কুহেলিকা পর্ব-৫

0
8564

“কুহেলিকা”
পর্ব-৫
মুন্নি আক্তার প্রিয়া
.
.
ফ্লোরে বসে বিছানার উপর মাথা রেখেই কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ে নন্দিনী।
ভোরের আলো ফুঁটতে শুরু করেছে মাত্র। হঠাৎই হাতে ব্যথা ও জ্বালা অনুভূত হয়। নন্দিনীর ঘুম ভেঙে যায়। হাতের দিকে তাকিয়ে দেখে হাত অনেকখানি কেটে গেছে। গলগল করে রক্ত পড়ছে কাটা স্থান থেকে। চোখের পলকেই সামনে দেখতে পায় একটা মানুষের অবয়ব। সম্পূর্ণ কালো পোশাকে আবৃত। হাতে একটা ছুড়ি। ছুড়ির কোণা বেয়ে রক্ত পড়ছে। নন্দিনী ভয়ে পিছিয়ে যায়।
“কে তুমি? আমার রুমে আসলে কীভাবে? আঘাত করছ কেন আমায়?”
অবয়বটি কোনো উত্তর না দিয়ে নন্দিনীর সামনে এগোতে থাকে। নন্দিনী বসেই পেছাতে থাকে। তবে কি মৃত্যু সন্নিকটে এসেই পড়েছে! নন্দিনী জোরে জোরে চিৎকার করে ডাকতে থাকে,
“বাড়িতে কেউ আছো! আমায় সাহায্য করো প্লিজ।”
কিন্তু নন্দিনীর আওয়াজ কারো কানেই পৌঁছায় না। কীভাবেই বা পৌঁছাবে! বাড়িতে নন্দিনী ছাড়া আর কেউ নেই। সবাই সেই রাতেই তোয়ার বাসায় গেছে। নন্দিনী পেছাতে পেছাতেই একটা সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে নিচে পড়ে যায়। উপর থেকে নিচে পড়ায় বেশ খানিকটা ব্যথাও পায়। কিন্তু কোথায় পড়েছে সেটা বুঝতে পারছে না। চারদিকে শুধু ঘুটঘুটে অন্ধকার। কাটা হাতেই বেশি ব্যথা পেয়েছে। ধুলোবালি লেগে আরো বেশি জ্বলছে। শরীরের ময়লা ঝেড়ে উঠে দাঁড়াতেই দেখতে পায় আগুনের মৃদু আলোতে দূরের দিকটা পরিষ্কার। সেখানে দুজন মানুষ বসে আছে। একজন পুরুষ ও একজন মহিলা। পুরুষ যে জন তার পরনে কালো ধুতি শুধু। গলায় কীসব মাথার মতো মালা। কপালে লম্বা লাল তীলক। চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে কী জানি বলছে আর আগুনে লাল রক্তের ন্যায় কিছু ঢালছে। সামনে রয়েছে মানুষের মাথা, পুতুল, শুকনো জবা ফুল। পাশের মহিলাটিও চোখ বন্ধ করে বসে আছে। চুলগুলো ছেড়ে রাখা। মুখ দেখা যাচ্ছে না। নন্দিনী কী করবে বুঝতে পারছে না। একই তো এই অন্ধকারে বের হওয়ার কোনো রাস্তা দেখা যাচ্ছে না। আর দ্বিতীয়ত এরা কালো যাদু করছে। এত মানুষের ক্ষতি এরাই করছে। নন্দিনী ভেবে নিয়েছে যা হবার হবে। তবুও সে এর শেষ দেখে ছাড়বে। এমনিতেও তো নন্দিনীর পেছনে কেউ লেগেই আছে। মরতে যদি হয় তবে না হয় সব জেনেই মরব।

নন্দিনী গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যায়। যতই সামনে এগোচ্ছে ততই যেন শরীর শিউরে উঠছে। যখন একেবারেই সামনে এগিয়ে যায় তখন নন্দিনীর চোখ চড়কগাছ। সামনে থাকা মানুষটাকে দেখে বুঝতেই পারছে না এই মানুষটাই ব্ল্যাক ম্যাজিকের সাথে জড়িত। না চাইতেও নন্দিনী মুখে হাত দিয়ে শব্দ করে চেঁচিয়ে উঠে। বড় মা সাথে সাথে চোখ তুলে তাকায়। কিন্তু গুরুজি তখনো যজ্ঞে ব্যস্ত। বড় মা নন্দিনীকে দেখে অবাক হয়ে বলে,
“তুমি এখানে?”
নন্দিনী কাঁপতে কাঁপতে বলে,
“আন্টি! আপনি! আপনিই এই কালো যাদুর সাথে জড়িত? একের পর এক খুন আপনার দ্বারাই হচ্ছে?”
নন্দিনীর উপর বেশ ক্ষেপে যান তিনি। উঠে দাঁড়িয়ে নন্দিনীর কাছে গিয়ে বলেন,
“নিজের মৃত্যুকে নিজে এভাবে কাছে ডেকে আনলে? গোপন আস্তানায় এসেই যখন পড়েছ তবে শোনো, হ্যাঁ আমিই এই কালো যাদুর সাথে জড়িত। এত বছরেও যেটা কেউ জানতে পারেনি মাত্র কয়দিনেই তুমি সেটা জেনে গেছ। তোমার মৃত্যু খুবই সন্নিকটে নন্দিনী।”
নন্দিনী কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“কেন সবাইকে এভাবে খুন করছেন? আমার সাথেই বা আপনার কীসের শত্রুতা?”
“তোমায় মেরে ফেলার কোনো ইচ্ছেই আমার ছিল না। তোমার বালিশের নিচে সূঁচ আর শুকনো জবা ফুল আমিই রেখেছিলাম। তবে আমি চেয়েছিলাম শুধু তোমাকে ভয় দেখাতে। যাতে তুমি এই বাড়ি ও রিশাদের জীবন থেকে চলে যাও। তা তো হলোই না বরং উল্টো তুমি সব জেনে গেলে। এবার তো তোমায় মরতেই হবে।”
“আমাকে মেরে ফেললেই আপনি পার পেয়ে যাবেন ভেবেছেন? সত্যি কোনোদিনও চাপা থাকে না। আজ না হয় কাল সেটা প্রকাশ পাবেই।”
তিনি নন্দিনীর চুলের মুঠি ধরে বলেন,
“তুই বেঁচে থাকলেই না প্রকাশ পাবে। তার আগেই তোকে উপরে পাঠানোর ব্যবস্থা করছি।”
তখনই সাথে সাথে চারদিক অন্ধকার হয়ে যায়। যজ্ঞের আগুন নিভে যায়। শেষ আগুনটুকু নেভার আগে দেখতে পায় গুরুর শরীর থেকে মাথাটা আলাদা হয়ে গেছে। সেই কালো অবয়বটি। হাতে রাম-দা।
বড় মা নন্দিনীকে ছেড়ে দেন। অবয়বটির উদ্দেশ্যে বলেন,
“কে তুই?”
“তোর যম! তোদের ক্ষতি করার কোনো উদ্দেশ্যে ছিল না আমার। কিন্তু তোরা আমার শিকারের দিকে হাত বাড়িয়েছিস। এটা তো হতে পারে না। নন্দিনীকে মারার আগেই আমার হাতে তোর মৃত্যু হবে।”

মুহূর্তেই বড় মায়ের মাথাটা আলাদা করে ফেলল। নন্দিনী ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠল। চারদিকে দৌঁড়াতে লাগল। কাঠের ন্যায় দরজার মতো কিছু পেয়ে এলোপাথাড়ি ধাক্কাতে লাগল। অবয়বটি বলতে লাগল,
“ভয় পাচ্ছো কেন নন্দিনী? আমি তো এখনই তোমায় মারব না। তোমার শত্রুদের শেষ করলাম। সময় হলে তোমাকেও শেষ করে দেবো।”
নন্দিনী এবার সেন্সলেস হয়ে মাটিতে পড়ে যায়।
.
নন্দিনীর যখন জ্ঞান ফিরে তখন নন্দিনীর গায়ে জ্বর। ভয়ে তটস্থ হয়ে বিছানায় উঠে বসে। পাশেই রিশাদ, হাসিব বসে আছে। আর সামনে মুহিব। রিশাদ নন্দিনীকে শান্ত করে বলে,
“রিল্যাক্স নন্দিনী। ভয় পেয়ো না। তুমি এখন বিপদমুক্ত।”
মুহিব নন্দিনীর দিকে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দেয়। নন্দিনী এক নিঃশ্বাসে পানিটুকু শেষ করে। বাড়ির মধ্যে পুলিশ, সাংবাদিকের কোনো অভাব নেই। সাথে তো রয়েছে গ্রামের মানুষজন। এত বছর পর আসল ঘটনা বের হলো। সাংবাদিকরা নন্দিনীর সাথে কথা বলতে চাচ্ছে। মুহিব জিজ্ঞেস করছে,
“আপনি কি মিডিয়ার সামনে এখন কথা বলতে পারবেন নাকি নার্ভাস আছেন এখনো?”
“মিডিয়ার সামনে কথা বলব কেন?”
“কারণ সবাই এখন এটাই জানে এই রহস্য বের করেছেন আপনি।”
“কিন্তু আমি তো…”
“হ্যাঁ, জানি আপনি রহস্য বের করেননি। বরং কেঁচো খুঁজতে গিয়ে কেউটে বেরিয়ে গেছে। পুরো ঘটনা কী হয়েছিল বলুন তো? আমরা যখন আসি তখন বাড়িতে কেউ ছিল না। আপনার রুমের দরজা খোলা ছিল। আপনার রুমে এসে আপনাকে পাইনি। তবে রুমের কোণায় একটা সুড়ঙ্গের মুখ দেখতে পাই। আমরাও সুড়ঙ্গ দিয়ে ভেতরে ঢুকি। ফোনের আলো দিয়ে চারপাশ দেখে দুজনের লাশ পেলাম। এক রিশাদের বড় মায়ের। আর দুই যার মাধ্যমে কালো যাদু করা হয়। আর কিছুটা দূরেই আপনাকে অজ্ঞান অবস্থায় পাই। এখন কথা হচ্ছে এদের খুন করল কে? আর আপনিই বা সেখানে গেলেন কীভাবে?”
“আমাকে যে হুমকি বার্তা দেয় সেই ওদের খুনী।”
“আপনি তাকে দেখেছেন?”
“সে মানুষ নাকি আমি তো সেটাই বুঝতে পারি না। শুধু দেখি একটি কালো অবয়ব। এবং সে বারবার শুধু এটাই বলে আমি নাকি তার শিকার। কিন্তু কে সে? কেন মারতে চায় আমাকে!”
“কী কী হয়েছিল সবটা একটু খুলে বলুন তো।”
নন্দিনী শুরু থেকে সবটা খুলে বলে। মুহিব চিন্তিত হয়ে বলে,
“আমিও তো এটাই বুঝতেছি না কেন সে আপনাকে খুন করতে চায়। আপনার কি কারো সাথে কোনো শত্রুতা ছিল?”
“জি না। আমি খুবই সাধারণ একটা মেয়ে। কখনো কারো সাথে উঁচু গলায় কথাও পর্যন্ত বলিনি।”
“ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, একটা কথা বলব?”
“জি।”
“আপনার কি কোনো প্রাক্তন ছিল?”
নন্দিনী এবার রিশাদের দিকে তাকিয়ে একটু ইতস্ততবোধ করে। রিশাদ নন্দিনীকে অভয় দিয়ে বলে,
“সত্যিটা বলো। সমস্যা নেই।”
“জি ছিল।”
“সে কি মারা গেছে?”
“না। বছর দুয়েক আগে অন্যজনকে বিয়ে করেছে।”
“গোলমেলে লাগছে এখনো। আচ্ছা এমন কেউ ছিল যে আপনাকে পছন্দ করত বা ভালোবাসতো?”
“মনে পড়ছে না।”
“মনে করার চেষ্টা করুন।”
নন্দিনী কিছুক্ষণ ভেবে বলে,
“হ্যাঁ, ছিল একজন। গ্রামের মাতব্বের ছেলে। প্রায়ই শুধু বলত তাকে বিয়ে করতে।”
“সে এখন কোথায়?”
“জানি না আমি। আমায় অনেক করে বোঝানোর পরও যখন রাজি হইনি তারপর থেকে তাকে আর দেখিনি।”
মুহিব কিছুক্ষণ চুপ থেকে কী যেন ভাবল। তারপর বলল,
“আচ্ছা। এখন মিডিয়ার সাথে কথা বলুন। সাংবাদিকদের এটা বলার দরকার নেই যে, কেউ আপনাকে মারার হুমকি দিচ্ছে।”
“আচ্ছা।”
রিশাদ নন্দিনীকে বাহিরে নিয়ে যায়। পুলিশ, মিডিয়া, গ্রামবাসীর অভাব নেই বাড়ির উঠোনে। সাংবাদিকদের সাথে কথা বলার পর সবাই বাড়ি থেকে চলে যায়। নন্দিনী বাড়িতে ঢোকার আগে ছোট মা পথ আগলে দাঁড়িয়ে বলেন,
“কালো যাদুর রহস্য বের করে সব মানুষের সাহায্য করার জন্য ধন্যবাদ নন্দিনী। কিন্তু এই বাসায় তোমার আর কোনো জায়গা নেই। কেউ তোমাকে খুন করতে চাচ্ছে। তোমাকে সাহায্য করতে গিয়ে যদি আমাদের কোনো ক্ষতি করে? যেচে তো আর কেউ নিজের ক্ষতি করতে চায় না।”
রিশাদ বলে,
“মা এসব কী বলছ? বিপদের সময় তুমি ওকে থাকতে দেবে না?”
“না। দেবো না। তুইও আর ওর সাথে কোনো সম্পর্ক রাখবি না। ভেতরে আয় তুই।”
“আমি তোমার মতো এত স্বার্থপর নই মা। নন্দিনার জায়গা এই বাড়িতে না হলে, আমিও থাকব না।”
ছোট মা রাগেই বাড়ির দরজা বন্ধ করে দেন। নন্দিনী মাথা নিচু করে বলে,
“আমার জন্য শুধু শুধু নিজেদের মধ্যে ঝামেলা করবেন না প্লিজ।”
মুহিব বলে,
“আপনাদের কারো সমস্যা না হলে নন্দিনী আমার বাসায় থাকতে পারে। বাড়িতে আমার মা-বাবা, ছোট দু’বোন রয়েছে।নন্দিনীর সমস্যা হবে বলে মনে হয় না।”
“আপনি কি জানেন, আমায় সাহায্য করলে সে আপনারও ক্ষতি করবে বলেছে। রুমের দেয়ালে হুমকি বার্তাটা দেখেছেন নিশ্চয়ই?”
নন্দিনীর কথা শুনে মুহিব হেসে বলে,
“মরণ থাকলে মরব। ভয় পেয়ে আরেকজনকে তো মৃত্যুর মুখে ঢেলে দিতে পারি না।”
সবাই বোঝানোর পর নন্দিনী রাজি হয়। মুহিব বাড়ির এড্রেস দিয়ে বলে,
“এটা আমার বাড়ির ঠিকানা। আমি বাড়িতে ফোন দিয়ে আপনাদের কথা বলে দিচ্ছি।”
রিশাদ জিজ্ঞেস করে,
“আপনি বাসায় যাবেন না?”
“থানায় আমার একটু কাজ আছে। আমি কাজটা কমপ্লিট করেই বাসায় আসব। আপনি নন্দিনীকে নিয়ে বাসায় যান।”
“ঠিক আছে।”
.
রিশাদ নন্দিনীকে নিয়ে মুহিবের বাড়ির দিকে যাচ্ছে। এই গ্রামে শুধু জঙ্গল আর জঙ্গল। দিনদুপুরে কাউকে খুন করে ফেললেও কিছুই করার থাকবে না। একজন জ্যোতিষীকে দেখে রিশাদ থেমে যায়। নন্দিনী জিজ্ঞেস করে,
“থামলেন কেন?”
“চলো জ্যোতিষীর কাছে হাত দেখাব।”
“আপনি বিশ্বাস করেন এসব?”
“না করার কী হলো? এর আগে অনেক কিছুই মিলে গেছে। তাই বিশ্বাস করি।”
“তাহলে আপনিই হাত দেখান। আমি এসব বিশ্বাস করি না।”
“বেশ! আমিই দেখাব চলো।”
জ্যোতিষীর কাছে গিয়ে রিশাদ হাত দেখায়। পাশে নন্দিনী দাঁড়িয়ে আছে। জ্যোতিষী চিন্তিত মুখে কিছুক্ষণ নন্দিনীর দিকে তাকিয়ে বলেন,
“মা তোমার হাতটা দাও তো।”
নন্দিনী বিরক্ত হলেও ভদ্রতার খাতিরে নিচে বসে হাতটা তার দিকে এগিয়ে দেয়। তিনি মনোযোগ দিয়ে হাত দেখছেন। হাত দেখে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন তিনি। আননোন নাম্বার থেকে তখন ফোন আসে নন্দিনীর। জ্যোতিষী বলেন,
“দূরে গিয়ে কথা বলো মা।”
নন্দিনী উঠে একটু দূরে গিয়ে ফোনটা রিসিভ করে বলে,
“হ্যালো কে বলছেন?”
ওপাশ থেকে কোনো শব্দ নেই। নন্দিনী আবার জিজ্ঞেস করে,
“কে আপনি?”
এবার ওপাশ থেকে বিদঘুটে একটা হাসির শব্দ আসে এবং ফোনটা কেটে দেয়। নন্দিনী সাথে সাথে ফোন দেয় সেই নাম্বারে। কিন্তু ফোনটা বন্ধ। রিশাদ এসে বলে,
“চলো।”
নন্দিনীকে চিন্তিত দেখে হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করে,
“কী হয়েছে?”
“কিছু না।”
“বলো।”
“একটা আননোন নাম্বার থেকে ফোন এসেছিল। বিদঘুটে হাসি ছাড়া আর কিছুই শুনতে পেলাম না। ছাড়ুন এসব। জ্যোতিষী কী বলল? আর উনি আমার হাত দেখলেন কেন?”
“শুনতে হবে না। শুধু শুধু টেনশন করবে।”
“না শুনলে আরো বেশি চিন্তা হবে।”
“ঘাবড়ে যাবে না তো?”
“না।”
“উনি বলেছেন তোমার সামনে অনেক বিপদ। এবং তোমার সাথে সম্পর্ক রাখলে আমারও অনেক বিপদ হবে। কিন্তু তুমি এটা ভেবো না, আমি ভয় পেয়ে পালিয়ে যাব। আমি তোমায় ভালোবাসি। তোমার বিপদ-আপদে সবসময় আমি তোমার পাশে থাকব।”
নন্দিনীর ফোনে তখন সেই নাম্বার থেকে একটা ম্যাসেজ আসে। ম্যাসেজটা ওপেন করে দেখে,
“জ্যোতিষী তোমাকে আমার হাত থেকে বাঁচাতে পারবে না। আর না পারবে ঐ ডিটেকটিভ। সে তোমায় সাহায্য করে নিজের বিপদ ডেকে আনল। তৈরি থেকো মৃত্যুর জন্য।”
রিশাদ নন্দিনীর হাত থেকে ফোনটা নিয়ে ঐ নাম্বারে কল দেয়। কিন্তু নাম্বারটা আবারও সুইচডঅফ!
রিশাদ নন্দিনীকে শান্তনা দিয়ে বলে,
“তুমি একদম চিন্তা করবে না।”
.
মুহিবের বাসায় সবাই খুব ভালোভাবেই মেনে নেয় নন্দিনীকে। মুহিবের ছোট বোনদের সাথে আড্ডা দিতে দিতে সব খারাপ কথা ভুলে যায়। দুপুরের দিকে রিশাদ বাসায় চলে যায়। নন্দিনী মুহিবের ছোট দুবোনের সাথে আচার খাচ্ছিল আর গল্প করছিল। মুহিব বাসায় এসে প্রাণচঞ্চল নন্দিনীকে দেখে খুশি হয়। নন্দিনীকে জিজ্ঞেস করে,
“রিশাদ কোথায়?”
“ওতো বাসায় গেছে।”
“আমাকে ফোনে বলল, আবার নাকি সে হুমকি ম্যাসেজ দিয়েছে?”
“হুম।”
“নাম্বারটা একটু লিখে দেন। আমি ফ্রেশ হবো এখন।”
মুহিবের ছোটবোনের থেকে খাতা নিয়ে নাম্বারটা লিখে মুহিবকে দেয়। মুহিব ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নাম্বারটা নিয়ে আবার থানায় চলে যায়।
রাতে ড্রয়িংরুমে মুহিবের ছোটবোনদের ক্লাসের পড়া শিখিয়ে দিচ্ছিল নন্দিনী। আটটার দিকে মুহিব আসে। সোফায় বসে বলে,
“কী করছেন তিনজনে?”
নন্দিনী মৃদু হেসে বলে,
“এইতো ওদের পড়া দেখিয়ে দিচ্ছি।”
কথা বলার মধ্যেই লোডশেডিং হয়। নন্দিনী ফোনের ফ্লাশ অন করে। মুহিব ম্যাচ এগিয়ে দিয়ে বলে,
“এই নিন ম্যাচ। রান্নাঘরে মোম আছে। একটু কষ্ট করে জ্বালিয়ে আনুন। নয়ত আপনি ওদের কাছে বসুন আমি যাই।”
“সমস্যা নেই। আমিই যাচ্ছি। রান্নাঘরের কোথায় কী আছে আন্টির সাথে দুপুরে গল্প করার সময় দেখেছি।”
“তাহলে তো হয়েই গেল। যান।”
মোমবাতি জ্বালিয়ে আনার পর মুহিব বলে,
“বই-খাতা গুছিয়ে তোমাদের নন্দিনী আপুকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়। দুষ্টুমি করবে না কিন্তু একদম।”
“আচ্ছা।”
————————–
সকালে নন্দিনীর ঘুম ভাঙার পর দেখে মুহিব একটা কাগজ নিয়ে ড্রয়িংরুমে বসে আছে। নন্দিনীকে দেখে বলে,
“আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।”
“কী হয়েছে?”
মুহিব কাগজটা নন্দিনীর দিকে এগিয়ে দেয়। নন্দিনী কাগজটা নিয়ে দেখে তাতে লেখা আছে,
“নন্দিনীকে সাহায্য করার চেষ্টা করো না। নন্দিনীর সাথে নিজেকে জড়িয়ে মরণ ফাঁদে পা দিয়ো না।”
নন্দিনী কাগজটা দেখে বলে,
“আমি আপনাকে বারবার বলেছিলাম। কিন্তু আপনি তো আমার কোনো কথাই শুনলেন না। আমি এখান থেকে চলে যাব।”
“এত ঘাবড়ে যাবেন না প্লিজ। শান্ত থাকুন আপনি। দেখি না পানি কতদূর গড়ায়। আমি রিশাদকে ফোন দিয়েছি। সে আসছে। আমি এখন দিদাদের কাছে যাচ্ছি। আপনি অযথাই কোনো টেনশন করবেন না প্লিজ।”
মুহিব চলে যাওয়ার পর নন্দিনী চুপ করে বসে থাকে। যতই বলুক চিন্তা করবেন না, মন তো আর তাতে সায় দেয় না।
সকাল ১০টার দিকে রিশাদ আসে। নন্দিনীকে সরাসরি জিজ্ঞেস করে,
“আমায় বিয়ে করতে তোমার কোনো সমস্যা আছে?”
নন্দিনী কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
“না।”
“তাহলে চলো। আমরা আজই বিয়ে করব। এবং তারপর ঢাকায় চলে যাব। এখানে থাকলেই তোমার বিপদের আশংকা বাড়বে।”
সবার থেকে বিদায় নিয়ে রিশাদ নন্দিনীর হাত ধরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। রিক্সা নিয়ে সোজা কাজী অফিসের দিকে যায়। রিক্সা কিছুদূর যেতেই হাসিবকে দেখতে পায় রিশাদ ও নন্দিনী।
রিক্সা থেকে নেমে রিশাদ বলে,
“ভালোই হলো তোর সাথে দেখা হয়ে। চল কাজী অফিসে যাব। নন্দিনীকে আজ বিয়ে করব আমি।”
“তুই বেঁচে থাকলে তারপর না নন্দিনীকে বিয়ে করবি!”
“হাসিব! এসব কী বলছিস তুই?”
হাসিব একটা ছুড়ি নিয়ে রিশাদের দিকে এগিয়ে যায়। রিশাদ রেগে হাসিবকে মারতে গেলে নন্দিনী রিশাদের হাত ধরে বলে,
“পাগল হলে তুমি? তুমি দেখছ না ওর হাতে ছুড়ি? আমাদের এখন থানায় যেতে হবে। চলো।”
রিশাদ আর নন্দিনী হাত ধরে দৌঁড়াতে থাকে। পেছন পেছন হাসিবও দৌঁড়ে আসতে থাকে…

চলবে…