কাঁচের গায়ে বৃষ্টি ফোঁটা পর্ব-৫+৬

0
264

#কাঁচের_গায়ে_বৃষ্টি_ফোঁটা (দ্বিতীয় পরিচ্ছদ)
–(পর্ব-৫)

————-
আহসান মঞ্জিলের সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে নিঝুম। চার বছর পর আজ আবার সে তার নিজের বাড়িতে পদার্পণ করতে চলেছে। যে বাড়িতে কেটেছে তার শৈশব, কৈশোর। জড়িয়ে আছে নানারকম স্মৃতি। বাবা, মা,ভাই এর আদর,স্নেহ, শাসন। সমর্পণ এতক্ষণে কাঁচি গেট ওভারটেক করে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেছে। নিঝুমকে পাশে না পেয়ে সে হতাশ হয়ে পেছনে তাকায়। হ্যাঁ, যা ভেবেছিলো তাই নিঝুম এখনো গাড়ির কাছেই দাড়িয়ে। সমর্পণ এগিয়ে যায়। নিঝুমের হাত ধরে টেনে নিয়ে আসে বাড়ির মধ্যে। নিঝুম চতুর্দিকে চোখ বুলায়। বাড়িটায় বেশ পরিবর্তন লক্ষণীয়। হবে নাই বা কেন চার বছর তো আর কম সময় নয়। গেটের দারোয়ানও চেঞ্জ করা হয়েছে। আগের দারোয়ান কাকা হলে তাকে এক দেখাতেই চিনে ফেলত। নিঝুম সমর্পণের পেছন পেছন বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করে। সদর দরজা পেরিয়ে লিভিং রুমে প্রবেশ করে যেখানে খুব আয়েশী ভঙ্গিতে বসে পত্রিকা পড়ছেন আহসান সাহেব। নিঝুমের থমকায়। সমর্পণ ফের তাকে খোঁচা দেয়। নিঝুম চকিত দৃষ্টিতে পুনরায় অগ্রসর হয়।

“হ্যালো মি.আহসান।”

সমর্পণের কথা শ্রবণ হতেই আহসান সাহেব পত্রিকা থেকে চোখ তুলে ওপরে তাকায়। সমর্পণকে দেখে তড়িঘড়ি করে পত্রিকা বন্ধ করে উঠে দাড়ায়। হাসোজ্জল মুখে হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়িয়ে দেয়।

“হ্যালো মি.চৌধুরী।”

দু’জনে হ্যান্ডশেক পর্ব শেষ করতে না করতেই আহসান সাহেবের চোখ আটকায় নিঝুমের ওপর। তিনি চমকায় খানিক। অন্তর গলে আসে কিন্তু কিছু একটা মনে পড়তেই কাঠিন্য রুপ ধারণ করে। রাগী মুখশ্রীতে শক্তপোক্ত কন্ঠে কেবলই যখন বললেন, “ও…. “। দেখা যায় তাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই সমর্পণ বলে, ” ও আমার জুনিয়র অফিসার নিঝুম।” অতঃপর নিঝুমকে উদ্দেশ্য করে বলে, “নিঝুম মিট করো মি.আহসানের সঙ্গে।”
।।
নিঝুম ভেতর থেকে ইতস্তত বোধ করছে কিন্তু বাহিরে তা প্রকাশ করতে নারাজ। সাবলীল ভঙ্গিতে সে তার বাবার নিকট হাত বাড়িয়ে দেয়।

“হ্যালো মি. আহসান। নাইস টু মিট ইউ।”

আহসান সাহেব একবার সমর্পণের দিকে দৃষ্টি দিলেন। অতঃপর বাধ্য হয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিঝুমের সঙ্গে হাত মেলালেন। নিঝুম খুব কষ্টে নিজেকে সংযত রাখল। অতঃপর তারা একত্রে বসে কিছু আলাপ আলোচনা করতে লাগলো। নিঝুম অবশ্য তেমন কিছুই বলছে না। সমর্পণের কথা গুলোতে শুধু হু,হা করছে। তার দৃষ্টি তো মা, ভাইকে এক নজর দেখার জন্য তৃষ্ণার্থ। একটু পরেই তাদের জন্য নাস্তা দেওয়া হলো। সমর্পণ সামান্য কিছু খেলেও নিঝুম শুধু পানিটুকুই খেলো। আরও কিছু সময় পর সেখানে উপস্থিত হলো তার ভাই নুহাশ আহসান। নিঝুমকে দেখে বাবার মতো নুহাশও চমকে উঠলো। এই বোনটি তার বড়-ই আদরের ছিল। কিন্তু প্রয়োজনে সে তাকে শাসনও করেছে প্রচুর। তবে ভালবাসায় ও কোনো কমতি রাখেনি। কিন্তু চার বছর আগে বোনের সেই অপমান তার হৃদয়ে গেঁথে গেছে। এক রাতের বিয়ে করা বরের জন্য সে তার বাবা,ভাইকে প্রত্যাক্ষ্যান করল কীভাবে? মুহূর্তেই চেহারার রঙ পাল্টে যায় নুহাশের। হিতাহিত জ্ঞান শূন্য সে এখন। কাঠিন্য চেহারায় যখনই সে নিঝুমের কাছে যাওয়ার জন্য উদ্ধত হচ্ছিল ঠিক তখনই তার বাবা তাকে কৌশলে আটকে নেয়। এই দৃশ্য নজর এড়ায় না নিঝুম, সমর্পণ কারোরই। তবুও সকলে চুপ। নুহাশের হিতাহিত জ্ঞান আসতেই সে চুপ মে’রে যায়। নিঝুমকে পরে দেখে নেবে আপাততঃ সমর্পণকে হাত করার চেষ্টা করতে হবে। তাহলেই লাইন ক্লিয়ার। তাদের সমর্পণকে নিমন্ত্রণ করার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো, ‘তার মন খুশি করে তাকে হাত করা।’ তবেই তাদের পক্ষে এই কালো জগতের শেখরে পৌঁছানো সম্ভব। কিছু সময় পর নুহাশ সেখান থেকে উঠে ভেতরে চলে গেল। পরক্ষণেই খুব অল্প সময়ের মধ্যে আবার ফিরে এলো। তারপর তাদের জন্য ভারী খাবারের আয়োজন করা হলো। নিঝুম খুব যত্ন করে খাবারটা শেষ করল। কারণ এটা তার মমতাময়ী মায়ের হাতের রান্না। যে স্বাদ নিঝুম আজও ভুলতে পারেনি।

খাবার শেষে এবার তাদের যাবার পালা। নিঝুম শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তার মাকে এক নজর দেখার আসায় ওত পেতে ছিল কিন্তু সে তো আর জানে না তার ভাই সবার অগোচরে অনেক আগেই তার মাকে ঘরবন্দী করে রেখে এসেছে।

নিঝুম, সমর্পণ চলে যায়। ওপরের ঘরের জানালা থেকে একজোড়া অশ্রু সিক্ত চোখ ঠিকই তাদের দেখতে পায়। এক একাই হাঁসফাঁস করে। কিন্তু তা চোখে পড়ে না নিঝুমের। ওরা চলে যেতেই নুহাশ আহসান সাহেবের পাশে এসে দাড়ায়।

“আটকে দিয়েছ?”

“হুম”

“বেশ ভালোই করেছ।”

“হুম”

“দুধ কলা দিয়ে কী তবে কা’ল’সা’প পুষলাম?”

“হয়তো।”

——————-
একটা বড় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির সম্মুখে আছে ইরা। আজ তার ইন্টারভিউ ছিলো এই কোম্পানিতে। খুব ভালো ভাবেই ইন্টারভিউ সম্পন্ন করেছে সে। আশা রাখে চাকরিটা তার হয়েই যাবে। বাড়ির কেউ তার চাকরি করার বিষয়টা পছন্দ করছে না কিন্তু ইরা চায় নিজের পায়ে দাড়াতে।
শেষমেশ ইরার জেদের কাছে সকলে হার মানতে বাধ্য হয়।

রিকশার জন্য ওয়েট করছে ইরা। ইদানীং সে গাড়ি-টাড়ি বেশি একটা ইউজ করে না। সবরকম ভাবে সাবলম্বী হতে চায়। সবরকম অভ্যেস করে নিচ্ছে। তবে রিকশায় চড়তে তার মন্দ লাগে না অবশ্য। সূর্য এখন মাথার ওপর প্রায়। রোদের তাপে শরীর ঝলসে যাওয়ার উপক্রম সকলের। ইরারও একই দশা। গায়ের জামাটা জায়গায় জায়গায় ঘেমে ভিজে উঠেছে। কোমর বরাবর চুল গুচ্ছ উন্মুক্ত ভাবে বিচরণ করছে তার পৃষ্ঠদেশে। এই উন্মুক্ততা যেন দ্বিগুণ তেজ বাড়িয়ে দিয়েছে শরীরের। সকালে শাওয়ার নেওয়ার ফলে চুলগুলো ভেজা ছিল তাই তো ছেড়ে এসেছিল। কে জানতো এই খোলা চুলই তার গরমের কাল হবে।

যখনই একটা খালি রিকশাকে হাতের ইশারায় ইরা ডাক দিতে যাবে ঠিক তখনই কোত্থেকে এক সুবিশাল গাড়ি এসে তার সম্মুখে উপস্থিত হলো। ইরা ভ্রু কুঁচকে সেদিকে চাইল। মনে মনে রাগ হলো। এই গাড়িটার জন্যই তার এতো অপেক্ষায় পাওয়া রিকশা টা হাত ছাড়া হয়ে গেল। এখন এ দুপুরে রোদে কতক্ষণ দাড়িয়ে থাকতে হয় কে জানে? ইরার ভাবনার মাঝেই শোনা গেল এক স্নিগ্ধ কন্ঠ,

“এই যে ম্যাম এখানেই থাকা হবে নাকি গাড়ির দিকে অগ্রসর হবেন।”

ইরা চমকে উঠে সামনে থাকা সুদর্শন যুবকটির দিকে দৃষ্টি ভেড়ায়। মুহূর্তেই তার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যায় যেন। শরীরে মৃদু কম্পন সৃষ্টি হয়। মস্তিষ্ক শূন্য। রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবল গরম তরলের বিচরণ শুরু হয়। খুব সন্তপর্ণে সামলে নেয় সে নিজেকে। পিছু হটতে নিলেই শক্তপোক্ত একটি হাত তার এক হাত টেনে ধরে তাকে নিজের একদম নিকটে এনে ফেলে। ইরার চোখ জোড়া চিকচিক করছে। আপাততঃ দুই মানব মানবী এখন গভীর অনুভূতিতে ডুবে যেতে ব্যস্ত। এই অনুভূতি নয়নে-নয়নে, হৃদয়ে-হৃদয়ে, পুনর্মিলনে।

“কেমন আছো?”

“যেমন রেখে গেছেন তেমন।”

“তুমিই তো চাইতে যেন আমি দুরে চলে যাই।”

“মুখের কথা আর মনের কথা কী এক? যদি বিশ্বাস করবেন তবে আবার কেন ফিরে আসা? বারংবার কষ্ট দেওয়ার মধ্যে কী পৈশাচিক আনন্দ নিহিত?”

নিহান মুচকি হাসে। দু-হাতে আবদ্ধ করে নেয় ইরার ঘামার্থ মুখশ্রী। খুব সন্তপর্ণে চুমু এঁকে দেয় ললাটে। অতঃপর দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলিয়ে বলে,

“পুরোপুরি আপন করে নিতেই তো হারিয়ে গিয়েছিলাম। যাতে করে আর কেউ কখনো হারানোর সুযোগ না পাই। না তুমি আর না আমি।”

“ভীষণ কষ্ট দিয়েছেন। একটা নয় দুটো নয় চার চারটা বছর।”

“ভালবাসা দিয়ে সব পুষিয়ে দিবো।”

ইরা মুহূর্তেই লজ্জা পেয়ে যায়। নিহানের দৃষ্টি থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। নিহান মুচকি হাসে। তার লজ্জাবতীকে কতদিন পর দেখছে। এ দেখার যেন কোনো শেষ নেই।

———————

চলবে,
সাদিয়া আফরিন নিশি

#কাঁচের_গায়ে_বৃষ্টি_ফোঁটা💦 (দ্বিতীয় পরিচ্ছদ)
–(পর্ব-৬)

————–
ইরার চোখে মুখে আজ প্রবল খুশির ঝিলিক। মেয়েটাকে আজ একটু বেশিই প্রাণবন্ত লাগছে। অহেতুক মিটিমিটি হাসছে। গুনগুনিয়ে গাইছে। ইহান মনে মনে খুশি হয়। সে জানে ইরার এই খুশির কারণ। নিহান ইরার কাছে যাওয়ার আগে ইহানের সঙ্গে মিট করে গেছে। ইহানই নিহানকে ইরার অবস্থান বলে দিয়েছিল। নিহান যাবে বলে ইহান আর গাড়ি পাঠায়নি। নয়তো তার আদরের বোনের জন্য কখন গাড়ি পাঠিয়ে দিতো। ইহান স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। যাক, অবশেষে একজন অন্তত সুখের মুখ দেখতে চলেছে!!

বরাবরের মতো অনিলা খানের ঘর থেকে ফোনে কথা বলার আওয়াজ ভেসে আসছে।সেই আওয়াজে আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে সারাবাড়ি পায়চারী করা ইরার পা অটোমেটিক বন্ধ হয়ে যায়। এটা নতুন নয় নিঝুম চলে যাওয়ার পর থেকেই সে এমনটা প্রায়শই লক্ষ করেছে। তার মা ঘরবন্দী হয়ে লুকিয়ে কার সঙ্গে যেন কথা বলে। সে এ বিষয়ে বারকয়েক জিজ্ঞাসাবাদ করেও লাভ হয়নি। অনিলা খান খুব সন্তপর্ণে বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। ইরা ভাবছে আর নয় আজকে সে আড়ি পাতবে মায়ের ঘরে। যদিও তা অন্যায় তবুও এভাবে আর কতদিন?তাদেরও তো অধিকার আছে তার মায়ের ব্যাপারে সবটা জানার।
খুব সন্তপর্ণে দরজায় কান লাগিয়ে দাড়িয়ে পরল ইরা। ঘরের মধ্যে থেকে ভেসে আসা অস্পষ্ট শব্দ গুলো এবার পুরোপুরি স্পষ্ট ভাবে ভেসে আসছে তার কর্ণে। কিন্তু ভেতর থেকে যা শোনা গেল তারজন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না সে। তার মা বারংবার “নিঝুম” নামটি ধরে সম্মোধন করছে। কথা গুলো এমন, ‘এই নিঝুম কী হলো থেমে গেলি কেন, এই নিঝুম জানিস ইহানটা না বড্ড বদলে গেছে, এই তুই এবার একেবারের জন্য আমার কাছে ফিরে আয় না মা।’
আরও অনেক অনেক কথা হচ্ছে তাদের মধ্যে। ইরার পক্ষে সেখানে দাড়ানো আর এক মুহূর্ত সম্ভব হলো না। সে ছুট্টে ইহানের রুমে চলে গেল। ইহান তখন সবেই বাহিরে বের হওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল। ইরা ইহানের সামনে এসে হাঁপিয়ে চলেছে অবিরত। ইহান সেদিকে একবার ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,

“কী হয়েছে এভাবে হাঁপাচ্ছিস কেন?”

ইরা কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে বলল,

“তো কী করবো। খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে তোমার সঙ্গে।”

“হ্যাঁ তো বলে ফেল। আমি একটু বেড়বো।”

“ভাইয়া বউমনি সত্যিই বেঁচে আছে। আমি মাকে বউমনির সঙ্গে ফোনে কথা বলতে শুনেছি।”

ইহান প্রথম কথাটা স্বাভাবিক নিলেও পরবর্তী কথাটি শুনে একটু থমকায়। তার মা সব জানে কিন্তু কীভাবে? এজন্যই ইহান প্রথম যেদিন নিঝুমের কথাটি তাকে বলে সে কোনো প্রতিক্রিয়া করে না।

“আরেহ ভাইয়া কী ভাবতে বসলে?”

“আচ্ছা কী কথা বলছিলো মা?”

অতঃপর ইরা সবকিছু খুলে বলল ইহানকে।

“আচ্ছা তুই যা এটা নিয়ে আমি পরে কথা বলবো মায়ের সঙ্গে।”

ইহান ইরাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে দ্রুত পায়ে বেড়িয়ে যায়। আর ইরা ভাবতে থাকে, এতো তরতাজা খবর পেয়েও ইহান কীভাবে এতটা স্বাভাবিক? ইহান বাড়িতে ফিরলে অবশ্যই এ বিষয়ে তাকে চেপে ধরবে ইরা।

——————
পার্কের বেঞ্চিতে হাস্যজ্জল মুখে বসে আছে সোনালি। তার থেকে কিছু টা দুরত্বে তুশী বাচ্চাদের সঙ্গে খেলায় মেতে আছে। সোনালী সেদিকে তাকিয়েই হাসছে। তুশীকে অন্যান্য বাচ্চাদের সঙ্গে এতটা খুশি দেখে তারও খুব ভালো লাগছে। অকস্মাৎ এক পুরুষালি কন্ঠস্বরে ঘোর কাটে তার।

“এই যে মিস হাসলে কিন্তু আপনাকে দারুণ লাগে।”

সোনালী ভীষণ রেগে গেলো। এটা তো সেদিনের সেই ছেলেটা। তেজস্বী কন্ঠে উত্তর দেয় সে,

“কী চাই?”

“আপনাকে”

“ফ্লার্ট করছেন?”

“উহুম সত্য বলছি।”

“জানেন আমি কে?”

“না বললে কী করে জানবো।”

“আমার ভাইয়া সমর্পণ চৌধুরী একজন সিনিয়র আর্মি অফিসার। আর আমি তারই একমাত্র বোন সোনালী চৌধুরী। সো বুঝতেই পারছেন আমার সঙ্গে ফ্লার্ট করার শা’স্তি কতটা ভ’য়ংক’র হতে পারে।”

“এতকিছু ভাবার মতো সময় হয়নি ম্যাডাম। আর ভাবতেও চাই না।”

“না ভাবতে চাইলেও ভাবুন নয়তো পরবর্তীতে আমাকে বিরক্ত করলে একদম গারদে ভরে দেবো।”

সোনালী ধপ করে উঠে যায়। এক পলক ইশানের দিকে তাকিয়ে হনহনিয়ে তুশীর কাছে যায়। তুশীর হাত ধরে টানতে টানতে চলে যায় পার্ক থেকে। তার এতো সুন্দর মুড টার ফালুদা বানিয়ে দিল ওই অসভ্য ছেলেটা। চারপাশটা এখন একদম অসহ্য লাগছে।

এদিকে ইশান! সে তো নিজের ধ্যানে মত্ত। “সোনালী” নামটি আপনমনে বারংবার আওড়িয়ে চলেছে। আশেপাশের কিছুতেই যেন ধ্যান নেই।

———————
তীব্র চিৎকারের শব্দে অসহ্য লাগছে নিহানের। মারিয়া এসেছে তার ফ্ল্যাটে। আদরের ছোট ভাই বাড়ি ছেড়ে অনত্র থাকবে এটা মেনে নিতে পারছে না সে। তবে এই সহজ কথাটি যেখানে শান্তশিষ্ট, সুশৃঙ্খল ভাবে উপস্থাপন করা যেত সেখানে সে তৈরি করছে বিশৃঙ্খলা। এটাই তাদের কালচার। চিৎকার, চেঁচামেচিতেই অভ্যস্ত তারা। এদিকে নিহান একপ্রকার বাধ্য হয়ে বোনের এমন ব্যবহার গলাধঃকরণ করে চলেছে। নেহাৎই বড় বোন তার ওপর নিহানকে অনেক স্নেহ করে তাই নয়তো এর উচিত জবাব সে অনেক আগেই মারিয়াকে দিয়ে দিত। পরিশেষে ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলে নিহান মুখ খুলে,

“আপু তুমি এমন কেন করছ? তোমাদের ওই নরক পুরীতে থাকার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার নেই সো এসব নিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি না করে ভদ্র ভাবে বসো।”

মারিয়া ভাইয়ের দিকে অবাক হয়ে চেয়ে রইল। অবিশ্বাস কন্ঠে বলল,

“তুই, তুই বলছিস আমাকে এসব কথা? তুই আমার নিহান তো? নাকি বিদেশে গিয়ে পাখনা গজিয়ে গেছে তাই আপুকে যা তা বলছিস?”

“আপু তুমি ভুল বুঝছ তেমন কিছুই নয়। আমি শুধু বোঝাতে চাইছি যে, আমাকে আমার মতো থাকতে দাও তোমরা। আমি নিজের মতো করে বাঁচতে চাই। হালাল পথে রোজগার করে জীবনযাপন করতে চাই। কোনো অসৎ পথের অর্থ আমার চাই না।”

“ওহ তাই বুঝি। সারাজীবন খেয়ে, পড়ে, বড় হয়ে এখন তোর মনে হচ্ছে এসব অসৎ উপার্জন? তবে আরও আগে কেন বেড়িয়ে আসিস নি? নাকি এখন নিজের ভবিষ্যৎ গড়ে নিয়ে সরে যেতে চাইছিস?”

“আপু প্লিজ! স্টপ টকিং ইউর ননসেন্স।”

“তুমি খুব ভালো ভাবেই জানো আমি কেন এমনটা চাইছি।আই নিড হার।”

“ওহ আই সি! এজন্যই তুই এমনটা করছিস। ওই মেয়েটার জন্য। ওই ফালতু মেয়েটার জন্য। তুই কী করে পারছিস ভাই?”

নিহান এতক্ষণ খুব করে ধৈর্য ধরে ছিলো কিন্তু আর পারল না। খুব করে তর্কাতর্কি চলল দু ভাই – বোনের মধ্যে। এক পর্যায়ে মারিয়া নিহানের গালে স্বজোরে চড় বসিয়ে দিয়ে রেগেমেগে বেরিয়ে গেল। নিহান কিছু বলল না শুধু দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। তার খুব মায়ানকে দেখতে ইচ্ছে করছে কিন্তু উপায় নেই। বড় ভাই তার ওপর আরও তিনগুণ বেশি রেগে আছে। সামনে পেলে খু’ন করে দেবে।

——————–
মারিয়া বর্তমানে কেমন অনুভূতি শূন্য। দিকবিদিকশুন্য। চতুর্দিকে কী হচ্ছে না হচ্ছে সেসব তার মাথায় নেই। তার আদরের ভাইটি তার কথা অমান্য করেছে, তার সঙ্গে তর্কে লিপ্ত হয়েছে, বেয়াদবি করেছে এটাই চরম ভাবে তার মস্তিষ্কে হানা দিচ্ছে। উত্তেজনায় গাড়ি টানছে হাই লেভেলে। অতর্কিতে ঘটে গেল এক অনাকাঙ্খিত ঘটনা। অসাবধানতায় তার গাড়ি গিয়ে পড়ল অন্য একটি গাড়ির সম্মুখভাগে। কোনো রকমে এক্সিডেন্ট হতে হতে বেঁচে যায়। অবশ্য এক্সিডেন্ট না হওয়ার সম্পূর্ণ ক্রেডিটই বিপক্ষীয় গাড়িটির। মাথা চেপে ধরে গাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসে মারিয়া। প্রচুন্ড মাথা জ্বালা করছে তার। ইদানীং বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়লে এমনটা হয়। অকস্মাৎ চোখ তুলে ওপরে তাকাতেই সামনে ভেসে ওঠে দুটি সুপরিচিত মুখ। মুহূর্তেই ভ্রু কুঁচকে ফেলে সে। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যায় তাদের সম্মুখে। ইহান বুকে হাত গুজে দাড়ায়। মারিয়া কোনো রকম ভঙ্গিমা ছাড়াই বলে,

“এখনো বেঁচে আছে দেখছি।”

ইহান কিছু বলার আগেই নিঝুম কথা টেনে নিয়ে বলে,

“কৈ মাছের জান এত সহজে হজম হবে না।”

মারিয়া দাঁতে দাঁত চেপে ধরে। ক্রোধিত কন্ঠে বলে,

“হবে হবে সময় হলে সব হবে।”

নিঝুম তাচ্ছিল্য হাসে। বলে,

“অপেক্ষায় থাকলাম।”

ইহান এদের মধ্যে নিরব দর্শনের ন্যায় পরিদর্শন করছে। মারিয়া রেগেমেগে চলে গেছে। যাওয়ার আগে নিঝুম তাকে সতর্ক বার্তা সরূপ বলে দিয়েছে সাবধানে গাড়ি চালাতে। এটা শুনে সে যেন দ্বিগুণ তেলে বেগুনে জ্বলে উঠেছে। ফলস্বরূপ আরও হাই স্পিডে গাড়ী টেনে চলে গেছে। এত কিছুর মধ্যে দিয়ে ইহান এতটুকু খুব ভালো ভাবেই বুঝেছে যে, তার ঝুম আর আগের মতো দুর্বল নেই। নিজের প্রটেক্ট এখন সে নিজেই করতে পারে। সত্যিই জীবন মানুষকে অনেক কিছু শিক্ষা দেয়। ভেঙেচুরে নতুন করে গড়তে শেখায়।

———————

চলবে,
লেখনিতে – সাদিয়া আফরিন নিশি