কৃষ্ণচূড়ার এক সন্ধ্যা পর্ব১২+১৩

0
309

#কৃষ্ণচূড়ার_এক_সন্ধ্যা – [১২+১৩]
লাবিবা ওয়াহিদ

———————–
আজ সকাল সকাল মোহনা নিথিদের বাসায় হাজির হয়েছে। সবেই নিথি ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বের হবে। মোহনা ঠিক সে-সময়েই বাড়ি ফিরে। মোহনাকে দেখে নিথি যেম ধপ কপ্রে জ্বলে ওঠে। এই সাত-সকালে আসার কী দরকার তার? আবার কোনো নতুন ফন্দি এঁটেছে নাকি? মোহনা নিথিকে একপলক দেখে বলে,
–“কাজে এসেছি। আজ রাইসা আপুর বিয়ের শপিং করতে হবে। মা বললো তোকে নিয়ে যেতে। তাই এসেছি। আপাতত রায়িন স্যারের চিন্তা ভুলে আমার সাথে চল। চাচীকে মা ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে!”

নিথি একবার আদনের দিকে তো একবার মোহনার দিকে তাকাচ্ছে। আদন ভ্রু কুচকে বললো,
–“তো তোমার এত আহ্লাদ কবে জম্মালো শুনি? একদম নিজে চলে এলে যে?”

মোহনার ঠান্ডা মস্তিষ্ক মুহূর্তে-ই গরম হয়ে গেলো। মোহনা আদনকে সম্মুখে কিছু না বলে নিথির উদ্দেশ্যে বললো,
–“তোমার ভাইকে তুমি সামলে নাও নিথি। দেখেছো, দিনদিন কেমন বিঁগড়ে যাচ্ছে?”

নিথি বেশ কাঠ কাঠ গলায় বললো,
–“সেটা আমি বুঝে নিবো। তুমি এখন যেতে পারো। আমি একাই যেতে পারবো! এড্রেস দিয়ে দাও!”

মোহনা কোনো ভণিতা ছাড়াই এড্রেস দিয়ে চলে গেলো। তার যেন একদমই এখানে থাকার ইচ্ছে নেই। নিথি তাচ্ছিল্যের স্বরে বলে,
–“চল আদন, তোকে দিয়ে আসি!”
–“তুমি যাবা আপু?”
–“হুম। মোহনার সাথে আমার বিষয়টা ব্যক্তিগত। মোহনা ছাড়াও ওই পরিবারে আমার আপনজন আছে। একজনের জন্যে বাকিদের কেন কষ্ট দিবো?”
–“তাহলে আমিও যাই?”

নিথি কী যেন ভাবলো। কিছুটা সময় নিয়ে নিজের কাঁধের ব্যাগ খুলতে খুলতে বললো,
–“তুই এসব খুলে তৈরি হয়ে নে। আমি তোর ক্লাস টিচারের থেকে ছুটি নিয়ে নিবো!”

আদনের খুশি দেখে কে? স্কুল কামাই দেয়ার চেয়ে খুশির আর কিছু আছে নাকি? শুক্রবার ব্যতীত একদিন তো ব্রেক দরকার। আদন গুণগুণিয়ে গান গাইতে গাইতে চলে গেলো। ছোট ভাইয়ের খুশি দেখে নিথি ফিচেল হাসলো। ব্যাগ থেকে ফোন বের করতে করতে নিজের রুমে চলে গেলো। ক্লাস টিচারের থেকে ছুটি নিয়ে নিজেও রেডি হয়ে নিলো। নিথি এবং আদন বাসা থেকে বের হওয়ার পূর্বমুহূর্তে নিথির ফোন বেজে ওঠে। নিথি থমকে দাঁড়ায় এবং সাইড ব্যাগ হাতড়ে ফোন বের করে। ফোনের স্ক্রিনে “রায়া” নামটি দেখে নিথি স্মিত হাসলো। রায়িনের থেকেই রায়া নাম্বারটি নিয়েছিলো। মাঝেমধ্যে কল করে আলাপে ব্যস্ত হয়ে পরে। নিথি অবিশ্য বিরক্তি প্রকাশ করে না। উল্টো তার মস্তিষ্ক জানান দেয় মেয়েটা না থামুক। নিথি নির্বিঘ্নে কল রিসিভ করলো। রায়ার কথাবার্তায় তাকে আগের চেয়েও বেশ স্বাভাবিক লাগছে। নিশ্চয়ই ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠছে!
–“আপু তুমি কী ভার্সিটিতে?”
–“না। একটু শপিং এ বেড়োবো।”
–“শপিং? আপু, আমিও আসবো। প্লিজ না করবে না, অনেকদিন তোমার সাথে দেখা হয়নি। আমার বুঝি কষ্ট হয় না? প্লিজ এড্রেস দাও, আমিও যাবো!”

রায়ার আবদার নিথি ফেলতে পারলো না। আসলেই বহুদিন দেখা হয়নি। শুধু মাঝেমধ্যে ফোনে যোগাযোগ হয়েছে। নিথির তো আর রায়ার মতো দুঃসাহস নেই রায়িনের কাছে রায়ার খবর নেয়ার। পড়ালেখার বিষয়ে রায়িন ভিষণ সেন্সিটিভ এবং সিরিয়াস মানুষ। তাকে পড়ালেখার বাহিরে প্রশ্ন করা মানেই ধমক কিংবা বকা খাওয়া। নিথি নির্দ্বিধায় এড্রেস বলে বাসা থেকে বের হয়ে গেলো।

—————————–
রায়িন সবে অফিস থেকে বেরিয়েছে। বর্তমানে ভিষণ রেগে। রাগটা রায়িনের পাপার উপর। গ্রাডুয়েশন শেষ হতে না হতেই তার বন্ধুর মেয়ের সাথে দেখা করার জন্যে তাড়া দিচ্ছে। রায়িন তড়িঘড়ি করে অফিসের সামনে পার্ক করা গাড়িটার পেছন সিটের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে পরলো। কামাল রায়িনের পেছনেই আসছিলো। তিনিও বিনা-বাক্যে ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসে৷ রায়িন ব্যস্ত স্বরে বললো,
–“এসি ছেড়ে টেম্পারেচার বাড়িয়ে দিন, কামাল চাচা!”

কামাল বিনা-বাক্যে তা-ই করলো। রায়িন কপালে বিরক্তির ছাপ ফুটিয়ে তুলে গলার টাই ঢুলে করলো। পরিহিত কালো কোর্টটি খুলে সজোরে পাশের সিটে ছুঁড়লো। যেন রাগটা কমানোর প্রচেষ্টা করলো রায়িন। কিন্তু সফল হলো না। রাগ তড়তড় করে বাড়লো যেন! রায়িন পুণরায় বললো,
–“হোস্টেলে চলুন চাচা। বাড়ি ফিরবো না আজ!”

ঠিক তখনই রায়িনের সেলফোন বেজে ওঠে। রায়িন প্যান্টের পকেট থেকে ফোনটা বের করলো। মা কল করেছে দেখে রায়িন আর কাটলো না, রিসিভ করে কানে ধরলো।
–“বলো মা!” রায়িনের গম্ভীর স্বর!
–“রায়া আবার জেদ করছে রায়িন। সেদিন কোন মেয়ে সাথে না দেখা হয়েছিলো? ওর সাথে শপিং এ যাবে!”
–“কোন মেয়ে?”
–“ওইযে তোর ছাত্রী। যেই মেয়ের জন্যে মেয়েটা একটু স্বাভাবিক হয়েছে?”

রায়িন নিশ্চুপ রইলো। তাকে অসুন্দর বলা মেয়েটা তার বোনের জন্যে মেডিসিন। রায়িন কিয়ৎক্ষণ নিরবতা পালন করে থমথমে গলায় বললো,
–“রেডি হয়ে থাকতে বলো। আমি আসছি!”

রায়িন কল কেটে লুকিং গ্লাসে তাকাতেই দেখলো কামাল গাড়ি চালানোর ফাঁকে ফাঁকে রায়িনকে দেখছে। রায়িনের মুখশ্রীর ভঙ্গিমা যেন কামাল বেশ ভালো করেই পড়ে ফেললো। উত্তরে অমায়িক হাসি দিয়ে বলে,
–“গাড়ি ঘুরাই তাহলে?”

রায়িন উত্তর দিলো না। ক্লান্ত জীবের ন্যায় সিটে গা এলিয়ে দিলো। ক্লান্তিতে চোখ বুজে এলো যেন।

—————————
নিথি আদনকে নিয়ে শপিংমলে পৌঁছিয়েছে সবেমাত্র। সকাল সময়টায় এত জ্যাম থাকে, বলার মতো না। তার উপর একটাও খালি সিএনজি পায়নি, যেটা রিজার্ভ করে এখানে আসতে পারবে। যেমন রিকশার অভাব ছিলো তেমনই সিএনজির। অন্যান্য সময় এগুলো অহরহ দেখা যায়। তবে নিথির অবশ্য তাড়া ছিলো না। সে চেয়েছে সবটা আস্তে-ধীরে হোক। কিন্তু আফিয়ার বারবার ফোন আসাতে নিথি তাড়াহুড়ো-ই করলো। শপিংমলের সিঁড়ির এক ধাপ অতিক্রম করতেই পরিচিত কন্ঠস্বর শুনে নিথির চরণ থমকে গেলো। ঘাড় বাঁকিয়ে পিছে ফিরতেই রায়াকে দেখলো হাস্যোজ্জ্বল মুখে একটা প্রাইভেট কার থেকে নামছে। নিথির কাছে আপাতত এটা উবারই মনে হলো। হবে রায়ার পরপর রায়িনকে দেখে নিথি ‘থ’ মেরে দাঁড়িয়ে রয়। যাকে বলে আউট অফ মাইন্ড। অনাকাঙ্ক্ষিত মুহূর্তে কাঙ্ক্ষিত মানুষকে পেলে ধাক্কা খাওয়া স্বাভাবিক। রায়িন একটি জাম কালারের শার্ট পরিহিত। ইন করা, উপরের দুটো বোতাম খোলা। সেখান থেকে একটা বোতাম লাগাতে লাগাতেই ড্রাইভিং সিটে বসা কামালের দিকে গেলো। কিছু একটা বলতেই কামাল গাড়ি নিয়ে কোথায় যেন চলে গেলো।

নিথির মনে হয়েছিলো রায়িন উবারের ভাড়া মিটাচ্ছে তাই নিথি লাজুক হেসে মাথা নুইয়ে ফেলে। আদন নিথির হাত দোলাতে দোলাতে বলে,
–“এটাই কী স্যারের বোন বুবু?”

রায়া নিথির সঙ্গে কুশল বিনিময় করলো, রায়িনের আসা অবধি। রায়িন আসতেই চারজন মিলে শপিংমলে ঢুকলো। নিথি তো কোণা চোখে একটু পরপরই তাকিয়েছে।

রায়িন ভেবেছিলো এখানে শুধু নিথি এবং আদন এসেছে। কিন্তু ভেতরে এসে দেখছে এলাহি কান্ড। এত মেয়ে মানুষের সামনে সে কী করবে? অদ্ভুত তো! রায়িনের নিভে যাওয়া রাগটা যেন ধপ করে জ্বলে উঠলো। মিনমিন করে নিথিকে গালমন্দ করতেও ভুললো না। কমনসেন্স নেই এই মেয়ের? কী করে এত মানুষের মধ্যে ওদের ডাকলো? বিষয়টা পারিবারিক রাখাই দরকার ছিলো!

পকেটে হাত গুজা রায়িনকে দেখে মোহনা যেন হঠাৎ আসমানে ভাসতে শুরু করলো। রায়িন তার জন্যে বিরাট সারপ্রাইজ ছিলো। মোহনা রায়িনের দিকে এক ধাপ এগোতেই আফিয়া ওর হাত ধরে আটকালো,
–“কই যাচ্ছিস? আমার সাথে চল। মা সাফ বলে দিয়েছে যেন আমি ছাড়া তুই কোথাও না যাস!”
–“কিন্তু আপু..”
–“কোনো কিন্তু না। ওদিকে তোর দুলাভাই ওয়েট করছে। ভুলে গেছিস? আর নিথি? তোর গেস্ট বুঝি?”

নিথি আলতো হেসে ইতিবাচক মাথা নাড়ালো। আফিয়া রায়িনকে সালাম দিলো এবং রায়ার সাথেও টুকটাক কথা বললো। আফিয়া ওদের সাথে কথা শেষ করে নিথির উদ্দেশ্যে বলে,
–“নিথু, তুই তাহলে ধীরে সুস্থে আয়। আমি, মোহনা এবং ভাবী তিন তলার ব্রাইডাল শো-রুমে আছি!”

নিথি এবারও হাসলো। ওরা চলে গেলো। মোহনা থাকতে চাইলেও থাকতে পারলো না। মোহনা যেতেই নিথি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। মন জুড়ে খুশির জোয়ার এসেছে যেন। আফিয়া আপুকে তার অগণিত ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে করছে। রায়া আদনের উদ্দেশ্যে বলে,
–“আদন, আজ তো তোমার সাথে আমার ফাস্ট মিট। চলো, ওই খেলনার দোকানে!”

আদনের চোখে-মুখে খুশির ঝলক ফুটে ওঠে। খুশিতে গদগদ হয়ে বলে,
–“চলো আপু!”

রায়া এবং আদন দ্রুত চলে গেলো। নিথি ওদের পিছু নিতে চাইলে রায়িন তার কবজি চেপে হালকা টান দিলো। মুহূর্তে-ই নিথির দেহের প্রতিটি রন্ধ্র অসম্ভব কেঁপে উঠলো। নিথি চমকে রায়িনের দিকে তাকালো। রায়িনের মুখশ্রী দেখে বুঝতে বাকি নেই, সাহেব রেগে আছে। নিথি আমতা আমতা করে আওড়ায়,
–“ক..কী হয়েছে স্যার?”
–“কমনসেন্স নেই তোমার? তোমাদের ফ্যামিলিতে আমাদের কেন টানলে? এটা কীরকম বিব্রতিকর তুমি বুঝো?”

রায়িনের হালকা ধমকে নিথি খানিক কেঁপে উঠলেও তাকে নির্বিকার দেখালো। নিথি এতদিনে বুঝে নিয়েছে এর সাথে যদিও জীবনে ঘর করতে হয় তাহলে এর ধমকে উঠতে এবং বসতে হবে। তার চেয়ে ভালো নয় কী, আগে ভাগে অভ্যাস করে নেয়ার! নিথি তাও মুখটা ভার করে বললো,
–“সরি স্যার। রায়া এতটা জোর করছিলো এবং আমিও ছিলাম তাড়াহুড়োয়! তাই আমার কাজিনদের ব্যাপারটা মাথায় আসেনি!”
–“সেটা আসবে কী করে? মাথায় তো এক গাদা গো/বর! গা’ধী!”
মিনমিন করেই বললো রায়িন। এই ধরণের শব্দ মূলত রায়িন তার বন্ধুদের সম্মুখে প্রয়োগ করে। সেখানে নিথি তার ছাত্রী। রায়িনের বিড়বিড়িয়ে বলা কথাগুলো নিথি বুঝলো না। তাও প্রশ্ন না করে বলে,
–“এসেছেন যেহেতু থাকুন না। তারা তো আপনাকে আর বিরক্ত করছে না স্যার!”

রায়িন চট করে নিথির হাত ছেড়ে দেয়। অতঃপর নিথিকে রেখেই পকেটে দু’হাত গুঁজে রায়াদের যাওয়া দোকানটার দিকে অগ্রসর হয়। নিথি তখন হতভম্ব চাহনি দিয়ে রায়িনের যাওয়া দেখছে। নিথি কয়েকবার চোখের পলক ফেলে নির্বাক স্বরে শুধালো,
–“এনার সাথে প্রেম করা কী এ জীবনে আদৌ সম্ভব? এত গম্ভীর পুরুষ কেন তিনি? তার হৃদয়ে কী ভালোবাসা জম্মায় না? ধুর, কিসব ভাবছি। তিনি হয়তো আমায় ছাত্রী মনে করেন।”

কিন্তু একদিন মানবে না, সেই বিশ্বাস নিথি নিজের মধ্যে রোপ করে রেখেছে। এই দৃঢ় বিশ্বাস হয়তো তার গভীর, স্নিগ্ধ ভালোবাসা থেকে এসেছে। নিথি একপ্রকার ছুটে রায়িনের পাশাপাশি চলে যায়। অতঃপর রায়িনের সাথে ধাপে ধাপে সামনের দিকে অগ্রসর হয়। নিথির হৃদয় বলে, রায়িনের সাথে পাশাপাশি হাঁটার ন্যায় প্রশান্তি আর কিছুতে নেই। নিথি বারংবার আগোচরে রায়িনের স্পর্শ করা স্থানে আঙুল ছুঁয়ে দেখছে। অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করছে তার মনকুঠুরিতে। তবে হাঁটতে হাঁটতে নিথি কারো সাথে ধাক্কা খেলো। নিথি ভেবেছিলো রায়িন-ই হবে কিন্তু অচেনা পারফিউম তার ভাবনাকে ভুল প্রমাণিত করলো। ভাবতে ভাবতে নিথি আবারও রায়িনের থেকে আলাদা হয়েছে। তাইতো এই অপ্রস্তুত ঘটনা। নিথি দূরে সরে ছেলেটাকে পর্যবেক্ষণ করতেই দেখলো অচেনা ছেলেটি তার দিকে কেমন করে তাকিয়ে আছে। নিথি ঘাবড়ালো, ভিষণরকম। রায়িন ঘাড় বাঁকিয়ে বিষয়টি দেখলো তবে তেমন গুরুত্ব দিলো না। ছেলেটি নিথিকে কিছু বলার পূর্বেই নিথি এক ছুটে রায়িনের কাছে চলে গেলো। ছেলেটির চাহনি ছিলো অস্বস্তিকর।

কিছুক্ষণ বাদে নিথির আফিয়াদের সাথে দেখা হলো। আফিয়ার ফিয়ন্সের পাশের ছেলেটিকে দেখে নিথি পুণরায় আঁতকে ওঠে৷ ছেলেটি নিথির দিকে চেয়ে আফিয়ার উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
–“ভাবী, ও কে?”
–“আমার কাজিন। নিথি। আর নিথি, তোকেও পরিচিত করিয়ে দেই, ও হচ্ছে জামান। তোর জিজার বেস্টফ্রেন্ড!”

————————–
আজ আফিয়ার বিয়ে। অতিথিদের সমাগম মিনিট বিশেক আগের চেয়েও বেড়েছে। চারপাশ হৈ-হুল্লোড় এবং আনন্দের বাতাসে নিমজ্জিত। আদন কই গেছে কার সাথে আছে কারো হুঁশ নেই। বড়ো’রা মেহমানদের আপ্যায়নে ব্যস্ত। আফিয়া স্টেজে বঁধুরূপে বসে আছে। ফটোগ্রাফার’রা ক্লিক ক্লিক শব্দে নতুন বউয়ের নানান পোজে অনবরত ছবি তুলতে ব্যস্ত। এছাড়া একেকজন বউয়ের সাথে নিজেদের ছবি তুলাতে লাইন বাঁধিয়ে ফেলেছে। নিথি অবশ্য এই ছবি তোলার পর্ব পূর্বেই ইতি টেনেছে। নিথি আপাতত তার বেস্টফ্রেন্ড নয়নার পাশে বসে আছে। নিথি কখনোই নয়নাকে তার বোনদের উর্ধ্বে দেখেনি। বরং সবসময় নয়নাকে প্রতিটি ফাংশনে ওদের সাথে নয়নাকেও সঙ্গে নিয়েছে। নয়তো তার কতটা আপন, নিথি তা প্রকাশ করতে পারবে না। তাই আফিয়া, সামিহা ভাবী ওদের সাথেও নয়নার বেশ ভালো সম্পর্ক।

নিথি বারংবার ফোন দেখতেও ভুলছে না। নয়না নিথির অস্থিরতা দেখে বললো,
–“তুই শিওর, তোর ওই স্যার আসবে?”
–“না এসে উপায় আছে নাকি? আপু সেদিন অনেক রিকুয়েষ্ট করেছে। এছাড়া আমিও তো গতকাল রিকুয়েষ্ট করলাম! আমার মন বলছে, উনি আসবেন। আসতে ওনাকে হবেই।”

নয়না আর কিছু বললো না। নিথির এই কনফিডেন্স গুলো নয়নাকে ভিষণ অবাক করে। নয়না নিথির দিকে ধ্যান না দিয়ে চারিপাশে নজর বুলাতে লাগলো। একসময় নিথির অপেক্ষার অবসান ঘটে। হ্যাঁ, সত্যি-ই রায়িন এসেছে। নিথি এক লাফে উঠে দাঁড়ায়। নয়নাও চমকে উঠে দাঁড়ায় এবং ব্যস্ত হয়ে বলে,
–“কী হলো?”
–“রায়িন স্যারকে দেখবি বলেছিলি না? ওই দেখ, খয়েরী রঙের পাঞ্জাবিওয়ালাকে। ওটাই আমার রায়িন স্যার!”

নয়না নিথির বর্ণনানুযায়ী সামনে তাকালো। কিছুটা ভীড়ের মধ্যে দেখা যাচ্ছে রায়িন এদিক ওদিক তাকিয়ে ফোনে কথা বলছে। নয়না ভিষণ অবাক হলো রায়িনকে দেখে। সত্যি-ই রায়িন দেখতে মন্দ নয়। নিথির নিঁখুত বর্ণনা খুব সুন্দরভাবে মিলে যাচ্ছে। নিথি নয়নাকে ফেলেই রায়িনের কাছে চলে গেলো। রায়িন নিথিকে দেখে থম মেরে দাঁড়ায়। সে যে প্রথম দেখছে শাড়ি পরিহিত এই নিথিকে। মেয়েটাকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। রায়িনের গলার মধ্যিখানে যেন কথা আটকে গেলো। কলের অপরপাশের ব্যক্তিটি তখনো এলোমেলো কন্ঠে হ্যালো, হ্যালো বলতে ব্যস্ত। রায়িন কোনোরূপ উত্তর দিচ্ছে না দেখে তিনি নিজ থেকেই কল কেটে দেয়। রায়িনের সেদিকেও হুঁশ নেই। অদ্ভুত ভ্রমে আছে নয়তো ঘোরে।
এর মাঝে এক জঘন্য কান্ড ঘটলো।
নিথির পেটের পাশের পিন ছুটে পেট কিছুটা দৃশ্যমান হলো। রায়িনের এলোমেলো দৃষ্টি হুট করে সেদিকে চলে গেলো। রায়িন জড়তায় হতভম্ব হয়ে দ্রুত পা চালিয়ে অন্যদিকে চলে গেলো। এদিকে নিথি নিজেও লজ্জায় হতভম্ব, বিমূঢ়! বিষয়টা এত দ্রুত ঘটলো যে নিথি এরকম অপ্রস্তুত ঘটনা সামাল দিতে ব্যর্থ হয়। যার ফলাফল এই কঠিন লজ্জা। নিথির লজ্জায় গাল ভার হয়ে যেন ছিঁড়ে পরছে। দ্রুত কমিউনিটি সেন্টারের মেকাপ রুমে চলে আসলো সে। নতুন এক পিন নিয়ে লাগাতেই দরজার লাগানোর বিকট শব্দ শুনতে পায়। নিথি যেমন চমকায় তার চেয়েও অধিক ভড়কালো জামানকে দেখে। জামানের দৃষ্টি পূর্বের চেয়েও ভয়াবহ! নিথি বিষ্ময়ের চরম পর্যায়ে পৌঁছালো। পা যেন বরফ হয়ে জমে আছে। কিছুতেই নড়তে চাইছে না। অধরজোড়াও নিথির মৃদ্যু কম্পনরত। নিথি এই কঠিন মুহূর্তে নিজেকে দুর্বল দেখাতে একদম ইচ্ছুক নয়।
তটস্থ হয়ে জোর গলায় বলে ওঠে,
–“এসবের মানে কী জামান ভাই? এখানে আপনি এসেছেন কার অনুমতি নিয়ে? এছাড়া দরজা কেন লাগিয়েছেন?”

জামান নিথির বচন সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করলো। নিথির দিকে এগোতে এগোতে ই’ডি’য়ে’ট মা’র্কা হাসি দিয়ে হালকা খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে হাত বুলিয়ে বলে,
–“তোমায় আজ সত্যি দারুণ লাগছে! নিজেকে কান্ট্রোল করাও দায় হয়ে পরেছে!”

নিথির বুঝতে বাকি নেই জামানের এমন উক্তির মানে। জামানের চাহনিতেও স্পষ্ট কামনা! নিথি ভয়ে এক চিৎকার দিয়ে দূরে সরে গেলো। জামান ঘর কাঁপিয়ে হেসে ওঠে। তার বিষাক্ত হাসির শব্দ চার দেয়ালে বারি খাচ্ছে। নিথি চিৎকার করে বলে,
–“দূরে থাকুন আমার থেকে। একদম আমার কাছাকাছি আসার চেষ্টা করবেন না!”
–“আহা! বাচ্চাদের মতো কথা বলছে। তোমার বুঝি আদর পেতে ইচ্ছা হয় না? আসো, তোমার অপ্রকাশিত আকাঙ্ক্ষা আমি পূরণ করে দেই!”

নিথি পুণরায় ঘরের অন্যদিকে চলে গেলো এবং বারংবার চিৎকার দিয়ে সাহায্য চাইছে। জামানের হাসিও যেন থামার নয়। হাসতে হাসতে বলে,
–“এখানে তোমার চিৎকার শোনার কেউ নেই, বুঝলে?”

নিথি পুণরায় চিৎকার দিয়ে উঠলো। ঠিক তখনই দরজায় কড়াঘাতের শব্দ শোনা যায়। নিথি কেঁদে-কেটে চোখ মুখ লাল করে ফেলেছে। সুযোগ বুঝে দরজার দিকে যেতে নিতেই নিথির গলার সিতাহারে জামানের হাত লাগলো। সেই টানে সিতাহারের সুতো ছিঁড়ে হারের প্রতিটা অলংকার এদিক সেদিক ছড়িয়ে গেলো। দুর্ভাগ্যবশত নিথির কাঁধের দিকের ব্লাউজও ক্যাচ ক্যাচ শব্দে কিছু অংশ ছিঁড়ে যায়। ঠিক তখনই রায়িন দরজা ভেঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করলো। জামান ভয় পেয়ে যায়। হাতে থাকা ছেঁড়া ব্লাউজের অংশটুকু ফেলে দিয়ে রায়িনকে ধাক্কা দিয়ে পালিয়ে যায়। রায়িন জামানকে ধরতে গেলে নিথির কান্নার বেগ শুনে তার পা থমকে যায়। ঘাড় বাঁকিয়ে নিথিকে দেখে রায়িনের বুক কেঁপে ওঠে। কী বিধ্বস্ত অবস্থা নিথির। নিথি নিজেকে শাড়ির আঁচলে আবদ্ধ করে নিশ্চুপ হয়ে কেঁদে যাচ্ছে। রায়িন কম্পনরত পায়ে এক পা এক পা করে এগিয়ে গেলো।
দু’জনের মাঝে নিরবতা চললো দীর্ঘক্ষণ! একসময় নিরবতা ভেঙ্গে রায়িন বলে ওঠে,
–“তুমি ঠিকাছো?”

ঠিক তখনই নিথির মা সহ নিথির জেঠু, জেঠীরা রুমে প্রবেশ করলো। ওদের মূলত জামান-ই পাঠিয়েছে। নিথির এরূপ অবস্থা দেখে শারমিন আক্তারের আত্মা কেঁপে উঠলো।

~চলবে, ইনশাল্লাহ।
ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম।