কৃষ্ণাবতী পর্ব-১২+১৩

0
1870

#কৃষ্ণাবতী
#১২ম_পর্ব

দুজনের খুনশুটির যেনো অন্ত নেই। তখন দেবব্রতের রুমের দরজা ঠেলে অন্না দেবের রুমে আসে। অন্নাকে এভাবে আসতে দেখে সৌদামিনী একটু হতচকিত হয়। অন্নাকে ভেতরে আসতে দেখে দেবব্রত কড়া কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
– কি রে টিচারের রুমে ঢুকতে কি পারমিশন লাগে না?
– লাগে তো কিন্তু আমার জানা মতে তোমার ক্লাস শেষ হয়ে গেছে। আর এখন চারটা বাজে। সুতরাং এখন তোমার বাসায় যাবার সময়। তাই এখন তো তুমি আমার টিচার নও

অন্নার যুক্তি শুনে দেবব্রত হেসে দেয়। ঠোঁটে হাসি টেনে বলে,
– তুই বাড়ি যাস নি কেনো? আর কৃষ্ণা কোথায়?
– এখানেই তো ছিলো

বলে পাশে তাকায় অন্না। কিন্তু কৃষ্ণা পাশে নেই৷ বরং দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে। প্রথমে অন্নার সাথেই ঢুকতে চেয়েছিলো। কিন্তু সৌদামিনীকে বসা দেখে আর ভেতরে ঢুকে নি সে। দেবব্রত আর সৌদামিনীকে একসাথে দেখতে ভালো লাগে না কৃষ্ণার। শুধু মনে হয় সোমা মাসির কথাগুলো মনে পড়ে। তার মাষ্টারমশাই দিদিমনিকে পছন্দ করে। দিদিমনির সাথে তার বিয়েও ঠিক ছিলো। ব্যাপারগুলো মনে পড়তেই মনটা কালো আধারে ঢেকে যায় তার। দরজার বাহিরেই দাঁড়িয়ে ছিলো সে, অন্না তখন হাত টেনে ভেতরে নিয়ে আসে তাকে। ভেতরে ঢুকেও মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিলো কৃষ্ণা। কৃষ্ণাকে দেখে অনেকটাই বিরক্ত হয় সৌদামিনী। ভালোই তো দেবব্রত এবং সে একাকিত্ব সময় কাটাচ্ছিলো। কিন্তু এর মাঝে কৃষ্ণা এসে পড়লো। অন্না একটি মেকী রাগের স্বরে বললো,
– এটা কিন্তু ঠিক নয় দাদাভাই, ভেবেছিলাম প্রাকটিক্যাল শেষে তোমাকে নিয়ে বাইরে কোথাও খাবো। দুপুরের তাড়ার জন্য খাওয়াটাও হয় নি আমার আর কৃষ্ণার। আর তুমি এখানে সুন্দর ইলিশ দিয়ে ভাত খাচ্ছো।
– সেকি তোরা খাস নি?
– নাহ, সময় হয় নি। এখন কি তুমি যাবি নাকি তোমার খাওয়া শেষ?

দেবব্রত কিছু বলার আগেই সৌদামিনী বলে উঠে,
– তুমিও আমাদের সাথে বসে পরো না অন্না।
– ইচ্ছে তো ছিলো সৌদামিনী দিদি কিন্তু দেখছোই তো কৃষ্ণাও আমার সাথে আছে। আর ওর একাদশী। ও মাছ খাবে না।
– কলেজে কৃষ্ণাকে নিয়ে এলে যে আজ?
– ও তোমাকে দাদাভাই হয়তো বলে নি, কৃষ্ণাকে এই কলেজেই ভর্তি করা হয়েছে। ও আমার সাথেই পড়াশোনা করছে। দাদাভাই এবার বল কি করবি? থাকবে নাকি আমাদের নিয়ে যাবে?

অন্নার কথাটা শুনে সৌদামিনীর মনটা খারাপ হয়ে যায়। কৃষ্ণার দিকে সূক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সে। কৃষ্ণা তখন ও মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কি অদ্ভুত না! কোনো কথা না বলেও, কোনো প্রতিবাদ না করেও মেয়েটি ধীরে ধীরে সব কিছু নিজের আয়ত্তে নিয়ে আসছে। এই সময়টা তো তার আর দেবব্রতের একান্ত ছিলো। কিন্তু এখানেও তার ছায়া পড়েই গেলো। সারার কথা শুনে যে খেলায় সে মত্ত হয়েছে তাতে এখনই নিজেকে পরাজিত মনে হচ্ছে সৌদামিনীর।
– তোকে না বলেছি ও তোর বৌদি হয়। নাম ধরে ডাকবি না।

হঠাৎ দেবব্রতের হুংকার শুনে অবাক হয়ে সৌদামিনী তার দিকে তাকায়। অন্নাকে সে কৃষ্ণাকে বৌদি বলার জন্য বকছে, দেবব্রত তার স্ত্রীর সকল অধিকার কৃষ্ণাকে কি দিয়ে দিলো তবে! তখন জিহ্বা কেটে অন্না বলে,
– সরি, আসলে ক্লাসে তো আর ওকে বৌদি বলা যাচ্ছিলো না তাই ফ্লো ফ্লো তে বেরিয়ে গেছে। বলো না যাবে কিনা? বৌদি সকালে না খেয়ে বেরিয়েছে।

কথাটা শোনামাত্র দেবব্রত কৃষ্ণার দিকে তাকালো। মাথা নিচু করে মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে। বাসায় আজ সকালে লুচি আর মাংস রান্না হয়েছে। তাই হয়তো খায় নি। তৎক্ষনাৎ প্লেটটা রেখে দিলো দেবব্রত। হাতটা ধুয়ে বললো,
– সরি রে দামিনী। আজ আর খেতে পারছি না। অন্য আরেকদিন না হয় খাবো। এর চেয়ে তুই ও বরং আমাদের সাথেই চল। ওখানেই খেয়ে নিবি।
– না তোরা যা, আমাকে বাসায় নামিয়ে দিবি।

বলেই সব গুছিয়ে নিলো সৌদামিনী। খানিকক্ষণ আগের উজ্জ্বল মুখটি নিমিষেই কালো হয়ে উঠলো। আবারো ক্ষত বিক্ষত হচ্ছে তার হৃদয়। কান্না পাচ্ছে, গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে। তার দেব সত্যি ই তার আর নেই। সে তার কাছে ক্রোশ দূর চলে গেছে। শুধু কৃষ্ণা ক্ষুধার কথা শুনতেই দেব প্লেটটা দেখে দিলো, একটাবার ভাবলো না সৌদামিনী ও তো না খাওয়া। সকাল সকাল উঠে তার জন্য রান্না করে এনেছে। শুধু তার পছন্দ বলে। পাত্তাই দিলো না দেব তার কষ্টের। তবে কি এখন দেবের ভাবনার বিচরণ কৃষ্ণাতেই হয়! দেবকে পাবার কোনো আশাই অবশিষ্ট রইলো না তার! কষ্ট গুলো গলায় আটকে আসছে সৌদামিনীর। এখানে দাঁড়ালে হয়তো অশ্রু বিসর্জন দিয়ে দিবে। তাড়াতাড়ি সব গুছিয়ে নিলো সে। বিকেল হয়ে গেছে তাই দেব ই তাকে বাসায় পৌছে দিবে বলে তাকে আটকালো। নয়তো তখন ই বের হয়ে যেতে ইচ্ছে হচ্ছিলো। যখন সিড়ি দিয়ে নামছিলো তারা, তখন দেব আর অন্না সামনে ছিলো আর কৃষ্ণা আর দামিনী পেছনে। দামিনীর মনে হতে লাগলো,
” আচ্ছা যদি এখান থেকে কাউকে ধাক্কা মারা হয় তবে কি সে ব্যালেন্স হারিয়ে পড়ে যাবে! কতটুকু পড়বে! ব্যাথা কি পাবে নাকি মরে যাবে! মরে গেলে তো পথের কাঁটাই সরে যাবে”

কৃষ্ণা এক সিড়ি এগিয়ে গেলেই দামিনীর ইচ্ছে হলো একটা ধাক্কা মারাই যাক। হাতটা এগিয়েও গিয়েছিলো। পরমূহুর্তে হাত গুটিয়ে নিলো সে। কতটা বিষাক্ত হয়ে উঠেছে তার মন! একটা বাচ্চা মেয়েকে মেরে ফেলার মতো নোংরা পরিকল্পনা করতেও দুবার ভাবে নি সে। মনে মনে বলতে লাগলো,
” হায় ঈশ্বর, আমাকে পথ দেখাও। এই নোংরা চিন্তা যাতে আমার মনে না আসে কখনো ”

কৃষ্ণাকে কাটিয়ে দ্রুত নিচে নেমে এলো সৌদামিনী। নিজেকে হিন্ন মানসিকতার মানুষ মনে হচ্ছে। না পাওয়ার আক্ষেপ তাকে কতটা নিচ মন-মানসিকতার অধিকারী করে তুলেছে ভাবতেও খারাপ লাগছে তার। এটাই হয়তো বাস্তবতা, সৌদামিনীর মনে অন্ধকার এখনো প্রবেশ করে নি তাই হয়তো সে নিজেকে সামলে নিয়েছে। অন্য কেউ হলে হতো নিজেকে নাও সামলাতো______

৯.
মুখে পেন্সিল ঠেকিয়ে বসে রয়েছে অর্জুন। তার সামনে একটি ফাকা ক্যানভাস। তাতে দুটো চোখ আঁকানো। এক মনে চোখ জোড়ার দিকে তাকিয়ে রয়েছে সে। পাশে রাখা ল্যাপটপে গাণ চলছে,

দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার গানের ও পারে–
আমার সুরগুলি পায় চরণ, আমি পাই নে তোমারে ॥
বাতাস বহে মরি মরি, আর বেঁধে রেখো না তরী–
এসো এসো পার হয়ে মোর হৃদয়মাঝারে ॥
তোমার সাথে গানের খেলা দূরের খেলা যে,
বেদনাতে বাঁশি বাজায় সকল বেলা যে।
কবে নিয়ে আমার বাঁশি বাজাবে গো আপনি আসি
আনন্দময় নীরব রাতের নিবিড় আঁধারে ॥

অর্জুনের ভাবনার গহীনে চোখজোড়া যেনো জেকে বসেছে। বিরবির করে বললো,
” কৃষ্ণাবতী সাহা – অর্জুন মিত্র, কৃষ্ণা-অর্জুন
নামের সাথে মিলেছে নাম
আত্নার মিলনের অপেক্ষা”

চোখ বন্ধ করলেই কৃষ্ণার টানাচোখ জোড়া চোখের সামনে ভাসছে তার। অর্জুনের বুঝতে বাকি রইলো না বেশ ঘোর অসুখে পড়েছে সে। তার অসুখকে খাটি বাংলায় বলা হয় “প্রেমের আঠা”। এর ঔষধ একটাই তা হলো “কৃষ্ণাবতী সাহা”। ভাবতেই ঠোঁটের কোনায় স্নিগ্ধ হাসি ফুটে উঠলো তার।

কৃষ্ণার জিহ্বার হুট করেই কামড় পড়লো। লোকে বলে,
“কেউ যদি কারোর নাম বেশি করে মনে করে তখনই জিবে কামড় পড়ে”____ কিন্তু কৃষ্ণার কথা কে মনে করছে! মামা? শিপ্রা? তা হবে না হয়তো কারণ আজই মামা ফোন করেছিলো দাঁদানের কাছে। মামি? সম্ভব ই না। তবে কি! ভেবেই বইয়ের থেকে মাথাটা তুলে দেবব্রতের দিকে তাকায় সে। দেবব্রত একনজরে পেপারে চোখ দিয়ে বসে আছে। চোখ না সরিয়েই গম্ভীর কন্ঠে বললো,
– আমার মুখে কি এলকোহল বানানোর প্রণালী লেখা আছে?

সাথে সাথেই চোখ সরিয়ে নিলো কৃষ্ণা। এই খচ্চর মাষ্টারমশাই কখনোই তাকে মনে করছে না। উফফ লোকটা এমন কেনো! মামাকে দেখতো মামীর জন্য কি সুন্দর বেলীফুলের মালা নিয়ে আসতে। কৃষ্ণার ধারণা বরেরা বুঝি বেলীফুলের মালা পড়িয়ে দেয় বউ দের৷ কিন্তু তার ক্ষেত্রে একেবারেই উলটো। তার বর তাকে রসায়ন পড়াচ্ছে। কৃষ্ণা মুখ ফুলিয়ে রসায়নের বিক্রিয়া কষতে লাগলো। তাও এই উছিলাতে দেবব্রতের রুমে তো প্রবেশের অনুমতি পেয়েছে। হঠাৎ কারোর চিৎকার শুনতে পায় তারা। দেবব্রত দৌড়ে গিয়ে দেখে……..

চলবে

#কৃষ্ণাবতী
#১৩ম_পর্ব

কৃষ্ণা মুখ ফুলিয়ে রসায়নের বিক্রিয়া কষতে লাগলো। তাও এই উছিলাতে দেবব্রতের রুমে তো প্রবেশের অনুমতি পেয়েছে। হঠাৎ কারোর চিৎকার শুনতে পায় তারা। দেবব্রত দৌড়ে গিয়ে দেখে তার মা অবন্তীকা দেবী সিড়িতে পা পিছলে পড়ে গিয়েছেন। ছাঁদ থেকে নামবার সময় এই ঘটনা ঘটেছে। পা এবং মাজায় অসম্ভব ব্যাথা পেয়েছেন তিনি। ব্যাথায় কাতর হয়ে আর্তনাদ করতে লাগলেন অবন্তীকা দেবী। কৃষ্ণা দৌড়ে গিয়ে তাকে ধরতে গেলে তিনি এর মাঝেই বলেন,
– এই মেয়ে তুমি আমায় ছুবে না।

তার বারণ শুনে দু কদম পিছিয়ে যায় কৃষ্ণা। কৃষ্ণার মুখখানা বেশ মলিন হয়ে যায়। দেবব্রত তাকে চোখের ইশারায় আশ্বস্ত করে সব ঠিক হয়ে যাবে। রীতা দেবী, অন্না এবং দেবব্রত অবন্তীকা দেবীকে তুলে নিজ রুমে নিয়ে যায়। নারায়ন বাবু দুদিন ঢাকার বাহিরে গিয়েছেন কিছু ব্যবসা জনিত কাজে। অবন্তীকা দেবীর ব্যাথায় নাজেহাল অবস্থা। কৃষ্ণার বেশ অস্থির লাগছে। যতই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করুক অবন্তীকা দেবী তাকে কিন্তু সে তাকে মায়ের জায়গাটাই দিয়েছে। বাগানের আকন্দ গাছ থেকে গোটা দশেক পাতা ছিড়ে তা দিয়ে গরম ছেক দেয় সে অবন্তীকা দেবীর পায়ে। প্রথমে বেশ কবার মানা করেন অবন্তীকা দেবী। তখন কৃষ্ণা একটু কড়া কন্ঠেই বলে,
– আপনার তো আমার সাথে সমস্যা মা, নিজের সাথে তো নয়। তাহলে কেনো আমার উপরে রাগ দেখিয়ে ব্যাথাটা বাড়াচ্ছেন। একটু শান্ত থাকুন, দেখবেন ব্যাথা কমে যাবে।
– বাবু, এই মেয়েটাকে কিছু বল। আমার তো মনে হয় আমাকে পুরোই পঙ্গু বানিয়ে দিবে। তোরা ডাক্তার বাবুকে ফোন দে না।

অবন্তীকা দেবীর কথা শুনে দেবব্রত ঠান্ডা কন্ঠে বললো,
– মা, আমি ডাক্তার কাকুকে ফোন দিয়েছি। কৃষ্ণাতো ভুল কিছু করছে না। তুমি একটু শান্ত হও না।
– কিভাবে শান্ত হবো। মেয়েটা কি পাতা দিয়ে ছেক দিচ্ছে। আরো ব্যাথা করছে।
– একটু সময় দাও। ঠিক হয়ে যাবে। প্লিজ, আমার জন্য একটু শান্ত হও।

দেবব্রতের কথার সাথে পেরে উঠলেন না অবন্তীকা দেবী। চোখ মুখ খিচে কৃষ্ণার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে রইলেন। মিনিট বিশেক পর যখন ব্যাথাটা একটু প্রশমিত হতে লাগলো তখন তার দৃষ্টির তীক্ষ্ণতা কমতে লাগলো৷
– মা, এখন কেমন লাগছে? ব্যাথা কমেছে?
– ব্যাথা কি তোমার বান্ধবী নাকি! বললেই কমে যাবে। আর আমার একেবারেই ভালো লাগছে না কারণ তুমি আমার সামনে বসে রয়েছো। তোমাকে দেখলেই ব্যাথা আরো বেড়ে যাচ্ছে।
– আমার মুখটা কি ছাঁদের সিঁড়ির মতো? আপনি স্বীকার না করলেও আমি জানি আপনার ব্যাথা করছে না।
– বেশি জানো তো তুমি
– আমি বই তে পড়েছি, আকন্দ ফুলের পাতা দিকে সেক দিলে ব্যাথা কমে যায়। এখন বই কি কম জানে?

রীতিমতো অবন্তীকা দেবীর সাথে কথা কাটাকাটি চলছে কৃষ্ণার। দেবব্রত এই দৃশ্য থেকে হাসবে নাকি কাঁদবে বুঝে উঠতে পারছে না। যেমন বুনোওল তার মা ঠিক তেমনই বাঘা তেতুল তার বউ৷ একেবারে খাপে খাপ। রীতা দেবী ফিসফিস করে দেবব্রতের কানে বললেন,
– এতোদিন পর একেবারে যোগ্য হাতে দিদিভাই পড়েছে।
– ঠিক বলেছো কাকী মা।

ঘন্টা দুয়েক বাদে নারায়ন বাবুর বন্ধু অনিন্দ্যবাবু এসে অবন্তীকা দেবীকে পরীক্ষা করেন। পা পিছলে যাওয়ায় পা টা খানিকটা মচকে গিয়েছে। আর মাজায় ব্যাথা পেয়েছেন। তিনি কৃষ্ণার বেশ প্রশংসাও করেছেন। মেয়েটা তাড়াতাড়ি নিজের উপস্থিত বুদ্ধি কাজে লাগিয়েছে বলেই অবন্তীকা দেবীর ব্যাথা অনেকটাই প্রশমিত হয়েছে। ডাক্তার বাবু যাবার পর আরেকটি ঝামেলা উৎপন্ন হলো। রাতে অবন্তীকা দেবীকে একা তো রাখা যাবে না। তার হাটতে গেলে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। একজনকে তার সাথে থাকতেই হবে। এই উছিলাতে দেবব্রতও ঝোপ বুঝে কোপ মারলো। সে কৃষ্ণাকে অবন্তীকা দেবীর সাথে থাকার জন্য বললো। তখনই অবন্তীকা দেবী বাধ সাধলেন,
– না না বাবু, ও আমার সাথে থাকবে না।
– কেনো? আমি কি রাতে আপনার জায়গায় ঘুমোবো নাকি! বরং আমি থাকলে রাতে আপনার ভয় লাগবে না। ভূত তাড়ানোর মন্ত্র জানা আছে আমার।
– নিজের ঘরে ভূত তাড়াও গে যাও। আমি তোমার সাথে থাকবো না ব্যাস।
– আজিব তো..

দুজনের মধ্যে আবারো বিশ্বযুদ্ধের আশংকা দেখে দেবব্রত একটু গম্ভীর কন্ঠে বললো,
– কি সমস্যা তোমাদের? একটা রাত একসাথে থাকবে তাতেই ঝগড়া করে একাকার করে ফেলছো। মা, কৃষ্ণা নাহয় বাচ্চা। তুমিও কি বাচ্চা হয়ে গেলে নাকি! আর কৃষ্ণা তোকেও বলি, কোমড় বেধে ঝগড়া করে যাচ্ছিস কখন থেকে। আর যদি একটা টু শব্দ শুনেছি তো আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না বলে দিলাম।

দেবব্রতের ধমক যেনো ঔষধের মতো কাজ করলো। দুজনই একেবারে চুপ হয়ে গেলো। চুপ হলে কি হবে তাদের চোখের দৃষ্টির‍ যুদ্ধ যেনো তখন ও অবিরাম চলতে লাগলো।

রাত ৩টা,
হঠাৎ করেই ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো অবন্তীকা দেবীর। বাথরুমে যাওয়াটা খুব বেশি দরকার হয়ে পড়েছে। কৃষ্ণাকে এতো রাতে তুলবেন, ইচ্ছে করছে না। যদিও সে কৃষ্ণাকে দেখতে পারেন না। কিন্তু মেয়েটির মুখ দেখলে কেমন যেনো মায়া লাগে তার। মেয়েটির চেহারার মাঝে শ্যামলীর একটি ছাপ রয়েছে। যেকারণে রাগারাগি করলেও বেশি কিছু বলতে পারেন না। কি ভালো হতো যদি শ্যামলীর মেয়েটাকে দেবব্রতের বউ করে এ বাড়ি আনা যেত। অবশ্য তার স্বামী ব্যাপারটাকে কখনোই মেনে নিবেন না। কারণ তার বন্ধুর মেয়ে সৌদামিনীকে তার বেশি পছন্দ। অবশ্য সৌদামিনী মেয়েটাও খারাপ ছিলো না। নম্র ভদ্র একটা মেয়ে, উচ্চশিক্ষিত। কিন্তু কেনো যে তার শ্বশুরমশাই এই মেয়েটাকে তার ছেলের বউ করে আনলেন কে জানে। বয়সের তুলনায় বেশি পাকা। অবন্তীকা দেবী নিজেই কষ্ট করে উঠতে গেলেন। কৃষ্ণাকে ডাকবেন না তিনি, মেয়েটা সন্ধ্যা থেকে তার জন্য কম করে নি। শোয়ার সময় ও মাঝায় মালিশ করে দিচ্ছিলো। মেয়েটাকে আর কষ্ট দেওয়াটা অমানবিক হয়ে যাবে।
– কিছু লাগবে মা?

অবন্তীকা দেবী উঠেই পড়েছিলেন প্রায়। তখনই কৃষ্ণা বলে উঠলো কথাটা। মেয়েটা তার পায়ের কাছে শুয়ে আছে। অবন্তীকা দেবী অবাক হয়ে বললেন,
– তুমি ঘুমোও নি?
– যদি আপনার কিছু তাকে তাই ঘুমাতে যাই নি।
– কাল তো কলেজ আছে তোমার? পারবে না ঘুমিয়ে? কষ্ট হবে তো!

অবন্তীকা দেবীর কথায় কৃষ্ণা মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে,
– পারবো। আপনি আমাকে নিয়ে চিন্তা করবেন না।
– আমার বয়েই গেছে তোমাকে নিয়ে চিন্তা করতে। চলো আমাকে বাথারুমে যেতে সাহায্য করো। তুলো আমাকে।

কৃষ্ণা শুধু হাসলো। তার শ্বাশুড়ি মা মুখে স্বীকার না গেলেও মনে মনে ঠিক তার জন্য চিন্তা করছে। ব্যাপারটা ভাবতেই ভালো লাগছে কৃষ্ণার। সময় লাগবে কিন্তু একটা সময় ঠিক নিজের জায়গা করে নিতে পারবে সে। এখন শুধু অপেক্ষা মাষ্টারমশাই এর মনে নিজের জায়গা করে নেওয়া____

১০.
সকাল ৯টা,
বটতলায় গরম চা হাতে বসে রয়েছে অর্জুন। দৃষ্টি কলেজের গেটের দিকে। অপেক্ষা তার কৃষ্ণাবতীর। মেয়েটাকে দেখার জন্য বেহায়া মনটা আকুপাকু করছে। রোজ রোজ এই বটতলায় বসে তার কৃষ্ণার অপেক্ষা করতে বেশ লাগে। প্রতিদিন একনজর দেখেই আড়ালে চলে যায় সে। তখনই একটা জুনিয়র এসে বলে,
– অর্জুন দা এবারও গানের লিষ্টে তোমার নাম দিয়ে দিছি। এবারেও বার্ষিক অনুষ্ঠানে তোমাকেই গাণ গেতে হবে বলে দিচ্ছি।
– তোরা তো দেখছি আমার কাছে একটা বার শোনাও জরুরী মনে করিস না৷ আমার যদি সময় না হয়?
– না বললে তো চলবে না। তোমার বিপদ সংকেত ও নাম লিখিয়ে৷ তোমাদের ডুয়েটের ব্যাবস্থা করে দিয়েছি।

কথাটা শুনেই যেনো মনটা ভালো হয়ে গেলো অর্জুনের। তার কৃষ্ণাবতীর সাথে গাণ গাইতে পারবে সে। রিহার্সালের অজুহাতেও এক সাথে সময় কাটাতে পারবে। জুনিয়রগুলো আজকাল বেশ কাজের হয়ে গেছে। তখনই কলেজের গেট দিয়ে কৃষ্ণাবতীর আগমন ঘটলো। নীল রঙের একটি সালোয়ার কামিজ পড়া। ঢেউ খেলানো চুলগুলো খুলে দিয়েছে। অশান্ত বাতাসের সাথে সাথে চুলগুলো ও উড়ছে। আনমনেই উঠে দাঁড়ালো অর্জুন। হাটতে হাটতে ঠিক দাঁড়ালো কৃষ্ণার সামনে। হঠাৎ কেউ সামনে এসে পড়ায় কৃষ্ণাও হতচকিত হয়ে উঠলো। অবাক চোখে তাকাতেই দেখলো তার সামনে অর্জুন দাঁড়ালো। হলুদ একটা পাঞ্জাবী আর কালো একটি জিন্স তার পড়নে। কেউ দেখলে বলবে হুমায়ুন আহমেদের হিমু এবং রুপা চরিত্র যেনো গল্প থেকে উঠে এসেছে। টানা টানা চোখে অবাক দৃষ্টি প্রয়োগ করতেই অর্জুন মুচকি হাসি দিয়ে বললো,
– গাণ গাইতে পারো?
– হ্যা?
– বললাম গাণ গাইতে পারো? সোজা বাংলা ভাষা, এ ছাড়া হিন্দী অথবা ইংলিশেও বলতে পারি। বলবো?
– হ্যা পারি, কেনো বলুন তো?
– কারণ এন্যুয়াল ফেস্টে তোমার পার্টনার আমি। আমি বরাবর ই ভালো গাই। এখন তোমার সুর যদি আমার সুরে না মিলে তখন তো সমস্যা। আজ বিকেলে প্রাক্টিস। চলে এসো

বলেই হাটা দিতে নিলে কৃষ্ণা পিছন থেকে বলে উঠে,
– আমার কোচিং আছে বিকেলে। বিকেলে পারবো না যে
– বাইলোজি কোচিং তো চারটায় শেষ হয়। চারটার পর থেকে তো ফ্রি। আমি তোমাকে পিক আপ করে নিবো। পাঁচটার সময় আমিই বাসায় পৌছে দিবো তোমায়। বাসায় বলে দিও
– আপনি কি করে জানলেন আমার চারটায় বাইলোজি পড়া আছে?

কৃষ্ণার কথা শুনে ঠোঁটে একটা দুষ্টু হাসি একে চোখ টিপ্পনী দিয়ে বলে,
– সিক্রেট, বলা যাবে না। রেডি থেকো।

বলেই হাতের চাবির রিংটা ঘুরাতে ঘুরাতে চলে গেলো৷ কৃষ্ণা তখন অবাক চোখে অর্জুনের যাবার পথে তাকিয়ে থাকে। এই দৃশ্যটা একজনের চোখ এড়ালো না। সূক্ষ্ণ চোখে কৃষ্ণাবতীর দিকে সে তাকিয়ে থাকলো। মুখে একটা প্রশান্তির হাসি টেনে নিজ গন্তব্যে রওনা দিলো সে। কৃষ্ণা তখন ও ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলো। তখনই..…….

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি