঠিকানা খুঁজে বেড়াচ্ছি যেনো।
.
শ্বশুর মশাই খেয়ে দেয়ে কিছুক্ষণ রেষ্ট নিয়ে বেরিয়ে গেলেন৷ চাচা শ্বশুর মশাই শহড়ের বাইরে আছেন। ননদ নিজ রুমে গিয়ে ঘুমানোর প্রিপারেশন নিচ্ছে। শাশুড়ী মা ও ভাতঘুম দিচ্ছে। কাজের লোক গুলো নিজেদের সব কাজ কমপ্লিট করে রান্না ঘরেই খেতে বসেছে। সবার অবস্থান দেখে নিয়ে আমি দ্রুত রুমে চলে যাই। জানালা দিয়ে ওকি দিয়ে দেখি দাড়োয়ান চাচা কি করছে। গেটে তালা লাগানো রয়েছে অর্থাৎ দাড়োয়ান চাচা দুপুরের খাবার খাচ্ছেন। এ সময় কেউ বাড়িতে আসবে না বাড়ি থেকে কেউ বেরও হবে না৷ তাই এসময়টাই দাড়োয়ান চাচা দুপুরের খাবার খায়। গায়ের সকল গহনা খুলে বিছানার একপাশে রেখে দিলাম৷ আমার নিজস্ব বলতে তালুকদার বাড়িতে কিছুই ছিলো না৷ এই আমিটাও আর আমার নিজের নই। জোর জুলুমের শিকার হয়েই অন্যকারো হয়ে গেছি। তবুও আমি শুধু আমাকে নিয়েই এক কাপড়ে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পড়লাম।

গেটের সামনে গিয়ে দ্রুত শাড়ির আঁচল কোমড়ে বেঁধে নিয়ে গেট টপকালাম। শহড় থেকে বেশ দূরেই আমার বাবার বাড়ি। কোনদিকে না তাকিয়েই বাড়ির সামনে থেকে একটা সিএনজি নিলাম। উদ্দেশ্য সর্বপ্রথম নিজের বাড়ি যাওয়া সেখানে গিয়ে বাবা,মা, বোনকে এক নজর দেখে প্রয়োজনীয় জিনিস পএ নিয়ে চট্টগ্রাম মামার বাড়ি যাওয়া। আমার ধীর বিশ্বাস এই মহাবিপদ থেকে একমাএ মামাই আমাকে বাঁচাতে পারবে। বাঁচার জন্য, মুক্তি পাওয়ার জন্য এতোটাই মরিয়া হয়ে গিয়েছিলাম যে হিতাহিতজ্ঞান শূন্য হয়ে গিয়েছিলো আমার। নয়তো বোকার মতো টাকা ছাড়া একটা সিএনজি তে ওঠে পড়ি আমি?
.
অর্ধেক রাস্তায় যেতেই জ্যামে আটকে যাই। সিএনজির সামনে একজন ভদ্রলোক ছিলেন অধৈর্য হয়ে ভাড়া মিটিয়ে নেমে পড়েন তিনি। তখনি আমার হুঁশ ফেরে। আমিতো কোন টাকা,পয়সা সাথে নিয়ে বের হইনি। যদি সিএনজি থেকে এখনি নেমে যেতে হয় আমি ভাড়া দিব কি করে? টেনশনে পেট চেপে আসলো তখন আমার। কান্না পাচ্ছিলো খুব। ভয়ে, চিন্তায় পুরো শরীর ঘামতে থাকে। পা দুটো কাঁপতে থাকে ভীষণ। দুহাতে হাঁটু চেপে ধরে কম্পন থামানোর চেষ্টা করি। তখনি সিএনজির ড্রাইভার বলে ওঠে,

-‘আপামনি আগানো সম্ভব হইতাছে না আপনি নাইমা কিছুটা পথ হাঁইটা যান। সামনে থিকা আবার সিএনজি বা অটো নিয়া নেবেন’।

আমি থরথর করে কাঁপতে শুরু করলাম। শুধু ভাড়া নেই এজন্য শুধু এতোটা ভয় আমি পাচ্ছিলাম না। বরং হ্যাভেনের গন্ডি থেকে নিজেকে মুক্ত করার শাস্তি কতোটা ভয়ংকর হতে পারে তা ভেবেই ভয়ে হাত, পা বাঁকা হয়ে আসছিলো আমার। একদিকে ভাড়া নেই আরেকদিকে সিএনজি থেকে নামার পর কেউ যদি চিনে ফেলে সে ভয়। আমার ওপর দিয়ে সেসময় কি যাচ্ছিলো এক আমি আর উপরওয়ালা জানেন৷

-‘ ভাই আমার কাছে তো কোন ভাড়া নেই। আরেকটু অপেক্ষা করি জ্যাম ছাড়ুক। আপনি আমাকে আমার ঠিকানায় পৌঁছে দিন ভাড়া দিয়ে দিব’।

কাঁপা গলায় কথাগুলো বলে থামলাম আমি। সিএনজিওয়ালা ভাই আমার দিকে কেমন চোখে যেনো তাকালো। তারপর আরো এিশ মিনিট জ্যামেই বসে ছিলাম হঠাৎ কি হলো সিএনজিওয়ালা ভাই আমাকে বললেন,

-‘ আপামনি ভাড়া দিতে হইবো না আপনি নাইমা যান’।

-‘কি বলছেন ভাই! প্লিজ আরেকটু ধৈর্য ধরুন জ্যাম ছেড়ে যাবে আমাকে আমার ঠিকানায় পৌঁছে দিন। কথা দিচ্ছি আপনার ভাড়া আমি মিটিয়ে দেবো’।

ওনি আমার কথা শুনলেন না। শেষ পর্যন্ত আমাকে ধমকে ধমকে সিএনজি থেকে নামিয়ে দিলেন। কিন্তু একবারো ভাড়া চাইলেন না৷ আমি নেমে পড়ার সাথে সাথে সিএনজি ড্রাইভার ভাইকে একজন পুরুষ লোক এিশ টাকা ভাড়ার জায়গায় পঞ্চাশ টাকা দিলেন। আমি বিস্ময় চোখে তাকিয়ে রইলাম পুরুষ লোকটির দিকে৷ কারণ সে আর কেউ নয় সেদিন রেষ্টুরেন্টে পরিচয় হওয়া সেই ব্যাক্তিটি নাম জিসান৷ ভয়ে আমার হাত,পা বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিলো। কোনরকমে নিজেকে সামলে নিলাম আমি। এক ঢোক গিলে সেখান থেকে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম৷ তখনি জিসান আমার দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন। অদ্ভুত এক দৃষ্টি ফেললেন তিনি আমার দিকে৷ সে দৃষ্টির রহস্য আমি সে সময় কব্জা করতে পারিনি৷ তবে আমার সিক্সথ সেন্স বলছিলো ভয়াবহ কিছু একটা ঘটতে চলেছে৷

-‘ ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড ক্যান আই হেল্প ইউ’? বলেই ভূবন ভুলানো এক হাসি দিলেন জিসান।

আমি জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আশেপাশে গিজগিজে মানুষ এক মহিলা এসে ধাক্কা খেলো আমার সাথে। জিসান বললো,

-‘ মিসেস আহি আপনার যদি কোন প্রবলেম না থাকে আপনি আমার সাথে আসুন আমি আপনাকে আপনার গন্তব্যে পৌঁছে দিব ‘।

-‘ ধন্যবাদ তাঁর কোন প্রয়োজন নেই ‘ বলেই সামনে আগাতে থাকলাম আমি। ওনিও আমার সাথে পায়ে পা মিলিয়ে এগুতে এগুতে বললেন,

-‘ আপনার সামনে খুব বিপদ। আপনি বোধ হয় আপনার হাজব্যান্ডের বিষয়ে পুরোপুরি অবগত নন। আমি যে আপনার হাজব্যান্ডের বন্ধু কম শত্রু বেশী আশা করি সেদিন বুঝতে পেরেছেন। ভয় নেই আমি আপনাকে সহায়তা করবো বড় ভাই মনে করে হলেও আপনি আমার সাথে আসুন ওপাশে আমার গাড়ি রাখা আছে আপনাকে সম্পূর্ণ নিরাপত্তা দিয়ে নিজের ঠিকানায় পৌঁছে দিব’।

আমি থেমে গেলাম সন্দেহী চোখে তাকালাম ওনার দিকে। আমার চাহনী দেখে ওনি বললেন,

-‘ কি ভাবছেন যেচে এসে সাহায্য করছি কেনো? ঐ যে বললাম বন্ধু কম শত্রু বেশী। শত্রুর বিবাহিত বউ তাঁকে ছেড়ে পালাচ্ছে এর থেকে আনন্দদায়ক আর কি হতে পারে? অনেক বছর পর আবারো হ্যাভেন তালুকদারকে হারতে দেখবো। অন্যকে হারতে দেখা স্পেশালি হ্যাভেন তালুকদার কে হারতে দেখার মতো মনোরম দৃশ্য আমার কাছে এ পৃথিবীতে আর দুটো নেই৷ ওর ঘরে শূন্যতা নেমে এলে বরাবরই আমার ঘর পূর্ণতা পায় যে’ বলেই অদ্ভুত চোখে তাকালেন।

সে সময় কি যেনো হলো আমার। মাথা কাজ করছিলো না। কি ঠিক কি ভুল মাথায় ছিলো না আমার৷ শুধু মাথায় একটা কথাই চলছিলো পালাতে হবে আমায় হ্যাভেন তালুকদার থেকে পালাতে হবে।
.
মাগরিবের আজান দিচ্ছে। ড্রাইভিং সিটে বসে আছে জিসান তাঁর পাশের সিটে আমি। গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার ঠিক পনেরো মিনিট পর – শহড় ছাড়াইনি তখন সে মূহুর্তেই সামনে একটি কার এসে থামলো। তাঁর পিছনে পনেরো,ষোলটা বাইক। আমার অবস্থা তখন ঠিক কি বলে বোঝাতে পারবো না। জিসানের দিকে আতঙ্কিত হয়ে তাকাতেই দেখলাম জিসান মিটিমিটি হাসছে। অথচ কয়েক সেকেন্ড আগেও তাঁর মুখটা ভয়ার্ত ছিলো৷ হঠাৎ এমন হাসছে কেনো? তাঁর মানে কি জিসানও আমাকে ঠকালো? হ্যাভেনের সাথে প্ল্যান করেই এমন টা করলো জিসান? নানারকম প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিলো মাথায় সে মূহুর্তেই পিছনের বাইক থেকে ছেলেরা নেমে হকি স্টিক দিয়ে জিসানের গাড়ি ভেঙে চুরমার করে ফেললো। হ্যাভেন শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে এগিয়ে এসে তিনটা লাথি দিলো গাড়ির ডোরে৷ জিসান মুচকি হেসে ডোর খুলে দিয়ে নিজে নেমে পড়লো। হ্যাভেন ভয়ংকর চাহনীতে চেয়ে একটানে গাড়ি থেকে নামালো আমাকে। সকলের সামনেই পরপর তিনটা থাপ্পড় দিলো আমার গালে। হ্যাভেনের ছেলেরা জিসানের গায়ে হাত তুলতে যেতেই জিসান উচ্চ কন্ঠে বলে ওঠলো,

-‘ এমপির ছেলের গায়ে হাত তুলবি তোরা? হাহাহা জান নিয়ে ঘরে ফিরতে পারবি তো ‘?

হ্যাভেন বাঘের মতো গর্জন তুলে জিসানের কলার চেপে ধরলো৷ আমার দেবর হিরা মাথা নিচু করে আমার সামনে এসে বললো,

-‘ ভাবী মা আসুন আমার সাথে গাড়িতে ওঠে বসুন ‘।

আমি হুহু করে কেঁদে ওঠলাম। এমন ভয়ংকর পরিস্থিতি তে ঠিক কিভাবে নিজেকে ঠিক রাখবো বুঝতে পারছিলাম না৷ হিরা আমাকে রিকোয়েস্ট করলো,

-‘ ভাবী মা দোহায় আপনাকে আপনি গাড়িতে গিয়ে বসুন ‘।

এদিকে জিসানের কলার চেপে ধরতেই জিসান এক ঝটকায় হ্যাভেনের হাত ছাড়িয়ে উচ্চ স্বরে হাসতে হাসতে বললো,

-‘ কি কান্ড! কি কান্ড! হ্যাভেন তালুকদার এবারেও বউকে কন্ট্রোল করতে পারলো না? ইশ পারবে কি করে নিজেকে আয়নায় কখনো ঠিকভাবে দেখলে তো পারবে। বার বার কে কিড়া দেয় তোকে এমন আহামরি সুন্দরী বউ ঘরে তুলতে? শালা, আরো ঘন্টা খানিক পর বউয়ের খোঁজ করতে পারলিনা সব স্যাট আপ করে ফেলেছিলাম একদম লাইভে যেতাম তোর বউকে নিয়ে অবশ্য এতে রূপসাকে হারাতো হতো। কিন্তু এমন জিনিসের জন্য রূপসাকে হারাতে আমার খুব একটা পুড়তো না ‘।

চলবে…