কাগজের তুমি আমি পর্ব-১২

0
2789

#কাগজের_তুমি_আমি
#দ্বিতীয়_অধ্যায়
#১২তম_পর্ব

হঠাৎ একটি ছবি কাপড়ের ভেতর থেকে নিচে পড়ে যায়। ছবিটা হাতে নিয়ে পাল্টালে দেখে একটি হাস্যোজ্জ্বল চেহারা। মুখে চাঁদের মতো উজ্জ্বল হাসি। হরিণা চোখের শ্যামবর্ণের মেয়েটির কি মায়াবী না চেহারা! এই মায়াবী চেহেরায় যে কেনো নিজেকে ভাসিয়ে দিবে। ছবিটি বেশ যত্ন করে কাগজের ভাজে রাখা। ছবিটির নিচে একটি ডেট দেখা যাচ্ছ তাহলো ০৮.০৯.২০১৪. কে এই মেয়েটি? যার ছবি এতোটা যত্ন করে দেখে দিয়েছে অনল। বোঝাই যাচ্ছে মেয়েটির সাথে তার সম্পর্কটা খুব কাছের। কিন্তু মেয়েটি কে এবং সম্পর্কটা কি তাদের এটাই বুঝে উঠতে পারছে না।
– তোকে আমি বলছিলাম মায়ের ঘরে থাকতে? এখন তো কোন মেহমান নেই তাহলে আমার ঘরে কি করছিস?

শক্ত কন্ঠে অনলের বলা কথাটা কানে আসতেই পেছনে ফিরে তাকায় ধারা। ধারার হাতে ছবিটা দেখতেই চট করে মেজাজ হয়ে যায় অনলের। ধীরে ধীরে চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো তার। সাধারণ মুখটায় একটা হিংস্রতায় ভরে উঠলো। অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে দাঁতে দাঁত চেপে থমথমে কন্ঠে বলে,
– আমার আলমারিতে হাত দিয়েছিলি?

হঠাৎ করেই এক ঝাক ভয় মনে এসে ভিড়লো ধারার। অনলের খিটখিটে মেজাজ এবং ঠেস মেরে কথা বলার সাথে আগ থেকে পরিচিত হলেও কেনো জানে এই মূহুর্তে সামনে থাকা মানুষটি একদম ই অচেনা লাগছে ধারার কাছে। আমতা আমতা করে কিছু বলতে যাবে তার আগেই ক্ষিপ্র গতিতে তার কাছে এসে খপ করে ছবিটা হাত থেকে ছিনিয়ে নেয় অনল। ধারা উপায়ন্তর না দেখে বলতে লাগে,
– আ…আসলে
– তোর সাহস কি করে হলো আমার জিনিসে হাত দেওয়ার? আমি তোকে পারমিশন দিয়েছি তোকে?
– না, আ…আমি
– তুই কি? লজ্জা লাগে না তোর? এক মিনিট, এক মিনিট। তুই কি এতোদিন আমার ভালো ব্যাবহারের কারণে ভাবছিস আমি তোকে মেনে নিয়েছি? আমার নিজের স্ত্রী হিসেবে মন থেকে মেনে নিয়েছি আমি? তুই কি গাধা? একটু ভালো ব্যাবহার করলেই গলে যাস? কি ভেবেছিস এই কদিন তোর সাথে একটু ভালো ব্যাবহার কি করেছি আমি তোকে ভালোবাসতে আরম্ভ করেছি? এতো সোজা ভালোবাসা? কান খুলে শুনে নে, তুই শুধু এবং শুধু আমার বাড়িতে আমার বউ হয়ে এসেছিস আমার মা চেয়েছে বলে। আমার মনে কোনোদিন তোর কোনো জায়গা এক মূহুর্তের জন্য ও তৈরি হয় নি। আর কোনোদিন তৈরি ও হবে না।
-…….
– সেদিন তোর বাবা-মার সামনে বড় গলায় তোকে নিজের বউ আর তোর বাচ্চাটাকে নিজের বাচ্চা বলে দাবী করেছি বলে তুই তো দেখি আকাশে উড়ছিস। কি ভেবেছিস আমি তোকে ভালোবাসতে লেগেছে। তোর সত্যি বুদ্ধিজ্ঞানটাও নেই। তোর মত মেয়েকে আমি ভালোবাসতে পারি আদৌ? সেটাকি মানাবে? এখন ই বেড়িয়ে যা আমার রুপ থেকে। নিজের জায়গাটা ভুলে যাস না। তুই মায়ের জন্য এ বাড়ির বউ হতে পারিস। আমার জন্য শুধুমাত্র একজন আশ্রিতা।

অনলের কথা শেষ হবার আগেই মাথা নিচু করে রুম থেকে বেড়িয়ে আসলো ধারা। আর এক মূহুর্ত সেই রুমে থাকাটা তার পক্ষে সম্ভব ছিলো। অনলের কথাগুলো মোটেই ভুল নয়, এটা বারবার মানতে চেয়ে নিজেকে বুঝাচ্ছে ধারা। কিন্তু তবু ও মনে হচ্ছে বুকে যেনো রক্তক্ষরণ হচ্ছে। চোখ গুলো ভিজে আসছে। সত্যি সে বেহায়া কেনো যেচে সেই কাজগুলো করতে গিয়েছিলো। অনলের প্রতিটি শব্দ বিষধার তীরের মতো ধারার হৃদয়কে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে। অবশ্য এটাই তো প্রাপ্য ছিলো তার। তাহলে কেনো এতো খারাপ লাগছে। সে নিজেও জানে না। খুব খারাপ লাগছে শরীরটা যেনো চলতেই চাচ্ছে না। ফুপুর রুমে এসেই গা এলিয়ে দেয় সে। চোখের অশ্রুতে কখন যে ঘুমিয়ে যায় নিজেও জানে না।

ধারা রুম থেকে চলে যাবার পর হুশ আছে অনলের। রাগের মাথায় মাত্রাছাড়া কথা বলে ফেলেছে সে। হয়তো এতো কড়া কথা না বললেও হতো তার। পাশ ফিরতেই দেখলো খাটের উপর কাপড় বের করা। ধারা হয়তো তার হাসপাতালের যাবার জন্য কাপড় করে দিচ্ছিলো। ছবিটা হয়তো কাপড়ের ভেতর থেকেই বেরিয়ে যায় এসেছে। এই সামান্য কাজের জন্য না জানি কতগুলো কথা শুনিয়ে দিলো তাকে অনল। এতোগুলো কথা কথা বলার কি আদৌ দরকার ছিলো নাকি সেটা উচিত ছিলো। এই রাগটা অনলের বড্ডবেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। কোনোভাবেই আটকাতে পারছে না। সজোরে আলমারিতে আঘাত করে খাটে বসে পড়লো সে। নিজের উপর ধিক্কার হচ্ছে। মেয়েটাকে না জানি কতোটা বেশি কথা শুনিয়ে দিলো সে। অনন্যার ছবিটার দিকে তাকিয়ে ভাঙাস্বরে বলতে লাগলো,
– ভুল করে ফেলেছি অনন্যা, ভুলটা বেশি হয়ে গিয়েছে। ধারাকে বিনা দোষে এতোগুলো কথা বলাটা একদম উচিত হয় নি। কি করবো বলো, ধীরে ধীরে ওর প্রতি দূর্বল হয়ে পড়ছিলাম। আর কালকের সেই একই ঘটনা আমার চোখের সামনে আবারো ঘটায় আমি যেনো নিজের মাঝেই ছিলাম না। নিজের অপারগতার সকাল রাগ ধারার উপর ঝেড়ে দিয়েছি। বিশাল বড় ভুল হয়ে গেছে। ওকে আশ্রিতা অবধি বলে দিয়েছি। কিভাবে ওর সামনে দাঁড়াবো অনন্যা। কিভাবে!!

রাত ১০টা,
সারাদিনের খাটাখাটুনির পর বাসায় এসেছে অনল। সারাদিনে একটা কথাই তাকে কুড়ে কুড়ে খেয়েছে, ধারার কাছে ক্ষমা কোন মুখে চাবে। বাসায় কলিংবেল দিতেই সুভাসিনী বেগম দরজা খুলেন। অনল ভেবেছিলো ধারা দরজা খুলবে। কিন্তু সুভাসিনী বেগম দরজা খোলায় তার মনটা একটু খারাপ হয়ে যায়। সুভাসিনী বেগম তাকে দেখেই বলেন,
– ফ্রেশ হয়ে আসো আমি খাবার দিচ্ছি।
– মা
– কি হয়েছে?

আশেপাশে ভালোভাবে দেখে সে বলে,
– ধারা কোথায়?
– সেটা কি তোমার জানার দরকার আছে?

সুভাসিনী বেগমের কাটকাট কথায় বুঝতে বাকি রইলো না তিনি সব জেনে গেছেন। ধারা কি তাকে বলে দিয়েছে। কিন্তু সে তো এমন মেয়ে না, হাজারো আঘাত করলেও টু শব্দ করে না মেয়েটা। তাহলে!
– ধারা আমাকে কিছুই বলে নি, কিন্তু আমার কান নামক একটা জিনিস আছে। যা দিয়ে আমি বেশ ভালো করেই শুনতে পাই। আর তুমি যখন তাকে চেঁচিয়ে আশ্রিতা বলছিলে আমি খুব ভালো করেই শুনেছি। যাক গে যাও ফ্রেশ হয়ে নাও।

সুভাসিনী বেগমের কড়া কথায় বেশ বড় সড় ঢোক গিয়ে অনল বলে,
– মা, ধারা কি খেয়েছে?
– হুম, সে এখন ঘুমাচ্ছে। ওর শরীরটা ভালো নেই। জ্বর এসেছে। আমি ঔষধ দিয়েছি। সো তোমার ওকে নিয়ে চিন্তা করার প্রয়োজন নেই।

বলেই সুভাসিনী বেগম রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন। অনলের নিজের মাঝে একটা গ্লানি অনুভব করছে। সে চাইলেও তার ধারে কাছেও ভিড়তে পারবে না। কারণ এখন সুভাসিনী বেগম আছেন। আর তিনি কতটা কড়া ব্যাপারবগুলো অনলের খুব ভালো করেই জানা আছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের রুমের দিকে হাটা দেয় অনল।

এক মাস পর,
ডাইনিং টেবিলে মুখোমুখি বসে আছে অনল-ধারা। এই এক মাসে ধারা যতটা পেরেছে অনলের কাছ থেকে দূরত্ব রাখার চেষ্টা করেছে। অনল কোনোভাবেই সেদিনের পর থেকে ধারার সাথে কথা বলতে পারে নি। ধারা সেই সুযোগটাই দেয় নি। সামনাসামনি বসা অবস্থায় ধারা একটা কথা ও বলছে না অনলের সাথে। মাথা নিচু করে কোনোভাবে খাওয়াটা সারছে। অপরদিকে অনল বারংবার ধারার আশেপাশে ভিড়তে চাইছে। কোথাও না কোথাও ফাকা ফাকা লাগছে। ধারার সাথে খুনসুটি গুলো বেশ মনে পড়ছে তার।
– আজ ধারার চেকাপ, অনল তুমি ওকে নিয়ে হাসপাতালে যাও।
– না না, ফুপি অনল ভাইয়ের যাবার প্রয়োজন নেই আমি একাই পারবো

সুভাসিনী বেগমের কথা শোনা মাত্র ধারা তাতে ভেটু দেয়। ধারা কথাটা বলামাত্রই অনল বলে উঠে,
– মা, পনেরো মিনিটের মধ্যে ওকে রেডি হতে বলো। আমার ডিউটি আছে, ওকে চেকাপ করিয়ে দেন আমি যাবো।

বলেই গটগট করে নিজের রুমে চলে যায় অনল। অগত্যা আর কথা বাড়াতে পারলো না ধারা।

রেডি হয়ে যখন বাসা থেকে বের হলো অনল তখন সি.এন.জি ডাকতে ব্যস্ত। ধারাকে আসতে দেখেই সে থেমে গেলো। এগিয়ে এসে কিছু বলতে নিলেই ধারা নিচুস্বরে বললো,
– আমি একাই যেতে পারবো অনল ভাই, কষ্ট করে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। ফুপি জানবেন ও না

কথাটা শুনেই অনলের মুখটা ছোট হয়ে গেলো। ঠান্ডা গলায় বললো,
– তুই কি আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছিস?
– এড়িয়ে যাবো কেনো? এখানে এড়িয়ে যাবার কিছুই নেই। সত্যি বলতে, আমি চাই না তোমার উপর বোঝা হয়ে থাকতে। সত্যি নিজের জায়গা ভুলতে বসেছিলাম। একটু ভালো ব্যাবহার করেছো তাই ভাবতে লেগেছিলাম… যাক গে, একজন আশ্রিতাকে তুমি আশ্রয় দিয়েছো, আমার বাচ্চাকে বাঁচিয়েছো। তাকে নিজের নাম দিয়েছো। সেই উছিলায় তোমার ঘাড়ে চেপে বসাটা আমার উচিত হবে না। তুমি যা করেছো এর চেয়ে বেশি কিছু তোমার কাছে চাওয়াটা উচিত নয়। এতোটা লোভী হওয়াটা আমার উচিত হয় নি। তাই আশ্রিতা হয়ে তোমার উপর আমি বা আমার বাচ্চা বোঝা হতে চাই না।

ধারার প্রতিটা কথা চুপ করে শুনেছে অনল। ধারা কথাগুলো বলে এগিয়ে যেতে নিলে……

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি