কাঁচের গায়ে বৃষ্টি ফোঁটা পর্ব-৭+৮

0
279

#কাঁচের_গায়ে_বৃষ্টি_ফোঁটা 💦(দ্বিতীয় পরিচ্ছদ)
–(পর্ব – ৭)

—————
“কিছু বলবি ইরা?”

ইরা আমতা আমতা করছে। তার এই ভাইটিকে সে বড্ড বেশি ভয় পায়। ইনিয়ে বিনিয়ে সে কোনো রকমে বলল,

“আসলে আমার মনে আরও একটি প্রশ্নের উদয় হয়েছে। সকাল থেকেই এই প্রশ্নটি আমার অন্তরটা অস্থির করে তুলছে। তুমি কী দেবে তার জবাব?”

“আচ্ছা বল কী প্রশ্ন? সম্ভব হলে অবশ্যই উত্তর দেবো।”

“মায়ের মতো তুমিও কী কিছু লুকাচ্ছ ভাইয়া?”

“এমন কেন মনে হচ্ছে?”

“নাহ মানে! তুমি আগের দিন গাড়িতে বউমনিকে দেখা নিয়ে কতটা অস্থির ছিলে কিন্তু আজ এমন একটা খবর শোনার পরেও নিশ্চুপ।”

ইহান তপ্ত শ্বাস ফেলল। শ্বাসরুদ্ধ কন্ঠে এই কয়েকদিনের সকল ঘটনা খুলে বলল ইরাকে। ইরা বাকরুদ্ধ। এমন কিছু সে কল্পনাও করতে পারে নি। খুশি হয়েছে ভীষণ সেই সঙ্গে আবার চিন্তার ছাপ তার মুখশ্রীতে স্পষ্ট। নিঝুমের এহেন এটিটিউড সর্বদা বজায় থাকলে তার ভাইয়ের কাছে তাকে ফিরিয়ে আনবে কী করে? ভাইটা তো তার বড্ড বউ পাগল হয়ে উঠেছে। মুখে প্রকাশ না করলেও ভাইয়ের অস্থির চিত্ত চোখ এড়ায় না ইরার।

——————-
সময় পেরিয়ে যায় তড়িৎ গতিতে। সেই সঙ্গে বদলায় জীবনের মোড়। কেটে গেছে একটি মাস। এই একটি মাসে তেমন কোনো পরিবর্তন লক্ষণীয় নয়। ইহান, নিঝুম নিজেদের মধ্যেকার ঝামেলা আপাতত স্থগিত রেখে নিজেদের কর্মক্ষেত্রে প্রবল সম্ভাবনা নিয়ে ছুটছে। সোনালির সঙ্গে প্রায়শই অনাকাঙ্খিত ভাবে ইশানের দেখা হয়ে যায়। ইশান প্রতিবারই তাকে হেনস্তা করতে উঠে পড়ে লেগে যায়। এদিকে সোনালি সেসব কাজে চরম বিরক্ত হয়ে ইশানকে বেশ চড়া অপমান করে দিয়েছে পাবলিক প্লেসে। তারপর থেকে আজ বেশ কিছু দিন ইশানের কোনো দেখা সাক্ষাৎ নেই। সোনালি যেন এই কয়েকদিনের বিচ্ছেদে পিপাসার্থ হয়ে উঠেছে। ইশানের প্রতি রাগটা যেন গলে জল হয়ে সেখানে অন্য কিছুর উৎপত্তি হয়েছে। চোখ জোড়া বারংবার তাকেই খুঁজছে। বেহায়া মন হাজার বারন সত্ত্বেও অকারণ সেদিকেই ছুটছে।

ইরা আর নিহান বেশ ভালোই আছে। নিহানের ওই পরিবার থেকে বেড়িয়ে আসার পর ইরা আর তাকে প্রত্যাক্ষ্যান করতে পারে নি। আর এই চার বছরে প্রণয় বিরহ জিনিসটি সে খুব ভালো ভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছে। তাই আর ইরাকে মানাতে নিহানের বেশি একটা কাঠখড় পোড়াতে হয়নি।

———————
সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল কিন্তু বিপত্তি বাজল একদিন। যেদিন নিঝুম হাতে না হাতে ধরতে সক্ষম হলো মায়ানের পাচারকৃত অবৈধ অ’স্ত্র। এক ট্রাক অ’স্ত্র পুলিশের আন্ডারে সংরক্ষণ করা হলো। ট্রাকের ড্রাইভার, হেল্পারসহ আরও তিনজন উপস্থিত ছিল। তাদেরকে থানায় এনে উত্তম মাধ্যম দেওয়ার পরে তারা স্বীকার করে নেয় যে এসব কাজে মায়ান জড়িত। তারা সকলেই মায়ানের লোক। এবাদেও মায়ানের সকল অপকর্ম, গুপ্তস্থান,আরও নানারকম তথ্য ওদের থেকে উদ্ধার করে নেয় নিঝুম। সেগুলোর কিছু ভিডিও ক্লিপ তৈরি করে মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেয়। সনামধন্য ব্যবসায়ী মায়ান মির্জার নামে এতবড় কেলেংকারী প্রমাণ হওয়ায় তোলপাড় হয়ে চলেছে টেলিভিশনের হেডলাইন। এমতাবস্থায় মায়ান, মারিয়া প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। নিঝুমের বিরূদ্ধে মা’ত্রা’তি’রিক্ত ভ’য়ংক’র স্টেপ নিতে চায়। ইহানের এ বিষয়ে যথেষ্ট অবদান আছে। কারণ কাজটা ইহান, নিঝুম দুজন মিলেই করেছে। কিন্তু মায়ান,মারিয়ার ক্ষোভ গিয়ে পড়ছে শুধু মাত্র নিঝুমের ওপর।

———————-
থানায় সাময়িক সময়ের জন্য আনা গেলেও পুরোপুরি আটকে রাখা সম্ভব হয়নি মায়ান,মারিয়াকে। শুধুমাত্র জবানবন্দি দিয়ে তাদের মতো সনামধন্য ব্যক্তিদের আটকে রাখা পসিবল নয়৷ সাময়িক সময়ের জন্য হাজিরা দিয়ে তারা আবার চলেও গেছে। তাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত প্রমাণ সমেত এরেস্ট ওয়ারেন্ট দিয়েছে উপর মহল। এখন এই সর্ব সমস্যার সমাধান ইহানের বাবার তৈরি করে রেখে যাওয়া পেন ড্রাইভ টি। যেখানে ভিডিও সমেত মায়ান,মারিয়ার নিজেদের মুখে নিজেদের অপকর্মের স্বীকারোক্তি আছে। কিন্তু সেটা এই মুহুর্তে কী করে পাবে নিঝুম? নিঝুম বেশ ভালো করে বুঝতে পারছে ওটা তার বাবার নিকট আছে। কিন্তু প্রমাণ ব্যতিত সেখানে গিয়েও কোনো লাভ হবে না। তার কাছে পাক্কা খবর আছে যে, ‘তার বাবা ওই পেন ড্রাইভ টি ইহানের বাবার এক্সিডেন্টের সময় ওই স্পট থেকে কৌশলে উদ্ধার করে নিজের কাছে রেখে দিয়েছে এবং এই পেন ড্রাইভ দ্বারা মায়ানকে হেনস্তা করে মোটা টাকা আয়ত্ত করে নেয় ক্ষণে ক্ষণে। মায়ান, মারিয়া শত চেষ্টায় পেন ড্রাইভ টি উদ্ধার করতে সক্ষম হয়নি। শেষমেশ তারা বাধ্য হয়ে আহসান সাহেবকে নিজেদের দলে টানে। এসব খবর নিঝুম গুপ্তচর দ্বারা জানতে পেরেছে।

———————-
টিভির পর্দায় নিঝুমকে দেখে ইশান, ইরা এক প্রকার বায়না ধরে বসে তারা নিঝুমের সঙ্গে দেখা করবে। এ ব্যাপারে খুব এক্সাইটেড তারা। ইহান শেষমেশ বাধ্য হয়ে রাজি হয়ে যায়। ইহানের অগোচরে ইশান আর ইরা প্ল্যানিং কষে কীভাবে নিঝুমকে আবার এ বাড়িতে ফিরিয়ে আনবে। এসব কথা ইহানকে আগে বলে না পরে যদি একদম না করে দেয় তখন কী হবে এই ভয়ে।

বিকেল নাগাদ ওদের নিয়ে রওনা হয় ইহান। নিঝুমকে সে বলেছে কেসের ব্যাপারে জরুরি কথা আছে এজন্য রয়েল কফিশপে মিট করতে আসতে। এটা না বললে নিঝুম কোনোদিন আসবে না এটা সে খুব ভালো ভাবেই জানে। এদিকে নিঝুম তার পরিবার অর্থাৎ তুশী, সোনালি আর সমর্পণের সঙ্গে একটু ঘোরাঘুরি করতে বেড়িয়েছিল। অবশ্য তুশীর আবদারেই তারা বেড়িয়েছে নয়তো কাজ ফেলে সমর্পণ বা নিঝুম কারোরই ইচ্ছে ছিল না আসার। পথিমধ্যে ইহানের ফোন পেয়ে নিঝুম সমর্পণকে সবটা জানালে সে বলে তারা সকলেই ক্যাফিটেরিয়ায় যাবে। কফি-টফি খেয়ে একসঙ্গে সকলে চলে আসবে। সেই ফাঁকে ওদের কাজটাও হয়ে যাবে। নিঝুমও এ বিষয়ে কোনো আপত্তি করে নি। সকলে মিলে রওনা হয়েছে কফিশপে।

———————
ইহান, ইশান, ইরা তিনজনে কফি-শপের মধ্যে ইতোমধ্যে পৌঁছে গেছে। ইহান চার সিট বিশিষ্ট একটি টেবিল বুক করে। তিনজন তিন সিটে বসে পড়ে তারা অন্য সিট টি নিঝুমের জন্য রাখা হয়। ইশান, ইরা ভীষণ উৎসুক। ইহানের হাবভাব বোঝা দায়। কিয়ৎক্ষণের মধ্যেই সেখানে নিঝুম তার পরিবার নিয়ে উপস্থিত হয়। আশেপাশে একটু চোখ ঘোরাতেই ইহানকে নজরে পরে তার। সেদিকে অগ্রসর হতেই আরও দুটো হাসোজ্জল মুখ দৃশ্যমান হয় তার অক্ষিপটে। মুহূর্তেই হৃদপিণ্ড কেঁপে ওঠে তার। ইশান ছিল তার বন্ধু+ভাইয়ের মতো আর ইরা ছোট বোন। এদেরকে খুব বেশিই স্নেহ করত সে। এই চার বছরে ভীষণ মিস করেছে ওদের। চার বছর পর ওদেরকে চক্ষু সম্মুখে দেখে কী করা উচিত দিকবিদিকশুন্য সে। ইহানের দৃষ্টি অনুসরণ করে ইশান,ইরা দুজনেই সেদিকে তাকায়। মুহূর্তেই তাদের চেহারায় উচ্ছ্বসিত ভাবটা আরও দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়। ইরা তো দৌড়ে গিয়ে নিঝুমকে জাপটে ধরে।তীব্র আর্তনাদে ডেকে ওঠে “বউমনিইইই”। নিঝুমের অন্তরে গিয়ে লাগে সেই ধ্বনি। ইশানও ভীষণ খুশি তার চেহারায় তা প্রকাশিত। সে ও চোখে চোখে অনেক কথা বলছে কিন্তু মুখে কিছুই বলতে পারছে না। নিঝুম ইরার মাথায় পরম স্নেহে হাত বুলিয়ে দেয়। তারপর ইরাকে শান্ত করে ইশানের কাছে যায়। আলতো করে জড়িয়ে ধরে। দুজনের মধ্যে কিছু কথপোকথন চলে। তার মধ্যেই তুশী দৌড়ে এসে টেনে ধরে নিঝুমের ওরনার আঁচল। চোখজোড়া সরু করে চেয়ে,ঠোঁট যুগল কিঞ্চিৎ উল্টিয়ে অভিমানে স্বরে বলে,

” আম্মা তুমি ওদেরকে কেন জড়িয়ে ধরছো? কেন আদর করছো? তুমি তো আমার আম্মা তুমি শুধু আমাকে আদর করবে, আমাকে ভালবাসবে, আমাকে জড়িয়ে ধরবে।”

তুশীর কথায় হুঁশ ফিরে সকলের। ইহান, ইশান আর ইরা সকলেই বোঝার চেষ্টা করে এই পিচ্চি টার সঙ্গে নিঝুমের সম্পর্ক টা ঠিক কী? সে নিঝুমকে আম্মা কেন বলছে? ইশান খেয়াল করে এই পিচ্চি টা তো তুশী। সোনালির ভাইয়ের মেয়ে। সে তার দৃষ্টি ওদের ওপর থেকে ঘুরিয়ে পেছনে তাকায়। পেছনে সোনালী দাড়িয়ে আছে তার দিকে চেয়ে। সোনালীর পাশেই দাড়িয়ে আছে এক সুঠাম দেহী পুরুষ। ইশান ভাবল এটাই হয়তো সোনালির ভাই। এতক্ষণে ইরা, ইহান দুজনের দৃষ্টিই ওদের ওপরে পরে গেছে। এই কেসে সমর্পণ নিঝুমকে একা ছেড়ে দিয়েছে এজন্য কখনো সমর্পণের সঙ্গে ইহানের আগে দেখা হয়নি। নিঝুমের সঙ্গে এমন সুপুরুষ, তার ওপর পিচ্চি মেয়েটার আম্মা ডাক ভীষণ ভাবে ভাবাচ্ছে ইহানকে। মনের মধ্যে অযাচিত ভয় বাসা বাঁধছে। এদিকে নিঝুম তখনও তুশীকে মানাতে ব্যস্ত। পিচ্চি মেয়েটার একটু বেশিই অভিমান। নিঝুমের ক্ষেত্রে সেটা আরও দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়। এদিকে সোনালি ইশানকে এখানে দেখে প্রচন্ড অবাক। সেই সঙ্গে খুশিও হয়। এই কয়েকদিনের দেখা না হওয়ার বিরহ এক নিমেষেই শেষ হয়ে যায়। সে তৃষ্ণার্থ প্রেয়সীর ন্যায় চেয়ে থাকে ইশানের পানে।

——————–

চলবে,
লেখনিতে,সাদিয়া আফরিন নিশি

#কাঁচের_গায়ে_বৃষ্টি_ফোঁটা💦(দ্বিতীয় পরিচ্ছদ)
–(পর্ব – ৮)

—————
এতক্ষণের হাসোজ্জল পরিবেশ, আনন্দের উচ্ছ্বাস সবকিছু যেন এক নিমেষেই রুপান্তরিত হয়েছে থমথমে পরিবেশে। সকলের মধ্যেই পিনপতন নীরবতা। কতশত কথা মনের কোণে চাপা পড়ে আছে কিন্তু বলার অবকাশ নেই। নিরবতা ভেঙে সমর্পণ বলল,

“তো নিঝুম এভাবে বসে থাকলে চলবে। ইন্ট্রডিউস করাও ওনাদের সঙ্গে।”

নিঝুম ঢোক গিলে। পরক্ষনেই স্মিত হেসে ইরা আর ইশানের দিকে ইশারা করে বলে,

“ও ইরা মি.ইহানের বোন আর ও ইশান ওনার ভাই।”

নিঝুম কথা শেষ করে চুপ মে’রে গেল। সমর্পণ বিরক্তি মাখা মুখ করে বলল,

“আহ নিঝুম শুধু ওনাদের পরিচয় দিলে আমাদের পরিচয়ও ওনাদের দাও।”

সমর্পণের এই একটি কথায় ইহান, ইরা, ইশান তিনজনই উৎসুক হয়ে উঠল। তারা তো এ সময়েরই অপেক্ষায় ছিল। নিঝুম হাত মোচড়াচ্ছে। তা দেখে সমর্পণ ফের বলল,

“ওকে আমিই দিচ্ছি আমাদের পরিচয়।”

সমর্পণ সোনালীর দিকে ইঙ্গিত করে বলল,”ও আমার একমাত্র বোন সোনালী চৌধুরী।” তারপর তুশীকে নিজের দিকে টেনে নিয়ে বলল,”এ হলো আমার প্রিন্সেস তুশী চৌধুরী”। সমর্পণ এবার নিঝুমের দিকে ইঙ্গিত করে যখনই মুখ খুলতে নিবে ঠিক তখনই ওয়েটার মেনু-কার্ড নিয়ে হাজির। ওয়েটারকে দেখে সমর্পণ সেদিকে মনোযোগ ঘুরিয়ে নেয়। নিঝুম দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। ইহান,ইরা,ইশান হতাশ হয়। এবারেও জানা হলো না নিঝুমের সঙ্গে সমর্পণের সম্পর্কের পরিসীমা।

অনেক চাপা কষ্ট, প্রশ্ন, অনুভূতি, দুঃখ সবকিছুর মধ্যদিয়ে কেটে গেল কিছু মুহূর্ত। এবার নিঝুম বলল তারা এখন উঠতে চায়। ইরা বাঁধ সাধে। কেঁদে দেয় অস্বাভাবিক ভাবে। নিঝুমকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো আবদার করে বলে,

“তুমি আমাদের সঙ্গে আমাদের বাসায় যাবে। তোমাকে আর আমি ছাড়ছি না।”

দেখা যায় এ কথা শুনে তুশী স্বশব্দে কেঁদে দেয়। কফিশপের অনেকেই তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। ব্যাপারটা একটু অসহ্যকর। পরিস্থিতি সামাল দিতে ইশান জোরপূর্বক ইরাকে নিঝুমের থেকে ছাড়িয়ে নিল। ইহান তখনও নিরব দর্শক। অবশেষে ইহান দ্রুত সেখান থেকে বেরিয়ে গেল। তারপক্ষে আর একদন্ড দাড়ানো সম্ভব হলো না। যাবার আগে ইশানকে কড়া আদেশ দিয়ে গেল ইরাকে নিয়ে দ্রুত গাড়িতে ফিরতে। সে অপেক্ষা করছে। ইশান অনেক কষ্টে ইরাকে সেখান থেকে নিয়ে যেতে সক্ষম হলো। নিঝুম মূর্তির ন্যায় দাড়িয়ে আছে। সোনালী, সমর্পণ এগিয়ে যায় তার নিকট। তুশী নিঝুমের কোল ঘেষে দাড়িয়ে নাক টানছে। সোনালী নিঝুমের জড়িয়ে ধরে। কাতর কন্ঠে বলে,

“সব ঠিক হয়ে যাবে ভাবিমনি। তুমি কষ্ট পেও না।”

সমর্পণ নিঝুমের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। নিঝুম সোনালীকে জড়িয়ে ধরেই ডুকরে কেঁদে উঠে। মায়ের কান্না দেখে তুশীও আবার কাঁদতে শুরু করে।

—————–
রেস্টুরেন্টে সোনালী বেশকিছু বার নিঝুমকে ভাবিমনি বলে ডেকেছে এই ব্যাপারটা চোখ এড়ায়নি ইহানের। শুধু ইহান নয় ইশান, ইরার নজরেও পড়েছে। সকলের মনেই অজানা আশঙ্কা ডানা মেলেছে। ইহানের মনটা সহসা অস্থির হয়ে উঠেছে। দিকবিদিকশুন্য মনে হচ্ছে। মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। রন্ধ্রে রন্ধ্রে তীব্র যন্ত্রণার সঞ্চার হচ্ছে। নিঝুমের কন্ঠ শোনার তীব্র বাসনা জাগছে অন্তরে। ঘড়ির কাটায় এখন রাত বারোটা বেজে উনিশ মিনিট। এতরাতে কী নিঝুমকে বিরক্ত করা ঠিক হবে? ও হয়তো এখন ঘুমিয়ে আছে। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে ইহান নিঝুমের নম্বরে ডায়াল করে ফেলল। কাজের সূত্রে নিঝুমের নম্বর ইহানের কাছে থাকলেও এই কয়েকদিনে কখনো দরকার ছাড়া ফোন করে নি ইহান। কিন্তু আজ আর নিজের বেহায়া মনকে সামলাতে অক্ষম হলো।

এতরাতে ইহানের ফোন পেয়ে নিঝুম কিঞ্চিৎ চিন্তিত হয়ে পড়ল। মনে মনে ভাবল, এতো রাতে কেন ফোন দিল? কোনো বিপদ হয়নি তো? নিঝুম চটজলদি ফোনটা রিসিভ করে নিল। উদ্বিগ্ন কন্ঠে শুধালো,

“কী হয়েছে? খারাপ কিছু কী? আপনি ঠিক আছেন তো?”

ইহান অধরে স্মিত হাসি টেনে বলল,

“এখনো তবে আমাকে নিয়ে চিন্তা হয়।”

নিঝুম অকস্মাৎ হতভম্ব হয়ে পড়ল। নিজের কর্মে নিজেই হতবাক সে। কোনো রকমে আমতা আমতা করে বলল,

“এক..একদমই নাহহ।”

ইহান তখনো হেসে চলেছে। যেখানে নিঝুমের কন্ঠেই স্পষ্ট চিন্তার ছাপ সেখানে মুখের কথায় কীই বা আসে যায়। ইহান দমে গেল না। রসিকতার ছলে বলল,

“তাহলে এতো প্রশ্ন করা কেনো?”

নিঝুম ঠোঁট কামড়ে বলল,

“এতরাতে ফোন দিলে এসব বলা স্বাভাবিক নয় কী?”

ইহান আনমনে উত্তর দিল,
“হয়তো স্বাভাবিক নয়তো নয়।”

“মানে?”- নিঝুমের কন্ঠে কৌতুহল।

ইহান বেলকনির গ্রিল ধরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল সুদূর আকাশে। ওপাশে নিঝুম অপেক্ষায়। ইহান দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। কাতর কন্ঠে বলল,

“ফিরে এসো না ঝুম। শেষ বারের মতো ক্ষমা চাইছি। চারটা বছর অনেক সহ্য করেছি। তুমিই বলো এখনো কী শেষ হয়নি আমার পাপের বোঝা? তিলে তিলে মরছি আমি। তোমাকে কষ্ট দিয়ে বিন্দু মাত্র ভালো নেই। ফিরে এসো প্রেয়সী।”

নিঝুম স্তব্ধ। চোখ বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়ছে। ঠোঁট কামড়ে শব্দ আটকে রেখেছে। ইহানের কাছে সে কিছুতেই নিজেকে উপস্থাপন করতে চায় না। নিঝুম নিজেকে যথা সম্ভব শক্ত করে কাঠিন্য স্বরে বলল,

“আর কখনো এসব বাজে টপিক নিয়ে ফোন করবেন না। মনে রাখবেন কাজ ব্যতিত আপনার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।”

ইহান হতাশ হয়। কন্ঠ খাদে নামিয়ে রিনরিনিয়ে হটাৎ প্রশ্ন করে বসে,

“তোমার সঙ্গে ওই বাচ্চা মেয়েটার কীসের সম্পর্ক? ও কেন তোমায় আম্মা বলে? মি.সমর্পণের বোন কেন তোমায় ভাবিমনি বলে ডাকে? মি.সমর্পণ কে হয় তোমার ঝুম?”

নিঝুম এসব প্রশ্নে ধাক্কা খায়। বিচলিত হয়ে পড়ে। কী বলবে না বলবে ভেবে না পেয়ে খট করে কল টা কেটে দেয়। ধপ করে বিছানায় বসে পড়ে। চোখের পানি মুছে নিয়ে আপনমনে বলে,

“একদিন আমিও এমন কষ্ট সহ্য করেছি মি.খান। কাছে থেকেও ছুঁতে না পারার কষ্ট। আজ আপনার মনে কী চলছে আমি তা বুঝতে পারছি শত হলেও আপনি আমার একমাত্র ভালবাসার মানুষ, আমার তিন কবুল বলে বিয়ে করা স্বামী। তবুও দেখুন না ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস। আপনার করা কয়েকটি ভুলের জন্য আজ আমরা একে অপরের থেকে কতটা দুরে অবস্থান করছি। আপনাকে আমি ভালবাসি আর সারাজীবন বাসব কিন্তু কখনো ধরা দিবো না। আপনি আমাকে সেই দিনই ফিরে পাবেন যেদিন প্রকৃত অর্থে প্রমাণ দিতে পারবেন আমি আপনার কে সেদিন। ভালবাসার পরীক্ষা। যেদিন আমি মনে করবো আপনি জীবনের এই কঠিন পরীক্ষায় পাশ করতে পেরেছেন ঠিক সেদিনই আমি আবার আপনার ঘরে আপনার সঙ্গে আপনার বধূ রুপে ফিরে যাবো। তার আগে নয়।”

——————–
“তারমানে ওই লোকটাই ভাবিমনির হাসবেন্ড। আর ওনারাই ভাবিমনির পরিবার?”

“হুম”- সমর্পণ মাথা ঝাকায়।

“কিন্তু ওনাকে দেখে তো এমন মনে হয় না। তাকে তো খুব বিচক্ষণ পুরুষ বলেই মনে হয়।”

“সবাইকে কী আর বাহিরে থেকে দেখে বোঝা যায়।”

“তা অবশ্য ঠিক কিন্তু তবুও।”

“হুম এখন অবশ্য আগের মতো নেই। নিঝুমকে হারিয়ে বেশ বুঝতে পেরেছে ভুলটা তার ছিল। আসলে আমরা মানুষেরা দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম বুঝি না। আশা করছি খুব শীঘ্রই ওদের কষ্টের দিন শেষ হবে৷”

সমর্পণ কিছু একটা ভাবতে বসে। অকস্মাৎ সোনালী বলে ওঠে,

“আচ্ছা ভাইয়া সবকিছু যদি ঠিক হয়ে যায় তবে কী ভাবিমনি আমাদের ছেড়ে চলে যাবে?”

সমর্পণ বোনের মুখের দিকে তাকায়। কী বলবে বুঝতে পারছে না। বোনের কথার মর্মার্থ খুব ভালো ভাবে তার কাছে প্রকাশ্য। কিন্তু সে তো নিরুপায়। নিঝুম যেতে চাইলে সে তো তাকে বাঁধা দিতে পারবে না। আচ্ছা নিঝুম চলে গেলে তুশীর কী হবে? তুশী কী করে মা ছাড়া বাঁচবে? সমর্পণের শঙ্কিত দৃষ্টিতে চোখ মিলিয়ে কান্নারত কন্ঠে সোনালী বলে,

“একজনকে হারিয়ে আরেকজনকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছি আমরা। এবার সে ও যদি চলে যায় তাহলে তো বাঁচা দুষ্কর।”

সোনালী এক ছুটে চলে যায়। চোখের অবাধ্য পানি গুলো লুকাতে হবে তো। সমর্পণ নিরব দর্শকের ন্যায় চেয়ে চেয়ে দেখে বোনের চলে যাওয়া। তার যে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার নেই।

——————–

চলবে,
®সাদিয়া আফরিন নিশি