কাগজের তুমি আমি পর্ব-২৩

0
2431

#কাগজের_তুমি_আমি
#দ্বিতীয়_অধ্যায়
#২৩তম_পর্ব

অনলের কথার আগা-মাথা কিছুই যেনো বুঝলো না ধারা। কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবে তখনই পেছন থেকে একটি কন্ঠ শুনে বেশ ভড়কে যায় ধারা।
– ধারা…

কন্ঠটি ছ মাস পরে শুনছে। পিছনে না ফিরেও খুব ভালোভাবেই মানুষটিকে চিনতে পারছে সে। হাসিমুখটা নিমিষেই পাথরের ন্যায় অনুভুতি শূন্য হয়ে গেলো। এই ভয়টা প্রতিটা সময় কুড়ে কুড়ে খেত তাকে। দিগন্তের মুখোমুখি হতে একেবারেই নারাজ ছিলো সে। অনলের দিকে কৌতুহলী দৃষ্টি তাক করতেই অনল বলে উঠলো,
– আমি বাইরে অপেক্ষা করছি। যদি বাড়ি ফিরার ইচ্ছে থাকে তো একটা ফোন দিস আর নাহলে আমি কাল ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দিবো।

অনলের কথাটা শুনে মাথায় যেনো বজ্রপাত হয় ধারা। নিমিষেই তার সুখগুলো যেনো কর্পুরের ন্যায় উবে যায়। অনলের কথায় এটুকু স্পষ্ট ধারা এ পথটা তার নিজেরই হাটতে হবে। আজ যে সিদ্ধান্তটা নিবে তার তার নিজেরই নিতে হবে। এতোদিন প্রতিটা লড়াই এ অনল তার ঢাল হয়ে ছিলো আজ সেই ঢালটাও তার সাথে নেই। ধারা অসহায় চোখে অনলের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে পেছনে ফিরলো ধারা। স্থির দৃষ্টিতে স্পষ্ট, জড়তাহীন গলায় বললো,
– কেমন আছো দিগন্ত? এতোদিন পর কি মনে করে?

ধারার কথাটা শুনে অনেকটাই অবাক হলো দিগন্ত। ছয় মাস আগের ধারার আর আজকের ধারার মাঝে যেনো রাত দিন পার্থক্য। এ ধারা যেনো তার ধরা ছোয়ার বাহিরে। একটু এগিয়ে এসে শান্ত গলায় বললো,
– তোমার কাছে বারে বারে কেনো আসি সে তো তোমার অজানা নয় ধারা।
– অবশ্যই অজানা, তোমার আমার মতো মেয়ের কাছে কি প্রয়োজন সেটাই আমি বুঝে উঠতে পারছি না।
– ধারা প্লিজ, এভাবে বলো না। মানছি আমি ভুল করেছি কিন্তু একটা সুযোগ কি আমাকে দেওয়া যায় না? আর তুমিও আমাকে বলো নি যে
– কি বলি নি দিগন্ত?

ভ্রু কুচকে ঝাঝালো কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো ধারা। দিগন্ত ও জোড় দিয়ে বললো,
– এই যে তুমি বাচ্চাটাকে নষ্ট করো নি
– আমি তো এটাও বলি নি যে আমি বাচ্চাটাকে নষ্ট করেছি। তুমি নিজেই সব মনে করে নিয়েছো। তুমি আমাকে একবার জিজ্ঞেস করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করো নি। এখন আমাকে দোষ দিচ্ছো প্রতিবারের মতো।

ধারার কথায় যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে। দিগন্ত একবার ও সত্য মিথ্যা যাচাই করার প্রয়োজনীয়তাবোধ করে নি তখন। শুধু ধারার নামে মিথ্যে আরোপ দিয়ে গিয়েছিলো। আজ নিজের কাজে নিজেই লজ্জিত দিগন্ত। মাথা নিচু করে বলে,
– আমাকে কি ক্ষমা করা যায় না ধারা। ভুল আমার ছিলো, তুমি যা শাস্তি দিবে আমি মেনে নিবো কিন্তু আমাকে আজ ফিরিয়ে দিও না ধারা। তোমাকে ছাড়া আমি যে শূন্য। এই ছয়টা মাস নিজের হৃদয়ের যন্ত্রণায় ভুগেছি আমি। তোমাকে বুঝিয়ে বলতে পারবো না কতোটা কষ্টের মাঝে ছিলাম। কত রাত জেগে কেটেছে তার হিসাব নেই। আমি তোমাকে ছাড়া একটা মূহুর্ত কল্পনা করতে পারি না ধারা। দম বন্ধ লাগে, প্লিজ একটা সুযোগ আমাকে দেও। এই বাচ্চাটা আমার, আমাকে আমার বাচ্চার কাছ থেকে দূর করো না। সেদিন যখন তোমাকে হাসপাতালে দেখেছিলাম সেদিন ই বুকের মাঝে অসংখ্য পাথর উঠে গিয়েছিলো। আমি তোমাকে বুঝাতে পারবো না আমার কতোটা কষ্ট হয়েছিলো যখন ভেবেছি তুমি শুধু বিয়ে করার জন্য আমার বাচ্চাটাকে মেরে ফেলেছো। যখন জানতে পারলাম আমার বাচ্চাটি সুস্থ রয়েছে কতো যে আনন্দ হয়েছে বুঝাতে পারবো না। প্লিজ একটা সুযোগ দাও ধারা। প্লিজ এই সামান্য কাগজের সম্পর্কটাকে আমাদের মাঝে দেয়াল হতে দিও না। প্লিজ

গলা ধরে এসেছে দিগন্তের। কথা বলতে বলতে হাটু গেড়ে বসে পড়ে সে। চোখ থেকে অনর্গল পানি পড়ছে। কেনো যেনো আজ তার কান্নায় কষ্ট হচ্ছে না, করুণা হচ্ছে কিন্তু কষ্ট হচ্ছে না। খুব স্বাভাবিকভাবেই বললো,
– তুমি কি আমাকে ভালোবাসো দিগন্ত?
– এভাবে কেনো বলছো ধারা?
– আমি তোমার অভ্যাস দিগন্ত ভালোবাসা নই। আমি তোমার জিদ, ভালোবাসা নয়। যদি ভালোবাসা হতাম তাহলে মূহুর্তেই পায়ে ঠেলে দিতে না আমায়। আমাকে বেশ্যা বলতেও তোমার মুখে বাধে নি। তুমি যদি আমাকে সত্যি ই ভালোবাসতে তাহলে কখনোই আমার চরিত্র নিয়ে বাজে কথা বলতে পারতে না দিগন্ত। আমি তোমার কেবল কামনা। তোমার খারাপটা আমার শুন্যতার জন্য লাগে নি, আমাকে অন্য কারোর সাথে দেখে লেগেছে। আমি তোমার কাছে একটা প্রাইজের মতো। ভালোবাসা এটাকে বলে না। ভালোবাসার মধ্যে কামনা থাকে না। আমাকে কখনো তুমি ভালোই বাসো নি। আমি তোমার চাহিদা ছিলাম। আর আমি ও কতো বোকা তোমার লালসাটাকে ভালোবাসা হিসেবে মেনেছি। আমি মেয়ে নামে কলংক। তুমি আমাকে ভালোবাসলে কখনো কলংকিত করতে না। তুমি কি জানো এই ছয়মাস কিভাবে কেটেছে। জানো না জানার ইচ্ছে ও তোমার নেই। যেদিন তুমি বলেছিলে তুমি বাচ্চাটার দায়িত্ব নিতে পারবে না সেদিন আমি সুইসাইড করতে চেয়েছিলাম। অনল ভাই না থাকলে হয়তো মরেই যেতাম। এর পর ও দু এক বার এ চিন্তা আমার মাথায় এসেছিলো। এই বাচ্চাটাকে বাঁচানোর জন্য আমি মা-বাবার পা ধরে কেঁদেছি। সেদিন অনল ভাই না থাকলে হয়তো আমাকে আত্নহত্যা করতে হতো। আর কিসের বাচ্চা বাচ্চা করছো বলোতো? কোন বাচ্চা, যার দায়িত্ব তুমি নিতে চাও নি। কাপুরুষের মতো দায়িত্ব নেবার ভয়ে তাকে মেরে ফেলতে চাইছিলে সেই বাচ্চার দোহাই দিচ্ছো। তুমি আদৌ জানো আমার প্রেগ্ন্যাসির অবস্থা কেমন ছিলো? বাচ্চাটা আদৌ কতটুকু বেড়েছে? আমার শরীরের পজিসন কেমন? না তুমি জানো না। অনল ভাইকে জিজ্ঞেস করে দেখো, সে এটাও বলতে পারবে বেবি দিতে কতোটুকু নড়াচড়া করে। সে বাবা না হয়েও বাবার সকল দায়িত্ব পূরণ করেছে। যে সময়টা আমার তোমাকে সব থেকে বেশি দরকার ছিলো তখন সেই মানুষটা আমার পাশে ছিলো, আমার ঢাল হয়ে। আমাদের কুকীর্তির সম্পূর্ণ দায়টা নিজের নামে চালিয়েছেন। আমাকে কেউ যেনো আঘাত না করে সেজন্য আমার সামনে তাকে পেয়েছি তাকে। আর কি বললে কাগজের সম্পর্ক হ্যা আমাদের মাঝে সম্পর্কটা কাগজের। কিন্তু আমি তাকে ভালোবাসি। আমার ভাবনার খেলাঘরে তার বসবাস। আজ তোমার কথাগুলো শুনে তোমার প্রতি করুনা হয়েছে কিন্তু তোমার প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয় নি। আমি তোমার কাছে ফিরবো না। এই কাগজের সম্পর্ক আমার সারাজীবনের অস্তিত্ব। এতোদিন তুমি আমার কাছে যা চেয়েছো আমি দিয়েছি আজ আমি চাচ্ছি। আমি তোমার থেকে মুক্তি চাচ্ছি। আমার বাচ্চা আর আমাকে মুক্তি দাও। আর কখনো আমার সামনে কোনো অহেতুক আবদার করো না। আমি রাখতে পারবো না। আরেকটা কথা, অনল ভাই যদি আমার জীবনে নাও থাকতো তাও আমি তোমার কাছে ফিরতাম না। যদি কোনোদিন অনল ভাই আমাকে ফিরিয়ে দিতে চায় আর আমার যাওয়ার কোনো জায়গা না থাকে আমি আর আমার বাচ্চা মরে যাবো তাও তোমার কাছে ফিরবো না। আমি বলি কি, তুমি এবার কাউকে সত্যি ভালোবাসার চেষ্টা করো। দেখবে সুখী হবে। আসি দিগন্ত।

দিগন্তের কোনো উত্তরের অপেক্ষা না করেই হাটা দিলো ধারা। আজ মন থেকে একটা ভার করে গেছে। বেশ ফুরফুরে লাগছে মনটা। কিন্তু যখনই ভাবছে অনল তাকে দিগন্তের কাছে ফিরিয়ে দিতে রাজী হয়েছে। তার কাছে শুধু কাগজের স্ত্রী হয়ে থেকে গেলো ধারা। কেনো জোর করলো না সে, কেনো দিগন্তকে এই সুযোগটা দিলো অনল এটা ভাবতেই মনটা কালো মেঘের মতো দুঃখগুলো ভর করছে। এদিকে ধারার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রয়েছে দিগন্ত। বুকটা যেনো ফেটে যাচ্ছে, আজ নিজের কর্মকাণ্ড তাকে ধারার কাছ থেকে এতোটা দূর করে দিয়েছে। চোখটা ঝাপসা হয়ে আসছে। এক নজরে ধারার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রয়েছে সে। ধারা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে লাগলো। হাটু গেড়ে এখনো সেখানেই দেখছে সে। বুক থেকে শুধু দীর্ঘশ্বাস বেরোলো।

পার্কের বাহিরে গাড়িতে বসে আছে অনল। মন এবং মস্তিষ্কের যুদ্ধে মস্তিষ্ক হেরে যাচ্ছে। বারবার মনে হচ্ছে ছুটে যাবে ধারার কাছে ছুটে যেয়ে ধারাকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসবে। কিন্তু পরক্ষণে মনে হচ্ছে যদি ধারা এখনো তাকে ফোন দেয় নি তবে কি ধারা দিগন্তকে মেনে নিয়েছে। দিগন্তকে সে তো ভালোবাসতো। অনল তো তার কাছে শুধু একটা বটবৃক্ষের ন্যায়। সে তো অনলকে ভালোবাসে না। আর এই সম্পর্কটা তো শুধুমাত্র কাগজের। কাগজের সম্পর্ক কি আদৌ সত্যিকারের সম্পর্কের ন্যায় হয়!! কৃতজ্ঞতা কখনো ভালোবাসা হতে পারে না। সূর্যাস্তের সময় হয়ে এসেছে। এখনো যেহেতু ধারা ফোন দেয় নি তবে এখানে দাঁড়িয়ে থাকার মানেই হয় না। না জানি কতো মান-অভিমানের অবসান ঘটছে। বুকে হাজারো ছুরির আঘাত হচ্ছে অনলের। চোখ মুখ মুছে গাড়ি স্টার্ট দিবে তখন…….

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি