#কাগজের_তুমি_আমি
#দ্বিতীয়_অধ্যায়
#অন্তিম_পর্ব
অধীর কন্ঠে বললো ধারা। তার গলা কাঁপছে। তার সুখের সংসারটাকি এভাবে ভেঙ্গে যাবে? অনল ভাবলেশহীন ভাবেই দাঁড়িয়ে আছে। এবার সে একটু এগিয়ে আসলো। ধারার মুখোমুখি হয়ে বললো,
– মানেটা স্পষ্ট আমি এই সম্পর্কে হ্যাপি না। একটা সম্পর্ক যেটা নামে মাত্র সম্পর্ক সেই সম্পর্কটা কতদিন টানা যায় বল? এভাবে আমি আর পারছি না। তাই বলছি কি
– তুমি কি ডিভোর্স চাচ্ছো?
– হ্যা?
– আমি কি দোষ করেছি অনলভাই? তুমি তো বলেছিলে তুমি আমার হাত কখনো ছাড়বে না, তাহলে কি এমন করেছি আমি?
– তুই কিছু করিস নি ধারা, দোষটা আমার। আমি ই বুঝতে পারি নি। আসলে আমাদের সম্পর্কের তো কোনো ভিত্তি ই নাই। একিটা সম্পর্ককে এভাবে টানাটা সত্যি আমার পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছে না।
– আমাদের সম্পর্কের ভিত্তি নেই? সত্যি কি নেই অনলভাই? আমাদের মাঝে কি ভালোবাসার গভীরত্ব নেই নাকি বোঝাপড়া নেই? তুমি তো বলেছিলে তোমার ভালোবাসা আমাদের দুজনের জন্য এনাফ হবে।
– ভুল বলেছিলাম। এখন আমি আর এভাবে সম্পর্কটা টানতে পারছি না। আমি চাইলেও তোর কাছে আসতে পারছি না। তুই কি সত্যি আমাদের মাঝের অদৃশ্য দেয়ালটা দেখতে পাচ্ছিস না ধারা।
ধারা এবার চুপ মেরে গেলো। সে নিজেও এই দেয়ালটা বুঝতে পারছিলো। কেনো যেনো চাইলেও এই দেয়ালটা ভেদ করা হয় নি তাদের দুজনের। ধারার চোখ ছলছল করছে। হয়তো তার আর অনলের পথচলাটা এটুকুই ছিলো। অনল যখন তার কাছ থেকে মুক্তি চাচ্ছে তবে তাই হোক। কাঁপা স্বরে বললো,
– তুমি কি সত্যি মুক্তি চাও?
– হু
– বেশ তাহলে, তোমার যেটা ভালো মনে হবে করো। আমি কাল ই অধরাকে নিয়ে মার বাড়ি চলে যাবো।
– কাল যেতে হবে না, কালকে উকিলের কাছে যাবো। তারপর অধরাকে নিয়ে ও বাড়ি চলে যাস।
ধারা অবাক চোখে অনলকে দেখে যাচ্ছে। যে লোকটা অধরাকে বাদে এক মূহুর্ত থাকতে পারে না আজ সেই লোকটা অধরাকে আটকাতেও চায় নি। টুপ করে পানির কণাটা চোখ থেকে পড়লো ধারার। এর থেকে তো মরে গেলেই ভালো হতো। বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যাথা শুরু হয়েছে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু না সে কাঁদবে না। সে কোনো খেলনা নয় যে বারবার মানুষের খেলার পাত্র হবে। অনল যখন মুক্তি চাচ্ছে তবে তাই হবে। মুক্তি দিবে সে তাকে। মেয়েকে নিয়ে একেবারেই কাল বের হবে। আর এ বাড়ি মুখো হবে না সে। বাবা-মা যদি আশ্রয় দেয় তো ভালো নাহলে সেদিক চোখ যাবে সেখানে চলে যাবে। ধারা কথা বাড়ালো না, ধীর পায়ে রুমে চলে গেলো। মেয়েটাকে কোলের মধ্যে নিয়ে গুটিসুটি মেরে শুয়ে রইলো। অনলের দিকে পিঠ করে শোয়ায় তার মুখটা দেখতে পাচ্ছে না অনল। সারাটা রাত নির্ঘুম কাটলো ধারার। চোখের পানিটা বাধ মানছে না। ফজরের আযান শুনে উঠে বসলো। মাথায় উল্টোপালটা অনেককিছু ঘুরছে। একবার ভাবলো এখনই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। মুক্তি ই তো অনল চায়। পর মূহুর্তে নামায পড়ে নিজেকে শান্ত করলো। খুব কান্না পাচ্ছে। নিজেকে সামলানোটা দায় হয়ে গেছে। না সে ভেঙ্গে পড়বে না, সেও দেখবে অনল কিভাবে তাকে ডিভোর্স দেয়। তার ভালোবাসা কি এতোটা ঠুনকো। নিজেকে অনেক বুঝিয়ে সুজিয়ে শান্ত করলো ধারা। এখন শুধু বিকেলের অপেক্ষা।
দুপুর ৩টা,
অধরা দুধ খেয়ে ঘুমোচ্ছে। ধারা তখন বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে মৃদু বাতাসে চুল উড়ছে। তখন রুমে অনল আসলো। হিনহিনে গলায় বললো,
– চল উকিলের কাছে যাবার সময় হয়ে এসেছে।
– হুম
ধারার আচারণ বেশ নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। কোনো কথা নেই শুধু চুপ করে পুতুলের মতো মাথা নাড়িয়ে রুমে আসলো। অনল ও বাড়তি কথা বললো না। অনল একটা গোলাপি শাড়ি কিনে দিয়েছিলো অধরা হবার পর। সেই শাড়িটাই গায়ে জড়িয়ে নিলো সে। আজ কেনো যেনো খুব সাজতে ইচ্ছে হচ্ছে। অনলের জন্য কখনো সেভাবে সাজা হয় নি। চুলগুলো খোপা বাঁধলো সে। ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক দিলো, চোখে গাড় কাজল। বেশ মানিয়েছে সাজটা ধারাকে। সব কাপড় গুছিয়ে নিলো। সাথে অধরার ও। যাবার আগে একবার রুমটা ভালো করে দেখে নিলো সে। এই রুমে কত স্মৃতি না তার আর অনলের। একটা বছরের স্মৃতি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে পা বাড়ালো গন্তব্যের দিকে। বাহিরে গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অনল। সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট কি চমৎকার লাগছে তাকে। লোকটা কি জানে তার এক ঝলক ধারার সারাটাদিনের ভালোথাকার খোরাকি। ধারাকে আসতে দেখে এগিয়ে এসে ব্যাগটা গাড়িতে তুললো সে। অধরা ধারার কোলে ঘুম। অনলকে এক নজরে ধারা দেখে যাচ্ছে, যেনো আগামীর খোরাকি জমাচ্ছে। অনল শুধু আড়চোখে ধারাকে দেখে যাচ্ছে। তবে কিছু বলছে না। ধারাকে সত্যি অনেক সুন্দর লাগছে। গাড়িতে বসে গাড়িটা স্টার্ট দেয় অনল। ধারা কাঁচের জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে থাকে। আর অনলকে দেখবে না সে। তাহলে আর তার থেকে আলাদা হতে ইচ্ছে হবে না। বুকটা ক্ষনে ক্ষনে ব্যাথা করছে। দমটা বন্ধ বন্ধ লাগছে। মনটা যে বড্ড বেহায়া।
অনল ধারাদের বাসায় আগে গেলো। অধরা আর ব্যাগ পত্র রেখে এলো। ধারা অবাক হলো তার মা কিছুই জিজ্ঞেস করলো না। তাহলে কি তিনিও জানেন। অনলকে জিজ্ঞেস করতেই অনল বললো,
– অধরাকে নিয়ে যাবি উকিলের কাছে নাকি? পাগল তুই? ও মামির কাছে থাক। এক ঘন্টার ই তো ব্যাপার। তুই তো ওকে খাওয়েছিস।
ধারা আর কথা বাড়ালো না। গাড়ি আবার ও চলতে লাগলো। যত পথ কাটছে ধারার কষ্টগুলো তত বাড়ছে। মনে হচ্ছে পালিয়ে গেলেই ভালো হতো, অন্তত সম্পর্কটা তো থাকতো। তার দোষটা কোথায় এখনো খুজে পাচ্ছে না। হঠাৎ ব্রেক কষায় হুশ ফিরলো ধারার। খেয়াল করলো তারা একটা হোটেলের সামনে।
– এখানে কি করবো আমরা?
অনলকে জিজ্ঞেস করে বসে সে। অনল বিরক্তি দেখিয়ে বলে,
– উকিল এখানে দেখা করতে বলেছে। আসলে আমার বন্ধু তো। তুই ভেতরে যা আমি পার্ক করে আসতেছি।
অনলের কথা শুনে গাড়ি থেকে নামলো ধারা। ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো রেস্টুরেন্টের দিকে। রেস্টুরেন্টে পা রাখতেই খটকা লাগলো ধারার। পুরো রেস্টুরেন্টটা সুন্দর করে সাজানো এবং আর স্টাফ বাদে কেউ নেই। পেছনে ফিরতেই দেখে অনল হাটু গেড়ে বসে রয়েছে রিং হাতে। ব্যাপারটা ধাতস্থ হতে কয়েক সেকেন্ড লাগলো ধারার। অনল ঠোঁটের কোনায় হাসি একে বললো,
– আমি আর কাগজের সম্পর্ক টানতে চাই না ধারা। আমি এই কাগজের সম্পর্ক থেকে মুক্তি চাই। এবার সত্যি সত্যি বিয়ে করতে চাই তোকে, শুধু সমাজের জন্য নয়, শুধু দায় এড়াতে কিংবা আশ্রয়ের জন্য নয়; ভালোবাসার জন্য। করবি আমাকে বিয়ে?
ধারা এবার তেড়ে আসলো অনলের কাছে। কলার চেপে ধরে দাঁড় করায় তাকে। ঠাস করে গালে চড় বসিয়ে দেয়। অনল হা করে তাকিয়ে আসে ধারার দিকে। ভেবেছিলো ধারা হয়তো তাকে জড়িয়ে ধরবে। আসলে বিগত সপ্তাহ থেকে কলিগদের সাথে মিলে এই কাজটা করে সে। এই আইডিয়াটা শামীম তাকে দিয়েছিলো। এভাবে যদি প্রপোজটা করে তাহলে ধারা অবাক হয়ে যাবে। কিন্তু উলটো হয়ে গেলো। দাঁতে দাঁত চেপে ধারা বললো,
– ফাজলামি করো তুমি আমার সাথে? ফাজলামি করো? কি ভাবো তুমি আমাকে? কাল সারারাত আমার উপর কি কেটেছে জানো তুমি? এখন আসছো ঢং করতে। তুমি জানো আমি ভেবেছিলাম একবার বাড়িটা ছেড়ে দিবো। তোমার কোনো আইডিয়া আছে। ডিভোর্সের কথা ভাবতেই আমার জাস্ট দুনিয়া নাই হয়ে গেছিলো। খুব আমার থেকে মুক্তি চাই না তোমার? একদিন সত্যি সত্যি হারিয়ে যাবো দেখো
বলতে বলতে কেঁদে দেয় ধারা। অনল তখন তাকে জড়িয়ে ধরে। আর ইচ্ছেমত কিল ঘুষি মারতে থাকে অনলকে ধারা। অনল তখন ধীর গলায় বলে,
– সরি, আমি সত্যি বুঝি নি। একটু এক্ট্রা হয়ে গেছে সরি। এটা আমার আইডিয়া না, শামীম বললো এভাবে বিয়ের প্রপোজালটা দিলে তুই খুশি হবি।
– করবো না বিয়ে তোমাকে, ছাড়ো, ছাড়ো
– সরি সরি। আসলে তোকে সারপ্রাইজ দেবার প্লান ছিলো। কিন্তু প্লানটা গোলমেলে হয়ে গেছে সরি। আর তুই ভাবলি কি করে তোকে ডিভোর্স দেবার কথা ভাববো আমি। তুই আমার নিঃশ্বাসে মিশে আছিস। তোকে ছাড়া একটা মূহুর্ত কাটানো দুষ্কর। ভাবলি কি করে আমি তোকে ডিভোর্স দিবো।
অনল আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ধারাকে।ধারাও তার বুকের সাথে মিশে থাকে। কালো অন্ধকার মেঘ সরে যেমন উজ্জ্বল সূর্য দেখা যায়, ধারার হৃদয়ের কালো মেঘ গুলো ও যেনো মূহুর্তে সরে গেলো। একটা অজানা তৃপ্তিতে মনটা ভরে গেলো তার। সেখান থেকে ধারাদের বাড়িতেই রেখে এলো তাকে অনল। যাবার সময় শুধু বললো,
– খুব তাড়াতাড়ি তোকে আমার করে আমার ঘরে নিয়ে যাবো রেডি থাকিস
এক সপ্তাহ পর,
ফুলের বিছানায় বসে রয়েছে ধারা। গায়ে সেই লাল বেনারসি। আজ আবার অনলের বউ হয়ে এ ঘরে বসে আছে। পার্থক্য একটাই এখন আর কাগজের সম্পর্কটা নেই। আছে সত্যিকারে সম্পর্ক। অধরাকে দুধ খাইয়ে সুভাসিনী বেগমের কাছে রেখেছে। সুভাসিনী বেগম আশ্বস্ত করলেন তিনি দেখে রাখবেন নাতনীকে। বুকটা আগের মতোই টিপটিপ করছে। সত্যি বলতে এটাই তো তাদের প্রথম বাসর। দরজা ঠেলার শব্দে মুখ তুলে তাকায় সে। অনল এসেছে, গোল্ডেন শেরওয়ানিতে খুব মানিয়েছে তাকে। অনল পাশে বসতেই বুকের ধুকপুকানি যেনো আরো বেড়ে গেছে। অনল ধীরে হাতটা ধরে ধারার। ধীরগলায় বলে,
– সারারাত পৃথিবীতে সূর্যের মতন
দুপুর-দগ্ধ পায়ে করি পরিক্রমা,
তারপর সায়াহ্নের মতো বিস্মরণ-
জীবনকে, স্থির জানি, তুমি দেবে ক্ষমা
তোমার শরীরে তুমি গেঁথে রাখো গান
রাত্রিকে করেছো তাই ঝঙ্কারমুখর
তোমার ও সান্নিধ্যের অপরূপ ঘ্রাণ
অজান্তে জীবনে রাখো জয়ের সাক্ষর____
কবিতাটার অর্থ জানিস?
– উহু
লজ্জামিশ্রিত কন্ঠে ধারা বলে। অনল আলতো হাতে ধারার মুখটা ধরে নিজের কাছে নিয়ে আসে। তারপর কানের কাছে ঠোঁট লাগিয়ে বলে,
– আমি তোর মাঝে বিলীণ হতে চাই, তোর নেশায় মত্ত হতে চাই। তোর সান্নিধ্যে নিজেকে উজার করে দিতে চাই। অনুমতি আছে?
-……
ধারা আর কোনো কথা বলতে পারে নি। বাহিরের আবহাওয়া স্তব্ধ, ধারাও অনলের মাঝে স্তব্ধ হয়ে রয়েছে। রাতের গভীরতার সাথে দুটো দেহের মিলনের গভীরত্ব ও বাড়ছে। নিঃশ্বাসের উম্মাদনা চলছে রুমের মাঝে। দুটো অতৃপ্ত হৃদয় নিজেদের তৃপ্তি মেটাতে ব্যস্ত। এই মিলনে নেই কোনো অন্যায়, নেই কোনো অবৈধতা। আজ যেনো সত্যি কাগজের তুমি আমি কথাটা ঘুচে গেছে। অনল, ধারার সম্পর্কটা আরো গভীর, আরো স্নিগ্ধ। সম্পর্ক কখনোই শুধু শারীরিক হয় না। সম্পর্কটা থাকে মনের। অনল ধারার সম্পর্কটা ছিলো কাগজের। কিন্তু ভালোবাসার কারণেই তাদের সম্পর্কটা কাগজের গন্ডির থেকে বেরিয়ে মনের সম্পর্কতে পরিণত হয়েছে। যেখানে সত্যিকারের ভালোবাসা থাকে সেখানে শারীরিক চাহিদাটা আসে না। তাই তো ধারার সাথে শারীরিক সম্পর্ক ছাড়াও অনলের ভালোবাসার গভীরত্ব ছিলো সুগভীর। আবার অধরার সাথে রক্তের সম্পর্ক না হওয়া সত্ত্বেও অনলের মনের সাথে সে জড়িয়ে আছে। সম্পর্কের এই টানগুলোই মাঝে মাঝে আমরা বুঝি না। আবেগের বশে ভুল করে বসি। কিন্তু এটা ভুলে যাই সব ধারা এবং অধরার জন্য অনল থাকে না। এটাই বাস্তবতা, এটা চিরন্তন সত্যি।
||সমাপ্ত||