“কুহেলিকা”
পর্ব-৬(অন্তিম পর্ব)
মুন্নি আক্তার প্রিয়া
.
.
জঙ্গলের ভেতর দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে পথ হারিয়ে ফেলেছে দুজনে। এভাবে দৌঁড়ানোর ফলে হাঁপিয়ে উঠেছে নন্দিনী। হাঁপাতে হাঁপাতে নন্দিনী বলে,
“কোথায় আসলে? এখানে তো জঙ্গল ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।”
“বুঝতে পারছি না কোথায় এসে পড়লাম। চলো সামনে এগিয়ে দেখি। রাস্তা পেলেও পেতে পারি।”
নন্দিনী আর রিশাদ সামনে হাঁটতে থাকে। হাসিবকে আর দেখা যাচ্ছে না। পুরনো পরিত্যাক্ত একটা বাড়ি দেখে রিশাদ বলে,
“আপাতত কি এই বাড়িটায় আশ্রয় নেব?”
“কেন? থানায় যাবে না?”
“রাস্তা তো খুঁজে পাচ্ছি না।”
“তাহলে চলো। হাসিব হয়ত আশেপাশেই কোথাও আছে। আমাদের আগেই লুকাতে হবে।”
গাছপালায় আবৃত পুরনো পরিত্যাক্ত বাসাটিতে দুজনে প্রবেশ করে। চারদিকে ধুলোবালি, মাকড়শারজাল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। হাত দিয়ে সামনে ঝাড়তে ঝাড়তে ভেতরে ঢোকে। বাড়িটার ভেতরে শুধু অন্ধকার। কিছুই ভালোভাবে দেখা যাচ্ছে না। পেছন থেকে কেউ সজোরে রিশাদের মাথায় আঘাত করে। সাথে সাথে রিশাদ ফ্লোরে লুটিয়ে পড়ে। নন্দিনী চিৎকার করে বলে,
“রিশাদ!”
মাথা থেকে রক্ত বের হচ্ছে রিশাদের। মাথাটা ঝিমঝিম করছে কেমন! ঝাপসা ঝাপসা চোখে রিশাদ তাকিয়ে দেখে পেছনে হাসিব দাঁড়িয়ে। এরপর সেখানেই জ্ঞান হারায় রিশাদ।
যখন জ্ঞান ফিরে তখন রিশাদকে একটা চেয়ারের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। সামনে হাসিব দাঁড়িয়ে আছে। রিশাদ ভাঙা ভাঙা গলায় বলে,
“হাসিব! তুই আমার বন্ধু হয়ে আমার সাথে বেঈমানী করছিস? নন্দিনী কোথায় হাসিব?”
হাসিব সামনে থেকে সরে যায়। মৃদু আলোতে দেখতে পায় সামনের চেয়ারের সাথে নন্দিনীকে বেঁধে রাখা হয়েছে। নন্দিনী কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“রিশাদ কিছু করো! হাসিব কেন এমন করছে?”
“হাসিব নন্দিনীকে ছেড়ে দে বলছি। আমি যদি একবার ছাড়া পাই তাহলে তোকে খুন করে ফেলব বলে দিলাম।”
সজোরে বুকে লাথি খেয়ে চেয়ারসমেত নিচে পড়ে যায় রিশাদ। রিশাদের চোখে বিস্ময়।
“কুত্তার বাচ্চা! তুই বাঁচলে তারপরই না হাসিবকে খুন করবি।”
রিশাদ অবাক হয়ে বলে,
“নন্দিনী! তুমি!”
নন্দিনী শব্দ করে হেসে বলে,
“অবাক হচ্ছিস? তুই কি ভেবেছিলি হাসিব আমায় বেঁধে রেখেছে?”
“এসবের মানে কী?”
“মানে? হ্যাঁ, তা তো বলবই। মরার আগে তোর তো সব জানা উচিত।”
নন্দিনী এতক্ষণ রিশাদের সামনে বসে ছিল। বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে হাসিবকে বলে,
“ওকে উঠিয়ে বসাও।”
হাসিব নন্দিনীর কথামত চেয়ার ধরে উঠায় রিশাদকে। রিশাদ বলে,
“তুই আমার বন্ধু হয়ে নন্দিনীর সাথে হাত মিলিয়েছিস?”
নন্দিনী বলে,
“আজ কথা হবে শুধু তোর আর আমার মধ্যে। আর কেউ কথা বলবে না আজ।
হাসিবকে তুই চিনিস কত বছর ধরে? ১ বছর ৬ মাস। হাসিবের সাথে তোর পরিচয় হয় ঢাকায়। ঢাকায় রাতে তোকে গুণ্ডারা এট্যাক করে। সেখানে হাসিবই তোকে বাঁচায়। সেই থেকেই হাসিবের সাথে তোর বন্ধুত্ব। পরিবারহীন হাসিবকে আশ্রয় দিস তোদের বাড়িতে। আর হাসিব এগুলো সব করে আমার প্ল্যানমাফিক।”
“এসব কেন করেছ?”
“তোকে মারার জন্যই এত নাটক করতে হয়েছে। পানিতে পড়ে মরার নাটক করেছিলাম আমি। হাসিব আমায় জানিয়েছিল তোরা নদীর ঘাটে আসছিস। সেই প্ল্যান অনুযায়ীই আমি নদীতে ঝাপ দেই।”
“তোমাকে যে হুমকি বার্তা দিত সেগুলো?”
“এগুলোও নাটক। আমাকে কেউ কোনো হুমকি বার্তা দেয়নি। ঐগুলো আমি নিজেই লিখতাম। রোহিতের খুন কে করেছে জানিস? আমি করেছি। তুই যখন ওয়াশরুমে যাস তখন রোহিত নিচ থেকে ছাদে যাচ্ছিল। আমার প্ল্যান অবশ্য ওকে সেদিনই মারা ছিল না। কিন্তু এমন সুবর্ণ সুযোগ যে পাব ভাবতেও পারিনি। রোহিতকে বললাম রিশাদ তোমায় বাড়ির পেছনে যেতে বলেছে। বেচারা আমার কথা বিশ্বাস করল। আমিও ওর পেছনে গিয়ে পেছন থেকে ছুরিটা ওর গলায় আর বুকে বসিয়ে দিলাম। সেখানেই পড়ে রইল রোহিত। ছুড়িটা আমি বাড়ির পাশে নদীতে ফেলে বাড়ির উঠোনে এসে প্রদীপ হাতে দাঁড়িয়ে থাকি। তখনই তুই আসিস। ছাদে গিয়ে সবাই যখন রোহিতের খোঁজে ব্যস্ত তখন আমি হাসিবকে ম্যাসেজ করে সবটা জানিয়ে দিয়েছি। হাসিবকে আমিই পাঠাই রোহিতকে খোঁজার জন্য। আসলে খোঁজার জন্য নয় ওর মাথাটা আলাদা করে ফেলার জন্য। হাসিব আমার কথামতই রোহিতের শরীর থেকে মাথা আলাদা করে ফেলে। রাম-দা নদীতে ফেলে দেয়। না কখনো নদীর পানি শুকাবে আর না কেউ কখনো প্রমাণ পাবে। ভেবে দেখ হাসিব কিন্তু সাথে সাথে আসেনি। অনেকটা সময় পর ওর চিৎকার শোনা যায়।”
নন্দিনী আবারও হাসতে থাকে। রিশাদের মুখের কাছে মুখ নিয়ে বলে,
“এরপর তোকে আমি আমার প্রেমের জ্বালে ফাঁসাই। তোর হাত ধরেই তোর বাড়িতে উঠি। আমার নেক্সট টার্গেট ছিল তোর বড় মা। কিন্তু মাঝখান থেকে খুব ঝামেলা করছিল তোর বান্ধবী তোয়া। বারবার আমার পথে চলে আসছিল। তাই তোর বড় মায়ের জায়গায় আমার পরবর্তী শিকার হয় তোয়া। তোয়ার বাসায় হুমকি বার্তা পাঠাই হাসিবকে দিয়ে। তোয়ার খাবারে বিষ হাসিবই মিশিয়েছে। সেইরাতে হাসিবকে কেউ দেখেওনি। তোরা সবাই জানিস তোয়া মারা গেছে। কিন্তু সত্যটা হলো তোয়াকে মার্ডার করা হয়েছে।”
“তার মানে তোয়ার খুনিও তুমি!”
“এখনই অবাক হোস না। আরো শোন, আমি বাড়ি থেকে জঙ্গলের ভেতর ইচ্ছে করেই যাই এবং তোকে দেখেই। তোর ডাকও আমার কানে এসেছিল। আমি তোকে বলেছিলাম, কেউ আমায় ডাকছে। আসলে কেউ আমায় ডাকেইনি। ঐগুলো ছিল আমার বানানো মিথ্যাকথা।
আমাকে যে ঘরে থাকতে দিয়েছিলি সে ঘরেই ছিল গোপন আস্তানা। ঘরের সুড়ঙ্গ দিয়েই কালো জাদুর আস্তানায় যাওয়ার রাস্তা। তোর বড় মা ভাবত আমি বোকাসোকা মেয়ে আমি এগুলো কিছু বের করতে পারব না। কিন্তু তোদের বাড়িতে থেকেই সব বের করেছি আমি। শুধু আমি নয় সাথে হাসিবও।
তোরা সবাই তোয়াকে দেখতে গেলেও বড় মা যায়নি। কারণ তার যে কালো জাদুর কাজ বাকি ছিল। ভোরের দিকে তোকে আর ঐ ডিটেকটিভকে আসতে দেখেই আমি সুড়ঙ্গ দিয়ে ভেতরে ঢুকেছি। দেয়ালে স্কচটেপ দিয়ে লাগানো হুমকি বার্তাটাও আমারই ছিল। যেই অবয়বের কথা তোদের বলেছি সেটা ছিল বানোয়াট। তোর বড় মাকে খুনটা আমিই করেছি। তোর মা যখন আমাকে হুমকিধামকি দিচ্ছিল রাম-দা নিয়ে আগে ঐ গুরুর মাথাটা আলাদা করি। তারপর চোখের পলকেই তোর বড় মায়ের মাথাটা আলাদা করে ফেলি। তিনি কিছু বুঝে উঠার আগেই ঘটনা ঘটে যায়। রাম-দা টা ফেলে দেই আগুনের ভেতর। আর অজ্ঞান হওয়ার নাটক করি।
জ্ঞান ফেরার পর তোদের যা বলি সবই ছিল বানানো কথা।”
“কেন করেছ তুমি এসব? বড়মা না হয় ব্ল্যাক ম্যাজিকের সাথে জড়িত বলে তাকে খুন করেছ। কিন্তু রোহিত, তোয়া, আমি আমরা কী ক্ষতি করেছি তোমার?”
“তোর কী মনে হয় সুদূর বিদেশ থেকে আমি এই গ্রামে এসেছি এমনি এমনি? প্রতিশোধ নিতে এসেছি আমি প্রতিশোধ।”
“কিন্তু আমি তোমায় সত্যিই ভালোবেসেছিলাম নন্দিনী। আমি তোমার এসব নাটক, অভিনয়ের কথা জানতাম না। তোমার বিপদের কথা জেনেও আমি তোমার হাত ছাড়িনি। তোমায় ভালোবেসে গেছি।”
“হাহ্! ভালোবেসেছিলি। তাও তুই? নিজের স্বার্থে তুই আমায় ভালোবেসেছিস। ঐ জ্যাতিষীর কথা মনে আছে? সেদিন তুই আমায় যা বলেছিলি তা ছিল মিথ্যা। জ্যোতিষী সেদিন আমার বিপদের কথা নয় বরং তোর বিপদের কথা বলেছিল। তোর জীবনে অনেক বিপদ রয়েছে। এবং তোকে সব বিপদ থেকে একমাত্র আমিই বাঁচাতে পারব এটাই বলেছিলেন উনি।”
“তুমি এসব জানলে কী করে?”
নন্দিনী হাসতে হাসতে বলে,
“বোকা ছেলে! সেই জ্যোতিষীও যে আমারই ঠিক করা ছিল। হাসিবকে দিয়েই আমি বলিয়ে দিয়েছি উনাকে কী কী বলতে হবে। আননোন নাম্বার থেকে যে তখন ফোন আসে? ঐ ফোন করেছিল হাসিব। সেটাও আমারই কথামত। আমি চেয়েছিলাম আমার অনুপস্থিতিতে জ্যোতিষী এসব বলুক।”
“এটা কেন করেছ তুমি? কী লাভ ছিল?”
“লাভ ছিল। লাভ ছিল বিধায় তো করেছি। আমি জানতাম, তুই জ্যোতিষী বিশ্বাস করিস। যদি তুই ভয়ে আমায় ছেড়ে দিস তখন তো আমার প্ল্যান ভেস্তে যেত। এজন্য জ্যোতিষীর এই নাটকটা করতে হয়েছে। আর ম্যাসেজটা হাসিবও পাঠিয়েছিল। যাতে সেখান থেকে আমার সরে আসার কোনো সন্দেহ না করতে পারিস তুই।”
রিশাদ অবাক হয়ে নন্দিনীর দিকে তাকিয়ে আছে। নন্দিনীকে দেখে কখনো মনেই হয়নি এতসব ঘটনা ওর ভেতর পুষে রেখেছিল। এত নিখুঁতভাবে খুন করেছে।
নন্দিনী বলে,
“রোহিত, তোয়া, বড়মা, গুরু আর তুই ছিলি আমার টার্গেট। চারজনকে খুন করা শেষ। আজ তোর পালা।”
“আমাদের অপরাধ কী ছিল নন্দিনী?”
“নাটক করিস না আমার সামনে। তুই, রোহিত আর তোয়াও যে এই কালো যাদুর সাথে জড়িত সেটা আমি জানিনা ভেবেছিস? গঙ্গার খুনটা তোরাই করেছিলি।”
“তুমি কি গঙ্গার কেউ? ওর মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে এসেছ?”
“না। আমি আমার ভালোবাসার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে এসেছি। আমার ছোট বোনের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে এসেছি।”
“তোমার ভালোবাসা, ছোট বোন!”
“হ্যাঁ আমার ভালোবাসা। আমার স্বপ্নীল। স্বপ্নীল আর আমার ছোট বোনকে খুন করেছিস তোরা।
সেদিন আমি ছিলাম বিদেশে। আমার ছোট বোন আর স্বপ্নীল দেশে এসেছিল জমি-জমার বিষয়ে কথা বলতে। রাতে বাড়িতে ফেরার পথে স্বপ্নীল আমায় ফোন দিয়েছিল। কথা বলার সময়ই তোরা আসিস। ফোনের ওপাশ থেকেই আমি চিৎকার চেঁচামেচি শুনতে পাই। তোর মুখে শুনতে পাই তোয়া আর রোহিতের নাম। রোহিতের মুখে শুনতে পাই তোর নাম। রোহিত কুত্তার বাচ্চা আমার ছোট বোনকে ধর্ষণ করেছিল। তুই আর তোয়া মিলে আমার স্বপ্নীলকে মেরে ফেলেছিস। রাতের অন্ধকারে ফোনটা দেখতে পাসনি। ফোনের ওপাশ থেকে আমি শুনেছিলাম আমার বোনের আত্মচিৎকার। শুনেছিলাম আমার স্বপ্নীলের আহাজারি। আমার তখন কেমন লেখেছিল বুঝতে পারছিস তুই? ওদের লাশটাও পর্যন্ত খুঁজে পাইনি আমরা। দুজনের মাথা তো আলাদাই করে ফেলেছিলি। দেহটাও রাখিসনি। হাসিব কে জানতে চেয়েছিলি না? হাসিব স্বপ্নীলের ছোট ভাই। আমার ছোট বোনের ভালোবাসা। সেই ভালোবাসার প্রতিশোধ নিতেই আমরা দুজন এসেছি।”
রিশাদ আকুতিভরা কণ্ঠে বলে,
“আমার ভুল হয়ে গেছে নন্দিনী। ক্ষমা করে দাও আমায় প্লিজ।”
“সেদিন আমার বোন আর স্বপ্নীলও ঠিক এভাবেই কেঁদেছিল। শুনেছিলি ওদের আকুতি? স্বপ্নীল বারবার করে বলেছিল আমার বোনটাকে ছেড়ে দিতে। ছেড়েছিলি সেদিন তোরা?”
রিশাদের আর কোনো আকুতি না শুনেই হাসিব আর নন্দিনী ক্ষত-বিক্ষত করতে থাকে রিশাদের শরীর। ফ্লোরে রক্তের বন্যা বয়ে গেছে। একের পর এক কোপ দিতে দিতে টুকরো টুকরো করে ফেলেছে রিশাদের শরীর। হাসিব আর নন্দিনীর মন শান্তি হয়েছে এতক্ষণে। নন্দিনী চিৎকার করে বলে,
“স্বপ্নীল দেখো আমি প্রতিশোধ নিয়েছি। ছোট বোন আমার দেখ তোদের খুনের বদলা আমরা নিয়েছি।”
হাসিব বলে,
“আমাদের কাজ শেষ। দুটোয় আমাদের ফ্লাইট। ১২টা বাজে এখন। এয়ারপোর্টে পৌঁছাতে হবে আমাদের।”
“হ্যাঁ চলো।”
বুক ভরা প্রশান্তি নিয়ে নন্দিনী আর হাসিব পুরনো বাড়িটা থেকে বেরিয়ে আসে। কত বছরের ইচ্ছে আজ পূরণ হলো দুজনের। প্রতিশোধের আগুন বুক থেকে নেমে গেছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে নন্দিনী। আকাশের মেঘের মাঝে দেখতে পায় স্বপ্নীল ও বোনের হাসিমাখা মুখ।
—————————————————
বোরকা পরে বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষা করছে নন্দিনী। হাসিব বাসের টিকেট কাটতে গেছে।
একগুচ্ছ ফুলের তোড়া নিয়ে সামনে দাঁড়ায় মুহিব। ফুলগুলো নন্দিনীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
“কংরাচুলেশন নন্দিনী।”
নিকাব পরায় শুধু চোখ দুটো দেখা যাচ্ছে। সেই চোখেই ছিল বিস্ময়। মুহিব মৃদু হেসে বলে,
“অবাক হচ্ছেন মিস নন্দিনী? ভাবছেন ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি কেন? তাহলে শুনুন, আপনার খুনের বিষয়ে আমি সব জানি। রোহিত, তোয়া, রিশাদ, গুরু আর বড় মাকে যে আপনিই খুন করেছেন সেটা আমার কাছে পরিষ্কার। আপনার সম্পর্কে আগাগোড়া সব ডিটেইলস বের করেছি। আপনি প্রতিশোধ নিতেই বিদেশ থেকে এসেছেন। কিন্তু কোন দেশ থেকে এসেছেন সেটা এখনো আমার অজানা। ভাবছেন আমি কীভাবে জানলাম খুনেন ব্যাপারে?
আপনার সাথে যখন আমি কথা বলি, তখন বলেছিলেন আপনি পানিতে ঝাপ দিয়েছিলেন মরার জন্য। আপনি এটাও বলেছিলেন আপনি গ্রামের মেয়ে। আর গ্রামের মেয়ে হয়ে সাঁতার জানেন না বলেছেন। অদ্ভুত না এটা? আপনার বলা গ্রামে গিয়ে আমি খোঁজ-খবর নিয়েছি। আপনার ছবি দেখিয়েও আপনার কথা জিজ্ঞেস করেছি। কিন্তু আপনাকে কেউই চিনতে পারেনি। তার কারণ আপনি সেই গ্রামের মেয়েই নন। এবং আপনার সেই গ্রামে কোনো প্রাক্তন ছিল না। আর না কোনো মাতব্বের ছেলে আপনাকে পছন্দ করত। এগুলো সবই ছিল মিথ্যা কথা। তাই তো?
তারপর বড় মায়ের রুমে মোমবাতিটা আপনিই রেখেছিলেন। আমি আসার পরই আপনি মোমটা জ্বালিয়ে তাড়াতাড়ি নিচে এসেছেন। আর তাড়াহুড়ো করে আপনার ম্যাচটাও ঐ রুমেই ফেলে এসেছেন। রিশাদের বাড়িতে কেউ কাঠি ম্যাচ ব্যবহার করত না। সেটা সেদিনই ক্লিয়ার হয়েছে। রিশাদের ছোট মা বলেছিল রান্নাঘরে ম্যাচের গ্যাস শেষ। বাড়ির কাজের লোককেও গ্যাস ম্যাচ আনতে বলেছিল। রিশাদের কাছেও ছিল গ্যাস ম্যাচ। কথায় কথায় জানতে পারি ঐ বাড়িতে কেউ কাঠি ম্যাচ ব্যবহার করে না। অথচ বড় মায়ের রুমে কাঠি ম্যাচ পড়ে ছিল। কারণ আপনি গ্যাস ম্যাচ জ্বালাতে পারেন না।”
নন্দিনী চুপ করে আছে। মুহিব মৃদু হেসে বলে,
“আমার বাড়িতে লোডশেডিং হওয়ার পর আমি আপনাকে গ্যাস ম্যাচ এগিয়ে দেই মোমবাতি জ্বালানোর জন্য। কিন্তু আপনি ম্যাচটা না নিয়ে রান্নাঘরে যান। কারণ রান্নাঘরে ছিল কাঠি ম্যাচ।
এরপর আপনি আরো দুটো ভুল করেন। সেগুলোও তাড়াহুড়োতেই করে ফেলেন। আপনি আমার বোনদের সাথে যখন আচার খাচ্ছিলেন তখন আমি আপনাকে বলেছিলাম, যে নাম্বার থেকে আপনাকে হুমকি দেওয়া হয়েছে সেটা কাগজে লিখে দিতে। আপনার ডান হাতে আচার লেগেছিল বিধায় আপনি বাম হাতে নাম্বার লিখে দেন। সাথে লিখেন ‘হুমকি বার্তার নাম্বার।’ আপনি যে দুই হাতেই লিখতে পারেন সেটা আমি সেদিনই জানি। আর হুমকি বার্তাগুলো আপনি বাম হাত দিয়েই লিখতেন।
দ্বিতীয় ভুলটা করেন আমার রুমে। আমার রুমে হুমকি বার্তা রেখে আসার সময় আপনার উড়না আমার ড্রয়ারের সাথে আটকে যায়। তাড়াহুড়ো করে সেটা খুলতে গিয়ে আপনার উড়নার কিছু অংশ ছিড়ে ফ্লোরে পড়ে যায় যেটা আপনি খেয়াল করেননি। সকালে যখন আপনাকে হুমকি বার্তা দেখাই তখন আপনি উড়না দিয়ে কপাল মুছছিলেন। তখনই উড়না ছেঁড়া দেখতে পাই। ছেঁড়া অংশটুকু আমার রুমেই পেয়েছিলাম।
এগুলোই ছিল আপনার ছোটখাট ভুল। এছাড়া পুরো ঘটনাটা আপনি নিঁখুতভাবে সাজিয়েছেন। আমি সব জেনেও পুলিশকে কিছুই জানাইনি। কারণ আমি চেয়েছিলাম আপনি আপনার প্রতিশোধ নিন। তবে এরমাঝেও একটা সত্যি আছে। সেটা হচ্ছে আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি আমি।”
মুহিব একটা রিং ও হ্যান্ডকাফ পকেট থেকে বের করে। দুহাতে দুটো নন্দিনীর সামনে ধরে বলে,
“এখন আপনিই সিদ্ধান্ত নিন। হ্যান্ডকাফ পরে জেলে যাবেন নাকি রিং পরে সারাজীবনের জন্য আমার হবেন?”
নন্দিনী হাসতে হাসতে নিকাবটা খুলে ফেলে। মুহিব অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। কারণ সামনের মেয়েটি নন্দিনী নয়। মেয়েটি বলে,
“নন্দিনীকে এতটা বোকা ভাবাই ছিল আপনার সবচেয়ে বড় ভুল।”
“কে আপনি?”
“নন্দিনীর শুভাকাঙ্ক্ষী। আপনার চোখের সামনে দিয়েই নন্দিনী চলে গেল অথচ আপনি বুঝতেও পারলেন না। এতক্ষণ আপনি যা যা বলেছেন সব ফোনের ওপাশ থেকে শুনেছে নন্দিনী। একটা ভয়েজ আপনার ফোনে পাঠাবে। শুনে নেবেন।”
সাথে সাথেই মুহিবের ফোনে একটা ভয়েজ আসে। ভয়েজটা ওপেন করে মুহিব।
“মিস্টার মুহিব, আপনি ভীষণ বোকা। আমি এত সহজেই আপনার কাছে ধরা দেবো এটা আপনি ভাবলেন কীভাবে? আমি আগেই জানতাম শেষ সময়ে আপনি আমাকে আটকাবেন। আপনি যে আমায় ভালোবাসেন সেটাও আমি জানতাম। এখন ভাবছেন আমি এসব কীভাবে জানলাম? আপনার মায়ের কাছে জানতে পারি আপনার ডায়েরী লেখার অভ্যাস আছে। আপনার রুমে হুমকি বার্তা রেখে আসার সময়ে যেই ড্রয়ারের সাথে আমার উড়না আটকে যায় সেখানেই ছিল আপনার ব্যক্তিগত ডায়েরী। এবং ভুলবশত সেদিন আপনি চাবি ড্রয়ারের লকারেই আটকে রেখেছিলেন। কথায় বলে না, আল্লাহ্ যা করেন ভালোর জন্যই করেন? কথাটা আসলেই সত্যি। উড়না ছাড়াতে গিয়েই আমি ডায়েরীটা পাই এবং সঙ্গে করে নিয়ে আসি। সে রাতেই ডায়েরী পড়ে জানতে পারি আপনি আমার সম্পর্কে অনেক কিছু জেনে গেছেন। আমাকে ভালোবাসার কথাটাও ডায়েরীতে লেখা ছিল। উড়নার ব্যাপারটা ছাড়া আপনি সবকিছু লিখে রেখেছিলেন। খেলার গুটিটা আমি সে রাতেই পাল্টে ফেলি। আপনার লোকরা আজ আমায় ফলোও করে। কিন্তু আমার শুভাকাঙ্ক্ষী আর আমি তাদের গোলকধাঁধায় ফেলি। তখন তারা আমার শুভাকাঙ্ক্ষীকেই আমায় ভাবে। আপনার পাশ দিয়েই আমি এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে চললাম।
মিস্টার মুহিব, কাঁচা মাথা নিয়ে নন্দিনীর সাথে গোয়েন্দাগিরি করা আর অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়া একই ব্যাপার। আমার ভালোবাসা শুধুই স্বপ্নীল। হয়ত ও আর পৃথিবীতে নেই। কিন্তু ওর প্রতি আমার ভালোবাসা এখনো বেঁচে আছে। আমি হলাম কুহেলিকা। কুয়াশায় আচ্ছন্ন নন্দিনী। কুয়াশায় ঢেকে থাকা ওপর পাশের যেমন কিছুই দেখা যায় না ঠিক তেমনিই আমাকে বোঝা সহজ নয়। গুড বাই মিস্টার মুহিব।”
ভয়েজটা শুনে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে মুহিব। সামনের মেয়েটাও চোখের আড়াল হয়ে গেছে। প্লেন উড়ার শব্দ পেয়ে আকাশের দিকে তাকায় মুহিব। হাত ঘড়িতে তাকিয়ে দেখে ২:২০ বাজে।
(সমাপ্ত)