কৃষ্ণডাহুক পর্ব-০১

0
454

#কৃষ্ণডাহুক – ০১
আয়ানা আরা (ছদ্মনাম)

মাতৃপিতৃহীন মীরা তখনই বুঝতে পেরে গিয়েছিলো যখন তার স্বামী তাকে বলল,’ মীরা! আমাদের এই এক বছরের সংসারেও মা তোমাকে মেনে নেয়নি, আমাদের এই সম্পর্কটাকে মেনে নেয়নি। প্রতিদিন তোমার নামে মার কাছে নালিশ শুনতে শুনতে আমি সত্যিই তিক্ত, অতিষ্ঠ! দয়া করে আমাকে ছেড়ে চলে যাও! আমি আর এই ভার নিতে পারছি না। হয় তুমি বাড়ি ছেড়ে যাও নয়তো আমায় মেরে ফেলো! ‘

স্বামীর অসহায় মুখ পানে চেয়ে মীরা স্তব্ধ হয়ে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিলো। কথার সারমর্ম বুঝতে বেগ পেতে হলো তার। বিমূঢ় দৃষ্টিপাত স্বামী ইয়ামিনের দিকে ফেলে,মন্থর গলায় বলল,’ আমাকে ডিভোর্স দিতে চাচ্ছো? ‘

ইয়ামিন ইতস্ততবোধ করলো খানিকটা, প্রতুত্তরে বলল,’ যা ভাবছো তাই। ‘

মীরা অবাকের শীর্ষে! যে ছেলেটা তাকে ছাড়া কিছুই বুঝতো না আজ সে ছেলেই কিনা তার কাছে মুক্তি চাইছে? মীরার শরীরে কম্পন অনুভব করলো, নিজেকে স্থির রেখে অস্ফুটসুরে বলল,’ আমি মুক্তি দিলে কি তুমি আর মা শান্তি পাবে? ‘

‘ হ্যাঁ, পাবো। ‘ ইয়ামিনের সোজাসাপ্টা উত্তর! অন্তঃস্থলে আঘাত অনুভব করলো মীরা। ফোঁস করে নিশ্বাস ছেড়ে বলল,’ তুমি তো আমাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলে ইয়ামিন! তবে এখন কেনো পথ বদলাচ্ছো? ‘

ইয়ামিন নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল,’ আবেগের বশে তোমায় নিজের ভালোবাসা ভেবে বিয়ে করেছিলাম! কিন্তু এখন সেই ভালোবাসাই আমার জীবনের কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে! তোমাকে ডিভোর্স দেওয়া ছাড়া কোনো উপায়ন্তর নেই আমার। ‘

আকস্মিক ভাবে মীরা হেসে উঠলো! ইয়ামিন চমকে গেলো মূহুর্তেই। থমথমে মুখে মীরার মনোভাব বুঝার চেষ্টা করলো, কিন্তু ব্যর্থ হলো সে। মীরা শুকনো হাসি অধরে ঝুলিয়ে বলে,’ কি চাচ্ছো আজকে চলে যাবো? ‘

ইয়ামিনের থমথমে মুখশ্রী! একটু থমকে বলে উঠলো,’ ঢাকার টিকিট আছে আমার কাছে। আজকের বাস। দুই ঘন্টা পর ছাড়বে। তুমি চাইলে যেতে পারো! ‘

মীরা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছুড়ে বলল,’ এখন বুঝি আমাকে চট্টগ্রাম থেকেও তাড়ানোর পরিকল্পনা করছো? ‘

ইয়ামিন অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালো। মীরা তা দেখে ম্লান হেসে বলে,’ চিন্তা করো না, তোমার দিত্বীয় বিয়েতে কোনো বাঁধা দিবো না আমি। আজই চলে যাবো এই শহর ছেড়ে! যে শহরে পাড়ি দিয়েছিলাম তোমার হাতে হাত রেখে! ‘

ইয়ামিন চমকালো এই ভেবে যে তার দিত্বীয় বিয়ের কথা মীরা জানলো কি করে?তবে বিনা বাক্য ব্যয় করে মীরার হস্তে একটি বাসের টিকিট ধরিয়ে আর একটা মোটা খাম ধরিয়ে বলে,’ এখনো আমাদের ডিভোর্স হয়নি! তবে তুমি যাওয়ার পূর্বে তাও হয়ে যাবে। ‘

মীরা আড়চোখে খামের দিকে তাকিয়ে বলে,’ এইগুলো কি? ‘

ইয়ামিন গম্ভির স্বরে বলে,’ টাকা। ‘

মীরা কড়া কথা শোনানোর জন্য যেই প্রস্তুতি নিবে তার পূর্বেই ইয়ামিন বলে উঠে,’ বিয়ের দেনমোহরের টাকা! এইগুলো তোমার প্রাপ্য ছিলো। ‘

বলেই ইয়ামিন গটগট পায়ে চলে গেলো। মীরা তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য হাসলো!

নিয়তির কি অদ্ভুত খেলা! যার সাথেই এই শহরে পাড়ি জমানো তাকে মুক্তি দিয়েই এই শহর ছেড়ে চলে যাওয়া। ভাগ্য বড়ই বিচিত্র! কারো ভাগ্য থাকে রঙিন আবার কারো বেরঙ! মীরার মনে হচ্ছে তার ভাগ্য ঠিক তার জীবনের মতোই বেরঙিন! নেই কোনো পিতৃ ছায়া নেই কোনো মাতৃ মমতা! এতিম এই মেয়েকে প্রথম ছুঁয়েছিলো ইয়ামিন নামক ছেলে! ইয়ামিনের বক্ষঃস্থলে গুটি সুটি মেরে শুলে পৃথিবীর সবথেকে সুখী নারী মনে করতো নিজেকে! ইয়ামিনের বক্ষঃস্থল তার শান্তির জায়গা! তবে জানতো না যে ভাগ্য সবসময় কারো সহায় হয় না। আজ দিত্বীয়বারের মতো মীরার সুখ কেড়ে নিলো ভাগ্য।

ডিভোর্স পেপারে সাইন করে মীরা লাগেজ শক্ত করে হাতে তুলে নিলো। বাহিরে এসে কোলাহলপূর্ণ পরিবেশ দেখে কিঞ্চিৎ হাসলো! বিয়ের আমেজ মূহুর্তেই এসে পরেছে বাড়িতে। বড় ছেলের দিত্বীয় বিয়ে বলে কথা! মীরার দৃষ্টি গেলো হলুদ পাঞ্জাবী পরিহিত ইয়ামিনের দিকে। তার আর ইয়ামিনের বিয়েটা ভীষণ সাদামাটা ভাবে হয়েছিলো, ছিলো না কোনো জাঁকজঁমক লাইটিং, ছিলো না কোনো বিয়ের পোশাক, আর না ছিলো মুখে কোনো সাজ। শুধুমাত্র তিনবার কবুল বলে শুরু করেছিলো তাদের এই সংসারের যাত্রা! কিন্তু কে জানতো এক বছর যেতেই যে এই সংসারে ফাটল ধরবে?

মীরা নিজের অন্তঃস্থলের কষ্ট ব্যক্ত করতে চাইলো না। যে এই কষ্টের মূল্য দিতে জানে না তার কাছে তো না-ই! মীরা গম্ভির মুখে ইয়ামিনের সম্মুখে দাঁড়ালো। তাতে ইয়ামিন সহ বাকিরা বেশ চমকালো। ইয়ামিনের খালাতো ভাই রেদওয়ান হেসে বলে,’ এ্যাই ভাবী? ব্যাগ পত্র নিয়ে কই যাচ্ছেন? জামাইয়ের বিয়ে খেয়ে যাবেন না? কাল তো যেতে পারতেন। ‘

মীরা বুঝতে পারলো তাকে টিটকারি করে কথাটা বলা হয়েছে। রেদওয়ানের কথার প্রতত্তুর না করে ইয়ামিনের দিকে কাগজ এগিয়ে দিয়ে বলল,’ আমি সাইন করে দিয়েছি! এইবার আপনিও করুন। ‘

বলেই সেইখানে এক মূহুর্ত না থেকে বেরিয়ে গেলো। ইয়ামিনের বিষ্ময়ে চোয়াল হা হয়ে গিয়েছে। ভাবতেও পারেনি এতো সহজে মীরা তাকে ডিভোর্স দিয়ে দিবে! কারণ মীরা তো তাকে নিজের প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসতো। ইয়ামিন মাথা ঘামালো না। রেদওয়ান তেজপূর্ণ স্বরে ইয়ামিনকে বলল,’ এই বেয়াদব মেয়ে নিজেকে কি ভাবে হ্যাঁ? জারজ একটা! ‘

ইয়ামিন বুঝতে পারলো রেদওয়ান এই কথাটা কোন প্রেক্ষাপটে বলেছে তাই প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বলল,’ বাদ দে! আপদ বিদেয় তো হয়েছে। ‘

____

যে বাড়িটিকে আপন ভেবেছিলো আজ সেই বাড়িটি থেকে নির্দ্বিধায় বেরিয়ে এলো মীরা। দারোয়ান মীরাকে ব্যাগপত্র নিয়ে বেরিয়ে যেতে দেখে অবাক হলেন! তার জানামতে মীরার পরিবার নেই তবে মীরা যাচ্ছে কোথায়? তিনি এগিয়ে প্রশ্ন করলেন,’ মীরা মা? কোথায় যাচ্ছো তুমি? ‘

মীরা হাসলো! মলিন হাসি! নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে শুধালো,’ আজকেই শেষ আপনার সাথে আর দেখা হবে না চাচা! ভালো থাকবেন। ‘

মীরার প্রতিটা কথা মাথার উপর দিক দিয়ে গেলো দারোয়ানের তা দেখে মীরা কিছু বলল না। চুপ চাপ বেরিয়ে গেলো।

অজানা গন্তব্য! গন্তব্যহীন জায়গায় পাড়ি দিচ্ছে মীরা। বাসে উঠে নিজের সিটে বসে বাস ছাড়ার প্রহর গুনছে। প্রহর শেষে বাস ছাড়তেই ভাবলো ঢাকায় যেয়ে সে করবে কি? কি করে খাবে?তার নতুন জীবনের আরেকটি অধ্যায় শুরু হবে সেখানে? মীরার মনে একাধিক প্রশ্ন! মস্তিষ্ক যেনো একটারও উত্তর দিতে পারছে না! মীরার মনে কিঞ্চিৎ ভয় হানা দেয়! কি হবে তার?ব্যাগ থেকে দেনমোহরের সেই খামটা বের করলো। আন্দাজ করে বুঝলো এইখানে প্রায় পঞ্চাশ হাজারের মতো আছে। ঢাকায় যেয়েই টুকটাকি শুকনো খাবার কিনে নিবে। তারপর লেগে পড়বে একটা ফ্ল্যাটের খোঁজে! নয়তো কোনো জনবহুল জায়গায় রাত কাটয়ে দিবে। একটা মেয়ের জন্য তা কতটুক কষ্ট যার সাথে সেই বুঝে। মীরা টাকার খামটা ব্যাগে পুড়ে জানালার বাহিরে তাকালো।

এক দমকা হাওয়া তার মুখমন্ডলে পড়তেই খোলা চুলগুলো সরে গেলো। গোছানো এক সাইডে রাখা চুলগুলো মূহুর্তেই অবিন্যস্ত হয়ে গেলো। মীরার চুল মুঠো করে বাঁধতে ইচ্ছা হলো না। ইয়ামিনের সাথে থাকা কালীন কখনোই বাহিরে খোলা চুলে বের হয়নি! ইয়ামিনের কড়া নিষেধাজ্ঞা ছিলো। কিন্তু আজ যেনো সে স্বাধীন পাখি! মীরা পরপর দুটো শ্বাস নিলো। কতদিন পর শান্তিতে নিশ্বাস নিতে পেরেছে সে জানে না। বাহিরের খোলা আকাশ দেখতে দেখতে মীরা তন্দ্রাঘোরে চলে গেলো!ঘুমন্ত মীরা টেরও পেলো না সামনে কি হতে চলেছে! তার জন্য কি অপেক্ষা করছে।

___

চোখদুটো খুলতেই মীরা নিজেকে সাদা চাদরের বিছানায় আবিষ্কার করলো। নিভু নিভু চোখে চারদিক বুলিয়ে সে বুঝতে পারলো সে এখন হাসপাতালে উপস্থিত। হাতে ভর দিয়ে উঠে বসতে নিলে কয়েকজন অচেনা মুখমন্ডল তার সামনে হন্তদন্ত করে উপস্থিত হয়। তাদের মধ্যকার এক মেয়ে এগিয়ে এসে চিন্তিত গলায় বলে,’ তুমি ঠিক আছো? কষ্ট হচ্ছে না তোমার? ‘

মীরার চমকপ্রদক চেহেরা! নিম্ন স্বরে বলে,’ আমি কোথায়? ‘

মেয়েটা প্রশ্ন শুনে মৃদু স্বরে বলে,’ তুমি যে বাসে ছিলে সে বাসের এক্সিডেন্ট হয়েছিলো। গুরুতর এক্সিডেন্ট হওয়ায় পুলিশ যায় ওখানে। তোমার সাথে যারা আহত ও নিহত হয়েছে তাদের পরিবারের খোঁজ পাওয়া গেলেও তোমার পরিবারের খোঁজ যায়নি। ওই মূহুর্তে আমরাও উপস্থিত ছিলাম সেখানে তাই আমরা আমাদের সাথে করে তোমাকে নিয়ে এসে চিকিৎসা করাচ্ছি। ‘

মীরা স্তব্ধ, হতবাক, নির্বাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো মেয়েটার দিকে। তার সাথে এতো কিছু হয়েছে আর সে টেরও পায়নি?

চলবে?