কারণে অকারণে সে পর্ব-০১

0
1137

#কারণে_অকারণে_সে
#পর্ব:১
#লেখক:রিয়ান আহমেদ

“তীব্র ভাই আমি তোমাকে অনেক বেশি ভালোবাসি। তুমি নেহা আপুকে বিয়ে করো না সে তোমাকে ধোঁকা দেবে।আমার মতো করে তোমাকে কেউ ভালোবাসতে পারবে না।”
কথাগুলো বলতেই তীব্র আরশির গালে সজোরে থাপ্পড় মারলো।থাপ্পড়টা এতোটাই জোড়ালো ছিল যে আরশি প্রায় পড়ে যেতে নিল কিন্তু পরক্ষণেই খাটের হাতল ধরে নিজেকে সামলে নিল। তীব্রর শরীর রাগে কাঁপছে সে রাগী গলায় বলল,”আরশি তুই কি পাগল হয়েছিস?চাচাতো ভাইয়ের এংগেজমেন্টের দিন তুই তাকে এমন কথা কিভাবে বলিস?”
আরশি তীব্রর কোনো কথা কানে তুলছে না।সে দম ফাটা কান্না করছে আর বিলাপ বকছে,”আমি তোমাকে ভালোবাসি তো।”
তীব্র আর সহ্য করতে না পেরে আরশিকে টেনে নিজের রুম থেকে বের করে দিয়ে ফ্লোরে ছুঁড়ে মারে।তীব্র নিজের মুখ শক্ত করে লাল লাল চোখ করে তাকিয়ে বলল,
“আরশি তোকে আমি আর কখনো আমার আশেপাশেও দেখতে চাই না। ছিঃ আমার তো ভাবতেও লজ্জা লাগছে তুই আমাকে নিয়ে এসব ভাবিস।”
কথাগুলো বলে তীব্র ধারাম করে নিজের রুমের দরজা লাগিয়ে দিল।আরশি এখনো মেঝেতে বসে বসে কান্না করছে।কিছুক্ষণ পর আরশি একটু স্বাভাবিক হয়ে আশে পাশে চোখ বুলিয়ে নেয়।নাহ্ কেউ নেই এখানে। সবাই নিচে অনুষ্ঠানে ব্যস্ত।যদি কেউ থাকতো তাহলে আজ ওকে বেশ লজ্জায় পড়তে হতো এই ঘটনার জন্য।আরশি নিজের হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে ছাদের দিকে পা বাড়ায়।ছাদে এসে পানির ট্যাংকের পেছনে গিয়ে বসে।

আরশির পুরো নাম আয়নুর আহসান আরশি।আর কিছু সময় আগে আরশি যার কাছে নিজের ভালোবাসার কথা বলেছে সেই ব্যক্তি আরশির একমাত্র বড় চাচা রেজাউল আহসানের ছেলে সামিয়ুল আহসান তীব্র।

আরশি ছাদের থেকে নিচের দিকে তাকায়।
নিচে গার্ডেনে অনুষ্ঠানের সব বন্দবস্ত হয়ে গেছে কিছুক্ষণ পরেই তীব্র আর নেহার আকদ বা এংগেজমেন্টে হবে।আরশির পরিবার এই বাড়ির দুই বাড়ি পরের বাড়িতে থাকে।দুটো বাড়ির নকশাই প্রায় এক রকম।আরশি ঝাপসা চোখে পাশে তাকায় সাথে সাথেই তার টনক নড়ে। একটা বেশ দামী মদের বোতল তার পাশে বসে আছে আবার সাথে একটি পানির বোতল এবং একটি গ্লাস।আরশি আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখে কেউ আছে কি না।না কেউ নেই সবাই নিচে অনুষ্ঠানে ব্যস্ত।
এরকম অনুষ্ঠানের বাড়িতে এরকম দুই একটা বোতলের সন্ধান পাওয়া তেমন বড় কিছু না।কেউ না কেউ এটা এনে রেখেছে অনুষ্ঠান শেষে গিলার জন্য।আরশি বোতলটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে দেখে আর বলে,
“মাই ডিয়ার মদের বোতল এই কালো অন্ধকার রাতে আমার কষ্টের সাক্ষী আজ একমাত্র তুমি হবে।তোমার আসল মালিককে ভুলে আমার হয়ে যাও।”
আরশি গ্লাসে ঢেলে একটু খেতেই তার অন্তর আত্না জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা।আরশি চোখমুখ খিচে বলে,
“বাহ্ এটাই তো চাই এর টেস্টটা ভালো না হলেও একটু একটু মাথায় ধরতে শুরু করেছে।”

আরশি একটু একটু করে পুরো গ্লাস শেষ করে এরপর হঠাৎ আরশির নাকে একটা ভীষণ সুন্দর ঘ্রাণ এসে বাড়ি খায় সাথে ভীষণ সুন্দর পুরুষালি গলার স্বর যে বলছে,”এই মেয়ে কি করলে এটা!”এরপর আরশির আর কিছুই মনে নেই।

আরশি চোখ খুলে দেখে তার রুমে সে আছে।আরশি নিজের চোখের চশমাটা টেবিল থেকে নিয়ে চোখে দেয়।মাথা ব্যাথা তাকে বেশ যন্ত্রণা দিচ্ছে।আরশি গতকাল রাতের ব্যাপারে মনে করার চেষ্টা করলো।সে এখানে কি করছে তার তো ছাদে থাকার কথা।আরশি চিৎকার করে বলল,”মাআআআআ!”
তখনই আরশির মা আরশির রুমে প্রবেশ করলো।আয়েশা বেগম শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে কাঁদছেন তার হাতে লেবুর শরবত।তিনি সেটা আরশির দিকে ধরে কান্নাজরিত কন্ঠে বললেন,
“নে খেয়ে নে এটা। মাথা ব্যাথা কমে যাবে।”
আরশিকে আর কিছু বলতে না দিয়ে আয়েশা বেগম লেবুর শরবত হাতে ধরিয়ে দিয়ে রুম ছাড়লেন।আরশি হা হয়ে তাকিয়ে আছে এসব কান্ডে।কিছুক্ষণ পর আরশির বড় ভাই আরহাম আরশির ঘরে এসে আরশিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে একটা থাপ্পড় লাগায়।আরশি কিছু না বলে গালে হাত দিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।আরহাম কোমরে হাত দিয়ে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,
“আরু(আদরের ডাক) তুই যে আমাদের মান ইজ্জত এভাবে শেষ করবি এটা আমরা কখনোই ভাবতে পারি নি। বাবার প্রেশার বেড়ে গিয়েছিল জানিস?সে এখনো মাথায় আইস ব্যগ দিয়ে বসে আছে।”
কথাগুলো শোনার পর আরশির মাথা ভনভন করে ঘুরতে থাকে।সে কি করেছে সবার সামনে গিয়ে?সে কি তীব্রকে ভালোবাসার কথা সবাইকে বলেছে না কি?আরশি ভাইয়ের কাছে এবার মুখ খুলে,

“ভাই আমি কি করেছি?আমার তো কিছুই মনে পড়ছে না।ভাই তুমি প্লিজ বলো জলদি না হলে একেই তো এই মাথা ব্যাথা তার উপর টেনশনে আমি ব্রেইন স্ট্রোক করবো এখনই।”
“কি করেছিস?দেখ তুই কি করেছিস।”
আরহাম নিজের ফোন বের করে একটা ভিডিও ধরে আরশির সামনে।ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে আরশি স্টেজে গিয়ে মাইক হাতে নিয়ে চুপচাপ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে।

একজন এসে আরশির কাছ থেকে মাইকটা নিতে চাইলে আরশি মেয়েটাকে এমন ধাক্কা মারে যে মেয়েটা ঠাস স্টেজ থেকে পড়ে যায়।আরশি নাক টেনে কান্না করে মাইকে বলতে শুরু করে,
“আমার জীবনের দুঃখ আপনাদের সাথে আজ শেয়ার করবো।আজ আমার ব্রেকাপ হয়েছে।কিন্তু মজার ব্যাপার হলো আমার আজ অব্দি প্রেম হয় নি।প্রেম না করেও মানুষের ব্রেকাপ কিভাবে হয় তাহলে?,,আমি জানি না।যাইহোক আমার ব্রেকাপের দুঃখ সহ্য করতে পারছি না তাই আমাদেরকেও আমার সঙ্গে দুঃখ সহ্য করতে হবে।আমার গান গাইতে পারি না তবুও আজকে এই বেসুরো গলায় গান গাইবো শুধুমাত্র আপনাদের কানকে কষ্ট দেওয়ার জন্য।,,,কিন্তু কি গান গাইবো?হুম মনে পড়েছে,,,,”
এরপর গান না গেয়েই আরশি ঠাস করে স্টেজে পড়ে যায় অর্থাৎ জ্ঞান হারায়।ভিডিও এখানেই শেষ।আরশি ঢোগ গিলে আরহাম এর দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমি এসব ভিডিও করেছো ভাই?”
“না তানহা(তীব্রর বোন) ভিডিও করেছে।”
আরহাম এবার কয়েকটা বড় বড় নিঃশ্বাস নিয়ে আরশির পাশে বসে বলল,
“আরশি তুই কোন ছেলের কথা বলছিলি কাল?আমাকে বল এক্ষুণি।”
আরশি চুপ করে আছে।কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না।আরহাম দুই মিনিট পর্যন্ত উত্তরের আশায় আরশির দিকে তাকিয়ে থেকে আর কিছু জিজ্ঞেস না করে রুম ত্যাগ করলো।

আরশি দুই হাতে মাথা চেপে ধরে কেঁদে দিয়ে বলল,”আল্লাহ্ এসব আমার ধারা কি হয়ে গেল?আমি তো ভেবেছিলাম মদ খেয়ে ছাদেই পড়ে থাকবো।এসব আমি কেমনে করলাম?,,,বাবাই তো এখন সামনে গেলে আমাকে থাপড়াবে।,,,এক মিনিট তীব্র ভাইয়ের এংগেজমেন্ট কি হয়ে গেছে?,,হ্যা হয়েই তো গেছে বোধ হয় আমার জন্য কি আর বসে থাকবে?গেল গেল আমার এই কূলও গেল ঐ কূলও গেল।বাবাই মনে হয় আজকেই আমাকে ত্যাজ্য দিয়ে দেবে।”
;
;
;
;
আরশির বাবা রিজা আহসান মেয়ের বিয়ের জন্য একদিনেই পাত্র খুঁজে ফেলেছেন।রিজা আহসানের কথা হলো,”মেয়ে আমার পাগল হয়ে গেছে অর্ধেক।এখন তার বিয়ে আমাকে যত দ্রুত সম্ভব দিতে হবে না হলে কদিন পরে পুরোপুরি পাগল হয়ে যাবে ও।”
আরশি কাট কাট জবাব দেয়,”বাবাই আমি পাগল হই নি।আমি জুস ভেবে ঐ পানীয়টা খেয়ে ফেলেছিলাম আমি জানতাম না ওটা পচা পানি ছিল।”
রিজা আহসান কিছুক্ষণ মেয়ের দিকে তাকিয়ে আবার মাথায় আইসব্যাগ দিতে ব্যস্ত হয়ে বললেন,
“মামনি তুমি আর মাসুম বাচ্চা সাজার চেষ্টা করো না।তুমি পাগল হয়েছো সঙ্গে দেবদাস হয়েছো তাই মদ খেয়ে মাতাল হয়ে আমার মান ইজ্জতের ফালুদা বানানোর দুঃসাহস করেছো।আর বিয়ে করতে সমস্যা কি ছেলে সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ। তোমার সমস্যা হওয়ার তো কথা না।আর তোমার যেই ছেলেকে পছন্দ ছিল আমি মনে করি আমার পছন্দ করা পাত্র তার চেয়ে ঢের ভালো।”

“ছেলে যত উত্তম পাত্র হোক না কেন আমি বিয়ে করবো না।সবেমাত্র আমার বিশ বছর শেষ হয়েছে তোমরা আমাকে এখনই বিয়ে দিতে চাইছো?বুঝেছি আমি তোমাদের ঘাড়ের বোঝা হয়ে গেছি তাই না?”(ন্যাকা কান্না করে)
রিজা আহসান মেয়ের চাল বুঝতে পেরে বললেন,
“এমনিতে তুমি না চাইলে আমি তোমার বিয়ে কুড়িতে কেন দুই কুড়িতেও(চল্লিশ) দিতাম না।কিন্তু মামনি তুমি তো এখন বেয়াদব হয়ে গেছো সাথে পাগলও।এখন তোমার একজন যোগ্য মানুষ দরকার যে তোমাকে শাসন করবে।কারণ আমাদের ধারা তোমাকে শাসন করা সম্ভব না।তুমি তো আমাদের কলিজা তাই তোমাকে একটা ধমক দিতেও আমাদের বুকে ব্যাথা লাগে।”

রিজা আহসান কথাগুলো বলে চুপচাপ ডিভানে মাথা হেলান দিয়ে শুয়ে পড়লেন।
আরশি চুপচাপ থেকে এবার নিজের মহা অস্ত্র ব্যবহার করলো।আরশি বাবা মায়ের খাটের উপর শুয়ে হাত পা ছড়িয়ে কাঁদতে শুরু করলো।আয়েশা বেগম ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে মেয়ের কান্ড দেখে রিজা আহসানকে বললেন,
“তোমার মেয়েকে যেতে বলো এই ঘর থেকে আমি নামাজ পড়বো আমার ওর ফ্যাচফ্যাচ করা কান্না ভালো লাগছে না।”
আরশি মায়ের দিকে তাকিয়ে অসহায় গলায় বলল,
“আম্মাজান তুমি প্লিজ আব্বাজানরে বোঝাও আমি এখন বিয়ে করবো না।”

হাজার বিনতির পরেও আরশির কথা কেউ শুনলো না। বিকেলে তাকে দেখতে পাত্রপক্ষ চলে এলো।পাত্রের নাম সাভাস(Savas)। আরশিকে আর সাভাসকে আলাদা কথা বলতে পাঠানো হলো।দুজনে আরশিদের ছাদে দাঁড়িয়ে আছে।সাভাস কিছু বলতে যাবে তার আগেই আরশি সাভাসের হাত ধরে বলে,
“ভাই আপনি আমার ধর্ম ভাই লাগেন।প্লিজ এখনই নিচে গিয়ে মানা করে দেন বিয়ের জন্য।”
সাভাস হতভম্ব হয়ে আরশির মুখের দিকে চেয়ে আছে।কি বলে এই মেয়ে?ধর্ম ভাই?সাভাস আরশির সামনে প্রথমবার মুখ খুলে,
“তোমার মাথায় একটু সমস্যা আছে আংকেল বলেছিল কিন্তু এখন দেখি এখন দেখছি তুমি পুরাই পাগল।কিন্তু সমস্যা নেই আমি সব ঠিক করে দেবো বিয়ের পর।”

সাভাস আরশির হাতের উপর হাত রেখে মিষ্টি হাসি দিয়ে কথাটা বলে।আরশি তরিৎ গতিতে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে কয়েক কদম দূরে গিয়ে দাঁড়ায়।এরপর চোখ বড়বড় করে বলে,
“আপনাকে আমি কি বলছি শুনেন না?আমি বিয়ে করবো না আপনাকে।”
সাভাস হাসে।সে ছাদের রেলিং এর উপর হাত রেখে বলল,
“তোমাকে আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে মাই কিউটি।উফ তোমার গালের টোল!”
আরশি কথাগুলো শুনতেই তার দিন দুনিয়া অন্ধকার হয়ে যায়।ছেলেটা হ্যান্ডসাম, কিউট,ড্যাশিং।কিন্তু সে এই ছেলের সঙ্গে,,,,।আরশি আর কিছু ভাবতে পারে না অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। এতো শক একদিনে তার পক্ষে নেওয়া মুশকিল।

#চলবে!