কাননবালা পর্ব-০৪

0
427

#কাননবালা!
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ৪

সময়ের রেলগাড়ী কখনো কারো জন্য অপেক্ষা করে না! দেখতে দেখতে ছয় মাস কেটে গেলো।এই ছয় মাসে নীতুর জীবনে অনেক পরিবর্তন না হলেও কিছুটা হয়েছে।এখনো নীতু টিউশনি করায়,রোজ নিয়ম করে রান্না করে,ঘর ঘুছায়।নিত্য নতুন পাত্রের সামনে সঙ সেজে বসে থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা।বিকট ভুঁড়িওয়ালা পাত্র নীতুকে মোটা বলে রিজেক্ট করে। বা এস এস সি পাশের মুদি দোকানি পাত্র নীতুকে বয়স বেশি! কালো বলে রিজেক্ট করে।এসবের কিছুই পরিবর্তন হয়নি।এই তো গতকাল পাশের বাসার আন্টি উপহাসের সুরে নীতুকে নিয়ে ভীষণ আফসোস করলো। তাছাড়া সোনাডাঙ্গায় থাকে যে মামী সেও প্রায় দিন মাকে কল করে বলে”হ্যারে, নীতুর কোন গতি হলো?বেচারি ঐ কালো রঙেই নিজের কপাল পুড়ালো!বয়স তো আর বসে নেই যৌতুক টৌতুক দিয়ে বিদায় কর মহিমা!সেতুকেও তো বিয়ে দিতে হবে!”
পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয় স্বজনের নীতুকে নিয়ে বড়ই চিন্তা। বিবাহ যোগ্য মেয়েকে ঘরে রাখা মানে পাপ!গুরুতর পাপ! এসব শুনে নীতুর এখন আর মন খারাপ হয় না! মন খারাপ হয় না মায়ের চিন্তিত মুখ দেখে।এমনকি ভাবির কটু কথা, ভাইয়ার নির্লিপ্ততা কোন কিছুই নীতুকে আগের মত আঘাত করে না।
একটা মানুষের আবির্ভাব নীতুর জীবনটা বদলে দিয়েছে পুরোপুরি ভাবে।মানুষটা দূরে থেকেও সবসময়ে ছায়ার মত বিচরণ করে! সেই মানুষটা আর কেউ নয়, তাজ। ছয় মাসে সম্পর্কের ক্ষেত্রটা বদলে গেছে।দুজন দুজনকে ভালোবাসি কথাটা না বললেও এক অদৃশ্য অধিকার বোধ জন্ম নিয়েছে। তাজ যেন একটু বেশিই নীতুর খেয়াল রাখে।নীতুর প্রতি এই প্রগাঢ় টান কে কি বলা যায়? ভালোবাসা নাকি প্রেম?তা নীতু জানে না।নীতু কেবল এতটুকু জানে তাজ তার ভিতরের সত্বাকে অজান্তেই জয় করেছে। দিনে অন্তত দশবার কল করে নীতুর খোঁজ নেয়া তাজের রুটিন হয়ে গেছে।ফোন ধরতে দেরি হলেই কখনো বা ভীষণ রাগারাগি করে!নীতুর মন খারাপ থাকা মানে তাজের বুকের বাম পাশে ভীষণ অস্থিরতা! নীতু আর তাজ দূরে থেকেও অদৃশ্য সংসার পেতেছে!ফোনে কথা বলতে বলতে দুজনের নাস্তা খাওয়া, তাজের শার্টের রঙ পছন্দ করে দেয়া,দুপুরের খাবারটাও খাওয়া হয় দুজনের কথা বলতে বলতে!রাতের ঘুমটাও নামে দুজনের একইসাথে!আগের মত নির্ঘুম রাত কাটে না।নীতু আপন মনেই হেসে ওঠে! তাজ পাগল, ভীষণ পাগল।সেদিন ফোন করে হুট করেই বললো,” নীতু বাসার জন্য কি বাজার নিবো?”
নীতু একথা শুনে তো ভীষণ অবাক। তাজের নিঃসঙ্কোচ কথা! যেন কতদিনের সংসার তাদের!
নীতু উত্তরে কি বলবে ভেবে পেল না।ওপাশ থেকে তাজই তাড়া দিয়ে বললো,”আহা! নীতু বলনা?চুপ করে আছো কেন?করল্লা আর পালংশাক উঠেছে বাজারে, নিয়ে নেই কি বলো?
নীতু চট করে বলে ফেললো,”আমি তো করল্লা খাই না!তুমি বরংচ পালংশাক নেও।”
তাজ ফোনের ওপাশেই মিষ্টি করে হেসে ফেললো নীতুর বোকা বোকা কথায়।কথাটা বলে নীতুও যেন খানিকটা লজ্জায় মিইয়ে গেলো।তবুও বলতে পেরে ভালো লাগলো নীতুর। তাজ দ্রুত কন্ঠে বললো,” ইলিশ না চিংড়ী,? ”
“ইলিশ। ”
“মুরগী না হাঁস?”
“মুরগী। ”
“গরু না খাসি?”
“খাসি!”
“মিনিকেট নাকি বালাম?”
“মিনিকেট।”
“প্রেম নাকি ভালোবাসা?”
“প্রেম!”…… বলেই নীতু ভীষণ লজ্জা পেলো।তাজ তখন হো হো করে হেসে দিলো।

দুজনের আলাপনের মাধ্যমটা যান্ত্রিক যন্ত্র হলেও সম্পর্কের গভীরতা দিন দিন বাড়তেই থাকলো।

***********
চিত্রালী থেকে নিউমার্কেট যেতে বেশিক্ষণ সময় লাগে না।টিউশন শেষ করে নীতু নিউমার্কেটে যাওয়ার জন্য অটোতে উঠলো।টুকটাক ব্যক্তিগত কিছু সামগ্রী কিনে ভাবলো বড় আপার বাসায় যাবে।দাদাভাইর নাকি জ্বর এসেছে বললো গতকাল বড় আপা।অটোতে বসতেই পানখাওয়া মধ্য বয়স্ক এক পুরুষ এসে বসলো নীতুর পাশে।নীতু খানিকটা চেপে বসলো জানালার দিকে।কিন্তু লোকটা যেন সুযোগ পেয়ে হাত পা ছড়িয়ে বিন্দাস করে বসলো।নীতুর গা গুলিয়ে উঠলো! লোকটার গা থেকে কেমন ভোটকা গন্ধ বের হচ্ছে। কতক্ষণ পরই নীতু অনুভব করলো লোকটা তার কনুই দিয়ে নীতুর বগলের নিচে ইচ্ছা কৃত ভাবে ধাক্কা লাগানো চেষ্টা করছে।আতঙ্কে নীতুর হাত পা ঠান্ডা হয়ে এলো!কি বিশ্রী লোক।নীতু এসব কর্মকান্ড ভীষণ ভয় পায়।নীতুর স্থানে ইতু থাকলে সটান করে থাপ্পড় বসিয়ে দিতো।নীতু তা পারলো না।সে চিৎকার করে অটো থামাতে বলে অটো থেকে নেমে গেলো।নীতু যখন নেমে যাচ্ছিল তখনও লোকটা পান খাওয়া ঠোঁটে বিশ্রী ভাবে হাসছিল।নীতু রাস্তার পাশেই বমি করে দিলো।

নীতুর চোখের সামনে ভেসে উঠলো অনেক বছর আগের একটা ঘটনা।তখন নীতুর বয়স ছয়।সেজ ফুফা আদর করার নাম করে নীতুর স্পর্শকাতর স্থান গুলোতে বিশ্রী ভাবে ছুঁয়ে দিতো।নীতু তখন ব্যাপারটা বুঝতে না পারলেও ভালো লাগতো না ঐ সব ছুঁয়ে দেয়া।গা মুচড়িয়ে নীতু প্রতিবাদ করতো!কোল থেকে নেমে যেতে চাইতো কিন্তু ফুফা শক্ত করে ধরতো ফলে নীতু ব্যথা পেয়ে কান্না করতো।এরপর থেকে ফুফা বাড়িতে এলে নীতু তার কাছে যেতো না কিন্তু সেই ঘটনা টা এখনো মনে কোণে দাগ কেঁটে বসে গেছে।
নীতু রাস্তার পাশে বসে পড়েই হু হু করে কেঁদে উঠলো।কেন তার সাথেই এসব হয়?নীতু তো সুন্দর নয়?তবুও কেন লালসার হাত থেকে বাঁচতে পারে না।পরক্ষণেই নীতুর মনে হলো,কুৎসিত লালসা কখনো সুন্দর বা অসুন্দর বিবেচনা করে না!তাদের কেবল নারী শরীরের উঁচু নিচু বাঁকের প্রয়োজন!

নীতুর ফোন বাজছে। চোখ মুছে নীতু কল রিসিভ করে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে তাজ বলে উঠলো,” নীতু কাঁদছো কেন?কি হয়েছে নীতু?”
তাজের কথায় নীতু আবার কেঁদে উঠলো।তাজ ব্যগ্রকন্ঠে বলে ওঠে, “টেল মি নীতু?আমার কিন্তু ভীষণ চিন্তা হচ্ছে। ”
নীতু তখনও ফুপিয়ে কাঁদছে।তাজ উচ্চস্বরে বলে উঠলো, ” এই নীতু আমি ভয় পাচ্ছি তো। প্লিজ,নীতু আমাকে বল কি হয়েছে?আবার পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছে?”

নীতু এবার সবটা খুলে বললো।সবটা শুনে তাজের মুখ ক্রোধে লাল হয়ে উঠলো।চিৎকার করে বলে উঠলো,”কুত্তারবাচ্চারে ছেড়ে দিলা কে?থাপ্পড় মারতে পারো নাই?হাত নেই তোমার?কেউ তোমার শরীরে হাত কি করে দেয়? কি করে হাত দেয় নীতু?কষিয়ে থাপ্পড় কেন মারো নাই?”…..শেষের কথাটা তাজ জোড়ে ধমকে বলে উঠলো।
নীতু ভয় পেয়ে কেঁপে উঠলো। তাজের এই রুপ সম্পর্কে নীতুর জানা ছিল না।

চলবে,