কৃষ্ণাবতী পর্ব-০৭

0
1737

#কৃষ্ণাবতী
#৭ম_পর্ব

সকাল সকাল কৃষ্ণার মুখ দেখেই মেজাজটা কেনো যেনো খারাপ হয়ে গেলো দেবের। তাকে এড়িয়ে ভেতরে ঢুকলো সে। তখনই কৃষ্ণা বলে উঠলো,
– কাল রাত কোথায় ছিলেন?

কথাটা এতোও খারাপ নয় কিন্তু প্রশ্নটা একেবারেই সহ্য হলো না দেবের। সে তখন ক্ষীপ্ত কন্ঠে বলে উঠে,
– আমি কোথায় যাবো, কি করবো তার হিসেব কি তোকে দিতে হবে?

দেবব্রতের প্রশ্নে খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় কৃষ্ণা। কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। সে কথাটা মোটেই সেভাবে বলে নি। কৌতুহলের বশেই মুখ ফচকে বেরিয়ে গেছে। আমতা আমতা করে ধীর কন্ঠে বললো,
– কাল রাত তো বাড়ি ফিরেন নি, তাই চিন্তা হচ্ছিলো। আমি কোনো হিসেব চাচ্ছি না
– নিজেকে কি আমার স্ত্রী ভাবা শুধু করেছিস তুই? চিন্তা হচ্ছিলো, কেনো রে? আমার জীবনটা নরক বানিয়েও শান্তি হয় নি নাকি?
-………..
– কি হলো মুখ খুলছিস না কেনো?

কি উত্তর দেওয়া উচিত কিশোরী কৃষ্ণার জানা নেই, শুধু ফ্যালফ্যাল নজরে দেবব্রতের দিকে তাকিয়ে রইলো। দেবব্রত তখন আহত সিংহের ন্যায় গর্জন করছিলো। তার চোখে যেনো ঘৃণার আগুণ জ্বলছিলো, সেই ঘৃণাটা নিকের প্রতি। চোয়াল শক্ত, দৃষ্টি স্থির। সে কৃষ্ণার মুখের উত্তরের অপেক্ষায় আছে। কিছু নিরীহ কৃষ্ণার উত্তরহীন মুখটা তাকে আরোও বিরক্ত করছে। রাগটা আরোও বেড়ে চলেছে। এই মায়াবী মুখটার মায়াও আজ এই রাগ শান্ত করতে পারছে না। বারবার মাথায় তার দামিনীর কান্নারত মুখটাই ভাসছে। অগ্নি দৃষ্টি প্রয়োগ করে শক্ত কন্ঠে বলে,
– মুখে কথা নেই? তা থাকবে কেনো? শুধু তো পারিস এই ইনোসেন্ট ফেসটা দিয়ে মানুষের সহানুভূতি অর্জন করতে। তারপর সেই মানুষটার ঘাড়ে উঠে তার ঘাড় চিবোতে। আমাকে একটু ক্ষ্যামা দে, আর পারছি না যে। দামিনী ঠিক বলেছিলো তোর মায়াবী মুখের পেছনে একজন সর্বগ্রাসী নারী লুকায়িত। আমিই দেখি নি। তুই আমার সর্বত্র গ্রাস করেছিস। আমাকে নিঃস্ব করে দিয়েছিস আমাকে।
-…….
– অবশ্য যে মেয়ে তার জন্মের সময় তার বাপকে গিলে সে কতোটা ভালো হতে পারে। অপয়া তো অপয়াই হয়। তোর মতো পিতৃপরিচয়হীন নারী আমাকে কি সুখ দিবে?

শেষ কথাগুলো বুঝতে বেশি বেগ পেতে হলো না কৃষ্ণার। এই পিতৃ পরিচয়হীনতার খোটা যে ছোট বেলা থেকে তার শুনতে হয়েছে। কিন্তু তার মাষ্টারমশাই ও যে সেইদলের একজন হবে এটা যেনো চিন্তার সীমা পার করেছে। বিদ্রুপের কন্ঠে কথাগুলো বলে নিজের ঘরের দিকে প্রস্থান করলো দেবব্রত। আজ যে নিয়ন্ত্রণ ছাড়িয়ে ফেলেছে নিজের। কষ্টের মাত্রা এতোটাই বেড়ে গেছে যে হিতাহিত জ্ঞানশুণ্য হয়ে পড়েছে সে। খুব কষ্টে দামিনীকে খাওয়িয়ে ঘুম পাড়িয়ে তবেই তার বাড়ি ত্যাগ করলো সে। তারপর আর ঘরে ফেরার ইচ্ছে হয় নি। বুড়িগঙ্গা নদীর পাড়ে বসেছিলো। মনকে কিছুটা সামলে নিয়ে ঘরে ফেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো। কিন্তু ঘরে ফিরেই কৃষ্ণার মুখ দেখে মেজাজ বিগড়ে গেলো তার। মনের সুপ্ত রাগগুলো মেয়েটাকে কটুকথা বলেই নেভালো সে। কৃষ্ণা সেই জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। চোখ বহুদিন পর ভিজে আসছে। এই বাপ নামক কটুকথা যে তার একেবারেই সহ্য হয় না। আচ্ছা একটা মানুষ তার স্ত্রী আর বাচ্চাকে ছেড়ে চলে গেছে, তাতে তার জন্মের দোষ থাকবে কেন? এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো এই নির্মম সমাজের কাছেও নেই। একজন অবশ্য আড়ালে দাঁড়িয়ে কৃষ্ণার সাথে হওয়া অন্যায় ব্যবহার গুলো নীরবে দেখছিলো। নিজের উপর অনুতাপ হচ্ছে, হিত করতে যেয়ে অহিত ই করে ফেললেন তিনি কৃষ্ণার সাথে। এবার কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে তাকে, এভাবে একটি নিরীহ মেয়ের ভবিষ্যত বঞ্চনার শুকার হতে পারে না, কখনো না_____

সকাল ১১টা,
যখন ঘুম ভাঙ্গলো দেবব্রতের তখন সূর্যিমামা মাথার উপর উঠে গেছেন। বারান্দা দিয়ে তীর্যক রশ্নি ঘরকে উত্তপ্ত করে তুলছে। ঘুম ভাঙ্গতেই চোখ মুখ খিচে উঠলো তার। সূর্যের আলোটা সরাসরি চোখে এসে বিধছে। এতে তার সুখের ঘুমটা ভেঙে গেছে। ঘুমের জগৎ টা খুব শান্তির। ভেঙ্গে গেলেই বাস্তবে ফিরে আসতে হয়। বাস্তবের কঠোর জগৎ বেদনা ব্যতীত কিছুই দিচ্ছে না। হঠাৎ বেদনার কথা মনে করতেই মনে পড়লো আজ সকালের কথা। কৃষ্ণাকে কি কটু কথাটাই না শুনিয়েছে সে। রাগটাকে কিছুতেই ধরে রাখিতে পারে নি। এটা ভাবতেই কৃষ্ণার ছলছল চোখের অবাক দৃষ্টিটি চোখের সামনে ভাসতে লাগলো। মেয়েটাকে অপমান করার নেশায় এতোই উন্মাদ হয়ে ছিলো যে তার হতবিহ্বল মুখটাও তার মনে দয়া তৈরি করে নি। নিজের কাপুরুষত্বের উপর আরোও মেজাজ খারাপ হচ্ছে। এমন দোষে তাকে দোষী বানিয়েছে যে দোষটা সে করেই নি। কোনোটা জ্ঞানশুণ্য হলে কারোর জন্ম নিয়েও প্রশ্ন করা যায়। দেবব্রতের নিজের কাজে নিজেই অনুতপ্ত। না বসে থাকলে হবে না। বাচ্চা মেয়েটির কাছে ক্ষমা চাইতে হবে তো। নিজের দাম্ভিকতা এতোও বেশি নয় যে নিজের দোষের ক্ষমাটুকু চাওয়ার সৎ সাহস নেই তার। তাড়াহুড়ো করে বিছানা ছাড়তেই খেয়াল করলো কেউ দ্বারে কড়া নাড়ছে। দেবব্রত ভেবেছে হয়তো কৃষ্ণা এসেছে। ছুটে গিয়ে দরজা খুলতেই হতাশ হতে হয় তাকে। দরজার অপরপাশে কৃষ্ণা নয়, তার দাদান প্রদীপ বাবু দাঁড়ানো। প্রদীপ বাবু ধুতি, পাঞ্জাবী পড়ে বাহিরে যাবার জন্য তৈরি হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
– দাদান কিছু বলবে?
– যাবার আগে তোমার সাথে দেখা করাটা জরুরী বলে মনে করলাম। তাই ই আসা।
– যাবার আগে মানে?
– আমি গ্রামে ফিরে যাচ্ছি।
– হঠাৎ?

দাদানের কথা যেনো কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না দেবব্রত। প্রদীপ বাবুকে গ্রাম থেকে একেবারের জন্যই এখানে থাকার জন্য রাজী করে এনেছিলো সে। হঠাৎ তার মতবদলের কারণটা যেনো হজম হচ্ছে না দেবব্রতের। দেবব্রতের কৌতুহলের অবসান করার জন্য মুখে হাসি টেনে প্রদীপ বাবু বলে উঠলেন,
– চেয়েছিলাম এবার একেবারের জন্যই এই শহরে থেকে যাবো। কিন্তু শহর আমার জন্য নয়। আর আমি তো একা যাচ্ছি না, কৃষ্ণাও আমার সাথেই যাচ্ছে।
– কৃষ্ণা যাচ্ছে মানে?
– এতো অপমানের পর কার ভরসায় তাকে রেখে যাবো আমি দেবব্রত? তোমার? সেই তুমিও তোমার মা-বাবার মতো তাকে অপমান করেছো।
-……

কোনো কথা না বলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে দেবব্রত। দেবব্রতের নত মাথা দেখে বিদ্রুপের স্বরে তিনি বলেন,
– মাথা নিচু করার মতো কাজ কেনো করো বলো তো? যাক গে, আমি কিছু কথা বলার জন্য এসেছিলাম। যেই পিতৃপরিচয়ের খোটা তুমি মেয়েটাকে দিয়েছিলে সেই কথাটা স্পষ্ট করে দেবার জন্য এসেছি………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি