কৃষ্ণডাহুক পর্ব-০২

0
316

#কৃষ্ণডাহুক – ০২
আয়ানা আরা (ছদ্মনাম)

আত্মসম্মান একটা মানুষের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ অর্থবহন করে! মানুষ নিজের ভালোবাসাকেও বিসর্জন দেয় আত্মসম্মানের কাছে হেরে। মীরা নিজের আত্মসম্মান রক্ষার্থে, এক বছরের সংসার, স্বামী ফেলে পাড়ি জমিয়েছে এক অজানা শহরে! নতুন গন্তব্যে! সূদুর ঢাকায়! আগামীতে কি হবে তার সাথে জানা নেই মীরার! সে এই নতুন শহরে কতদিনই বা টিকতে পারবে সেও জানে না মীরা! নিজেকে হাসপাতালের বিছানায় আবিষ্কার করার পর তার মস্তিষ্ক যেনো শূণ্য হয়ে গিয়েছে! পাথরের ন্যায় শক্ত হয়ে গিয়েছে। এই দূর্বল শরীর নিয়ে সে উঠবে কি করে? নিজের জন্য আশ্রয়স্থল খুঁজবে কি করে? তার টাকাগুলোও তার কাছে নেই! নিজেকে এই মূহুর্তে সবচেয়ে অসহায়, নির্জীব এক প্রাণী লাগছে মীরার।

‘ এ্যাই মেয়ে? ঠিক আছো তুমি? ‘

কারো বিচলিত প্রশ্ন! মীরা হতবুদ্ধি হয়ে নজর দেয় তারউপর! মেয়েটির অস্থির দুটি চোখখানা দেখে মীরার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পরে। মেয়েটা হতবাকের ন্যায় চেয়ে বলে,’ কাঁদছো কেনো তুমি? ‘

মীরাকে প্রশ্ন করেও জবাব পেলো না মেয়েটি! হতাশ দৃষ্টি ফেলে বলে,’ এই মূহুর্তে তোমার উপর দিয়ে কি যাচ্ছে তা একটু হলেও আঁচ করতে পারছি। আচ্ছা, তুমি কি এই শহরে নতুন? ‘

মীরা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে জবাব দেয়,’ হু। ‘

মেয়েটি আহত পূর্ণ দৃষ্টি ফেলে মীরার পানে। মীরা স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। মেয়েটি সুক্ষ্ণ কষ্ট অনুভব করলো মীরার জন্য।

‘ এই শহরে তোমার কেউ আছে? ‘

‘ ন না। ‘ মীরা সোজাসাপ্টা উত্তর দিয়ে ক্ষ্যান্ত হলো। মেয়েটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,’ তোমার নামটা কি বলতে পারবে? ‘

‘ মীরা! ‘ নির্বিকার উত্তর।

‘ তোমার কি যাওয়ার জায়গা নেই? ‘

মীরা অন্য মনস্ক থেকে মুখ ফসকে বলে উঠলো,’ নাহ। ‘ মেয়েটি খানিক অবাক হলো মীরার জবাবে! এতো বড় শহরে এই তরুণী এক থাকবে? তার জন্য কত টুকুই বা নিরাপদ? মেয়েটি নিজের চিন্তা ব্যক্ত না করে মন্থর গলায় বলল,’ আমি যদি তোমাকে সাহায্য করি তাহলে কি চলবে? ‘

মীরা শুনে লজ্জিতবোধ করলো। বুঝতে পারলো মুখ ফসকে কথাটা বলে ভুল করেছে। সে কারো দয়ার পাত্রী হতে চায় না! যেখানে সে নিজের আত্মসম্মান রক্ষার্থে স্বামী বাড়ি ছেড়েছে সেখানে সে কোনোদিনও আত্মসম্মানের পরোয়া না করে অন্যের সাহায্য নিয়ে ঢ্যাং ঢ্যাং করতে পারবে না। মীরা অস্ফুট সুরে উত্তর দিলো,’ আমি আপনার সাহায্য নিতে পারবো না৷ আপনি এমনিতেই আমার চিকিৎসা করিয়ে আমাকে ঋণী করে দিয়েছেন। ‘

মেয়েটি চমৎকার হাসলো, উত্তরে বলল,’ হুহ? তোমাকে না আমার বেশ লেগেছে। আমার কোনো ছোট বোন নেই জানো? তাই আমি চাচ্ছি তোমাকে আমার বাড়িতে ছোট বোন করে নিয়ে যেতে! যাবে কি? ‘

মীরা চমকালো! চকিত নয়নে তাকালো মেয়েটির দিকে। শ্যামলা গড়নের মায়াবী মুখটি ফুটে উঠেছে! কি অপরূপ সৌন্দর্যে আচ্ছাদিত মেয়েটি।

‘ না আপু, আমার পক্ষে সম্ভব না আপনাদের বাড়িতে আশ্রিতার মতো পরে থাকা। ‘

‘ আপু বলে যেহেতু ডেকেছো সেহেতু আপুর দায়িত্ব পালন করতে কেনো আমাকে পিছিয়ে দিচ্ছো মীরা? ‘

আদ্রিকার অভিমানী স্বর! মীরা অবাক হলো, মেয়েটা এতো দ্রুত কি করে তাকে আপন করে নিতে পারলো? মীরা নতজানু হয়ে বলল,’ আমি শুধু শুধু আপনাদের বোঝা হয়ে থাকতে পারবো না আপু। সমস্যাটা একান্তই আমার, আমি কাউকে জড়াতে চাই না। ‘

আদ্রিকা ভ্রুকুঁচকে তাকালো, তেজপূর্ণ স্বরে বলল,’ বোঝা হয়ে থাকতে কে বলেছে তোমায়? এ্যাই শোনো মেয়ে, তোমার এই শহরে কেউ নেই। এতো বড় শহরে এক তরুণীর একা থাকা মানে কি জানো? তোমার মাথার উপর কোনো ছায়া নেই! কোনো ক্ষতি হলে? নিজের জীবন নিয়ে কি ভয়ডর নেই নাকি? ‘

‘ আছে! তবে আমি কারো বাড়িতে আশ্রিতা হয়ে থাকতে চাই না। ‘

‘ ওকে ফাইন! তুমি আমাদের বাড়িতে ভাড়া দিয়ে থেকো! তবুও আমার সাথে আমার বাড়ি আসো। এই মূহুর্তে তুমি একা একটা মেয়ে, এতো বড় শহরে থাকতে পারবে না। জীবন অতো সহজ না যতটা তুমি ভাবছো! মানুষ তোমার জীবনে আসবে, তোমাকে বুঝাবে তুমি তাদের জীবনে সবচেয়ে মূল্যবান কেউ তারপর একটা সময় তোমাকে ছন্নছাড়া করে দিয়ে যাবে। ‘

আদ্রিকার কথা গভীর চিন্তায় ফেলে দিলো মীরাকে। কিয়ৎক্ষনের জন্য মীরার কাছেও মনে হচ্ছে আদ্রিকার সাথে তার বাড়ি যাওয়াই শ্রেয়। সে তো আর ওইখানে ফ্রি থাকবে না! ভাড়া দিয়েই থাকবে, ছোট খাটো একটা জব খুঁজবে সে।

‘ আমি যাবো। তবে ওখানে থাকলে আমি আমার বাসার ভাড়া দিবো, মানা করবেন না দয়া করে। ‘

আদ্রিকা হাসলো, মীরাকে বলল,’ আচ্ছা, আমি তোমাকে অন্য জামা দিয়ে যাচ্ছি। হাসপাতালের এই জামাটা খুলে ওটা পরে নাও। ‘

বলেই বেরিয়ে গেলো আদ্রিকা। এতক্ষন চুপ করে থাকা বাকি সদস্যর’ আদ্রিকার পিছে পিছে বের হলো। তাদের যেতেই মীরা নিজের চিন্তায় ডুব দিলো! নতুন এক বাড়ি যাচ্ছে, সেখানে কি করে মানিয়ে নিবে নিজেকে? ওখানের মানুষরা কেমন হবে? কেউ যদি তাকে পছন্দ না করে? তবে সে যাবে কোথায়? শুধুমাত্র নিজের নিরাপত্তার জন্য সে আদ্রিকার সাথে যেতে রাজী হয়েছে নয়তো সে কক্ষনোই যেতো না!

‘ অচেনা একটা মেয়েকে নিজের বাসায় থাকতে বলা কি উচিত হয়েছে তোর আদ্রিকা? ‘

আদ্রিকা প্রশ্ন শুনে ভ্রুকুঁচকে তাকালো, হাতে জামা তুলতে তুলতে বলল,’ হ্যাঁ হয়েছে কেনো? ‘

‘ মেয়েটা তোর পূর্ব পরিচিতও না! তবে কেনো এতো দরদ দেখাচ্ছিস রাস্তার মেয়েকে? বহুরূপীও তো হতে পারে। ‘

বান্ধুবির কথায় নাক মুখ কুঁচকে গেলো আদ্রিকার। ‘চ’ বর্গীয় উচ্চারণ করে বলে,’ মেয়েটা আমার চেনা জানা না হলেও ওর কথা শুনে যা বুঝলাম ও অনেক অসহায়! ওর যাওয়ার কোনো জায়গা নেই! আমি ওকে বাসা দিয়ে যদি সাহায্য করে পূন্য কামাতেই পারি তবে সাহায্য করতে সমস্যা কোথায়? এমনিতেও আমাদের বাড়ির ভাড়াটিয়ারা গত মাসে বাসা ছেড়ে দিয়েছে। একটা ফ্ল্যাট একমাস ধরে পরে আছে! ‘

কথাগুলো বলেই আদ্রিকা সবাইকে ঠেলে কেবিনের ভিতরে প্রবেশ করলো। সবাই চোয়াল হা করে তাকিয়ে আছে আদ্রিকার পানে। আদ্রিকার এ রূপ যেনো কারোরই হজম হচ্ছে না! মানুষের প্রতি এতো দরদ আদ্রিকার কোনো কালেই ছিলো না! আচমকা আশ্রয়হীন মীরাকে দেখে তার কি হলো কে জানে?

আদ্রিকা কেবিনে প্রবেশ করে মীরাকে তাড়া দেখিয়ে বলল,’ মীরা দ্রুত, ফ্রেশ হও, এই জামা ধরো। আজ বাড়িতে আমার বড় ভাই আসবে! যদি বাড়ি দ্রুত না যেতে পারি তবে আমার কপালে শনি আছে। ‘ বলেই হাসতে লাগলো আদ্রিকা। মীরা জোরপূর্বক হেসে জামা হাতে নিয়ে ফ্রেশ হতে গেলো।

____

গাড়ি ট্রেনের গতিতে এসে থামলো বিলাসবহুল এক বাড়ির সামনে। বাড়ির ঠিক সামনের দরজায় নেমপ্লেটে আঁকাবাঁকা ভাবে লিখা,’ হুমায়ূন মঞ্জিল ‘ জ্বলজ্বল করছে। মীরা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সে দিকে। বারবার তার বুক চিঁড়ে বেরিয়ে আসছে দীর্ঘশ্বাস! তার নতুন জীবনের সূচনা বোধহয় এখান থেকেই শুরু! এই বাড়ি থেকেই শুরু হবে তার জীবনের সংগ্রাম! এই বাড়ির মানুষরা কি তাকে আদৌ মেনে নিবে? তাদের কাছে তো সে নিতান্তই এক রাস্তার মেয়ে! আদ্রিকার বেশভূষা দেখে সে যতটা বুঝলো আদ্রিকা বেশ বড়লোক পরিবারের মেয়ে। আদ্রিকার স্ট্যাটাসের সাথে তো তার যায় না! তবে কেনো আদ্রিকা তাকে এই বাড়িতে নিয়ে এলো? হুট করে কেউই এক অচেনা মেয়েকে বাড়ি নিয়ে আসে না! কিন্তু আদ্রিকা এসেছে। এর পিছনে কি কোনো রহস্য আছে নাকি সে মানবদরদী বলে তাকে সাহায্য করেছে? হতেও পারে আদ্রিকা মানবতার খাতিরে তাকে এখানে এনেছে!

‘ মীরা বের হও, এসে পরেছি আমরা। ‘

আদ্রিকা মীরাকে বের হতে বলে চলে গেলো ভিতরে। মীরা মন্থর পায়ে টলমল করে বেরিয়ে এলো গাড়ি থেকে। ভিতরে যেতে ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে তার। আদ্রিকা তাকে এইভাবে রেখে গেলো কেনো? তার তো মনে হয় না অস্বস্তিতে বাড়ির মাটিতেও পা পরবে!

চলবে?