কুহুকথা পর্ব-১৩ এবং শেষ পর্ব

0
765

#কুহুকথা
#নুশরাত_জেরিন
#পর্বঃ১৩

,
,
—কোথায় যাওয়া হচ্ছে শুনি?

কথাটা কর্নগোচর হতেই কুহু মুচকি হাসলো।পেছন ঘুরে দাড়ালো।
রায়হান দাড়িয়ে আছে।পাশে তার গাড়ি।নিশ্চয় কোথাও যাচ্ছিলো,কুহুকে দেখে দাড়িয়েছে।

কুহু হাসি মুখেই উত্তর দিলো,

—তোমার কাছেই যাচ্ছিলাম ভাইয়া!

রায়হানের মুখেও হাসি ফুটলো।এই দুই মাসে অনেক কিছুই বদলেছে।সাথে বদলেছে তার আর কুহুর সম্পর্কও।
প্রায়ই দেখা সাক্ষাৎ হয় তাদের।দুষ্টমীও হয়।ভাই বোনের ভালবাসা মিশ্রিত দুষ্টুমী।
এইতো কিছুদিন আগেই কথা হয়েছিলো তাদের।
রায়হান তার বাবার সম্পত্তির ভাগ কুহুকেও দিতে চায়।যতো যাই হোক কুহুও তো বাবারই মেয়ে।রায়হানের মা ও আপত্তি করেনি।মেয়েটার হক আছে সম্পত্তিতে।সে হক নষ্ট করার সে কে?
কুহুকে জানাতেই সে সময় চেয়েছিলো।বলেছিলো কিছুদিন পর এই ব্যাপারে তার সিদ্ধান্ত জানাবে।
রায়হান বলে উঠলো,

—তো এসো,গাড়িতে উঠে এসো।

গাড়িতে বসতে বসতে কুহু প্রশ্ন করলো।

—তুমি কোথাও যাচ্ছিলে?

—হ্যাঁ,তোমার কাছেই।

—আমার কাছে!কেনো?

রায়হান মৃদু হাসলো।গাড়ি চালু করতে করতে বললো,

—কেনো যেতে পারিনা বুঝি?

—না,সেরকম কিছু না।

—তুমিও তো আমার কাছেই আসছিলে?কোন বিশেষ কারনে?

কুহু দুষ্টুমীর হাসি হাসলো।

—কেনো,আমি বুঝি এমনি এমনি যেতে পারিনা?

রায়হান শব্দ করে হেসে উঠলো।

—আমার কথা আমাকেই ফেরত দিচ্ছো?

কুহুও হাসলো।বেশ কিছুক্ষণ নিরবতা পালন করে বললো,

—তোমার সাথে আমার গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা আছে ভাইয়া।

–সম্পত্তির বিষয়ে?

—হুম।

—আমিও এ বিষয়েই কথা বলতে এসেছিলাম।
কাগজ পত্র সব রেডীই আছে।তুমি বললেই তোমার নামে….

কুহু বাঁধা দিলো।
—আমার নামে না ভাইয়া!

—তাহলে?

—আমার বাবা মায়ের নামে আমার ভাগের সম্পত্তি আমি লিখে দিতে চাই।

রায়হান অবাক চোখে তাকালো।গাড়ি থেমে গেছে ততক্ষণে। কিছুক্ষণ অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে বললো,

—তুমি কি সত্যিই এমনটা চাও?

কুহু মাথা নাড়লো।সে তার বাবা মাকে খুশি দেখতে চায়।শেষ বয়সে তাদের অর্থাকষ্ট দূর করতে চায়।
এতো সম্পত্তি পেলে তাদের জীবন অনায়াসে শুয়ে বসে,হেসে খেলে কেটে যাবে।
সে বললো,

—তারা যে আমার দায়িত্ব ভাইয়া!

রায়হান মৃদু হেসে বোনের মাথায় হাত রাখলো।কুহুকে যতো জানছে ততোই অবাক হচ্ছে সে।সাথে বাড়ছে গর্ব।
রায়হানের চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে,

—এই নির্লোভ নিরহংকার মেয়েটা আমার বোন!

,

,
আবিরের আজ শরীর খারাপ।গায়ে প্রচন্ড জ্বর। এমন অসময়ে এতো জ্বর হলো কেনো কে জানে?মুখে কোন খাবার পর্যন্ত তুলতে পারছেনা।সবকিছু বিস্বাদ।
আবির মুখ চোখ কুঁচকে বিছানায় বসে আছে।গায়ে তার চাদর জরানো।
প্রচন্ড শীত লাগছে তার।সামনে বাটিতে স্যুপ রাখা।
মা একটু আগেই স্যুপটা দিয়ে গেছে।
আবির আরো একবার চামচ দিয়ে স্যুপটা মুখে নেওয়ার চেষ্টা করলো।পরক্ষনেই থু দিয়ে ফেলে দিলো।
নাহ্ খাওয়া যাচ্ছে না একদম।
সেন্টার টেবিলে বাটিটা রেখে বিছানায় শুয়ে পরলো।
চোখ বুজলো না।চোখ বুজলেই আজকাল কুহুকে দেখতে পায় সে।
চোখ খুললেও যদিও দেখতে পায়।
শাড়ি পরে বউ রুপে ঘুরঘুর করে সে ঘরময়।চুল তার খোলা থাকে।
কি মোহনীয় লাগে দেখতে!
আবির দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
তার আর অপেক্ষা করতে ইচ্ছে হয়না।কিসের অপেক্ষা করছে সে?কুহুর?তার মনে আবিরের জন্য ভালবাসা হবার?কিন্তু অদৌ তা হবে কি?কুহু সত্যি কখনো ভালবাসবে তাকে?
আবির আবারও দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
কিছু ভাবতেও ইচ্ছে করছেনা।ভাবনা গুলোও কেমন বিস্বাদ।
হঠাৎ দরজায় কড়া নড়লো।
আবির নড়েচড়ে উঠলো।
এম৷ সময় এঘরে মা ছাড়া আর কেউ আসবেনা।
নিশ্চয় আবির স্যুপ খেয়েছে কিনা দেখতে এসেছে।
সে চাদরটা মুখের ওপর টেনে নিলো।ঘুমঘুম পাচ্ছে।
বললো,

—ঘরে এসো মা।

কিছুক্ষণ বাদেই সে চাদরটা সরালো।তার মা এতক্ষণ যাবদ চুপ থাকার মানুষ নয়।তাহলে কে ঘরে এলো?
সে সামনে তাকাতেই চমকে উঠলো।
কুহু?শাড়িপরা স্নিগ্ধ রুপে?
নিশ্চয় সে ভুলভাল দেখছে।কুহু এখানে আসতেই পারেনা।
সে আবার চাদর টেনে শুয়ে পরলো।কুহুর চিন্তা করতে করতে মাথা পুরো খারাপ হয়ে গেছে।সারাদিন রাতই এসব দেখছে সে ইদানীং।

কুহু আবিরের কার্যকলাপে চোখ কুঁচকালো। কতোটা সাহস নিয়ে এসেছে সে।আর আবির কিনা তাকে পাত্তাই দিলোনা?
সে সতর্কতামুলক কাশি দিলো।বললো,

—ওগো শুনছো?

আবির তড়িৎ গতিতে উঠে বসলো।তার হার্টবিট ফাস্ট হয়ে গেছে।বুকে হাত রেখে চোখ বড় করে কুহুর দিকে তাকালো।
কুহুর মুখে দুষ্টমী মাখা হাসি।
সে হাসছে?
কই আবিরের কল্পনায় দেখা কুহুতো কখনো হাসেনা?এভাবে কথাও বলেনা। তবে কি এটা সত্যি কুহু?
মনে হাজারো খুশির ঢেউ বইলেও সে মুখটা স্বাভাবিক রাখলো।বললো,

—কি বললে?

—কি বললাম?ডাকলাম তোমায়!তুমি তো আমায় দেখেও না দেখার ভান করলে!

—তুমি আমায় তুমি বলছো কেনো?

—বারে স্বামীকে তুমি বলবো না তো কি বলবো?তুই?

আবির থতমত খেলো।সে এতো ঘামছে কেনো হঠাৎ? জ্বর কি ছুটে গেলো?
গালে মাথায় হাত দিয়ে শুকনো ঢোক গিলে বললো,
—তুমি কি সত্যিই এসেছো কুহু?

—কেনো?মিথ্যা মনে হচ্ছে নাকি?

আবির করুন চোখে তাকালো।

—তবে আরো আগে কেনো আসোনি?

কুহুর হৃদয়টা ধক করে উঠলো।এতো আকুলতা মিশিয়ে কেনো কথা বলছে লোকটা?
সে এগিয়ে গিয়ে আবিরের পাশে বসলো।

—আপনিও তো আমার আর খোঁজ নেননি।

—কে বললো নেয়নি?আমি প্রতি মুহুর্তে তোমার খোঁজ পেয়েছি।লোক ঠিক করে রেখেছিলাম তো।
শুধু নিজেকে সংযত রাখার জন্য নিজে তোমার কাছে যাইনি।

—কষ্ট হয়নি?

—সে আর বলতে!
আর তোমার?

—খুব!

হঠাৎ আবির চোখমুখ কুঁচকে ফেললো।বললো,

—এই তুমি আবার আপনি করে কেনো বলছো?

কুহু মৃদু হাসলো।

—তখন তো দুষ্টুমী করে বলেছিলাম।

—উহু,তুমিই ভালো ছিলো,আপনি চলবেনা।

—সময় দিন,আস্তে আস্তে অভ্যাস করে নেবো।

—আর?

—আর কি?

—নিজের সংসারের দায়িত্ব তুলে নেবে না?

কুহু মাথা নাড়লো।
আবির বললো,

—আর আমার দায়িত্ব?

কুহু শব্দ করে হেসে উঠলো।তার হাসির শব্দ রিমিঝিমি চুড়ির মতোন শোনালো।আবির মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকালো।
কুহু সেদিকে লক্ষ না করেই হাসতে হাসতে বললো,

—আজীবন শুনেছি বউয়ের দায়িত্ব স্বামী নেয় আর এখানে দেখি স্বামীর দায়িত্ব বউকে নিতে বলে।

আবির এগিয়ে এসে পেছন থেকে জড়িয়ে নিলো।ঘারে মুখ গুজে বললো,

—আমার সব নিয়মই এমন উল্টো।

কুহু কেঁপে উঠলো খানিকটা। আবিরের হাতের বন্ধন ছাড়ানোর জন্য হাত দিয়ে চেষ্টা করলো।বললো,

—কি হচ্ছে কি?ছাড়ুন।

আবির ফিসফিস করলো,

—ছাড়ার কোন প্রশ্নই আসছেনা।এখন তো নয়ই বরং সারাজীবন এই বন্ধন ছাড়াতে পারবেনা।এভাবেই আটকে রাখবো আমি।
যতক্ষণ না প্রানপাখি দেহ ছেড়ে উড়াল দেয়।

কুহু তড়িৎ গতিতে পিছু ফিরলো।আবিরের মুখ চেপে ধরে ছলছল নয়নে তাকালো,

—আর কখনো এসব কথা বলবেন না।কষ্ট হয়!

আবির এবার সামনে থেকে জড়িয়ে নিলো।

—ভালবাসো?

কুহু মাথা নাড়লো।সে কথা বলতে পারছেনা।মনে হচ্ছে গলায় কিছু আটকে গেছে।হয়তো অতিরিক্ত খুশি!
তার চোখ বেয়ে অশ্রুর ধারা নামলো।
অপ্রত্যাশিত খুশির অশ্রু!

,

সমাপ্ত।