কৃষ্ণডাহুক পর্ব-৬+৭

0
251

#কৃষ্ণডাহুক – ০৬
আয়ানা আরা (ছদ্মনাম)

‘পড়ালেখা’ শব্দটা উচ্চারণে সহজ হলেও চলমান রাখাটা একটা মেয়ের জন্য ভীষণ কঠিন। মাতৃপিতৃহীন এক মেয়ের জন্য তো পড়ালেখা চলমান রাখাটা সৌভাগ্য! মীরা আদ্রিকার মুখে নিজের পড়ালেখার কথা শুনে এক প্রকার স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো! সে আবারো পড়ালেখা করতে পারবে? এই সৌভাগ্যও আছে তার? পরমূহুর্তেই মুখখানি চুপসে গেলো! পড়ালেখা করতে গেলে তো অনেক টাকা লাগে এতো টাকা সে পাবে কোথায়?

মীরা গোমড়া মুখে আদ্রিকার দিকে তাকালো, আদ্রিকা গভীর মনোযোগে ফোনে কিছু দেখতে ব্যস্ত। মীরা ভাঙা ভাঙা গলায় শুধালো,’ আদ্রিকা আপু। ‘

আদ্রিকা মাথা তুলে মীরার দিকে তাকালো। পরক্ষণেই ফোনের দিকে তাকিয়ে বলল,’ হু, বলো? ‘

মীরা রাশভারী কণ্ঠে বলল,’ আমার পড়ালেখা করা সম্ভব না আপু। ‘

আদ্রিকা ক্ষাণিক রাগ দেখিয়ে বলল,’ এ্যাই মেয়ে? তুমি চড় চিনো? পড়ালেখা না করলে তোমাকে কেউ চাকরিতে নিবে তোমার মনে হয়? ‘

মীরা থমথমে মুখে তাকালো আদ্রিকার দিকে। নতজানু হয়ে বলল,’ চাকরি না করলে পড়ালেখার খরচ চালাবো কি করে? ‘

‘ কতদূর অব্দি পড়েছো তুমি? ‘

পুরুষালি গম্ভির কণ্ঠকে অনুসরণ করে দরজার দিকে তাকালো আদ্রিকা ও মীরা। আদ্রিককে ভ্রুকুঁচকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থতমত খেলো মীরা। আদ্রিক দরজা পাড় করে ঘরে প্রবেশ করতে করতে বলল,’ কতটুক পড়েছো তুমি হ্যাঁ? ‘

‘ এইচএসসি। ‘ থমথমে মুখে জবাব দেয় মীরা।

আদ্রিক খানিকসময় চিন্তা করে বলল,’ একটা ভালো চাকরি পাওয়ার জন্য অন্তত ভার্সিটিটা কমপ্লিট করতে হয়! তবে তুমি অনন্ত আব্বুর স্কুলে জব করতে পারো পাশাপাশি নিজের এডমিশন টেস্টের প্রস্তুতিও নিতে পারো। ‘

মীরা চিন্তিতবোধ করলো আদ্রিকের কথায়, কিছু বলার জন্য চোয়াল হা করতে নিলেই আদ্রিক থামিয়ে দিয়ে বলল,’ এডমিশন টেস্টের বই নিয়ে চিন্তা করো না!আপাতত আমি ফ্রি আছি, আমি দেখে নিবো। ‘

আদ্রিকের যেচে পড়ানোর ব্যাপারটা ভালো লাগলো না মীরার। ভদ্রতার খাতিরে তার সাথে অভদ্রতামীও করতে পারছে না। আদ্রিকার দিকে অসহায় চোখে তাকালে আদ্রিকা ঠোঁট প্রসারিত করে হেসে বলে,’ দেখেছো মীরা, আদ্রিক ভাইয়া তোমার সব সমস্যার সমাধান করে দিলো। কাল তুমি অনন্ত আব্বুর স্কুলে যেয়ে চাকরির ব্যাপারটা পাকাপক্ক করে এসো,কেমন? ‘

মীরা প্রতুত্তর করার পূর্বেই আদ্রিকা হাতের মুঠোয় ফোন শক্ত করে ধরে তড়িঘড়ি করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। যাওয়ার পূর্বে আদ্রিকা ভুলবশত দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে গিয়েছে তা দেখে মীরার ছোট মনে কিঞ্চিৎ ভয় জমলো! সে আর আদ্রিক এক রুমে বন্দী।

আদ্রিক মীরার দিকে একবার ভ্রুকুঁচকে তাকিয়ে দরজার কাছে গেলো। দরজার হাতল ধরে টান দিয়ে খোলার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। মুখ দিয়ে ‘চ’ বর্গীয় উচ্চারণ করে বলল,’ শিট! আদ্রিকা মস্ত বড় ভুল করে চলে গেলো। ‘

মীরা মন্থর গলায় বলল,’ কি হয়েছে? ‘

আদ্রিক মীরার দিকে শান্ত দৃষ্টিপাত রেখে এগিয়ে আসতে আসতে বলল,’ আদ্রিকা দরজা বন্ধ করে দিয়ে গিয়েছে। এই দরজাটায় সমস্যা আছে, বন্ধ করলেই লক হয়ে যায়। ‘

আদ্রিকের কথায় মীরার আত্মা কেঁপে উঠে। বিষ্ময়পূর্ণ চোখে আদ্রিকের দিকে তাকিয়ে বলে,’ এখন কি হবে? ‘

আদ্রিক মীরার পাশে বসে বলে,’ অপেক্ষা করতে হবে। ‘

মীরা শুকনো ঢোক গিলে জড়সড় হয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিলো! সে একা একটা মেয়ে কোনো পরপুরুষের সাথে এক রুমে থাকবে কি করে এখন?

মীরার ভয় পাওয়া দেখে আদ্রিক বিরক্তবোধ করলো! মেয়েটাকি তাকে বাজে ছেলে ভাবছে যে একা পেয়ে সে তার সুযোগ নিবে?
আদ্রিক ঠোঁটের অর্ধভাগ কামড়ে বলল,’ ভয় পাচ্ছো কেনো মীরা?আমি বাঘ না ভাল্লুক? ‘

মীরা আদ্রিকের দিকে তাকিয়ে ভয়ে তটস্থ হয়ে বিরবির করে বলল,’ তারচেয়েও বেশি কিছু! ‘

মীরার বিরবিরিয়ে বলা কথা আদ্রিকের কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই ঘাড় বাকিয়ে হাসলো সে। পরমূহুর্তে মীরার দিকে পূর্ণ দৃষ্টি ফেলে বলে,’ হু? আমি তো ডেঞ্জারাস? ‘

মীরা দুপাশে মাথা নাড়ালো।
আদ্রিক দুষ্টু হেসে বলল,’ তো কি বললে ওইসময়? ‘

‘ কই কি বললাম? ‘

আদ্রিক মীরার দিকে ছোট ছোট চোখ করে তাকিয়ে বলে,’ আচ্ছা? ‘

মীরা নিজের দৃষ্টি সরিয়ে প্রতুত্তর করলো,’ হু। ‘

‘ কইসিলাম এই অপরিচিত মাইয়াডারে বাইতে রাখিস না। পোলা মাইনশে কি এতো কিছু বুঝে? যেইখানে মধু সেইখানেই মৌমাছি তারা। ‘

মর্তুজা বেগমের গগণ কাঁপানো চিৎকার শুনে সকলে মস্তক নতজানু হয়ে ‘থ’ মেরে দাঁড়িয়ে রইলো। মীরার হাত পা অবশ হয়ে আসছে! নিজেকে এইভাবে কলঙ্কিত হতে দেখে কি বলবে ভেবে কূল পাচ্ছে না। মীরার বেগতিক অবস্থা দেখে মর্তুজা বেগম কথা শোনানোর আরো সুযোগ পাচ্ছেন। তিনি তর্জনী তাক করে মীরার উদ্দেশ্যে বলে,’ এ্যাই মেয়ে? সত্যি কইরা কও, তোমরা অতক্ষণ ওই ঘরে কি করতেসিলা? ‘

মর্তুজা বেগমের কথায় মীরা হতবাক, নির্বাক, স্তব্ধ দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করে তারউপর। মর্তুজা বেগমের প্রতুত্তরে সে কি বলবে ভেবে পেলো না। আকস্মিক ফু্ঁপিয়ে উঠলো সে। সবাই থমথমে মুখে তার দিকে তাকালো। আদ্রিক এতক্ষণ চকিত চেহেরায় তাকিয়ে ছিলো মেঝের দিকে। নিজের দাদির এই কথা শুনে বলল,’ ঘরে কি করছিলাম সেটা জানার এতো আগ্রহ কেনো তোমার? ‘

আদ্রিকের কথায় সবাই আরেকদফা হতবাক হয়ে তাকালো তার দিকে। ঘটনা বাড়ির সবার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।

মর্তুজা বেগম মূহুর্তেই তেঁতে উঠলেন, মুখ বাকিয়ে বলেন,’ তয় জানা লাগবো না?তোর জন্য আমাগো সম্মানহানী হইবো আর আমি মাইনা নিমু? ‘

আদ্রিক পরপর দুইবার ঘনঘন নিলো, দাদির প্রত্যেকটা কথা তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে দিচ্ছে তবুও মুখের উপর তর্ক করতে পারছে না কারণ সেই শিক্ষাটা তার পরিবার থেকে সে পায়নি।

আদ্রিককে চুপ থাকতে দেখে মার্জিয়া বেগম এগিয়ে এলেন। আদ্রিকের বাহু ধরে বলেন,’ আদ্রিক? তুমি কি মীরামার সাথে বাজে কিছু করেছো? ‘

আদ্রিক বিস্ফোরিত নয়নে তাকায় নিজের মায়ের দিকে! তার নিজের মা তাকে অবিশ্বাস করছে? যে মাকে তাকে চোখ বুজে বিশ্বাস করতে আজ সেই মা তার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলছে? আদ্রিক এক ঝটকায় মীরার দিকে তাকালো। মীরার সেই কখন থেকে ফুঁপিয়ে যাচ্ছে। আদ্রিক তটস্থ পায়ে মীরার দিকে এগিয়ে ওর বাহুদ্বয় শক্ত করে চেপে বলল’ মীরা? আমি তোমার সাথে বাজে কিছু করেছি? তুমিই বলো! ‘

মীরা ক্রন্দনরত অবস্থায় জবাব দিতে পারলো না, আদ্রিককে রাগানোর জন্য তা যথেষ্ট! আদ্রিক মীরাকে পরপর দুবার ঝাঁকিয়ে বলল,’ এ্যাই মেয়ে? আমি তোমাকে কিছু করেছি? যদি মিথ্যা বলো, যা করি নি তা করতে বাধ্য হবো। ‘

মীরা ভয়ে শব্দ করে কেঁদে উঠলো! হিঁচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতে বলল,’ নাহ, আপনি এমন কিছুই করেন নি। ‘

মীরার কান্নার স্বর এতো বেশি ছিলো যে আদ্রিক ছাড়া তার কথা কেউ বুঝতে পারেনি। আদ্রিক মীরাকে ছেড়ে সবার দিকে তাকিয়ে বলে,’ দেখেছো? ও কি বলেছে? আমি ওকে কিছুই করি বিশ্বাস হয়েছে এইবার? ‘

কারো মুখে ‘রা’ নেই। আদ্রিক ভ্রুকুঁচকে তাকালো সবার দিকে। সবাই বিষ্ময় চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। মার্জিয়া আদ্রিকের দিকে একবার তাকিয়ে মীরার কাছে এসে বলে,’ মীরা ঠিক আছো তুমি? ‘

মার্জিয়ার কথায় আদ্রিক তার দিকে তাকালো। মার্জিয়ার চোখ ছলছল করছে। আদ্রিক মার্জিয়ার এহেন কথার সারমর্ম বুঝতে পারলো না৷ মর্তুজা বেগম নিজের মতো আহাজারী করছেন। সাহিল হুমায়ূন পরিস্থিতি বুঝতে পেরে বললেন,’ ভাবী? আপনি বাড়ির ছেলেকে অবিশ্বাস করছেন?’

মার্জিয়া গম্ভির স্বরে বলেন,’ ছেলে বাড়ির হোক বা বাহিরের! ছেলে তো ছেলেই। ‘

মীরা স্তব্ধ দৃষ্টিতে তাকালো মার্জিয়ার দিকে। মার্জিয়ার কথার অর্থ বুঝতে পারলো না সে। মর্তুজা বেগম মেকি সুরে কান্না করতে করতে বললেন,’ এই ছেলে আমার সম্মানহানী করে ছাড়বে! মার্জিয়া, আদিল তোরা কিছু কর নইলে আমি কিন্তু আত্ম-হত্যা করুম। ‘

চলবে?

#কৃষ্ণডাহুক – ০৭
আয়ানা আরা (ছদ্মনাম)

থমথমে পরিবেশে। কারো মুখে রা নেই। মীরা স্তব্ধ, অবশ শরীরে দাঁড়িয়ে আছে। চোখের পানি গালে লেপ্টে আছে। সবাইকে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আদ্রিকার মনে কিঞ্চিৎ সন্দেহ জাগে। সবাই তো এতো চুপচাপ থাকার মানুষ নয় তাছাড়া সকলের মুখ এতো অন্ধকার কেনো?

আদ্রিকা মন্থর পায়ে এগিয়ে আসতে আসতে বলল,’ সবাই মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছো কেনো? ‘

মর্তুজা বেগম মুখ ঝাপটি মেরে বলেন,’ কই আসিলা তুমি? ‘

‘ আমি তো ভার্সিটি গিয়েছিলাম। কি হয়েছে এখানে? ‘

মর্তুজা বেগম কিছু বলার জন্য মুখ খুলবে তার আগেই মার্জিয়া বেগম আদ্রিকাকে সংক্ষেপে বলল সব শুনে আদ্রিকা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো! পরক্ষনেই ঠোঁট এলিয়ে হেসে বলল,’ দাদু? তোমার মনে হয়না তুমি সবসময় সবকিছুতে ওভাররিয়েক্ট করো? ‘

মর্তুজা বেগম আদ্রিকার কথায় ক্ষেপে উঠলেন, চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন,’ বড়দের সাথে কেমনে কথা কইতে হয় জানস না? বেয়াদব! ‘

আদ্রিকা নেত্রপল্লব আকারে ছোট করে মর্তুজা বেগমের দিকে তাকালো, প্রতত্তুর না করে ঠাট্টার সুরে বলল,’ তোমরা ব্যাপারটাকে যেভাবে নিচ্ছো আসলে ব্যাপারটা তেমন না। দরজাটা আমিই লাগিয়েছিলাম ভুলবশত। ‘

আদ্রিকার এহেন কথায় উপস্থিত সকলের চোয়াল হা হয়ে গেলো। আদিল হুমায়ূন গাম্ভির্যের সহিত বলেন,’ ঘটনা কি, খুলে বলো। ‘

আদ্রিকা এক এক করে তখনকার ঘটে যাওয়া সব কথা সবার সামনে তুলে ধরলো। সব শুনে মর্তুজা বেগমের মুখ চুপসে গেলো, চোরের ন্যায় আঁচলে দ্রুতগতিতে মুখ ঢাকলেন। সবাই বিষ্ময়কর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। তিনি সকলের দৃষ্টি উপেক্ষা করে বাজখাঁই গলায় বললেন,’ আমার দিকে এমনে তাকাস কেন তোরা? আমি হইলাম গিয়া পুরান যুগের মানুষ, অবিবাহিত যুবক যুবতীরে এক কামরায় দেখলে ভুল বুঝবোই। ‘

মায়ের কথায় সাহিল হুমায়ূন ক্ষাণিক রাগ দেখিয়ে বললেন,’ তাই বলে আপনি বাড়ির ছেলেকে সবার সামনে চরিত্রহীন উপস্থাপন করবেন? আপনার উচিত ছিলো আমাদের সবাইকে এক সঙ্গে করে কথা বলে, কাজেই আপনি বোকাদের মতো কাজ করে বসেছেন। মীরা মেয়েটার মনে কতটুক আঘাত লেগেছে আপনার ধারণাও আছে? ‘

সাহিল হুমায়ূনের কথায় মর্তুজা বেগম মেকি সুর তুলে কান্না আরম্ভ করে দিলেন। তার কান্না কেউ পরোয়া না করে যে যার মতো নিজেদের ঘরে চলে যেতে লাগলো। আদ্রিকা মীরার বাহু ধরে বলে,’ খুব বেশিই কষ্ট পেয়েছো? ‘

মীরা অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ালো, আদ্রিকা শুকনো হেসে বলেন,’ দাদু এমনই! খিটখিটে ধরণের। যে কিনা বাড়ির ছেলের সাথেই এমন ব্যবহার করে তার কাছে অন্তত তোমার ভালো ব্যবহার আশা করা বৃথা। তার আশে পাশেও ঘেষো না! তাতেই তিল থেকে তাল বানিয়ে দিবেন। ‘

আদ্রিকা একবার দম নিয়ে ফের বলল,’ একবার কি হয়েছে জানো? ‘

মীরা কৌতুহলপূর্ণ দৃষ্টিপাত আদ্রিকার দিকে ফেলে বলল,’ কি? ‘

‘ আমার ভার্সিটির এক ক্লাসমেটকে নিয়ে বাড়ি এসেছিলাম। গ্রুপ ওয়ার্ক ছিলো, আমাদের গ্রুপে আরো দুজন ছিলো তাদের আসতে দেরী হয়েছিলো বলে দাদু ওই ছেলেকে আমার প্রেমিক বলে চালিয়ে দিলেন। তাকে অনেক বুঝানো হয়েছে তারপরও যদি সে বুঝে! আমার সেই ক্লাসমেটটাকে তো দাদু সোজা বলেই দিয়েছিলো,’ কালকে বাড়িতে মা বাবারে দিয়া প্রস্তাব পাঠাইও। ‘ ছেলেটা তো সেদিনই তওবা করে গিয়েছে এই বাড়িতে আর পা ফেলবে না। ‘

আদ্রিকার কথায় মীরা ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো, পরমূহুর্তে চিন্তিত স্বরে বলে,’ উনি এমন করেন কেনো?’

‘ সাহিল আব্বুর বিয়ে ঠিক হয়েছিলো দাদুর খালাতো বোনের মেয়ের সাথে কিন্তু পরে কোনো এক কারণে বিয়েটা ভেঙ্গে যায় তারপর থেকেই এমন খিটখিটে মেজাজে থাকেন,সবকিছুই সহজ ভাবে নিতে পারেন না, একটুতেই সন্দেহ করেন। ‘

‘ তোমার কি একটু বেশিই ব্যথা লেগেছে হাতে, মীরা? ‘

মুখ কাচুমুচু করে মীরার সামনে এসে দাঁড়ালো আদ্রিক। মীরা আদ্রিকের দিকে তাকিয়ে তার পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলে আদ্রিক আবার বলল,’ সরি? বেশি লেগেছে? ‘

মীরা কিঞ্চিৎ রাগমিশ্রিত কণ্ঠে বলল,’ লাগলেও কি? এই বাড়িতে আমি যতদিন আছি ততদিন দয়া করে আমার সাথে কথা বলবেন না,তখন আবার আপনার দাদু ঊনিশ থেকে বিশে রূপান্তর করতে সময় নিবে না। ‘

আদ্রিকের মনে অপরাধবোধ হানা দিলো, তবুও আত্মসম্মানের কাছে হেরে মীরার পাশ কাটিয়ে নিজের ঘরে যেয়ে শব্দ করে দরজা লাগিয়ে দিলো। দরজার শব্দে মীরা নাক মুখ কুঁচকে নিজের গন্তব্যের জন্য পা বাড়ালো।

‘ মীরামা যে? আসো এখানে বসো। কোনো দরকার ছিলো নাকি তোমার? ‘

অনন্ত হুমায়ূনের বিনয়ের সাথে বলা কথায় মীরা চমৎকার হেসে বলল,’ আদ্রিকা আপু মানে আদ্রিকা আমাকে বলছিলো যে আপনার স্কুলে শিক্ষিকা লাগবে?’

অনন্ত হুমায়ূন টেবিল হাতড়ে নিজের চশমা নিয়ে চোখে লাগিয়ে বললেন,’ হ্যাঁ হ্যাঁ, লাগবে। ‘

মীরার ঠোঁট জুড়ে স্বস্তির হাসি ফুটে উঠে। নিজের হাতের জরুরি কাগজ পত্র অনন্ত হুমায়ূনের সামনে তুলে ধরে বলে,’ এইগুলো লাগবে না? ‘

অনন্ত হুমায়ূন মীরার হাত থেকে ওইগুলো না নিয়েই হেসে বলেন,’ তুমি হলা বাড়ির মেয়ে! তোমার জব নিতে গেলেও আবার কোনো ফর্মালিটি করতে হবে নাকি? কাল থেকে স্কুলে জয়েন করতে পারো। ‘

অনন্ত হুমায়ূনের কথায় মীরা ঠোঁট প্রশ্বস্ত করে হেসে উঠে দাঁড়ালো, কৃতজ্ঞতার সুরে বলে,’ আপনারা আমার জন্য যা করছেন তার জন্য আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো। ‘

অনন্ত হুমায়ূন রাগমিশ্রিত কণ্ঠে বললেন,’ এই বাড়িতে থাকছো তারমানে তোমার সব দায়িত্ব আমাদের! তোমাকে জবটা দিতাম না যদি আজকে আম্মার জন্য কাহিনিটা না ঘটতো। ‘

উত্তরে মীরা ম্লান হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।

সূর্যের তীর্যক আলোয় ধরণী হয়েছে আলোকিত। সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি অদ্ভুত! রাত থেকে দিন আবার দিন থেকে রাত। সব কিছুই চলে নিয়ম মাফিক। কোনো কিছুই কারো জন্য থেমে নেই।
সাদা পর্দা ভেদ করে তীর্যক আলোক রশ্মী মঈরার মুখমণ্ডলে পূর্ণরূপে পড়তেই মীরা পিটপিট করে নিজের নেত্রপল্লবজোড়া খুলে উঠে বসলো। টেবিল হাতড়ে নিজের কমদামি ফোনটায় সময় দেখে নিলো! জিহ্ব দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে মনে মনে বলল,’ স্কুলের শুরুরদিনই এতো দেরী! অনন্ত আংকেল কিনা কি ভাবে! ‘

মীরা ফোনটা নিজের স্থানে রেখে, দ্রুত পায়ে রেডি হয়ে নিচে গেলো। অনন্ত হুমায়ূন বাসা থেকে বের হচ্ছিলেন মীরাকে দেখে পদাচরণ থামিয়ে বললেন,’ আরেকটু দেরী করলেই আমি চলে যেতাম। ‘

মীরা মনে মনে লজ্জিতবোধ করলো! ইশ কি ভাবছে তাকে? অনন্ত হুমায়ূন মীরার মনোভাব বুঝে বললেন,’ তুমি নাস্তা করে তারপর এসো। ‘

‘ না! তার দরকার নেই, এমনিতেই দেরী হয়ে গিয়েছে। ‘ মীরা তাড়াহুড়ো করে জবাব দিলো।

অনন্ত হুমায়ূন নিজের হাত ঘড়ির দিকে নজর বুলিয়ে বললেন,’ তুমি ধীরে সুস্থে নাস্তা খেয়ে আদ্রিকের সাথে চলে এসো আজকে। ও গতকাল আমাকে বলছিলো আজকে স্কুলে যাবে ও। ‘

আদ্রিকের নাম শুনেই মীরা থমকে গেলো। তার নিকটবর্তীতে বসে থাকা আদ্রিকের দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো সে নাক মুখ কুঁচকে বসে আছে যেনো অনন্ত হুমায়ূনের কথা তার কর্ণকুহরে পৌঁছায় নি।

মীরা কিছু বলবে তার আগেই অনন্ত হুমায়ূন তার কথা না শুনেই বের হয়ে চলে গেলো। মীরা হতাশ মুখে তাকালো আদ্রিকের দিকে। আদ্রিক ভাবলেশহীন হয়ে নাস্তা করছে।
মার্জিয়া বেগম দাঁড়িয়ে থেকে তাদের মধ্যকার জনজাট বুঝতে পারলেন, মীরাকে নাস্তা দিতে দিতে বললেন,’ কালকে ঘটনা দুঃস্বপ্ন ভেবে ভুলে যাও, আমরাও ভুলে গিয়েছি। ‘

মীরার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,’ আম্মার কথা মনে নিও না। ‘

মীরা প্রতুত্তরে শুকনো হাসি দিলো তা আড়চোখে একবার আদ্রিক দেখে উঠে দাঁড়ালো।

‘ উঠে গেলি যে? ‘ মার্জিয়া বেগমের বিচলিত কণ্ঠস্বর।

আদ্রিক তাড়াহুড়ো করে বলল,’ এখনই বের হবো, যদি উনি যেতে চায় তবে দ্রুত আসুক, আমি বাহিরে দাঁড়াচ্ছি। ‘

মার্জিয়া বেগম কিছু বলবেন তার আগেই আদ্রিক চলে গেলো তার কথা শোনার অপেক্ষা না করে।

চলবে?