কুঁড়েঘর পর্ব-০৭

0
485

#কুঁড়েঘর
#লেখিকা–মার্জিয়া রহমান হিমা
। পর্ব ০৭ ।

রাত হয়ে যাওয়ায় রিধিশা হেটে বা এসে রিকশা নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে চলে যায়।
নিশাদ, রেহান, সূর্য, সাদি চারজন তাদের ফ্ল্যাটে ফিরে আসে। ফ্রেশ হয়ে ফ্লোরে বসে পরে নিশাদ সিগারেট নিয়ে। আজ সারাদিন একটাও খাওয়া হয়নি।
সূর্য ড্রইংরুম থেকে পানি খেয়ে নিশাদের রুমে আসলো। পাশে বসে একটক সিগারেট জ্বালিয়ে বললো
” ব্যাপার কি বলতো? আসার সময় তোকে নাকি রেহান খুঁজে পাচ্ছিলো না?”

নিশাদ ধোয়া ছেড়ে জানলার দিকে তাকিয়ে বললো
” হুম একটু দূড়ে গিয়েছিলাম তাই।” সূর্য গভীর দৃষ্টি দিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে নিশাদকে।
কিছুক্ষণের মধ্যে সাদি আর রেহানও আসলো।
” তোর ভাব সাব ঠিক লাগছে না কেনো জানি। পিকনিকে গিয়ে দেখলাম রিধিশা মেয়েটার পেছনে পেছনে ছিলি। কেমন কেয়ার করছিলি। বাসেও তো ওর সাথেই লেট করে এসেছিলি। তুই কি প্রেমে টেমে পড়েছিস?”

রেহানের কথা শুনে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালো নিশাদ। রেহান আমতা আমতা করে বলে
” না মানে বললে সমস্যা কি? আমরা তো বেস্টফ্রেন্ড নাকি!”
নিশাদ চিবিয়ে চিবিয়ে বললো
” বেশি বুঝিস তোরা এইজন্যই বিরক্ত লাগে। পিকনিকে পুরো গ্রুপের দায়িত্ব তো আমাদের উপরই ছিলো নাকি? না দেখলে যদি হারিয়ে যেতো তখন বদনাম তো আমাদেরই হতো।”

তিনজনই মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো। রেহান বলে উঠে
” কিন্তু বাস থামিয়ে কোথায় গিয়েছিলি?”
নিশাদ নিশ্বাস ফেলে তখনের ঘটনা বললো। তিনজিন উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছে। সব শুনে সূর্য বললো
” ভালো করেছিস। শত্রু হলেও কি মানুষ তো! যদি কিছু হয়ে যেতো হয়তো নিজেকে দায়ি করতি তুই।”

নিশাদ কিছু না বলে একের পর এক সিগারেট খাচ্ছে।
মাথায় রিধিশার কথা ঘুরছে। রিধিশার উপর রাগ থাকলেও আসার সময় রিধিশার চোখের পানি আর
চুপচাপ থাকাটা ভালো ঠেকছে না নিশাদের কাছে।
শান্তু পাচ্ছে না কোনোভাবে।
রেহানদের রুমে রেখেই বিছানায় শুতেই ঘুমিয়ে পড়লো।

.

রিধিশা অন্ধকার আচ্ছন্ন রুমে মাথার উপরে থাকা দেয়ালের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। চোখের ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছে তার জন্য আবারও।
সবাই যখন আজ বাসে উঠছিলো তখন মায়ের কল এসেছিলো আজ। কিছুটা দূড়ে কথা বলতে গিয়েছিলো।

ভালোমন্দ কথা বলার পর লিমা বেগম জানায়
“তোর বাবার হুটহাট কি পাগলামো ভাবনা চিন্তাও ঢুকে যাচ্ছে বুঝতে পারছি না আমি। তোর জন্য আবারও এক নতুন পাত্র দেখেছে। আমাকে না বলেই কথাবার্তা বলছে তাদের সাথে। ছেলেটা সরকারি চাকরি করে। তোর বাবা গতকাল আমাকে জানিয়েছে। আর বারবার বলছে বড় বাড়িতে বিয়ে দেবে তোকে। তুই সুখি হবি। ছেলের বাড়িতে বলেছে তুই ঢাকা থেকে পড়াশোনা করিস।”

রিধিশা অবাক হয় সব শুনে। উত্তরে বলেছিলো
” আম্মু তুমি কিছু বলছো না কেনো? বাবা আবারও আমার বিয়ের পেছনে কেনো লেগেছে? আর এতোদিন তো আমার উপর তো রেগে ছিলো।”
লিমা বেগম কাঁপাকাঁপা গলায় বলে
” জানি না। আমার সুখের সংসারে কার জানি নজর লেগেছে। তোর বাবার আবহাওয়া পরিবর্তন হচ্ছে মনে হচ্ছে আমার।”

রিধিশা রাগে দূঃখে কেঁদে বলেছিলো
” বাবা আমার এতোই ভালো করতে চায় যে তার জন্য আজ আমি এখানে এসে দাঁড়িয়েছি। আগে কি আমি ভালো ছিলাম না? মাঝে মাঝে আমার মতো সুখি মেয়ে কয়জন ছিলো সেটা ভাবি আমি। বেশি ভালো করতে গিয়ে সন্তানকে কোথায় পৌঁছে দিয়েছে সেটা ভাবতে বলো বাবাকে। আমার আর কোনো ভালো ভাবতে হবে না তাকে। আমি নিজের ভালো বুঝে নেবো আর না পাড়লে খারাপটাই ভালো থাকবে আমার জন্য।”
কথা বলতে বলতস হুশজ্ঞান হারিয়ে কোথায় এসেছিলো জানে না। এরপরেই নিশাদ এসে বাঁচিয়েছে।

রিধিশা শুধু তার বাবার পরিবর্তনের কথা ভেবে যাচ্ছে। তার বাবা আগে তার একমাত্র মেয়ে রিধিশা কিসে খুশি হতো সেই কথা ভাবতো। রিধিশা মা, বাবার আদরের দুলালী ছিলো। আর আজ নিজেই নিজের ভাত আর থাকার জায়গাটুকু জুটিয়ে নিচ্ছে কোনো ভাবে।
আজ এক বছর ধরে তার বাবা কখন কি ভাবে বুঝতে পারে না সে। হুট করে বাবার এমন পরিবর্তন অনেক ভাবায় তাকে। সত্যি, সময়ের সাথে সাথে কোন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয় কেউ জানে না।
রিধিশা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে গেলো।

_________

ঘুম থেকে উঠেই রিধিশা নাস্তা খেয়ে বাসা চেঞ্জ করার জন্য কিছু জিনিস পত্র গুছিয়ে নিতে থাকে। বাকি জিনিস গুলো লোক দিয়ে নিতে হবে। ভার্সিটি থেকে এসে বাসা চেঞ্জ করবে বলে ভাবলো।
.
এলার্মের শব্দে ঘুম ভেঙে যায় নিশাদের। নিশাদ চোখ কচলে উঠে বসে। ফ্রেশ হয়ে গিয়ে ড্রইংরুমের সোফায় বসে পড়ে। কাজের বুয়া নাস্তা তৈরি করে টেবিলে সাজিয়ে দিয়েছে। নিশাদকে দেখে কফি বানাতে চলে গেলো আবারও। নিশাদ টেবিলে বসে নাস্তা খেতে খেতে রেহানদের ডাকতে থাকে চিৎকার করে। মাঝরাতে গানের আওয়াজ এসেছিলো তার কানে। নিশ্চই এগুলো পার্টি করেছিলো তাকে রেখে।

সূর্য ঢুলতে ঢুলতে এসে টেবিলে বসে।
” তোরা মাঝরাতে লাউডস্পিকারে গান ছেড়ে পার্টি করছিলি। তোদের কমন সেন্স এর কি বলি দিয়েছিস? পাশের ফ্ল্যাটের লোক গানের জন্য ডিস্টার্ব হয়ে এসে বিচার দেয় তখন কে শুনবে সেসব?”
সূর্য বিরক্ত কন্ঠে বললো
” আরে ভাই আমরা করি নাই। আমরাও তো রাতে ঘুমাতে পারলামনা গানের জন্য। সাদি আর রেহান তো গান শুনে নাচছিলো। আমরা পার্টি করলে তোকে নিয়েই তো করি।”

নিশাদ ভ্রু কুঁচকে বললো
” তাহলে কে গান ছেড়েছিল রাতে?”
” আমি কি করে জানবো। দেখ পাশের ফ্ল্যাটেরই কেউ হবে।” নিশাদ কথা না বাড়িয়ে নাস্তা শেষ করলো। বুয়া কফি দিয়ে যায়। নিশাদ কফি খেতে খেতে ভার্সিটির জন্য তৈরি হতে থাকে। সূর্যও তৈরি কিন্তু বাকি দুজন ঘুমাচ্ছে। নিশাদ জ্যাকেট পড়তে পড়তে বললো
” ওদের উঠিয়ে আয় নাহলে আজ সারাদিন ঘুমাবে।”
সূর্য গিয়ে দুজনকে টেনে টেনে উঠায়। দুজন ব্রাশ করে দৌঁড়ে নাস্তা খেতে যায়। ভার্সিটিতে না গেলে তাদের দিন যায় না তাই ভার্সিটি মিস দেওয়া যাবে না।
নিশাদ আর সূর্য আগেই বেরিয়ে যায়।

রিধিশা ভার্সিটিতে এসে মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। ভেবেছিলো আজ বাসা চেঞ্জ করবে কিন্তু সাজেদা আন্টিকে ফোন করে জানতে পারলো আগের ভাড়াটিয়া এখনও জায়নি বিকেলে যাবে মাত্র। জোতি এসে বসলো রিধিশার পাশে। জোতি হেসে বললো
” কালকে সারাদিন কেমন কাটলো?”
রিধিশা মুচকি হেসে বললো
” ভালো, খুব ভালো লেগেছে। কিন্তু তোর খবর তো বললি না। কাল সেই ভাইয়াটার সাথে বসেছিলি বারবার। ছেলেটানে আমি ওই বজ্জাত ছেলের সাথে দেখেছিলাম।”

জোতি লজ্জামাখা হাসি দিয়ে বললো
” ছেলে ছেলে বলিস কেন তোর দুলাভাই হয়। নিশাদ ভাইয়ের বন্ধু রেহান নাম।”
রিধিশা অবাক স্বরে বললো
” কি! এসব কবে হলো?” জোতি বললো
” ওই আরকি হয়েগেছে। আচ্ছা তোর মাথায় কিসের দাগ এটা? ব্যাথা পেয়েছিস কিভাবে?” রিধিশা জোড়পূর্বক হেসে বললো
” ওই আরকি একটু টেবিলের কোণায় লেগেছিলো।”
কিছুক্ষণ পর দুজন ক্লাসের জন্য উঠে গেলো।

ব্রেক টাইমে দুজন ক্যান্টিনে গিয়ে বসলো। রিধিশা আজ টাকা আনেনি তাই আর কিছু অর্ডার করে না। জোতি দুজনের জন্যই স্যান্ডউইচ অর্ডার করে।
জোতি মোবাইল নিয়ে গুঁতোগুঁতি করতে দেখে ভাবে নিশ্চই রেহানের সাথে কথা বলছে।
রিধিশা এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে দেখে নিশাদকে দেখতে পেলো। নিশাদের দিকে তাকাতেই প্রথমে এক মুহূর্তের জন্য কিছুটা ভয় পেয়ে যায় কারণ নিশাদও ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

রিধিশা বুকে থু থু দিয়ে বিরবির করে বললো
” এভাবে ভূতের মতো তাকিয়ে আছে কেনো? আমি তো প্রথমে বাঘ ভেবেছিলাম।” খাবার আসতেই রিধিশা চোখ ঘুরিয়ে নেয় নিশাদের থেকে। দুজন খাওয়া দাওয়া শেষ করে বসে থাকে। জোতির খেয়ালই নেই একা একা উঠে চলে গেলো। রিধিশা বিরক্ত হয়ে জোতির কাছে যাবে বলে ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে গেলো। কিন্তু বের হতেই নিশাদ এসে সামনে দাঁড়ায়।

.

রিধিশা ভ্রু কুঁচকে বললো
” আপনার সমস্যা কি? বারবার পেছনে লাগছেন কেনো আমার? অদ্ভুত!” নিশাদ রাগি গলায় বললো
” অদ্ভুত আমি না তুমি? আমি দিয়েছিলাম বলে তো ব্যান্ডেজ দাওনি কাল। তো বাসায় গিয়ে তো দিতে পারতে!”
রিধিশা কপালে আলতো ছুঁয়ে বললো
” আমারটা আমি দেখে নেবো আপনার এতো ভাবতে হবে না। একটু ব্যাথা পেলেই ব্যান্ডেজ লাগাতে হবে এটা কোথায় লিখা আছে?”
নিশাদ রেগে কিছু বলতে গিয়েও বললো। জ্যাকেট টেনে মুখ ফুলিয়ে চলে গেলো। রিধিশা জোতির কাছে গেলো।

ভার্সিটি ছুটি হলে আজ আবারও সেই লেকের গাছে গেলো। গিয়ে কাঠগোলাপ গাছটার নিচে বসে রইলো।ফুল তার ভিষণ প্রিয় তেমনই লাল কাঠগোলাপ ফুল একটু বেশি প্রিয় তার। গ্রামে থাকতে অনেক খুঁজেও গাছটা পায়নি সে। বাবা বলেছিলো নার্সারি থেকে এই গাছসহ আরো অনেক গাছ এনে দেবে কিন্তু দেয়নি আর।

রিধিশা নিচে পরে থাকা একটা ফুল হাতে নিয়ে বসে থাকে। কি সুন্দর ফুলটা!
হুট করে কপালে ব্যাথা পাওয়া জায়গাটা জ্বলে উঠে। রিধিশা উফফ করে উঠে। কলিজা লাফিয়ে উঠেছে একটুতেই। রিধিশা চোখ উঠিয়ে উপরে তাকিয়ে নিশাদকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চোখ বড়বড় করে ফেলে। তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়ায়।

নিশাদ দাঁত কেলিয়ে বললো
” কালকে ভাব দেখিয়ে আমার দেওয়া ব্যান্ডেজ নাওনি কিন্তু আজ আমার দেয়া ব্যান্ডেজই তোমার কপালে লাগিয়ে দিয়েছি।”
রিধিশা হাত দিয়ে দেখলো সত্যি তাই। রিধিশা রেগে বললো
” আপনি তো মহা বজ্জাত লোক! আপনাকে বলেছি আমি ব্যান্ডেজ লাগাতে?” নিশাদ ঝুকে বললো
” তুমি বললেই আমি শুনবো নাকি? তুমি কি আমার বউ নাকি যে, তোমার কথা শুনে চলবো?”
রিধিশা রেগে বললো
” আপনার মতো ছেলের কপালে বউ’ই তো জুটবে না আমি তো কোম ছাড়!”

নিশাদ ভাব নিয়ে বললো
” ঠিল বলেছো তুমি নিশাদের বউ হওয়ার যোগ্য না। তাছাড়া তোমাকে বিয়েই বা কে করবে? ভাবের টাংকি একটা!”
” আপনার জন্য একটু শান্তিতে বসতে পারি না। বদ, বজ্জাত ছেলে একটা।”
নিশাদ কান ঝেড়ে বাইক নিয়ে চলে গেলো।
রিধিশা কপালের ওয়ানটাইম ব্যান্ডেজ খুলে ফেলতে চাইলে ব্যাথায় টনটন করে উঠে। হয়তো ছিলে গিয়েছে। কালকে বাসায় গিয়ে ব্যাথার দিকে খেয়াল দেয়নি।
.

রিধিশা বাসায় এসে খাওয়ার ইচ্ছে নেই তাও হালকা পাতলা খেয়ে টিউশনিতে চলে গেলো। দুদিনের বন্ধ নিয়েছিলো সব টিউশনি থেকে কিন্তু আজকে বাসা চেঞ্জ করা হয়নি তাই ভাবলো পড়িয়ে আসবে তাদের।

চলবে….