কাগজের তুমি আমি পর্ব-১৮

0
2970

#কাগজের_তুমি_আমি
#দ্বিতীয়_অধ্যায়
#১৮তম_পর্ব

হঠাৎ কলিংবেলের শব্দ কানে আসায় ধারা দরজাটা খুলতে যায়। দরজাটা খুলতেই দেখে একজন মধ্যবয়স্কা মহিলা এবং একজন মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এদের কাউকেই ধারা চিনে না। অবাক নয়নে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকলে মহিলাটা বেশ খাকারি গলায় বলে উঠেন,
– এটা অনলদের বাসা না?
– জ্বী, আপনারা
– তুমি কে? ভাবী কোথায়?

ধারা কিছু বলে উঠার আগেই সুভাসিনী বেগমের কথা ধারার কানে আসলো,
– কে এসেছে রে ধারা?

ধারার সময় লাগছে দেখে সুভাসিনী বেগম নিজেই উঠে আসলেন। সুভাসিনী বেগমকে দেখেই মহিলাটা বেশ গদগদ হয়ে বললেন,
– ভাবী কেমন আছো গো? কতদিন পরে তোমাকে দেখছি বলো!

বলেই ধারাকে এড়িয়ে ঘরে ঢুকে পড়লেন ভদ্রমহিলা এবং মেয়েটি। সুভাসিনী বেগম ও বেশ অবাক হলেন, যেনো উনি এদের মোটেই আশা করেন নি। অবাক কন্ঠেই জিজ্ঞেস করলেন,
– সুমনা তুমি হঠাৎ?
– কেনো গো ভাবী আসতে পারি না বুঝি?
– না না সেটা না, আসলে না ফোন না কিছু। তাই অবাক হলাম আর কি। আসো আসো।
– আসলে কি বলো তো ভাবী, অনলের বিয়েতে তো আমি আসতে পারি নি। এখানেও একটা কাজ ছিলো তাই ভাবলাম এক কাজে দুইটা হয়ে যাবে। তা অনলের বউ কোথায় ভাবী?

মহিলা বসতে বসতে কথাগুলো বললেন। সুভাসিনী বেগম মুচকি হাসি হেসে ধারাকে ইশারা করেন। উচ্ছ্বাসিত মনে বলে উঠেন,
– এইতো তোমার অনলের বউ, ধারা। ধারা, ও সুমনা, সম্পর্কে তোর ফুপু শ্বাশুড়ি আর ও হচ্ছে মহুয়া। মহুয়া তোর থেকে বয়সে বড় কিন্তু অনলের থেকে ছোট।
– আসসালামু আলাইকুম।

ধারা খুব ভদ্র ভাবেই সুমনাকে মুখে সালাম দেয়। পায়ে ধরে সালাম করা ব্যাপারটা একেবারেই ধারার পছন্দ নয় উপরে পেটটা বড় হবার কারণে ঝুকতেও পারবে না। তাই মুখেই সালামটা দিলো সে। সুমনা বেগমের মুখ দেখে মনে হচ্ছে ব্যাপারটা যেনো তার একেবারেই পছন্দ হয় নি। ভ্রু কুচকে পা থেকে মাথা অবধি নজর তাক করে নিলেন তিনি। ধারার বড় পেটটাই যেনো তাকে বেশি অবাক করছেন। ধারার খানিকটা অস্বস্তি হতে লাগলো। সুভাসিনী বেগম ও ব্যাপারটা লক্ষ্য করলেন। তাই ধীর কন্ঠে বললেন,
– আসলে এই সময়ে ঝুকাটা ঠিক হবে না তো তাই।
– আমি যত দূর জানি বিয়ের ছয় মাস হইছে মাত্র। এখনই বউ মা পোহাতি হয়ে গেলো, একটু তাড়াতাড়ি হয়ে গেলো না ভাবী?

উনার কথায় বেশ লজ্জা পেয়ে যায় ধারা। মাথাটা অটোমেটিক নিচু হয়ে আসে। সুভাসিনী বেগম ও সুমনা বেগমের এমন হুট করে করা প্রশ্নে কি বলবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। ঠিক তখনই পকেটে হাত গুজে মুখে হাসি হাসি ভাব নিয়েই অনল বলে উঠে,
– ফুপ্পি, তোমাদের সমস্যাটা ঠিক কোথায় বলোতো? এখন ধারা যদি প্রেগন্যান্ট না হতো তখন জিজ্ঞেস করতে ছয় মাস হয়ে এসেছে খুশির খবর কবে শুনাবে? এখন যখন দেখছো ও প্রেগন্যান্ট, তো কোথায় একটু দোয়া তোয়া করবে। তা না জিজ্ঞেস করছো একটু তারাহুড়ো হয়ে গেলো না। এখন আমরা নবদম্পতি যাবো তো যাবো কই? আর এমনেও আমার তো হবয়স হচ্ছে তাই না, এখন বুড়ো বয়সে ট্যাম নিয়ে ঘুরার ইচ্ছে আমার নেই। যৌবন থাকতে থাকতেই বাচ্চার বাবা হতে চাই। ফুফার মতো চুলে পাক ধরার পর বাচ্চার বাবা হলে দেখা যাবে বাবা কম নানা বেশী লাগবে আমাকে। নো নো সেই রিস্ক আমি নিতে পারবো না। তাই আর কি এই তাড়াহুড়ো।

অনলের হাসিমুখের কথাগুলো শুনে বেচারি সুমনা বেগমের যেনো মুখটা খানিকটা ছোট হয়ে গেলো। মহুয়া যখন হয়েছিলো তখন শফিক সাহেবের প্রায় চুল পেকে গিয়েছিলো। অনল সেটার খোচাটাই দিয়েছে সমনা বেগমকে। সুমনা বেগমের স্বভাব সম্পর্কে খুব ভালো করেই জানা আছে অনলের। রুম থেকে বের হতেই যখন দেখলো সুমনা বেগম সকাল সকাল এসে টপকেছেন তখন ই ড্রয়িং রুমের দিকে এসে হাজির হয় সে। ধারার অনলের কথা শুনে বেশ হাসি পেলো। কিন্তু ফুপু শ্বাশুড়ির সামনে নতুন বউ খিক খিক করে হাসছে ব্যাপারটা খারাপ তো খারাপ মহা খারাপের পর্যায়ে পড়বে। ঠোটে ঠোট চেপে নিজের হাসিটা আটকে রাখলো সে। অনল এবার বেশ কড়া করেই ধারাকে বলে উঠে,
– এই তোর আক্কেল নাই?
– কেনো আমি কি করলাম?
– খাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে মনে আছে? এখানে দাঁড়ায় থাকলে কি খাবার গুলো উড়ে উড়ে পেটে ঢুকবে। চল খেতে যাবি। ফুপি তুমি বসো, আমি পিচ্চিটাকে নিয়ে যাচ্ছি। আসলে ওর টাইম টু টাইম ঔষধের ব্যাপার আছে তো।

বলেই ধারার হাত ধরে টেনে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসালো। ধারা শুধু আড় চোখে সুমনা বেগমকে দেখে যাচ্ছে। মহিলা বেশ তীক্ষ্ণ নজরে ধারা আর অনলকে দেখে যাচ্ছেন। অনল সেদিকে তোয়াক্কা না করে নিজ হাতে সব কিছু ধারাকে বেড়ে দিচ্ছে। সুমনা বেগম এবার সুভাসিনী বেগমকে বলতে শুরু করলেন,
– ভাবী একটা কথা বলি কিছু মনে করো না। ছেলেটা একটু বেশী বউ ঘেষা হয়ে উঠেছে তোমার। এখন তো বুঝতেছো না পরে ঠিক ই বুঝবে।

সুমনার বেগমের কথায় সুভাসিনী বেগম বেশ চটে উঠলেন। বেশ থমথমে গলায় বলে উঠলেন,
– এসব কি কথা সুমনা? ধারার এখন শরীরের যা অবস্থা তাতে তোমার মনে হয় না অনলের তাকে বেশী প্রয়োজন। আর স্বামী স্ত্রীর ব্যাপারটায় বউ ঘেষা ব্যাপারটা আসছে কোথায়?
– আসলে তোমার ভাইয়ের মেয়ে তো তাই তুমি দেখেও না দেখার ভান করছো। অনলের মতি গতি কিন্তু ভালো না বলে দিচ্ছি।
– তাও ভালো বউ ঘেষা হয়েছি, তোমার ভাইয়ের মতো অন্য মেয়ে ঘেষা তো হই নি। এটাই ভালো না ফুপ্পি।

সুমনা বেগমের কথা কানে যেতেই হাসি মুখে কথাটা বলে উঠলো অনল। এবার অনলের কথাটা যেনো সুমনা বেগমের একটু বেশি আতে লাগলো। কিছু বলতে যাবেন তার আগেই সুভাসিনী বেগম বলে উঠলেন,
– এতো দূর ট্রাভেল করে এসেছো। আসো আমার রুমে রেস্ট নিবে চলো। মহুয়া আয় তো সোনা মামী মার সাথে।

সুভাসিনী বেগমের কথায় আর কিছুই বলতে পারলেন না সুমনা বেগম। সুমনা বেগম মনোক্ষুন্ন হয়ে উঠে সুভাসিনী বেগমের সাথে গেলেন। ধারার মনে হলো মানুষটি তাকে একেবারেই পছন্দ করেন নি। বেশ ভাবনায় পড়ে গেলো সে। সত্যি বলতে অনলের সাথে বিয়ের পর থেকে একবার ও এই বাড়িকে শ্বশুর বাড়ি বলে মনে হয় নি। বরং নিজের বাড়ি ই লেগেছে। কিন্তু সুমনা বেগমের আসার পর থেকে মনে হচ্ছে এবার একটু মেপে চলতে হবে।
– এতো চিন্তা করতে হবে না। যার তোকে ভালো লাগে না তাকে তো আর জোর করে ভালো লাগাতে পারবি না

অনলের কথায় চিন্তায় ছেদ পরে ধারায়। পাশ ফিরে তাকালে দেখে লোকটা নিজ মনে খেয়েই যাচ্ছে। তার সুমনা বেগম কে নিয়ে কোনো মাথা ব্যাথাই নেই। ধারা খাবার মুখে দিতে দিতে বললো,
– চেষ্টা তো করতেই পারি তাই না?
– লাভ নেই, আমার ফুপ্পিটা একটু এমন ই। তাই বলছি অহেতুক কিছু করতে যাস না। তুই তো আর তার বাড়ির বউ না। আসছে কদিনের জন্য, চুপচাপ থাক। সময় হলে চলে যাবে।
– আচ্ছা তুমি সবসময় কিভাবে আমার মনের কথা জেনে যাও?

ধারার প্রশ্নে মুচকি হাসি হেসে তার গালটা টেনে দিয়ে অনল বলে,
– বয়স তো আর এমনি এমনি হয় নি। যাক গে, রুমে চল ঔষধ আছে। আর ফলগুলো খাস নি কেনো, আমি খাবো নাকি ফল? তোর এসব কারণে আমার প্রিন্সেসটা এতো দূর্বল হয়ে যাচ্ছে। এখনো কিক অবধি করেনি, খা বলছি।
– আর খেতে পারছি না, আমি তো রাক্ষস না।

পরমূহুর্তেই অনলের অগ্নিদৃষ্টিতে চুপ হয়ে গেলো ধারা। লোকটা কথায় কথায় হুংকার ছাড়ে। ভয় লাগে কিন্তু আবার ভালো লাগে। লোকটাকে আজকাল খুব ভালো লাগে ধারার। ইচ্ছে করে সারাটাদিন শুধু দেখতে। প্রতিনিয়ত মানুষটাকে দেখলে প্রেম প্রেম পায়। কিন্তু মুখে কিছুই বলে উঠতে পারে না সে। ভয় হয়, বলা তো যায় না। ধুম ধাম করে মেরে বসে যদি। অনলের কোনো ভরসা নেই। তার হুংকার শুনলেই ভালোলাগা গুলো গলাতেই আটকে যায় ধারার_______

রাত ১০টা,
নিজের ঘরে ঢুকতেই দেখে ধারা বিছানা করছে। ধারা সুভাসিনী বেগমের সাথে থাকতো। কিন্তু হুট করে নিজের রুমে দেখে বেশ হতবাক হয় সে। অবাক হয়েই ধারাকে প্রশ্ন করে বসে সে,
– তুই এই রুমে?
– ও চলে এসেছো তুমি, আমি এখন থেকে কিছুদিন এই রুমেই থাকবো। আসলে ফুপ্পি মহুয়া ত মায়ের রুমে থাকছে। আর ঘরে তো শোবার রুম বেশি নেই প্লাস ফুপ্পি জানেন ও না আমি যে তোমার সাথে থাকি না। জানলে আরো কান্ড করবেন। এমনেই আমার সব কাজে কেনো যেন দোষ খুজেন। এটা জানলে ফুপুকে শুধুশুধু কথা শুনাবেন।

ধারার কথায় যথেষ্ট যুক্তি আছে। তাই অনল আর কোনো কথা বাড়ালো না। কোথাও কোথাও বেশ অস্বস্তি লাগছিলো অনলের। ধারার সাথে বিয়ের পর থেকে সেভাবে একই রুমে থাকা হয় না কি না। এখন আবার থাকতে হবে দেখে বেশ অস্বস্তি লাগছে অনলের। দীর্ঘশ্বাস ফেলে টাওয়াল আর কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো সে। বিছানাটা গুছিয়ে হেলান দিয়ে বই পড়তে লাগলো ধারা। আজকাল শরীরটা ভারী হয়ে গেছে। একটু চললেই বেশ কষ্ট হয়ে যায়। বাহিরের থেকে স্বাভাবিক থাকলেও কোথাও না কোথাও বুকটা টিপ টিপ করছে। অনলের সাথে একই রুমে থাকবে ব্যাপারটা তাকে খুব ভাবাচ্ছে। অনলের তো ঠিক নেই গতবারের মতো কিছু করলে! ওয়াশরুমের দরজার শব্দে স্বম্বিত ফিরে ধারার। পাশ ফিরে থাকালে দেখে অনল ফ্রেশ হয়ে বেরিয়েছে। হয়তো গোসল করেছে। চুল থেকে টপ টপ করে পানি পড়ছে, পরনে অলিভ কালারের টিশার্ট আর কালো থ্রি কোয়ার্টার। পা হাটু থেকে উম্মুক্ত বিধায় লোম গুলো দেখা যাচ্ছে। ধারা খেয়াল করলো তার বুকে যেনো কেউ ড্রামপিট বাজাচ্ছে। অনলের চোখে চোখে পড়তেই লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো সে, যেনো চোর ধরা পরেছে। এখন এই রুমে একেবারেই থাকতে পারবে না সে। তাই ধীর কন্ঠে বললো,
– তুমি খেতে আসো আমি ফুপির কাছে গেলাম

কথাটা বলে তড়িৎ গতিতে উঠতে গেলেই………

চলবে