কুঁড়েঘর পর্ব-০৯

0
467

#কুঁড়েঘর
#লেখিকা–মার্জিয়া রহমান হিমা
। পর্ব ০৯।

ভার্সিটিতে এসে রিধিশা ক্লাসে না গিয়ে হোস্টেলে জোতির কাছে চলে গেলো। আজকে অনেকটা তাড়াতাড়িই এসেছে।
এসে দেখে জোতির রুমমেট তৈরি হচ্ছে আর জোতি উল্টো পিঠ হয়ে শুয়ে আছে। এখনও শুয়ে থাকতে দেখে রিধিশা অবাক হয় কিছুটা। রিধিশা জোতির কাছে বসেই গরম তাপ অনুভব করে। জোতির কপালে হাত দিয়ে দেখে জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে মেয়ের।
রিধিশা অবাক গলায় বলে
” কিরে তোর দেখি জ্বর! এতো জ্বর কখন আসলো? আমাকে জানালি না একবার।”
জোতি উঠে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে বলে
” আরে রাতে একটু জ্বর এসেছিলো।”

রিধিশা রাগি গলায় বললো
” হোস্টেলে থাকার বেশি শখ না তোর? এবার শখ মিটিয়ে নে। এই হোস্টেলে বাপ,দাদা ত দূড় চৌদ্দ পুরুষের কেউ নেই। মরে গেলেও কেউ বাড়ির লোকের মতো এসে একটু যত্ন করবে না। থাক, থাক আরো থাক আমিও ভাইয়ার কাছে আজকে ফোন দিয়ে সব জানাবো।”
জোতি অসহায় চেহারা বানিয়ে বললো
” এমন করিস কেনো? তুইও তো আমি হোস্টেলে আসার কয়েকদিন আগে অসুস্থ হয়েছিলি আমি কি কিছু বলেছিলাম? অসুস্থতা কি আর আমি ডেকে আনি?”

রিধিশা ভ্রু কুঁচকে বললো
” আমার সাথে তোর কিসের তুলনা? আমি অসুস্থ হয়েছিলাম তখন যত্ন করার জন্য তুই ছিলি কিন্তু এখানে তোর কে আছে বল আমায়।” জোতি মুখ বাঁকিয়ে বসে থাকে। রিধিশা কর্কশ গলায় জিজ্ঞেস করে
” ঔষধ, খাবার কিছু খেয়েছিস?”

জোতি তার রুমমেটের দিকে একবার তাকিয়ে বললো
” আরে হ্যা বাবা, সবই খেয়েছি। এই যে মেয়েটা আমার জ্বর দেখে রাতেই ঔষধ দিয়েছিলো। যাই হোক মেয়েটা ফোনে ডুবে থাকলেও আমার একটু খেয়াল রেখেছে।” শেষের কথাটা রিধিশার কানে ফিসফিস করে বলে।

রিধিশা ঠোঁট চেপে হাসলো। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে ধন্যবাদ দিতেই মেয়েটা মুচকি হেসে বেরিয়ে গেলো।
রিধিশা জোতির দিকে তাকিয়ে বললো
” ভালো করেছে। এখন রেস্ট কর ক্লাসে যেতে হবে না আজ।”
জোতি কাথা দিয়ে পা থেকে মাথা পর্যন্ত মুড়িয়ে বললো
” সে তো আজকে আমি যাবোই না। যাহ বান্ধুপী ভালো করে ক্লাস করে আয়। আর ইম্পরট্যান্ট ক্লাসের নোট গুলো দিয়ে দিস আমায়।”
রিধিশা আলতো হেসে বেরিয়ে গেলো।
.

ক্লাসে গিয়ে চুপচাপ বই বের করে পড়তে থাকে। মাস্টার্স ফার্স্ট ইয়ারদের সেমিস্টার এক্সাম শুরু হবে আগামীকাল থেকে তাই ভার্সিটির মাঠে মানুষের সমাগম কম বললেই চলে।
রিধিশা ক্লাসে চোখ বুলিয়ে দেখে কেউ খাচ্ছে, কেউ গল্প করছে আবার অনেকেই নোট লিখছে।

রিধিশার ক্লাসে মন বসলো না। জোতি ছাড়া ক্লাসে কারোর সাথেই পরিচিত না সে। নিজেই সেচ্ছায় পরিচিত হতে যায়নি।
বট গাছের দিকে তাকিয়ে দেখে গাছের নিচে আজকে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। এক দুজন লোক দেখা যাচ্ছে অপরিচিত।
রিধিশার ক্লাসে বসে থাকতে বিরক্তি এসে পড়লো।
রিধিশা ব্যাগ নিয়ে লাইব্রেরিতে চলে আসলো। দুটো বই নিয়ে চেয়ার টেনে বসে পড়ে।

টেবিলের উপর জোড়ে শব্দ শুনেই রিধিশা চমকে মাথা তুলে তাকায়।
মিলি রাগি দৃষ্টিতে রিধিধাকে দেখে যাচ্ছে। রিধিশা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। মেয়েটাকে পিকনিকে দেখেছিলো, নিশাদের সাথে ছিলো সব সময়।
মিলি রিধিশার হাত চেপে লাইব্রেরির বাইরে নিয়ে আসে।

বারান্দায় এনে রিধিশার হাত ছেড়ে দেয়। রিধিশা অবাক স্বরে বললো
” আরে কে আপনি? এভাবে হাত ধরে এনেছেন কেনো?”
মিলি রাগি গলায় বললো
” কেনো এনেছি বুঝতে পারছো না বুঝি? নিশাদের সাথে কি সম্পর্ক তোমার?”

রিধিশা রেগে গেলো মিলির কথায়।
” অদ্ভুত তো! ওই ছেলের সঙ্গে আমার কি সম্পর্ক থাকবে?” মিলি তেড়ে এসে বললো
” কচি খুকি তুমি? বোঝনা কি বলছি আমি? আমাকে কি বোকা পেয়েছো? আমি সব শুনেছি। আসার পর থেকে তুমি আমার নিশাদের পেছনে হাত ধুয়ে পড়ে আছো। থার্ডক্লাস মেয়ে! আমার নিশাদের দিকে হাত বাড়ানোর সাহস আসে কোথা থেকে?”
রাগে রিধিশার মাথার রগ তরতর করে ছিড়ছে
কিন্তু চুপ করে থাকে রিধিশা। মিলিকে দেখেই বুঝতে পারছে এই মেয়ে সুবিধার না তার জন্য।

রিধিশা রাগ কন্ট্রোল করে বড় একটা নিশ্বাস নিয়ে বললো
” দেখুন তার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। প্রথম দিন একটু ঝামেলা হয়েছিলো এরপর আর এমন কিছুই হয়নি যার জন্য আপনি এসব কথা শোনাচ্ছেন। আর কিছু জানার বা বলার থাকলে আমাকে বলবেন না। আপনার নিশাদকেই গিয়ে জিজ্ঞেস করবেন।”
হনহন পায়ে লাইব্রেরিতে এসে আগের জায়গায় বসে পড়ে রিধিশা।
মিলি রাগে ফুঁসছে। রিধিশার কথা একদমই হজম করতে পারছে না। মিলি ফ্রেন্ডরা তাকে জোড় করে নিয়ে গেলো এখান থেকে।

রিধিশা বসে বসে বই এর ভেতর মুখ ডুবিয়ে রেখে কেঁদে যাচ্ছে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে।
” ওই বজ্জার ছেলের জন্য আমি কেনো কথা শুনবো? এতই যখন ভালোবাসা তাহলে কোলে বসিয়ে রাখে না কেনো?” এসব বলে বলে কেঁদে যাচ্ছে।
লাইব্রেরির অনেকেই ক্লাসে চলে গিয়েছে। এখন লাইব্রেরি ফাকাই বলা চলে। রিধিশা একা একা কেঁদে যাচ্ছে।

নিশাদ রিধিশার সামনের চেয়ারে বসে শব্দহীন ভাবে। রিধিশার কান্না শুনে অবাক হয়। মুখের সামনে বই দিয়ে রাখায় চেহারাটা দেখতে সক্ষম হলো না। নিশাদ এদিক ওদিক তাকিয়ে রিধিশার মুখের সামনে থেকে বইটা নামিয়ে দিলো।
রিধিশা কান্নার মাঝে সামনে নিশাদকে বসে থাকতে দেখে কান্না থামিয়ে ফেললো। হাত দিয়ে চোখ মুছে নেয়। নিশাদ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো
” কাঁদছিলে কেনো?”

নিশাদের কথায় রিধিশার আবারও কান্না পেলো কিন্তু কান্না করলো না। ভাঙ্গা গলায় বললো
” আপনি অযথা আমার পেছনে পড়ে আছেন কেনো? আমাদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই তাও শুধু শুধু আপনার গার্লফ্রেন্ডের থেকে কথা শুনবো আমি?”
নিশাদ ভ্রু কুঁচকে বললো
” গার্লফ্রেন্ড? আমার গার্লফ্রেন্ড কে?”

রিধিশা নিশাদের দিকে চোখ বড়বড় তাকিয়ে বললো
“এমন ভাব করছেন যেনো বিশুদ্ধ ছেলে আপনি? আপনার গার্লফ্রেন্ড না থাকলে আমার নিশাদ নিশাদ বলে আমাকে এতো কথা শুনিয়ে গেলো কে?”
নিশাদ বুঝতে পারলো মিলি ছাড়া আর কেউ না। নিশাদ বিরক্ত গলায় বললো
” আরে ওইটা গার্লফ্রেন্ড না। ছাড় ওর কথা, মেয়েটা পাগল। আচ্ছা ওর হয়ে আমি সরি বলছি।”

” আপনি সরি বললেই তো আর আমার অপমানের ঘা ফুরাবে না! আপনি আর আমার সাথে কথা বলবেন না প্লিজ! অনুরোধ করছি আমি।”
রিধিশা দুটো বই নিয়ে বেরিয়ে গেলো লাইব্রেরি থেকে। নিশাদ রিধিশার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে নিজের চুল টানতে থাকে।
দাঁতে দাঁত চেওএ বিড়বিড় করে বলে
“মিলি জ্বালায় আমার জীবনটা ধ্বংস হয়ে গেলো। এই মেয়েকে কিভাবে আমার পিছু ছাড়াবো?”

ব্রেক টাইমের আগের ক্লাসে ভার্সিটির নবীন বরণের উৎসবের কথা জানায় সবাইকে। দুদিন পর নবীন বরণের অনুষ্ঠান হবে। সবাইকেই থাকতে হবে বলে জানিয়ে দেয়।
রিধিশা ব্রেক টাইমে জোতির কাছে চলে গেলো। জোতি শুয়ে আছে এখনও। রিধিশা পাশে বসে বললো
” কিছু খাবি?” জোতি মাথা নেড়ে হ্যা বললো।
রিধিশা জিজ্ঞেস করলো কি খাবে।
জোতি হেসে বললো
” পাস্তা আর বার্গার খাবো।”

বিধিশা বিরক্তকর চাহনি দিয়ে তাকায়।
” জ্বর উঠেছে এসব আনছি না। এগুলো ছাড়া অন্যকিছু খেলে বল।” জোতি জেদ ধরে বলে
” এগুলোই খাবো নাহলে খাবো না।” জোতি রিধিশার হাতে টাকা দিয়ে ধাক্কিয়ে পাঠিয়ে দিলো। রিধিশা ক্যান্টিন থেকে পার্সেল করে নিয়ে আসে।
রিধিশা প্যাকেট থেকে খুলতে খুলতে বললো
” দুদিন পর নবীন বরণের অনুষ্ঠান হবে আজ বলেছে।”

জোতি অবাক হয়ে পড়ে খুশিতে চেঁচিয়ে উঠে। জোতি খুশি হয়ে বলে
” হায়! বান্ধুপ্পী, আমার কতো দিনের ইচ্ছা ছিলো বলতো, কলেজে নিজেদের নবীন বরণ দেখার। ইশশ অবশেষে ইচ্ছে পূরণ হচ্ছে। আচ্ছা শোন আমরা দুজন শাড়ী পড়বো ঠিকাছে?”
রিধিশা মন খারাপ করে ফেলে।
” আমি তো শাড়ি পড়িনি আগে কখনো। আম্মু তো আমাকে কখনো শাড়ি কিনে দেয়নি তাই কোনো শাড়ি নেই আমার।”

জোতি শান্তনা দিয়ে বললো
” আরে এতো চিন্তা কিসের? মে হু না! আমারও শাড়ি নেই। আমরা দুটো শাড়ি কিনে নেবো।” রিধিশা কিছু বললো না। শাড়ি কিনতে গেলেই আরো কতো টাকা খরচ হবে!
রিধিশা মাথা নেড়ে বললো
” আচ্ছা পড়ে দেখা যাবে। এখন খাওয়া শুরু কর।”
জোতি পাস্তা’টা রিধিশার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো
” নে খা।”
রিধিধা মুখ কুঁচকে বললো
” নাহ ইচ্ছে করছে না তুই খা। আমি নাস্তা করেই এসেছি।”

জোতি মুখ ফুলিয়ে বললো
” তুই জানিস না আমি পাস্তা খাই না! আমি তোর জন্যই আনিয়েছি। চুপচাপ খেয়ে নে এটা ফেলবো নাকি এখন?”
রিধিশা কিছুটা খেয়ে বাকিটা রেখে দিলো। দু দিন ধরে
কিছুই খেতে ইচ্ছে করে না। পছন্দের খাবারও না।

_________

প্রতিদিনের মতো আজও টিউশনি শেষ করে বাসায় ফিরতে রাত হয়ে যায়। আনমনা হয়ে হেটে হেটে আসতেই খেয়াল করলো রাস্তা কেমন যেনো। গতকাল ভার্সিটিতে না যাওয়ায় সব টিউশনি তাড়াতাড়ি শেষ করায় রাত হয়নি কিন্তু আজ রাত হয়েছে যেটা প্রতিদিনই হয়।
রিধিশার কেমন ভয় ভয় করতে থাকে। বিড়বিড় করে বললো
” এই কোন জায়গায় এসে পড়লাম? আমার আগে খোঁজ নেওয়া দরকার ছিলো।”

বাসায় যাওয়ার আগেই দোকান পড়লো একটা। আগেও দেখেছে তবে আগে বন্ধ দেখতো। দোকানের কাছে আসতেই দোকানে বসা ছেলেগুলো ওর দিকে তাকায়। রিধিশা বুঝতে পারলো ছেলেগুলো সুবিধার নয়। রিধিশা দ্রুত পা বাড়িয়ে দোকান পার করলো কিন্তু বিপদ যেনো পিছু ছাড়ে না। পেছন থেকে এক লোক ডেকে উঠে। রিধিশা নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে যায়।
” এই যে সুন্দরী এদিকে এসো তো।”

রিধিশা ভয়ে কাবু হয়ে যায় ভেতরে ভেতরে। রিধিশা দোয়া দুরূদ পড়ে দুই পা এগোতেই পেছন থেকে কয়েকজন তার সামনে এসে দাঁড়ায়। রিধিশা ভয়ে ঢোক গিললো।
“এই যে ডাক কি শুনতে পাও নাই? কি নাম?” ছেলেটা কেমন করে তাকিয়ে হাসলো।
.
রিধিশা মুখ কুঁচকে নেয় ওদের দেখে। হঠাৎ পাশে কারো অস্তিত্ব অনুভব করতেই রিধিশা ভয় পেয়ে পাশে তাকায়। কিন্তু পাশে তাকিয়ে নিশাদকে দেখে চমকে গেলো। জানে পানি ফিরে পেলো। রিধিশা কোনোদিকে খেয়াল না করেই ভয়ে ভুল ঠিকে জ্ঞান হারিয়ে নিশাদের বাহু খামছে পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়।
ভয়ে হাত পা কাঁপছে তার।

চলবে……..