#কুঁড়েঘর
#লেখিকা–মার্জিয়া রহমান হিমা
। পর্ব ১৪ ।
রিধিশা পেছন ঘুরে ফুলগাছ দুটোকে দেখছে একটু পর পর। নিশাদ খেয়াল করে বললো
” বারবার ওইদিকে কি দেখো?” রিধিশা বললো
” আমি যতোবার এসেছি একদিনও দুটো ফুলগাছে একসাথে ফুল দেখিনি। কাঠগোলাপ গাছে ফুল থাকলে কৃষ্ণচূড়া গাছে ফুল থাকে না আর কৃষ্ণচূড়া গাছে ফুল থাকলে কাঠগোলাপ গাছে থাকে না। যেই গাছে থাকে না সেই গাছের নিচে আগের দিনের ফুল পড়ে থাকে।
নিশাদ উঠে গাছ দুটোর দিকে তাকালো। পাঞ্জাবীর পকেটে দুটো হাত ঢুকিয়ে কিছুক্ষণ গাছ দুটোকে দেখে বলে উঠলো
” আমার কি মনে হয় বলো তো! তোমার যেদিন বিয়ে হবে সেইদিন থেকে তুমি দুটো গাছেই ফুল দেখতে পাবে।”
রিধিশা কোণা চোখে নিশাদের দিকে তাকিয়ে বললো
” হ্যা, আপনি তো সব জানেন।”
নিশাদ গলা ঝেড়ে ভাব নিয়ে বললো
” হ্যা, অবশ্যই। আমি নিশাদ, আমি না জানলে আর কে জানবে বলো তো?” রিধিশা ভেংচি কাটলো নিশাদের কথা শুনে।
.
দূড় থেকে সূর্য কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুজনকে দেখছে।
” কোথায় ভাবলাম নিশাদকে বাসা থেকে নিয়ে আসতে হবে রেগে গিয়েছে দেখে আর এই ছেলে এখানে দাঁড়িয়ে রিধিশার সাথে কথা বলে যাচ্ছে। যাই হোক একটা ছবি তুলে নেই, পড়ে রেহানদের দেখাতে হবে। পাক্কা এই ছেলে প্রেমে পড়েছে।” সূর্য দূড় থেকে জুম করে দুজনের একসাথে কয়েকটা ছবি তুলে চুপিসারে চলেও গেলো।
.
রিধিশা হঠাৎ করে রাগি গলায় বলে উঠলো
” আপনার সাথে আমি এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলছি কেনো? আর আপনার জন্য এতো অপমানিত হলাম তাও আপনি আমার সাথে বসে আছেন!”
নিশার ভ্রু কুঁচকে তাকালো রিধিশার দিকে, গমগম স্বরে বললো
” মানুষের ভালো করতে নেই সেটা তোমাকে দেখলেই বারবার প্রমাণ পাই। কোথায় কান্না থামিয়ে মন ভালো করে দিলাম আর তুমি এখন পুড়নো কথা তুলছো?”
রিধিশা গম্ভীর গলায় বললো
” আমি নিজের জন্য একাই যথেষ্ট, হুহ।” রিধিশা পার্স ব্যাগ কাধে নিয়ে হাটা শুরু করলো। নিশাদও সাথে সাথে হাটছে, তা দেঝে রিধিশা হাটা থামিয়ে বললো
” কি চাই? আমার সাথে হাটছেন কেনো? কাজ নেই আপনার? যান ওই অনুষ্ঠানে যান।”
নিশাদ গম্ভীর গলায় বললো
” আমি কোথায় যাবো সেটা কি তোমাকে বলে দিতে হবে? কে তুমি? আমার বউ নাকি?”
রিধিশা হাটতে হাটতে তাচ্ছিল্য হেসে বলে উঠলো
” আপনার বউ আমি হবো কেনো? আপনার বউ হওয়ার কোনো interest নেই আমার আর আপনার বউ হওয়ার যোগ্যতাও আমার নেই। আপনার বউ তো হবে মিলি।”
নিশাদ চোয়াল শক্ত করে রিধিশার হাত চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বললো
” আমার বউ কে হবে সেটা আমি বলবো। দুনিয়ার বলা তে আমি বিয়ে করবো না ঠিকাছে? আর বারবার অন্যের কথায় নিজের যোগ্যতা’র কথা তোলা বন্ধ করো। তোমার কতোটা আর কি কি যোগ্যতা আছে সেটা তুমি আর আমি জানি। অন্যের কথায় নিজের যোগ্যতার প্রশ্ন তুলে নিজেকে ছোট করার মানে নেই। এসব কথা যেন আর না শুনি তোমার মুখে।”
রিধিশা শান্ত চোখে নিশাদের চোখের দিকে তাকালো। নিশাদ নিশ্বাস ফেলে রিধিশার হাত ছেড়ে দিলো। রিধিশা চুপচাপ হাটতে থাকে পাশে নিশাদ হাটছে।
একই পথে দুটো মানুষ নিশ্চুপ ভাবে হেটে চলছে।
রাস্তার মানুষ গুলোও নিজেদের কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত। হঠাৎ কয়েকজনের চোখে পড়লে দুজনকে দেখছে।
হেটেই দুজন বাড়ির কাছাকাছি চলে আসলো। নিশাদ তার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। রিধিশা পিছু না ঘুরেই বুঝতে পারছে নিশাদ দাঁড়িয়ে আছে। রিধিশা বাড়ির সামনে এসে গেট খুলে ভেতরে ঢুকে পড়লো।
নিশাদও উপর নিজের ফ্ল্যাটে চলে আসলো।
.
বাসায় ঢুকে ফ্রেশ হয়ে জোতিকে ফোন করে বলে দিলো চিন্তা না করার জন্য। রিধিশা ফোন বের করে মায়ের সাথে কথা বললো কিছুক্ষণ।
দুপুরের রান্না বসিয়ে দেয় রিধিশা। খাওয়া দাওয়া করে টিউশনিতে যাবে।
_______
সকালে ঘুম থেকে উঠেই নামায পড়ে বেরিয়ে পড়লো রিধিশা। আনমনে হেটে যাচ্ছে রাস্তায়। সকালে এখানে গাড়ি বেশি দেখা যায় না। হুট করে এক দুটো যদি পাওয়া যায়।
রিধিশা ভাবনায় এতোটাই বিভোর যে সামনে একটা বড় পাথর পড়ে আছে সেদিকেও খেয়াল করলো না। যার ফলে কিছুদূর এগোতেই বড়সড় হোচট খেয়ে পড়ে গেলো বেচারী। রিধিশা চোখ মুখ কুঁচকে বসে আছে, ভালোই ব্যাথা পেয়েছে। রিধিশা তাকিয়ে দেখে পা হালকা ছিলেও গিয়েছে সাথে মারাত্মক ব্যাথাও করছে। হয়তো মচকে গিয়েছে।
রিধিশা কাঁদতে কাঁদতে বললো
” কি ব্যাথা! এই সময়েই ব্যাথা পেতে হলো? এখন কি করবো আমি?”
.
নিশাদ জগিং করতে বেরিয়েছিলো। আগে জগিং তো দূড় ঘুমই ভাঙ্গতে ভার্সিটির টাইম পেড়িয়ে যেতো কিন্তু এখন অভ্যাসটা কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে তাই তাড়াতাড়ি সকালে উঠলে জগিং করতে বেরিয়ে পড়ে। নিজের বাসারও অনেকটা সামনে নিশাদ রিধিশাকে রাস্তায় বসে থাকতে দেখে চোখ বড় বড় করে তাকালো। কানের হেডফোন খুলে গলায় রেখে বললো
” এই মেয়ে এখানে বসে কি করছো?”
রিধিশা কাঁদছিলো নিশাদের কথা শুনে চোখ মুছে নিশাদের দিকে তাকিয়ে রাগি গলায় বললো
” ভিক্ষা করছি দেখছেন না?”
নিশাদ হাটুতে ভর দিয়ে বসলো। রিধিশার চুল গুলো ধরে টানতে টানতে রেগে বললো
” তকমার এই রাগ আমাকে দেখাবে না বুঝেছো! তোমাকে মাথায় তুলে আছাড় দেবো আমি। আমার রাগের সামনে তোমার রাগ কিছুই না।”
রিধিশা কাঁদতে কাঁদতে বললো
” আরে ছাড়ুন। আমি পায়ে ব্যাথা পেয়েছি।” রিধিশার কথা শুনে চুল ছেড়ে পায়ের দিকে তাকালো। পায়ে হাত দিতেই ব্যাথায় চেঁচিয়ে উঠে। নিশাদ মুখ কুঁচকে বললো
” চোখ টা কি বাসার আলমারিতে রেখে এসেছো? চোখ দিয়েছে দেখে চলার জন্য। আলমারিতে গুছিয়ে রাখার জন্য না।” রিধিশা মুখ ফুলিয়ে রাখে।
.
নিশাদ ভ্রু কুঁচকে বললো
” কোথাও যাবে এখন?” রিধিশা মাথা নেড়ে বললো
” টিউশনিতে যেতে হবে।” নিশাদ উঠে কিছুটা সামনে গিয়ে হেটে এসে বললো
” এখন তো ফার্মেসি খোলা নেই কি করবো? আজকে আর টিউশনিতে যেতে হবে না। চলো বাসায় দিয়ে আসি।” রিধিশা মাথা নেড়ে বললো
” না টিউশনি বন্ধ করা যাবে না। কয়েকদিন ধরে বন্ধ যাচ্ছে।” নিশাদ কোমড়ে গাত রেখে বললো
” তাহলে তো আরো কোনো অপশন নেই।” রিধিশা ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই নিশাদ মেকি হেসে রিধিশাকে কোলে তুলে নেয়। রিধিশা চমকে চেঁচিয়ে বলে উঠে
” আরে আরে কি করছেন? নামান আমাকে।” নিশাদ ধমক দিয়ে বলে উঠলো
” চুপ! যা করছি চুপচাপ দেখো নাহলে আমার বাসার ছাদ থেকে নিয়ে ফেলে দেবো। এখন কিছুই করতে পারবে না তুমি।” রিধিশা দাঁতে দাঁত লাগিয়ে চুপ করে যায়।
.
নিশাদ রিধিশাকে নিয়ে বাসায় লিফটে উঠে যায়। রিধিশা ভীতু গলায় বললো
” কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আপনি আমাকে?” নিশাদ শক্ত চাহনি দিয়ে তাকালো রিধিশার দিকে। যার মানে চুপ থাকতে বলছে। রিধিশা ঢোক গিললো, ভয়ে হাত অয়া অবশ হয়ে যাচ্ছে তার।
নিশাদ রিধিশাকে দাঁড় করিয়ে ফ্ল্যাটের দরজা খুলে ভেতর যায়। রিধিশার হাত ধরে ভেতরে নিয়ে আসে।
রিধিশা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ভেতরে এসে ভীতু চোখে পুরো ফ্ল্যাটে চোখ বুলায়। নিশাদ রিধিশাকে সোফায় বসিয়ে রুমে চলে গেলো।
ফার্স্টএইড বক্স এনে রিধিশার পায়ে কেটে যাওয়া জায়গায় স্যাভলন লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দেয়। মচকে যাওয়া জায়গায় ধরে রিধিশার দিকে তাকিয়ে বললো
” চিৎকার দেবে না রুমে রেহানরা ঘুমাচ্ছে।”
বলেই রিধিশার পা মুচড়ে দেয়। রিধিশা নিজের মুখ চেপে ধরে চিৎকার বন্ধ করে নেয়। রিধিশা চোখ বড় বড় তাকায় নিশাদের দিকে। নিশাদ বললো
” দেখোতো হাটতে পারো কিনা।” রিধিশা উঠে দেখে পা ঠিক হয়ে গেছে। মচকে যাওয়া জায়গায় ব্যাথাও নেই কিন্তু কেটে যাওয়া জায়গায় কিছুটা ব্যাথা আছে।
রিধিশা খুশি হয়ে বললো
” থ্যাংক ইউ।” নিশাদ থমথমে চেহারায় বললো
” যাও বের হও এখন। তোমাকে উপকার করা শেষ। আর এবার কিপটামো না করে পায়ের যেই ব্যাথা আছে সেটার জন্য ঔষধ খেও নাহলে তোমারই সমস্যা হবে।”
.
রিধিশা মুখ বাঁকিয়ে বললো
” সেটা আমি বুঝে নেবো আর আপনার বাসায় আসার জন্য মরে যাচ্ছিলাম না আমি।” নিশাদ ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বললো
” হ্যা, তা তো দেখেছিই। এখানে না নিয়ে আসলে আজকে সারাদিনেও টিউশনিতে যেতে পারতে না।” রিধিশা ভেংচি কেটে বেরিয়ে গেলো বাসা থেকে।
টিউশনিতে যেতে হবে নাহলে লেট হয়ে যাচ্ছে অনেক।
নিশাদ খুশিতে আত্মহারা কারণ মচকে যাওয়া পা ঠিক করার ট্রিট টা অনেক আগেই দেখে আসলেও
কখনো টায় করেনি বলতে গেলে টায় করার সুযোগ পায়নি কিন্তু আজকে করেছে সাথে সফলও হয়েছে এতে প্রচণ্ড খুশি। নিশাদ হাসতে হাসতে বলে
” প্রথমে কি না ভয় পেয়েছিলাম মনে মনে। ভাগ্য সহায় ছিলো বলে পা টা ঠিক হয়েছে নাহলে উল্টো কাজ করলে তো রিধিশার পা’টা ইন্নানিল্লাহ হয়ে যেতো।”
.
আজকে রেহান আর সাদির পরীক্ষা তাই দুজন খেয়ে আগেই বেরিয়ে পড়েছে। নিশাদ তৈরি হচ্ছে যাওয়ার জন্য। ক্যাম্পাসে একদিন না গেলে যেনো দিন কাটে না। চুল ঠিক করে ঘড়ি পড়ে জ্যাকেট পড়তে পড়তে রুম থেকে বের হতেই দেখে সূর্য কোমড়ে হাত রেখে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
নিশাদ ভ্রু কুঁচকে বললো
” কি? এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো?”
সূর্য নিশাদের কথা শুনে ফোন বের করলো। আর জিজ্ঞেস করলো
” তোর আর রিধিশার মাঝে কি চলছে রে?”
নিশাদ চোখ বড় বড় করে বললো
” কি! আমার আর রিধিশার মাঝে? পাগল হলি নাকি? কিছু খাইছিস এই সকালে? ওই মেয়ের ভাব দেখে মরে যাই আবার ওই মায়ের সাথে কি চলবে?”
সূর্য চোখ ছোট করে বললো
” আমারে গাধা পাইছিস? আমি কি কিছু বুঝি না?
আচ্ছা বল কালকে রাগ করে যে অনুষ্ঠান থেকে চলে এসেছিলি এরপর কোথায় ছিলি তুই?”
” কোথায় আবার বাসায়ই তো আসলাম সোজা!”
সূর্য দাঁত কেলিয়ে বললো
” তাই নিশাদ ভাই? তাহলে এই ছবি তে তোর জমজ ভাই আর রিধিশা রয়েছে নিশ্চিই!” নিশাদ সূর্য হাত থেকে ফোন নিয়ে দেখলো অনেক গুলো ছবি তার আর রিধিশার। নিশাদ সূর্যের দিকে তাকাতেই সূর্যর চাহনি দেখে বললো
” নাথিং ইয়ার। কালকে মিলি ওকে অনেক বাজে কথা বলেছিলো, রিধিশা কাঁদছিলো তাই সরি বলতে গিয়েছিলাম। এর বেশি কিছুই না আর কিছু হলেও তোদেরকে কি মিথ্যা বলবো নাকি?”
সূর্য তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো
” হুম, যাই করিস আমাদের কথা যেনো মাথায় থাকে।”
চলবে…….