কুঁড়েঘর পর্ব-০৬

0
494

#কুঁড়েঘর
#লেখিকা–মার্জিয়া রহমান হিমা
। পর্ব ০৬।

সবাই ফুল টিমের সাথে হাটছে আর গল্প করতে ব্যস্ত। জোতি রিধিশাকে নিয়ে বারবার পেছনে পড়ে যাচ্ছে আর নিশাদের ধমক খেয়ে আবার দৌঁড়ে আসছে।
নিশাদ দুজনের দিকে তাকিয়ে রাগি গলায় বললো
” আর একবার যদি তোমাদের ডেকে আনতে হয় তাহলে ম্যামের কাছে বিচার দিবো। টিমের সাথে না থেকে এদিক ওদিক ঘুরছো কেনো?”
রিধিশা স্থির চোখে তাকালো নিশাদ বুঝলো না কোন রেগে নাকি কোন কারণে তাকানো হয়েছে এভাবে।

নিশাদ দুজনের পেছনে হাটছে। নিশাদের পেছনে তার বন্ধুরা রয়েছে তাদের মতো করে।
সবাই পাহাড়ে উঠতে থাকে। মিলি আবার এসে নিশাদের সাথে চিপকে লেগে থাকে।
নিশাদ বিরক্তিতে ঠাস ঠাস করে হাটছে।
” আচ্ছা নিশু! আমার অনেক পা ব্যাথা করছে, তুমি আমাকে কোলে নাও প্লিজ!”
পেছন থেকে সাদি বললো
” আরে নিশাদের হাতে আর পা’য়ে তো ব্যাথা একটু আগেই আমাকে বলল!”

” অহ মাই গড, কি বলছো! আরে আমাকে আগে বলোনি কেনো? তুমি কি কোথাও ব্যাথা পেয়েছো নাকি?” নিশাদ সাদির দিকে আড়চোখে তাকায়। তার তো কিছুই হয়নি আর কিছুই বলেনি।
সূর্য এগিয়ে এসে বললো
” আরে তেমন কিছু হয়নি তবে হয়েছে হলো, নিশাদের খাওয়া দাওয়া কম হচ্ছে অনেক থেকে তাই আর কি একটু ব্যাথা। তোমাকে তো কোলে নেওয়া একদমই সম্ভব না। তবে তুমি চাইলে রাউফ তোমাকে কোলে নিতে পারে।”

সূর্যর দিকে তাকিয়ে রাউফের দিকে তাকাতেই মিলির গা গুলিয়ে আসে। ছেলেটা দেখতে একদমই নরমাল ছেলেদের মতো না। ডিগ্রিপ্রাপ্ত একটা বখাটে ছেলে। রাউফ ভেটকিয়ে তাকিয়ে আছে। মিলি মুখ কুঁচকে বললো
” নাহ কাউকে দরকার নেই নিশাদ ছাড়া। নিশাদ! আমরা আরেকবার আসবো তারপর তুমি আমাকে কোলে নিয়ে উঠবে। একটা রোম্যান্টিক মোমেন্ট ক্রিয়েট হবে আর সবাই হা করে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকবে। আই এম ওয়েটিং ফর দিজ মোমেন্ট।”

রেহান বিরবির করে বললো
” তাহলে আর এই মোমেন্ট কখনই আসবে না আর তোমার ইচ্ছেও পূরণ হবে না।” সূর্যরা রেহানের কথা শুনে হাসলো
নিশাস কিছু না বলে হেটেই যাচ্ছে। তার দৃষ্টি সামনে থাকা রিধিশার দিকে। দুজন নিজেদের মতো হাটছে।

পাহাড়ের উপর পৌঁছে সবাই যার যার মতো এদিক ওদিক দেখতে থাকে। পাহাড়ে কিছু লোকের আনাগোনা চলছে যাদের দেখে বোঝা যাচ্ছে এরা স্থানীয় লোক।
রিধিশা পাহাড়ের এক কোণে দাঁড়িয়ে প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিলো। কতোদিন পর আবারও পাহাড়ে এসেছে। মুচকি হাসি দিয়ে সব দেখতে থাকে।
পাহাড় থেকে চারপাশে সব কিছু সবুজ দেখা যাচ্ছে। সবুজ গাছ-পালা সাথে কিছু উঁচু পাহাড়।

নিশাদ ক্যামেরা এনেছিলো কিছু ছবি তুলবে। একপাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছে সে, হুট করে একটা ছবি ক্লিক করে খেয়াল করলো সেটায় রিধিশাকে দেখা যাচ্ছে। অসাধারণ একটা ছবি। নিশাদ চেক করে দেখে আরো কিছু ছবি উঠেছে রিধিশা সহ।
রিধিশার থেকে কিছুটা দূড়ে জোতিও রয়েছে কিন্তু জোতির ছবি উঠেনি।

নিশাদ, রিধিশার কাছে কিছুটা এগিয়ে ধমক দিয়ে বললো
” এই মেয়ে কোনায় দাঁড়িয়ে আছো কেনো? একবার পড়ে গেলে তোমার বয়ফ্রেন্ডও উঠিয়ে আনবে না গিয়ে।”
রিধিশান তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে জতির কাছে গেলো।
সাদি সবাইকে ডেকে বললো
” এবার সবাই চলো অন্য জায়গায়ও যেতে হবে।”

সবাই পাহাড় থেকে নেমে কাপ্তাই হ্রদ যাচ্ছে।
এখানে এসে স্যাররা কিছু ট্রলার হায়ার করে। পানির ভয়ের কারণে রিধিশা সেখানে যাওয়া থেকে দূড়েই থাকলো তবে জোতিকে জোড় কিরে পাঠালো। মেয়েটা তার জন্য আনন্দ করবে না সেটা চায় বা রিদিশা।

নিশাদ ক্যামেরা দিয়ে পাহাড়ে ভিডিও করছে। দুপাশে পাহাড়ের মাঝে হ্রদের উপর টলার চলছে দৃশ্যটা অমায়িক সুন্দর। ট্রলার কিছু দূড় একটা পাহাড়ের কাছে গিয়ে থামলো। সবাই জায়গাটা দেখতে লাগলো। জায়গা গুলো প্রত্যেকটাই এতো সুন্দর! সবাই সব কিছু দেখছে আর অবাক হচ্ছে।

ঘুরাঘুরির পর্ব শেষ হতেই বাসে উঠার জন্য আবারও তাড়া দেয়। সবাই ধীরেসুস্থে উঠে বসে। নিশাদ চেক করে দেখলো তার দায়িত্বে যেই বাসটা রয়েছে সেখানে সবাই বসছে কিন্তু রিধিশাকে চোখে পড়লো না। নিশাদ বাস থেকে বেড়িয়ে দেখে জোতি এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।
নিশাদ গিয়ে বললো
” তুমি বাসে উঠছো না কেনো? আর কি খুঁজছো তুমি?”

জোতি ভীতু গলায় বললো
” আসলে ভাইয়া রিধি’কে খুঁজে পাচ্ছি না। কিছুক্ষণ আগে ওইদিকটায় হাটছিলো।”
“ঠিকাছে আমি ওকে নিয়ে আসছি তুমি বাসে গিয়ে বসো।” জোতি মাথা নেড়ে চলে গেলো।
নিশাদ জোতির দেখানো দিকে হাটতে থাকে।
” এসব মেয়েদের জন্যই সবার এতো প্রবলেম। এখন বাস ছেড়ে দেবে আর এখন কিনা তাকে কোথায় যেয়ে হলো! আস্ত বেয়াদব একটা মেয়ে।”

নিশাদ হাটতে হাটতে এগিয়ে যায় অনেকটা পথ। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলতে দেখলো রিধিশাকে। নিশাদ রেগে বোম হয়ে গেলো।
নিশাদ হনহন পায়ে রিধিশার কাছে এগোলো। সেদিক থেকে একটা ট্রাকের আসছে ভিষণ গতিতে। রিধিশার পাশ কাটিয়ে যেতেই রিধিশার এক্সিডেন্ট হয়ে যাবে।
নিশাদ আঁতকে দৌঁড়ে গিয়ে রিধিশার কোমড় পেঁচিয়ে সেখান থেকে সরিয়ে আনে।

সরে আসতেই একিটা গাছ ধরে দাঁড়াতে চায় নিশাদ কিন্তু গাছে ঠায় না পেয়ে দুজন অন্যটা গাছের সাথে বারি খায়। দুজনই ব্যাথা পেয়ে চেঁচিয়ে উঠে।
নিশাদ ব্যাথা পেয়ে কাধ ঝাড়তে লাগলো। আগের গাছটায় ঘষা লাগায় হাতের তালুর দিকে ছিলে গিয়েছে।

রিধিশাকে নিচে পড়ে থাকতে দেখে নিশাদ এগিয়ে গেলো। রিধিশার সামনে বসে দেখে রিধিশার চোখ বন্ধ। নিশাদ কয়েকবার ডেকে বুঝলো মেয়ে জ্ঞান হারিয়েছে। নিশাদ নিজের মাথার চুল টানলো। কি করবে এখন?
নিশাদ রিধিশাকে কোলে উঠিয়ে হাটতে থাকে যেখানে বাস দাঁড়িয়ে আছে সেই রাস্তায়। পথে একটা দোকান আছে সেখানে অয়ানি আছে কিনা দেখতে হবে।

দোকানে এসে একটা চেয়ার আর পানির বোতল দিতে বললো দোকানে বসে থাকা ছেলেটাকে। নিশাদ রিধিশাকে বসিয়ে দেখে মাথা ছিলে গিয়েছে। মাথায় বোধয় বারি খেয়েছে। রিধিশার চোখের কোণে পানিও দেখতে পেলো। নিশাদ ভ্রু কুঁচকে তাকালো
” মেয়েটা কি কাঁদছিল? কিন্তু ব্যাথা পেয়েই তো অজ্ঞান হলো কাদলো কখন? তাহলে আগে কাঁদছিল হয়তো।”

নিশাদ রিধিশার চোখে মুখে পানি দিতেই রিধিশা ধীরেধীরে চোখ খুলে। নিশাদকে ভ্রু কুঁচকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রিধিশা সাথে সাথে উঠে দাঁড়ায়। পড়তে গিয়েও চেয়ার ধরে দাঁড়িয়ে যায়। নিশাদ রেগে বললো
” এই তোমার সমস্যা কি বুঝিনা আমি। আমাকে জালানো ছাড়া আর কোনো কাজ আছে তোমার? রাস্তা দিয়ে বড় বড় বাস, ট্রাক যাচ্ছে বারবার সেখানে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলে তুমি! মাথা গিয়ে গোবর ঠেসে রেখেছো? আমি না সময় মতো না গেলে কি হতো তোমার?”

নিশাদের এতোগুলো কথা শুনেও রিধিশা কোনো রিয়েক্ট করলো না। চুপচাপ এলোমেলো পায়ে হেটে যেতে থাকে। নিশাদ অবাক হলো কিছুটা রিধিশা কথা না বলাতে। নিশাদ দোকান থেকে ওয়ানটাইম ব্যান্ডেজ কিনে রিধিশার পেছনে যেতে থাকে।

.

বাসে কাছে এসে দেখে তাদের বাস ছাড়া সব বাস উধাও। নিশাদকে দেখে রেহান এগিয়ে আসে। রেহান রেগে বললো
” কোথায় ছিলি তুই? আমাকে চিন্তায় ফেলে কই উধাও হয়েছিলি? তোকে না পেয়ে বাস আটকে রেখেছি আমি এখনও।”
” থ্যাংক ইউ বন্ধু। তোর মতো বন্ধু যেনো সইবার থাকে। আমি ভেবেছিলাম বাস বোধয় আমাদের রেখেই চলে গিয়েছে।”

রিধিশা বাসে উঠছিল রেহান সেদিকে তাকিয়ে বললো
” ওও আমাদের! তা কোথায় ছিলি তোরা?”
” পরে বলবো এখন চল!”
নিশাদ আর রেহান বাসে উঠে যায়। জোতি চিন্তায় এতো গভীর হিয়ে আছে যে রিধিশাকে বাসে উঠতেও দেখেনি। রেহান পাশে বসতেই জোতি অস্থির হয়ে তাকালো। রেহান বললো
” আরে নিশাদ তোমার বান্ধবীযে নিয়ে এসেছে।” জোতি সস্তির নিশ্বাস ফেললো।

নিশাদ আবারও রিধিশার পাশে সিট খালি পেয়ে সেখানে বসে। রিধিশা সিটে মাথা রেখে বাইরে তাকিয়ে আছে। নিশাদ ওয়ানটাইম ব্যান্ডেজ এগিয়ে দিয়ে বললো
” মাথায় লাগিয়ে নাও। মাথায় চোট লেগেছে আর কোথাও ব্যাথা পেলে আরেকটা লাগিয়ে নাও।”

” সবচেয়ে বড় ব্যাথা তো মনে লেগেছে কিন্তু সেখানে তো এসব লাগিয়ে ব্যাথা সারানো যাবে না।”
রিধিশা নিশাদের হাতের দিকে তাকিয়ে ব্যান্ডেজগুলো দেখে আবারও নিশাদের দিকে তাকায়। নিশাদ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। রিধিশা ভেংচি কেটে মুখ ফিরিয়ে নেয়।

“বেয়াদব মেয়ে! একটু ভালো ব্যাবহার করেছি বলে আবার নিজের ভাব দেখাচ্ছো! এই জন্যই মেয়েদের উপকার করতে নেই।” রিধিশা একবার তাকিয়ে আবারও চোখ ফিরিয়ে নেয়। নিশাদ মুখ ফুলিয়ে রাখে। নিজের হাতে একটা ব্যান্ডেজ লাগাগে গিয়েও রিধিশার উপর রেগে তিনটেই ফেলে ফিলো।

নিশাদ পকেট থেকে রিধিশার ফোন বের করে হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো
” ধরো এটাও রাখো। বেয়াদব মেয়েদের জিনিস রাখি না আমি। ফোনটা না আনলে ভালো হতো তাহলে আর ভাব থাকতো না। পাশে পড়ে ছিলো বলে ভালো মানুষি দেখিয়ে নিয়ে এসেছিলাম কিন্তু হুহ!”
রিধিশা তার ফোন নিয়ে বসে থাকে।

ঢাকা আসতে পুরো জার্নিটা এমনি কেটে গেলো। নিশাদ পুরোটা সময় এক ভাবনায় ডুবে ছিলো। রিধিশাও নিস্তব্ধতা দিয়ে কাটিয়ে দেয়। ভার্সিটিতে বাস থামলো। একে একে সবাই নেমে যায় বাস থেকে। রিধিশা সবার শেষে নামলো। নিশাদকে বাসের নিচে দেখে তার সামনে গিয়ে বললো
” ধন্যবাদ।” নিশাদ জ্যাকেট টেনেটুনে কিছুটা ভাব নিয়ে দাঁড়ালো। রিধিশা মুখ বাঁকিয়ে চলে গেলো, তা দেখে নিশাদ চোয়াল শক্ত করে তাকিয়ে থাকে।
” বদ মেয়ে একটা।”

চলবে……..