কিছু জোড়া শালিকের গল্প পর্ব-০৮

0
370

গল্পের নাম: #কিছু_জোড়া_শালিকের_গল্প
পর্ব ৮: #উচিত_শিক্ষা
লেখিকা: #Lucky_Nova

ক্যান্ডেল দাঁতেদাঁত চিপে হাত মুষ্টিবদ্ধ করলো। শত চেষ্টা করেও সরাসরি তাকাতে পারলো না। বাদিকেই তাকিয়ে নজর ঘুরাতে লাগলো। এসির শীতল বাতাসেও গরম লাগতে শুরু হলো।
ইভান পকেটে হাত গুজে দাঁড়িয়ে মজা দেখতে লাগলো। কে বলবে এই মেয়েই গত কয়েকদিন অপরিমেয় দাপট দেখিয়েছে!
ক্যান্ডেলের নিজের উপর খুব রাগ হচ্ছে।
এই লোকের সামনে এভাবে ধরা খাওয়াটা ঠিক কতটা অপমানের তা ও ছাড়া কেউ বুঝবে না।
ক্যান্ডেল অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে কাঠ গলায় বলল, “ফাইল রেডি।”
এবারো তাকালো না ক্যান্ডেল।
ইভান এক হাত বের করে বাড়য়ে দিলো। ক্যান্ডেলও ফাইলগুলো ধরিয়ে দিলো ইভানের হাতে। ওর দৃষ্টি এখনো একই দিকে আবদ্ধ।
ইভান ফাইল হাতে ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, “Come in.”
ক্যান্ডেল খুব আড়ষ্টভাবের সাথে ঢুকলো। বসলো চেয়ার টেনে।
আজ বেশি সময় নিলো না ইভান। সামান্য চোখ বুলিয়েই বলল, “সব তো আগের মতোই আছে। কী ঠিক করেছো?”
এতক্ষণে তাকালো ক্যান্ডেল। চোখে মুখে বিস্ময়।
“আমি কাজের ক্ষেত্রে গাফিলতি পছন্দ করি না।” গম্ভীর চোখে তাকিয়ে বলল ইভান।
শরীরটা জ্বলে যেতে লাগলো ক্যান্ডেলের। কতটা কষ্ট করে দুইবার করে কাজগুলো করেছে ও। সেই কাজ নাকি আগের মতোই আছে। হয়নি।
সত্যিই হয়নি নাকি ব্যক্তিগত বিষয়ের শোধটা এভাবে তুলছে?(লেখিকা লাকি নোভা)
ইভান উঠে দাঁড়িয়ে গাঢ় নীল কোটটা হাতে নিতে নিতে বলল, “আবার করতে হবে। আপাতত শো-রুমে যাবো আমরা।”

🌸
ড্রাইভিং সীটে বসেছে ক্যান্ডেল। গাড়িটা ও চালাবে। যদিও এখনো প্রচুর অস্বস্তি হচ্ছে। ওই লোকের পাশে বসে পুরো রাস্তা যেতে হবে ভেবেই বিরক্ত লাগছে।
ইভান গাড়ির দরজা খুলে ঢুকে পড়লো ক্যান্ডেলের পাশের সীটে।
গা কেমন শিউরে উঠলো ক্যান্ডেলের। দু’হাতে স্টিয়ারিং চেপে ধরলো শক্ত করে। না জানে আজ কী করে গাড়ি চালাবে ও। মাঝখান দিয়ে একটা পর্দা টাঙিয়ে দিতে পারলে বেঁচে যেত ক্যান্ডেল। মুখটা দেখা লাগতো না। সাথে উপস্থিতিটাও টের পাওয়া যেত না।
ইভান কোটটা পিছনে রাখতে রাখতে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো ক্যান্ডেলের দিকে।
আড়চোখে তাকিয়ে সেটা খেয়ালও করলো ক্যান্ডেল। অন্যসময় হলে তাকানো নিয়ে ঝগড়া শুরু করতো ক্যান্ডেল। কিন্তু এখন সে সুযোগ নেই। তাই চুপচাপ গাড়ি চালু করলো ক্যান্ডেল।
ইভান চুপচাপ নিজের ফোন বের করে ভিডিয়ো গেমে মনোযোগ দিলো।

তিরিশ মিনিট পেরিয়েছে। ক্যান্ডেল বিরক্ত হয়ে উঠেছে। কারণ শোরুমে আসার রাস্তাটা গুলিয়ে ফেলেছে ক্যান্ডেল। এই শোরুমটায় আগে আসে নি ক্যান্ডেল। আজই প্রথম। ভেবেছিলো জিপিএস দেখে আসতে পারবে। আর জিপিএস অনুযায়ী সে ঠিক জায়গাতেই এসেছে। তাও শোরুমের ‘শ’-ও চোখে পড়ছে না। ইতিমধ্যে এই জায়গার আশপাশও চক্কর লাগানো হয়ে গেছে।
অদ্ভুত তো! শোরুম কি ভ্যানিস হয়ে গেলো?
এরমধ্যে ইভানের দিকে কয়েকবার আড়চোখে তাকিয়েছে ক্যান্ডেল। সে আপন মনে কার রেসিং গেম খেলছে। এদিকে যে কত সময় হয়ে গেছে ওরা গন্তব্যে পৌঁছায় নি সে খেয়াল নেই তার।
ক্যান্ডেল শোরুম খুঁজতে থাকার দরুন খুব ধীর গতিতে গাড়ি চালাচ্ছিলো। এবার ব্রেক কষে থামিয়ে দিলো গাড়িটা।(লেখিকা লাকি নোভা)
ঢোক গিলে গলা ভিজিয়ে তাকালো ইভানের দিকে।
সে এখনো আয়েস করে বসে গেম খেলছে। গাড়ি থেমেছে, এবার তো চোখ তুলে তাকানো উচিত। আজব!
ক্যান্ডেল আমতাআমতা করতে লাগলো।
‘শোরুম খুঁজে পাচ্ছি না’ এই কথাটা বলতেও যেন কেমন লাগছে। কী লজ্জাজনক একটা বিষয়! নিজেদের শোরুমই চিনে আসতে পারলো না।
“বের হও।”
ইভানের কথায় ধ্যান ভাঙলো ক্যান্ডেলের। ভ্রুকুটি করে তাকালো ইভানের দিকে।
ইভান ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে নিতে নিতে তুচ্ছ চাহনিতে চেয়ে বলল, “চেনোই না সেটা আগে বললে আমাদের এই তিরিশ মিনিট বেঁচে যেত।”
হতভম্ব হয়ে গেলো ক্যান্ডেল। এই লোক সব খেয়াল করেছে!
ক্যান্ডেল মুখ ফস্কে বলে ফেললো, “এতসময় ধরে আমি খুঁজে যাচ্ছি দেখেও কিছু বলো নি কেনো?”
“আমি কেনো বলতে যাব? আর তুমি যে কোনো কাজেরই না সেটা আমি কীভাবে জানবো? অবশ্য, জানলে আমি কখনোই এই প্রজেক্টে তোমাকে রাখতে দিতাম না।” সীটবেল্ট খুলতে খুলতে দায়সারাভাবে বলল ইভান।
কথাগুলো তীরের মতো বিঁধলো ক্যান্ডেলের শরীরে। নিজের রাগ দমাতে চেয়েও পারলো না ও।
“তোমার মতো ফালতু লোকের সাথে আমারও কাজ করার ইচ্ছে নেই। যত্তসব!”
ইভান শীতল দৃষ্টিতে তাকালো ক্যান্ডেলের দিকে। মেয়েটার সত্যিই মাথায় রক্ত তুলে দেওয়ার ক্ষমতা আছে। কিন্তু ইভান যত যাই হোক চেঁচামেচি করে কোনো কিছু করতে পছন্দ করে না। সে ঠান্ডা মাথায় কাজ করতে পছন্দ করে। এক কথায় ঠান্ডা মাথার খুনি যাকে বলে।
তাই তর্কে জড়ালো না। বরং ক্যান্ডেলের এই কথার জবাবটা তুলে রাখলো।
ইভান বেরিয়ে গেলো গাড়ি থেকে। ক্যান্ডেল রাগান্বিত চোখটা ঘুরিয়ে ইভানকে দেখতে দেখতে সে এসে দাঁড়ালো ওর পাশের দরজায়। নির্লিপ্ত চোখের ইশারায় বেরিয়ে আসতে বলল। অর্থাৎ সে ড্রাইভ করবে।
দাঁত কিড়মিড়িয়ে নেমে পড়লো ক্যান্ডেল। ইভান বসলো ড্রাইভিং সীটে। আর ক্যান্ডেল ওর পাশে।
মিনিট দশেকের মধ্যেই শোরুমে এসে পড়লো ওরা। গাড়িটা নির্দিষ্টভাবে একপাশে পার্ক করে নেমে পড়লো ইভান।
ক্যান্ডেল খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে লাগলো আশপাশ। অবশেষে বুঝলো, জিপিএসে লোকেশনই ভুল দিয়েছিলো ক্যান্ডেল।
নিজের কপাল নিজের ঠুকে মরতে ইচ্ছে হলো ওর। কী লজ্জাজনক!

ক্যান্ডেলের আজ কপালটাই খারাপ। কোনো কিছু ঠিক মতো হয় নি। প্রডাক্ট, কস্টিউম কোনোটাই ঠিক নেই। এখানেও কথা শুনতে হলো। খুব কৌশলে করা অপমান যাকে বলে। তবে প্রত্যেকটা কথাই গায়ে লাগার মতো। যেমনটা গাড়ির মধ্যে বলেছিলো।
দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো ক্যান্ডেল। উবারে কল করে করে গাড়ি পেয়েছে তাও আসতে আধাঘণ্টা লাগবে বলেছে। ততসময় দাঁড়িয়েই থাকতে হবে। আর নাহলে ইভানের সাথে ফিরতে হবে। যেটা করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ক্যান্ডেলের নেই।
এই লোকের ধারে কাছেও আর থাকতে চায় না ক্যান্ডেল। তিন বছর জব করছে ও। এর মধ্যে কেউ এত কথা শোনায় নি যত কথা এই লোক তিনদিনে শুনিয়ে ফেলেছে। তিনদিনও তো নয়। দুইদিন।
কেমন অসহ্যকর একটা অনুভূতি হচ্ছে। সব দোষ ওই ফালতু রাতটার। চিন্তা করেই আবার অপ্রতিভ হয়ে উঠলো ক্যান্ডেল। মাথা এদিক ওদিক ঝেড়ে দাঁড়ালো চুপ করে।(লেখিকা লাকি নোভা)
ইভান এখনো শোরুম থেকে বেরোয় নি। বের হলেই ওর চেহারাটা দেখতে হবে। তার আগেই জায়গাটা ছাড়তে পারলে বাঁচতো ক্যান্ডেল। কিন্তু তা বোধহয় সম্ভব নয়।
চোখ বন্ধ করে অস্বস্তিকর একটা নিঃশ্বাস ফেলতে না ফেলতেই পুরো শরীর এক বালতি পানিতে ভিজে গেলো ক্যান্ডেলের। হকচকিয়ে চোখ খুললো ক্যান্ডেল। নিজের দিকে তাকাতেই চোখ চড়কগাছ হয়ে গেলো। আর মুখ হয়ে গেলো বোয়াল মাছের মতো হা।
ক্যান্ডেল হা করা মুখেই মাথা তুলে পানির উৎসের দিকে তাকাতেই একটা মেয়ে জিভ কেটে বালতি হাতে দৌড়ে বারান্দা থেকে পালালো।
বাসার কাজের লোক হয়তো। ময়লা পানি সরাসরি বারান্দা দিয়ে ফেলতে গিয়েই এই অকাজ করে বসেছে।
বিষয়টা বুঝে রাগে, ক্ষোভে গা ঝিম মেরে উঠলো ক্যান্ডেলের৷ ইচ্ছে করছে ওই মেয়ের চুলের মুঠি ধরে পেদাতে। শহরের মধ্যে কোন আক্কেলে বারান্দা দিয়ে পানি ফেলে ও?
অবশ্য এতে মেয়েটারো দোষ নেই। কারণ ক্যান্ডেল রোদ থেকে বাঁচতে যে বিল্ডিং এর পাশে ছায়ায় দাঁড়িয়েছে, সেটার পাশেই ব্যাপার জায়গা ফাঁকা। ঘাস লতাপাতা দিয়ে আবৃত। জায়গাটা নোংরা না হলেও চিপসের প্যাকেটসহ বিভিন্ন ছেড়া কাগজপত্র, পলিথিন পড়ে আছে৷ হয়তো বিল্ডিং এর মানুষেরাই ফেলে। সেই আক্কেলেই মেয়েটাও পানি ফেলেছে। খেয়াল করেনি যে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে।

বুক ফুলিয়ে বড় বড় শ্বাস নিচ্ছে আর ফেলছে ক্যান্ডেল। আশেপাশের সবাই ঘুরে ঘুরে তাকাচ্ছে ওর দিকে।
ক্যান্ডেল পুরো ভিজে গেছে। ভেজা বেড়াল বলা চলে। গায়ের সাথে লেপ্টে গেছে হালকা গোলাপি রঙের লং টপসটা। মাথার চুলগুলোও ভিজে গেছে। পানি গড়াচ্ছে চুলের প্রান্তভাগ থেকে।
গা ঘিনঘিন করছে ক্যান্ডেলের। নিজেকে আবর্জনা লাগছে। গোসল না নেওয়া পর্যন্ত শান্তিই পাবে না ও।
ইভান বের হলো শোরুম থেকে। সরাসরি চোখ পড়লো রাস্তার ওপর পাশে ভিজে ছুপছুপ হয়ে থাকা ক্যান্ডেলের দিকে। ব্যাপারটা বুঝতে না পারায় কপাল আপনাআপনিই খানিক কুচকে গেলো ইভানের।

ক্যান্ডেল একমনে দাঁত কিড়মিড়িয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। মানুষজন ঘুরে ঘুরে তাকাচ্ছে ক্যান্ডেলের দিকে। আড়চোখে দেখেই সেটা বুঝতে পারছে ক্যান্ডেল। উবার আসা অব্দি কিনা মানুষের হাসির পাত্রী হয়ে রাস্তায় সং হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়!
তাছাড়া ভিজে শরীরে উবারে কি তুলতে চাইবে?
ভেবেই মুখটা থমথমে হয়ে গেলো ক্যান্ডেলের। ক্রোধে শরীর জ্বলে উঠলো ওর।(লেখিকা লাকি নোভা)
রিক্সাতে গেলেও তো মানুষজন হাসবে।
উফ! কী অসহ্য। নিজের চুল টেনে ছিড়তে ইচ্ছে করছে ক্যান্ডেলের। সাথে ওই মেয়েটাকেও খুন করতে ইচ্ছে করছে ওর।
ওর ভাবনায় ছেদ ফেলে ইভান গাড়ি থামালো ওর সামনে। থমকালো ক্যান্ডেল। ইভান ওর দিকে না তাকিয়েই স্থির গলায় বলল, “Hop in.”
ক্যান্ডেল কয়েক সেকেন্ডের জন্য এদিক ওদিক তাকালো। লোকটার সাথে যাবার ইচ্ছে না থাকলেও এখন উপায় নেই। তাছাড়া গাড়িতে না যাওয়ার কথা তো ক্যান্ডল বলে নি ইভানকে। তাই মানসম্মান খোয়ানোর প্রশ্নই ওঠে না। ভাগ্যিস বলে নি! নাহলে এই লোক নির্ঘাত ফেলে চলে যেত। আর পথের কাছে গুনে গুনে পঁচিশ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকতে হতো ক্যান্ডেলকে।
আর যদি উবারের লোক ভিজে শরীরে গাড়িতে তুলতে না চাইতো তাহলে তো আরোই বিপদে পড়তো ক্যান্ডেল।

নোংরা পানিতে ভিজে চিটচিট করা শরীরে শান্তিতে বসতেও পারছে না ক্যান্ডেল। গায়ের সাথে জামাটা লেপ্টে আছে বলে আরো অস্বস্তি হচ্ছে ওর। স্কার্ফ দিয়ে সম্পূর্ণ গা ঢাকাও সম্ভব নয়। এদিকে পাশের লোকটার চরিত্র সমন্ধে ক্যান্ডেলের খুব সুন্দর একটা ভুল ধারণা আছে। যদিও ইভান একবারো ওর দিকে তাকায় নি এখনো। তাও ক্যান্ডেলের ধারণা এই লোক ঠিকই সব খেয়াল করেছে। ‘লুচ্চা দ্য গ্রেট’ বলে কথা! কেমন যেন লাগছে ক্যান্ডেলের।

ইভান সামনের দিকে দৃষ্টি রেখে গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে সীটে ঝুলানো নিজের কোটটা নিয়ে ক্যান্ডেলের দিকে বাড়িয়ে দিলো।
ক্যান্ডেল তাকালো ভ্রুকুটি করে। এটা দিচ্ছে কেনো এই লোক?
“জড়সড় হয়ে না থেকে এটা নেও আর গায়ে জড়াও।” সামনের দিকে দৃষ্টি রেখে ঠান্ডা গলায় বলল ইভান।
ক্যান্ডেল কটাকটা গলায় বলল, “কেনো? এটা জড়াবো কীসের জন্য?”
ক্যান্ডেলের ত্যাড়া কথায় গোপনে একটা বিরক্তির নিঃশ্বাস ফেললো ইভান। যে কেউ বুঝবে ওর কাঁচুমাচু ভাবটা। তাও ঘাড় ত্যাড়ামি করছে।
“তুমি জানো না কেনো জড়াতে হবে? নাকি এটাও আমার বলে বুঝিয়ে দিতে হবে?” সরাসরি প্রশ্ন ছুড়লো ইভান।
গায়ে আগুন জ্বলে উঠলো ক্যান্ডেলের। কথার ধাঁচ এত ফালতু এই লোকের!
“লুচ্চা।” মুখ ঘুরিয়ে বিড়বিড়িয়ে বলে উঠলো ক্যান্ডেল।
সাথে আরো কয়েকটা শব্দও বিড়বিড়ালো ক্যান্ডেল। যার সবটাই কানে এলো ইভানের। নিমিষেই খিঁচড়ে গেলো মেজাজটা। নিজের সীটের পাশে রেখে দিলো কোটটা। কিছুক্ষণ পর বিনাবাক্যে রাস্তার পাশে গাড়ি থামালো ইভান।(লেখিকা লাকি নোভা)
ক্যান্ডেল ভ্রু কুচকে আড়চোখে তাকালো ইভানের দিকে। হঠাৎ গাড়ি থামালো কেনো?
ইভান এবার সরাসরি তাকালো ক্যান্ডেলের দিকে। তার চোখে স্পষ্ট রাগ। মুখটা থমথমে।
ক্যান্ডেল আড়চোখে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে বিষয়টা কী।
রেগে যেহেতু গেছে তারমানে একটু আগে বিড়বিড়িয়ে বলা কথাগুলো শুনেছে? হাহ্! শুনলেও কী? এই কয়েকদিনে তো প্রমাণ হয়েই গেছে সে কেমন। তাই লুচ্চাকে তো লুচ্চা বলা দোষের নয়।
তবে ইভানকে নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে বেশ চিন্তায় পড়ে গেলো ক্যান্ডেল। চোখা দৃষ্টিতে ও তাকালো ইভানের দিকে। কী করতে চাইছে লোকটা?

ইভান ক্যান্ডেলের মুখের দিক থেকে চোখ সরিয়ে ওর গায়ের দিকে তাকাতেই চরম বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে গেলো ক্যান্ডেল। সরাসরি না তাকিয়েও বুঝতে পারলো ও। চোখের পাপড়িগুলো কেঁপে উঠলো। শিউরে উঠলো পুরো শরীর। কাঁচুমাচু হয়ে জামা টেনেটুনে বলল হালকা তেজী স্বরে বলল, “অসভ্যতা করছেন আপনি।”
ইভান ভ্রু উঁচু করে একটা ড্যাম কেয়ার ভাব নিয়ে বলল, “ওহ! কিন্তু কীভাবে?”
ঢোক গিললো ক্যান্ডেল। খুব অস্বস্তি হচ্ছে। সরাসরি তাকাতেও পারছে না।
“আজকে ব্লাক কালার!”
আচমকা ইভানের বলা এই তিনটা শব্দে শরীর ঝাঁকি দিয়ে উঠলো ক্যান্ডেলের। ঘাম ছুটে গেলো রীতিমতো। আচমকা খাচায় বন্দি হয়ে যাওয়া পাখির মতো ছটফটিয়ে উঠলো ও। শিরশির করে উঠলো সারা শরীর।
ইভান সীটবেল্ট খুলে ক্যান্ডেলের দিকে ঝুঁকলো। একহাত সীটের পাশে অন্যহাত গাড়ির জানালার কাচে রাখতেই হকচকিয়ে মাথাটা পিছিয়ে নিলো ক্যান্ডেল। অজানা আতঙ্কে বুক ধুকপুক শুরু করলো।
ইভান রাস্তার দিকে ইশারা করে প্ররোচিত কণ্ঠে বলল, “রাস্তাটা ফাঁকা। কেউ নেই দেখো। তুমি চাইলে আমরা কিছুক্ষণ প্রাইভেট টাইম স্পেন্ড করতে পারি। খুব ঘনিষ্ঠভাবে। কেউ জানবেও না। শুধু তোমার আর আমার মধ্যেই থাকবে।”
কান ঝাঁঝাঁ করে উঠলো ক্যান্ডেলের। চেহারার রঙ রক্তিম হয়ে গেলো লজ্জায়, অপমানে। মৃদুভাবে কেঁপে হয়ে উঠলো সমস্ত শরীর।
ভয়ে ভয়ে রাস্তার দিকে তাকালো ক্যান্ডেল। লোকটা কোন রাস্তায় নিয়ে এসেছে গাড়িটা! সত্যিই তো কেউ নেই।
“এত ভাবার কী আছে? Let’s do it.” ইভান আরেকটু ঝুঁকে আসতেই চমকে উঠলো ক্যান্ডেল। দ্রুত দরজার দিকে ঘুরে দরজাটা খোলার জন্য হাত বাড়াতে যাওয়ার আগেই ইভান জালানাতে রাখা হাতটা নামিয়ে দরজার হ্যান্ডেল ধরে নিলো। ধক করে উঠলো ক্যান্ডেলের বুক। আতঙ্কে ফ্যাকাসে হয়ে গেলো পুরো মুখ।
ইভান সমস্বরে বলে উঠলো “আজ তোমাকে কোথাও পালিয়ে যেতে দিচ্ছি না। কারণ আজ অসভ্যতা, নির্লজ্জতা, বেহায়ামি আর লুচ্চামি সব দেখেয়েই ছাড়বো তোমাকে।”
বলতে বলতে গাড়ির দরজা লক করে দিলো ইভান।
না চাইতেও ঘাবড়ে গেলো ক্যান্ডেল। ভয়ে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হলো।

ইভানকে টাই খুলতে দেখে বুকটা হুহু করে উঠলো ক্যান্ডেলের। কোনোমতে তোতলানো গলায় বলল, “কাছে আসলে কিন্তু আমি…”
“কিছুই করতে পারবা না তুমি।” শক্ত চোখে তাকিয়ে বলতে বলতে টাই খুলে ফেললো ইভান।
ক্যান্ডেল ছটফটিয়ে উঠে দরজার লক খোলার জন্য হাত বাড়ালো।
সাথে সাথে হাতটা ধরে নিলো ইভান।
ভয়ে শিউরে উঠলো ক্যান্ডেল। পুরো সাদা হয়ে গেলো চেহারার রং। অন্যহাতটা দিয়ে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই সেটাও মুঠোবন্দি করলো ইভান।
ক্যান্ডেল আরো ঘাবড়ালো। হাত মোড়ামুড়ি করে কান্নার ভাবটা আটকে রেখে বলল, “ছাড়ুন আমায়।”
“অসভ্যতা করার আগেই ছাড়তে বলছো?” তেরছাভাবে বলল ইভান।
মুখ শুকিয়ে গেলো ক্যান্ডেলের। চোখ স্পষ্ট আতঙ্ক ছেপে উঠলো।(লেখিকা লাকি নোভা)

“ভালোভাবে রাজি না হলে অন্য পথও জানি আমি। যেমন ধরো এই টাই-টা দিয়ে তোমার হাতদুটো বাঁধবো। আর তোমার এই সুন্দর স্কার্ফটা টেনে খুলে তোমার মুখটা। তারপর তোমার এই সুন্দর জামাটা ছিড়ে টুকরো টুকরো করবো। এরপর তোমার এমন হাল করবো যাতে তুমি দ্বিতীয়বার এই মুখটা কাউকে দেখাতেই না পারো।”
আঁতকে উঠলো ক্যান্ডেল। থমকে গেলো বুকের স্পন্দন। অতিরিক্ত ভয়ে অসাড় হয়ে এলো হাত পা।
ক্যান্ডেল বুঝলো ওর শরীর নেতিয়ে পড়তে চাইছে। চোখদুটো বন্ধ হয়ে আসছে। কিন্তু ক্যান্ডেল কোনোমতেই এই মুহূর্তে ঢলে পড়তে চাইছে না। অসম্ভব। লোকটা যদি সত্যিই কিছু করে ফেলে? একদম সুযোগ দেওয়া যাবে না। একদম যাবে না।
ইভান আরো কিছু বললো হয়তো। কিন্তু ক্যান্ডেলের কানে গেলো না। তার আগেই নিস্তেজ হয়ে পড়লো ওর শরীর। জ্ঞান হারিয়ে হেলে পড়লো ইভানের বুকে।

🌼
ত্রয়ীর মুখটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। কাল থেকেই খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে সে। খুব কষ্ট হচ্ছে। নুহাস এখনো ফোন করে নি। ত্রয়ীও ফোন করে পায় নি৷ এমন একটা মূহুর্তে সে কী করে ফোন বন্ধ করে বসে আছে তাই ভেবে পাচ্ছে না ত্রয়ী।
কালকের দিনটা শুধু আছে হাতে। তারপর ঘরোয়া ভাবে বিয়েটা হয়ে যাবে। আর কিছু করার থাকবে না। কেঁদে ফেললো ত্রয়ী।
“কী রে! কী হলো তোর? দরজাটা খোল। খাবি দাবি না নাকি?” আহাজারি করে দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে বললেন সাবিহা।
ত্রয়ী চট করে মাথা তুলে চোখের জল মুছলো। নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে দরজা খুললো।
সাবিয়া ভ্রু কুচকে ফেললেন মেয়ের চোখ মুখ দেখে। চোখ বসে গেছে একদম। চোখের আর নাকের লাল ভাবটা জানান দিচ্ছে মেয়ে কান্নাকাটি করেছে। কিন্তু কেনো? বিয়ে বলে?(লেখিকা লাকি নোভা)
“কী হয়েছে তোর? কান্নাকাটি করছিস কীজন্য?”
ত্রয়ী হাসার চেষ্টা করে বলল, “কই না তো?”
খুব দুর্বল শোনালো কণ্ঠটা।
সাবিহা কাছে এগিয়ে এসে কিছু বলতে চাওয়ার আগেই ফোন বেজে উঠলো। বুকের ভিতরটা মোচড় দিলো ত্রয়ীর। নুহাস!
দেরি না করে মায়ের সামনে থেকে সরে বিছানার কাছে এলো ত্রয়ী। খুব আশা নিয়ে ফোন হাতে নিলো। কিন্তু অচেনা নম্বর দেখে মুখটা হতাশ হয়ে গেলো নিমিষেই।
“কে ফোন করেছে? ধর। তারপর খেতে আয়।” বলতে বলতে হন্তদন্ত করে চলে গেলেন সাবিহা। তার রান্না চাপানো গ্যাসের উপরে। পুড়ে গেলে সমস্যা।
ত্রয়ী ফোন তুলে কানে দিলো।
“হ্যালো?”
“ধরেছো এতক্ষণে?” কটাক্ষ করে বলল নীল।
ত্রয়ীর কপাল কুচকে গেলো।
“যাইহোক। তোমার সাথে যে রুমে কথা বলেছিলাম ওই রুমে যাও। গিয়ে যে বুক শেলফটা আছে সেটার একদম উপরের তাকের কোণায় দেখো। একটা হলুদ খাম আছে। খামটা খুললেই সব উওর পেয়ে যাবা।” গম্ভীর গলায় বলল নীল।
“কীসের উওর? আর কীসের খাম?”
“গিয়ে দেখো। তারপর তুমি যেটা চাও সেটাই হবে।”
নীলের কথায় ভ্রুতে আরেকটু ভাঁজ পড়লো ত্রয়ীর।
“রাখছি।” বলে ফোন কাটলো নীল।
ত্রয়ী ফোন হাতে দাঁড়িয়ে চিন্তা করতে লাগলো যে এমন কী আছে সেই খামে? আর ও যেটা চাইবে সেটাই হবে মানে কী?
“খেতে আসিস না কেনো?” নিচ থেকে চেঁচিয়ে উঠলেন সাবিহা।
ত্রয়ীর খাওয়ার ইচ্ছে না থাকলেও মায়ের বকাবকিতে নিচে এলো। বাধ্য হয়ে খাবারও খেলো খানিক।
সাবিহা সবই খেয়াল করলেন। ত্রয়ীর অন্যমনস্কতা। হতাশ ভাব। বিয়ের জন্য তো এত মন খারাপ হওয়ার কথা নয়। তাহলে কী হয়েছে?
অবশ্য ত্রয়ী মুখ ফুটে না বললে তিনি বুঝবেন কী করে?
সাবিহা ঠিক করলেন আজ রাতে নিরিবিলি সব জিজ্ঞেস করবেন ত্রয়ীকে।

ত্রয়ী সেই রুমে বুক শেলফের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। হলুদ খামটা চোখেও পড়েছে। বুঝতে পারছে না লোকটা হলুদ খাম এখানে কবে রাখলো।
যেদিন এসেছিলো, সেদিন? হয়তো।
ত্রয়ী খামটা বের করে আনলো। ভ্রুকুটি করে ছিড়লো খামের মুখটা।
খাম উলটে নিতেই কতগুলো ছবি বেরিয়ে এলো সেটা থেকে। সেগুলো হাতে নিয়ে দেখতেই বড়ো রকমের ধাক্কা খেলো ত্রয়ী। মাথাটা ঘুরে উঠলো যেন। শ্বাস নিতেও কষ্ট হতে লাগলো।
স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে বেগ পেতেই হাতে আঁকড়ে ধরলো বুক শেলফের মাঝের তাকটা।

🌸
প্রায় ঘণ্টাখানেকে পর চোখ পিটপিটালো ক্যান্ডেল। সময় নিয়ে তাকালো পুরোপুরিভাবে। বার করেক পলক ঝাপটিয়ে বুঝতে চেষ্টা করলো সে কোথায় আছে।
গাড়ির মধ্যে!(লেখিকা লাকি নোভা)
ভ্রুকুটি করে কিছু চিন্তা করতে লাগলো ক্যান্ডেল। ঘণ্টাখানেক আগের ঘটনা মনে পড়তেই শিউরে উঠলো ক্যান্ডেল। প্রথমেই নিজের শরীরের দিকে তাকালো। গায়ের উপর একটা কোট রাখা।
চোখ বড়োসড় করে করে চট করে ড্রাইভিং সীটের দিকে তাকালো ক্যান্ডেল।
ইভান সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো। চোখাচোখি হতেই ঢোক গিলে জড়সড় হয়ে বসলো ক্যান্ডেল। আড়চোখে তাকিয়ে চিন্তা করতে লাগলো কী হয়েছিলো জ্ঞান হারানোর পরে? কিছু করেনি?
নিজের দিকে আরেকবার দেখলো ক্যান্ডেল।
নাহ, জামাকাপড় তো ঠিকই আছে।
ক্যান্ডেল আরেকবার তাকালো ইভানে দিকে। তাকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে অগোছালোভাবে চোখ সরালো ক্যান্ডেল। এলোমেলোভাবে জালানার দিকে দৃষ্টি ফিরালো।
কী সাংঘাতিক ভয়টাই না পেয়েছিলো ও। ভেবেছিলো সত্যিই লোকটা কিছু করে ফেলবে। চিন্তা করলেই তো ভিতরটা কেঁপে ওঠে।
ইভান গাড়ি স্টার্ট দিলো।
আরেকবার আড়চোখে ইভানের দিকে তাকালো ক্যান্ডেল। সে গম্ভীর মুখে মনোযোগ দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে।
ক্যান্ডেল ভ্রুকুটি করে জালানার দিকে ফিরলো। অদ্ভুত লোক তো! এভাবে ভয় দিয়ে কী পেলো সে! অসভ্য লোক।
মনে মনে আওড়ালো ক্যান্ডেল৷ ভুল করেও এই শব্দ জোরে উচ্চারণ করবে না ও। ভয়ে তটস্থ সে।

অফিসে ফিরে ফাইলগুলো গুছিয়ে নিলো ক্যান্ডেল।
ইভানের কোটটা রাখলো চেয়ারের পিছনে। গায়ের জামা এতক্ষণে শুকিয়ে গেছে। তাছাড়া এই লোকের কোট ওর রাখারও ইচ্ছে নেই।
ইভান ওর পাশে বেশ দূরত্ব রেখেই দাঁড়িয়ে আছে। না তাকিয়েও ক্যান্ডেল বুঝতে পারছে যে সে তীর্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে ওকে।
ক্যান্ডেল তো কোনোমতে এখান থেকে বের হতে পারলেই বাঁচে। গাড়ির ঘটনার জন্য এখনো গা শিউরে শিউরে ওঠে। কী ভয়ানক!(লেখিকা লাকি নোভা)
ক্যান্ডেল দ্রুত ফাইলগুলো ঠিকঠাক করে নিলো। তারপর বেরিয়ে যাওয়ার জন্য দরজার কাছে গিয়ে নব ঘুরিয়ে খুলতেই পিছন থেকে দরজা ঠেলে দিলো ইভান।
ধরাম করে বন্ধ হয়ে গেলো দরজা। হকচকিয়ে উঠলো ক্যান্ডেল। ঢোক গিলে আস্তে আস্তে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো পিছন দিকে।
ইভানকে পিছন থেকে একদম কাছে আবিষ্কার করে চুপসে গেলো ভয়ে।
ইভান পিছন থেকে আরেকটু এগিয়ে আসতেই ধড়ফড়িয়ে দরজার সাথে লেপ্টে গেলো ক্যান্ডেল। ভয়ে ধক ধক করতে লাগলো বুকের ভিতরটা। যদিও যথেষ্ট স্বাভাবিক মুখ করে থাকার চেষ্টা চালালো ক্যান্ডেল।
ইভান শীতল চোখে তাকিয়ে ধীর গলায় বলল, “ভবিষ্যতে আমার চরিত্র নিয়ে আরেকটা বাজে কথা বললে, আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।”
থমকে গেলো ক্যান্ডেল। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো একদম।

(চলবে…)

(লেখিকা লাকি নোভা)
(গল্প কপি সম্পূর্ণ নিষেধ।)