কৃষ্ণচূড়ার এক সন্ধ্যা পর্ব-০১

0
664

#কৃষ্ণচূড়ার_এক_সন্ধ্যা – [০১]
লাবিবা ওয়াহিদ

——————————–
–“শেষ পর্যন্ত নিজের ছোট ভাইয়ের হোম টিউটরের প্রেমে পড়লি? এটা কী আদৌ বিশ্বাসযোগ্য রে নিথি?”

নিথি নির্বাক, নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে। দৃষ্টি তার হোস্টেলের দিকে। এই হোস্টেলেই রায়িন থাকে। রায়িন তার ছোট ভাইয়ের হোম টিউটর হিসেবে আছে। মায়ের কাছে শুনেছে তার জন্যেও নাকি রায়িনকে শীঘ্রই ঠিক করা হবে। মাসের শেষ চলছে। হয়তো দিন কয়েক পর থেকে সেও রায়িনের সামনে বসে পড়বে! নয়না নিথিকে ধাক্কালো। নিথির ধ্যান ফিরতেই তড়িৎ নয়নার দিকে ফিরলো। নয়না নিথির হাতে হাত রেখে বললো,
–“তুই কী আমার সাথে প্রাঙ্ক করছিস?”

নিথি নেতিবাচক মাথা নাড়ালো। মজা কেন করবে সে? নিথি কপালে ওড়নার বিচরণ চালিয়ে নিম্ন স্বরে বলতে লাগলো,
–“মজা করছি না। ইনফেক্ট, এই কঠিন সত্যটি আমিও মানতে পারছি না নয়না। উনি আদনকে পড়াচ্ছে আজ প্রায় ছয় মাস হতে চলেছে। প্রতিবার যখন আসতো, একবারও ঘুরে তাকাতো না আমার দিকে। আর আমার বেহায়া দৃষ্টি শুধু তার দিকেই স্থির থাকতো। আমি সত্যি জানতাম না ওনাকে এই ভাবে নিজের হৃদয় দিয়ে ফেলবো। কে জানতো হৃদয়ে তাকে এতদিন লালন করবো?”

নয়না তপ্তশ্বাস ফেললো৷ নিথির চোখ-মুখের ঝলকে বেশ ভালোই বোঝা যাচ্ছে নিথি মিথ্যা বলছে না এবং তার অনুভূতি গুলোও মিথ্যে নয়। তবে বিষয়টা কেমন দুইয়ে দুইয়ে পাঁচ হয়ে গেলো না? হোম টিউটরকে নিথি ভালোবাসে? এটা কতজন মানবে? নয়না পুণরায় তার কৌতুহল প্রকাশ করলো,
–“বুঝলাম তুই প্রেমে পরেছিস। কিন্তু ছেলেটার বায়োডাটা তো দিবি! নিশ্চয়ই বেশি বড়ো নয়!”

তখনই জ্যাম ছুটলো। রিকশা চলতে লাগলো বাকি গাড়িগুলোর সাথেই। নিথি ব্যাগের হাতল খোঁচাতে খোঁচাতে আপনমনে বলে ওঠে,
–“পিছেই ফেলে এসেছি তার হোস্টেল!”

নয়না তখনই দাঁড়ানোর চেষ্টা করে হুডির উপর দিয়ে হোস্টেল দেখার প্রচেষ্টা চালালো। তবে সে বিফল হলো। তবে আন্দাজ করে বুঝলো নিথি কোন হোস্টেলের কথা বলেছে। নয়না পুণরায় নিজের আসনে বসে বললো,
–“এই হোস্টেলের ফি নাকি মাত্রাতিরিক্ত? আমার আপু আমাকে বলেছিলো। এছাড়া এই হোস্টেলের সুবিধাগুলো বড়ো লোক বাবার ছেলে-মেয়েরাই নাকি পায়। আমারই তো মাঝেমধ্যে ইচ্ছা করে বাসা ছেড়ে এখানে শিফট হই!”

নিথি নয়নার দিকে পিটপিট করে তাকালো। নিথির এরূপ দৃষ্টিতে নয়না থতমত খেয়ে আগের প্রসঙ্গে ফিরে বললো,
–“সেই কথা বাদ। ছেলেটা দেখতে কেমন? আর এই হোস্টেলে থাকে এর মানে তো বড়োলোকি কারবার! যদি বড়ো লোক হয়ে থাকে তাহলে আগ বাড়িয়ে টিউশন করায় কেন? আমার তো খটকা লাগছে!”
–“কোথায় শুনেছিস হোস্টেলে উচ্চ-মধ্য ভেদাভেদ করা হয়? হয়তো ধনীদের জন্যে আলাদা ব্যবস্থা আছে তাই বলে যে মধ্যবিত্ত’রাও উঠতে পারবে না সেটা কে বলেছে তোকে?”
–“বাদ দে, এতো আইডিয়া নেই আমার। তবে আপুর থেকে যা শুনেছি তাতে যা বোঝার আমি বুঝে নিছি। খটকা আমার কিন্তু রয়েই গেছে!”

নিথি নয়নার মন মতো উত্তর ঠিক করতে পারে না। তাই সে আপাতত নিশ্চুপ। বারংবার তার দৃষ্টিতে ভাসছে রায়িনের স্নিগ্ধ মুখশ্রী। দু’দিন দেখেনি মানুষটিকে। সপ্তাহে পাঁচ দিন পড়ায় কি না। ওই এক-দেড় ঘন্টার সময়টিতেই মানুষটাকে মন ভরে দেখে সে। নয়না পুরণায় তার ভাবনায় ছেদ ঘটালো। নিথি বিরক্ত হলো। নিথি পুণরায় বলে ওঠে,
–“যেদিন দেখবি সেদিন বুঝবি৷ তিনি আমার কাছে অমূল্য রত্ন বৈ কিছু নয়। বর্ণনা দেয়ার সাধ্যি আমার নেই!”

নয়না আর প্রশ্ন করলো না। কিছু মিনিটের মধ্যে নয়নার বাসার সামনে চলে আসলো। নয়নাকে নামিয়ে দিয়ে রিকশা চললো নিথির গন্তব্যে। নিথি আগের ন্যায় আনমনে বসে রইলো। নয়নার কয়েকটি কথা তার মনেও খটকার দাগ কেটেছে৷ তবে নিথি চাইলো না সেসব খটকাকে প্রস্রয় দিতে। ফুটপাতের দু’ধারে তখন কৃষ্ণচূড়ার সম্ভার! ঘোলাটে সন্ধ্যা। ধীরে ধীরে আলো’রা নেতিয়ে পরছে রাতের আঁধারিয়ার মাঝে। আঁধারিয়াও সপ্তর্পণে গ্রাস করছে আলোকে। বাড়িতে ফিরতে বেশ দেরী-ই হবে তবে। নিথি গিয়েছিলো নয়নাকে নিয়ে শপিং এ। সামনেই নিথির চাচাতো বোনের বিয়ের কাজ শুরু হবে। তাইতো নিথির মা একপ্রকার জোর করেই তাকে শপিং এ পাঠালো। কৃষ্ণচূড়ার নিম্নে মানুষদের চলাচল দেখতে দেখতে নির্বিঘ্নে নিঃশ্বাস ফেললো নিথি। হঠাৎ তার দৃষ্টি আটকে যায় এক চিরচেনা মানবের উপর। নিথি তাকে অতিক্রম করার পূর্বেই রিকশা চালককে থামতে বললো। রিকশাচালকও অপ্রস্তুত হয়ে থেমে যায়। নিথি হাঁক ছাড়লো সেই অতি পরিচিত মানবের উদ্দেশ্যে। মানবটি তার হাঁটা বন্ধ করে ঘাড় বাঁকিয়ে পিছে ফিরে তাকায়। নিথি যেন তৎক্ষনাৎ চমকে উঠলো। ল্যাম্পপোস্টের কৃত্রিম আলোয় কতটা মোহনীয় লাগছে মানুষটিকে। গায়ের গ্রে কালার টি-শার্টটি যেন আরও ফুটে ওঠেছে তার তনুতে। কপালে তার এক ঝাঁক চুল উম্মুক্ত বাতাসে অবাধ্য হয়ে উড়ছে। রায়িন তার হাতের সাহায্যে চুলগুলোকে সেট করে নিথির দিকে তাকালো। নিথি নিজেকে সামলে বেশ শীতল কন্ঠে বলে ওঠে,
–“স্যার, হেঁটে যাচ্ছেন যে?”
–“হ্যাঁ। বাস থেকে মোড়েই নেমেছি। তবে রিকশা পাচ্ছি না। এজন্য-ই একপ্রকার বাধ্য হয়ে হাঁটতে হচ্ছে!”

রায়িনের শেষোক্ত বাক্যটি শেষ হতেই পরিবেশ মাগরিবের আযানে মুখোরিত হলো। নিথি অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে মাথায় ওড়না জড়ালো। অতঃপর নিথি আমতা আমতা করে আওড়ায়,
–“আপনি যদি কিছু মনে না করেন, তাহলে আমার সাথে আসবেন?”

রায়িন যেন ভাবনায় পরে যায়। জড়তায় ভ্রু’যুগলের মাঝে ভাঁজ পরলো তার। নিথিকেও মুহূর্তের মাঝে ইতস্তত দেখালো। সে কী ভুল কিছু বলে ফেললো? তার তো মনে হয় না। নিথি কথা ঘোরাতে পুণরায় বললো,
–“রিকশা নেই তাই বললাম। যেহেতু আমি বাসাতেই যাচ্ছি সেহেতু একসাথে গেলে ক্ষতি নেই। এছাড়া আদনও হয়তো আপনার জন্য অপেক্ষা করছে!”

রায়িন তখনো চিন্তায় বুদ। একটা মেয়ে মানুষের সাথে রিকশায় ওঠাটা হয়তো মানতে পারছেন না। নিথি পুণরায় অবাক হলো রায়িনের কান্ডে। বর্তমান ঢাকার শহরে কোন ছেলের এতো অস্বস্তি হয় একজন মেয়ের সাথে বসতে? রায়িনকে যেন প্রতি ক্ষণে ক্ষণে নতুন ভাবে চিনছে এবং নতুন ভাবে প্রেমে পরছে। তার ব্যক্তিত্ব-ই হয়তো এমন। রায়িন কপালে দু’হাতের বিচরণ চালিয়ে বেশ সময় নিয়ে বললো,
–“আমি হেঁটে যেতে পারবো। তুমি যাও! আদনকে বলে দিও অপেক্ষা না করতে!”

এবার নিথি জড়তায় জুবুথুবু! রায়িন কী তাকে খারাপ মেয়ে ভাবছে? সে কী ভাবছে নিথি একজন বেহায়া মেয়ে? তবে নিথি তো তার ভালোর জন্য-ই বললো। সে তো পারবে না তার প্রিয় মানবটিকে হেঁটে যেতে দিয়ে নিজে আবেশে রিকশা করে বাড়ি ফিরতে। নিথি কিছু একটা ভেবে নিজেই রিকশা থেকে নেমে গেলো। ব্যাগ হাতড়ে টাকা বের করার পূর্বেই রায়িনের কন্ঠস্বর শুনতে পেলো। টাকা বের করতে চাওয়া হাত জোড়া থেমে যায় মানবটির স্নিগ্ধ কন্ঠে।
–“আরে কী করছো? নামলে কেন?”
–“আপনি হেঁটে যাবেন আর আমি আরাম করে বাড়ি ফিরবো, এটা ভাবলেন কী করে শুনি? আপনি যেমন হাঁটবেন তেমন আমিও হেঁটে বাসায় ফিরবো!” কথাটি নিরবে হৃদয়েই বললো নিথি। রায়িনের সম্মুখে বলার মতোন সৎ সাহস তার নেই! নিথি স্মিত হেসে রিকশাওয়ালার ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে বললো,
–“আপনি স্যার মানুষ। আপনাকে অসম্মান করে আমি কিছুতেই রিকশা করে বাড়ি ফিরতে পারি না। এছাড়া আজকের আবহাওয়া সুন্দর, হাঁটতে মন্দ লাগবে না!”

রায়িন একপলক নিথিকে দেখে দৃষ্টি ঘুরিয়ে ফেললো। নিথি নিঃশব্দে হাসলো। রায়িন হাঁটা শুরু করলে নিথি তার পাশাপাশি গিয়ে পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটতে লাগলো। হাঁটার গতি বেশ ক্ষীণ। কিছুক্ষণ পরপর দুই মানব – মানবীকে দমকা শীতল হাওয়া ছুঁয়ে যাচ্ছে। সেই দমকা হাওয়ায় উপরে ছায়া দেয়া রক্তিম কৃষ্ণচূড়া পরছে তাদের উপরেই। কী এক অপরূপ দৃশ্য। নিথির ইচ্ছে করলো মুহূর্তটুকু ক্যামেরা বন্দি করে নিতে। কিন্তু সে তা পারবে না। পাশের মানবটি কী ভাববে সেই ভেবে। তবে ক্যামেরা বন্দি করতে না পারলেও নির্বিঘ্নে দৃষ্টিতে এবং মস্তিষ্কে ঠিকই মুহূর্তটুকু বন্দি করে ফেললো নিথি।

~চলবে, ইনশাল্লাহ।

বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমাসুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন।