কুহুকথা পর্ব-০১

0
783

#কুহুকথা
#নুশরাত_জেরিন
#পর্বঃ১

—আপনি এমন একটা কাজ কি করে করলেন আব্বা?

রুনা বেগমের চাপা চিৎকারে ঘরের লোকগুলোর মুখ পাংশুটে বর্ন ধারন করলো।একে অন্যের মুখ চাওয়া চায়ি করলো সবাই।আজিজ হোসেন চোখ তীক্ষ্ণ করেন।
এতো চিৎকার চেচামেচি তার পছন্দ না।সারাজীবন আস্তে কথা বলে এসেছেন তিনি।কখনো উচ্চ স্বরে একটা বাক্যও উচ্চারন করেননি।অথচ তার ছেলের বউ কিনা জোরে ছাড়া কথাই বলতে পারেনা।খুশির খবর,দুঃখের খবর,ভালো-খারাপ সব রকম কথা তার জোরে বলা চাই ই চাই।
এমনকি খুব আদুরে ভাবে ছেলে আবিরের মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়ার সময়ও সে জোরে জোরে কথা বলে।
হঠাৎ করে অচেনা অজানা কেউ শুনলেই হয়তো ভাববে সে ঝগড়া করছে।আদতে কিন্তু তেমন কিছুই না।
আজিজ হোসেনের উত্তর না পেয়ে রুনা বেগম পাশে দাড়ানো তার স্বামী মইনুল হোসেনকে ইশারা করলেন।
মইনুল হোসেন এতক্ষণ বউয়ের কথা শুনছিলেন।সে সাধারণত সবসময়ই বউয়ের কথা শোনেন।বলার মতো সুযোগ কখনো পাননা তিনি।
সর্বদা বউ আর বাবাকে ভয় করে আসা তার অভ্যাস।অথচ তার ছেলেটা হয়েছে তার বিপরীত।
অন্যকে ভয় পাওয়া দুরের কথা তাকেই সবাই ভয় পেয়ে চলে।
রাগের বস্তা সে।নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোন কাজই করেনা।
তবে আজ করেছে।দাদু আজিজ হোসেনের এক কথায় তার অফিসের পুরাতন কর্মচারীর ছোট মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে এনেছে।
যদিও বিয়ে ঠিক হয়েছিলো বড় মেয়ের সাথে।
কিন্তু বিয়ের আগ মুহুর্তে জানা গেলো বিয়ের কনে পালিয়েছে। বিয়ে বাড়ি শোকের বাড়িতে পরিনত হলো।
মেয়ের বাবার সম্মান যায় যায়।
অগত্যা আজিজ রহমান বলে উঠলেন,

এ বাড়ির ছোট মেয়েকে আবিরের বউ করে নিয়ে যাবেন তিনি।

এতে বিয়ে বাড়ির সবার মুখে হাসি ফুটলেও রুনা বেগম আর আবিরের মুখ ছিলো অগ্নিমূর্তির মতো।
রুনা বেগম এমনিতেই বিরোধিতা করে আসছিলো শশুড়ের সিদ্ধান্তে।
তার একমাত্র ছেলে কিনা বিয়ে করবে এক সাধারণ কর্মচারীর মেয়েকে?তবুও যা একটু মন কে বুঝ দিয়েছিলো,মেয়েটা গরীব হলেও বেশ সুন্দরী। আবিরের পাশে মানাবে ভাবো।
তাও হলো না।মেয়েটা কিনা বিয়ের আসর ছেড়ে পালিয়ে গেলো?আবিরের ভাগ্যে জুটলো কিনা এক শ্যামবর্নের মেয়ে?

মইনুল হোসেন ধীরপায়ে এগিয়ে দাড়ালেন।মিনমিন করে বললেন,

—সত্যি আব্বা, কাজটা কিন্তু ঠিক করেননাই।

আজিজ হোসেন রক্ত চক্ষু করে তাকালেন।ছেলেটা হয়েছে বউয়ের চামচা।এতক্ষণ যাবত একটা কথাও সে বলেনি অথচ বউ ইশারা করার সাথে সাথে চলে এলো।
তিনি বড় করে শ্বাস ফেললেন।
তার মনটাও যথেষ্ট খারাপ।
রেজাউল লোকটাকে ভীষন পছন্দ করেন তিনি।
তার অফিসে একসময় কাজ করতো সে।এখন আর করেনা।একটা হাত কাটা তার।রোড এক্সিডেন্টে হাত হারিয়েছিলেন।
লোকটা এতো সৎ ছিলো যে মাঝে মাঝে আজিজ হোসেন অবাক হতেন খুব।এখনকার যুগেও এতোটা সৎ লোক আছে নাকি?
তার সততায় মুগ্ধ হয়েই তার বড় মেয়ের সাথে নিজের নাতি আবিরের বিয়ে ঠিক করেছিলেন।মেয়েটার নাম পিহু।
বেশ মিষ্টি মেয়ে!বাবার গুনগুলো সাধারনত সবসময় বড় মেয়েরাই পায়।আজিজ রহমানের তেমনটাই ধারনা ছিলো।
তবে পিহু বিয়ের আসর ছেড়ে চলে যেতে পারে এ কথা তিনি ভাবতেই পারেননি।
তবুও পিহুর ছোট বোন কুহু মেয়েটাও খারাপ না।
নেহাৎ তার গায়ের রংটাই সামান্য চাপা।তাতে কি?
তিনি মইনুল হোসেনের দিকে তাকাননা।
বউয়ের আচল ধরে ঘুরে বেড়ানো ছেলের সাথে তার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।
দেয়াল ঘেসে পায়ের উপর পা তুলে গম্ভীর মুখে বসে থাকা আবিরের দিকে তাকিয়ে তিনি বলেন,

—তোমার কি মত দাদুভাই?আমি ভুল করেছি?

আবির এতক্ষণ যাবত মাথা নিচু করে বসে ছিলো।দাদুর কথায় সে মুখ তুলে চাইলো।
দাদুকে সে যথেষ্ট সম্মান করে,ভালোও বাসে।তাই হয়তো তার এক কথায় চেনা পরিচয় না নিয়ে কোথাকার কোন মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলো সে।
কিন্তু তাই বলে বিয়ের আসরে এতো বড় অপমান করবে?বিয়ের কনে পালিয়ে গিয়ে ছোট বোনকে কনে বানিয়ে দেবে?
আবির গম্ভীর গলায় বললো,

—আমি কিছু জানিনা দাদু,আমার কিচ্ছু ভালোলাগছেনা।

রুনা বেগম ফট করে বলে উঠলেন,

—এসব এই মেয়েটার প্লান নয়তো আব্বা?বা তার পরিবারের?

—আবিরকে বিয়ে করাটা?কেনো?তার প্লান হবে কেনো?আবিরের মতো সেও তো বাধ্য হয়েই বিয়েটা করেছে,নিজের বাবার সম্মান বাঁচাতে!

রুনা বেগম মুখ বাঁকালেন।

—বাধ্য না ছাই!দেখেন গায়ের রং ময়লা বলে হয়তো বিয়ে হচ্ছিল না,তাই এমন প্লান করেছে সবাই মিলে।

আজিজ হোসেন চোখ রাঙালেন।
—আজেবাজে কথা বলবে না বউমা।মেয়েটা ভালো,খুবই ভালো।
নয়তো কেউ বাবার সম্মানের জন্য নিজের জিবনকে জলে ভাসিয়ে দেয়না।

—জলে ভাসিয়ে দিলো কোথায়?বরং তার কপাল খুলে গেলো।এমন মেয়ে এ বাড়ির বউ হবার যোগ্য নাকি?

—সে তো তুমিও যোগ্য না বউমা!

রুনা বেগম কাঁদো কাঁদো মুখ বানালেন।কথাটা তিনি প্রায়শয় শশুড়ের কাছে শুনেছেন।প্রথম প্রথম গায়ে লাগলেও এখন আর তেমন লাগেনা।কেমন গা সওয়া হয়ে গেছে।তবুও কথার তাৎপর্য বোঝানোর জন্য মুখটা কাঁদো কাঁদো বানাতে হয়।

—আপনি এমন কথা বলতে পারলেন আববা?

আজিজ হোসেন উত্তর দিলেননা।
আবিরের দিকে একধ্যানে তাকিয়ে থাকলেন।তার কেনো যেনো মনে হয় তিনি আবিরের ইচ্ছের বিরুদ্ধে জোর করছেন।
ইচ্ছের বিরুদ্ধে জোর করে কাউকে সুখী করা যায়না।
কেউ স ইচ্ছায় লেংড়া মেয়েকে বিয়ে করেও সুখী হয়।
আজিজ হোসেনের হঠাৎ করেই খারাপ লাগতে শুরু করলো।এসব কথা তার আগে ভাবা উচিৎ ছিলো।অন্তত বিয়েটা হবার আগে।
তিনি আদুরে গলায় বললেন,

—ঘুমাতে যাও দাদুভাই।অনেক তো রাত হলো!

আবির বিনাবাক্যে উঠে দাড়ালো।দরজার কাছে হেটে যেতেই আজিজ হোসেন বলে উঠলেন,

—কুহু মেয়েটাকেও ঘরে নিয়ে যেও। ওর ও তো ঘুম পেয়েছে হয়তো।করিডোরের সামনে কতক্ষণ যাবত দাঁড়িয়ে আছে সে।

আবির পেছনে ঘুরলোনা।সামনে তাকিয়েই বললো,
—তার সাথে আমি একঘরে থাকতে পারবোনা দাদু।যাকে বউ হিসেবে মানতেই কষ্ট হচ্ছে তাকে নিজের ঘরে কিকরে ঠাই দেই?
ওর অন্যকোন ব্যবস্থা করো তুমি।

কথাটা শোনার সাথে সাথে রুনা বেগমের মুখে হাসি ফুটে উঠলো।ছেলেটা এই প্রথম তার মায়ের মনের মতো কথা বলেছে।
খুশিতে বাক-বাকুম করতে করতে সে আবিরের পিছু ছুটলেন।
রুম পেরিয়ে লম্বা করিডোরের সামনে আসতেই তার চোখ কুঁচকে এলে।
ঘোমটা টেনে গুটিসুটি মেরে দাড়িয়ে থাকা বধুবেশের মেয়েটাকে তা সহ্য হচ্ছেনা।
সে গটগট পায়ে সামনে এসে দাড়ালো।
কুহু সামনে কারো পায়ের শব্দ পেয়ে চোখ তুলে তাকালো।এতক্ষণ যাবত সে ভেতরের ঘরের সব কথাই শুনেছে।
কান পাতে নি অথচ কথাগুলো একা একাই তার কানে আছড়ে পরেছে।কুহুর জায়গা অন্য কোন মেয়ে থাকলে কি করতো?কেঁদে কেটে বুক ভাসাতো?স্বামীর পা জড়িয়ে ধরতো?
কুহুর এসব কোনকিছুই করার ইচ্ছে জাগছেনা।বরং আবিরকে একটা লম্বা ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে করছে।
এইযে কুহুর বিয়ে হয়ে গেলো এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হলো কার?কুহুর পরিবারের।
বাবার এক্সিডেন্টের পর পুরো পরিবারের ভরন পোষনের দায়িত্ব কুহুর উপরেই তো।
পিহু তো সারাদিন সাজগোজ নিয়েই ব্যস্ত থাকতো।
কুহু এ বাড়ছে থাকলে তার পরিবারকে কে দেখবে একথা ভেবেই চিন্তা হচ্ছিল তার।তবে যেহেতু তার স্বামী তাকে বউ হিসেবে মানেই না তাহলে আর কি করার আছে?
যদিও অন্যসব মেয়ের মতো মনের কোনে কোথাও স্বামী সংসার করার তীব্র এক বাসনা গুটিসুটি মেরে বসে ছিলো।কিন্তু কুহু তো আর অন্য সবার মতো না।অন্য আর পাঁচটা মেয়ের মতো তার জিবনও না।
রুনা বেগম কটমটে ভঙ্গিতে বলে উঠলেন,

—এখানে কি করছো তুমি?

—দাঁড়িয়ে আছি।

কুহুর নির্লিপ্ত জবাবে রুনা বেগম বিরক্ত হলেন।তিনি ভেবেছিলেন মেয়েটা তার কথায় কাঁদো কাঁদো গলায় বলবে,

—কিছুই করছিনা মা।
রুনা বেগম তখন চিৎকার করবে,

—মা মানে?খবরদার আমাকে মা বলবে না।আমি শুধু আবিরের মা।

তবে এমন কিছুই না হওয়ায় তিনি মনে মনে হতাশ হলেন।পরক্ষনেই মুখ বাঁকিয়ে বললেন,

—আবিরতো তোমায় ঘরে ঠাই দেবেনা বলেছে,এখন কোথায় থাকবে তুমি?

—কোথায় আবার?এই করিডোরেই থাকবো।
এখানেই খাবো-দাবো,সংসার করবো।

রুনা বেগম হকচকিয়ে উঠলেন।বলে কি এ মেয়ে?করিডোরে সংসার করবে?
কেনো?তাদের কি বিশাল অট্টালিকার মতো বাড়ি নেই?এতো বড় বাড়ি থাকতে করিডোরে সংসার পাতবে কেনো?
পরমুহূর্তেই দাঁতে জিভ কাটলেন।
মেয়েটা সংসার করবে কিভাবে?আবির তো তাকে মানবেই না।
দাদুর মুখের দিকে তাকিয়ে পিহুকে বিয়ে করতে রাজি হলেও তার ছোট বোনকে সে কিছুতেই মেনে নেবেনা।বিয়ের আসরে কনে পালিয়ে যাওয়ার মতো অপমান আর আছে নাকি?
এ অপমান কি সহজে ভোলা যায়?
রুনা বেগম চোখ গরম করে তাকালেন।মেয়েটা বেশি সুবিধার না।কেমন নির্লিপ্তভাবে বসে আছে।কথাও বলছে কাটাকাটা।
এমন মেয়ের সাথে কথা বলে সুবিধা পাওয়া যায়না।
তারচেয়ে বরং আবিরকে দেখে আসা যাক।
কথাটা ভেবেই কুহুকে পাশ কাটিয়ে তিনি সামনে এগোলেন।

,

,

চলবে…..