ওড়নার দোষ
(৬+৭)অংশ
Israt জাহান
সেদিনের পর থেকে টানা পনেরো দিন মেঘা ছন্ন’র সামনে ভুলক্রমেও যায়নি।ওইদিন রাতে যে কাজটা করেছে তার মরমে মরে যাচ্ছিল মেঘা।এই ঘটনার পর কোন মুখ নিয়ে যাবে ও ছন্ন’র সামনে?আচমকা কখনো ছন্নকে সামনে দেখতে পেলে সেখান থেকে একদম ছুটে এসে রুমে বসে থাকে।এমনকি তিনবেলার খাওয়ারটাও রুমে বসে খায় এখন সে।পড়াশোনার দোহায় দিয়ে সারাদিন বই নিয়ে রুমে বসে থাকে।আজকে সকালবেলা হঠাৎ বাবার ডাক পরল মেঘার ঘরে।মিশুকে ডাকতে পাঠিয়েছে বাবা।নিচে নেমে দেখল লিভিংরুমে সবাই একসাথে বসে চা খাচ্ছে আর গল্প করছে।দাদীবুর পাশে ছন্ন কপালে হাত দিয়ে মাথা নিচু করে বসে আছে। এই গল্পের মেলার মধ্যে মেঘাকে আবার কিসে প্রয়োজন হল সেটাই ভাবছে মেঘা।হাসিমুখ করে একদম ছন্ন’র মুখোমুখি হয়ে রুশার পাশে গিয়ে বসল।বাবা বলল,
“তোর ভাইয়ার জন্য একটা মেয়ে পছন্দ করা হয়েছে জানিস তো?মেয়েটা তোর কলেজের বাংলা টিচারের মেয়ে।”
এলিনা হেসে বলল,
“ভাইয়ার কান্ড দ্যাখো।আরে মেঘা জানবে না তো কে জানবে?ওই তো মেয়েটাকে পছন্দ করেছে।সেদিন বিকালে ও সঙ্গে করে নিয়েসেছিল মেয়েটাকে বাড়িতে।অবশ্য এসব ব্যাপারে না জানিয়ে।”
“তাই নাকি?তাহলে কী ঘটকালি করা শিখে গেল আমার মেয়ে?”
“ভাইয়ের জন্য বোন এটুকু করতেই পারে ভাইয়া।এটাকে ঘটকালি বলেনা।মেয়েটা ওর থেকে থ্রি ইয়ারসের সিনিয়র হলেও মেঘার সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক।এর আগেও তো এসেছিল রাহুলের(ছেলে)জন্মদিনে।আমার বেশ মনে আছে।”
রুবেল মেঘার কাঁধে হাত রেখে বাহবা দেওয়ার মত করে বলল,
“তাই তো বলি মেয়েটাকে সবাই এত পছন্দ করলে কী করে?আমার মেঘা মা সবসময় বেস্ট জিনিসটাকেই চুজ করে।ওর পছন্দের ওপর আর কোনো কথাই থাকতে পারেনা।ছন্ন তুমি নিশ্চিন্তে বিয়েটা করতে পারো।”
চাচ্চুর কথার পর মেঘা ছন্ন’র দিকে তাকিয়ে একটু কেঁপে উঠল।কেমন ভয়ংকর চোখ করে তাকিয়ে যেন গিলছে ছন্ন মেঘাকে।সেই চোখে রাগ,বিস্ময় আর অবাক সবই দেখতে পাচ্ছে মেঘা।চাচ্চুর কথার পৃষ্ঠে ছন্ন বলল,
“আমি কারো পছন্দের ওপর এত সহজে নিশ্চিন্ত হতে পারিনা মামা।তবে নিশ্চিন্ত হওয়ার জন্যই আজকে মেঘা তার সাথে দেখা করিয়ে দিতে চেয়েছে আমাকে।”
মেঘা একদম চমকে গেল ছন্ন’র কথা শুনে। এরকম মিথ্যা বলল কেন ছন্ন?
“হ্যাঁ এতে কিন্তু ভালোই হবে।সামনাসামনি দেখা করে দুজন দুজনকে আগে থেকে জেনে নেওয়া ভালো।তা কখন দেখা করতে যাচ্ছো তোমরা?”
চাচ্চুর কথার জবাব দিতে ছন্ন হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখে বলল,
“এইতো বেলা বারোটার সময়।”
“এই ভাইয়া আমিও যাবো তোদের সঙ্গে। তোরা গল্প করবি আর আমি মেঘা একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসব তখন।”
রুশার কথা শুনে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল মেঘা। কিন্তু সে আশায় জল ঢেলে ছন্ন বলল,
“পরের বন্ধুদের সাথে ঘুরতে তোর খুব মজা লাগে?মেঘার এক গাদা বন্ধু-বান্ধব আসবে ওখানে।তুই মাঝখানে বেহায়ার মত ওদের সাথে গিয়ে ঘুরবি।কী প্রয়োজন?”
ভাইয়ের কথায় রুশার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল সেই সাথে একটু অবাকও হল।ছন্ন কখনোই বোনের সাথে এইভাবে কথা বলেনা। রুবা বুঝতে পারল ছন্ন বেশি ঝামেলা বাড়াতে চায়না ওখানে।নিরিবিলি দেখা করতে চায় ও। তাই রুশাকে বলল,
“আরে মেঘা যাচ্ছে কারণ মেয়েটার সঙ্গে ওকে ও পরিচয় করিয়ে দিবে তাই।খামখা তুই গিয়ে কী করবি?”
মেঘা আমতা আমতা করে বলল,
“আমি বরং ওকে ফোন করে জানিয়ে দিই কোথায় আসবে।তারপর না হয় ভাইয়া গিয়ে দেখা করবে।”
ছন্ন’র ইচ্ছে করছে উঠে গিয়ে কানের নিচে কষে একটা থাপ্পড় দিতে মেঘাকে।রুবা বলল,
“আরে না তুই যা ওর সঙ্গে।ওকে নিয়ে আমার একটুও বিশ্বাস নেই।পরে দেখা যাবে ও মেয়েটার সঙ্গে আর দেখাই করতে গেল না।”
রুবার সুরে সুর মিলিয়ে এলিনাও বলল,
“হ্যাঁ মেঘা তুই যা ওর সঙ্গে।যেখানে আমাদের সবার মেয়েকে পছন্দ সেখানে ও এখনো নাক কুচকাচ্ছে।”
“প্রায় সাড়ে এগারোটা বাজে।মেঘা তুমি গিয়ে তৈরি হয়ে নাও।আমি ওয়েট করছি।”
ছন্ন’র কথা শুনে মেঘা ওর দিকে তাকাতে একটা বিজয়ের হাসি দিল ছন্ন।রুমে গিয়ে ভাবল আজকে কোনোভাবেই ও সেলোয়ার স্যুট পরবেনা।ছেলেটার যা বদ স্বভাব।আজ আবার দেখা গেল ওড়না টেনে নিয়ে চলে যাবে।কী প্ল্যান করে যে ওকে বাইরে নিয়ে যাচ্ছে আল্লাহ্ মাবূদ ভালো জানে।
মেঘা ব্ল্যাক কালার লেগিন্সের সাথে ব্ল্যাক কালার লং থ্রি কোয়ার্টার হাতার কূর্তি পরল।তারপর ব্ল্যাক কালারের ব্যান্ড দিয়ে চুলগুলো নিয়ে উঁচু করে পিছনে একটা ঝুটি বাঁধল।সেই সাথে গলায় ব্ল্যাক আর হোয়াইট কালার মিক্সড একটা স্কার্ফ পেঁচিয়ে সামনের দিকে ঝুলিয়ে দিলো।নিজেকে একবার আয়নাতে দেখে বড্ড বেমানান লাগল ওর।একটু সাজগোজ না করলে একেবারেই মানাচ্ছেনা ড্রেসটার সঙ্গে।তারপর কানে এক জোড়া ডায়মন্ডের সাদা মাঝারি টপ পরল,মুখে হালকা মেকাপও করল আর চোখের পাতায় চিকন করে আইলাইনার টেনে নিল।সবশেষে লিপস্টিকটা হাতে নিয়ে ভাবছে এটা পরা ঠিক হবে কী হবে না।কারণ লিপস্টিকটা অরেঞ্জ কালারের ছিল।অনেক ভাবাভাবির পর লিপস্টিকটা পরেই নিলো মেঘা।আয়নায় নিজেকে একবার ভালো করে দেখে যাওয়ার সময় বামহাতে হোয়াইট স্টোনের একটা ব্রেসলেট পরে নিয়ে নিচে নেমে এল।ফুপি সোফায় বসে ম্যাগাজিন দেখছিল। মেঘা ফুপিকে বলল,
“ফুপি আমি রেডি।”
“ও বাইরে আছে মা।তুই রেডি হলে বাইরে যেতে বলেছে।”
মেঘা ফুপিকে বায় বলে বাইরে বেরিয়ে গেল। ছন্ন তখন গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ফোন স্ক্রল করতে ব্যস্ত।মেঘার হাইহিলের আওয়াজ কানে এসে মাথা উঁচু করে এক ঝলক ওকে দেখে ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসল।মেঘা কত আশা করেছিল ছন্ন একবার ওকে পা থেকে মাথা অবদি ভালো করে দেখবে মুগ্ধ নয়নে।কিন্তু ছন্ন’র ভাবটা এমন ছিল যেন কোনো পথচারীকে দেখল।কিন্তু মেঘাই বা এমন কিছু ভাবছে কেন?ওর তো এমনটা ভাবার কথা নয়।ছন্ন যে ওকে স্পেশালি নটিশড করবে সেটা ও কী করে ভাবল?ও তো আর ছন্ন’র সাথে এক্সেস কোনো রিলেশনে এটাচ্ড না।ভাবনাগুলো মাথা থেকে বের করে দিয়ে ছন্ন’র পাশের সিটে গিয়ে বসল।
“এ কী আপনি কেন?ড্রাইভার কোথায়?”
গাড়ির স্টার্ট করে সামনের দিকে তাকিয়ে ছন্ন বলল,”ড্রাইভার ড্রাইভারের জায়গায়।”
বাসা থেকে বেরিয়ে এসে কিছুদূর এগিয়ে যেতেই মেঘা প্রশ্ন করল,”আপনি মিথ্যা কেন বললেন?আমি আপনাকে কখন বলেছি লিয়া আপুর সাথে আপনাকে মিট করিয়ে দিব?”
“(নিশ্চুপ)”
“আপনি ওনার সাথে মিট করবেন তো আমাকে সাথে করে কেন নিয়ে আসলেন?”
“(নিশ্চুপ)”
মেঘা খুব বিরক্ত হয়ে গেল ছন্ন’র নিস্তব্ধতার জন্য।এই ছেলের ব্যাপার স্যাপার কিছুই বোঝা যাচ্ছেনা।মিথ্যা বলে,হাত ধরে টেনে এনে হুট হাট বাইরে বের করে নিয়ে আসছে।কী চাচ্ছেটা সে আল্লাহ্’ই জানে।কিন্তু এভাবে চুপ করে থাকলে তো হবেনা।কথা বলতে হবে ওকে।এই ব্যাপারে আজকেই ক্লিয়ার হতে হবে।মেঘা বিরক্তির সুরে বলল,
“আরে ভাইয়া কথা বলেন না কেন?কিছু তো বলবেন নাকি?”
ধুম করে গাড়িতে ব্রেক কষল ছন্ন।সিটবেল্ট না বাঁধার কারণে বড়সড় একটা ধাক্কা খেলো মেঘা। চোখ গরম করে তাকাল ছন্ন’র দিকে।কিন্তু ছন্ন’র দৃষ্টি দেখে মেঘা নিজেই চমকে গেল। কী ভয়ংকর চোখ করে তাকিয়ে আছে ওর দিক। গাড়ির গ্লাসগুলো আগে বন্ধ করে দিল ছন্ন। তারপর মেঘার হাত শক্ত করে ধরে নিজের দিকে টেনে নিয়েলো।গর্জন করে বলল,
“মায়ের পেটের ভাই লাগি আমি?”
“মানে?”
মেঘার হাতটা ছেড়ে দিয়ে মাথা নিচু করে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ল ছন্ন।মেজাজ নিয়ন্ত্রণ করে শক্ত কন্ঠে মেঘাকে জিজ্ঞেস করল,”আমার কাছে পারমিশান নিয়েছো মেয়ে পছন্দ করার আগে? আমি কী তোমাকে বলেছিলাম আমার জন্য মেয়ে দেখতে?”
“ফুপি তো বলেছিল।”
“খুবই ভালো কথা।ফুপি বলেছিল।আজ পনেরোটা দিন আমার থেকে লুকিয়ে বেড়িয়েছো কেন?”
“কোথায়?আমি তো আমার পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম।আপনার থেকে লুকিয়ে বেড়াবো কেন?”
“গ্রেট।তাহলে আমাকে দেখলে পালিয়ে যেতে কেন?”
“আপনাকে দেখে পালাবো কেন?কী সব কথা বলছেন আপনি?”
ছন্ন শান্ত ভঙ্গীতে তাকাল মেঘার দিকে।মেঘা আড়চোখে তাকিয়ে ওকে দেখে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে থাকল।
“এবার বলবে তুমি আমার রুমেও উঁকি ঝুকি দাওনি।”
মেঘার কান,চোয়াল সব লাল হয়ে গেছে।ছন্ন’র সামনে না গেলেও ওর রুমের সামনে থেকে যাওয়ার সময় রুমের দরজা ভেজানো থাকলে মেঘা উঁকি দিয়ে ছন্ন কে একটু দেখার চেষ্টা করত।সেটা যে ছন্ন’র চোখে পরে যাবে তা ও ভাবতেই পারেনি।
“আমি আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি।”
“আশ্চর্য হওয়ার মত কী হলো?”
“আবার প্রশ্ন করছো?এই মেয়ে তুমি ভাবো কী নিজেকে হ্যাঁ?”
মেঘার হাত ধরে আবার নিজের কাছে টেনে এনে বলল।
“সেদিন রাতে পাবলিক প্লেসে দাঁড়িয়ে পাক্কা দু’মিনিট লিপস্টিক খাইয়েছো আমাকে।তারপর বাড়িতে আবার আমার জন্য মেয়ে নিয়ে আসছো।কী সমস্যা তোমার?মাথায় গন্ডগোল আছে?”
“দেখুন আমি সেদিন ইচ্ছে করে করিনি।আপনি করতে বাধ্য করেছিলেন।”
“আমি করতে বাধ্য করেছিলাম!”
ছন্ন অবাক হওয়ার ভঙ্গীতে তাকাল।মেঘা বলল,
“হ্যাঁ।আপনি আমাকে তাকানোর জন্য ওইভাবে ফোর্স না করে চলে আসতে দিলে ওরকমটা কখনোই করতাম না আমি।”
“তাকাতে বলেছিলাম বলে তাই চুমু খেতে হবে?”
ছন্ন’র কথা শুনতে খুব অসহ্য লাগছে মেঘার। কেন এরকম এমবারেস্ড করছে ওকে?ভ্রু কুঁচকে তাকাল ছন্ন’র দিকে।এখন মুখ চিপে হাসছে ব্যাটা।মেজাজ খারাপ হয়ে গেল মেঘার।তারপর গলা খাঁকাড়ি দিয়ে বলল,
“আমি তো বলেছিলামই খারাপ কিছু হয়ে যাবে।”
“বেশ তো এবার আমিও খারাপ কিছু ঘটাবো।”
“খারাপ কিছু ঘটাবেন মানে?”
উত্তরের আশায় বিস্ময় চোখে তাকিয়ে আছে মেঘা ছন্ন’র দিকে।ছন্ন’র কোনো জবাব নেই। গাড়িটা চালিয়ে দিয়াবাড়ি নিয়ে গেল ছন্ন।রাস্তার সাইডে গাড়ি থামানোর পর মেঘা ভীতস্বরে প্রশ্ন করল,
“এখানে কেন আসলেন?”
“খারাপ কিছু ঘটাতে।”
ওড়নার দোষ
৬ষ্ঠ অংশ
গাড়ি থেকে নেমে ছন্ন কাউকে ফোন দিয়ে বলল,
“আমি দিয়াবাড়ি চলে এসেছি।তুই ওনাকে সঙ্গে করে এখানে নিয়ে আয়।আর তোর ক্লোজড কিছু বন্ধুদের নিয়ে আসবি।”
কথা শেষ করে ছন্ন গাড়িতে গিয়ে বসল।তারপর মেঘাকে ভালো করে একবার দেখে বলল,
“এইরকম ছোটো খাটো স্কার্ফ গলায় পেঁচিয়েছো কেন?ওড়না কোথায় আজ?”
“নেই।”
“নেই নাকি আমার ভয়ে পরে আসোনি?”
“জানিনা।আমার খারাপ লাগছে আমি বাসায় যাব।”
“ভয় পাচ্ছো?আরে তুমি যা ভাবছো তেমন কিছুই আমি করবোনা।আমি কী তোমার মত নির্লজ্জ নাকি?তবে তোমাকে দেখতে বেশ চমৎকার লাগছে।আবার অরেঞ্জ কালার লিপস্টিকও পরেছো দেখছি।ব্যাপার কী বলো তো?”
মেঘা রেগে তাকাল ওর দিকে।মেজাজ খুব খারাপ হচ্ছে ওর।মেঘা বলল,
“এখানে কেন এসেছেন বলেন তো?ঘুরতে তো আসেননি তা বোঝায় যাচ্ছে।”
“বিয়ে করতে এসেছি।”
চমকে তাকাল ছন্ন’র দিকে মেঘা।বলল,
“বিয়ে?মজা করছেন?”
“আমি তোমার মত কখনো কিছু নিয়ে মজা করে বলিনা।”
“সিরিয়াসলি বিয়ে করছেন তাহলে?”
“হুম।”
“তো আমাকে সাথে করে নিয়েসেছে কেন?”
“সেটা একটু পরই টের পাবে।”
“দেখুন ফুপি কিন্তু খুব কষ্ট পাবে।আপনি এভাবে না জানিয়ে কাউকে বিয়ে করতে পারেন না।আমি এখনি বাড়িতে ফোন করবো।”
মেঘা ফোন হাতে নিতেই ছন্ন ছোঁ মেড়ে হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিল।বলল,
“বেশি বারাবারি করলে হাত মুখ বেঁধে রাখবো কিন্তু।”
“মানে কী?আপনি যাকে পছন্দ করেন তার কথা বাড়িতে বললেই তো হয়।”
“বলে লাভ হবেনা বলেই তো এমন অঘটন ঘটাতে হচ্ছে।এই তুমি কোনো কথা বলোনা তো।এমনিতেই আমার মাথা খারাপ করেছো। বোকা বোকা কথা বলে আর মেজাজ গরম করোনা।”
খানিকসময় বাদে চারজন ছেলে কাজীকে সঙ্গে করে নিয়ে গাড়ির সামনে আসল।ওরা কাজীকে নিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসল।মেঘা আর ছন্ন সামনের সিটে বসা।কাজী বিয়ে পড়াতে শুরু করলে মেঘা ভয়ে একদম চুপসে গেল।রীতিমত থরথর করে কাঁপছে ও।এতক্ষণে বুঝতে পারল বিয়েটা ওকেই করছে ছন্ন।হঠাৎ করে ছন্ন এসব করছে কেন?ও কী ওদের সম্পর্কটা ভুলে গেছে?ওদের বিয়েটা বাড়ি থেকে যে কোনোদিনও মেনে নিবেনা।উল্টে ফুপির সাথে সম্পর্কটা আবার নষ্ট হবে।সম্পর্ক ছিন্ন করে দিবে একেবারে চিরতরের জন্য।ও কী একবারও ফুপির কথা ভাবছেনা?মেঘা চিল্লিয়ে ছন্নকে বলল,
“আপনি কী করছেন এসব?”
“চুপচাপ বিয়েটা করে নাও।আমি পরে তোমাকে সব বুঝিয়ে বলছি।”
“কী বোঝাবেন আপনি আমাকে?আপনি কী পাগল হয়ে গেছেন?আপনি ভুলে গেছেন আপনার আর আমার সম্পর্ক?আর এভাবে বিয়ে করার মানে কী?
শাহেদ বলল,
“ভাইয়া উনি তো রাজি হচ্ছেনা।”
“আপনারা আমাকে জোড় করে এখানে এনে এটা কী ধরনের বিয়ে পড়াতে বলছেন?যেখানে মেয়ে জানেইনা তার বিয়ে।দেখুন এসব বিয়েতে অনেক ঝামেলাতে পরতে হয়।আমি এসব ঝামেলা পোহাতে পারবোনা।আমি গেলাম।”
কাজির কথা শুনে ছন্ন ওর মামাতো ভাইকে বলল,
“শাহেদ ওনাকে আটকা।”
শাহেদ আর ওর বন্ধুরা কাজির মুখ বেঁধে গলায় ছুড়ি ধরে রাখল।তারপর ছন্ন গাড়ি থেকে নেমে মেঘাকে নিয়ে কাশবনের ভেতর ঢুকে গেল।
“আপনি এমনটা কেন করছেন বলেন তো?আপনার মনে এমনকিছু চলছে জানলে আমি জীবনেও আপনার সঙ্গে আসতাম না।”
“সেদিন রাতে আমার কথাগুলো শুনলে আজকে এভাবে ফোর্স করতে হতোনা তোমাকে।আচ্ছা এই বিয়েতে তোমার প্রধান সমস্যাটা কোথায় বলো তো?”
“আপনার আর আমার সম্পর্ক।বুঝতে পেরেছেন? আপনি আমার ফুপির ছেলে।আর এই ধরনের সম্পর্ক থেকে বিয়ে আমাদের বাড়িতে কোনোদিনও পছন্দ করেনা।মেনেই নিবেনা আমাদের সম্পর্কটা।আর তারউপর আপনি এভাবে বিয়ে করছেন আমাকে।সারাজীবনের জন্য ওই বাড়ির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে আমাদের।আমি বুঝতে পারছিনা আপনি হঠাৎ করে এরকম একটা সিদ্ধান্ত কী করে নিলেন?”
“ওয়েল।এখনো বোঝাচ্ছি।আগে তোমার আর আমার সম্পর্কটা ক্লিয়ার করি।আমি তোমার ফুপির ছেলে নই।অর্থ্যাৎ তোমার ফুপাতো ভাই না আমি।”
“কী?”
“হ্যাঁ।আমার যখন এগারো বছর বয়স তখন আমার ছোটকাকু তোমার ফুপিকে মানে আমার মামনিকে নিয়ে অস্ট্রেলিয়া আমাদের কাছে চলে আসে।আমি তখন আমার বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে।মামনির তখনো কোনো বাচ্চা হয়নি।নিজের ছেলের মতই আমাকে ভালোবাসতো।তাই আমি মামনিকে চাচি না বলে মামনি বলে ডাকতাম।বেশ ভালোই যাচ্ছিলো আমাদের সময় গুলো।হঠাৎ করেই সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেলো। কয়েক বছরের মাথায় একটা এক্সিডেন্টে আমার বাবা-মা আর আমার ছোটকাকু মারা যায়।ছন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় আমার আর মামনির জীবন।রুশার তখন একদম ছোট।নিজের সন্তানের মতই আগলে রেখে আমাকে বড় করে মামনি।মামনির থেকে অসীম ভালোবাসা পেয়েও আমি বাবা-মায়ের চলে যাওয়ার কষ্টটা ভুলতে পারিনা।বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়াতে শুরু করি তখন থেকেই।জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরতে বেশি ভালো লাগত আমার। পড়ালেখার থেকে জঙ্গলের দিকেই বেশি টান ছিল।পড়াশোনা শেষ করে একটা ভালো জবও করতে শুরু করি।তবে বছরের চারমাস জব আর বাকিমাস গুলো ছন্নছাড়ার মতই ঘুরে বেড়াতাম জঙ্গলে।নিজের বাবা-মাকে হারানোর কষ্ট তো আমাকে একদম গ্রাস করে নিয়েছিলো।তারউপর মামনিকে দুমড়ে মুচড়ে যেতে দেখে আর ঘরে ফিরতে ইচ্ছে করতোনা। তুমি জানো ওই এক্সিডেন্টটার পেছনে মূল কারণ ছিলাম আমি।আমার ভরসাতে মামনি রুশাকে আমার কাছে রেখে গিয়েছিলো।হঠাৎ খেলার মাঝে রুশা আমার কোল থেকে ফ্লোরে পরে দম একদম বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়ে যায়। সেই খবর পেয়েই দ্রুত আসছিলো তারা।আর তারপরই……”
ছন্ন লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিয়ে আবার বলতে শুরু করলো,
“নিজেকে ক্ষমা করতে পারিনি এখনো।মামনি ছোটকাকুকে কতোটা ভালোবাসে তা এখনো দেখতে পাই আমি।মামনির সামনে দাঁড়াতে আমার খুব খারাপ লাগে।এর জন্যই যতোটুকু পারি বাড়ির বাইরে থাকার চেষ্টা করি।কিন্তু মামনি আমাকে নিজের সন্তানের থেকেও অত্যাধিক ভালোবাসে।আমার জীবন ব্যবস্থা তার একদমই সহ্য হয়না।সুখী দেখতে চাই সে আমাকে। ঠিক করল দেশে নিয়ে গিয়ে একটা বাঙালী মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে আমাকে সংসারী করবে।তাই একরকম জোর জবস্তি করেই নিয়ে চলে এলো দেশে।এই নিয়ে আমি তিনবার এখানে এলাম।প্রথম দু’বার মামার বাড়িতে এসে থেকেছি অনেক দিন করে। ওইযে শাহেদ কে দেখলে।ও আমার মামার ছেলে।এখানে আসার পর বাঙালী মেয়েদের প্রতি একটা বাজে ধারণা তৈরি হয়েছিল আমার। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম বাঙালী মেয়ে বিয়ে করবোনা।আর এদিকে মামনি অস্ট্রেলিয়ান মেয়েদের একদমই সহ্য করতে পারেনা।তাই উঠে পরে লাগল আমাকে বাঙালী মেয়ের সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্য।এত কথার মধ্যে তোমার আমার সম্পর্কটা নিশ্চই ক্লিয়ার হয়েছে।এবার বলি তোমাকে কেনো বিয়ে করার সিদ্ধান্তটা নিলাম? প্রথম যেদিন তোমার সাথে আমার দেখা হয় সেদিন শাহেদের বাইক করে রুশাকে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছিলাম।তুমি যখন আমার সাথে ঝগড়া করতে ব্যস্ত ছিলে আমি তখন তোমার সাথে ঝগড়া প্লাস তোমাকে দেখতে ব্যস্ত ছিলাম।প্রথমদিনে তোমাকে দেখে তোমার প্রতি একটা ভালোলাগার মোহ কাজ করছিল।বিশেষ করে তোমার কথা শুনে।তুমি যখন আমাকে বললে আমি তোমাকে ফুললি প্ল্যান করে মার্ডার করতে চেয়েছি।কথাটা শুনে খুব মজা লেগেছিল এতুটুকু একটা পুচকে মেয়ের কথা শুনে।তোমার এই একটা কথাই তোমাকে নিয়ে ভাবতে আমায় বাধ্য করে।মোহ থেকে অফুরন্ত ভালোলাগাতে পৌঁছে গেল তো সেদিন।যেদিন তুমি লিফ্টের মধ্যে আমার বুকের ভিতর মাথা গুজে ছিলে।ওই সময় শুধু আমার অফুরন্ত ভালোলাগা না সাথে অন্যরকম সুখকর অনুভূতি আর দুর্বলতা কাজ করছিল তোমার প্রতি।মনে মনে ঠিক করে ফেলেছিলাম বিয়ে করলে এই পুচকে মেয়েটাকেই করবো।খুব খুশি হয়েছিলাম তোমার ওড়নাটা মার্ডার হওয়াতে।না হলে তো তুমি আমার বুকের মধ্যে মাথা গুজতে না আর আমার দুর্বলতাও হতেনা।কীভাবে এতো দ্রুত তুমি আমার দুর্বলতা হলে আমি নিজেও তা জানিনা।আর জানতেও চাইনা। শুধু এতোটুকু জানি তোমাকে আমার প্রয়োজন।”
মেঘা হতভম্ব হয়ে ছন্ন’র কথা শুনছে।কিছু বলার মত ভাষা খুঁজে পাচ্ছেনা।ছন্ন আবার বলতে শুরু করল,
“অনেক অবাক লাগছে তাইনা?আরো লাগবে, শোনো।যাকে বিয়ে করার মত সিদ্ধান্ত নিলাম তার মধ্যেও আমার জন্য কিছু একটা অনুভূতি হচ্ছে কিনা সেটাও তো আমাকে দেখতে হবে। আমি যখন তোমার সাথে কথা বলে চলে আসি তখন আমি একশো তে একশো শিওর ছিলাম তুমি আমাকে খুঁজবে।কারণ তোমার চোখে আমি আমার জন্য ভালোবাসার আভাস পেয়েছি। তোমার চোখ কথা বলছিল।রুশাকে পাঠিয়ে দিয়ে একটা দোকানে ঢুকে তোমাকে নটিশড করি। দেখলাম তুমি পাগলের মত এদিক ওদিক ছুটে আমাকে খুঁজছো।অবশেষে না পেয়ে ভীড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে প্রায় কেঁদেই ফেললে।তখন যা আনন্দ হচ্ছিল আমার।ইচ্ছে করছিল গিয়ে তোমাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরি।তার আগেই দেখলাম তুমি নিচে চলে গেলে।একটা গাড়িতে গিয়ে বসলে।তোমাকে কিছু বলতে যাব তখন রুশা ফোন করল।তোমার চাচ্চু আর মামনি আমার জন্য অপেক্ষা করছিল।তাই বাধ্য হয়ে চলে এলাম শুধু তোমার গাড়ির নাম্বারটা মুখস্ত করে। ফিরে এসে জানলাম মামনির ভাতিজি আসেনি বলে মামনি যাবেনা ওই বাড়িতে।তারপর তোমার চাচ্চু আমাদের একটা ট্যাক্সিতে উঠিয়ে দিয়ে তোমার গাড়িতে গিয়েই বসল।তখন বুঝে গেলাম আমার মামনির ফুলকলিটাই তুমি।এত সহজে তোমাকে পেয়ে যাব ভাবিনি।তারপর তোমাদের বাড়িতে এসে তোমার সাথে কথা বললাম কথা বলে জানতে পারলাম তোমার নাম মেঘা।বিশ্বাস করো আমি তখন নিশ্চিত হয়ে গিয়েছি এই ছন্ন’র সাথেই মেঘাচ্ছন্ন হয়ে মিশে যেতে হবে তোমাকে।সেদিন চাচ্চুর সাথে কথার মাঝে জানতে পারলাম এ বাড়িতে আত্মীয়ার মাঝে সম্পর্ক গড়ে ওঠেনা।তার এক বোনের গল্প শুনিয়েছিলো আমাকে।মামনির কাছে তোমার কথা বলার আর সাহস পেলাম না।বুঝে গেলামঅনেক কাটখড় পোড়াতে হবে।
কিন্তু সেটা অনেক সময়সাপেক্ষের ব্যাপার।বিলিভ মি আমার এত ধৈর্য আর সময় কোনোটাই নেই।ইচ্ছে তো করছিল সেদিনই তোমাকে বিয়ে করে ফেলি যেদিন বাড়িতে তোমার সাথে দেখা হলো।একবার ভাবলাম চাচ্চুকে বিষয়টা জানাবো কিন্ত পরে ভাবলাম কোনো লাভ হবেনা।কারণ তোমার দাদীবু আর তোমার বাবা খুব একগুঁয়ে ধাচের মানুষ।”
এতকিছু শোনার পর মেঘা ঠিক কী বলবে ওকে বুঝতে পারছেনা।ছন্ন ওর দিকে এগিয়ে এসে বলল,
“এখন তো তুমি বুঝতে পারছো আমি কেন তোমাকে এভাবে বিয়ে করতে চাইছি?”
“এটা কোনো সমাধান না।এভাবে বিয়ে করলে কী আমাদের মেনে নিবে?আর আমি এখন সেভেনটিন।আমার বিয়ের বয়স হয়নি।আমার বিয়ে নিয়ে বাড়ির সবার অনেক স্বপ্ন।”
“সবকিছু হবে।আমি ম্যানেজ করবো।যা বলার সব আমি বলব।তুমি শুধু বিয়েটা করবে।আর কিচ্ছু করতে হবেনা।এমনকি মেনে নেওয়ার ব্যাপারটাও আমি ম্যানেজ করবো।তুমি এতো ভেবোনা।কোনোকিছু না ভেবে আমি এতদূর আসিনি।”
“আপনার মনে হচ্ছে না আপনি পাগলের মতো চিন্তাভাবনা করছেন? আমি পারবোনা এভাবে বিয়ে করতে।
“হ্যাঁ আমি জানি এই ব্যাপারটা পুরোটাই যুক্তিহীন মনে হচ্ছে তোমার কাছে।কিন্তু আমার কাছে মনে হচ্ছেনা।আর মনে হলেও কিছু করার নেই।বিয়ের মতো বিষয় নিয়ে ভাবার কোনো ইচ্ছাই ছিলোনা আমার।কিন্তু হঠাৎ তোমাকে দেখার পর থেকে এটা নিয়ে আমার খুব ইচ্ছা হয়েছে।বউ জিনিসটা কী রকম হতে পারে সেটা তোমাকে নিয়েই ভেবেছি এই ক’দিন।এর মাঝে হঠাৎ করে তোমার জায়গায় অন্য কাউকে বউ ভাবা একদম অসম্ভব ব্যাপার আমার জন্য।আর তুমি যদি না পারো তাহলে আমি কোনো অস্ট্রেলিয়ানকে বিয়ে করবো তবু তোমাকে ছাড়া অন্য কোনো বাঙালী মেয়েকে না। আর তাকে কিন্তু মামনি কোনোদিনও মেনে নিতে পারবেনা।অনেক কষ্ট পাবে।জীবনে তো সে কম কষ্ট পায়নি।না হয় বাকি জীবনও কষ্ট পেয়ে কাটাবে।শুধুমাত্র তোমার ওপর রেগে আমি এমন একটা কাজ করবো বলে।কারণ তোমাকে ছাড়া আমি কোনো বাঙালী মেয়েকে বিয়ে করবনা।আর যদি তোমার সাথে বিয়েটা হয় হয়তো কিছুদিন কষ্ট পাবে মামনি।কিন্তু যখন মেনে নিবে তখন মামনির থেকে খুশি আর কেউ হবেনা।এখন তুমি ভেবে দ্যাখো। হাতে সময় আছে দশ মিনিট।”
“কী বললেন আপনি?আপনার কী আমার ফুপির জন্য একটুও দয়া মায়া নেই?
ছন্ন মেঘার কথার প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে থেমে গেলো।চোখ মুখের ভাবটা শক্ত করে দৃষ্টি দূরে রেখে বললো,
“আমার শরীরে ওসব নেই।এতো কথা বাদ দাও।অলমোস্ট দু’মিনিট সময় কিল করেছো।আট মিনিট সময় আছে জলদি ভেবে বলো।তাই বুঝে আমি আমার ডিসিশন নিবো।”