কৃষ্ণাবতী পর্ব-০৯

0
1821

#কৃষ্ণাবতী
#৯ম_পর্ব

হঠাৎ করেই বুকের বা পাশে চিনচিনে ব্যাথা অনুভূত হলো কৃষ্ণার। না বুঝেও তার মাষ্টারমশাইকে মন দিয়ে দিয়েছে যে সে। এটা তো অস্বীকার করার উপায় নেই। তাই তো মনটা বারে বারে হাহাকার করছে। বিদ্রোহ করছে। দাদানের পিছু পিছু ঘরের চৌকাঠ পার হবে ঠিক তখনই পিছন থেকে চিরচেনা কন্ঠ শুনতে পায় কৃষ্ণা। পেছন ফিরে তাকালে দেখতে পায় দেবব্রত কঠোর দৃষ্টি প্রয়োগ করে তাকিয়ে আছে। নির্লিপ্ত কন্ঠে দাদানকে উদ্দেশ্য করে বলে,
– নিজে যাচ্ছো যাও, আমার বউকে নিয়ে যাচ্ছো কেনো?

দেবব্রতের নির্লিপ্ত কন্ঠের কথাটা শুনে হতবাক হয়ে যায় উপস্থিত সবাই। অবন্তীকা দেবী যেনো ছেলের এরুপ কথায় বিষম খেয়ে উঠেন। আজ দুদিনে এরুপ কোনো কথাই ছেলের কাছ থেকে শুনেন নি তিনি। ছেলের এমন ১৮০° ঘুর্ণণে অবাক হয়ে গেলেন তিনি। প্রদীপ বাবু ভ্রু কুঞ্চিত করে তার নাতীর দিকে তাকিয়ে আছেন। দেবব্রত ও স্থির দৃষ্টিতে প্রদীপ বাবুর দিকে তাকিয়ে রইলো। কৃষ্ণা যেনো স্বপ্ন দেখছে। যে ব্যাক্তি বিয়েটাকেই মানে না, সেই ব্যাক্তি আজ দৃঢ় কন্ঠে তাকে নিজের বউ দাবি করছে। দেবব্রত আবারও বলে উঠলো,
– তোমার থাকতে ইচ্ছে না হলে চলে যাও। কৃষ্ণা এ বাড়িতেই থাকবে। এটা যে ওর অধিকার।

বলেই কৃষ্ণার হাত থেকে ট্রাংকটি নিজের হাতে নিয়ে নেয় সে। বা হাতে ট্রাংকটি নিয়ে ডান হাতে কৃষ্ণার হাতটি ধরে হাটা শুরু করে দেবব্রত। দেবব্রতের কাজে মুচকি হাসি হাসেন প্রদীপ বাবু। তিনি এতোদিন পর পাপবোধ থেকে মুক্তি পেয়েছেন। বুকে একটি স্বস্তি বয়ে যাচ্ছে। এদিকে নারায়ন বাবুর মনে স্মিত খটকা লাগে। দেবব্রত কি অতীতের কিছু জেনে গেলো তবে!!

৭.
দেবব্রতের খাটে পা দুলিয়ে বসে রয়েছে কৃষ্ণা। দেবব্রত তার সামনে বসা। মাথা নিচু করে আছে। কিভাবে কথা শুরু করবে বুঝে উঠতে পারছে না। কৃষ্ণা অবাক নয়নে তার বরকে দেখে যাচ্ছে, কপালে চিন্তার ভাজ, মুখে গ্লানির ছাপ স্পষ্ট, নত চোখে মাটির দিকে তাকিয়ে আছে আর ক্ষণে ক্ষণে নখ খাচ্ছে। কৃষ্ণার বেশ হাসি পেলো, এতো বড় মাষ্টারমশাই এমন অবাক করা কাজ করবে এটার হিসেব মিলাতে পারছে না সে। এবার একটু রাগী কন্ঠ বানিয়ে দেবব্রতের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো সে,
– নিচে এটা কি বললেন সবাইকে? আমি আপনার বউ? আর আমাকে তো আপনার৷ সহ্যই হয় না তবে কেনো আটকে রাখলেন আমাকে?

এবার দেবব্রত মাথা তুললো। কৃষ্ণা তার দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে। দেবব্রতের বুঝতে বাকি রইলো না, সকালের ব্যাবহারে মেয়েটি বেশ কষ্ট পেয়েছে। গ্লানিমিশ্রিত কন্ঠে বললো,
– সকালে কথাটা আমি সেভাবে বলতে চাই নি।
– তো কিভাবে বলতে চেয়েছেন? অপয়াকে কে শুদ্ধ ভাষায় ও অপয়াই বলা হয়।
– আমি সে সব কিছুই বলতে চাই নি। আসলে কালকে মন- মেজাজ ভালো ছিলো না। সব কিছু মিলিয়ে বেশ অসহায় হয়ে গেছি। তুই বুঝবি না ছোট তো? এই শেষবারের মতো ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আর এমন করবো না আমি।
– বেশ আমি ক্ষমা করে দিলাম। কিন্তু মাষ্টারমশাই, আমাকে আটকালে কেন? আমি চলে গেলে আপনার সব সমস্যাই তো দূর হয়ে যেতো। দিদিমনিকে ও কষ্ট পেতে হতো না।

কৃষ্ণার সরল মনের প্রশ্নের উত্তর যে দেবব্রতের কাছেও নেই। হয়তো গ্লানি বোধে, দায়িত্ববোধের কারণে এই কাজটা করলো সে। যে ত্যাগ কৃষ্ণার মা-বাবা তার জন্য করেছে, তার তুলনায় এটা হয়তো খুব সামান্য। স্মিত হাসি ঠোটে টেনে বললো,
– তুই যে আমার দায়িত্ব কৃষ্ণা। সেটাকে এড়ানোর শক্তি মহামায়া আমাকে দেয় নি। ভালোবাসাকে অস্বীকার করলেও এই দায়িত্ব এড়ালে নরকেও আমার ঠায় হবে না। শ্যামলী মাসির অনেক ঋণ যে বাবার উপর আছে। সেটা কে আমার ই বয়ে যেতে হবে।
– মার ঋণ যদি থাকে সেটা তো বাবামশাই এর উপর। আপনার উপর তো নেই। অন্যের ভার নিজের কাধে নিবেন না মাষ্টারমশাই। একটা সময় নিজেই দিশেহারা হয়ে যাবেন। আর আমার মতো পিতৃপরিচয়হীনা মেয়ের জন্য এতো ব্যাকুল হবেন না। দয়ার ভার সহ্য করার ক্ষমতা যে আমার ও নেই

কৃষ্ণার কথাগুলো দেবব্রতকে অবাক করে দেয়। এতো ছোট মেয়ে এতো সুন্দর করে কথাও বলতে জানে। কৃষ্ণার চোখজোড়া উজ্জ্বল, উদ্দীপ্ত; মুখের তেজ যেন দেবব্রতকে ও ছুয়ে যাচ্ছে। সৎ বাবার মেয়ে বলে কথা। কই সে তো এভাবে দৃঢ় কন্ঠে কাউকে কোনো কথা বলতে পারে না। কারণ তার বাবা একজন অপরাধী। দেবব্রত ঠান্ডা কন্ঠে বললো,
– আমাকে ঋণের বোঝা থেকে মুক্তি দিবি?
– কিভাবে?

অবাক নয়নে প্রশ্ন ছুড়ে দেয় কৃষ্ণা। দেবব্রত দেরী না করে উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে বললো,
– লেখাপড়া করতে হবে। অনেক বড় হতে হবে। এই ভট্টাচার্য পরিবারের যোগ্য বউ হয়ে উঠতে হবে। আমি যাতে গর্বের সাথে বলতে পারি তুই আমার বউ, আমার অর্ধাঙ্গিনী। পারবি না?
– পারবো, তবে আপনি আমাকে সাহায্য করবেন তো?
– হ্যা করবো। যেদিন তুই আমার যোগ্য হয়ে উঠবি সেদিন আমার আবারও অগ্নিকে সাক্ষী করে তোকে বিয়ে করবো। সম্মানের সাথে তোকে সিঁদুর পড়িয়ে দিবো। কথা দিলাম

দেবব্রতের কন্ঠ দৃঢ়। সে ঋণের বোঝা থেকে মুক্তি চায়। সে শ্যামলী দেবী এবং সোমনাথ বাবুর সব ঋণ পরিশোধ করতে চায়। কৃষ্ণাকে তার যোগ্য স্থানে পৌঁছে দিয়ে। কে বলেছে ভালোবাসাই সব সম্পর্কের ভিত্তি। কিছু কিছু সম্পর্ক ভালোবাসা ব্যাতিত ও গড়ে উঠে। সেই সম্পর্কগুলো ভালোবাসার সম্পর্কের চেয়েও মজবুত হয়। হয়তো এমনই একটি সম্পর্ক কৃষ্ণা এবং দেবব্রতের। একবার ভেবেছিলো কৃষ্ণাকে তার বাবার পরিচয়টা দিয়ে দিবে। পরে তার মাথায় অন্য একটি ভাবনা আসলো। যেকারণে চুপ মেরে গেলো সে।

সৌদামিনীর ঘরে তার এবং দেবব্রতের ভালো বান্ধবী সারা বসে রয়েছে। সারা এক নজরে সৌদামিনীকে দেখে যাচ্ছে। সৌদামিনী তার কাগজপত্র গুছাচ্ছে। বাহিরে পড়াশোনা করার জন্য যাবে বলে ভাবছে সে। এই দেশে দেবব্রতের টান ছাড়া আর কিছুই খুজে পাচ্ছে না। শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। মুক্তি চায় এই যন্ত্রণা থেকে। বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়ায় আত্নীয়রা কথা শুনাতেও থামছে না। কেউ কেউ তো তাকে দূর্ভাগাও বলে হা হুতাশ করছে। এসব একেবারেই সহ্য হচ্ছে না সৌদামিনীর। এর থেকে বাহিরে চলে যাওয়াটাই ভালো হবে। সারার খুব বিরক্ত লাগছে। সৌদামিনী এভাবে নিজের অধিকার ছেড়ে দিচ্ছে বলে। তাদের ফ্রেন্ড সার্কেলের সবাই জানে দেবব্রত কতোটা ভালোবাসে সৌদামিনীকে, আর সৌদামিনী ও দেবব্রততে মত্ত। তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে উঠলো সে,
– পালিয়ে গেলে কি আদৌ বেঁচে যাবি সৌদামিনী?
– কি বলছিস তুই?

কাগজ গুলো হাতেই রেখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি প্রয়োগ করে সারার দিকে সৌদামিনী। সারাও দমে যায় না। ঠান্ডা গলায় বলে,
– দেবব্রত কোথা থেকে একটা মেয়েকে বিয়ে করে আনলো আর তুই ও সেই শোকে বনবাসে যাচ্ছিস। আমি যাস্ট মেনেই নিতে পারছি না। দেবব্রত আর তুই ছোটবেলা থেকে একে অপরকে ভালোবাসিস। কোন এক মেয়েকে বিয়ে করলো বলে সেই ভালোবাসাকে দান করে দিবি তুই?
– তোদের ধর্মের মিতো আমাদের ধর্মে যে চারখানা বিয়ে করা যায় না

বিদ্রুপের স্বরেই সৌদামিনী কথাটা বললো। সারাও দ্বিগুণ তেজ দেখিয়ে বললো,
– তোকে দ্বিতীয় বিয়ে তো করতে বলি নি। বলেছি নিজের অধিকার কেড়ে নিতে। ভালোবাসাকে এতো সহজেই অন্যের হাতে তুলে দিবি। তোর কি কষ্ট হচ্ছে না? বিদেশে গেলেই কি ভুলে যাবি দেবব্রতকে?
– হয়তো না। হয়ত কেনো বলছি। দেবব্রত যে আমার রক্তে মিশে আছে নেশার মতো। পারবো না তাকে ভুলতে কিন্তু একটা সতেরো বছরের বাচ্চার সাথে দেবকে নিয়ে লড়বো?
– যে জিনিসটা তোর তা নিয়ে তো লড়াই এর প্রশ্নই আছে না। দানবীর হাজী মোহাম্মদ মহসিন না সেজে নিজের ভালোবাসাকে অন্যের হবার আগেই নিজের করে নে। পালিয়ে গেলে দেবব্রত নামের সিঁদুরটার সাথে পুরো দেবব্রত টাই ওর হয়ে যাবে।

সৌদামিনী সারার কথাগুলো মন দিয়ে শুনে। কথাগুলো তাকে ও ভাবাচ্ছে। কাগজগুলো রেখে সারার পাশে বসে সে। অধীর কন্ঠে বলে,
– কি করবো আমি?

সারা এবার প্রশান্তির হাসি হাসে। তারপর বলে,
………..

চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি