ওহে প্রিয় পর্ব-৮+৯

0
1698

#ওহে_প্রিয়
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৮+৯
_________________
জসিম আহমেদ, জিসানের বাবা রাজনীতির দিক থেকে হারিয়েছেন হুমায়ুন তালুকদার কে। এতে তাঁর সবদিক দিয়েই চরম ক্ষতি হয়েছে৷ জসিম আহমেদের উদ্দেশ্যই ছিলো হুমায়ুন তালুকদার সহ তাঁর পুরো পরিবার কে সবদিক দিয়ে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া। বহুদিনের রাজনৈতিক শত্রুতা তাঁদের।
তাই তো তাঁর ছেলে হ্যাভেনের জীবনে সুচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বের হয়েছে। মানুষের জীবন অর্ধেক ধ্বংস হয়ে যায় পরম বন্ধু রূপে শত্রুর আগমন ঘটলে। হ্যাভেনের জীবনও ধ্বংস হয়েছে জিসান এবং রূপসার আগমনে৷

সেদিনের পর থেকেই পরিবর্তন আসে হ্যাভেনের ব্যাক্তিত্বে ৷ ডিভোর্স পেপারে সাইন করার পর থেকেই যেনো নতুন এক হ্যাভেনের জন্ম হয়। যে হ্যাভেন পরিবার, সমাজ এবং শহড়ের জন্য হয়ে যায় এক আতঙ্কের নাম। রাজনীতিতে পুরো মনোনিবেশ করে। বাবার থেকেও ছেলে হয়ে যায় তুখোড় রাজনীতিবিদ। এসবে হুমায়ুন তালুকদারের খুশি হওয়ার কথা থাকলেও সে খুশি হতে পারেনি। কারণ এর মধ্যে হ্যাভেনের মাঝে অনেক অস্বাভাবিক আচরণ ফুটে ওঠে। বাবা হিসেবে ছেলের এই অস্বাভাবিকতা মেনে নিতে পারেন না তিনি। এদিকে হ্যাভেনও হয়ে যায় একরোখা। কি ঠিক কি ভুল বিবেচনা করে কখনোই কাজ করে না সে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এই বিষয় টা তেমন সমস্যা সৃষ্টি করতে পারেনি। কারণ হ্যাভেন পরবর্তীতে জসিম আহমেদের প্রতিপক্ষ হিসেবে নিজেকে তৈরী করছিলো। বাবা নয় এবার ছেলে হবে প্রতিপক্ষ। তখন থেকেই প্রতিটি মূহুর্তে বাড়ির প্রতিটি সদস্যর চোখেই ধরা পড়ে শান্তশিষ্ট হ্যাভেনের অশান্ত রূপ। চোখ দুটো সবসময় থাকে রক্তিম বর্ণ। দুচোখ জুরে সর্বসময় থাকে প্রবল অস্থিরতা।

পরিবার থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় অনেক ভালো পরিবারের মেয়েকে হ্যাভেনের বউ করে নিয়ে আসবে। নতুন কেউ তাঁর জীবনে এসে জীবনটা সুন্দর ভাবে গুছিয়ে দিলে নিশ্চয়ই ভুলে যাবে পুরোনো ক্ষত?

নামি-দামি পরিবারের মেয়ের সঙ্গেই বিয়ে ঠিক করা হয় তাঁর। মেয়ের বাড়িতে প্রথম দিন উপস্থিত হতেই মেয়ের ফুপু সামনেই বলে ওঠে,

-‘ সবই ঠিক আছে ছেলের গায়ের রঙটা বেশ চাপা হয়ে গেছে। আমাদের মেয়ে আবার ধবধবে ফর্সা। বাচ্চাকাচ্চা মায়ের রঙ পেলেই হয় ‘

মেয়ের ফুপুর কথা শেষ হতেই মেয়েকে আনা হয় মেয়েকে সামনে আনা মাএই সকলের সামনে মেয়ের মুখে থুথু ফেলে হ্যাভেন। তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে,

-‘ তোর ফর্সা চামড়ায় আমার থুথু বড্ড বেশীই মানানসই ‘। বলেই হনহন করে বেড়িয়ে যায়।

লজ্জায় মাথা নত করে ফেলে হুমায়ুন তালুকদার। মেয়ের বাড়ির সামনে সেদিন তিনি কতোটা ছোট হয়েছেন শুধু তিনিই জানেন। ছেলের আচরণে সে নিজেই হতবাক। বাড়ি ফিরে হিংস্র গলায় হ্যাভেন বলে তাঁর জন্য মেয়ে না দেখতে সময় হলে সেই তুলে আনবে কোন অপরূপ সুন্দরী কে।
.
তারপর থেকেই কারো প্রত্যাখ্যান সে সহ্য করতে পারেনা। গায়ের রঙ নিয়ে কেউ তাঁকে তুচ্ছ করলে সে যেনো ক্ষেপা বাঘ হয়ে যায়। সবচেয়ে বেশী আঘাত বোধহয় এই জিনিসটাতেই পেয়েছিলো সে। উপরওয়ালা না হয় ওনাকে গায়ের রঙেই কমতি দিয়েছেন তাই বলে জীবনে চলার পথে এই কমতি টা এভাবে আঘাত হানবে? ভালোবাসা হারানোর যন্ত্রণা, ভালোবাসার মানুষের তাচ্ছিল্য,বন্ধুত্বে, ভালোবাসায় বিশ্বাসঘাতকতা উন্মাদ বানিয়ে দেয় ওনাকে। কাউকে সহ্য করতে পারেন না ওনি, নিজের মর্জিতেই চলে অন্যকাউকে তেমন গুরুত্ব দেয় না। অপরাধ কে অপরাধ বলে বিবেচনা করে না সে। ডিপ্রেশনে ভুগতে ভুগতে সাইকোপ্যাথিতে আক্রান্ত হয়ে যায় ওনি। হুমায়ুন তালুকদার সহ পরিবারের প্রত্যেকেই টের পায় হ্যাভেন দিন দিন মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে ৷ কোনভাবেই যখন তাঁকে বোঝানো যাচ্ছিল না, সামলাতে পারছিলো না, তখন সিদ্ধান্ত নেয় জরুরি ভিত্তিতে তাঁর চিকিৎসা করাবে। কিন্তু সেটি করতেও পারেনি প্রথম দিন হ্যাভেনের মা বুঝিয়ে শুনিয়ে ডক্টরের কাছে নিয়ে গেলে ডক্টর কে মারধর করে হসপিটাল এডমিট করে চলে যায় সে। পুলিশ ক্যাস হতে যাচ্ছিলো ব্যাপারটা তাঁর আগেই ডক্টর এবং নার্সকে টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ করে রাখা হয়৷ একবার পুলিশ ক্যাস হয়ে গেলে এ বছর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন পেতে খুবই কাঠখড় পোহাতে হতো হ্যাভেনকে।
.
সেদিন এ পর্যন্তই বলে আমায় হ্যাভেন। তারপর নিশ্চুপ হয়ে ঘুমিয়ে যায় ওনি। আর আমি ওনার বুকে মুখ গুঁজেই অঝড়ে কাঁদতে থাকি। এতোকিছুর মাঝে আমি মেনে নিতে পারছিলাম না হ্যাভেনের জীবনে অন্য কেউ স্ত্রী রূপে ছিলো। ঠিক যেভাবে প্রতিটা রাত আমার মাঝে মিশে থাকেন ওনি এভাবেই মিশে থাকতো রূপসার মাঝে। রূপসাকে ভালোবেসে কাছে টানতো ওনি আর আমাকে? নেশার ঘোরে বলতো ভালোবাসি নেশা কেটে গেলেই তাচ্ছিল্যের হাসি দিতো। আমি সহ্য করতে পারছিলাম না এই দহন৷ স্ত্রী হিসেবে নিজ স্বামীর থেকে ভালোবাসা পাওয়া টা আমার অধিকার। সেখানে ওনি আমায় বিয়ে করেছেন অসুস্থ মস্তিষ্ক নিয়ে, প্রত্যাখ্যান সহ্য করতে না পেরে। যে প্রত্যাখ্যানের জন্য ওনার মস্তিষ্ক, মন চরম ভাবে আঘাতগ্রস্ত হয়েছে, যে গায়ের রঙকে তাচ্ছিল্য করে ওনার ভালোবাসা ওনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। সেই প্রত্যাখ্যান সেই তাচ্ছিল্য ওনি দ্বিতীয় বার সহ্য করবেনা বলেই বিয়ে করেছেন আমায়। বজায় রেখেছেন নিজের জেদ কে। কি লাভ এমন ভিত্তিহীন একটা সম্পর্কে জরিয়ে থেকে? ঐ লোকটা না হয় অসুস্থ আমিতো অসুস্থ নই। তাহলে কেনো ওনার অসুস্থতাকে সারাজীবনের সঙ্গী করে নেবো আমি?
.
সেদিনের পর একদিন ওনি আমায় ভার্সিটিতে এডমিশন নিয়ে দেয়। শুরু হয় নিয়মিত ভার্সিটিতে যাওয়া। কিন্তু পড়াশোনায় মন বসাতে পারতাম না।
আমাকে যখন ওনি ক্লাসে পৌঁছে দেয় আমার সাথে আরো সাত,আটজন ক্লাসে যায়। তাঁরা কিন্তু স্টুডেন্ট নয় তবুও তাঁরা পুরো ক্লাস টাইম বসে থাকে। ক্লাস শেষে আমার সঙ্গেই বেড়িয়ে যায়। এরা আমাকে ভার্সিটিতে সর্বক্ষণ ফলো করে। একদিন ভুলবশত একটা ছেলের সাথে ধাক্কা খাই ফলশ্রুতিতে ছেলেটিকে তিনদিন হসপিটালে কাটাতে হয়৷ আর বাড়ি নিয়ে আমাকে পুরো একঘন্টা ঠান্ডা পানিতে গোসল করানো হয়। এ সবই ছিলো ওনার অসুস্থ মস্তিষ্কের কাজ৷ পুরো বাড়িতে সিসি ক্যামেরা সেটআপ করা রয়েছে। পুরো ভার্সিটিতে রয়েছে সশরীরের সিসি ক্যামেরা। দম বন্ধ করা পরিবেশে বসবাস করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেছি আমি। বাবা,মা, বোনকে দেখার ইচ্ছে হলে ওনি নিজে গিয়ে তাঁদের নিয়ে আসে তবুও এক ঘন্টার জন্য নিজ পরিবারের কাছে যেতে দেয়নি। ওনার মন জুরে আমার জন্য ভালোবাসা নেই আছে শুধু অবিশ্বাস আর সন্দেহ। কোনদিন ওনি আমায় স্বস্তি দেবেন না আর না নিজে স্বস্তিতে থাকবেন৷ দিনের পর দিন আতঙ্কিত জীবন কাটাতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল।
আমি এই অসুস্থ লোকটার সাথে মানিয়ে নিতে পারছিলাম না আর। পালিয়ে যেতেও পারছিলাম না। কিন্তু হঠাৎ করেই আজ এমন একটা পরিস্থিতির মুখোমুখি হলাম যে আমার মন,মস্তিষ্ক যা বললো ঠিক তাই করলাম। পালিয়ে এলাম ঐ শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ থেকে।
____________
আহির প্রতিটা কথাই মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো সালমা রহমান সাবা৷ তাঁর ৩৩ বছরের জীবনে কম মানুষের সাথে পরিচয় ঘটেনি। বহু মানুষের জীবনের বহু জটিলতার কাহিনী শুনেছে। নিজের জীবনেও কম জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়নি তাঁকে। তাঁর কাছে প্রতিটি মানুষের জীবনই সরল অংকের মতো। প্রথম দিকে সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো আহিকে যে করেই হোক আইনের সহায়তা নিয়ে হ্যাভেন থেকে উদ্ধার করবে৷ কিন্তু ধীরে ধীরে তাঁর সেই মনোভাবের পরিবর্তন ঘটলো এবং শেষের দিকে চরম বিরক্ত হয়ে চোখ,মুখ কুঁচকে ফেলে প্রশ্ন করলো,

-‘ এতোক্ষণে নিশ্চয়ই তোমার খোঁজে পুরো শহড় তোলপাড় চলছে? যেহেতু পুরো বাড়িতে সিসি ক্যামেরা রয়েছে সেহেতু তোমায় খুঁজে পেতে খুব একটা পরিশ্রম করতে হবে না তাঁদের। আর সেকেন্ড টাইম হ্যাভেন থেকে পালিয়েছো ধরা পড়লে এর শাস্তি ঠিক কতোটা ভয়ানক হবে আশা করি বুঝতে পারছো ‘?

-‘ শাস্তি যাইহোক হ্যাভেন বেঁচে থাকলে আমার মৃত্যু হবেনা ম্যাম। কিন্তু সুযোগ যখন পেয়েছি চেষ্টা তো করাই যায় ‘।

-‘ আর যদি বেঁচে না থাকে ‘?

আঁতকে ওঠলো আহি ভয়ার্ত চোখেমুখে চেয়ে রইলো সাবার দিকে। সাবা তাচ্ছিল্য হেসে বললো,

-‘ দেড় বছরের বৈবাহিক সম্পর্ককে তুচ্ছ করে হাজব্যান্ডকে মৃত্যুশয্যায় ফেলে এসে তাঁর মৃত্যুর আশঙ্কা শুনে ভয় পাচ্ছো ‘?

নিভে গেলো আহি দুচোখ উপচে অনবরত অশ্রু ঝড়তে শুরু করলো। সাবা আহির দুহাত নিজের দুহাতের মুঠোয় নিয়ে শান্ত গলায় বললো,

-‘ আমি তোমায় সাহায্য করবো। কিন্তু তাঁর আগে আমি তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই এবং কিছু প্রশ্ন করতে চাই। আশা করি সঠিক উত্তর দেবে’।

কিছুক্ষণ চললো পিনপতন নীরবতা। নীরবতা ভেঙে সাবা বললো,

-‘ মানুষের গোটা জীবনই ধাঁধার মতোন। মানুষের জীবনে কিছু ঘটনা ঘটে তাঁর মধ্যে কিছু ঘটে স্বাভাবিকভাবে আর কিছু ঘটে অস্বাভাবিক বা এক্সিডেন্টলি। হ্যাভেনের সাথে তোমার বিয়েটাও এক্সিডেন্টলি হয়েছে। কিন্তু তুমি কি জানো আমাদের জীবনে স্বাভাবিকভাবে যা ঘটে বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই তা হয় ক্ষনস্থায়ী। আর হুট করেই অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনাই আমাদের জীবনের সাথে ওতোপ্রোতো ভাবেই জড়িয়ে যায়৷ নিয়তি বদলে ফেলার ক্ষমতা এক উপরওয়ালা ছাড়া কারো নেই। কিন্তু আমরা মানুষ রা সেই নিয়তি কে বদলাতে গিয়ে নিজেদের জীবনকে অনেক সময় বিপর্যস্ত করে ফেলি’।

আহি নিশ্চুপ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। সাবা স্মিত হেসে বললো,

-‘ আমার কাছে হ্যাভেন নির্দোষ নয় সে আমার চোখে অবশ্যই দোষী। কারণ সে একটা মেয়েকে জোর জবরদস্তি করে নিজের জীবনে জরিয়েছে। এটা তাঁর উচিত হয়নি৷ কিন্তু অনুচিত বিষয়গুলোও আমাদের জীবনে ঘটে যায়। হয়তো এই অনুচিত বিষয়গুলোর মাঝেও রয়ে যায় অনেক বড় উচিত ‘।

সাবা এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জিগ্যেস করলো,

-‘ কিছু বোঝোনি তাই তো ‘?

আহি ডানে বামে মাথা নাড়ালো। সাবা স্মিত হেসে বললো,

-‘ সেদিন যদি হ্যাভেনের গায়ে হাত না তুলতে তাহলে হয়তো তোমার অমত থাকলেও বিয়েটা স্বাভাবিক ভাবে হতো। কারণ তোমার মা, বাবা রাজি থাকতেন এই বিয়েতে তাই মা, বাবার জন্য তোমার বিয়েটা করতেই হতো৷ হ্যাভেনের জায়গায় অন্য কোন ছেলে হলেও বাবা,মা জোর করলে বিয়ে কিন্তু তোমায় করতেই হতো। তুমি নিশ্চয়ই বাবা,মায়ের অবাধ্য সন্তান নও ‘?

এবারেও ডানে,বামে মাথা নাড়ালো আহি৷ সাবা বললো,

-‘ সেদিন যদি তুমি বাড়ি থেকে পালিয়ে না যেতে এবং জিসানের সাথে হ্যাভেন তোমায় না দেখতো তাহলে হয়তো তোমার ওপর ওভাবে টর্চার করা হতো না। পৃথিবীতে কোন পুরুষই স্ত্রীর পরোকিয়া মেনে নিতে পারে না৷ সেখানে হ্যাভেনের প্রথম স্ত্রী, প্রথম ভালোবাসার মানুষ পরোকিয়ায় লিপ্ত হয়ে তাঁকে প্রত্যাখ্যান করে এমন একটা অতিত যার জীবনে রয়েছে সে দ্বিতীয় বার এমন কিছুর সম্মুখীন নিশ্চয়ই হতে চাইবে না? তুমি পরোকিয়া করোনি কিন্তু তুমি বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর যখন হ্যাভেন তোমাকে পায় তখন তুমি ছিলে জিসানের সঙ্গে। যে জিসানই ছিলো তাঁর প্রাক্তন স্ত্রীর পরোকিয়ার সঙ্গী। এবং প্রাক্তন স্ত্রীর বর্তমান স্বামী। সেদিন হ্যাভেনের জায়গায় অন্য যে কোন ছেলে থাকলেই রিয়্যাক্ট টা ওভাবেই করতো। সেখানে যদি হয় সাইকোপ্যাথিতে আক্রান্ত তাহলে তো কথাই নেই ‘।

বিস্ময় চোখ মুখে চেয়ে রইলো আহি। কিন্তু সাবা থেমে রইলো না প্রশ্ন করলো,

– ‘সেদিনের পর বা সেদিনের আগে হ্যাভেন কখনো রাগের বশে তোমার গায়ে হাত তুলেছে, মারধর করেছে ‘?

-‘ নাহ ‘।

-‘ কি আশ্চর্য প্রথম দেখায় তুমি গায়ে হাত তুললেও সে হাত তুলেনি৷ কিন্তু যখন বাড়ি থেকে পালালে এবং জিসানের সঙ্গে পেলো তোমায় তখন কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলেছে৷ এটা আমার কাছে কিন্তু স্বাভাবিকই লাগছে ডোন্ট মাইন্ড ‘।

আহি করুন চোখে চেয়ে রইলো। তা দেখে আবারো স্মিত হাসলো সাবা। বললো,

– ‘ সাইকোপ্যাথি না থাকলে যে অবিশ্বাস আর যে সন্দেহ টা রয়েছে ওর সেটাও থাকতো না। আর এই মানসিক অসুস্থতা দূর করার জন্য ডক্টরের থেকে একজন একান্ত সঙ্গীনি ভীষণ প্রয়োজন ওর।মানসিক অসুস্থতা দূর করার জন্য একজন মানুষের প্রয়োজন প্রচুর ভালোবাসা, প্রচুর কেয়ার। অথচ সেসবের কিছুই পায়নি হ্যাভেন৷ পাবে কি করে শুরুটাই ছিলো তাঁর ভুল, সঙ্গীনি খোঁজায় ছিলো ভুল। জোর করে কখনো ভালোবাসা পাওয়া যায় না৷ জোরের ওপর কোন সম্পর্কই মধুর করে গড়ে তোলা যায় না। এটা ওর মস্তিষ্ক বুঝতে পারেনি ‘। একটু থেমে আবারো বললো,

-‘ হ্যাভেন দ্বিতীয় বার ভালোবেসেছে কিন্তু প্রথম বারের মতো বিশ্বাস করতে পারছে না। প্রথম বার তাঁর হারানোর ভয় ছিলো না কিন্তু হারিয়ে ফেলেছে। দ্বিতীয় বার হারানোর ভয় আষ্টেপৃষ্ঠে জরিয়ে ধরেছে ওকে। যা ফুটে ওঠছে ওর অস্বাভাবিক আচরণে।

-‘ ভালোবাসা নয় ম্যাম নিজের জেদের জন্যই ওনি আমায় বিয়ে করেছেন ‘।

-‘ শুরুটা যেভাবেই হোক ঐ মানুষ টা তোমায় ভালোবেসে ফেলেছে আর সেই ভালোবাসা থেকেই তোমাকে হারানোর ভয় জন্ম নিয়েছে ‘।

-‘ একসঙ্গে থেকেও আমি যা বুঝতে পারিনি আপনি শুধু গল্প শুনে সেটা বুঝে গেলেন ‘। অবিশ্বাস্য কন্ঠে বললো আহি৷

-‘ এখানেই তো লজিক ডিয়ার ‘। বলেই মুচকি হাসলো সাবা৷

-‘ তাঁর মানে আপনি বলছেন আমার পালিয়ে আসা উচিত হয়নি ‘?

-‘ পালিয়ে নয় ছেড়ে আসা উচিত হয়নি। ধরো অপারেশন শেষে যদি হ্যাভেন প্রাণে বেঁচে যায় জ্ঞান ফেরার পর জানতে পারে তুমি নেই চলে গেছো এই কথা শুনে সে মূহুর্তেই স্ট্রোক করে মারা যায় হ্যাভেন কি হবে ‘?

চমকে ওঠে ভয়ার্ত কন্ঠে বলে,

-‘ এমন কিছু হবে না ‘।

-‘ আল্লাহ না করুক এমন ঘটলে নিজেকে কোনদিন ক্ষমা করতে পারবে না তুমি। আর যদি বেঁচে ফেরে তাহলেও কোন না কোন ভাবে তোমাকে খুঁজে বের করবেই কিন্তু তুমি চাইলে আমি সর্বাত্মক সহযোগিতা করবো তোমায়। যদি হ্যাভেন থেকে মুক্তি চাও মুক্তি পাবে যদি হ্যাভেনের সঙ্গে স্বাভাবিক এবং ভালোবাসাময় জীবন গড়তে চাও সেটিও পাবে ‘।

দ্বিতীয়টি শুনতেই মরিয়া হয়ে ওঠলো আহি। কিভাবে সম্ভব দ্বিতীয় জীবনকে পাওয়া? প্রশ্ন করতেই সাবা বললো,

-‘ দ্বিতীয় জীবন তুমি তখনি পাবে যখন তুমি মন থেকে হ্যাভেনকে স্বামী হিসেবে মেনে নিতে পারবে, নিজ ইচ্ছেতে ফিরে যাবে ওর কাছে। কিন্তু এর জন্য হ্যাভেনকে তোমাকে চিনতে হবে বুঝতে হবে। তাঁর থেকেও বেশী জরুরি নিজের মনকে বোঝা। তোমার মন ঠিক কি চায় তোমার মনে হ্যাভেন শুধুই অপ্রিয় হয়ে রয়েছে? নাকি প্রিয়র স্থানও দখল করে নিয়েছে? হ্যাভেন শুধুই তোমার ঘৃণা নাকি ভালোবাসাও ‘?

-‘ এতো কঠিন এতো জটিল প্রশ্নের উত্তর কি করে দেবো ম্যাম ‘?

আহির বয়স কম। এ বয়সে এতো জটিলতা না বোঝাই স্বাভাবিক। ওর বয়সে সাবাও এতোটা বুঝদার ছিলো না। যদি বুঝদারই থাকতো তাহলে আজ তাঁর জীবনটাও অন্যরকম হতে পারতো। বুক চিঁড়ে এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো সাবার। বললো,

– ‘ এই উত্তর সত্যি কেউ কাউকে বোঝাতে পারবেনা সবাইকে নিজের অনুভূতি নিজেকেই বুঝে নিতে হয়। কেউ পারেনা কারো অনুভূতি কাউকে বুঝিয়ে দিতে। সময় পরিস্থিতি ধীরে ধীরে সবটা বুঝিয়ে দেয়। নিজের মনের কথা বুঝতে হলেও নিজেকে সময় দিতে হবে।
কিন্তু আমার প্রশ্ন “যে পুরুষ দেড়টা বছর তোমার শরীর ছুঁতে পেরেছে সে পুরুষ কি একটুখানিও হৃদয় ছুঁয়ে দিতে পারেনি” ‘?

থমথমে মুখে চেয়ে রইলো আহি এই উত্তর যে সে নিজেও পরিষ্কার ভাবে বুঝতে পারেনা বা বুঝতে চায় না। বার বার মনে পড়ে যায় হ্যাভেনের প্রথম স্ত্রী, প্রথম ভালোবাসা সে নয় রূপসা।
.
রাত তখন প্রায় দশটা। আহি নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে। সাবা তাঁর থেকে ওঠে যায় বেলকনিতে। পুরো বাড়ির আশেপাশে চোখ বুলায়, দেখতে পায় দশ,বারো জন অপরিচিত পুরুষ মুখ। তাঁর আর বুঝতে বাকি নেই এরা হ্যাভেন তালুকদারের লোক। কিন্তু সে একজন আত্মমর্যাদা সম্পন্ন নারী হয়ে অপর নারীর প্রতি জোরজুলুম করাকে প্রশ্রয় দেবে না৷ আবার সত্যিকারের ভালোবাসা হারিয়ে যেতে দিতেও মন সায় দিচ্ছে না৷ আর যাই হোক তাঁর নির্মল এসব শুনলে আহি আর হ্যাভেনের বিচ্ছেদ কে কখনোই সাপোর্ট করতো না৷ এ মূহুর্তে আহিকে জানতে দেওয়া যাবেনা তাঁর পুরো বাড়ি ঘেরাও করা হয়েছে তাহলে মেয়েটা ভয় পেয়ে যাবে ভেবেই নিজের দেবর নির্ঝরকে ফোন করলো সাবা। প্রয়োজনীয় কথা বলে চিন্তিত মুখে ঘরে ফিরে আসে। এবং কঠিন এক সিদ্ধান্ত নেয় যে সিদ্ধান্ত হবে হ্যাভেনের প্রতি আহির ভালোবাসা আছে কিনা তাঁর সঠিক পরীক্ষা।
.
রাতে খাবার খাওয়ার জন্য জোর করেও লাভ হলো না। আহি পানি ছাড়া মুখে কিছুই তুললো না। সাবা আহির দিকে অপলক চোখে চেয়ে আছে মেয়েটা সত্যি চোখ ঝলসানো সুন্দরী। তবে চোখ জোরা একদম নির্মলের চোখের মতো ডাবের পানির ন্যায় ঘোলাটে দুচোখের মনিই হালকা ব্রাউন কালারের। আহিকে দেখলে নির্মল নিশ্চয়ই গলা উঁচু করে রসিকতার সুরে বলতো, সে তাঁর মেলায় হারিয়ে যাওয়া ছোট বোন। তা শুনে নির্মলের বোন নেহা নিশ্চয়ই জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যেতো। মুচকি হেসে সাবা আহিকে নিয়ে একটি রুমে চলে গেলো। বিছানায় বসতে দিয়ে পুরোনো এক ডায়েরী বের করে তার সামনে ধরলো। বললো,

-‘ সারারাত নিশ্চয়ই ঘুম হবে না। কিন্তু আমাকে ঘুমাতেই হবে। আমার নির্মল অপেক্ষা করছে আমার জন্য। এটা আমার ননদের রুম৷ ঘন্টা,দুয়েক পর আমার দেবর আসবে তোমার পাশের রুমটাই ওর ভয় পেও না। তাঁকে বলা হয়েছে বাড়িতে আমার মেয়ে স্টুডেন্ট আছে’।

-‘ এটা কিসের ডায়েরী ম্যাম ‘?

-‘ পুরোনো ডায়েরি খুব বেশী পুরোনো নয়৷ তবে এটাতে রয়েছে আমি এবং আমার প্রিয়র জীবনের কিছু কাহিনী। সারারাত কেটে যাবে তোমার আর হ্যাঁ সকালে তুমি যে সিদ্ধান্ত নেবে সে সিদ্ধান্ত তোমার জীবনে এনে দেবে অনেক বড় এক পরিবর্তন ‘।

মলিন দৃষ্টিতে চেয়ে মৃদু হেসে প্রশ্ন করলো,

-‘ আপনার এবং স্যারের মানে আপনার হাজব্যান্ডের জীবন ঘটিত লেখা আছে ‘?

মৃদু হাসলো সাবা লাজুক চোখে, মুখে মাথাও নাড়ালো। আহি নিষ্পলক চোখে চেয়ে রইলো সাবার দিকে। সাবা ম্যাম দেখতে বেশ সুন্দরী। প্রথম দেখায় কেউ বিশ্বাসই করবেনা তাঁর বয়স এিশ ক্রস করেছে এবং সে একজন প্রফেসর। চেহেরার মাধুর্য এবং উচ্চতা দেখে বোঝার উপায় নেই সে কলেজ পড়ুয়া নাকি ভার্সিটিতে পড়ুয়া স্টুডেন্ট। না বোঝার খাতিরেই অহরহ বিয়ে এবং প্রেমের প্রস্তাব পান এই সাবা ম্যাম। জুনিয়রদের তালিকাই বেশী। আহি হিয়ার কাছে শুনেছিলো হ্যারিও সাবা ম্যামকে প্রপোজ করেছিলো। হিরারও ক্রাশদের মধ্যে প্রথম তালিকায় রয়েছে সাবা ম্যাম। প্রায় অনেক স্টুডেন্টই মারাত্মক ভাবে ক্রাশ খেয়ে বসে আছে এই ম্যামকে দেখে। হঠাৎ আহির মনে পড়লো হ্যাভেনের কথা। সাবা ম্যামকে নিয়ে হ্যাভেনকেও বেশ কথা বলতে শুনেছে। ম্যাম এর বাসা হ্যাভেনই চিনিয়েছে আহিকে। হঠাৎই মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো আহির। বিরবির করে বকে দিলো হ্যাভেনকে। আবার সন্দেহ হলো হ্যাভেন কি ম্যাম এর বাসায় আসতো? ম্যামের প্রতি কোনভাবে আকৃষ্ট নয়তো হ্যাভেন? পরোক্ষণেই ভাবলো ছিঃ কি ভাবছি আমি আর যাই হোক হ্যাভেন ক্যারেক্টারলেস নয়। আহি বুঝলো এ মূহুর্তে সে একটু হলেও জেলাস ফিল করছে।
.
সাবা চলে গেছে তাঁর রুমে। আহি বাথরুম থেকে বেরিয়ে পড়নের কাপড় ঠিক করে নিয়ে বিছানায় বসলো। ডায়েরিটা ধরে বিরবির করে বললো,

-‘ সবার জীবনের প্রণয়,পরিণয় কতো মধুর হয় অথচ আমার জীবনে প্রণয়ের আগেই ভয়ংকর পরিণয় ঘটলো। সাবা ম্যাম সময় কাটানোর জন্য তাঁদের জীবন কাহিনী পড়তে দিলেন। কেউ কারো জীবন কাহিনী এভাবে কাউকে পড়তে দেয়? একদিনেই এতোটা আপন করে নিলেন ম্যাম আমায়? নানারকম চিন্তা করতে করতেই ডায়েরির প্রথম পৃষ্ঠায় চোখ বুলালো আহি৷ প্রথম পৃষ্ঠা পড়া মাএই চমকে গেলো সে। প্রথম এই লাইনগুলো কোন না কোন ভাবে তাঁর জীবনের সাথে যেনো মিলে যায়। তাহলে কি ডায়েরি পড়তে দেওয়ার পেছনে অনেক বড় একটা কারণ রয়েছে? রয়েছে এই ডায়েরির ভিতরেই অনেক প্রশ্নের উত্তর? এই ডায়েরি পড়ার মাধ্যমেই কি তাঁর মনের সকল দ্বিধার অবসান ঘটবে’?
________________
১.
“আমার অপ্রিয় তুমি
আমার প্রিয় তুমি
আমার ঘৃণা তুমি
আমার ভালোবাসা তুমি”
তুমি
তুমি
তুমি শুধুই তুমি নির্মল।

চলবে..