#কাঁচের_গায়ে_বৃষ্টি_ফোঁটা💦(দ্বিতীয় পরিচ্ছদ)
–(পর্ব-১)
————–
-ভাবিমণি, ভাবিমণি কোথায় তুমি? দেখে যাও কী এনেছি তোমার জন্যে।
– কই কই দেখি দেখি কী এনেছ দেখি।
– ওহ গড! আইসক্রিম! মাই ফেবারিট।
– হুম এজন্যই তো এনেছি। তুমি খুশি হলেই আমি খুশি।
– ওলেহহ আমার মৌটুসী আমাকে কত্তো ভালোবাসে রে।
– হুম অনেককককককককক
– আমিও এত্তগুলো বাসি
ওদের কথার মধ্যেই বাচ্চা মেয়েটি দৌড়ে এসে অভিমানী সুরে বলে,
– আর আ আ আমাকে কেউ ভা ভালবাসে না।
বাচ্চা মেয়েটি গাল ফুলিয়ে থাকে। তখনই নিঝুম তাকে পরম স্নেহে বুকে আগলে নেয়। ফোলা ফোলা গাল দুটো আলতো টেনে দিয়ে আদুরে কন্ঠে বলে,
– কে বলেছে তোমাকে কেউ ভালবাসে না? আমার মাম্মা টাকে তো আমি অনেক অনেক অনেকককককক ভালবাসি। আই লাভ ইউ সো মাচ মাই ডিয়ার তুশীমনি।
– আই লাভ ইউ টু মাম্মা
নিঝুমের কথা শুনে তুশী অনেক আনন্দিত হয়ে যায়। ঝাপিয়ে পড়ে নিঝুমের বুকে। তখনই পাশ থেকে সোনালী মুখ খোলে। সোনালী হলো তুশীর একমাত্র ফুপ্পি। তুশী আসার আগে নিঝুম আর সোনালীর মধ্যেই কথোপকথন চলছিল।
– আমিও তো আমার তুশুরানিকে অনননননেক ভালবাসি। তুশুরানি এসো আমার কাছে।
সোনালী হাত বাড়িয়ে ডাকে তুশীকে। তুশী নিঝুমের কাছ থেকে দৌড়ে সোনালীর কাছে যায়। সোনালী ওকে দু গাল ভরে আলতো চুমু এঁকে দেয়। তখনই সিড়ি বেয়ে নেমে আসে তুশীর বাবা সমর্পণ। সমর্পণ নিজের স্বভাবসুলভ
ভঙ্গিতে ওদের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলে,
– কী হচ্ছে এখানে? এতো আদর ভালবাসার বন্যা বয়ে চলেছে। শেষে তো দেখা যাবে আমার ভাগে কম পরছে।
তুশী ফের গাল ফোলায়। সোনালির পেটে মুখ ঘসতে ঘষতে বলে,
– ফুপ্পিয়া দেখো না বাবা আবার আমায় হিংসে করছে।
নিঝুম, সোনালী, সমর্পণ একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। অতঃপর সকলে একসঙ্গে হেসে ওঠে। তুশীর অভিমান গাঢ় হয় ওদের এমন হাসতে দেখে। কোথায় মা আর ফুপ্পি বাবাকে আচ্ছা করে বকে দেবে তা না করে হাসছে? তুশী মন খারাপ করে দৌড়ে সিড়ি কাছে চলে যায়। পেছন ফিরে এক পলক তাকিয়ে বলে,
– তোমরা সব্বাই ভীষণ পঁচা।
তুশী সোজা হয়ে সিড়ি বেয়ে ওপরে চলে যায়। পেছন থেকে সকলে ডাকে কিন্তু সে শোনে না। মেয়েটা এমনই ভীষণ অভিমানী। আবার একটু পর মন ভালো হয়ে গেলে নিজে থেকেই চলে আসবে। নিঝুম হতাশ হয়ে বলে,
– চিন্তা করবেন না স্যার। ও একটু পরই চলে আসবে।
– হুম
– আহ ভাবিমনি তুমি আবার ভাইয়াকে স্যার বলছ। এটা তো তোমাদের অফিস টাইম নয়।
– মৌটুসী আমি এভাবেই অভ্যস্ত হয়ে গেছি। হয়ে যায় আরকি৷
– প্রবলেম নেই। নিঝুম এভাবেই ডাকুক। ইনফেক্ট ওর এই অলওয়েজ স্যার, স্যার করাতে আমি ভেতর থেকে সর্বদা স্ট্রং থাকি। বাড়িতে থেকেও কাজের এনার্জি পাই।
– থাক থাক হয়েছে এবার আবার তোমরা তোমাদের কাজ নিয়ে পড়িও না। খেতে চলো সবাই।
সোনালীর কথায় সমর্পণ কিছু একটা চিন্তা করে বলে,
– ওহ হ্যাঁ ভালো কথা মনে পড়ল! নিঝুম তুমি কী আজ লেট করে বেরবে?
– নাহ স্যার নাস্তা সেরেই বেড়িয়ে যাবো।
– ওহ গুড! আমার একটা ইম্পর্টেন্ট ডিসকাশন আছে তোমার সঙ্গে। তুমি ক্যাম্পে গিয়ে একবার আমার কেবিনে মিট করে যেও।
– জ্বি স্যার অবশ্যই।
অতঃপর সকলে নাস্তা করতে যায়। খেতে খেতে নিঝুম বলে,
– মৌটুসী আমার আইসক্রিম?
– এগুলো ফ্রিজে তুলে রেখেছি। নাস্তা সেরে খেয়ে নিও।
– ওহ গুড গার্ল
সমর্পণ খাওয়া ফেলে নিঝুমের দিকে তাকায়। স্থির কন্ঠে বলে,
– মাঝে মাঝে আমি এটাই ভেবে বসি তুমি তুশীর থেকে মেইবি ছোট হবে বয়সে। এমন পাগলামি কখনো তুশীকেও করতে দেখি নি।
নিঝুম লজ্জা মাখা হাসি দেয়। তা দেখে সমর্পণ, সোনালী দুজনেই মৃদু হাসে।
দেওয়ালে টাঙানো বড় ছবিটিতে দৃষ্টি আবদ্ধ করে রেখেছে সমর্পণ। দৃষ্টি স্থির। মন অশান্ত। তবুও অশান্ত মনটাকে বেঁধে রাখতে কোনো রকম ত্রুটি সে রাখে না। শত হোক তুশী বড় হচ্ছে। ওর সামনে কখনো তাকে ভেঙে পড়লে চলবে না। সমর্পণের আকাশ-পাতাল চিন্তার মধ্যেই দরজায় টোকা পড়ে। সে ছবিটির কাছ থেকে সরে এসে গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
– কাম ইন
সঙ্গে সঙ্গে নিঝুম হুড়মুড়িয়ে সেখানে ঢুকে পড়ে। হাত ঘড়িটি সেট করতে করতে ব্যস্ত কন্ঠে বলে,
– আপনার হয়েছে লেট হচ্ছে তো। আমি কিন্তু তৈরি।
সমর্পণ নিজেকে স্বাভাবিক করে নেয়। টেবিল থেকে কিছু ফাইল পত্র তুলতে তুলতে বলে,
– হ্যাঁ চলো।
– হুম হুম
—————–
– মে আই কাম ইন, স্যার?
– ইয়েস, কাম ইন।
– কিছু একটা ইম্পর্ট্যান্ট দরকার আছে বলেছিলেন?
– হুম বলছি আগে বসো।
নিঝুম চেয়ার টেনে বসে। সমর্পণ হাতের একটা ফাইল নিঝুমের দিকে এগিয়ে দেয়। নিঝুম ফাইলটি হাতে নেয়। সমর্পণ চেয়ার হেলান দিয়ে আরাম করে বসতে বসতে বলে,
– ওটা দেখো
নিঝুম কৌতুহল বসত ফাইলটি খোলে। পুরো ফাইলটা খুব মনোযোগ সহকারে চেকিং করে। হঠাৎই নিঝুমের বুকটা ধক করে ওঠে। পুরোনো স্মৃতি ইশারায় ডাক দিয়ে যায়। মনকে শক্ত করে সে সমর্পণের দিকে করুণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। সমর্পণ সেদিকে তোয়াক্কা না করে বলে,
– এই কেসটা তোমাকে হ্যান্ডেল করতে হবে নিঝুম। দিস ইজ মাই অর্ডার।
নিঝুম ততক্ষণাৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ায়। কৌতুহলী দৃষ্টি নিয়ে ভরাট কন্ঠে বলে,
– এটা আপনি কী বলছেন স্যার? সবকিছু জেনে শুনে আমার সঙ্গে এমনটা আপনি কী করে করতে পারেন?
সমর্পণ হতাশার নিশ্বাস ফেলে বলে,
– আ’ম হেল্পলেস নিঝুম। তুমি তো জানোই আমি খালামনির প্রতি ঠিক কতটা দুর্বল। সে আমার থেকে কিছু চেয়েছে আর আমি তাকে ফিরিয়ে দিবো এটা কী করে হয়?
– কিন্তু স্যার এরজন্য তো আমাকে সাফার করতে হবে। প্রতিবার সকলের প্রয়োজনে কেন আমাকে ব্যাবহার করা হয়?
– এটা তোমার ডিউটি নিঝুম। ডিউটিকে এভাবে নিজের পার্সোনাল লাইফের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলো না। মনে রাখবে তোমার ডিউটিতে মুল লক্ষ্য নিজেকে স্ট্রং রাখা। যেটা আমি তোমাকে এই চার বছর ধরে প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছি। এবার আমার গুরুদক্ষিণা চাই নিঝুম। তোমাকে প্রুভ করে দিতে হবে আমি ট্রেনার হিসেবে ঠিক কতটা পার্ফেক্ট। আমার ছাত্রী হিসেবে তুমি কতটা পার্ফেক্ট। কী পারবে তো নিঝুম?
সমর্পণের কথা গুলো চরম গতিতে মস্তিষ্কে হানা দিতে লাগল নিঝুমের। হ্যাঁ অবশ্যই নিঝুম পারবে! তাকে পারতেই হবে। সে তো দুর্বল নয়। সময় এসেছে অন্যায়ের বদলা নেওয়ার। অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার। সে এই দেশের বুক থেকে অপরাধীদের নিশ্চিহ্ন করতে সদা প্রস্তুত। সে দেশের কাছে ওয়াদা বদ্ধ সব রকম পরিস্থিতিতে সে দেশের হয়ে লড়াই করবে। তাহলে এখন কেন পিছু হটবে? কখনোই না! নিজের পার্সোনাল লাইফের সঙ্গে প্রফেশন গুলিয়ে ফেলার মতো ভুল নিঝুম করবে না। সে গভীর থেকে গভীরতর একটা তপ্ত নিশ্বাসের সঙ্গে ভেতর থেকে নিজেকে তৈরি করে নিল। অতঃপর দৃঢ় কন্ঠে বলল,
– ইয়েস স্যার, আমি পারব। নিঝুম প্রমাণ করে দেবে আপনার শিক্ষা এবং তার মনোবল কোনটাই ঠুনকো নয়। নিঝুম ভাঙবে তবু মচকাবে না। পৃথিবীর বুক থেকে অপরাধীদের নিশ্চিহ্ন করে তবেই আমার শান্তি। এতে যদি আমার ম’র’ন ও লেখা থাকে তবে তাই সই।
– গুড গার্ল। এমন মনোবলই তোমার থেকে গ্রহণ যোগ্য। ওকে! তবে এখন নিজের কাজে ফোকাস করো। নেক্সট উইকে আমরা ঢাকা শিফট হচ্ছি।
– ওকে স্যার! নাও আই ক্যান গো।
– সিওর
নিঝুম ফাইলটার দিকে এক পলক তাকিয়ে জোর কদমে হেঁটে চলে যায়। সমর্পণ সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস টেনে মিনমিনিয়ে বলে,
– আমার হাতে কিচ্ছু নেই নিঝুম। আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো খালামনির মনের ইচ্ছে পূরণ করার।এখন সময় এসেছে সবকিছুর হিসেব বুঝে নেওয়ার। বাকিটা আল্লাহর ইচ্ছে।
—————–
– ইহান ইহান কোথায় তুই? তুই কী আবার নিজেকে ঘরবন্দী করতে চাইছিস? আচ্ছা এভাবে আর কতদিন চলবে?
– যতদিন না আমার ম’র’ন হচ্ছে ততদিন।
অন্ধকারাচ্ছন্ন বেলকনিতে থেকে ভেসে এলো অসহায়ত্ব কন্ঠ। অনিলা খান আঁতকে উঠলেন ছেলের এরুপ বাক্যে। কোনো রকমে অশান্ত মন নিয়ে হাতড়ে হাতড়ে ঘরে প্রবেশ করলেন তিনি। হাতড়ে হাতড়ে চলে গেলেন বেলকনিতে। এখন অমাবস্যা তিথি তাই আকাশে ঘোর অন্ধকার বিরাজমান। সেই আঁধার ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর বুকে। পৃথিবীর বুকে অবস্থিত ইহানের ছোট্ট বেলকনিতে। অনিলা খান ছেলেকে আবছা আলোয় উপলব্ধি করতে পারলেন। তিনি ধীর কন্ঠে বললেন,
– এমন করে বলিস না বাবু। তোর বাবার মৃত্যুর পর থেকে তো তোর মনোবলেই বেঁচে আছি আমরা। কিন্তু এই চারটে বছর ধরে এ কোন দোটানায় ভাসছি আমরা বল। তুই তো এখনো কিছু খোলাসা করে বললেই না কখনো। পুলিশের চাকরি টাও ছেড়ে দিলি। এভাবে কী আর জীবন চলে। কত দিন এমনটা চলবে বল? কতদিন?
অনিলা খান আঁচলে মুখ চেপে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। ইহান বিরক্ত হলো। মুখ দিয়ে ‘চ’ শব্দ উচ্চারণের মধ্য দিয়ে বিরক্ত প্রকাশ করল। অনিলা খান বুঝতে পারলেন ছেলে তার রেগে যাচ্ছে। তিনি সেই অবস্থায় ফের হাতড়ে হাতড়ে বেড়িয়ে গেলেন রুম থেকে। এটা নতুন নয় এই চারটি বছর ধরে এভাবেই হয়ে আসছে।
অনিলা খান চলে যেতেই ইহান ওই অন্ধকার আকাশে দৃষ্টি মেলায়। বিড়বিড় করতে করতে বলে,
– ওই আকাশটার সঙ্গে আমার জীবনের ব্যাপক মিল। একজন আমাকে ঠকালো আর একজনকে আমি ঠকালাম। আমিও বিবেক বিবেচনা না করেই প্রতিশোধ নেশা এবং ডিউটির সীমারেখায় চরম ভুল করে বসলাম। হেলায় হারালাম অমূল্য কাছে থাকা রত্নটি।
আপন মনে সারারাত বিড়বিড় করতে করতেই পার করে দেয় ইহান। এভাবেই প্রায় প্রত্যেকটি রাত কাটে তার।
—————–
চলবে,
®সাদিয়া আফরিন নিশি
#কাঁচের_গায়ে_বৃষ্টি_ফোঁটা (দ্বিতীয় পরিচ্ছদ)
–(পর্ব – ২)
————–
এক সপ্তাহ কেমন চোখের পলকেই পার হয়ে গেল। সমর্পণ সোনালী, তুশী আর নিঝুমকে নিয়ে ঢাকায় শিফট হয়ে এসেছে। চেনা শহর, চেনা পথঘাট আজ বড্ড অচেনা নিঝুমের কাছে। হবে নাই বা কেন এই চার বছরে সে তো নিজেই নিজের কাছে অচেনা। সেক্ষেত্রে তো এই ইট, কাঠ,পাথরের দালানে আবৃত শহরের বদলে যাওয়াটা নিছকই তুচ্ছ।
ঘড়ির কাঁটায় সময় দেখে নিয়ে তৈরি হতে লেগে পড়ল নিঝুম। একে তো নতুন ক্যাম্প তারওপর তার কাঁধে চাপানো বড়সড় দ্বায়িত্বের বোঝা। সব মিলিয়ে ভীষণ ব্যস্ত সে। সমর্পণ অনেক আগেই বেড়িয়ে গেছে। নিঝুম তৈরি হয়ে তুশী, সোনালী থেকে বিদায় নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে। বাইকে চেপে সোজা ক্যাম্পের পথ ধরে।
—————-
– ভাইয়া চলো। আজ তো আশ্রমে যাওয়ার ডেট। বাচ্চাগুলোকে দেখে আসতে হবে। ওরা প্রতি মাসের এই দিনটিতে তোমার জন্য না খেয়ে অপেক্ষা করে থাকে। তুমি না গেলে তো ওরাও কিছু মুখে তুলবে না। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও।
ইরার কথায় ইহান ছোট্ট করে, “হু” বলল শুধু। পরপরই উঠে চলে গেল ফ্রেশ হতে। আশ্রমের কথা শুনলে ইহান না করতে পারে না। প্রতি মাসের এক তারিখে আশ্রমে বাচ্চাদের সঙ্গে সময় কাটায় সে। এই আশ্রমটা তার বাবার নামে করা। সকল অনাথ,অবহেলিত শিশুদের জন্য। আশ্রমের শিশুদের কাছে ইহান খুবই প্রিয় পাত্র। সেখানকার সকল বাচ্চারা তাকে ভালো ভাইয়া বলে ডাকে। ইরাকে বলে ভালো আপু। আর ইশানকে বলে দুষ্টু ভাইয়া। কারণ ইশান ওদের সঙ্গে প্রচুর দুষ্টুমি করে, বিরক্ত করে তোলে খুব।
ইরা,ইশান, ইহান তিনজন গাড়ি করে রওনা হয়ে গেল আশ্রমের পথে। অনিলা খান বাসায় আছেন। শারীরিক সমস্যার দরুন তিনি তেমন একটা যেতে পারেন না।
—————-
ঢাকা শহরের সবথেকে বড় প্রবলেম হলো এই ট্রাফিক জ্যাম। একবার জ্যাম বাঁধলে ছাড়াছাড়ির আর কোনো ওয়ে নেই। এটা অবশ্য নিত্যদিনের রুটিন। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে বাইকের ওপর দু-হাত টান টান করে রেখে সামনে তাকিয়ে আছে নিঝুম।
জ্যামে আটকে দাড়িয়ে পড়েছে ইহান-দের গাড়িটাও। ইরা, ইশান বিরক্তির নিশ্বাস ফেলল। ইহানের সেদিকে কোনো পরয়া নেই। সে তো আপনমনে জানালা থেকে বাহিরে তাকিয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে কোনো গভীর চিন্তায় মগ্ন। ইরা ইহানের এক কাঁধে হাত রেখে আলতো কন্ঠে ডাক দিল। ইহান চমকে উঠে পাশ ফিরে বলল, “কিছু না।” ইরা চুপ করে রইল। কিয়ৎক্ষণ বাদেই ইহান কেমন জানি দিশেহারা হয়ে পড়ল। বেশ অস্থিরতা নিয়ে জানালার বাহিরে মাথা বের করে দিল। ততক্ষণে জ্যাম ছেড়ে গেছে। ইরা, ইশান ইহানের এমন অবস্থা দেখে তাড়াতাড়ি ওকে টেনে ভেতরে ঢোকায়। ইরা অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করে,
– কী হয়েছে ভাইয়া এমন করছ কেন? খারাপ লাগছে বেশি?
ইশানও ইরার সঙ্গে তাল মেলায়,
– হ্যাঁ ভাইয়া কী হয়েছে বলো না?
ইহান হাতের ইশারায় বাহিরের দিকে দেখায়। কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারছে না। ওর শ্বাস নিতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। তবুও অনেক কষ্টে ভাঙা ভাঙা বুলি আওড়ে বলল,
– নি… নি.. ঝু..ঝুম
ইরা, ইশান দুজনেই অবাক। একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। অতঃপর ইরা বলল,
– এসব তুমি কী বলছ ভাইয়া বউমনি কোত্থেকে আসবে? বউমনি তো আরও চার বছর আগেই….
কথা শেষ করতে পারে না ইরা। চোখজোড়া জলে চিকচিক করে ওঠে। ইশান ইরার কাঁধে হাত রাখে। ইরা নিজেকে সংযত করে নেয়। ইহান গাড়ির সিটে ঝিমিয়ে পড়তে পড়তে বলে,
– স..সত্যি বল..ছি আমি।
অতঃপর ইহান চুপ করে চোখ বন্ধ করে থাকে। ইরা,ইশান বুঝতে পারছে না এটা কী করে সম্ভব? তবে এই চার বছরে এমন কথা ইহান কখনো বলেনি। এটাই প্রথম। কিছু যদি না দেখে থাকে তবে এমন অদ্ভুত প্রসঙ্গ তোলার মতো মানুষ ইহান নয়। তবে কিছু তো একটা ঘটেছেই যা ইরা আর ইশান দেখি নি। তবে সেটা কী?
—————-
নিঝুমকে সঙ্গে নিয়ে সমর্পণ ডিরেক্ট এখানকার থানায় চলে গেল। থানার সিনিয়র অফিসারের সঙ্গে কথা বলে ইহানের বাবার মৃ’ত্যু এবং তার রেখে যাওয়া সেই অসমাপ্ত কাজ যেটা চার বছর আগে শেষ করতে করতেও শেষ করতে পারে নি ইহান। সেই অসমাপ্ত কাজের দ্বায়িত্ব তুলে দেওয়া হলো নিঝুমের কাঁধে। সিনিয়র অফিসারের কাজ থেকে সবরকম দ্বায়িত্ব বুঝে নিয়ে নিঝুম আজকের মতো বাড়িতে চলে গেল। সমর্পণ সেখানে আরও কিছুক্ষণ আলাপ আলোচনা করল। তার মতে এই কেস সালুয়েশনের জন্য নিঝুম’ই একমাত্র যোগ্য ব্যক্তি।
সমর্পণ পেশায় একজন আর্মি অফিসার। নিঝুমকে সে নিজের হাতে ট্রেনিং দিয়ে তৈরি করে নিয়েছে তার জুনিয়র অফিসার পদে। চার বছর ধরে নিঝুমকে গড়ে পিঠে তৈরি করেছে একজন দক্ষ দেশসেবিকা হিসেবে। প্রথম প্রথম নিঝুম খুব ভয় পেত। তার রক্তে ফোবিয়া জনিত সমস্যার কারণে অচেতন হয়ে পড়া জিনিসটা নিয়ে অনেক বার সমর্পণকে বিপাকে পড়তে হয়েছে। তবুও সে হাল ছাড়ে নি। উন্নত চিকিৎসার মাধ্যমে সারিয়ে তুলেছে নিঝুমের সেই উইকনেস। নিঝুমের অতীত জানার পর থেকেই সমর্পণের তীব্র ইচ্ছে নিঝুম নিজ হাতে তার অপরাধীদের শাস্তি দিক। দেশের বুকে নিজের নাম লেখাক। সেই জন্যই সে এই কেসের ভারটা নিঝুমের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। মূলত নিঝুম বা সমর্পণ কারোরই পুলিশি কেস হ্যান্ডেল করার কথা নয় তবুও এটা পারসোনাললি সমর্পণ এ্যারেন্জ করেছে।
—————
আশ্রমে আজ আর যাওয়া হলো না ইহানদের। ইহানের শরীরের অবগতির জন্য গাড়ি ব্যাক করে বাড়িতে চলে এলো ওরা। অনিলা খান এসব কথা শুনে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া করলেন না। ইরার বেশ খটকা লাগলো। এমন অদ্ভুত কথা শুনেও তার মা কীভাবে চুপ আছে? তিনি কী আগে থেকে কিছু জানেন?
বাড়িতে এসে থেকেই নিঝুমকে দেখার ব্যাপারটা ইহানকে বেশ ভাবাচ্ছে। সে সময় সাময়িক অসুস্থতা ফিল করলেও এখন সে দিব্বি ফিট আছে। নিঝুমের শূন্যতায় সে একগুয়ে জীবন কাটালেও তার মস্তিষ্ক পুরোপুরিই সতেজ আছে। শুরু মাত্র একটু ঝিমিয়ে গেছে। নিঝুমকে এক ঝলক দেখার সঙ্গে সঙ্গেই সেটা যেন আবার তাজা হয়ে উঠেছে। কিছু একটা ভেবে ইহান তৈরি হয়ে বেড়িয়ে পড়ে পুলিশ স্টেশনে। সাময়িক ছুটি কাটাচ্ছিল এতদিন সে। তবে আজ থেকে আবার কাজে জয়েন করবে এবং সেই সাথে নিঝুমকে খুঁজবে। তার বিশ্বাস নিঝুম আছে। এই শহরেই আছে। একদিন সে ঠিক তার দেখা পাবে। দেখা পাবেই।
– কোথায় যাচ্ছো ভাইয়া?
ইশানের প্রশ্নে দাড়িয়ে পরে ইহান। হ্যান্ড ঘড়িটির বেল্ট আটকাতে আটকাতে তার উত্তর,
– থানায় যাচ্ছি
– কেনো? কোনো প্রবলেম হয়েছে কী?
– নাহ! অনেক দিন কাজে অবহেলা করেছি আর নয় এখন সময় হয়েছে ব্যাক করার।
– ওহ আচ্ছা। বেস্ট অফ লাক।
– থ্যাংকিউ
ইহান চলে যায়। ইশান কৌতুহলী মনে ভাবতে থাকে,
– ভাইয়ার হলো টা কী? মনে হচ্ছে এই সেই চার বছর আগের ইহান। এতদিনের পাগলাটে ইহান আর নেই।
—————-
বাড়িতে কেউ নেই। মেইন ডোর লক করা দেখেই নিঝুম বুঝে গেছে সোনালী হয়তো তুশীকে নিয়ে বেড়িয়েছে। ডুপ্লিকেট চাবি দ্বারা ডোর ওপেন করে সে ভেতরে প্রবেশ করে। রুমে গিয়ে ফ্রেশ নেয়। তারপর কিচেনে গিয়ে এক মগ কফি করে আবার রুমে চলে যায়। অতঃপর থানা থেকে সংগ্রহকৃত ডকুমেন্টস গুলো চেক করতে বসে পড়ে। সব তথ্য খুব নিখুঁত ভাবে দেখে নেয়। সব তথ্যের ভিত্তিতে একটি কথাই নিঝুমের মাথায় ঘোর পাক খেতে থাকে। পেনড্রাইভ টা এখন কার কাছে আছে? নাকি নষ্ট করে দিয়েছে? কফির মগে চুমুক দিতে দিতেই বেলকনিতে চলে যায় সে। কিছুক্ষণ ভাবনা – চিন্তার পরপরই তার মস্তিষ্কে প্রবল ভাবে একটি কথা হানা দেয়। হ্যাঁ! সে পেয়ে গেছে উত্তর। পেন ড্রাইভের খোঁজ হয়তো তার নাগালে। পেন ড্রাইভ টা যে এখনো পর্যন্ত নষ্ট করা হয়নি এটাও সে সিওর। অজান্তেই ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসির দেখা মেলে তার। নিঝুম কফির মগটা পাশের টি-টেবিলে রেখে দিয়ে সোজা হয়ে দাড়ায়। দুপুরের আকাশটা রোদে ঝলমল করছে। আকাশের দিকে তাকানো দ্বায়। রোদের উত্তাপে চোখ যেন ঝলসে পড়ে। নিঝুম চোখ বন্ধ করে নেয় ততক্ষণাৎ। মনের মধ্যে কিছু স্মৃতি স্মরণ করে। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে মনে মনে আওড়ায়,
কাঁচের গায়ে বৃষ্টি ফোঁটা
জীবন স্রোতে ভাসছি একা
জমানো অনেক মনের কথা
অভিমানে পড়ছে চাপা
—————-
চলবে,
লেখিকা – সাদিয়া আফরিন নিশি