কৃষ্ণচূড়ার এক সন্ধ্যা পর্ব-১৪+১৫

0
299

#কৃষ্ণচূড়ার_এক_সন্ধ্যা – [১৪+১৫]
লাবিবা ওয়াহিদ

————————-
–“আরে জোয়ান পোলায় টিচার, বুঝো না? ইটিসপিটিস থাকবেই। মেয়েটাও তো কম চরিত্রহীনা না। ছিঃ ছিঃ ছিঃ বিয়েভর্তি কমিউনিটি সেন্টারে এরা এসব করে বেড়ায়? ভাগ্যিস আফিয়ার মায়ের পিছু পিছু আসলাম, নয়তো দেখতি এগুলা ধামাচাপা দিয়ে রাখতো!”
–“হ্যাঁ ভাবি, ঠিক বলেছেন। চোখের দেখা কী ভুল হয় কখনো? জলজ্যান্ত প্রমাণ সামনে দাঁড়িয়ে। আরও দেও জোয়ান ছেলের কাছে পড়াইতে। এ মাইয়া তো না যেন আ’গুনের গোলা!”
–“ছেলেও কেমন বেহায়া, মাইয়ার লগে এখানে, ছিঃ! বলতেও গা ঘিনঘিন করে!”

কয়েকজন মহিলার কথাবার্তায় রায়িনের চোখ-মুখ অসম্ভব লাল হয়ে আছে। রাগে, অপমানে মাথা ভার হয়ে আছে যেন তার। রায়িন কয়েকবার বলেছে, নিথি বা তার মধ্যে কিছু হয়নি। অন্যকেউ নিথির ক্ষতি করার চেষ্টা করছিলো, কিন্তু মহিলাগুলো আরও দু’লাইন বাড়িয়ে বললো,
–“বেশি ভালো সাজার চেষ্টা করবা না। নিজে দোষ করসো, স্বীকার করো। তা না করে আরেকজনের উপর দোষ চাপানোর মানে কী?”

এরকম নানান কানাঘুষা করতে লাগলো। নিথি জ্ঞান হারিয়ে শারমিন আক্তারের কোলে পরে আছে। আপাতত হিতাহিত জ্ঞান নেই। রায়িন পরেছে বিরাট ঝামেলাতে। নিথির চাচী এবং চাচা’রা নির্বাক হয়ে এখনো দাঁড়িয়ে। এমন পরিস্থিতি নিজ চোখে দেখে তাদের বিশ্বাস না করে উপায় নেই। আপাতত তারা বাকরুদ্ধ। তাদের বাড়ির মেয়ে শেষে কি না প্রাইভেট টিচারের সাথে…! রায়িন পাশের চেয়ারে মাথা ধরে চুপ করে বসে আছে। একসময় নিথির জেঠু মাইনুল হোসেন চোখ রাঙিয়ে বলে ওঠে,
–“তুমি আমাদের বিশ্বাসের এই প্রতিদান দিলে? আমাদের বাড়ির মেয়েকে এভাবে বেইজ্জতি করতে নিচ্ছিলে? এই তোমার শিক্ষা?”

রায়িনের চোখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। মাথা তুলে সোজা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে জেঠুর দিকে। রায়িন বেশ জোর গলায় বলে,
–“আপনাকে কী আমায় রাস্তার জা/ নো/ য়ারের মতোন মনে হয়? আমি একজন ভদ্র ঘরের সন্তান হয়ে কখনোই একটা মেয়েকে হেনস্তা করতে পারি না। সেখানে নিথি তো আমার ছাত্রী! কতবার বলবো, নিথির সাথে আমার ওরকম কোনো সম্পর্ক নেই! এর মাঝে যে বড়ো শ/ য়/ তান তাকে না ধরে আপনারা আমার পিছে লেগেছেন কেন?”

মহিলাদের আবার কানাঘুষা শুরু হলো।
–“যেমন বাপ তেমনই হয়েছে তার মেয়ে। দেখেছিস, মেয়েটার চরিত্র কেমন? এর আগেও তাহলে অন্য পুরুষের সাথে মেলামেশা ছিলো! নাউজুবিল্লাহ! সমাজটা ন’ষ্টা’মিতে ভরে গেলো!”

মাইনুল হোসেন এবার অতীষ্ঠ হয়ে গেলেন। কিন্তু কিছু বলতেও পারছেন না। ঘটনা এখনো এই কক্ষের বাইরে যায়নি। বরপক্ষও এসেছে অনেকক্ষণ। ঘটনা জানাজানি হলে আফিয়ার বিয়েও যেমন ভেঙ্গে যাবে তেমনই সকলে তাদের পরিবারকে ছিঃ, ছিঃ করবে। মাইনুল হোসেন বেশ ভালোভাবে উপলব্ধি করছেন কঠিন বিপদ তাদের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে। এখনই কোনো ব্যবস্থা না নিলে বড়ো কোনো সর্বনাশ ঘটে যাবে। মুহূর্তে-ই মাইনুল হোসেন মেয়ের স্বার্থে, পরিবারের স্বার্থে স্বার্থপর হয়ে উঠলেন। সর্বপ্রথম তার এই মহিলাগুলোর মুখ বন্ধ করতে হবে! কিন্তু কী করে? চিন্তায় হাবুডুবু খেলেন পুণরায়।

শারমিন আক্তারের কোলে নিথির জ্ঞান ফিরলো। মাইনুল হোসেন প্রথমে ভেবেছিলেন নিথির থেকেই আসল সত্যটি জেনে নিবেন। তবে নিথি আগের মতো-ই ভাবশূন্য, চোখে-মুখে একরাশ ভীতি একত্রিত হয়েছে। জবানে শব্দ নেই, মস্তিষ্কে ভাবনা নেই। বারংবার সেই কালো সময়টা তার মস্তিষ্কে বিচরণ করছে। চারপাশে কী হচ্ছে, কারা আছে কিছুই তার ধ্যানে নেই। মাইনুল হোসেন পরলেন কঠিন এক পরিস্থিতিতে। ওদিকে কানাঘুষা যেন থামতেই চায় না।
–“দেখেছিস, মেয়ের মুখে কোনো কথা নাই। আমি জানতাম, এই মেয়ে সেই চরিত্রহীনাদের অন্তর্ভুক্ত! কিছু না করলে এমন চুপ থাকবে কেন? কী ভেবেছে অপরাধ করে পার পেয়ে যাবে?”
–“আপনারা দয়া করে চুপ থাকবেন? যা জানেন না তা নিয়ে কেন কথা বলছেন? আমার মেয়েকে কেন দোষারোপ করছেন?”
–“তোমার মেয়ে কী ধোঁয়া তুলসি পাতা যে তাকে ঘাড়ে বসিয়ে পূজো দিবো? তোমার মেয়ে কী করেছে তা তো নিজের চোখেই দেখেছি!”
–“ফর গড সেক নিথি! প্লিজ কিছু বলো! নিথি!”

শেষোক্ত বাক্য বলে রায়িন জোরে এক ধমক দিলো। নিথি ভয় পেয়ে আঁতকে উঠলেও পুণরায় গুটিশুটি মেরে গেলো। তার ভিষণ ভয় করছে। অথচ উপস্থিত পরিস্থিতি কীরূপ ভয়ংকর তা নিথির কল্পনারও বাইরে। একসময় সাজিদ ছুটে আসলো মেকাপ রুমে। সবার দিকে নজর বুলিয়ে মাইনুল হোসেনের উদ্দেশ্যে বললেন,
–“কাজী এসে গেছে চাচ্চু, আফিয়ার বিয়ে পড়ানোর আগে এখানে আনবো তাকে?”

“বিয়ে” শব্দটি শুনে নিথির হারিয়ে যাওয়া সম্বিৎ যেন ফিরে আসে। কান্নাভেঁজা চোখে সাজিদের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। রায়িন তখন পুণরায় বলে ওঠে,
–“বিয়ে? কিসের বিয়ে? আপনারা বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলছেন বলে মনে হয় না? এক কথা কেন বারবার আপনাদের বলতে হবে?”

এতক্ষণে মাইনুল হোসেন বেশ কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে বসলো। পরিবারের সম্মান এবং মেয়ের বিয়ে ভাঙ্গার পূর্বে ওদের বিয়ে দিতে হবে। এখানে কোনো বাঁধা তিনি মানবেন না! মাইনুল হোসেন রায়িনকে তোয়াক্কা না করে সাজিদকে সম্মতি দিলেন। সাজিদ বিনা-বাক্যে চলে গেলো। নিথি এবার মুখ খুললো,
–“জেঠু, তুমি কী করে এই কঠিন কথা কী করে বলতে পারছো? উনি নির্দোষ! এসব কী করছো তোমরা?”

আগুনে ঘি ঢালতে মহিলাগুলো এবার মুখ খুললো,
–“বাহ! বুলি ফুটেছে তাহলে। দেখেছেন, প্রেমিকের জন্যে কত দরদ? প্রেমিক নাকি হাতের ময়লা কে জানে। এছাড়া আমাদের জানা আছে তোমাদের মুরোদ। যদি এতই সত্যবাদী হও তাহলে বিয়ে করে দেখাও।”
–“যেখানে আমাদের মাঝে কোনো সম্পর্ক নেই সেখানে জোর করে বিয়ে দিতে চাইছেন? বিয়ে দিয়ে উল্টো দু’জন মানব-মানবীর জীবন নষ্ট করতে চাইছেন আপনারা। আপনারা কী চোখ থাকতে অন্ধ? কী করে তিল কে তাল বানাচ্ছেন? আন্সা মি!”

নিথি সকলকে সত্যটা জানাতে চাচ্ছিলো কিন্তু কেউ তাকে সামান্য গুরুত্ব দিলো না। শারমিন আক্তার নিজেও মূর্তির ন্যায় বসে রয়। এর মাঝে সাজিদ কাজি নিয়ে চলে আসে। বড়ো জেঠু এবার কাঠকাঠ গলায় নিথির উদ্দেশ্যে বলে,
–“বিয়েটা করে নিজেরও সম্মান বাঁচা সাথে আমাদেরও! যা ক্ষতি তোরা দু’জন মিলে করেছিস, আর কিছু করিস না। আজ তোর জন্যে আফিয়ার বিয়ে ভাঙলে আমি তোদের সাথে খারাপ কিছু করে বসবো!”
–“এই মশাই! আপনার খারাপ কিছু মাই ফুট! কিছুতেই অন্যের দোষ আমি নিজের ঘাড়ে চাপাবো না! আধুনিক যুগে এসেও আপনাদের মানসিকতার সামান্য উন্নতিও ঘটেনি। আবার কিসের বড়ো বড়ো ডায়লগ ছাড়ছেন? আজ আমি বিয়ে করবো না, কিছুতেই না। বিয়েটাকে কী আপনারা ছেলে খেলা পাইছেন? আমাকে যদি জোর করে বিয়ে দেয়া হয় তাহলে আমি আপনাদের বিরুদ্ধে একশন নিবো। তখন কই যাবে আপনাদের এই লোক দেখানো সম্মান? কিছু বলছি না বলে সব পেয়ে বসবেন? ওয়েট, এতক্ষণ যা করিনি এখন আমি তা-ই করবো!”

রায়িন তার পাঞ্জাবির পকেট থেকে ফোন বের করলেই সাজিদ চট করে ফোনটা কেড়ে নেয়। নিথি কাঁদতে কাঁদতে হাত জোড় করে সাজিদের উদ্দেশ্যে বললো,
–“প্লিজ ভাইয়া ওনার ফোন ফেরত দিয়ে দাও। এখানে অনেক বড়ো ভুল বুঝাবুঝি হচ্ছে। তোমরা কী করে এতো পাষাণ হচ্ছো?”
–“যেভাবে তোরা এই অকাজ করতে গিয়েছিস ঠিক সেভাবেই। চুপচাপ বিয়েটা কর, নয়তো সারাজীবনের মতো এখান থেকে দূরে চলে যাবি!”
–“আমি তা-ই করবো, তাও বিয়েটা হতে দিও না!”

মাইনুল হোসেন কঠিনভাবে বেঁকে বসেছেন। বিয়ে তো ওদের করতেই হবে। একপ্রকার জোর-জবরদস্তির মাধ্যমে ওদের বিয়েটা সম্পূর্ণ হয়।

————————————
নিথি নির্বাক হয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তার দেহে একটি কটি বিদ্যমান, যেটা রায়িনের গায়ে ছিলো। রায়িন ভাবশূণ্য হয়ে রাস্তার মোড়ে এসে কামালকে কল দিলো। কামাল রিসিভ করতেই রায়িন ক্লান্তির স্বরে বললো,
–“চাচা, আপনি গাড়ি নিয়ে আসুন। আমি ** তে অবস্থান করছি!”

নিথি ঝাপসা চোখে রায়িনের দিকে তাকালো। রায়িনের অবস্থা দেখে তার বক্ষ হু হু করে কেঁদে উঠলো৷ এই পবিত্র মানুষটাকে আজ তার জন্যে কতটা অপমান, লাঞ্ছনা সহ্য করতে হলো। এমনকি জোর-জবরদস্তি তাকে বিয়েও করতে হলো। অথচ নিথি ছিলো অচল, বাক্যহীন। নিথি তো চায়নি এভাবে অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনা ঘটুক, তাহলে কেন সে রায়িনের জীবনটা এলোমেলো করে ফেললো? অনুশোচনা, অপরাধবোধের দগ্ধে পুড়ে ছাড়-খাড় হচ্ছে তার সমস্ত দেহ। নিথির সমস্ত দেহ যেন অবশ হতে চাইছে। অদ্ভুত যন্ত্রণা তার মস্তিষ্কতে চাপ সৃষ্টি করছে।

সন্ধ্যার শেষ লগ্ন চলছে। ফুটপাতে কৃত্রিম আলোর বিচরণ চলছে। কৃষ্ণচূড়া গাছগুলো সম্বলহীন হয়ে সটান মেরে দাঁড়িয়ে। তাদের গাছে যে কৃষ্ণচূড়ার দেখা নেই, কৃষ্ণচূড়ার সিজন যে সেই কবেই শেষ। নিথির ওই সম্বলহীন গাছগুলোর সাথেই নিজেকে তুলনা করতে চাইছে। একসময় তার জীবনও কৃষ্ণচূড়ার সবুজ পাতার ভাঁজে ভাঁজে ফুলের মতো স্নিগ্ধ এবং সুন্দর ছিলো। আর আজ গাছে যেন কৃষ্ণচূড়া নেই, তেমনই তার জীবনের সুখও নেই, দহনে পুড়ছে সে, তুমুলভাবে। প্রখরভাবে! মিনিট দশেকের মাঝে একটি প্রাইভেট কার তাদের সামনে এসে থামলো। নিথি পুণরায় এটাকে উবার ভেবে নিলো।

কামাল রায়িনের পাশে এক যুবতীকে দেখে বেশ চমকালো। দ্রুত কাঁচ নামিয়ে মাথা নিচু করে রায়িনের দিকে তাকাতেই রায়িন বিনা-বাক্যে পিছের সিটের ডোর খুললো এবং নিথির উদ্দেশ্যে বেশ গম্ভীর স্বরে বললো,
–“উঠো!”

নিথি বাধ্য মেয়ের মতো উঠে বসলো। এছাড়া তার যে কোনো উপায় নেই। রায়িন নিথির পাশে বসলো না। ফ্রন্ট সিটের ডোর খুলে উঠে বসলো। এতে নিথির ফোলা চোখে আবারও অশ্রুর মেলা ভর করে৷ অধরে অধর চেপে অশ্রু ধারা আটকে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালালো। কামালের সবটাই যেন মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। লুকিং গ্লাসে একবার নিথিকে তো একবার ঘাড় বাঁকিয়ে নিথিকে দেখছে। কী হচ্ছে এসব? মেয়েটাই বা কে? কৌতুহল দমাতে অক্ষম কামাল। ফোস করে নিঃশ্বাস ফেলে রায়িনকে প্রশ্ন করে বললো,
–“এটা কে?”

রায়িন ভাবলেশহীন। কামালের প্রশ্ন এড়িয়ে বলে,
–“আমি দ্রুত বাড়ি ফিরতে চাই!”

কামাল কৌতুহল কিছু দমালেন। অতঃপর পুণরায় মেয়েটার দিকে তাকিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো। নিথি সিটে মাথা এলিয়ে বাহিরটা দেখতে লাগলো। জীবন কোথা থেকে কোথায় গিয়ে ঠেকলো। যেন জীবন তার সাথে কঠিনরকম বেঈমানী করলো। কেন? কেন মিথ্যে সবসময় জিতে যাবে? মিথ্যেগুলোর সাময়িক জিত বুঝি এতটা ভয়াবহ? নিথি তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো।

একঘন্টার মাঝে মেইনরোড ছেড়ে এক নিরিবিলি লোকালয়ে প্রবেশ করলো। নিথি কিছু বিষ্ময় নিয়ে দ্রুত মাথা তুলে সটান মেরে বসলো। চোখের কোণ মুছতে মুছতে সতর্কতার সাথে চারপাশে নজর বুলালো। এটা কই? এই রোডে তো কিছু বাড়ি পর পর শুধু ডুপ্লেক্স বাড়ি দেখা যাচ্ছে। এটা কোন এরিয়ায় ঢুকালো গাড়ি? এরমাঝে রায়িন আরেকটা কথা বলে ওঠে, কামালের উদ্দেশ্যে।
–“ও আমার অপ্রত্যাশিত স্ত্রী, চাচা!”

কামাল তখনই তার মনোযোগ হারালো। বেসামাল হতেই স্পিড সামলাতে ব্যর্থ হতে হতে দ্রুত নিজেকে শুধরে নিলো। কী বলছে রায়িন এসব? কিসের স্ত্রী? রায়িনের মাথা ঠিকাছে? নিথি পুণরায় শুনলো রায়িনের বাক্য। রায়িনের কথায় নিথি থমকে যায়। বারবার লোকটিকে চাচা কেন বলছে, তিনি কী রায়িনের পূর্ব পরিচিত? কিছুক্ষণ আগেও তো চাচা শুনেছিলো রায়িনের মুখে। নিথির কাছে সবটা কুয়াশার ন্যায় ধোঁয়াশা লাগছে। চারিপাশে যা হচ্ছে সবটাই যেন তার কাছে অস্পষ্ট!

কিছুক্ষণের মধ্যে এক বড়ো গেট দিয়ে হর্ণ বাজাতে বাজাতে গাড়িটি প্রবেশ করলো। গেট দিয়ে গাড়িটি ঢুকাতে ঢুকাতে রায়িন বললো,
–“পাপা কী আজ বাসায়, চাচা?”
–“না। থাইল্যান্ডে কাজের জন্যে গিয়েছে। ডিলটা হুট করেই হয়েছে। তোমার ফোন সুইচড অফ ছিলো বিধায় তোমায় জানাতে পারেনি। বিকালেই রওনা হয়েছে!”

অন্য দেশের নাম শুনে নিথির পিলে চমকে উঠলো। তার চেয়েও বেশি অবাক হলো এত সুন্দর সৌখিন বাড়ি দেখে। এর মানে রায়িন বড়োলোক বাবার ছেলে? এতদিন তাহলে কেন লুকালো রায়িন? তার পরিচয়ের সত্যতা কী, নিথির জানা নেই। এতদিন যেন কোনো মায়াজালে বন্দি অবস্থায় ছিলো। নয়তো তার মস্তিষ্কে একবারও কেন এলো না, রায়িন বড়োলোক হতে পারে? এছাড়াও রায়িন ভাবনা, পোশাক সবটাই ছিলো সাধারণ ছেলেদের মতো। তাইতো নিথির সরল মন ভেতরের কাহিনী ধরতে অক্ষম ছিলো।

————————
অন্ধকারাচ্ছন্ন এক সৌখিন রুম। কয়েকটা ক্যান্ডেল ঢিপঢিপ করে জ্বলছে রুমের একপাশে। সেই ক্যান্ডেলের আবছা আলোয় ক্যান্ডেলের পাশের দেয়ালে রায়িনের হাসিমাখা ছবিটা দৃশ্যমান। নিথি বড় বিছানার একদম মধ্যিখানে বসে আছে। যেহেতু বিয়েটা অপ্রত্যাশিত ছিলো তাই রুমে কোনো ফুল টুল নেই, অন্যান্য বাসরের মতো। আজ প্রথমবার নিথি রায়িনের মায়ের সাথে পরিচিত হয়। অপ্রত্যাশিত বিয়ের কথায় সকলের চেহারাতেই বিষ্ময় ভাব ফুটে উঠেছিলো। ঘন্টাখানেক সময় লেগেছিলো অজানা ঘোর হতে বের হতে। তবে রায়া ছিলো সবচেয়ে খুশি। নিথি তার ভাবী হয়েছে, তার সবচেয়ে পছন্দের আপুটা ভাবী হয়েছে। আর কী চাই তার? তবে অন্তরা রহমান খুব একটা মানতে পারেননি। মানাটা আপাতত নিজের মধ্যে চেপে গেলেন অন্তরা রহমান। নিথির বিধ্বস্ত অবস্থা দেখেই তার বুঝতে বাকি নেই, বড়ো কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছে। রায়িন অবশ্য এখনো সবটা খোলাশা করেনি। এছাড়া নিথির অবস্থা উপলব্ধি করে তাকেও কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পাননি। এতে যদি নিথি বিব্রতবোধ করে? সেই ভেবে। রায়িন বাড়িতে এসেই সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গিয়েছিলো। মিনিট দশেক পরে হাতে চাবির গোছা নিয়ে নিচে নামে। পরনে তার একটি টি-শার্ট এবং জিন্স। নিথিকে একপলক দেখে অন্তরা রহমানের উদ্দেশ্যে বলেছিলো,
–“মা আমি আসছি, কখনো ফিরবো জানা নেই!”

বলেই নিথিকে আরেক পলক দেখে রায়িন বেরিয়ে পরে। সেই যে বেরিয়েছে এখনো রায়িন ফিরেনি। রাত আনুমানিক সাড়ে এগারোটা। দুপুর থেকে নিথির পেটে কিছু পরেনি। নিথি বর্তমানে তার শ্বাশুড়ির দেয়া একটি শাড়ি পরে আছে। ছেঁড়া ব্লাউজে নিথি একদমই কমফর্ট ফিল করছিলো না। এর মাঝে অন্তরা রহমান একবার নিথিকে দেখতে এলেন। মেয়েটার জন্যে বড্ড মায়া হচ্ছে তার। রুমে এসে খাবারের জন্যে তাগিদ দিতেই নিথি মিইয়ে যাওয়া গলায় বলে,
–“স্যার আসবেন না?”

নিথির ব্যবহার এবং রায়িনের প্রতি চিন্তা অন্তরাকে সন্তুষ্ট করলো। তিনি নিথিকে মিথ্যা আশা দিয়ে বলেন,
–“তুমি খেতে আসো। ও বেশি দেরী করবে না। যদি তোমার আসতে সমস্যা হয়, আমি খাবার পাঠিয়ে দিবো?”

নিথির প্রচন্ড অস্বস্তি হচ্ছে। তাই সে নিচ পর্যন্ত যাওয়ার দুঃসাহস করলো না। নিথি অপরাধীর সুরে বলে,
–“আসলে আন্টি, আমার খারাপ লাগছে। কষ্ট করে খাবার পাঠালে…”

নিথি জড়তায় বাকিটা বলতে পারলো না। গলায় কথা যেন দলা পাকিয়ে আসছিলো তার। অন্তরা রহমান বুঝলেন নিথির অস্বস্তি। তাই নিথিকে আর অস্বস্তিতে না ফেলে তিনি চলে গেলেন। নিথি পুণরায় রুমে চোখ বুলাতে লাগলো। বিয়েটা অপ্রত্যাশিত হলেও রায়িন তার। ভাবতেই এক অদ্ভুত প্রশান্তি কাজ করছে তার মনগহ্বরে।

————————
রায়িন এক ধ্যানে তার বন্ধুদের ড্রিংক করা দেখছে। সব শুনে ওরা তিনজনই ভিষণ রকম স্তম্ভিত! কীভাবে তিল জিনিসটা তাল হয়ে গেলো। শেষমেশ রায়িন এমন বাজেভাবে ফাঁসলো? সমবেদনা জানানোর কোনোরূপ ভাষা পেলো না। বলাবাহুল্য, কোনো অনুভূতি-ই কাজ করছে না তাদের মাঝে। ওরা বর্তমানে একটি বারে অবস্থান করছে। হঠাৎ রায়িন ওদের অবাক করে দিয়ে রাব্বির হাত থেকে ড্রিংকের ছোট গ্লাসটা কেড়ে নিয়ে ঢকঢক করে পুরোটা গিলে নিলো। এতে রাব্বিসহ বাকি দু’জনের বিষ্ময় ছুঁয়েছে সপ্তম আসমানে। রায়িন একের পর এক গ্লাসের বিয়ার শেষ করলো। একসময় রায়িনের চোখ জোড়া রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো। রাব্বি একপ্রকার জোর করে রায়িনের হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে নিলো। চোখ বড়ো বড়ো করে বলে,
–“পাগল নাকি তুই? প্রথমবারে এত কেউ খায়? এভাবে ভেঙ্গে পরছিস কেন? দোষ ওদের, কই শাস্তি দিবি তা না করে উল্টো দেবিদাস সাজছিস? দেখ, যা হয়েছে তা হয়েছেই। তোর ভাগ্যে মেয়েটা ছিলো বিধায় তুই বিয়েটা খন্ডাতে পারিসনি। হোক বিয়েটা অপ্রত্যাশিত তাতে কী? এভাবে তুই ভেঙ্গে পরলে বাকিটা সামলাবে কে? মেয়েটার সাথে জুলুম করা আসল শ/ য়তানের মুখোশ টেনে ছিঁড় আগে। এভাবে বসে থাকলে কিছুই হবে না!”

অদ্ভুতভাবে রায়িনের মাথায় নেশা চাড়া দিয়ে উঠেছে। তাই রাব্বির কথাগুলো নিরবে শুনলেও উপলব্ধি করতে পারলো না। চোখে সব ঝাপসা দেখছে। হিতাহিত জ্ঞানশূণ্য হয়ে পরছে যেন। রায়িন এলোমেলো স্বরে বলে ওঠে,
–“আমি ঘুমাবো। আমায় তোদের বাসায় নিয়ে যা। আমি তোদের তিনজনের বাসাতেই ঘন্টা ধরে ঘুমাবো।”
–“কিন্তু ভাই, আজ তোর বাসর রাত!”
–“কিসের বাসর? বাসর মাই ফুট!”

——-
ভোর পর্যন্ত নিথি অপেক্ষা করলো রায়িনের। কিন্তু রায়িন ফিরেনি। ঘন্টাখানেক ধরে কেঁদে ভাসিয়েছে নিথি। একমাত্র তার জন্যে রায়িনের সুস্থ জীবনটা নষ্ট হয়ে গেলো। রায়িন কেন ফিরবে তার কাছে? অপরাধবোধ নিথিকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। কেন সাজানো গোছানো জীবনটা এমন এলোমেলো হলো? নিথি পারবে না, কখনোই পারবে না রায়িনের ঘাড়ে বোঝা হয়ে থাকতে। একসময় নিথি উঠে দাঁড়ায়। ওয়াশরুম থেকে হাত-মুখ ধুঁয়ে বেরিয়ে আসে। রায়িনের স্টাডি টেবিলের কাছে গিয়ে একটা নোট নেয়। সেখানে কিছু কথা লিখে যথাস্থানে রেখে নিথি বেরিয়ে গেলো অজানার উদ্দেশ্যে।

রায়িন ফিরে দুপুরের দিকে। বাড়িতে এসেই জানতে পারে নিথি নিখোঁজ। রায়িন একদমই স্বাভাবিক অবস্থায় ছিলো না। খুব বেশি ড্রিংক করায় তার মাথা ভার হয়ে আছে। চোখ জোড়াও ভিষণ জ্বালা করছে। মায়ের থেকে নিথির কথা শুনে নিথিকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে সিঁড়ি বেয়ে নিজের রুমে চলে গেলো। বিছানায় বসতে নিতেই সেখানে একটি চিরকুট খুঁজে পেলো। চিরকুট হাতে নিয়ে কয়েকবার চোখের পলক ফেলে পড়তে লাগলো।
–“দুঃখিত স্যার। আপনার জীবনটা এভাবে নষ্ট করার জন্যে৷ আমি জানি, আপনি কতটা সৎ এবং পবিত্র মানুষ। আমি পারিনি আপনার জীবনে থেকে আপনার সাজানো জীবন নষ্ট করতে। আমি আপনাকে ভালোবাসি স্যার। আজ থেকে নয়, অনেকদিন আগে থেকে। জানি শুনতে অদ্ভুত লাগছে কিন্তু এটা চরম সত্যি। তবে আমি আপনাকে জোর করবো না স্যার, তাইতো আপনার জীবন থেকে খুব দূরে চলে এসেছি। ডিভোর্স পেপার সময়মতো পেয়ে যাবেন। আমি আপনাকে কখনোই দুঃখে দেখতে চাই না। আপনার হাসিটা যে আমার ভিষণ প্রিয়।
ইতি,
আপনার জীবনের অন্ধকার।

~চলবে, ইনশাল্লাহ।
ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম।