কৃষ্ণডাহুক পর্ব-৪+৫

0
284

#কৃষ্ণডাহুক – ০৪
আয়ানা আরা (ছদ্মনাম)

হল রুমে পিনপিন নিরবতা! সকলের দৃষ্টি বিষ্ময়,কৌতুহলপূর্ণ। মীরার চোয়াল বিস্ময়ে হা হয়ে গিয়েছে। মীরার ধ্যানে এক ভরাট কণ্ঠস্বর কর্ণকুহরে পৌঁছালো মীরার।

‘ কি হয়েছে? তোমরা এইভাবে আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছো কেনো? এর আগে দেখো নি? ‘

আদ্রিকা নির্বিকার ভঙ্গিতে বলে,’ বড় আব্বু! তুমিও আদ্রিক ভাইয়ের সাথে দেশে এসেছো? ‘

আদ্রিকা যাকে বড় আব্বু বলে সম্বোধন করেছে তার দিকে তাকালো মীরা। পূর্ণ দৃষ্টি ফেললো তার উপর। বিষ্ময়ে তার চোয়াল হা হয়ে গিয়েছে। সাহিল হুমায়ূনের দৃষ্টি পরে সোফায় বসে থাকা মীরার দিকে।

‘ এটা কে? ‘ মীরার দিকে ইশারা করে বললেন সাহিল হুমায়ূন। আদ্রিকা স্পষ্টভাবে জবাব দিলো,’ আমার বান্ধুবি। ‘

সাহিল হুমায়ূন এগিয়ে আসতে আসতে বললেন,’ ওর সাথে কি করে পরিচয় হয়েছে তোমার? ‘

‘ অনলাইনে। ‘ সোজাসাপ্টা জবাব দিলো আদ্রিকা। এক দম নিয়ে ফের বলল,’ মীরা পুরো তোমার কার্বন কপি বড় আব্বু! আমরা সবাই দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম! এতোটা মিল থাকে কি করে দুজন অপরিচিত মানুষের মধ্যে? ‘

সাহিল আড়চোখে মীরার দিকে তাকিয়ে বললেন,’ পৃথিবীতে একই দেখতে সাতজন মানুষ আছে। তাই অবাক হওয়ার কিছু নেই, স্বাভাবিক। ‘

আদ্রিকা ঠোঁট এলিয়ে হেসে বলে,’ আচ্ছা বাদ দাও। তুমি হঠাৎ দেশে এলে কেনো? ‘

‘ প্রায় ঊনিশ বছর ধরে বাংলাদেশে আসি না। অনেকদিন ধরেই ভাবছিলাম আসবো কিন্তু কাজের চাপে আসা হয়নি৷ এখন শুনলাম আদ্রিক আসবে তাই ওর সাথে দেশে এসে পড়লাম। খুশি হওনি আমি আসায়? ‘

আদ্রিকা উৎফুল্ল হয়ে বলে,’ নাহ! তা কেনো হবে? তুমি আসায় আমি খুশি হয়েছি অনেক! ‘

ফের বলল,’ বড় আব্বু? কি এনেছো আমাদের জন্য? ‘

আদ্রিকার কথা শেষ হতেই সবাই হৈ হৈ করে লাফিয়ে উঠলো! অর্থাৎ তাদেরও একই প্রশ্ন।

তাদের চিৎকার শুনে আদ্রিক নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এলো, দাঁতে দাঁত চেপে আদ্রিকাকে বলল,’ কেন? আমি যা দিয়েছি তাতে তোদের হয়না?আরো লাগে? লোভী সবগুলো! ‘

আদ্রিকা তেজপূর্ণ দৃষ্টিতে আদ্রিকের দিকে তাকিয়ে রাগী সুরে বলে,’ তোমার কি? আমি বড় আব্বুকে বলেছি! কথার মাঝে ফোঁড়ন কাটার স্বভাবটা ঠিক করো। ‘

আদ্রিকার কথায় সকলে হেসে উঠলো। আদ্রিক প্রতুত্তর না করে নিজের ঘরে যেয়ে পুনরায় স্বশব্দে দরজা লাগিয়ে দিলো। আদ্রিকা তা অগ্রাহ্য করে সাহিলের দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকালো। সাহিল ঠোঁট এলিয়ে হেসে বলে,’ তোমাদের সবার জন্য অনেক কিছু এনেছি। কাল দিবো নে। এখন অনেক রাত হয়ে গিয়েছে। ‘

বলেই মীরার দিকে ইশারা করে বললেন,’ এ্যাই মেয়েটাকে দেখে টায়ার্ড মনে হচ্ছে। ওকে ওর রুম দেখিয়ে দিয়ে আসো। ‘

সাহিলের কথায় আদ্রিক বলল,’ ওহ হ্যাঁ! মীরা চলো তোমাকে তোমার ফ্ল্যাটে নিয়ে যাই। ‘

ততক্ষনাৎ মার্জিয়া বেগম সেখানে এসে অস্থির গলায় বলেন,’ ফ্ল্যাট মানে? কি বলছিস তুই আদ্রিকা? ‘

‘ মীরা তো ফ্ল্যাটে থাকবে! ‘

মীরা বুঝতে পারলো আদ্রিকা ইচ্ছে করে তাকে ফাঁসিয়েছে। মার্জিয়া বেগম অভিমানী চোখে তাকিয়ে কিছু বলার ক্ন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন তা দেখে মীরা অপ্রস্তুত হাসলো।

‘ মীরামা? আমাদের বাসায় একটা রুম থাকা সত্ত্বেও তুমি আলাদা থাকবা কেনো? ছি ছি! অতিথি আল্লাহর উপহার! অতিথিকে বেজার করা মানে আল্লাহকে বেজার! এক পা এমনিতেই আমার কবরে এখন অতিথিকে বেজার করে পাপ করতে চাই না আমি। ‘

কথায় আছে,’ মানুষ ফাঁসলে সবদিক থেকেই ফাঁসে। ‘ ঠিক মীরাও ফেঁসেছে তো ফেঁসেছে সব দিক থেকেই ফেঁসেছে। মানুষটা যেনো মূহুর্তেই তার মায়ের স্থান দখল করে নিয়েছে চাইলেও তার কথাকে অগ্রাহ্য করে মানা করতে পারছে না! যদি মন খারাপ করে এই ভেবে।

অনন্ত হুমায়ূন মার্জিয়া বেগমের কথায় সায় জানিয়ে বলেন,’ অতিথি মানুষ, আলাদা থাকবে কেনো? আমাদের সাথেই আমাদের পরিবারের সদস্যদের মতো থাকবে যতদিন এই বাড়িতে আছে। ‘

মীরা বিচলিত দৃষ্টিতে তাকালো আদ্রিকার দিকে। আদ্রিকা ঠোঁট প্রসারিত করে হেসে বলে,’ আমাকে বলে কি লাভ? আমি তো একশো বার একে বলেছিলাম আমার কথা তো শোনে নি! তোমরাই বলো কিছু। ‘

মার্জিয়া বেগম আর অনন্ত হুমায়ূনের জোরাজুরিতে শেষে মীরা রাজী হলো! সাহিল হুমায়ূনের দিকে নজর পড়তেই মীরা তার চোখের কোণে জল দেখতে পেলো। সাহিল হুমায়ূন তাকে খেয়াল করেই দ্রুত চোখে জল মুছে তড়িৎগতিতে পা চালিয়ে হল রুম প্রস্থান নিলেন! মীরা এর অর্থ বুঝলো না। মার্জিয়া বেগম আর আদ্রিকা মিলে তাকে গেস্টরুমে নিয়ে গেলো। এখন থেকে সে এখানেই থাকবে!

মানুষগুলোকে মীরা যতটা খারাপ ভেবেছিলো তারা মীরার কল্পনার চেয়েও বেশি ভালো! তাদের মন ভীষণ ভালো! সহজেই তারা মানুষের সঙ্গে মিশে যায়! আচ্ছা তার কপালে এতো সুখ সইবে তো? যেদিন তারা সত্য শুনবে সেদিন কি এতো ভালো ব্যবহার করতে পারবে! সে ডিভোর্সি জানার পর তাদের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে! মীরা ভাবতে পারলো না৷ আদ্রিকার থেকেও এই কথা লুকিয়েছে সে। আদ্রিকাকে সে সত্যিটা বলে দিবে! কাউকে সে ধোঁকা দিতে চায়না!

____

বাড়ির সামনের ল্যাম্পপোস্টের মৃদু আলোয় ছেলেটার চেহেরা ভেসে উঠলো মীরার চোখে। মীরা ভীতু দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,’ আপনি এখানে? ‘

ছেলেটা মীরাকে অগ্রাহ্য করে বলল,’ আমার বাড়ি আমার ছাদ, আমি থাকবো না তো কে থাকবে? ‘

মীরা অপ্রস্তুত হয়ে বলল,’ আমি ওইভাবে বুঝাতে চাইনি! আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন। ‘

‘ সমস্যা নেই! আপনি এতো রাতে এখানে? ‘

‘ ঘুম আসছিলো না তাই ছাদে এলাম। ‘

‘ ছাদে এসে চিৎকার করতে নিচ্ছিলেন কেনো? ‘

মীরা ইতস্ততবোধ করলো খানিকটা। শুকনো ঢোক গিলে বলল,’ আসলে আপনাকে এতো রাতে ছাদে দেখে ভয় পেয়েছিলাম! ‘

আদ্রিক শব্দহীন হাসলো! বলল,’ আমি সময়মতো আপনার মুখ না চেপে ধরলে আজ আপনি আমাকে ক্যারেক্টারলেস প্রমাণ করে দিতেন সকলের সামনে। যা একদমই শোভাজনক হতো না। ‘

মীরা অপরাধবোধ করলো, অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে নতজানু হয়ে বলল,’ দুঃখিত, আমি সত্যিই বুঝতে পারি নি! ‘

আদ্রিক বলল,’ তুমি আদ্রিকার সেই অনলাইন বান্ধুবি মীরা না? তুমি হয়তোবা আমার ছোটই যেহেতু আদ্রিকার বান্ধুবি! তাই তোমাকে আর আপনি করে ডাকলাম না।’

মীরা অপ্রস্তুত হাসলো। আদ্রিক আড়চোখে তা দেখলো! তারপর ঘুমু ঘুমু চোখে তাকিয়ে বলল,’ আমি তাহলে যাচ্ছি! ঘুম ধরেছে অনেক। ‘

বলেই যেতে নিলে আবার কি ভেবে পিছে ঘুরে মীরার দিকে তাকিয়ে বলে,’ ও হ্যাঁ! দাদুর কাছে শুনেছিলাম এই ছাদটা রাতে একটা মেয়ের জন্য নিরাপদ নয়। তাও আবার এমন আগুন সুন্দরী মেয়ের জন্য। আমাদের ফ্যামিলির কোনো মেয়েই এতো রাতে এই ছাদে আসে না। ‘

মীরা মনে কিঞ্চিৎ সাহস জুগিয়ে বলল,’ তো? ‘

আদ্রিক আবারো ঘুরে যেতে যেতে বলল,’ তো কিছুই না! আমি খালি তোমাকে সাবধান করছি! না মানে পরে কিছু হলে আমার দোষ দিতে পারবা না যে আমি তোমাকে এলার্ট করি নি। ‘

মীরা ভয়ে ভয়ে ঢোক গিললো। আদ্রিক ভাবনা ভাবান্তর ছাড়া হেলেদুলে যেতে লাগলো। আচমকা মীরা দৌড়ে যেয়ে আদ্রিকের হাত শক্ত করে ধরে বলল,’ ভয় লাগছে আমার! আমাকেও সাথে নিয়ে চলুন। ‘

আদ্রিক চমকালো! ভীষণ ভাবে চমকালো মীরার কর্মকান্ডে। পরক্ষণেই মুখ ঘুরিয়ে ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো আদ্রিক। মীরা আদ্রিকের হাত শক্ত করে ধরে ছাদ থেকে নেমে এলো। শব্দবিহীন পায়ে নিজের ঘরের সামনে গেলো। ঘরে যেয়ে নিজের কর্মকান্ডের জন্য নিজেকে মনে মনে কয়েকটা কড়া কথা শোনালো মীরা! লোকটার হাত ধরলো কেনো সে? ইশ! তাকে এখনো বাজে ভাবলে? মীরা চিন্তা হতে লাগলো! লোকটা কি বুঝতে সে কোন উদ্দেশ্যে হাত ধরেছিলো! মীরা মনে মনে ঠিক করলো কালকে সকাল হতেই সে আদ্রিকের ঘরে যেয়ে তাকে সরি বলে আসবে। সে চায় না আদ্রিক মনে তার জন্য কোনোরকম ভুল ধারণা পোষণ করুক।

চলবে?

#কৃষ্ণডাহুক – ০৫
আয়ানা আরা (ছদ্মনাম)

মীরা সকাল হতেই নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে নিচে গেলো। মানুষের বাসায় থাকছে তাদের সাহায্য না করলে কেমন দেখায়? সেই ভেবেই মীরা নিচে নেমেছে। টেবিলে বসে সকলে নাস্তা করছে। মীরা সবার দিকে চোখ বুলিয়ে এগুতে নিলেই চোখ যায় আদ্রিকের দিকে। শ্যামবর্ণের সুঠাম দেহের মোহনীয় পুরুষ এলোমেলো চুলে মথর হয়ে নাস্তা করছে যেনো এই সময় তার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো নাস্তা করা। মীরা এক পলক আদ্রিকের পানে চেয়ে মার্জিয়া বেগমের নিকট গেলো।

মার্জিয়া বেগম সবাইকে নাস্তা বেড়ে দিচ্ছিলেন, মীরাকে দেখে চমৎকার হেসে বলেন,’ সুপ্রভাত, মীরামা। নাস্তা করতে বসে পরো চেয়ারে। তোমার জন্যই আদ্রিকা খালি রেখেছে, ঘুমুচ্ছিলে বলে তোমায় আর জ্বালায় নি।’

মীরা উত্তরের পরিবর্তে শুকনো হাসি দিয়ে আদ্রিকার পাশে বসে।

নতুন পরিবেশে তাও আবার অচেনা সব মানুষের মাঝে বসে মীরার নাস্তা খেতে বেশ অস্বস্তি হচ্ছে! নাহ, ইয়ামিনের বাড়িতে তো এমন হয়নি! তবে কি তার পাশে আদ্রিক বসেছে তাই এতো অস্বস্তি হচ্ছে? মীরা আড়চোখে আদ্রিকের দিকে তাকালো। নাক মুখ কুঁচকে নাস্তা খেয়ে যাচ্ছে। মীরা এক দৃষ্টিতে সেই বিরক্তিকর চাহনির দিকে তাকিয়ে রইলো। আকস্মিক ভাবে আদ্রিক তাকালো তার দিকে। আদ্রিক বিষ্ময়পূর্ণ দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করলো মীরার দিকে। মীরা অপ্রস্তুত হয়ে বসলো, তড়িৎ নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে নাস্তা খেতে ব্যস্ত হয়ে পরলো। আদ্রিক তা দেখে হাসলো, চেয়ার টেনে মীরার নিকটবর্তী স্থানে এসে ঠোঁট বাকিয়ে হেসে বলল,’ মীরা ম্যাডাম দেখি আদ্রিক হুমায়ূন কে ঘুরঘুর করে দেখতে অনেক পছন্দ করে! তাই না মীরা ম্যাডাম? ‘

আদ্রিকের আকস্মিক কথায় মীরা স্তব্ধ হয়ে গেলো। ঘাড় কাত করে আদ্রিকের দিকে তাকালো, আদ্রিক নাস্তা খাচ্ছে! তবে কি তার ভ্রম ছিলো? নাহ! হতেই পারে না। মীরার গলায় খাবার আটকে গেলো যেনো, ভীতু দৃষ্টি ফেললো সবার উপর। সবাই চুপচাপ মাথা নত করে নাস্তা খাচ্ছে তাই এইখানে কারো ধ্যান নেই।

‘ আমাদের বাড়িতে খাওয়ার সময় কেউ কথা বলে না,সাহিল আব্বুর জন্য। তিনি খাওয়ার সময় কথা বলা বিশেষ একটা পছন্দ করেন না। ‘

মীরা বিস্ফোরিত নয়নে তাকালো আদ্রিকের দিকে। তারমানে ওই কথাটা তাকে আদ্রিকই বলেছে? আদ্রিক তাকে নিয়ে এইসব ভাবে? ছি ছি! মীরা নিজেকে মনে মনে জঘন্য ভাষায় কথা শুনালো, আদ্রিকের দিকে তাকিয়ে বোকা হেসে ফিসফিসিয়ে বলে,’ ওহ, তবে এইসব আমাকে বলছেন কেনো? ‘

‘ এমনি, মীরা ম্যাডাম। ‘

মীরা শুকনো ঢোক গিললো। মীরার মন চাচ্ছে খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে তবে ভদ্রতার জন্য পারছেও না অভদ্রের মতো এই কাজ করতে। নতজানু হয়ে চুপচাপ নাস্তা খেতে লাগলো। আদ্রিক তা দেখে আনমনে হাসলো।

____

‘ এই অপরিচিত মাইয়াডারে এই বাইতে রাখা ঠিক হইবো না। ‘

ঝাঁঝমিশ্রিত স্বরে চিল্লিয়ে বলে উঠেন মর্তুজা বেগম। তার নিকটবর্তী সকলে নতজানু হয়ে তার কথা শুনছে। অনন্ত হুমায়ূন সবাইকে এভাবে দমে যেতে দেখে এগিয়ে এসে বলেন,’ আম্মা, মেয়েটা অসহায়। মেয়েটার পরিবার নেই, ঢাকায় একদম একা এমতাবস্থায় যদি আমরা মানুষ হয়ে সাহায্য না করি তবে সৃষ্টিকর্তা আমাদের উপর অসন্তুষ্ট হবেন! আপনি সৃষ্টিকর্তাকে অসন্তুষ্ট করবেন? ‘

দমে গেলেন মর্তুজা বেগম। নাক টেনে বলেন,’ টিভিতে দেখস না? এমনে অপরিচিত মাইয়াগুলা বাহানা দিয়া বাড়িতে ঢুকে পরে সব লুটপাট কইরা নিয়া যায়গা। ‘

‘ মেয়েটার মন অনেক পবিত্র আম্মা। আমি কাল কথা শুনেই বুঝেছি। ‘

মর্তুজা বেগম ফুঁসে উঠলেন, পান চিবুতে চিবুতে বললেন,’ দুনিয়ার কতটুক বুঝস তুই? কালকে জন্মাইলি মাত্র আর শিখাইতে আইসোস আমারে! আমি তোরে পেটে ধরসি নাকি তুই আমারে পেটে ধরসোস? ‘

অনন্ত হুমায়ূন দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তিনি জানেন এখন তার মাকে যদি কিছু বুঝাতে যান তবে লাভের লাভ কিছুই হবে না উলটো তিনি রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে আহাজারী শুরু করবেন। সেদিনেরই কথা জমি নিয়ে ঝামেলা লাগায় তিনি নিজের ভুল সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিচ্ছিলেন সকলের উপর তারা না শুনলে তিনি পাড়া প্রতিবেশি ডেকে ছেলে, ছেলের বউদের নিয়ে আহাজারী শুরু করে দিয়েছিলেন! প্রতিবেশিদের খুব কষ্টে বুঝিয়ে শুনিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দিয়ে ছিলেন তারা। ওই ঘটনার পর থেকে তার কথার বিরুদ্ধে কেউ যায়নি।

পরিস্থিতি মূহুর্তে মূহুর্তে খারাপ হতে দেখে চুপ করে থাকা সাহিল হুমায়ূন মুখ খুলেন, সোফা থেকে উঠে মন্থর গলায় বলেন,’ মা, এইরকম ব্যবহার করছেন কেনো? মেয়েটাকে দেখে ভালোই মনে হয়েছে। থাকলে তো আর সমস্যা নেই। ‘

মর্তুজা বেগম আঁচলে মুখ ঢেকে ফ্যাচফ্যাচ শব্দ করে কাঁদতে কাঁদতে বললেন,’ তুই কি বুঝবি? বিয়া শাদি না কইরা ঊনিশ বছর আগে বিদেশ গেসিলি গতকাল ফিরলি এই ঊনিশ বছরে কি তোর এই মার কথা একবার মনে পড়সে? ‘

সাহিল হুমায়ূন থতমত খেলেন, অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বললেন,’ এইখানে আমার বিয়ের কথা কেনো এলো মা? আপনি কি আমার এই বয়সে এসে আমাকে বিয়ে দিতে চাচ্ছেন? ‘

সাহিল হুমায়ূনের সন্দিহান কথায় মর্তুজা বেগম আরো উচ্চশব্দে কাঁদতে লাগলেন। উপস্থিত সকলে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো মর্তুজা বেগমের দিকে। ততক্ষনাৎ সেখানে উপস্থিত হলো আদ্রিক তার পাশেই আদ্রিকা।

আদ্রিক তড়িঘড়ি করে এগিয়ে এসে বিচলিত কণ্ঠে বলল,’ দাদু, কি হয়েছে তোমার কাঁদছো কেনো? ‘

মর্তুজা বেগম কান্নার স্বর উচ্চ করে বললেন,’ তোর সাহিল আব্বুরে এতো কষ্ট কইরা পড়ালেখা করাইলাম,সবার থেকে বেশি ওরে আদর দিলাম আর ও বেইমানি করলো। ‘

‘ কি বেইমানি? ‘

‘ এইতো বিয়া না কইরা বিদেশ চলে গেলো, আমার কষ্ট হয় না বুঝি? প্রতিদিন হাহাকারে বুকটা ফেটে যায়! সাহিল এতোদিনে বিয়ে করলে আমার একটা নাতনী থাকতো। ও তোদের সাথে থাকতো। ‘

আদ্রিক ইতস্ততবোধ করলো নিজের দাদির কথায়। সকলে অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে মর্তুজা বেগমের দিকে! তিনি চাচ্ছেনটা কি?

আদ্রিক নড়েচড়ে বলে উঠে,’ তুমি কি সাহিল আব্বুর বিয়ে দিতে চাচ্ছো? তাও আবার উনার এই বয়সে আসার পর? ‘

মর্তুজা বেগম মূহুর্তেই তেঁতে উঠলেন, রাগমিশ্রিত কণ্ঠে বলে উঠেন,’ আমার সাহিল কি দেখতে কোনো অংশে কম নাকি? তোর লগে দাঁড়াইলে তোরে ওর থেকে বুড়া মনে হবে। ‘

আদ্রিক এক ভ্রুকুঁচকে তাকালো মর্তুজা বেগমের দিকে। পরক্ষণেই গগণ ফাটানো হাসি দিয়ে বলে,’ ভালো তো! তোমার এই পঞ্চাশ বছরী ছেলের জন্য কি কচি বউ আনবা? না মানে যদি আনো তাহলে তাকে আগে থেকেই আম্মু বলার প্রস্তুতি নিবো। ‘

‘ আদ্রিক! এইখানে কোনো সিনেমা চলছে না। ‘ গম্ভির কণ্ঠে বলে উঠেন আদ্রিকের বাবা আদিল হুমায়ূন। মার্জিয়া বেগম আড়চোখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে তার হাবভাব বুঝার চেষ্টা করলেন, তবে ব্যর্থ হলেন।

আদ্রিক আদিল হুমায়ূনের নিকটবর্তী এসে বলে,’ সিনেমার ডিরেক্টর দাদু হলে তো একটু আধটু আমারো অ্যাক্টিং করা লাগে। ‘

আদ্রিকের কথায় আদিল হুমায়ূন থমথমে দৃষ্টিতে তাকান সাহিলের দিকে। তার গম্ভির মুখশ্রী ভালো লাগলো না তার। সাহিল হুমায়ূন আদিল হুমায়ূনের দিকে তাকিয়ে মর্তুজা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলেন,’ মা? আপনার কি মাথা আদৌ ঠিক আছে? এই বয়সে এসে আমি নিজের থেকে কোনো ছোট মেয়ে বিয়ে করতে পারবো না, খালি ছোট কেনো বড় সমবয়সী কোনো মেয়েকেই নাকি। আমি একাই সুখি আছি। দয়া করে আমাকে আবার ফিরে যেতে বাধ্য করো না। মনে রেখো যদি একবার ফিরে যাই তবে এই বাড়িতে লাশ হয়েই ফিরবো। ‘

মর্তুজা বেগমের থমথমে মুখমণ্ডল! ভেবেছিলেন ছেলেকে অসুস্থতার বাহানা দিয়ে দেশে এনে গ্রামে তার পরিচিত এক চাষার কন্যার সাথে বিয়ে দিবেন! চাষাকে লক্ষ টাকা দিলে এমনিতেই রাজী হতো। কিন্তু তার পরিকল্পনায় পানি ঢেলে চলে গেলেন সাহিল হুমায়ূন! তিনি খুব ভালো করেই জানেন সাহিল হুমায়ূন একরোখা মানুষ, যা বলেন তাই করে। একবার ছেলেকে ফিরে পেয়েছেন আরেকবার হারাতে চান না।

সাহিল হুমায়ূনের চলে যেতেই সকলে এক এক করে স্থান পরিবর্তন করতে লাগলো। আদ্রিক নিজের দাদির দিকে তাকিয়ে চলে গেলো। তিনি তখনও চোয়াল হা করে বসে ছিলেন। সব কিছুই তার বুঝার বাহিরে ছিলো।

চলবে?