কৃষ্ণচূড়ার এক সন্ধ্যা পর্ব-২+৩

0
416

#কৃষ্ণচূড়ার_এক_সন্ধ্যা – [০২+০৩]
লাবিবা ওয়াহিদ

—————————
নিথি এবং রায়িন বাড়ি একসাথে ফিরায় শারমিন আক্তার বেশ চমকালো। তবে সম্মুখে কিছু জিজ্ঞেস না করে হাসি-মুখে রায়িনকে স্বাগতম জানালো।
–“কেমন আছো রায়িন?”
–“জ্বী ভালো আন্টি! আদন রুমে?”
–“হ্যাঁ, তুমি যাও। টেবিলেই বসেছে আদন!”

রায়িন উত্তরে মুচকি হেসে চলে গেলো আদনের রুমের উদ্দেশ্যে৷ রায়িন যেতেই নিথি হাসার চেষ্টা করে বললো,
–“আসলে রাস্তাতেই দেখা হয়ে যায়, তাই একসাথেই এসেছি আম্মু!”
–“ভালো করেছিস, এখন যা রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে!”

নিথি মাথা নাড়িয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে চলে গেলো। শারমিনের কাজে তাড়া থাকায় মেয়ের হাঁটার এরূপ ভঙ্গিমা খেয়াল করলেন না। নিথি রুমে এসে পায়ের স্কিন মুজোটা খুলতেই দেখলো পায়ে বাজে রকম ঠোসা পরেছে৷ ঠোসা কনিষ্ঠা আঙুলে এবং পায়ের পেছন অংশে। ঠোসা গুলো কেমন রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে৷ একে তো নতুন জুতো পরেছে তার উপর এতটা রাস্তা হেঁটে এসেছে। পা ব্যথায় হাঁটু জোড়া যেমন কাঁপছে, তেমনই ঠোসা পরা অংশগুলোও ভিষণ জ্বালা করছে। নিথি চোখ মুখ খিচে কিছুক্ষণ ওভাবেই বসে রইলো। তবে এই ব্যথার কাছে আজকের মুহূর্তটুকু ফিঁকে। এরকম মুহূর্তের কতো-ই না স্বপ্ন দেখেছে সে। রায়িন অজান্তেই তাকে পূর্ণ করেছে। নিথি জ্বালা নিয়েই উঠে দাঁড়ালো। জামা চেঞ্জ করে ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমে ঢুকে পরলো। ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে নিথি রান্নাঘরের দিকে ছুটলো। খুদা তো কম পায়নি তার। এছাড়া রায়িনকে দেখারও তো সময় আছে। রান্না ঘরে যেতেই শারমিনকে দেখলো চা করতে। ভিষণ ব্যস্ত হয়ে নাস্তা বানাচ্ছে। নিথি তখনই বললো,
–“আম্মু, খিদে পেয়েছে। খাবার কিছু পাবো?”
–“পরেছি তো মহা জ্বালায়! দেখছি রায়িনের জন্যে নাস্তা তৈরি করছি, এখন তুইও..”

শারমিন আর কিছু বললেন না। চায়ে চিনি মিশিয়ে দিতে দিতে বলে,
–“ঠিকাছে। তুই নাস্তাগুলো রায়িনকে দিয়ে আয়, এতক্ষণে আমি তোর নাস্তা বানাচ্ছি। জলদি কর!”

নিথি যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলো। মুখভঙ্গিতে নিজের খুশি প্রকাশ না করে থমথমে কন্ঠেই বললো,
–“ঠিকাছে।”

নিথির হাতে খাবারের ট্রে-টা দিতেই নিথি চলে গেলো। মাথায় ঠিকই ওড়না জড়িয়েছে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে অবশেষে আদনের রুমের সামনে আসলো। হঠাৎ অনুভব করলো তার হার্টবিট তীব্র গতিতে বেড়ে যাচ্ছে। নিঃশ্বাসও ভারী হয়ে আসছে। একটু একটু লজ্জাও অনুভূত হচ্ছে। নিথি লাজুক হেসে ভিরিয়ে দেয়া দরজাটা পা দিয়ে খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো। প্রথমেই তার নজরে এলো আঁকিবুঁকি করা আদন। বেশ মনোযোগের সাথে খাতাতে কলমের বিচরণ চালাচ্ছে সে। নিথি রুমের কোথাও রায়িনকে পেলো না। কোথায় গেলো ছেলেটা? নিথি ভবঘুরে হয়ে টেবিলের এক পাশে নাস্তার টেবিলটা রাখলো। আদন সেখান থেকে ছল-চাতুরী করে এক পিস পিঠা নিতে গেলে তার হাতে এক চড় মারলো নিথি। আদন হাত সরিয়ে নাক ফুলিয়ে তাকালো।
–“এটা স্যারের খাবার। তুই অভদ্রের মতো খাবারে হাত দিচ্ছিস কেন?”
–“পিঠাগুলো লোভনীয় তাই নিচ্ছিলাম। আর তুমি এটা কী করলা? আম্মুর কাছে বিচার দিবো কিন্তু!”
–“আম্মু কী তোকে খাওয়ায় না? অন্যের পাতের খাবার নেয়ার এত লোভ কেন? আম্মুকে আমিও বিচার দিবো!”

আদন মুখটা ভার করে পুণরায় কলম হাতে নিয়ে নিলো। নিথি পুরো ঘরে নজর বুলিয়ে ধীর কন্ঠে বলে ওঠে,
–“স্যার কোথায়?”
–“বারান্দায়! কথা বলছে!”

নিথি খুঁক করে কাশলো৷ গলা খাকারি দিয়ে কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে রয়। কিন্তু স্যারেরও তো আসার নামগন্ধ নেই। কী এতো কথা বলছে? নিথি বারান্দায় উঁকিঝুঁকি মারলো। কিন্তু ফলাফল শূন্য। নিথিকে এমন ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আদন ভ্রু কুচকে বলে,
–“এভাবে খাম্বার ন্যায় দাঁড়িয়ে আছো কেন আপু?”

নিথি চোখ রাঙানি দিলো। আদন মুখ ভেঙ্গিয়ে পুণরায় পড়াতে মনোযোগী হলো। নিথি কিছুক্ষণ হাঁসফাঁস করে বেশ সাহস জুগিয়ে বারান্দার দিকে অগ্রসর হয়।

——-
–“প্লিজ রায়িন! আয় না। তোকে তো কেউ ড্রিংকস করে বলে নাই!”
–“নেভার! আমি বেশ ভালো করেই জানি তোরা কী-রকম পার্টির কথা বলছিস৷ আর তোদের নিয়ে আমি কোনো রিস্ক নিতে চাই না। পরবর্তীতে দেখা যাবে সত্যি সত্যি-ই তোরা আমায় ড্রিংক্স করিয়েছিস। এই ড্রাংক অবস্থায় মাঝরাতে কিছুতেই হোস্টেল ঢুকতে দিবে না!”
–“আরে চিল! লেট করলে তোর বাবা আছে না? উনি-ই ম্যানেজ করে নিবে সব। প্লিজ আয়!”
–“দেখ রাব্বি! আমি এখন স্টুডেন্টের বাসায় আছি, সো প্লিজ! এসব ফালতু কথাবার্তা বলে টাইম ওয়েস্ট করিস না। আমি কখনোই পাপাকে এসবে জড়াবো না। রাখছি!”

বলেই রায়িন কল কেটে এক দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তার এই বন্ধুগুলোও হয়েছে একেকটা ব/দে/র হাড্ডি! রায়িন একবার বাহিরে নজর দিয়ে ভেতরে আসতে নিতেই কারো সাথে সজোরে ধাক্কা খেলো। রায়িন অসম্ভব বিরক্তির সাথে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,
–“হোয়াট দ্য..”

–“______”

নিথি যে রায়িনের সাথে এভাবে ধাক্কা খাবে বুঝতেই পারেনি। কে জানতো এভাবে রায়িন ছুটে এদিকেই আসবে। উফফ, তার নাকটা মনে হয় গেলো! নাক কচলাতে কচলাতে নিথি মাথা উঁচু করে তাকালো। ভিষণ বেসামাল অবস্থা তার। নিথি রায়িনের শক্ত মুখশ্রী পরখ করে আমতা আমতা করে বললো,
–“স..স্যরি!”

রায়িন স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলো। অতঃপর থমথমে গলায় বললো,
–“ইট’স ওকে।”

অতঃপর রায়িন নিথিকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে চলে গেলো। নিথি ঘাড় বাঁকিয়ে রায়িনের যাওয়া দেখে নাক কচলাতে কচলাতেই বেলকনিতে চলে গেলো। আজ দিনটা কী তার ব্যথা পাওয়ার দিন? এমনিতেই পায়ে ঠোসা পরেছে এখন আবার নাকে চাপ লেগেছে। কী দারুণ অভিজ্ঞতা হলো তার। তবে যাই হোক, নিথি নির্বিঘ্নে অনুভব করেছে রায়িনের কড়া পারফিউমের ঘ্রাণ। এই কড়া পারফিউমটা যেন মাদকতার ন্যায় কাজ করে। না জানি অন্যান্য মেয়ের সামনে এভাবে গেলে কতজন তাকে গিলে খায়? নিথি আজেবাজে চিন্তা না ভেবে বেলকনিতে মেলে দেয়া শুকনো কাপড়গুলো হাতে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। একপ্রকার ইচ্ছে করেই সে কাজ করছে তাও সময় নিয়ে। কাজের বাহানায় রায়িনকে দেখাই তার একমাত্র উদ্দেশ্য। রায়িন একবারও এদিকে তাকায়নি। সে একবার ফোন চাপছে, একবার আদনের পঅড়া দেখছে নয়তো চায়ে চুমুক দিচ্ছে। তবে আদনের যেন নিথিকে নিয়ে চিন্তা এবং সন্দেহ হচ্ছে। বোনের এসব কাজ-কর্ম তার সুবিধার লাগছে না।

কই, গতকালও তো বোনকে বলেছিলো বেলকনি থেকে কাপড় গুলো এনে দিতে। কই সে তো একবারও পাত্তা দিলো না। তাহলে আজ সূর্য কোন দিকে উদয় হলো? সামনে স্যার থাকায় আদন তার খচখচানি বহিঃপ্রকাশও করতে পারছে না। রায়িন লক্ষ্য করেছে আদন পড়ায় অমনোযোগী! রায়িন শান্ত বুলিতে আদনকে ধমকে ওঠে। আদন এবং নিথিও এতে অপ্রস্তুত হয়। নিথি পিটপিট করে রায়িনের দিকে তাকিয়ে দেখে তার ভাইকে রায়িন বকছে। নিশ্চয়ই অমনোযোগী হয়েছিলো। নিথি আর ওখানে থাকলো না, দ্রুত রুম ত্যাগ করলো। রুম ত্যাগ করলেও দরজার ফাঁকে উঁকি দিয়ে রায়িনকে দেখতে ভুললো না। তার দেখার মধ্যেই শারমিন আক্তার নিথিকে ডেকে উঠলো। নিথি বিরক্তির নিঃশ্বাস ফেলে মায়ের কাছে চলে গেলো। রায়িনের দেখা পেয়ে খুদার কথা সে ভুলতে বসেছিলো।

খাওয়া-দাওয়া শেষ করে নিজের রুমের দিকে অগ্রসর হলো নিথি। যাওয়ার পূর্বে আদনের ঘরে উঁকি দিতে ভুলেনি সে। উঁকি দিতেই দেখলো শারমিন আক্তার রায়িনের সাথে কথা বলছে। বিষয়টা বুঝতে নিথির ক্ষণিক সময় লাগলো। আচ্ছা শারমিন আক্তার কী নিথিকে পড়ানোর বিষয়টা বলছে? নিথি তো সবে অনার্সে উঠেছে। রায়িন মাস্টার্সের ছাত্র। কিছুদিন পরেই তার স্টাডি কমপ্লিট হয়ে যাবে। সে কী পারবে অনার্স পড়ুয়া নিথিকে পড়াতে? তবে পড়ালে নিথির জন্যে বেশি ভালো হবে। তাকে আর রোজ বাহানা দিয়ে আদনের ঘরে যেতে হবে না। মুহূর্তে তার অভ্যন্তরে খেলে গেলো প্রশান্তির জোয়ার।

——
রাত গভীর। কুঞ্জ মেঘের আড়ালে বারংবার লুকাচ্ছে অর্ধ চাঁদ। চাঁদের আহামরি ঝলক না থাকলেও মোটামুটি দৃশ্যমান, আবছা। নিথি একটা কেটবরি চিবুতে চিবুতে সেটার দিকেই তাকিয়ে আছে। ইদানীং সে একদমই ঘুমাতে পারে না। বলা বাহুল্য, তার আঁখি জোড়াতে ঘুম ধরা দেয় না। এক নির্মম অসুখে ভুগছে সে। সেই নির্মম অসুখের নাম হচ্ছে রায়িন। মানুষটার মুখশ্রী তাকে ঘুমোতে দেয় না। ঘুমালেও তার স্বপ্নে রায়িন নিজ রাজত্ব চালায়। সারাদিন ভাবলে হয়তো এমনই হবে। তবে তার ভিষণ ভালো লাগে, রায়িনকে নিয়ে ভাবতে। নিথি চকলেটের কাগজটা বেলকনি দিয়ে ফেলে রুমে আসতেই টেবিলের উপির রাখা ফোনের ভাইব্রেশন শুনতে পেলো। নিথি টিস্যু দিয়ে হাত মুছে চটজলদি ফোনের কাছে চলে গেলো। ফোন হাতে নিয়ে দেখলো এক আননোন নাম্বার থেকে কল আসছে। নিথি ভ্রু কুচকে তাকাতেই আবারও কল আসলো। নিথি কিছু একটা ভেবে কল রিসিভ করে ফোনটা কানে রাখলো। চিরচেনা কন্ঠস্বর শ্রবণ হতেই নিথির সর্বাঙ্গ শিউরে ওঠলো। নিথি কাঁপতে কাঁপতে অস্ফুট স্বরে আওড়ায়,
–“আ..আপনি?”
–“হুম। কিছু জানার জন্যে কল করেছিলাম!”
–“জ..জ্বী বলুন স্যার!”
–“কাল থেকে তোমাকেও পড়াবো আমি। আগামীকাল সকালে ফ্রী আছো?”

নিথি ক্যালেন্ডারে চোখ বুলালো। আগামীকাল-ই নতুন মাসের সূচনা ঘটবে। এছাড়াও আগামীকাল সরকারি ছুটি। নিথি আমতা আমতা করে বললো,
–“জ্বী!”
–“বেশ। এগারোটায় রেডি থেকো। আমি তখনই আসবো। আদনকেও বলে রাখিও, একসাথে পড়াবো তোমাদের!”

নিথির হাত-পা থরথর করে কাঁপছে। আগামীকাল সামনা-সামনি থাকবে। নিথি তাকে প্রাণ ভরে দেখার সুযোগ পাবে? সেচ্ছায় কথা বলতে পারবে? সবটা কেমন স্বপ্নের মতো লাগছে তার। নিথির কোনো উত্তর না পেয়ে রায়িন কল কেটে দেয়। নিথিকে পড়িয়ে-ই রায়িন তার বাড়ি যাবে। দু’দিন সেখানে থেকে চলে আসবে। এজন্য-ই মূলত সকালেই পড়াবে।

নিথির আগে যেটুকুও ঘুম আসতো, এখন রায়িন কল করে তার সেটুকু ঘুমও কেড়ে নিলো৷ সারারাত সে ঘুমাতে পারলো না। ভাবনায় মত্ত থাকলো তার একমাত্র স্বপ্নপুরুষের!

[০৩]
লাবিবা ওয়াহিদ

————————
সারারাত নির্ঘুম কাটিয়ে ভোরের দিকে চোখ লেগে এসেছিলো নিথির। সেই চোখ লাগাটাই গভীর ঘুমে পরিণত করেছে। এখনো নিথি তন্দ্রায় আচ্ছন্ন৷ শারমিন আক্তার সেই কখন থেকে ডেকে চলেছে নিথিকে। কিন্তু নিথির যে হুঁশ নেই, সে আপাতত ঘুমে বেহুঁশ! শারমিন আক্তার একসময় না পেরে নিথির হাত ধরে টানলো। নিথি বসতে গিয়ে পুণরায় শুয়ে পরলো। শারমিন আক্তার ক্লান্ত ভঙ্গিতে দু’হাত নিজ কোমড়ে রাখলেন। দেয়াল ঘড়ির দিকে ক্লান্ত হয়ে নজর বুলালেন। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে আদনকে হাঁক ছেড়ে ডাকলেন। আদনও এক দৌড়ে হাজির।
–“তোর বোনের ঘুম ভাঙ্গা। আমার অনেক কাজ পরে আছে!”

বলেই শারমিন আক্তার ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। আদন ঘুমন্ত নিথির দিকে তাকিয়ে শয়তানি হাসি দিলো। পা টিপে টিপে নিথির পায়ের সামনে আসলো। ঝাটা থেকে দুটো ছোট কাঠি ভেঙ্গে নিথির পায়ের পাতায় বিচরণ চালালো। নিথি সুঁড়সুঁড়ি অনুভব করতেই তার ঘুম হালকা হয়ে এলো এবং পা নড়াচড়া শুরু করলো। নিথি যতবার পা সরিয়ে দিচ্ছে আদন ততবার নিথির পায়ে আবার সুঁড়সুঁড়ি দিচ্ছে। নিথি একসময় বিরক্তির সাথে উঠে বসলো। চোখ-মুখ এখনো ঘুমুঘুমু। আদনের উদ্দেশ্যে এক চিৎকার দিলো সে।
–“আদন!! ফা/ই/জলামির লিমিট থাকা দরকার! তুই আমার ঘুম ভাঙ্গাচ্ছিস কোন সাহসে?”
–“স্যারকে বসিয়ে তুই মরার ঘুম ঘুমোচ্ছিস আবার আদনকে ধমকাচ্ছিস? জলদি ওঠ! আর এক সেকেন্ড যদি তোকে বিছানায় দেখি, ঠে/ঙ্গি/য়ে বিছানা থেকে নামাবো। অ’স’ভ্য!”

বলেই শারমিন আক্তার দরজার সামনের থেকে চলে গেলেন। “স্যার” শব্দটি শুনে নিথির ঘুম উবে গেলো। দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকাতেই মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পরলো। এগারোটা বেজে চল্লিশ মিনিট! এতক্ষণ সে স্যারকে বসিয়ে রেখেছে? মাই গড! নিথি উঠে দরজার দিকে যাওয়ার পূর্বেই তার খেয়াল এলো সে এলোমেলো সাথে তার জামা-কাপড়ও! নিথি জলদি ড্রয়ার থেকে জামা-কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে দৌড় দিলো। আদন সবকিছু চোখ বড়ো বড়ো করে দেখে গেলো। বোকার মতোন মাথা চুলকাতে চুলকাতে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।

——————————-
রায়িন আজ প্রচন্ড বিরক্ত। বিরক্তির সাথে একবার হাত ঘড়ি দেখছে তো আশেপাশে নজর বুলাচ্ছে। আপাতত রায়িন নিথিদের বৈঠকঘরে অবস্থান করছে। এখানেই নিথিকে পড়াবে সে। কিন্তু নিথি কই? মেয়েটা এতো দেরী করছে কেন? তার তো সময়ের দাম আছে নাকি!? বিরক্তিতে কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ পরলো তার। এর মাঝে হন্তদন্ত হয়ে বই হাতে ছুটে আসলো নিথি। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রায়িনকে প্রথমে সালাম দিলো। রায়িন মাথা উঠিয়ে নিথির দিকে তাকালো। ফোলা চোখ দেখে ভালোই বোঝা যাচ্ছে মাত্র ঘুম থেকে উঠেছে। রায়িন মিনমিন করে আওড়ায়,
“ই’ ডি’ য়ে’ট!”

নিথি বই-খাতা নিয়ে রায়িনের মুখোমুখি বসলো। হাই তুলে নিথি তার বইগুলো ছড়িয়ে রাখলো। রায়িন প্রথমেই বললো,
–“তোমার যেটায় বেশি প্রব্লেম সেটা বলো। আপাতত আজ বেশি পড়াতে পারছি না।”

নিথি মুখটা ছোট করে ফেললো। সে কতটা দেরী করে ফেললো আজ। মানুষটাকে কতটা অপেক্ষা করিয়েছে। ভাবতেই তার ভেতরটা অপরাধবোধে দগ্ধ হচ্ছে। রায়িনের মুখে ফুটে ওঠা বিরক্তিও সে ভালোভাবে বুঝতে পারলো। প্রথমদিনে কেন এরকম কান্ড ঘটালো সে? নিথি মনমরা হয়ে তার প্রব্লেম তুলে ধরলো রায়িনের নিকট। রায়িন সেই চ্যাপ্টারে কিছুক্ষণ ভালোভাবে চোখ বুলিয়ে নেয়। কী অসাধারণ রায়িনের বোঝানোর ভঙ্গি। এত সুন্দর করে প্রতিটি বিষয় নিথিকে বুঝিয়ে বলতে পারবে নিথি তা ভাবতেই পারেনি। আসলেই রায়িন একজন ব্রিলিয়ান্ট। কিছু বোঝানোর ক্ষেত্রে সে বেশ পটু। এবার সে বুঝলো কেন আদন এই ছয় মাসের ব্যবধানে এতটা ভালো রেজাল্ট করছে। তবে নিথি যে রায়িনের দিকে কতবার তাকিয়েছে তার কোনো হিসাব নেই। মানুষটা কাছ থেকে আরও বেশি সুন্দর। গালে হাত দিয়ে কোণা চোখে রায়িনকেই দেখলো শুধু।

যেহেতু নিথি পয়তাল্লিশ মিনিট খুইয়েছে তাই রায়িন আধ ঘন্টাই পড়াতে পারলো। তার আজ ভিষণ তাড়া। তাই বাসায় পড়া দিয়ে রায়িন চলে গেলো। রায়িন চলে যেতেই নিথি এক দৌড়ে বারান্দায় চলে গেলো। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেই রায়িন নিথিদের এপার্টমেন্ট থেকে বের হলো। রায়িন এদিক সেদিক রিকশার খোঁজে সামনে এগিয়ে গেলো। নিথি ততক্ষণ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে রইলো যতক্ষণ পর্যন্ত না রায়িন চলে যাচ্ছে। এ যেন এক শীতল অনুভূতি। নিথি মিনমিন স্বরে বললো,
–“দুঃখিত রায়িন। আপনাকে আমি আজ অনেকটা অপেক্ষা করিয়েছি। আল্লাহ আপনার যাত্রা সুস্থ করুক।”

রায়িনের দেখা পেলো না প্রায় দু’দিন। ভার্সিটির ক্যান্টিনে বসে স্যান্ডউইচ খাচ্ছে নিথি। নয়না তার সম্মুখেই বসে আছে। নিথির এমন নির্বিকার ভাব-ভঙ্গি নয়নার বেশ অদ্ভুত লাগছে। মেয়েটা আগের মতো পকপক ছেড়ে দিয়েছে৷ প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না। কেমন ম্যাচিউর ভাব এসেছে যেন তার স্বভাবে। এই পরিবর্তনের কারণ কী শুধুই হোম টিউটর? নয়নার এমন তাকানো দেখে নিথি তার স্যান্ডউইচটা এগিয়ে দিলো। নয়নার যেন ভাবনায় বিচ্ছেদ ঘটলো।
–“খাবি?”
–“না।”
–“তাহলে তাকিয়ে ছিলি যে?”
–“না ভাবছি, হুট করে আমার বান্ধুবী কেমন ম্যাচিওর হয়ে গেলো!”

নিথি স্যান্ডউইচে কামড় বসালো। আজকাল নয়নার প্রশ্নগুলোর কোনো উত্তর খুঁজে পায় না সে। তার কাছে সবকিছু স্বাভাবিক লাগলেও চারপাশের মানুষদের চোখে সে পরিবর্তনশীল।
–“জবাব দিলি না যে?”
–“কিসের জবাব?”
–“এত পরিবর্তনের মানে কী? তোর সেই স্যার?”

নিথির খাবার চিবানো থেমে যায়। আপনমনে কিছু একটা ভেবে আবার কামড় বসালো। খেতে খেতে অস্ফুট স্বরে আওড়ায়,
–“আজ দু’দিন হয়েছে, তার দেখা পাইনি!”
–“আমি কিন্তু সেটা বলিনি। দুই দিনের কোন ছোঁকড়া আইছে যে তোর মাথা ঘুরিয়ে দিলো?”
–“উত্তর চাই তোর?”
–“হুম, চাই।”
–“ঠিক আছে। সময় হলে তোকে বুঝায় দিবো!”
–“আমার এখনই বোঝা-পড়া করতে হবে। এসব মানা ইমপসিবল!”

নিথি কিছু একটা ভেবে নেয়। অতঃপর কী মনে করে ব্যাগ থেকে ফোন বের করলো। নিথির ফোন বের করায় এক মুহূর্তের জন্যে নয়না ভেবে নিয়েছিলো যে নিথি তাকে তার স্যারের পিকচার দেখাবে। কিন্তু তার ভাবনাকে ভুল প্রমাণিত করে নিথি কাউকে কল দিলো এবং নয়নাকে তার পাশে আসতে ইশারা করলো। নয়না সময় না নিয়ে দ্রুত চলে আসলো। নিথি লাউডস্পিকার দিলো। রিং হচ্ছে কিন্তু কল ধরছে না। নয়না উৎসুক নজরে ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে আছে। কয়েকবার রিং হতেই কল রিসিভ হলো। সাথে যেন নিথির হৃদপিন্ডের ধুকপুকানিও বেড়ে যায়। ওপাশ থেকে ঘুমঘুম কন্ঠস্বর শোনা যায়। নিথি প্রশান্তিতে চোখ বুজে ফেলে। অদ্ভুত অনুভূতি ঘিরে ধরেছে তাকে। নয়না তার পাশে সেটা মস্তিষ্ক জানান দিতেই নিথি নিজেকে সামলালো। নয়নার কানে কানে বললো,
–“ভয়েজ শুন!”

পুণরায় “হ্যালো” শোনা গেলো। নিথি কম্পিত কন্ঠে আওড়ায়,
–“আসসালামু আলাইকুম, স্যার!”
–“ওয়া আলাইকুম আসসালাম। কিছু বলবে?”

কী শীতল সেই কন্ঠস্বর। নিথির অভ্যন্তরে যেন কেউ এত এত ঠান্ডা পানি ঢালছে। আনন্দে ভেতরটা যেন ঢাঁক ঢোল পে/টা/চ্ছে। নিথি অধরে মুচকি হাসি ছড়িয়ে বললো,
–“একচুয়ালি একটা বিষয়ে জানার ছিলো। একটু পরই ক্লাস শুরু হবে কিনা! না জানলে স্যারের কাছে আজ নির্ঘাত অপমানিত হতে হবে। প্লিজ স্যার, হেল্প মি!”

অপরপাশ হতে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ কানে এলো।
–“ঠিক আছে। কোন বিষয়ে জানতে চাও বলো, আই উইল ট্রাই মাই বেস্ট!”

নিথি জানালো সবটা। কিছুটা সময় নিয়ে রায়িনও তার প্রশ্নের উত্তর দিলো৷ নিথি এবার খুশিতে গদগদ হয়ে বলে,
–“থ্যাংকিউ এন্ড সরি, ডিস্টার্ব করার জন্য!”

রায়িন নিঃশব্দে হাসলো। হাসিমুখেই উত্তর দেয়,
–“ইট’স ওকে। কোনো বিরক্ত করোনি আমায়!”
–“রাখছি তাহলে?”
–“হুম।”

কল রাখতেই রায়িন উঠে বসলো। আড়মোড়া ভেঙে এদিক সেদিক তাকালো। নিথির কথা মাথায় চাড়া দিতেই নিঃশব্দে হাসলো। এসিটা অফ করে ব্ল্যাঙ্কেটের ভেতর থেকে পা জোড়া বের করতে করতে রায়িন হাঁক ছাড়লো,
–“মা, কফি!”


–“কন্ঠ শুনেছিস? কেমন?”
–“ভালো। তবে চেহারা কেমন বুঝবো কীভাবে?”
–“আপাতত কন্ঠ শুনে বসে থাক। একদিন তাকে সরাসরি দেখাবো ইনশাল্লাহ!”

নয়না তাকিয়ে নিথির খুশিতে গদগদ করা মুখখানা দেখলো। মেয়েটা আজ বড্ড খুশি। নয়না চাইলো না এই সুন্দর হাসিতে ব্যঘাত ঘটাতে। তাই নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে রইলো নিথির অধরে ঝুলন্ত হাসিতে।

~চলবে, ইনশাল্লাহ।

ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের অপেক্ষায় রইলাম!