কাঁচের গায়ে বৃষ্টি ফোঁটা পর্ব-৩+৪

0
253

#কাঁচের_গায়ে_বৃষ্টি_ফোঁটা (দ্বিতীয় পরিচ্ছদ)
–(পর্ব-৩)

————
“হেই বেইবি,, ইউ নো দ্যাট ইউ আর লুকিং সো প্রীটি?”

ইশানের কথা শুনে ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে রইল তুশী। এতো ভারি কথার মিনিং সে কিছুই বুঝল না। ইশান ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আলতো হাতে তুশীর গাল টেনে দিল। সোনালীর দিকে ইশারা করে বলল,

“ইওর মাম্মা ইজ গুড টু”

তুশী এবার হয়তো কিছু একটা বুঝল। সে ফুলো ফুলো গাল দুটো প্রসারিত করে বলল,

“ওটা আমার মাম্মা নয় আমার ফুপ্পিয়া”

ইশান যেন এটা শোনারই অপেক্ষায় ছিল। মেয়েটিকে দেখে আগেই সে বুঝতে পেরেছিল বেবিটা তার নয়। বিবাহিতা -অবিবাহিতার পার্থক্য উপর থেকে দেখেও অনেকটা বোঝা যায়। তবুও শিওর হওয়ার জন্য তুশীকে ওভাবে বলেছে সে। ইশান তুশীর সঙ্গে আরও টুকটাক কথা বলছে। ততক্ষণে সোনালীর স্ন্যাক্স কেনা শেষ। পাশ ফিরে তুশীকে অপরিচিত যুবকের সঙ্গে কথা বলতে দেখে কিঞ্চিৎ রাগ হলো তার। দ্রুত পায়ে ওদের দিকে হেঁটে এসে চিলের মতো ছো মে’রে তুশীকে নিজের দিকে টেনে নিল। ঘটনাচক্রে ইশান, তুশী দুজনেই হতভম্ব। ইশান কিছু বলার পূর্বেই সোনালী কপট রাগ দেখিয়ে বলল,

“এই যে মিস্টার,, কী এতো কথা বলছিলেন ওর সঙ্গে? জানেন না অপরিচিত লোক হয়ে বাচ্চাদের সঙ্গে বেশি কথা বলতে নেই?”

“নাহহহ জানতাম না তবে এখন জেনে নিলাম।”

ইশানের কথায় যেন গা জ্বলে উঠল সোনালীর। সে দাঁত কিড়মিড় করে তাকালো ওর দিকে। অতঃপর তুশীকে টানতে টানতে নিয়ে চলে গেল। তুশী সোনালীর হস্ত বন্ধনে থাকা অবস্থায়ও পেছন ফিরে বার কয়েক ইশানকে দেখে নিল। ততক্ষণে সোনালী তাকেও শাসাচ্ছে,

“বাড়ি গিয়ে তোমার হচ্ছে দাড়াও। তুমি কেনো দূরে গেলে?কেন কথা বললে ওই ছেলেটির সঙ্গে?”

এদিকে ওরা চলে যেতেই ইশান আনমনেই হেসে ফেলে। সিগারেট কিনতে এসেই সোনালীর ওপর চোখ পড়ে তার। তুশী থেকে নামটাও জেনে নিয়েছে। কিন্তু এড্রেস বলতে পারে নি তুশী। সোনালীর মায়াবী মুখশ্রীটা অদ্ভুত ভাবে তাকে ভীষণ রকম আর্কষণীত করেছে। মেয়েদের সঙ্গে ফ্লার্ট করা তার পূর্বকার অভ্যেস হলেও সোনালীকে দেখে কেমন জানি একটা মায়া বিরাজ করছে তার মনে। সেখানে ছলনার কোনো জায়গা নেই। কথায় আছে না,” লাভ এ্যাট ফার্স্ট সাইড” অনেক টা সে রকম। কিন্তু ইশান এসব মন থেকে মানতে চাইছে না তবুও মনের সঙ্গে যুদ্ধে পেরেও উঠছে না।

—————–
“আরে ইহান যে এসো এসো।”

“জ্বী স্যার।”

“তো বলো কেমন আছো এখন?”

“আলহামদুলিল্লাহ ভালো। স্যার একটা কথা! আসলে আমি কাল থেকে ডিউটিতে ব্যাক করতে চাইছি। ছুটির ডেট এখনো শেষ হয়নি তবুও আমি চাইছি কাল থেকে জয়েন করতে। আমার মনে হয় আমি এখন টোটাল ফিট আছি।”

“ওকে ওকে ওকে মাই সন! তুমি তাহলে কাল থেকেই জয়েন হয়ে যাও। আর কাল তবে তোমাকে একজনের সঙ্গে ইন্ট্রডিউস করিও দিবো কেমন।”

“কে সে?”

“খুব বিশেষ কেউ। কালকেই না হয় বলি।”

“ওকে স্যার তবে আমি এখন উঠি।”

“ওহ! শিওর।”

————
বেশ তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে থানার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়ল নিঝুম। মনটা আজ কেমন কেমন জানি করছে। মনে হচ্ছে বড় কিছু হতে চলেছে। অস্থিরতা দমাতে না পেরে সকাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তৈরি হয়ে হাজির থানায়। নিঝুম সিনিয়র অফিসার খোরশেদের সঙ্গে কেসের বিষয়ে কথা বলতে ব্যস্ত ঠিক তখনই দরজার কড়া নাড়ে কেউ। অফিসার খোরশেদ সেদিকে মনোযোগ দিয়ে বলেন,

“কাম ইন”

ততক্ষণাৎ ভেতরে প্রবেশ করে ইহান। ইহানকে দেখে খোরশেদ আনন্দিত কন্ঠে বলেন,

“এসো এসো ইয়াং ম্যান। গতকাল বলেছিলাম না তোমার সঙ্গে একজনকে ইন্ট্রডিউস করিয়ে দিবো। এই দেখো সে এসে গেছে।”

“জ্বি স্যার আমি অতি আগ্রহী।”

ইহানের মন্তব্যে চমকে ওঠে নিঝুম। সে এতক্ষণ ইহানের উল্টো দিকে ঘুরে ছিল। এখনো সেভাবেই আছে। যার ফলস্বরূপ এখনো কেউ কারো মুখ দেখে নি। নিঝুম বুঝতে পারছে না এখন তার কী করা উচিত। পেছনের মানুষটি যে
ইহান এ বিষয়ে সে শতাধিক নিশ্চিত। কিন্তু কথা হলো ইহান তাকে দেখার পর ঠিক কীভাবে রিয়েক্ট করবে এটাই। ততক্ষণে অফিসার খোরশেদ ইহানকে চেয়ারে সিট নিতে বলল। ইহান বসে গেল নিঝুমের পাশের চেয়ারটি টেনে। নিঝুম এবার জড়সড় হয়ে বামপাশ ফিরে বসল। ইহান একটু অবাক হলো। এমন ব্যবহার সে আশা করছে না। পরপরই অফিসার খোরশেদ নিঝুমকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“মিসেস নিঝুম এই হলো মিস্টার ইহান। এনার কথাই বলেছিলাম আপনাকে। আপনি তো ইহানের বাবার মৃত্যু রহস্যের তদন্তেই আছেন বর্তমানে।”

নিঝুম নামটি শোনা মাত্র জ্বলে উঠল ইহানের অন্তর। এতক্ষণ খোরশেদের দিকে মনোযোগী দৃষ্টি দেওয়া চক্ষুযুগল এখন অতি উদাসীনতায় চেয়ে আছে কিছুটা দুরত্ব বসে থাকা চেনার মতো অপরিচিতার দিকে। ইহান অতি আগ্রহ নিয়ে চেয়ে আছে। কিন্তু নিঝুম! সে তো ফিরতে চেয়েও পারছে না। এতগুলো বছর পর এই মানুষটির মুখোমুখি হওয়া ওপরে ওপরে সহজ হলেও অন্তস্থল থেকে বিরাট কঠিন। নিঝুমকে ফিরতে না দেখে অফিসার খোরশেদ বললেন,

“মিসেস নিঝুম এনিথিং রং? আপনি এমন করছেন কেন?”

নিঝুম ভেতর থেকে জোর নিশ্বাস টেনে নেয়। অতঃপর নিজেকে স্বাভাবিক করে সটান হয়ে দাড়িয়ে ইহানের দিকে হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়িয়ে দেয়।

“হ্যালো মিস্টার ইহান আ’ম নিঝুম আহসান।”

ইহানের যেন হাত এগোচ্ছে না। কন্ঠনালী কাঁপছে ভীষণ। কিছু বলতে নিয়েও পারছে না। লেডিস শার্ট, লেডিস প্যান্ট, চোখে চশমা, হাতে ঘড়ি, চুলগুলো কার্লিং করে উঁচুতে উঠিয়ে ঝুটি করা, সামনের কিছু চুলে কালার করা। এ কোন নিঝুম। সবথেকে বড় কথা হলো এতটা স্ট্রং পারসোনালিটি কোথায় পেল সে। কীভাবে স্ট্রিক্ট হয়ে কথা বলছে ইহানের সঙ্গে। কই ইহান তো পারছে না। তবে সে কী করে পারছে। আচ্ছা সে নিজেকে আহসান কেন বলছে? ইহানের সঙ্গে তো তার ডিভোর্স হয়নি তবে তার তো নিঝুম খান হওয়ার কথা তাহলে আহসান কেন? এতগুলো বছর কোথায় ছিল সে? কীভাবে এতকিছু হলো?
আনমনা ইহানকে ফের বাজিয়ে দেয় নিঝুম,

“কী এতো ভাবছেন মিস্টার। আমি কিন্তু এবার অপমান বোধ করছি। বাই দি ওয়ে, আপনি কোনো ভাবে আমার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করতে অনিচ্ছুক নয়তো? ওকে ডান! আমি উইথড্র করছি আমার হ্যান্ডশেক।”

ততক্ষণাৎ নিঝুম হাত নামিয়ে নিতে গেলে ইহান তড়িঘড়ি করে নিঝুমের হাতে হাত মেলায়। অনুতপ্ত হয়ে বলে,

“সরি, সরি! আমি আসলে একটু অন্য মনস্ক ছিলাম। এগেইন সরি।”

“ইট’স ওকে।”

অফিসার খোরশেদ এদের কর্মকাণ্ডে হেসে কুটিকুটি। তিনি আবার অধিক রসায়ন সত্তার মানব। এদিকে হ্যান্ডশেক শেষে নিঝুম অফিসার খোরশেদকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“স্যার আমাকে এখন উঠতে হবে। আমি এই সাবজেক্টটা নিয়ে আগামীকাল কথা বলে নিবো। এখন আপাততঃ ক্যাম্পে যেতে হবে। ওখানে জরুরি কাজ আছে।”

খোরশেদ খুব সাচ্ছন্দ্যে নিঝুমকে বিদায়ের পারমিশন দিয়ে দিলেন। ইহান বেশ বুঝতে পারছে নিঝুম তাকে ইন্ডাইরেক্টলি অপমান করতে চাইছে। কিন্তু এখন তার হাতে কিছুই নেই। তবে সেও আবরার খান ইহান। সব রহস্য বের করে তবেই ছাড়বে।

—————-
একমাত্র অনিলা খান ছাড়া আর কাউকেই আজকের ঘটনা জানায় না ইহান। কিন্তু অনিলা খান হু হা ছাড়া তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। ইহান বেশ বিরক্তি নিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করে। এমন একটা সিরিয়াস মুহূর্তে তার মা কী করে এতটা স্বাভাবিক থাকতে পারে। লাইক সিরিয়াসলি!!

ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেয় ইহান। মনটা অনেক দিন পর কিছুটা শান্ত হয়েছে। তা শুধুমাত্র নিঝুমের দর্শনে। আবার অস্থিরতাও বেড়েছে অনেক। নানারকম প্রশ্ন মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। কিন্তু উত্তর জানতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে নিশ্চয়ই। নিঝুমের কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে তাকে ফিরিয়ে আনতে হবে খান বাড়িতে। এত কঠিন কাজ তো আর এতো সহজে সাধন হবে না।

—————–
বিছানায় এপাশ ওপাশ করছে ইশান। মনটা তার আজ ভীষণ চঞ্চল। সবকিছু কেমন অস্থিরতায় পরিপূর্ণ লাগছে। ছুট্টে গিয়ে তার নাগাল পেতে মন চাইছে। এ কেমন অনূভুতি? অথচ যার জন্য তার এতো উচাটন সে এসবের কিচ্ছুই জানে না। সে তো দিব্বি তার মতো ভালো আছে। ইশানের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়ে সে আছে মহা সুখে।

বেলকনির সিঙ্গেল দোলনাটায় বসে থেকে আনমনে আকাশপানে চেয়ে আছে ইরা। বিষন্ন মনে রোজের চলাচল এই তীব্র যন্ত্রণার। চার বছর আগে হারিয়ে যাওয়া যুবকরুপী প্রেমিক পুরুষের সন্ধান সে আজও পায়নি। পায়নি সেদিন ঘটে যাওয়া ঘটনার বর্ণনা। কোথায় চলে গেল সে? কেন গেল? আর কী তবে কোনো দিন ফিরবে না? নাহ!ভাবা যাচ্ছে না এসব। তীব্র কষ্ট হানা দেয় হৃদয়ে। বুক চিড়ে ফালিফালি হওয়ার উপক্রম হয়ে পড়ে।

—————

চলবে,
®সাদিয়া আফরিন নিশি

#কাঁচের_গায়ে_বৃষ্টি_ফোঁটা (দ্বিতীয় পরিচ্ছদ)
–(পর্ব – ৪)

————–
অফিসার খোরশেদের কথা শুনে নিঝুম বেশ বিরক্ত হলো। “এই কেসে ইহানের সঙ্গে তাকে কাজ করতে হবে,”এটা কেমন কথা? সে যখন একাই এই দ্বায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে সেখানে আবার অন্য কাউকে নিতে হবে কেন? এদিকে ইহান তো মহা খুশি। সে তো মনে মনে এটাই চাইছিল। টুকটাক ডিসকাশন শেষ করে নিঝুম বেড়িয়ে যায় থানা থেকে। ইহানও পিছু নেয় নিঝুমের।
————–

” ঝুম….. ”

তীব্র আর্তনাদ মাখা কন্ঠে থমকে দাড়ায় নিঝুম। পায়ের নিশ্চল গতি। পিছু ফেরে না। ফেরার প্রয়োজন মনে করছে না। তীব্র অগ্রাহ্য করতে চাইছে। কিন্তু ওই যে ওই আর্তনাদ তো পুরোপুরি উপেক্ষা করার নয়। “ঝুম” এ নামে কেবল অদিতি তাকে ডাকত। আর আজ ইহান ডাকছে। এই দুজন ব্যক্তিকেই সে চরম ঘৃণা করে। দুজনেই স্বার্থপর। তাকে চরম ভাবে ঠকিয়েছে। অদিতি এবং ইহান দুজনেই নিজের স্বার্থে তাকে ব্যবহার করেছে। ইহানের জন্যই তার জীবন মা’রা’ত্ম’ক ঝুঁ’কির মধ্যে ফেঁসে গিয়েছিল। ম’র’তে ম’র’তে বেঁচেছে। সেদিন যদি সমর্পন না থাকত? তাহলে নিজের পরিণতি ভেবেই আঁতকে উঠে নিঝুম। চোখের কোণ চিকচিক করে ওঠে। ঝাপসা লাগে চতুর্দিক। গলায় পেঁচানো জরজেট ওড়নার কোণ দিয়ে খুব সন্তর্পণে চোখের পানি মুছে নেয় সে। নিজের দুর্বলতা আর কারো সামনে প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক সে। অতীতের পাতা ঘাটলে মনটা বি’ষি’য়ে ওঠে। মূহুর্তেই নিজেকে শক্ত আবরণে আবৃত করে নেয়। কঠিন ভঙ্গিতে পেছন ফিরে তাকায়। কাঠ কাঠ গলায় উত্তর দেয়,

“ফার্স্ট অফ অল, আ’ম নিঝুম, নট ঝুম। এন্ড ইউ হ্যাভ নো রাইট টু কল মি লাইক দ্যাট।”

ইহান থতমত খেয়ে যায়। করুন সুরে কিছু বলতে নিবে তার আগেই নিঝুম হাত উঁচিয়ে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে,

“প্লিজ স্টপ ইউর ড্রামা। আই ওয়ান্ট টু গো নাও।”

নিঝুম চলে যেতে পা বাড়াতেই ইহান হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে গিয়ে নিঝুমের সম্মুখে দাড়ায়। হাত জোর করে অনেক আকুতি মিনতি করে কিছু কথা বলার জন্য কিন্তু নিঝুম শুনতে নারাজ। সেই মুহূর্তে প্রকৃতিও ওদের সঙ্গে মেতে উঠে মান-অভিমানের খেলায়। নিঝুমের মান ভাঙাতে যেমন ইহান ব্যাকুল তেমনই তীব্র তাপ সম্পন্ন সূর্য যখন অভিমানে নিজেকে মেঘের আড়ালে লুকিয়ে নেয় তখন সেই মান ভাঙাতে ব্যস্ত থাকে অজস্র মেঘরাশি। তাদের সেই মান অভিমানের খেলা প্রকৃতির বুকে ঝড়ে পড়ে বৃষ্টি হয়ে। আজও ঠিক তাই হচ্ছে। পশ্চিমাকাশে আগে থেকেই তীব্র মেঘের আনাগোনা। হঠাৎ করে গগনের বক্ষ চিঁড়ে প্রবল বারিধারা সিক্ত করে তুলছে ধরনী। সেই বর্ষণে সিক্ত হয়ে উঠছে দুজন নর-নারীর অন্তরীক্ষ। বৃষ্টির পানির সঙ্গে চোখের পানি মিলেমিশে একাকার হয়ে মিলন খেলায় লিপ্ত হয়েছে।

“পথ ছাড়ুন।”

“যদি না ছাড়ি?”

“ভুল করছেন।”

“তুমি হয়তো ভুলে যাচ্ছো আমার ক্যারেক্টর। নম্রভাবে কথা বলছি বলে অতিরিক্ত করছ।”

“আর আপনি হয়তো ভুলে যাচ্ছেন আমার পরিচয়। আমিও কিন্তু আর আগের ক্যারেক্টর বহন করছি না।”

“তুমি যেমনটাই হতে চেষ্টা করো না কেন আমার কাছে তুমি সেই আগের নিঝুমই থাকবে। কারণ আমি তোমাকে খুব কাছ থেকে দেখেছি, খুব করে চিনি, খুব করে জানি। তুমি শুধু আমার নিঝুম। একান্তই আমার ব্যক্তিগত।”

নিঝুম তাচ্ছিল্য হাসে। তুচ্ছ কন্ঠে বলে,

“তাই বুঝি? তা কোথায় ছিল চার বছর আগে আপনার এই সো কোল্ড অনুভূতি? যখন আমি স্ত্রী রুপে আপনার পেছন পেছন তৃষ্ণার্থ প্রেয়সীর মতো ঘুরে বেড়াতাম। দিনরাত ভালবাসি, ভালবাসি বলতাম। আপনার যাবতীয় টেক কেয়ার করতাম। পাগলের মতো আপনাকে চাইতাম। কিন্তু আপনি তো শুধু আমাকে ইউজ করে গেছেন। দিনকে দিন পায়ে পিষেছেন আমার ভালবাসাকে। আপনার জন্য আমি ম’র’তে ম’র’তে বেঁচেছি। আর কী চাই আপনার? ধোঁকা দিয়েছেন আমায়। দিনরাত ঠকিয়ে গেছেন। এখন আবার নতুন করে কী স’র্ব’না’শ করতে এসেছেন আমার?”

“হুম সবকিছুই মেনে নিলাম। বাট সবকিছুর পরে শুধু একটি কথাই বলবো ঝুম ” ভালবাসি, ভালবাসি, ভালবাসি।”

“তাই তা কী করে উদয় হলো এ-ই ভালবাসা?”

” এভাবে বলো না ঝুম। তুমি হয়তো সেদিন একটু খেয়াল করলেই সবটা ধরতে পারতে। তোমার ছোট্ট ছোট্ট পাগলামি গুলোতে দিনকে দিন আমি অভস্ত্য হয়ে গিয়েছিলাম। সেই অভ্যেস ধীরে ধীরে ভালবাসায় রুপান্তরিত হতে বেশি সময় নেয় নিয়ে। আমি তোমাকে অনেক বার একসেপ্ট করতে চেয়েছি কিন্তু ওই যে অপরাধ বোধটা আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়েছে বারংবার। যততবার তোমাকে কাছে টানতে চেয়েছি মনে হয়েছে আমি কোনো পাপ করছি। তোমাকে আমার অতীত না জানিয়ে বেশি দুর এগোনো ঠিক হবে না। অবশেষে তুমি সবটা শুনেই নিলে আমার থেকে। জানো সেদিন রাতে কতটা কী প্ল্যানিং করেছিলাম। ভেবেছিলাম পরদিন খুব আয়োজন করে তোমাকে প্রপোজ করবো।তারপর দুজনে মিলে সুখের পৃথিবী তৈরী করবো।এসব দেখে তুমি কতটা খুশি হবে ভেবে নিজেই আনন্দিত হচ্ছিলাম। সবকিছু ঠিকঠাক ছিল কিন্তু তুমি ঠিক ছিলে না। পরদিন সকালটা সুন্দর হওয়ার বদলে ডুবে গেল ঘন কালো অন্ধকারে। তোমাকে হারিয়ে ফেললাম আমি। তারপর থেকে পাগলপ্রায় আমার দশা। সবকিছু থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিলাম। ডিপ্রেশনে ভুগছিলাম অনেক টা। অপরাধ বোধ, পেয়ে হারানোর কষ্টে নিজেকে ঘরবন্দী করে নিয়েছিলাম। কাজ থেকে নিয়েছিলাম লম্বা বিরতি। অবশেষে হঠাৎ সেদিন তোমার আবছা অবয়ব দেখতে পাই হাই রোডে। তারপর থেকে নিজেকে গুছিয়ে নেয়। ফিরে যাই কর্মক্ষেত্রে। ভাগ্যের পরিহাসে দেখা মেলে তোমার সঙ্গে। দু’জনে ফের মুখোমুখি। কিন্তু ভিন্নতা আকাশচুম্বী।”

বৃষ্টির বেগ আরও তীব্র রুপ নিয়েছে। নিঝুম সমানে চোখের জলে ফেলছে। খুব করে ইচ্ছে করছে ইরানের বুকে ঝাপিয়ে পড়তে কিন্তু পারছে না। কোনো এক অদৃশ্য দেয়াল রোধ করছে তার অন্তর রাস্তা। ইহানও কেমন ঝিমিয়ে পড়েছে। নতমস্তকে দাড়িয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন। নিঝুম বৃষ্টির মধ্যেই ছুট লাগায়। এক মুহূর্ত দাড়ায় না। চোখ দিয়ে অজস্র জলরাশি উপচে পরছে তো পরছেই। থামার কোনো নাম নেই। ইহান হতাশ হয়। নিঝুম কিছু না বলেই চলে যাবে ভাবতে পারে নিয়ে। পেছন থেকে অনেক করুণ কন্ঠে আরেক বারের মতো ডেকে বসে,

“ঝুমমমম……….”

নিঝুম থমকে দাঁড়ায়। বৃষ্টির শব্দের সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে থমথমে কন্ঠে আবৃতি করে,

“কাঁচের গায়ে বৃষ্টি ফোঁটা
জলছবি আর আঁকবে না
জমানো অনেক মনের কথা
থাক তুমি তার বুঝবে না

অনেক দিয়েছ যন্ত্রণা মনে
এবার না হয় কিছু গ্রহণ করো সাদরে
পারো যদি করতে প্রমাণ
খুলবে তবে মনের দুয়ার
দেখাও দেখি কেমন পারো
মনের প্রাচীর তবে ভাঙো”

—————
এয়ারপোর্ট থেকে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে নিহান। তবে চার বছর আগে যে বাড়ি থেকে বেড়িয়েছিল আজ সেখানে যযাচ্ছে না। আজ যাচ্ছে তার নিজের সৎ পথে উপার্জিত অর্থে তৈরি ভবনে। যেটাকে কেন্দ্র করে সে বিগত চার বছর ধরে নানারকম স্বপ্নের জাল বুনেছে ভিনদেশে থেকে। আর সেই স্বপ্নের প্রতিটি ধাপ শুরু হয়েছে ইরাকে জড়িয়ে। হ্যাঁ এ-ই চার বছর নিহান বিদেশে ছিল নিজের ক্যারিয়ার গড়তে। চার বছর আগে ইরানের বলা কথা গুলো সে তলিয়ে দেখেছে। অতঃপর তার ইরাকে নিজের করে পাওয়ার জন্য একটু স্যাকরিফাইস করেছে মাত্র। এ কথা কেউ না জানলেও ইহান জানত। নিহান যযাওয়ার আগে ইহাকে সবটা বলে গিয়েছিল। আজ সেই অপেক্ষার অবসান ঘটতে চলেছে। ইরাকে সে নিজের করে নেবে। নেবেই!!

—————-
“নিঝুম আগামীকাল আমাদের একটি ইম্পর্টেন্ট ইনভাইটেশন আছে। তুমি তৈরি থেকো। এই ইনভাইটেশনে আমাদের অনেক জরুরি ক্লু পেতে পারি।”

সমর্পণের কথায় নিঝুম খাবার মুখে তুলতে তুলতে প্রশ্ন করে,

“ওহ তাই। তো কোথায় শুনি?”

“আহসান মঞ্জিলে।”

নিঝুমের হাত থেকে কাটা চামচটি পড়ে যায়। চেহারায় বিষন্নতা স্পষ্ট। সমর্পণের খাওয়া শেষ। সে উঠে গিয়ে নিঝুম কাঁধে হাত রাখে। কনফিডেন্সলি বলে,

“বি স্ট্রং এন্ড টেক কেয়ার অফ ইওর সেল্ফ। উইল সি সামথিং বেটার ইন দ্যা ফিউচার।

—————–

চলবে,
সাদিয়া আফরিন নিশি