কুহুকথা পর্ব-১০

0
408

#কুহুকথা
#নুশরাত_জেরিন
#পর্বঃ১০

,
,
—দরজা খুলে ভাঙচুর করছিস কেনো বাবু?

আবির পিছু ঘুরলো।রুনা বেগম দাড়িয়ে আছেন।তার চোখেমুখে খুশি উপচে পরছে।আবির অবাক হলো।এতো খুশি হবার মতো কোন ঘটনা অদৌ ঘটেছে কি?সে তো ঘরের জিনিসপত্র ভাঙচুর করলো একটু আগে।জিনিসপত্র সব এদিকওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।কাচগুলো ভেঙে একাকার।তাহলে মায়ের খুশি হবার কারন কি?সে একভ্রু উঁচু করে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালো।

—মানে?

—মানে মানে কি করছিস হ্যাঁ?
দরজা আটকে ভাঙচুর করবিনা তুই?ভাঙচুরের শব্দ শুনে আমি ভয় পাবো,ভয়ে জোরে জোরে দরজা ধাক্কাবো।
বলবো,বাবু দরজা খোল সোনা,কিচ্ছু উল্টো পাল্টা করিসনা।তুই যা চাস তাই হবে।
তুই তখন জোড় গলায় বলবি,তুমি চলে যাও মা,আমায় একা থাকতে দাও।
তা না করে তুই দরজা খুলে ভাঙচুর করে বসে আছিস?

আবির হা করে কিছুক্ষণ নিরবতা পালন করলো।এই মুহূর্তে অন্যকারো মা থাকলে কি করতো?ঘরে ভাঙচুর করার অপরাধে বকাবকি করতো?নাকি তার ছেলের মন খারাপ কেনো তা জিজ্ঞেস করতো?
সে মিনমিনিয়ে বললো,

—কেনো এসেছো মা?

রুনা বেগম খাটের একপাশে আরাম করে বসলেন।পেছনে হেলান দিতে গিয়ে আবার সোজা হলেন।পেছনের শক্ত খাটটা তার পিঠে বাঁধছে। মুখ কুঁচকে বললেন,

—একটা বালিশ দেতো বাবু,পিঠের নিচে দেই।

আবির ভোতা মুখ করে বালিশ এগিয়ে দিলো।
—বললে না?

—কি?

—কিছু বলতে এসেছো?

–কেনো তোর ঘরে এমনি আসতে পারিনা?

—হুমম।

—কি হুম?হ্যাঁ নয়তো না বলবি!

আবির মুখ গোমড়া করে বসলো।তার এই মুহুর্তে কথা বলতে ইচ্ছে করছেনা।আবার না বলেও পারছেনা।মাকে কিছু বলা মানেই সেচ্ছায় ঝড় ডেকে আনা।তাও আবার যে সে ঝড় না,ঘূর্ণিঝড়!
সে বড় করে নিশ্বাস ছাড়লো।
কেমন দম আটকে আসছে।ভালো লাগছেনা কিছুই।
ভেতরে ছুড়ির ফলার আঘাতের মতো তীব্র ব্যাথা হচ্ছে। কেনো হচ্ছে কে জানে? হয়তো কুহুকে অন্য ছেলের সাথে দেখার জন্য।
ভাবনার মাঝেই রুনা বেগম বলে উঠলেন,

—ড্রেসিং টেবিলটা ভাঙিসনি কেনো বাবু?ওটা কতো পুরোনো হয়ে গেছে,বদলাতে বললেও তো বদলাস না।এই সুযোগে নতুন একটা আনতে পারতি।

আবির চোখ কুঁচকে তাকালো।তার তাকানোর ভঙ্গি দেখে রুনা বেগম ফিক করে হেসে উঠলেন।

—বউয়ের রাগ আমার উপর ঝারবি নাকি?

আবির চকিত দৃষ্টিতে তাকালো।

—মা তুমি?

—সওওব জানি!

—কিভাবে?

—সকালে ছাদ থেকে রাস্তায় তোদের কথা বলতে দেখলাম।কুহু চলে যাবার পরপরই তুই মুখ গম্ভীর করে ঘরে এলি।আর এসেই তো এই কান্ড করলি।

ইশারা করে ভাঙচুর দেখাতেই আবিরও সেদিকে তাকালো।
পরপরই মাথা নিচু করলো সে।
মাথায় কারো হাত পরতেই পুনরায় চমকালো।রুনা বেগম মমতাভরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন।মৃদু গলায় বললেন,

—পাগল ছেলে,এতোটুকু কারনেই মন খারাপ করতে আছে?বউ ই তো,অন্য কেন মেয়ে তো আর না।
কথা না শুনলে তুলে নিয়ে চলে আসবি।

আবির মুচকি হাসলো।তার পাগল মায়ের আজ হলোটা কি?

—কিন্তু তুমি যে ওকে পছন্দ করোনা।

–হ্যাঁ,করতাম না,ভেবেছি ও তোর জন্য পার্ফেক্ট না।কিন্তু এখন মনে হয় খোদা যা করে ভালোর জন্যই করে।নয়তো কে জানতো আমার রাগী মেয়ে বিদ্বেষী ছেলে হুট করেই তার বউয়ের জন্য পাগল হয়ে উঠবে?

আবির হুহুা করে হেসে উঠলো।মায়ের কোলে মাথা রেখে চোখ বুজলো।

—তোমাকে আজ অন্যরকম মনে হচ্ছে মা!

রুনা বেগম হাসলেন।গভীর মমতায় আবিরের মুখপানে চেয়ে বললেন,

—মায়েরা যে এমনই হয়,একেক পরিস্থিতিতে একেক রকম রুপ!

,

কুহু যতো জোরে সম্ভব পা চালাচ্ছে। আবিরের বাড়ির সামনের পথটুকু সে দ্রুত পার হতে চায়।টাকা থাকলে অবশ্যই সে রিকশা করে যেতো।
কিন্তু প্রত্যেক দিনদিন রিকশা করে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব না।সামান্য টিউশনি করিয়ে কতটাকাই বা রোজগার হয়?সংসারই যেখানে ঠিকমতো চলেনা সেখানে বাড়তি খরচের চিন্তা করাটাও অন্যায়।
তাছাড়া হাতে যে যৎসামান্য টাকা আছে তা দিয়ে পিহুর জন্য নতুন চাদর কিনতে হবে।
আজ সে আবারও ডায়েরী হাতে কুহুর রুমে এসেছিলো।সেখানে লেখা ছিলো,

“আমার শীতের কোন পোষাক নেই।
নেই বলতে একেবারেই নেই।শীতে কি যে কষ্ট হয় আমার!তাছাড়া শীত ও তো বেশ পরেছে।এতো শীতে চাদর ছাড়া থাকা যায় নাকি?ইশ!কেউ যদি একটা চাদর এনে দিতো!
পুনশ্চঃএই শীতে যেই নতুন চাদর বাজারে এসেছে,ওইযে পুতি বসানো?কিনলে যেনো ওগুলোই কেনা হয়।কমদামি চাদর আবার আমি পরিনা।গা চুলকায়”

কুহু ডায়েরীটা আবার বের করলো।কেমন অদ্ভুত কষ্ট হচ্ছে তার।পিহু কেনো এমন করে কে জানে?এইযে কুহুর গায়ের মলিন চাদর,সেতো চারবছর ধরে পরছে।কই সে তো নতুন চাদর চায়নি।অথচ পিহুকে প্রতিবছরই কিনে দেওয়া হয়।
কুহু বড়সড় দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।
বাবার ঔষধ ফুরিয়ে এসেছে প্রায়।পিহুর পেছনে খরচ করতে না হলে সে বাবার ঔষধ কিনতে পারতো।
হাঁটার মাঝেই সামনে দড়াম করে বাড়ি খেলো কুহু।কপালে লেগেছে খুব।
সে অবাক হলো।রাস্তার মাঝে গাছ এলো কোথা থেকে?সামনে তাকাতেই আরো একদফা অবাক হলো।
আবির?
আবির ততক্ষণে কুহুর সামনে ঝুকে দাড়িয়েছে।
মুখে হাসির রেখা নেই বললেই চলে।চোখগুলো লাল লাল।কেমন রাগী রাগী ভাব।
কেনো?এতো রেগে আছে কেনো সে?
কুহুর জিজ্ঞেস করতে হলোনা।তার আগেই আবির বলে উঠলো,

—ছেলেটা কে?

–কোন ছেলে?

—কালকের ছেলেটা,যার গাড়িতে উঠে বসলে?

কুহু ভ্রু কুঁচকে এলো আপনাআপনি। কঠোর স্বরে বললো,

—আপনাকে কেনো বলবো?

—তুমি করানটা জানো!

—না জানিনা,পথ ছাড়ুন আমার।

আবির পথ ছাড়া দুরের কথা উল্টো এসে হাত চেপে ধরলো।কুহু হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলো।

—আশ্চর্য,হাত কেনো ধরেছেন?

আবির সেকথার উত্তর দিলোনা।নিজের মতোই বললো,

—ছেলেটার সাথে কি সম্পর্ক তোমার?কি হয় সে?কেনো তার গাড়িতে উঠেছো?

—বলবো না।

–বলবে না?

—না।

—ঠিক আছে।

আচমকা কুহুকে পাঁজা কোলে তুলে নিলো সে।কুহু হাত পা ছোড়াছুড়ি করলো। চিৎকার করে বললো,

—আরে,কি হচ্ছেটা কি?কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমায়?ছাড়ুন!

আবিরের প্রতুত্তর না পেয়ে মিনমিন করলো।

—আমার ভাই হয় সে।

আবির থমকে দাড়ালো।রাগী রাগী মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠেছে ততক্ষণে। ভেতরে শান্তির বাতাস বইতে শুরু করেছে কি?আবারও চলতে শুরু করতেই কুহু বলে উঠলো,

—বললাম তো সব,তবু কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?

—প্রথমে কেনো বললেনা?এখন শাস্তি তো ভোগ করতেই হবে?

,

চলবে…..